১
দিনের এই সময়টা প্রফেসরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ এই সময়টা তার ধ্যান করার সময়। তবে দিন না বলে আসলে বলা উচিত রাতের এই সময়টা। কথাটা মনে আসতেই প্রফেসরের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ভাষা ব্যাপারটা সবসময় তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। মানুষ নিজেও জানে না তার জীবনে বেশিরভাগ জটিলতাই আবর্তিত হয় ভাষা আর সময়কে কেন্দ্র করে। আর যেহেতু সময়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর একমাত্র মাধ্যম হলো ভাষা এ কারণেই সময়ের বহুমাত্রিকতা প্রকাশ করার জন্য ভাষা ও তার আয়োজনের পসরা সাজিয়ে বসে। যেকোনো ভাষায় সময়ের সাথে সম্পর্কিত শব্দের ভান্ডার সবসময়ই সমৃদ্ধ হয়। যেমন— অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। আবার সময়ের পরিসরকে ছোট করে নিয়ে এলে দিন কিংবা রাত আরও ছোট করে বলতে গেলে মুহূর্ত…
সময় আর ভাষা নিয়ে মাথার ভেতরে গজিয়ে ওঠা ভাবনার এই জটিল সমীকরণের সুতোটা হঠাৎই কেটে গেল একটা উৎকট শব্দে। ঘরের বিশাল দখিনা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি চলে গেল প্রফেসরের।
রাতের আকাশ ভেদ করে সূক্ষ্ম একটা আলোর রেখা শূন্যের দিকে ধেয়ে চলেছে। বেশ অনেকটা ওপরে উঠে চারপাশে আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে তীব্র শব্দে ফেটে পড়ল আতশবাজিটা। ল্যাপটপের ডালা নামিয়ে নিজের পাইপে শেষ দু-টান দিয়ে ওটাকে রিডিং টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল প্রফেসর জাকারিয়া আহমেদ। কাছের মানুষ তো বটেই অ্যাকাডেমিক কিংবা নন- অ্যাকাডেমিক দুই জগতেই সে প্রফেসর জ্যাক নামে অধিক পরিচিত।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতে নিজের কাঁধ ডলল প্রফেসর, লম্বা সময় ধরে টানা ল্যাপটপে কাজ করার ফলে কাঁধটা ধরে গেছে। আবারও জানালা দিয়ে আসা আলোর ঝলকানি আর কটকটে শব্দে সেদিকে ফিরে তাকাল সে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, বুঝলাম থার্টি ফার্স্টের রাত, তাই বলে বারোটা বাজার দুই ঘণ্টা আগে থেকেই শুরু করে দিতে হবে! এত আনন্দ মানুষের মনে আসে কোথা থেকে?
অবশ্য সবাই যে তার মতো অসামাজিক ও রসকসহীন হবে এমনটা ঠিক নয়। তাহলে তো আর পৃথিবী চলবে না।
কাঁধ ডলতে ডলতে প্রফেসর বিরাট দখিনা জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। এই জানালা দিয়ে নিজের বিরাট বাড়িটার প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে থাকা প্রফেসরের জন্য এই জানালাটাই হলো সামাজিক জীবন আর নিজের মনস্তাত্ত্বিক জগতের মাঝে একমাত্র সেতুবন্ধন। বহুদিন হলো সামাজিকতা থেকে দূরে থাকা জাকারিয়া আহমেদের মাঝে পারিপার্শিক সমাজ নিয়ে যতটুকু আগ্রহ বিদ্যমান, সেটা মেটানোর একমাত্র মাধ্যম হলো এই জানালা।
