১২
বেশ অনেকক্ষণ টান না দেওয়াতে প্রায় নিভে আসতে থাকা সিগারটাকে টেবিলের ওপরে রেখে দিল ফাত্তাহ। তারপর কফির কাপের শেষ কণাগুলো কাপ উলটো করে গলায় ঢেলে দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর ছোট বাচ্চারা দুধ বা হরলিক্স খাওয়ার পর যেভাবে মুখ মোছে অনেকটা সেভাবে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজের মুখ মুছল।
একটা ব্যাপার খেয়াল করল প্রফেসর, লোকটার প্রতিটা আচরণ কথাবার্তা আর নড়াচড়ার ভেতরে কেমন যেন অদ্ভুত এক ধরনের জান্তব ভাব আছে, যেন ভীষণ হিংস্র কোনো প্রাণী নড়াচড়া করছে। ব্যাপারটা কি শুধুই তার কল্পনা, নাকি মানুষটার বিকৃত চেহারার কারণে ঘটছে, নাকি আসলেই ব্যাপারটা এমন জান্তব, পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না প্রফেসর
হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে প্রফেসরের দিকে ফিরে তাকাল সে ভালো চোখটা দিয়ে। তারপর পুরনো সেই তাচ্ছিল্যের ভাবটা গলায় পরিষ্কার ফুটিয়ে তুলে বলে উঠল, “বলো প্রফেসর, এতই যখন তোমার গল্প করার শখ, শুনি কী গল্প করতে চাও তুমি। তবে আমার একটা শর্ত আছে,” বলে সে নিজের ভালো চোখের ধারালো দৃষ্টি স্থির করে রাখল প্রফেসরের মুখের ওপরে। “তুমি আমাকে যদি প্রশ্ন করো, তবে আমিও তোমাকে প্রশ্ন করব।”
“মানে আমি একটা প্রশ্ন করব, আপনি একটা প্রশ্ন করবেন, তাই তো?” প্রফেসরের দৃষ্টি টেবিলের ওপরে রাখা নিজের হাতের ওপরে স্থির। তারপর মুখটাকে একটু ওপরে তুলে সে বলে উঠল, “আমি রাজি। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। আপনি যে প্রশ্ন করবেন সেটার উত্তর দেওয়া না দেওয়ার ভার আমার ওপরে।”
প্রফেসরের শর্ত শুনে সামান্য হেসে উঠল ফাত্তাহ। “সাবধান প্রফেসর, এমন কোনো শর্ত দিও না যাতে পরে তুমি নিজেই ফেঁসে যাও। আমিও কিন্তু উত্তর নাও দিতে পারি।”
প্রফেসর নিজের মুখটাকে সামনের দিকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আমার হারানোর মতো কী আছে বলুন?”
জোরে হেসে উঠল ফাত্তাহ, নিজের ডান হাতের একটা আঙুল উঁচু করে বলে উঠল, “বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কথা বলার এই হলো আনন্দ। তোমার শর্তে আমি রাজি প্রফেসর। তুমি কি একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। তুমি মনে হয় বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে।
এবার প্রফেসর সামান্য হেসে উঠল, “হয়তো বা। ডেটা বলে আপনি আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। সময় খুব অদ্ভুত এক ব্যাপার, মি. অ্যালবার্ট।”
“হুমম, সময়ের চেয়ে বড় নিয়ামক যেমন হয় না, ঠিক তেমনি সময়ের চেয়ে বড় আঘাতকারীও আর হয় না। তোমার প্রশ্ন বলো প্রফেসর,” ফাত্তাহর গলায় তাচ্ছিল্যের জায়গায় সামান্য ঔদাসীন্য।
“আপনি ধরা পড়ার পর কোনো উকিল চাননি কেন? আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আপনি চাইলেই একজন উকিল পেতে পারতেন,” প্রফেসর খুবই স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল, যেন খোশগল্প করছে অনেকটা এমন সুরে। কিন্তু তার প্রশ্নের জবাবে খবুই উচ্চৈঃস্বরে আবারও হেসে উঠল ফাত্তাহ।
“প্রশ্নটা বোকার মতো হয়ে গেল না প্রফেসর,” বলে সে জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল। “শুরুতেই যদি এভাবে ভুলচুক প্রশ্ন করো তবে তো তুমি খেই হারিয়ে ফেলবে। একটা ব্যাপার তোমাকে বুঝতে হবে, মানুষ আইনের লোক নিয়োগ দেয় আইনের বিষয়ে। আমি তো আইনের আওতায় থেকে কিছু করতে চাইছি না। আমি যা করেছি সেটা যেমন বে-আইনি, আর আমি যা চাইছি সেটাও তেমনি বে-আইনি। কাজেই উকিল দিয়ে আমি করবটা কী? আর তার চেয়ে বড় কথা এমন কোনো গর্দভ উকিল নেই যে আমার চেয়ে আইন ভালো জানে, কিংবা আমার চেয়ে ভালো ডিফেন্স করতে পারবে। পেয়েছ তোমার উত্তর?”
