শবের উপরে শামিয়ানা (রচনা ১৯৯৪-৯৬। প্রকাশ ১৯৯৭)
গ্রহণ
দুপুরের হলকা লেগে থেমে থাকে মুহূর্ত সময়
এ চোখ যা দেখেছিল
তা এর দেখার কথা নয়।
আহ্নিক আবর্তে ঘোরে মাথা আর বুকে পোড়ে পাখি
ঘর কিছু আছে বলে
সত্যি তুমি ভেবেছিলে না কি?
দাঁড়ানো মিথুনমূর্তি ধরেছে হরিৎ হলাহল
খোলা আকাশের নীচে
খসে আছে চিরায়ত ফল
দুদিন বিলাপ হবে তারপরে ভুলে যাবে সব
তবে কি খড়েরই কাছে
আমার এতটা পরাভব!
ঘুমিয়ে পড়েছে হাত, ফুরিয়ে গিয়েছে বীজ বোনা
এই গ্রহণের দিনে
ভাবি আর কিছু দেখব না।
*
আমার মেয়েরা
লিখে যাই জলের অক্ষরে
আমার মেয়েরা আজও অবশ ভিক্ষার হাতে পড়ে আছে সব ঘরে ঘরে।
*
থাকা
এর কোনো শেষ নেই, এ আবাদ, এই জলাজমি
এই রাত দুপ্রহরে ঢল, এই বানভাসি ভোর
উদোম কিশোর আর কিশোরীর মাথাগোঁজা পাকে
এই গেঁথে থাকা, এই করুণায় দুহাত বাড়ানো।
এর কোন শেষ নেই, তোমাদের এই আসা যাওয়া
গলিত হাতের মুঠো খড়কুটো ভরা আছে ভেবে
এই ভেসে ওঠা এই বেঁচে থাকা অশনেবসনে
ঝিম হয়ে বসে থাকা কাক আর কাকের আকাশ।
এর কোনো শেষ নেই পানের বরজে ঢেকে থাকা
গ্রামগুলি দুই পাশে পড়ে থাকা এই ভাঙা ডানা
ঠোঁটে লেগে থাকা রস, বুকের উপরে চলা চাকা,
চাকার উপরে শব, শবের উপরে শামিয়ানা–
এর কোনো শেষ নেই, মাথায় কুয়াশা মাখা ভোরে
দেশের ভিতরে বন্দী দেশও ঘুমায় অকাতরে।
*
অবলীন
যে দূর দূরের নয়, যে দূর কাছের থেকে দূর
যে আকাশ ভরে আছে আকাশের ভিতরে বিধুর
যে স্বর স্বরের চেয়ে শরীরের আরো কাছাকাছি
আমার ভিতরে আমি ক্ষীণ তার প্রান্ত ছুঁয়ে আছি।
যে তুমি তোমারও চেয়ে ছড়িয়ে রয়েছ অবিনাশ
যে তুমি পাথরে ফুল যে তুমি সজলে ভাসো শিলা
কালের আহত কাল তুলে নিয়ে যায় তার শাঁস
এতদিন সয়ে থেকে তার পরে ছিঁড়ে যায় ছিলা
ঘুমের ভিতরে ঘুমে পড়ে থাকে ডানাভাঙা হাঁস
পাটল প্রবাহে তবু অবিকল জাগে এক টিলা–
আমি সেই স্তবে ভরা নীরব পলের পাশাপাশি
কিছুই-না-এর প্রেমে অবলীন ধীর হয়ে আছি।
*
বিশ্বাস
আমার বিশ্বাস আছে আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।
আগুন কখনো তাই সততায় ডাকে না আমাকে।
যত দূরে যাই দেখি তোমার মুখর মুদ্রাগুলি
ঘরের শিয়রে, পথে, জাদুঘরে, জলের প্রবাহে।
তোমার হৃদয় কোনো অথর্বতা জেনেছে কি আজ?
নিঃস্বতায় মুছে গেছে হৃদয়ের কালাকাল সীমা?
জাগো, জেগে ওঠো, জাগো, অন্ধকার জাগরণে জাগো–
আমাদের পৃথিবীতে কখনো ফেরে না হিরোশিমা।
তোমার বিশ্বাস নেই তোমাকে বিশ্বাস করি আমি?