এই জানালা দিয়ে দৃষ্টিগোচরে আসা ঢাকা শহরের ব্যস্ত জীবনের সামান্য আঁচ বেশ উপভোগ করে সে। যেমন এই মুহূর্তে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল মানুষজন স্থানীয় বাজারের কাছের মোড়ে কয়েক জায়গায় আগুন জ্বেলে শীত তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। কাছেই দুটো বড় বড় স্পিকার দেখা যাচ্ছে, নিশ্চই সেটাতে উচ্চ স্বরে বাজছে উৎকট কোনো গান। একদল ছেলে সেটাকে ঘিরে হল্লা করছে। প্রফেসর অনুমান করল এরা সম্ভবত আশেপাশের কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। শুধু ছেলেপেলেই নয় দুয়েকটা মেয়েকেও দেখতে পেল সে ভিড়ের ভেতরে। ব্যাপারটা দেখে কেন জানি ভালোই লাগল তার কাছে। রাতের এই সময়েও মেয়েরা বাইরে বের হওয়ার মতো নিরাপদ অনুভব করছে, ব্যাপারটা তাকে খানিকটা আনন্দ দিল। একটা সময় তো এরকম ভাবাই যেত না।
অবশ্য আজকের রাত ঢাকাবাসীর জন্য উদ্যাপনেরই রাত। এত বড় বড় একাধিক ঘটনা দেশবাসীর জীবনে খুব কমই ঘটেছে, তাও আবার নতুন বছরের একেবারে সায়াহ্নে। জটলার ভেতর থেকে আরও একটা আতশবাজি ছুটে গেল আকাশের দিকে। সেইসাথে হুল্লোড়ে ফেটে পড়ল দলটা।
দলীয় উন্মত্ততার ছোঁয়া সবসময়ই খুবই অদ্ভুত আর জটিল মনে হয় প্রফেসরের কাছে। বড় যেকোনো ভিড়ে মানুষের ভেতরে নাকি একটা কম সাইকোলজি কাজ করতে থাকে। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সবার মধ্যে তৈরি হয় এক মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ, আর সেটা দ্বারা একইসাথে অনেকটা একইভাবে পরিচালিত হতে থাকে ভিড়ের একটা বড় অংশ। ব্যাপারটা বিভিন্ন লেভেলে বিভিন্ন পন্থায় ঘটে থাকে। সিনেমা-থিয়েটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মিছিল, মাহফিল থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দান কোনোটাই এর বাইরে নয়। ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় ‘মব সাইকোলজি’ এটাকে কি ঠিক সেটাই বলা যায় কি না মনের ভেতরে সেই প্রশ্ন জেগে উঠল প্রফেসরের। কিন্তু সাথে সাথে আরেকটা টার্ম মনে পড়ে যাওয়াতে সেটাকে বাতিল করে দিল সে।
“ক্রাউড সায়েন্স’ নামে সাইকোলজির নতুন একটা শাখা এসেছে। প্রফেসর নিজে সাইলোজির জগতের মানুষ হলেও এই ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানে না। আজ থেকে কয়েক বছর আগে শুধু একটা বই পড়েছিল এই বিষয়ের ওপরে। ব্যাপারটা নিয়ে আরও বিশদভাবে জানতে হবে, মনের ভেতরে কথাটা নোট করে রাখল সে। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে রিডিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবল আবারও পাইপটা ধরিয়ে আরও কিছুক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের আনন্দ উদযাপন অবলোকন করুক। কিন্তু ঘড়ির দিকে দৃষ্টি পড়তেই মনের একটা অংশ তাকে সচেতন করে দিল, ইতোমধ্যেই খানিকটা দেরি হয়ে গেছে তার কাজের।
বড় করে একবার দম নিয়ে জানালার কাছ থেকে সরে এলো প্রফেসর। ল্যাপটপের পাশে রাখা মোবাইলটা বন্ধ করে পাইপটা একটা কাঠের বাক্সে রেখে পরিচ্ছদ পালটে এসে দাঁড়াল ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নাটার সামনে। ঢিলেঢালা শোয়ার পোশাক পরিহিত দীর্ঘদেহী একজন মানুষকে আয়নায় দেখতে পেল। নিজের কাছে মনে হলো, এই কয়েক মাসে অনেকটাই বুড়িয়ে গেছে সে। দিনের পর দিন টানা পরিশ্রম, সমাজ ও পরিবার থেকে দূরে কাটানো একাকী জীবন, সেই সাথে নিজের কাজের গভীর থেকে গভীরতম এবং জটিল থেকে জটিলতর পরিচ্ছেদে প্রতিনিয়ত পরিগমন বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে তার ভেতরে। নিজেকে যতটুক সে চেনে তাতে সে এটা জানে এগুলোর কোনোটাই আসলে সত্যি নয়। ভেতরের ব্যাপারটা আসলে অনেক গভীর। মানব মনের গহিন কোণের ব্যাপারগুলো সবসময় জটিলই হয়। সে নিজেও এর বাইরে নয়।