প্রফেসর সামান্য মাথা নেড়ে বলে উঠল, “এবার আপনার পালা।”
“তুমি এখানে কী করছ?” ফাত্তাহ একবার ভুরু নাচিয়ে বলে উঠল। “তুমি এদের লোক নও, সেটা আমি নিশ্চিত। এদের ঘটে এত বুদ্ধি নেই। সেইসাথে আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি সরাসরি এই লাইনের লোকও নও। কারণ তুমি শুরু থেকেই একটার পর একটা নিয়মকানুন ভেঙে চলেছ। তাহলে তুমি এখানে করছ টা কী? আরেকজনের লড়াই তুমি কেন লড়ছ?” ফাত্তাহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রফেসরের ওপরে স্থির।”
“আমি এখানে কেন, সেটা তো আপনারই সবচেয়ে ভালো জানার কথা, কফি কালারের চশমার কাচের অন্যপাশ থেকে প্রফেসরের দৃষ্টি ফাত্তাহর ওপরে স্থির, সাথে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, তাতে খানিকটা চ্যালেঞ্জের ছোঁয়া।
“হুমম, তা তো বটেই,” ফাত্তাহ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল। “কিন্তু আমি সেটা জানতে চাইনি। আমি জানতে চেয়েছি তুমি এখানে থাকার পেছনের কারণটা। সামনের কারণটা আমি খুব ভালোই জানি এবং বুঝতে পারি। পেছনের কারণটা কী?”
প্রফেসর মাথা তুলে সামান্য ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, “আমাদের সবারই কোনো না কোনো দ্বায়বদ্ধতা থাকে। মনে করুন সেরকমই কোনো দ্বায়বদ্ধতার কারণেই আমি এখানে এসেছি।”
“অনেক গভীর উত্তর, প্রফেসর,” বলে ফাত্তাহ সামান্য হেসে উঠল। “এত গভীর উত্তর আশা করিনি আমি। এবার তোমার প্রশ্ন বলো।”
প্রফেসরের ইচ্ছে হলো আবারও পাইপটা ধরায় কিন্তু সেটাকে হাতে নিলেও ধরাল না সে বরং সেটাকে সামান্য নাড়াচাড়া দিয়ে সে জানতে চাইল, “আপনি এত ভালো বাংলা শিখলেন কোথায়?”
ফাত্তাহ প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছে, মুহূর্তের জন্য প্রফেসরের মনে হলো মানুষটার চোখ যেন জ্বলে উঠল। ফাত্তাহ যেন মনের গভীরে কিছু একটা নেড়ে চেড়ে ভাবছে সে জবাব দেবে কি দেবে না। তারপর সে মুখ খুলে খানিকটা চটুল গলায় বলে উঠল, “আমি মোট সাতটা ভাষা জানি। বাংলা জানাটা এমন আর কি কঠিন?” তার চোখের মণিতে সেই জ্বলন্ত ভাবটা যেন এখনও বিদ্যমান।
“আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না মি. অ্যালবার্ট,” প্রফেসর অত্যন্ত সিরিয়াস। নিজের প্রশ্নের জবাব তার চাই-ই চাই। “আপনি যেভাবে বাংলা বলছেন তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় এই ভাষাটা আপনি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসেবে শেখেননি বরং এটা আপনার প্রকৃতিগত ভাষা।”
“এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার কিছু নেই প্রফেসর,” ফাত্তাহ সিরিয়াস হতে হতে যেন গলাটাকে হালকা করে ফেলল। “লাহোরের যে এলাকায় আমি বেড়ে উঠেছি পুরো পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি বাঙালি সেই এলাকাতেই বাস করে। ছোটবেলা থেকে তাই আমি বাংলার ভেতরেই বড় হয়ে উঠেছি। আর একাত্তরের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হওয়া বেশিরভাগ বাংলা ভাষাভাষী পরিবার ওই এলাকাতেই থাকত, কাজেই উটের পাছায় গোদ রোগ যেভাবে অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়ায় চেপে বসে, বাংলা ভাষাটাও ঠিক তেমনি আমার ওপরে সেভাবে চেপে বসেছে,” এই পর্যন্ত বলে সে হালকা স্বরে হেসে উঠল। প্রফেসর খেয়াল করল তাচ্ছিল্যের সাথে শেষ কথাটা বলার পর লোকটার চোখের তারায় একটু আগে জ্বলতে থাকা আগুনটা যেন খানিকটা স্তিমিত হয়ে এলো।
প্রফেসর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাত্তাহর দিকে। “এবার আপনার পালা মি. ফাত্তাহ। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। “
ফাত্তাহ খানিকটা হালকাভাবে কাঁধ নেড়ে বলে উঠল, “তুমি বরং পরবর্তী প্রশ্ন করো। আমি প্রশ্ন করব না এবার।”
“আপনি মানুষ খুন করেছেন?” প্রফেসর টেবিল থেকে পাইপটা উঠিয়ে নিল। ওটাতে তামাক ভরে সযত্নে ধরিয়ে ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে।
অ্যালবার্ট ফাত্তাহর চোখের আগুন আবারও যেন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। “একটা না অসংখ্য মানুষ মেরেছি আমি। একসাথে একদল মানুষকেও নিজে হত্যা করেছি আমি,” পুরানো সেই জান্তব ভাবটা ফিরে ফিরে আসছে ফাত্তাহর ফ্যাসফ্যাসে গলার ভেতরে। একটু আগের সেই হালকা স্বরটা চলে গেছে। “পেয়েছ উত্তর, আর কিছু?”
