০৩. শব্দক্রীড়া এবং অদ্ভুত প্রশ্ন
হরিচরণ গাঙ্গুলির বাসা একটা আঁকাবাঁকা গলির শেষপ্রান্তে। পিছনে একটা খাটাল এবং বস্তি এলাকা। বাড়িটা দোতলা। পাশে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরে কচুরিপানা ভর্তি। বিকেলেই মশার প্রচণ্ড উৎপাত।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও এদিকটায় পোমোটারদের নজর পড়েনি। দোতলা বাড়িটার আশেপাশে অনেক একতলা বাড়ি। কোনওটা পুরনো, কোনওটা নতুন। এ বাড়িটা পুরনো। একতলায় একটা প্রেস, মুদির দোকান, পাউs বিস্কুটের দোকান কয়লার ডিপো এইসব।
টাইপিস্ট ভদ্রলোক নিচেই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে শশব্যস্তে অভ্যর্থনা করে দোতলায় নিয়ে গেলেন। ঘরে সাধারণ আসবাব। টেবিলে একটা পোর্টবল টাইপরাইটার কভারে ঢাকা। অনেক কাগজপত্রও লক্ষ্য করলাম। বোঝা গেল, বাড়িতেও টাইপের কাজকর্ম করেন।
হরিবাবু বন্ধ জানালা দেখিয়ে বললেন, বড় মশা। তাই জানালা বন্ধ করে রাখি। এখনই কী উৎপাত দেখুন! এমন সাংঘাতিক মশা স্যার, বিষাক্ত ওষুধ স্প্রে করেও কাজ হয় না।
তিনি ঘরে আলো জ্বেলে দিলেন। কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। বললেন, শ্যামবাবুর কোনও ফোটো নেই আপনার কাছে?
দেয়ালে কয়েকটা বাঁধানো ফোটো ঝুলছিল। হরিবাবু বললেন, না স্যার। ওগুলো আমার ফ্যামিলির ছবি। তবে ওই ছবিটা বরমডিহির মুনলেকের ধারে শচীনবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে তোলা আমার ছবি।
কর্নেল সেই ছবিটার কাছে গেলেন। দেখতে দেখতে বললেন, ভোলা নেই এর মধ্যে?
ওই লোকটা ভোলা স্যার!
রোগা বেঁটে এবং ফো একটা লোক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কাঁচুমাচু হাসি। পরনে হাতকাটা ফতুয়া এবং খাটো ধুতি। পুরাতন ভৃত্যমার্কা চেহারা। আমরা ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় যে ভোলাকে দেখেছিলাম, সে শক্তসমর্থ গড়নের। সে এই ছবির ভোলা নয়। আর অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের তাগড়াই চেহারা। চেহারায় আভিজাত্য ঠিকরে বেরুচ্ছে, যদিও ছবিটা পুরনো। হরিবাবু তার পেছনে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রায় আট বছর আগে ভোলা গ্রুপ ফোটো। তবু হরিবাবুকে চেনা যাচ্ছে।
মোট চারটে ছবি। ঝুল জমে আছে। আর একটা ছবি রাধাকৃষ্ণের। কর্নেল সেটার কাছে গেলে হরিবাবু বললেন, শচীনবাবুদের গৃহদেবতার ফোটো স্যার! ওঁদের ভবানীপুরের বাড়ির ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত। শচীনবাবুর ইচ্ছে ছিল, শেষজীবনে বরমডিহিতে গিয়ে কাটাবেন। এই বিগ্রহ সেখানে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সঙ্গে মামলা বেধে গেল।
রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের ছবির নীচের দেওয়ালে সিঁদুরের ছোপ এবং কালো দাগ দেখে বোঝা গেল হরিবাবু ভক্তিমান। তিনি নিশ্চয় কোর্টে যাওয়ার আগে ধূপধুনো জ্বেলে প্রণাম করে তবে বেরোন। কালো দাগগুলো ধূপকাঠিরই হবে।
কর্নেল বললেন, শ্যামবাবু এসে শুতেন কোথায়?