ভাবলেই ভাবনার প্রবাহে আরও পরিগমন করতে হবে। তার চেয়ে চিরায়ত নিয়মে নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিয়ে একটানে সে খুলে ফেলল ড্রেসিং টেবিলের কাচের ডালাটা। ভেতরে থরে থরে প্রয়োজনীয় সব জিনিস সাজানো। স্বচ্ছ কাচের একটা ছোট বোতলে থাকা হালকা সবুজাভ এক ধরনের তেল দিয়ে নিজের চুলে সামান্য বুলিয়ে নিয়ে ঘন ধূসর চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে নিল সে। বিশেষ তেলের হালকা মিষ্টি গন্ধ তার নাসারন্ধে প্রবেশ করতেই যেন সামান্য শিহরন খেলে গেল প্রফেসরের শরীরে। বিশেষ এই তেলটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে নেপালের থামেল থেকে আনিয়েছে। ওরা আবার এই বিশেষ জিনিসটা আনিয়েছে হিমালয়ের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। গভীর মনঃসংযোগের জন্য বিশেষ এক ধরনের পাহাড়ি তিলের বীজ থেকে বানানো এই তেলের জুড়ি নেই।
প্রাত্যহিক মেডিটেশনের সময়ে সাধারণত এই বিশেষ তেলটা সবসময় সে ব্যবহার করে না। কিন্তু আজকের রাতটা তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর এই রাতের জন্য জিনিসটা অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে তার কাছে। তেলটা সে শুধু চুলেই লাগাল না। বরং খানিকটা তেল সে আঙুলের ডগায় নিয়ে দুই ভুরুর মাঝখানে থার্ড আই পয়েন্টেও লাগিয়ে নিল। বিশেষ যে ধরনের মেডিটেশনে সে অভ্যস্ত তাতে থাড আই পয়েন্ট নামে পরিচিত ওই জায়গাটার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। মূল কাজে নামার আগে ওই পয়েন্টটা একটু স্টিমুলেট করতে হবে তাকে।
তেলের বোতলটা জায়গামতো রেখে সে এক হাতে তুলে নিল একটা সুগন্ধি মোমবাতি, অন্য হাতে নিল গোল বাটির মতো বিশেষ একটা জিনিস। জিনিস দুটো সে ল্যাপটপ টেবিলের ওপরে রেখে চলে এলো ঘরের দরজার কাছে। সেখানে দরজার ঠিক পাশেই অনেকটা সুইচ বোর্ডের মতো দেখতে একটা বিশেষ বোর্ড লাগানো। সেই বোর্ডে নির্দিষ্ট একটা সুইচ চাপতেই রুমের প্রতিটি দরজা-জানালা অটেমেটিক সিস্টেমে লক হয়ে গেল। এখন এই রুম থেকে কোনো শব্দ বাইরে যাবে না কিংবা বাইরের কোনো শব্দও ভেতরে আসতে পারবে না। আরেকটা সুইচ চাপতেই প্রতিটি জানালা মোটা পর্দা দিয়ে ঢেকে গেল। রুমটাকে লক করে সাউন্ড ও লাইটপ্রুফ করে সে চলে এলো টেবিলের কাছে। ঘরের ভেতরে আগে থেকে একটা হালকা ডিম লাইট জ্বলছিল, এবার সে মোমবাতিটাকে জ্বালিয়ে অন্য হাতে সেই গোল বাটির মতো দেখতে জিনিসটা নিয়ে চলে এলো ঘরের মাঝামাঝি। মোমবাতিটাকে সামনে রেখে বসে পড়ল পদ্মাসনে।
গোল বাটির মতো জিনিসটা সে বাম হাতের তালুতে রেখে ডান হাতে ওটার ভেতরে থাকা মোটা কাঠির মতো জিনিসটা খুব সাবধানে বাটির ওপরের কিনারার চারপাশে বুলাতে শুরু করল। প্রথমে শুধুই খসখসে শব্দ ছাড়া আর কিছু হলো না, কিন্তু দক্ষ হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে একটু পরেই খুব সূক্ষ্ম মিষ্টি একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ঘর জুড়ে।