“প্রথমবার,” প্রফেসর খুব সাবধানে উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে প্রতিটা শব্দ। “সবকিছুরই তো প্রথমবার বলে একটা ব্যাপার থাকে। আপনার প্রথমবার মানুষ হত্যার অভিজ্ঞতাটা জানতে চাই। আন্তর্জাতিক খুনি এবং জল্লাদ হিসেবে পরিচিত অ্যালবার্ট ফাত্তাহর প্রথমবার মানুষ মারার অভিজ্ঞতাটা আমি জানতে চাইছি।”
প্রফেসর ভেবেছিল অ্যালবার্ট ফাত্তাহ এমনিতেই রেগে আছে তার প্রশ্ন শুনে সে আরও রেগে উঠবে। হয়তো আবারও আগের মতো অগ্নিবর্ষণ শুরু করবে কিন্তু সে খুবই অবাক হয়ে খেয়াল করল, তার প্রশ্ন শুনে মানুষটার আগুনে চোখের তারা নরম হয়ে এলো। মানুষটা ইচ্ছে করেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল, নাকি এমনিতেই হয়ে এলো এটা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও সে দেখতে পেল মানুষটার চোখের আগুনের পরিবর্তে সেখানে খেলা করে গেল একঝাঁক সারল্য। ব্যাপারটা খুবই অবাক করল প্রফেসরকে। তবে তার অবাক হওয়ার পালা আরও বাকি ছিল।
প্রফেসর আরও কিছু বলার আগেই হেসে উঠল ফাত্তাহ। হাসতেই থাকল। “ওহো, প্রফেসর তুমি কি ভেবেছিলে আমি জন্ম থেকেই এমন খুনি! ওহো ডিয়ার! আর তুমি ভাবলে কী করে যে খুনের কথা বলতেই আমি একেবারে সত্য কথাটা বলে দেব?”
“মি. ফাত্তাহ, আমাকে কি আপনার বোকা মনে হয়? আমি মোটেই ভাবিনি যে আপনি জন্ম থেকেই খুনে। এই পৃথিবীতে কেউই খুনি হয়ে জন্মায় না। সময়-সমাজ আর পারিপার্শ্বিকতা তাকে তৈরি করে,” ফাত্তাহর কথা শুনে একটু রেগে গিয়েছিল প্রফেসর কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই সামলে নিল নিজেকে। “প্রতিটা মানুষের বাইরের আবরণের ভেতরে একটা না একটা গল্প থাকে যার প্রভাবেই সে মানুষটার বাইরের আবরণটা গড়ে ওঠে। যেকোনো মানুষকে জানতে হলে বুঝতে হলে তার আবরণের ভেতরের সেই গল্পগুলো জানাটা খুব জরুরি। আমি শুধু আপনার সেই ভেতরের গল্পগুলোই জানতে চাই।”
“আচ্ছা, কী হবে সেই গল্পগুলোকে জেনে, যেগুলো অনেক আগেই দাফন হয়ে গেছে,” বলে ফাত্তাহ মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠল। “ধরে নাও আমরা বাস্তবের কোনো মানুষ নই। আমরা কোনো সিনেমা কিংবা ধরে নাও আমরা কোনো গল্প কিংবা উপন্যাসের চরিত্র এবং এই মুহূর্তে আমরা একটা কাহিনির ভেতরে আছি। সেক্ষেত্রে তোমার কি মনে হয় না এভাবে তোমার স্রেফ কথোপকথন চালিয়ে যাওয়াটা পাঠককে বিরক্ত করত?”