মেঝেয় বিছানা করে দিতাম। মশারি কিনতে হয়েছিল ওর জন্য। যা মশা।
আপনি আপনার তক্তাপোশের তলা খুঁজেছেন?
তন্নতন্ন খুঁজেছি। আপনিও খুঁজে দেখুন। বলে হরিবাবু টর্চ বের করলেন।
থাক। বলে কর্নেল আবার বিগ্রহের ছবির কাছে গেলেন। ছবিটা আন্দাজ ৬ ফুট বাই ৪ ফুট সাইজের ফ্রেমে বাঁধানো। বললেন, এই ছবিটা নামাবেন একটু?
কে-কেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন। আপনি ব্রাহ্মণ। এতে পাপ হবে না। ছবিটা নামান।
হরিবাবু ছবিটা সাবধানে দেওয়ালের পেরেক থেকে দুহাতে খুললেন। অমনই কালোরঙের ছোট্ট এবং পাতলা একটা নোটবই–ঠকাস করে পড়ে গেল নিচে।
কর্নেল সেটা দ্রুত কুড়িয়ে নিলেন। হবিবাবু চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ। এ কী!
আপনি সব ছবির ঝুল ঝাড়বেন বা পরিষ্কার করবেন, কিন্তু এটাতে হাত দেবেন না জেনেই শ্যামবাবু নোটবইটা এর আড়ালে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।
হরিবাবু ছবিটা কপালে ঠেকিয়ে যথাস্থানে লটকে দিলেন। ধপাস করে বিছানায় বসে বললেন, শ্যামার কাণ্ড! ওঃ! আগে যদি জানতাম নোটবইটা ওখানেই আছে? তাছাড়া এইটুকু সাইজের নোটবই! আর আমি গঙ্গার ঘাটে বড় সাইজের কালো ডায়রি বই নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এখন বুঝতে পারছি, বদমাইস লোকটা দূর থেকে দেখেই টের পেত–ওঃ।
উনি কপালে মৃদু থাপ্পড় মারলেন অনুশোচনায়। তারপর কেঁদেই ফেললেন। আমারই বুদ্ধির দোষে শ্যামার প্রাণটা বেঘারে গেছে। হায়! হায়! কেন আমি ওখানে খুঁজিনি?
কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি কীভাবে জানবেন একটা পবিত্র ছবির পেছনে এটা লুকোনো আছে? যাই হোক, আজ আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি, আমার দেখা দরকার, এর মধ্যে কী আছে যে কোনও সাংঘাতিক লোকের এটা এতই দরকার এবং বেচারা শ্যামাবাবুকে এর জন্যই প্রাণ হারাতে হল? আপনি কাল সকালে কোর্টে যাওয়ার পথে এটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। তারপর বলব, কী করা দরকার।
হরিবাবু চোখমুছে বললেন, কিন্তু স্যার! বদমাসটার শাস্তি হবে না? ওকে আপনি ছেড়ে দেবেন?
আপনিই বলেছেন, নোটবই যাকে দেবেন, তাকে ধরে ফেললে আপনি পরে বিপদে পড়তে পারেন। আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে।
না, না। ধরবেন না সঙ্গে সঙ্গে। তাকে ফলো করবেন। হরিবাবু চাপা গলায় বললেন, তাছাড়া এ-একটা রীতিমতো রহস্য স্যার। এই রহস্যের কিনারা করা কি উচিত নয়? মহীবাবু বলছিলেন, আপনি বিখ্যাত রহস্যভেদী।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। রহস্য আমাকে টানে। তবে সেটা পরের কথা। আপনাকে বাঁচিয়েই রহস্য ফাঁস করা উচিত কি না?