শব্দটা নিজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে বহুবার অভ্যাসে অভ্যস্ত প্রফেসরের চোখ দুটো আপনাতেই বন্ধ হয়ে এলো। তিব্বতিরা আলাদা নামে ডাকলেও ইংরেজিতে এই গোল বাটির মতো জিনিসটাকে বলা হয় সিংগিং বোল। বহু প্রাচীন যুগ থেকে তিব্বতি সাধুরা এই জিনিসটা ব্যবহার করে আসছে ধ্যানের সময়ে নিজেদের মনঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য। দীর্ঘদিন ধরেই মেডিটেশনে প্রাথমিক মনঃসংযোগকে শক্তিশালী করার জন্য এই জিনিসটা ব্যবহার করে আসছে প্রফেসর। কাজেই আজকের রাতে এই জিনিসটা তো অপরিহার্যই।
গত কয়েক বছর ধরে যে কাজটা করার চেষ্টা করে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে চলেছে সে, সেই ব্যাপারটাকে একটা পরিণতি দেওয়ার ভিন্ন একটা পথ আবিষ্কার করে সে আজ থেকে ছয় মাস আগে। গত ছয় মাসের চেষ্টার পর এখন সেটাও যখন ব্যর্থ হতে চলেছে কাজেই একমাত্র নিজের মস্তিষ্কের জোরই ভরসা। আর সে কারণেই আবারও পুরানো অবস্থানে ফিরে যাওয়ার এই প্রচেষ্টা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে বিশেষ মেডিটেশনটা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রফেসর সেটাকে ঠিক কী নামে অভিহিত করা যায় সে সম্ভবত নিজেও জানে না। কারণ ব্যাপারটা বহু বছর ধরে বিশেষ একটা কারণে অভ্যাস করে চললেও এটাকে সে নিজে বিশেষ কোনো নাম দেয়নি। মেডিটেশনটার একটা অংশ বহু প্রাচীন বিদ্যা জেন মেডিটেশনেরই একটা নতুন ধরন। প্রফেসর সেটাকে চর্চার মাধ্যমে নিয়ে গেছে পুরোপুরি ভিন্ন এক মাত্রায়। যে কারণে এই মুহূর্তে যেটা সে চর্চা করে সেটাকে আর পুরোপুরি জেন মেডিটেশন বলা চলে না, বরং এটাকে জেন মেডিটেশনের এক ধরনের ফিউশন বলা যেতে পারে। তবে এর শুরুটা অনেকটাই জেন মেডিটেশনের মতোই।
সিংগিং বোলের আওয়াজ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হওয়ার সাথে সাথে প্রফেসর অনুভব করতে থাকল তার দুচোখের মাঝের থার্ড আই পয়েন্টে যে বৃত্তটা সে কল্পনা করছে সেটার পরিধি ও গভীরতা দুটোই সমান তালে বেড়ে চলেছে। বহু চর্চার অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত প্রফেসর জানে একসময় এই বৃত্তটা তার সমগ্র অস্তিত্ব থেকে শুরু করে তার পুরো মনস্তত্ত্বটাকেই দখল করে নেবে। আর এর পরেই শুরু হবে নতুন খেলা। যে খেলার মাধ্যমে নিজের সাইকির একাধিক লেভেল পার হয়ে সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে গভীর থেকে গভীরতম প্রদেশে। তারপর একটা সময় তার শারীরিক ও মানসিক অস্তিত্বের যাকে বলা হয় ইন আর ইয়ান তাদের এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটবে। আর সেখান থেকেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে কিছু পরম সত্য, তার উদ্ভূত সমস্যার জাগতিক সমাধান…
ব্যাপারটা স্রেফ শুরু হতে যাবে এমন সময় আচমকাই খুব যান্ত্রিক একটা পিপপিপ শব্দে ঘন হয়ে আসতে থাকা মনঃসংযোগটা কেটে গেল প্রফেসরের।