ফাত্তাহর কথা শুনে প্রফেসর সামান্য হেসে উঠল। “বরং আপনি উলটো বললেন মি. ফাত্তাহ। যদি সত্যি সত্যি আপনি আর আমি কোনো উপন্যাসের চরিত্র হতাম তবে আমাদের বলা গল্পগুলোই বরং সবেচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো পাঠকের কাছে। কারণ সেই সৃষ্টির আদি থেকে গল্পই হলো মানব সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। গল্পই হলো সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে আমরা সময়কে, সমাজকে, ধর্মকে এমনকি স্রষ্টাকেও সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারি। আর এ কারণেই এমনকি ধর্মগ্রন্থগুলোতে প্রদত্ত শিক্ষাগুলো মানুষকে শেখানো হয় গল্পের মাধ্যমে। বড় বড় সব সাধক-দরবেশ-সুফি কিংবা সন্ন্যাসীদের জীবনের গল্প থেকেই আমরা সবচেয়ে বেশি শিখতে পারি। কাজেই এ আর ব্যতিক্রম কী হবে যে আপনাকে বোঝার জন্য আমি আপনার জীবনের গল্পগুলোই জানতে চাইব।”
এবার ফাত্তাহ সামান্য হেসে উঠল। “আমি হয়তো বলতে পারতাম কী হবে আমাকে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি জানি তুমি কেন আমাকে বুঝতে চাইছ,” সে তার ভালো চোখটা সামান্য উঁচু করল। তার মন্দ চোখটাতে কোনো নড়াচড়া নেই। মানুষের চোখ নাকি তার মনের দর্পণ— এই প্রবাদ বাক্যকে সঠিক প্রমাণ করে ফাত্তাহর মনের সমস্ত ভাব ফুটে ওঠে তার একমাত্র ভালো চোখটাতে। কিন্তু সেই চোখটাতে রয়েছে একের পর এক ধোঁকার প্রলেপ। তার চেয়ে বড় কথা সেই চোখটার ঠিক নিচেই গালের লম্বা সাদা কাটা দাগটা থাকার কারণে যখনই চোখটা নাড়ায় সে সাথে সাথে নড়ে ওঠে ওটা। চোখের এক্সপ্রেশন আর মুখের ভাবের সাথে সাথে বদল ঘটে কাটা দাগটার আকৃতির, যে কারণে লোকটা প্রতিটি অভিব্যক্তি খুবই প্রকট এবং উৎকটভাবে ধরা দেয় তার সামনে উপবিষ্ট মানুষটার কাছে। সেইসাথে আছে ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর। সবমিলিয়ে এই প্রকটতা ভীষণ অসুস্থ একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে অন্যের ওপরে।
ঠিক যে চাপটা প্রফেসর এই মুহূর্তে অনুভব করছে। না চাইতেই ফাত্তাহর মুখের অভিব্যক্তির সাথেসাথে একটা অস্বস্তির মেঘ দলা পাকিয়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে তার ভেতরে। এই কথোপকথনের যুদ্ধতে বারবার সে যা পরিকল্পনা করছে সেটাকে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এই মানসিক চাপ।
প্রফেসর অনুভব করল সে ফাত্তাহকে এই মুহূর্তে যা বলেছে সেটা আসলে মানুষটার মনে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করেছে সেটা সে মাপতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ মানুষটা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ করে কী যেন ভাবছে। অস্বস্তি কাটানোর জন্য প্রফেসর টেবিল থেকে তার পাইপটা তুলে নিয়ে ধরাতে লাগল। নিজের পাইপটা ধরিয়ে কাঠের বাক্সটা আবারও এগিয়ে দিল ফাত্তাহর দিকে। লোকটা কী করছে এমনকি সেটা দেখারও সাহস হচ্ছে না তার। এই লোকটা যদি এখন সরাসরি তাকে এড়িয়েও যায় কিছু করার থাকবে না।
প্রফেসর মুখ তুলে সোজা তাকাল ফাত্তাহর দিকে। লোকটা এক হাতে সিগার নিয়ে সেটাকে ধরাতে ব্যস্ত। এখনও তার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কী ভাবছে। চশমার ঘোলাটে কাঁচের ভেতর থেকে প্রফেসর সোজা তাকিয়ে রইল ফাত্তাহর দিকে।