আজ্ঞে! ঠিক বলেছেন স্যার! আমি ছাপোষা মানুষ। দেশের বাড়িতে একদঙ্গল পুষ্যি।…
হরিবাবু চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন। কর্নেল মশার উৎপাতের অজুহাত দেখিয়ে চলে এলেন। তবে এ-ও সত্যি, বিকেল যত ফুরিয়ে আসছিল, মশার অত্যাচারও তত বাড়ছিল। শীতে মশার উপদ্রব এমনিতেই বেড়ে যায়। তো এ একটা এঁদো জায়গা।
ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কফি করতে বলে নোটবইটা নিয়ে বসলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, শ্যামবাবুর ওয়ার্ডগেম খেলার অভ্যাস ছিল দেখছি। হুঁ, ক্রসওয়ার্ড পাজল। এ একটা বিচিত্র নেশা, জয়ন্ত! তবে এতে ভাষার শব্দজ্ঞান বাড়ে। বাহ! ভদ্রলোক রীতিমতো ইংরেজিতে পাকা ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজি পত্রিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজ পাঠাতেন। অ্যাঁ? এটা তো ভারি অদ্ভুত!
কৌতূহলী হয়ে বললাম, দেখি! দেখি!
কর্নেল খুদে নোটবইটার একটা পাতা দেখালেন। তাতে একটা চৌকো ছকে এঁকে ইংরেজি অক্ষর লেখা।
G R A B
R A R E
A R T S
B E S T
বললাম, অসাধারণ! লম্বালম্বি বা পাশাপাশি পড়লেও চারটে একই শব্দ। গ্র্যাব, রেয়ার, আর্ট, বেস্ট। বলেই চমকে উঠলাম। কর্নেল! কিন্তু এই ইংরেজি শব্দগুলোর মানেতে কী যেন সংকেত আছে?
কী সংকেত?
উত্তেজিতভাবে বললাম, গ্রাব মানে–জোর করে দখল বা আত্মসাৎ করা। রেয়ার মানে–দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। আর্টস–শিল্পকলা। সচরাচর চিত্রকলাই বোঝায়। বেস্ট সর্বোত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট। তাহলে মোটামুটি মানে কী দাঁড়াচ্ছে দেখুন দুর্লভ এবং সর্বোৎকৃষ্ট চিত্রকলাগুলো আত্মসাৎ করো! তাই না?
ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, কফি খাও ডার্লিং! নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে। আরও কিছু মানে বেরুতে পারে।
কফি খেতে খেতে নোটবইটার আরও পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্রসওয়ার্ড পাজল ছাড়া আর কিছু নেই। আবার ওই পাতাটায় মন দিলাম। বললাম নাহ। এটা নিশ্চয় কোনও প্রাচীন দুর্লভ ছবি হারানোর কেস। এর মধ্যে কোনও সংকেত অবশ্যই আছে। কিন্তু যে এই নোটবইটা হাতাতে চায়, সম্ভবত সে-ই তার মর্মোদ্ধার করতে পারে। বলে একটুখানি চিন্তাভাবনা করে নিলাম। আচ্ছা। কর্নেল! ইংরেজি হরফগুলো যদি সংখ্যার ভিত্তিতে সাজাই
ডার্লিং! তুমি ওয়ার্ডগেমের পাল্লায় পড়েছ। আজকাল বিদেশে কুইজ খুব চালু। সেই কুইজ!
ওঁর কথা গ্রাহ্য না করে আঙুল গুনে হিসেব করতে থাকলাম। বললাম, একটা কাগজ দিন। দেখি কী দাঁড়াচ্ছে।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাড বের করে দিলেন। আমি হিসেব করে একটা ছক সাজিয়ে ফেললাম ইংরেজি বর্ণমালার সংখ্যার ভিত্তিতে। এ-কে ১ ধরে ছকটা সাজালাম।
৭ ১৮ ১ ২
১৮ ১ ১৮ ৫
১ ১৮ ২০ ৫
২ ৫ ১৯ ২০
কর্নেলকে কাগজটা দেখিয়ে বললাম, লম্বালম্বি ধরলে ২৮, ৪২, ৫৮ এবং ৩২ পাচ্ছি। পাশাপাশি ধরলে ২৮, ৪২, ৪৪ এবং ৪৬ পাচ্ছি। এবার দেখুন ২৮+৪২+৫৮+৩২=১৬০দাঁড়াচ্ছে। আবার ২৮+৪২+৪৪+৪৬=১৬০ দাঁড়াচ্ছে। কর্নেল! লম্বালম্বি এবং পাশাপাশি যোগ দিলে দুদিকেই যোগফল ১৬০। এটা নিশ্চয় কোনও সংকেত!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে শুধু বললেন, বাহ্!