এই ঘূর্ণিচরাচরে আমার সমস্ত রাত্রি ঘিরে
মুনিয়ার ডানা সব ঝরে গেছে আণবী ছটায়–
তোমাকেই খুঁজি তবু শরীরের ভিতরে শরীরে।
*
মেঘ
মেঘ আমাদের জন্য এনেছে সহজবোধ্য বাড়ি।
আজ এই কালো ভোরে সেই দেশে চলে যেতে পারি
স্তূপের সমস্ত দিন ফেলে রেখে। কে কাকে ধরতে পারে আর।
এক বিদায়ের থেকে আরেক বিদায়ে পালাবার
মাঝখানে পড়ে আছে সরলরেখার জানুবৎ
পথ, আর তার শেষে দুশো বছরের বুড়ো বট
বলে, এত ভয় কেন, আয় এইখানে এসে বোস–
মেঘই আমার জন্য এনে দিল প্রথম সাহস।
*
পরিখা
‘কিছুই যা বোঝা যায় না তার সঙ্গে বোঝাপড়া ক’রে
আমার সুলগ্নে এসো। এর কোনো কণামাত্র কমে
আমাকে পাবে না তুমি। আমি এ ঘুমের প্রান্ত ছুঁয়ে
সেই কোন্ আদিমধ্য কাল থেকে পড়ে আছে একা–
এক লহমায় আজ সে কি এত মিথ্যে হতে পারে?
আমার হৃদয় আজও নভকণিকার আলো থেকে
তোমাকে সৌরভ দেয়- দিতে পারে- যদি তুমি জানো
আমার শরীরে এসে লগ্ন হতে একাকার জলে।
কিন্তু এই অবেলায় তোমার মুখের দিকে চেয়ে
আজ আমার মনে হয় তুমি ভুলে গেছ সেই টান
তোমার বুকের কাছে কোথাও এ আউশের ধান
রাখে না পীতাভ ছোঁয়া। তবে কি তর্পণ হাতে নিয়ে
নিজেরই দক্ষিণ দ্বারে হাঁটু মুড়ে বসে আছো শুধু?
আমি কেন আছি তবে? আমি তবে বেঁচে আছি কেন?’
–এই কথা বলেই সে আমার পাথরে চাপা ধ্যানও
ভেঙে দিয়ে চলে গেল পরিখার ওপারে ত্বরিতে–
আমার নিস্তার আমি তখনই পেরেছি তাকে দিতে।
*
ছেলেধরা বুড়ো
কলেজ স্ট্রিটের পাশে বসে আছে ছেলেধরা বুড়ো।
পুরোনো অভ্যাসবশে দুচোখ এখনও খুঁজে ফেরে
যেসব ধমনী ছিল এ-পথের সহজ তুলনা
ঈশান নৈর্ঋত বায়ু কখনো-বা অগ্নিকোণ থেকে
যেসব ধমনী ছুঁয়ে পৃথিবীও পেত উত্থান
রূপের ঝলক লেগে সে কি এত মিথ্যে হয়ে গেল?
উপমার মৃত্যু হলো এই নবদূর্বাদল দেশে?
বুড়ো তাই গান গায়, থেকে থেকে বলে ‘আয় আয়’
লোকেরা পাগল ভাবে লোকেরা মাতাল ভাবে তাকে
ঢিল ছুঁড়ে দেখে তার গায়ে কোনো সাড় আছে কি না
সে তবু গলায় আনে নাটুকে আবেগ, হাঁকে ‘এই
শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বীভৎসা পরে যেন—’
আর সেই মুহূর্তেই বৃষ্টি নেমে আসে তার স্বরে
চোখের কুয়াশা ঠেলে দেখে তার চারপাশে সব
যে যার দিনের মতো ঝাঁপ ফেলে চলে গেছে ঘরে
পুরোনো অভ্যাসে শুধু বুড়োর পাঁজরে লাগে টান–
যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা?