ফাত্তাহ আস্তে-ধীরে সিগারটাকে ধরিয়ে টেবিলের মাঝ বরাবর হালকা নীলচে সুগন্ধি ধোঁয়া ছাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর সেটাকে সামান্য নাড়া দিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল। “আজ সন্ধ্যায় আমি যখন তোমাদের প্রশাসনকে আমার প্রস্তাবটা দিলাম আমি জানতাম সেটা তারা এত সহজে মেনে নিবে না। বোমাগুলোর অবস্থান বের করার জন্য আমার ওপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করা হবে।”
প্রফেসর ভালোভাবে খেয়াল করল বোমা শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ে মুখে একটা বিশেষ অভিব্যক্তি ফুটে উঠল লোকটার। কিন্তু অভিব্যক্তিটাকে আসলে আনন্দের-বেদনার-হতাশার নাকি সাফল্যের বলা চলে সেটা ধরতে পারল না সে।
“এবং বিশ্বাস করো প্রফেসর, আই জাস্ট ডোন্ট গিভ আ ফাক অ্যাবাউট দ্যাট,” ফাত্তাহ বলে চলেছে। “এরা কেউ আমার বালটাও বাঁকা করার ক্ষমতা রাখে না,” বলে সে একটা আঙুল তুলল। “এই অর্থে যে এদের কারো সেই ক্ষমতাও নেই আমার উদ্দেশ্যের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারবে। তবে এটা ঠিক যে আমি ভাবছিলাম আমাকে কী ধরনের চাপের মুখে পড়তে হতে পারে। কল্পনাতে অনেক কিছুই ছিল কিন্তু সবকিছুকে ভুল প্রমাণ করে তুমি প্রবেশ করলে রুমের ভেতরে,” তার গলায় সেই পুরানো তাচ্ছিল্য ফিরে এসেছে।
“তোমার ওই সুদর্শন চেহারা আর দামি কোট দেখে একটা ক্লাউন ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছিল না তোমাকে আমার। কিন্তু সেখান থেকে তুমি এই গল্প পর্যন্ত এসে থামলে,” বলে সে হেসে উঠল। “পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটা কাল ঘটতে চলেছে এই শহরে। নাইন-ইলেভেনের আগের দিনের পৃথিবী আর পরের দিনের পৃথিবীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। আজকের ঢাকা আর আগামীকালের ঢাকার ভেতরেও অনেক পার্থক্য থাকবে। আজকের বাংলাদেশ আর আগামীকালের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য থাকবে। নতুন আর পুরানো দুই সময়ের মাঝখানে আটকে আছি তুমি আর আমি দুজন মানুষ। আর আমাদের মাঝখানে এসে পড়েছে তোমার এই গল্প। ব্যাপারটা ভাবতেই কেন জানি হাস্যকর লাগছে আমার কাছে,” বলে সে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে লাগল।
প্রফেসর অনুভব করল এবার আর কাপড়ের নিচে নয় বরং কপালের ওপরেও মৃদু ঘাম দেখা দিয়েছে তার।
হাসতে হাসতেই ফাত্তাহ বলতে লাগল, “কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার এই ধরনটা খারাপ লাগেনি আমার কাছে। ঠিক আছে প্রফেসর, তুমি যদি গল্পই শুনতে চাও, আমি গল্পই বলব। দেখি কতটা শক্তি আছে তোমার মাঝে। দেখি তুমি আমার থেকে গল্প নিংড়ে সত্য বের করতে পারো কি না। বলো, কী গল্প শুনতে চাও?”
অনেকক্ষণ তীব্র জ্বর থাকার পর হঠাৎ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করলে তখন যেরকম অনুভূতি হয় অনেকটা সে ধরনের অনুভূতি হলো প্রফেসরের। না চাইতেও পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার ওপরে কপালটা মুছে নিয়ে অনেক কষ্টে একেবারে স্বাভাবিক গলায় সে বলে উঠল, “আপনার প্রথম খুনের গল্প, তবে- বলে সে আরও যোগ করল। “এরপর আরও কিছু শোনার থাকবে আমার। অনেক কথা আছে আজ আমাদের। তবে আগে এটাই শুনতে চাই আমি।”
ফাত্তাহ হাসতে হাসতেই হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেল। মুখ থেকে সিগারটা সরিয়ে বলে উঠল, “ঠিক আছে, তবে আমিও যা জানতে চাইব সেটার জবাব দিতে হবে।”
প্রফেসর সামান্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “যেকোনো প্রশ্নের শতভাগ সৎ উত্তর পাবেন। বিনিময়ে আমিও একই জিনিস আশা করব আপনার কাছ থেকে।”
সামান্য মাথা নেড়ে ফাত্তাহ বলতে শুরু করল নিজের গল্প।