আরও উৎসাহী হয়ে বললাম, এবার ইংরেজি অক্ষরগুলো দেখা যাক। এই ABEGRST ৭টা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ফোনটা ধরো, জয়ন্ত!
টেলিফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ কড়া ধমক দিল, এই ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু!
নোটবইটা কেন নিয়ে এসেছিস? হরিকে ফেরত না দিলে টাক ফুটো করে দেব। ব্যাটা ঘুঘু হয়েছ। ফাঁদ দেখনি?
তারপর লাইন কেটে গেল। টেলিফোন রেখে বললাম, হুমকি দিল কেউ।
কী হুমকি?
কথাগুলো বললাম। আমার হাত কাঁপছিল। কর্নেলকে পুলিশ মহলে আড়ালে ঠাট্টা করে বুড়ো ঘুঘু বলে। লোকটা দেখছি কর্নেলকে বিলক্ষণ চেনে এবং হরিবাবুকে ফলো করে এসেও থাকবে। আমাদের গতিবিধির দিকেও নজর রেখেছে। শীতের মধ্যে গায়ে ঘাম ঝরা গরম টের পাচ্ছিলাম।
কর্নেল হাসলেন। হুঁ। রহস্য ঘনীভূত বলা চলে। তবে তোমাকে ওয়ার্ডগেমের ভূতে পেয়েছে জয়ন্ত! সাবধান!
বললাম, ১৬০ নাম্বারটা কি কোনও সংকেত বলে মনে হচ্ছে না আপনার?
কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, । তারপর কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। একটা নাম্বার ডায়াল করে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ মুখার্জিকে দিন না প্লিজ! মিঃ মুখার্জি? হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে।…না। ফোনে বলা যাবে না। মুখোমুখি…ঠিক আছে। কাল সকালে ৯টায় যাচ্ছি। …ধন্যবাদ রাখছি।
কান খাড়া করে শুনছিলাম। বললাম, মিঃ মুখার্জি মানে কি সেই রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেট শচীনবাবু?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তুমি ইচ্ছে করলে সঙ্গী হতে পারো। না কি উড়োফোনের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেছ?
বললাম আপনার সঙ্গে থাকলে যমরাজকেও ভয় পাই না!
কিন্তু তোমার মুখে অস্বস্তির ছাপ!