*
ঘাতক
মনে হয়েছিল গলিতে গলিতে তোমাদের দেখা পাব
মনে হয়েছিল সান্ধ্য গঙ্গা ভরে যাবে কিংখাবে
মনে হয়েছিল বাঁ পাশে দাঁড়ানো অশ্বত্থের টানে
একবার এসে পৌঁছলে কেউ ফিরবে না হীনভাবে—
হয়তো তো ভুল, হয়তো সেসবই বলেছি জ্বরের ঘোরে
ট্রাফিকের চাপে শবানুগমন থম্কে পথের মোড়ে।
কথা দিয়ে কথা মুখ ঢেকে রাখে, আর সেই সমারোহে
দিন আমাদের কিছুই বলে না, রাত্রিও খুব বোবা–
কপালের কাছে ছাই উড়ে এলে বিভূতিই ভাবি তাকে
চণ্ডাল এসে দাঁড়ায় কখনো, ফিরে যায় কখনো-বা,
ফুটপাথে শুধু ভিখিরিরা শোনে আকাশবাণীর রব
আমাদের কাঁধে লীন হয়ে আছে দহনোন্মুখ শব।
কে ওকে মেরেছে? সেকথার কোনো উত্তর নেই আজ
এ-মুখে ও-মুখে তাকিয়ে এখন চুপ করে থাকা শ্রেয়।
আমি কি জানি না আমিই যে সেই ঘাতক? অথবা তুমি
তুমি কি জানো না তুমিও যে সেই ঘাতক? অথবা সেও
সেও কি জানে না তারা সবাই যে ঘাতক? কিন্তু তার
চোখ আজও আছে পথ চেয়ে কোনো অবোধ বন্ধুতার।
ঘুমের ভিতরে মনে হয়েছিল নাম জানি আমি তার।
*
জলেভাসা খড়কুটো : প্রথম গুচ্ছ
১
ঢালু পাড় ভেঙে নেমে আসবার সময়ে
হারিকেন যেখানে জ্বলছিল
থেমে যায় ধর্ম
শিকড়বাকড়েরা নিশ্বাসে নিশ্বাসে কথা বলে ওঠে
যেন কতদিনের জানা
পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় ছইহারা নৌকো
চুপ করে থাকে বৈঠা
এই মাঝির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের অনেকদিন আগে
অথচ একদিন বুঝবে কথাটার কোনো মানেই নেই।
.
২
মনে করার কথা কিছুই আর বলব না
তোমার গাঁথুনি আমার জানা হয়ে গেছে
এই তো? শুধু এইটুকু?
সবচেয়ে ভালো তবু সুপুরিটানের দোহারা দাঁড়ানো
আর রেখাদোলানো এই ছলছলে জলে
কেঁপে ওঠা অবৈধতা।
.
৩
কেন আমাকে মানতে হবে তোমার নিয়ম?
দুই পাড় ভেঙে
দেখেছি তার মধ্যে বসতি করে মানুষ
কথাও চলে এপার ওপার
চিৎসাঁতার না ডুবসাঁতার
ভালো করে ভাবার আগেই ঝাঁপ দিয়ে পড়ছি
টইটম্বুর জলে।
.
৪
মেঘনার মতো তার শরীরে আদুল শুয়ে আছি।
.
৫
জন্ম জন্ম কথা বলে যাব।
নীরবতার মধ্যে জেগে উঠছে ভাপ
কামড়গুলি সব পথে পথে লুটোয়
তার থেকেই জন্ম নেয়, জন্ম নিতে থাকে, সরু সরু ঘাস
আর তার গায়ে হাত বুলাতে বুলোতে
শেষ হয়ে যায় আমার সর্বস্বহারা অপঘাত।
.
৬
বৃষ্টির শব্দ জানবে তোমার ঘর।
শহরের হেলাফেলা মুছে নিয়ে কতদূর যে ঘুমিয়ে পড়তে পারি
তার চিহ্ন থাকবে এখানে, এইখানে।
তুমিও জানো
কোনো কাজের মধ্যে নেই আমি, অকাজেও না।
.
৭
গান গাইবার সময়ে তোমার গলার শঙ্খদাগে
যখন ঢেউ লাগে
আর সুরের কালো হাওয়ায় যখন ঘুমিয়ে পড়ে সবাই
নাম-না-জানা দুটোমাত্র তারা ছাড়া আর সবাইকেই যখন ঢেকে নেয় মেঘ
হিম পড়ে ইতিহাসের পাতায়
খোলা ছাতের সেই অন্তরাতে
বোলো, তুমি বোলো।
*
জলেভাসা খড়কুটো : দ্বিতীয় গুচ্ছ
৮
ভরাট আঙুরের মতো এক-একটা গাঁয়ের নাম।
আমরা এসে পৌঁছলাম নান্দিনায়।
বলিনি তোমার ভালো লাগবে?