নাহ্। ও কিছু নয়।
তবে ডার্লিং! ওয়ার্ডগেমের ভূত তোমাকে একটা অঙ্ক উপহার দিয়েছে। সত্যি ওয়ার্ডগেমের ভূত আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাড়ি ফিরে অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই ছকটা নিয়ে অনেক জল্পনা এবং আঁক কষাকষি চলেছিল। শেষে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে-রাত্রে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। খুনখারাপি, ভূতপ্রেত, আবার কখনও পরীক্ষার হলে বসে অঙ্কের পরীক্ষা দিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই অঙ্ক কষতে পারছি না, এইসব দুঃস্বপ্ন।
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে শুনলাম, কিছুক্ষণ আগেই হরিবাবু সেই কালো নোটবইটা নিয়ে গেছেন। কর্নেল আমার অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ভবানীপুরে অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবীর বাড়ি রওনা হলাম।
বাড়িটা কলকাতার আর সব বনেদি অভিজাত বংশীয়দের বাড়ির মতো বিরাট। মস্ত গেট এবং সুদৃশ্য লন। চারদিকে উঁচু দেওয়াল ঘেরা আছে। মধ্যিখানে দোতলা পুরনো আমলের বিলিতি স্থাপত্য। বড় বড় থাম। ফুলবাগানে মর্মরমূর্তি।
একটা লোক আমাদের বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলে গেল। কর্নেল বললেন, শচীনবাবুর চেম্বার ছিল ওপাশের একটা আলাদা বাড়িতে। সেটা এখন নার্সিংহোম। এক ডাক্তারকে ভাড়া দিয়েছেন। শচীনবাবুর ছেলে নেই। এক মেয়ে। সে স্বামীর কাছে আমেরিকায় থাকে।
ভেতরকার দরজার পর্দা তুলে নাদুসনুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক বেরুলেন। তার হাতে একটা ছড়ি। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি।
শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখে বললেন, খবরের কাগজের লোক সঙ্গে এনেছেন কেন কর্নেল সায়েব? পাবলিসিটি ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি না।
কর্নেল হাসলেন। না না। ও আমার তরুণ বন্ধু। সময় পেলেই আমার সঙ্গী হয়।
যাক গে। বলুন কী ব্যাপার! বলে আইনজীবী বসলেন। মনে হল বাতের অসুখে ভুগছেন। একটা পা ছড়িয়ে দিলেন। গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কোট। মাথায় মাফলার জড়ানো এবং পরনে পাজামা। পায়ে মোজা ও পামসু।
কর্নেল বললেন, হরিচরণ গাঙ্গুলি নামে কেউ একসময় আপনার ক্লার্ক ছিলেন?
হরি? আইনজীবী নিস্পলক চোখে তাকালেন। হরির আবার কী হল? শুনেছি, সে তো এখন আলিপুর কোর্ট চত্বরে বসে টাইপ করে। ভালই কামায়।
মিঃ মুখার্জি! উনি আপনার ক্লার্ক ছিলেন কি না জানতে চাইছি।
ছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছেন?
ওঁকে কি আপনি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন, নাকি উনি নিজে থেকেই কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন?
শচীনবাবু একটু গুম হয়ে থাকার পর বললেন, ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলেও ওকে রাখতাম। অন্য কাজ অনেক ছিল। করাতাম! কিন্তু আমার ঠাকুরঘর থেকে বিগ্রহ চুরি গেল। যাকে-যাকে সন্দেহ হয়েছিল, হরি তাদের একজন।
কী বিগ্রহ?
রাধা-কৃষ্ণ। বলে শচীনবাবু কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকালেন। গাঢ় স্বরে ফের বললেন, বংশের প্রাচীন বিগ্রহ। আমরা পুরুষানুক্রমে বৈষ্ণব। পাঁচশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহ স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের হাত থেকে আমার পূর্বপুরুষ আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন।
কোনও রত্ন ছিল বিগ্রহে?
ছিল। বাজারদরের কথা যদি ধরেন, তবে তার দাম তত কিছু নয়। কিন্তু যদি ইতিহাস এবং আর্টের প্রশ্ন তোলেন, বলব–ওই বিগ্রহ দুর্লভ।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, রেয়ার আর্ট?
শচীনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রেয়ার আর্ট কী বলছেন? রেয়ারেস্ট আর্ট!
বেস্ট!
অ্যাঁ? শচীনবাবু রুষ্ট মুখে আমার দিকে তাকালেন।
কর্নেল দ্রুত বললেন, আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আপনারা ব্রাহ্মণ। তো আপনি ৪ নিজেই পুজো করতেন, নাকি পুজোর জন্য সেবায়েত ঠাকুর রেখেছিলেন?
শচীনবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি মশাই কোর্টকাছারি করতাম। ওকালতি পেশা। মিথ্যাকে সত্য, আবার সত্যকে মিথ্যা করা ছিল আমার কারবার। আমি স্পষ্ট কথা পছন্দ করি। নিজে পুজোর মতো পবিত্র কর্ম করতে সংকোচ হত তাই ঠাকুর রেখেছিলাম। বংশের আরাধ্য বিগ্রহের সেবা-যত্ন, তারপর দোল বা রাসপূর্ণিমা ইত্যাদির বাৎসরিক সব অনুষ্ঠান ঠাকুরমশাই-ই সামলাতেন। আমার অত সময়ই বা কোথায়?
বিগ্রহ কীভাবে চুরি গিয়েছিল?
ঠাকুরঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল। ভোরে গঙ্গাস্নান করতে যাওয়ার সময় ঠাকুরমশাই দেখেন দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে বিগ্রহ নেই। পুলিশ এল। বাড়ির লোকজন বলতে আমি, আমার স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে, এবং কর্মচারী ঝি-চাকর-দারোয়ান এরা। পুলিশ জেরা করে চলে গেল। সন্দেহ করার মতো কাউকে পায়নি। সেই রাত্রে ঠাকুরমশাই মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছিলেন। শচীনবাবু ভিজে কণ্ঠস্বরে বললেন, একটু পাগলাটে সাধকটাইপ লোক ছিলেন। তো হরি যদিও রাত্রে পাইকপাড়ায় নিজের বাসায় থাকত, আমার কেন যেন তার ওপরেও সন্দেহ হয়েছিল। এত বছর পরে আর মনে নেই কেন ওকে সন্দেহ করেছিলাম।
আপনি ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরকে চিনতেন?
নামটা চেনা ঠেকছে। শ্যামসুন্দর–বলে শচীনবাবু কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, হরি মাঝে মাঝে তার এক আত্মীয়কে এনে চাকরির জন্য সুপারিশ করত মনে পড়ছে। সে-ই কি?
আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর এ বাড়িতে গতিবিধি কি অবাধ ছিল?
তা ছিল। আমার কর্মচারীদের আমি নিজের ফ্যামিলির লোক মনে করতাম। এখনও করি। এখন অবশ্য আর অত লোক নেই। দরকারও হয় না।
হরিবাবু তার সেই আত্মীয়কে নিয়ে এ বাড়ি আসতেন কি?
এসে থাকবে। মনে নেই।
কেন হরিবাবুকে সন্দেহ হয়েছিল, মনে পড়ছে না?
শচীনবাবু নড়ে বসলেন। ও! হ্যাঁ। আমার এক কর্মচারী আমার বৈমাত্রেয় ভাই তরুণের বাড়ি থেকে হরিকে বেরুতে দেখেছিল। বিগ্রহ চুরির কিছুদিন আগে। পুলিশ তরুণকে জেরা করেছিল। তরুণ বলেছিল, হরিহ্যাঁ, ওর সেই আত্মীয়ের চাকরির জন্য নাকি গিয়েছিল। তবে আজও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণই বিগ্রহ চুরি করিয়েছিল। ওর মতো বদমাইস আর দুটি নেই। দেশবিদেশে ব্যবসা করে। বিদেশে ওই বিগ্রহ বেচে বহু টাকা দাম পেয়েছে। জানেন? তরুণ দুনম্বরি ব্যবসা করে। নিষিদ্ধ মাদক। বুঝলেন? আমি ওকে এবার ধরিয়ে দেব। জেল খাঁটিয়ে ছাড়ব।
মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর নাকের বাঁ পাশে কি প্রকাণ্ড জডুল ছিল?
আইনজীবী হঠাৎ এই প্রশ্নে খাপ্পা হয়ে গেলেন। আপনি ও মাসে এসে আমার বরমডিহির বাড়ি সম্পর্কে একটা ভুতুড়ে গল্প ফেঁদে গেলেন। আজ এসে আবার হাজারটা প্রশ্ন।
প্লিজ মিঃ মুখার্জি–
শচীনবাবু মুখ বিকৃত করে বললেন, হরির নাকের পাশের জঙুল নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? হঠাৎ জডুলের কথা আসছে কোথা থেকে, বুঝি না।
তাহলে ছিল?