কুড়ি কুড়ি বছরের পাড়ি ভেঙে
নতুন পৈঠা
কতদিনের না-বলা নিয়ে বসে থাকবে এখানে
অজচ্ছল ভেসে যেতে যেতে সবাই একদিন ভুলে যাবে
আমরা ছিলাম।
.
৯
নিমফুলের আলো এসে পড়ছে তোমার ভোরবেলাকার মুখে
কোথায় যাবে সেই ভিনদেশী মানুষ
চায়ের জন্য খুচরো গুনতে গিয়ে যার হাত থেকে
খসে পড়ে বটচারা
আর ধুলোয় নিচু হয়ে যে দেখতে পায়
তোমার মুখের আদলে ভরে গিয়েছে গোটা দেশ।
.
১০
যদি আমিই না দেখতে পাই কে আর বলবে তোমার কথা।
ওই বৃন্তের প্রস্ফুরণে
চুমুক দিয়েছিল অন্ধকার
আর তার থেকেই পাকে পাকে ভেঙে যাচ্ছিল বাঁধ
পিচ্ছিলতার দিকে গড়িয়ে যাবার আগে
আমার চোখেমুখে তোমার মসৃণ পাটক্ষেত।
.
১১
আর তাছাড়া, ওরা বলছিল
ভালোবাসা কথাটার গায়ে ঝুলে আছে মৌচাক।
.
১২
কথাটা ঠিক তা নয়, বলতে গিয়ে ভুলে গেলাম।
আলে-থেমে-থাকা জল থেকে ছেলেমেয়েরা খুঁটে তুলছিল মাছের কণা
তাদের মুখের প্রতিবিম্বে
একলহমা থমকে গিয়েছিল সর্বনাশ
আর, যদিও তুমি কোথাও ছিলে না
আমার আঙুলে এসে কেঁপে যাচ্ছিল তোমার নক্তক্ষত আঙুল।
.
১৩
শহরের কামড় আমার ঘাড়ে
চোখের ঢালুতে কালো দাগেরও মানে আছে
পাঁজরগুলি নরম হয়ে আসছিল যেন খসেপড়া পালক।
তাহলে তো তোমার কথাই সত্যি হলো
আর আমিও যে জানি না তা নয়
মটরদানায় ভিজে ঠোঁট রেখে
শুয়ে থাকতে থাকতেই শরীর কুয়াশা হয়ে গেল।
.
১৪
ওই ভুরু, ক্ষীণ পক্ষ্মপাত
এতদিন পরে এই দ্বাদশীতে এলে
তুমি এলে
শূন্য থেকে শূন্যে ঝরে রুপোলি প্রপাত।
.
১৫
না-ই যদি হতো? ধরো, যদি না-ই হতো?
পলিমাটি দিয়ে বানিয়ে তুলছিলাম মুখ
কত অপমানের চিহ্ন, কত ভুলবোঝার
বিন্দু বিন্দু করে গেঁথে দিচ্ছিলাম
তবু ওই মুখ কেবলই জেগে উঠছিল, জেগে থাকছিল
উপকথার মতো
বৃত্তান্ত থেকে বৃত্তান্তে গড়িয়ে যাচ্ছিল
আর তার আবছায়ায়
বোকা হয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল আমার।
*
জলেভাসা খড়কুটো : সপ্তম গুচ্ছ
৪৮
তবে কি সম্পূর্ণ হলো দেখা?
এবারে সম্পূর্ণ হলো দান?
ও-দেশের জলধারা এসে
এ-নদীতে করেছে প্রয়াণ–
তুমি কেন আধখানা প্রেমে
যুবাদের মতো ম্রিয়মাণ?
.
৪৯
যতদূর পিপাসাতে এ-শরীর সাড়া দিতে পারে
আগুন জ্বালিয়ে যাও ততদূর পাতায় পাতায় তুমি সানুমূলে পাইনের বন।
.
৫০
রাতের পেয়ালা শেষ হলে
দেবতা ভোরের আলো খান
আঙুল এখনও বিজড়িত
পুতুলে লাগেনি আজও টান
নিঃশেষের কাছে এসে গেলে
অপ্রেমিক প্রেমিকসমান।
.
৫১
কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোনো কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।