জডুলটা বিচ্ছিরি দেখাত বলে বলতাম, অপারেশন করে নিও। নিয়েছে কি কে জানে?
অপারেশন করে নিয়েছেন।
তা হঠাৎ জডুল নিয়ে পড়লেন কেন? হরিকে আপনি চিনলেন কী করে?
কর্নেল হাসলেন। আলিপুর কোর্টে আমার এক আত্মীয়ের একটা মামলা চলছে। সেই সূত্রে আলাপ হয়েছে হরিবাবুর সঙ্গে। টাইপিস্টের কাজ করেন। কথায় কথায় বলছিলেন, আপনার ক্লার্ক ছিলেন।
আমার নিন্দে করছিল নাকি?
না, না। খুব সুখ্যাতি করছিলেন।
আইনজীবীর মুখ দেখে মনে হল, কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, যাক গে। আপনার আসার আসল উদ্দেশ্য কী, এবার খুলে বলুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি। আপনি কর্নেল সায়েব বলেই এতক্ষণ কথা বলছি। একজন পরিচারক এতক্ষণে চায়ের ট্রে আনল। আইনজীবী খেঁকিয়ে উঠলেন, তোদের চৌদ্দ মাসে বছর! দুকাপ চা করতেই–নিন কর্নেল সায়েব! চা খান। কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝে আমার মেজাজ কেমন বিগড়ে যায় আজকাল। কীভাবে যে বেঁচে আছি! একে বাঁচা বলে?
ভদ্রলোকের কথাবার্তার ভঙ্গি দেখে আমারও মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কর্নেলের দেখাদেখি চায়ের কাপ হাতে নিতে হল। তাছাড়া বিগ্রহ চুরির ঘটনা সেই কালো নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমের সঙ্গে জড়িয়ে রহস্য সত্যিই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে এবার।
কর্নেল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার ঠাকুরঘর থেকে ঐতিহাসিক পবিত্র বিগ্রহ চুরি গিয়েছিল। পুলিশ তা আজ পর্যন্ত উদ্ধার করে দিতে পারেনি। আমার মনে হচ্ছে, বিগ্রহ এখনও বিদেশে পাচার হয়নি। কোথাও তা লুকানো আছে। যদি আপনি এই প্রশ্নটার উত্তর সঠিক দেন, তাহলে আমি হয়তো বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে পারব।
শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন কর্নেলের দিকে। আপনি তো নেচারিস্ট। আপনার কার্ডে লেখা আছে কথাটা। তা আপনি ভেতর-ভেতর গোয়েন্দগিরিও করেন বলে সন্দেহ হচ্ছে?
না মিঃ মুখার্জি। আমি মাঝে মাঝে কোনও রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে সেই রহস্য ফাঁস করতে উঠে পড়ে লাগি। আমার এ-ও একটা হবি বলতে পারেন।
বিগ্রহ চুরিতে রহস্য কোথায় মশাই? স্রেফ চুরি। ওই তরুণের কীর্তি!
আপনার বরমডিহির বাড়িতে যে ঘটনার কথা বলেছিলাম,আমার ধারণা তার সঙ্গে আপনার বিগ্রহ চুরির যোগসূত্র আছে।
অ্যাঁ! বলেন কী?
আপনি আমাকে এবার এই প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন!
বিগ্রহ কি আপনি বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকে ফাঁসানোর জন্য নিজেই চরি করে–
আইনজীবী ফ্যাঁসফেঁসে গলায় আর্তনাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, বেরিয়ে যান আপনারা! গেট আউট ফ্রম মাই হাউস! বেরিয়ে যান বলছি! নইলে দারোয়ান ডেকে বের করে দেব।
কর্নেল তুম্বো মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আমি যে ওঁকে অনুসরণ করলাম তা বলা নিষ্প্রয়োজন।…