শনির দেশে – সুকুমার রায়

শনির দেশে – সুকুমার রায়

কেউ যদি বলে যে, এই পৃথিবীর বাইরে যেখানে বলবে, সেখানে নিয়ে তোমাদের তামাশা দেখিয়ে আনবে—তাহলে তোমারা কোথায় যেতে চাও? আমি জানি, সেরকম হলে আমি নিশ্চয় শনি গ্রহে যেতে চাইব। পৃথিবীর আকাশে আমরা শুধু চোখে যতটুকু দেখতে পাই, তাতে মনে হয় যে, সব চাইতে সুন্দর জিনিস হল চাঁদ। সেখানে একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, এই পৃথিবীকে কেমন মস্ত আর জমকালো চাঁদের মতো দেখায়, সেটা নিশ্চয়ই একটা দেখবার মতো জিনিস। কিন্তু শনি গ্রহে যাবার পথে সেটা আমরা দেখে নিতে পারব।

যাক মনে কর যেন শনি গ্রহে যাত্রা করাই স্থির হল। মনে কর এমন আশ্চর্য আকাশ-জাহাজ তৈরি হল যাতে পৃথিবী ছেড়ে, পৃথিবীর বাতাস ছেড়ে ফাঁকা শূন্যের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। তোমার বয়স কত? দশ বৎসর? বেশ তা হলে 1919 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা স্বপ্ন-জাহাজে রওনা দিলাম শনি গ্রহে যাবার জন্য। আমাদের জাহাজটা মনে কর খুব দ্রুত এরোপ্লেনের মতো ঘন্টায় 100 মাইল বা125 মাইল করে চলে।

আমরা আকাশের ভিতর দিয়ে হু হু করে চলেছি আর পৃথিবীর ঘরবাড়ি সব ছোটো হতে হতে একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো শহর, বড়ো বড়ো নদী, সব বিন্দুর মতো, রেখার মতো হয়ে আসছে। এই গোল পৃথিবীর গায়ে পাহাড় সমুদ্র, দেশ মহাদেশ ক্রমে সব অতি নিখুঁত মানচিত্রের মতো দেখা যাচ্ছে। ওই ফ্যাকাশে হলদে মরুভূমি, ওই ঘন সবুজ বন, ওই ছেয়ে-নীল সমুদ্র, ওই সাদা সাদা বরফের দেশ। নভেম্বর মাসে আমরা, এখান থেকে চাঁদ যতদূর, ততদূর চলে গিয়েছি। এক বছরে 1920 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা প্রায় দশ লক্ষ মাইল এসে পড়েছি। পৃথিবী থেকে চাঁদটাকে যেমন দেখি এখন পৃথিবীটাকে ঠিক তেমন দেখাচ্ছে। হিমালয় পাহাড়কেও আর পাহাড় বলে ভালো বোঝাই যাচ্ছে না। চাঁদের যেমন অমাবস্যা পূর্ণিমা হয়, দিনে দিনে কলায় কলায় বাড়ে কমে, পৃথিবীরও ঠিক তেমনি। এমনি করে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, কিন্তু কই? শনি গ্রহ ত একটুও কাছে আসছে বলে মনে হয় না। শুনেছিলাম যে এক প্রকাণ্ড গ্রহ, তার চারিদিকে আংটি ঘেরা। কিন্তু তোমার ত বিশ বছর বয়স হল, গোঁফদাড়ি বেরিয়ে গেল, এখন ত সে সবের কিছুই দেখা গেল না। ওই লাল রঙের মঙ্গল গ্রহটা যেন একটুখানি কাছে এসেছে, কিন্তু সেও ত খুব বেশি নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতটি বলছেন, মঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছতে আর চল্লিশ বৎসর লাগবে। ও হরি। তাহলে শনিতে পৌঁছব কবে? শনি পর্যন্ত যেতে লাগবে প্রায় আটশো বৎসর। তা হলে উপায়? একমাত্র উপায়, আরও বেগে যাওয়া। আর পাঁচ গুণ দশ গুণ বিশ গুণ বেগে কামানের গোলার মতো বেগে ঘন্টায় দু হাজার মাইল বেগে ছুটতে হবে। তাই ছোটা যাক।

আর দুই বৎসর মঙ্গল পর্যন্ত এসে পড়া গেল। ওখানে গিয়ে একবার নামলে মন্দ হত না। ওই লম্বা লম্বা আঁচড়গুলো সত্যিকারের খাল কিনা, ওখানে সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান জীব কেউ আছে কিনা, একটিবার খবর নেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের ত অত অবসর নেই, যেমনভাবে চলেছি এমনি করে চললেও শনিতে পৌঁছতে আর অন্তত চল্লিশ বৎসর লাগবে! সুতরাং সোজা চলতে থাকি।

মঙ্গলের পথ পার হয়ে এখন বৃহস্পতির দিকে চলেছি। মাঝে মাঝে ছোটো-বড়ো গোলার মতো ওগুলো কি সামনে দিয়ে হুস করে ছুটে পালাচ্ছে? কোনোটা দশ মাইল, বিশ মাইল, কোনোটা একশ মাইল বা দুশ মাইল চওড়া—আবার কোনোটা ছোটোখাটো ঢিপির মতন বড়ো, কোনো কোনোটা সামান্য গুলি-গোলার মতো। এরা সবাই গ্রহ। যে নিয়মে বড়ো বড়ো গ্রহেরা সূর্যের চারিদিকে চক্র দিয়ে ঘোরে—এরাও প্রত্যেকেই, এমনকী যেগুলি ধূলিকণার মতো ছোটো সেগুলিও, ঠিক সেই নিয়মেই নিজের নিজের পথে নিজের নিজের তাল বজায় রেখে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়।

এমনি করে ছুটতে ছুটতে আর দশ বৎসর কেটে গেল, ছোটো ছোটো গ্রহগুলিকে আর যেন দেখাই যায় না। পৃথিবী সূর্যের আশেপাশে মিটমিট করে জ্বলছে। সূর্যও দেখতে অনেকখানি ছোট্ট হয়ে গেছে—সেই পৃথিবীর সূর্য আর এই সূর্য যেন ফুটবলটার কাছে একটি ক্রিকেট বল। ক্রমে আর আট-দশ বৎসর ছুটে, গ্রহরাজ বৃহস্পতির চক্রপথের সীমানায় হাজির হওয়া গেল। কোথায় পৃথিবী আর কোথায় বৃহস্পতি। 365 দিনে পৃথিবীর এক বৎসর—কিন্তু বৃহস্পতি যে প্রকাণ্ড পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সেই পথে একেবার পাড়ি দিতে তার প্রায় বারো বৎসর সময় লাগে। ধোঁয়ায় ঢাকা প্রকাণ্ড শরীর—তার মধ্যে হাজার খানেক পৃথিবীকে অনায়াসেই পুরে রাখা যায়। অথচ এই বিপুল দেহ নিয়ে গ্রহরাজকে লাটিমের মতো ঘোরপাক খেতে হচ্ছে। এ কাজটি করতে পৃথিবীর চবিবশ ঘন্টা সময় লাগে, কিন্তু বৃহস্পতির দশ ঘন্টাও লাগে না। বৃহস্পতির চারিদিকে সাত-আটটি চাঁদ—তার মধ্যে চারটি বেশ বড়ো বড়ো—তিনটি আমাদের চাঁদের চাইতেও বড়ো।

বৃহস্পতির এলাকা পার হয়েছি। শনির আলো ক্রমে আর উজ্জ্বল হয়ে আসছে—ক্রমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, তার চেহারাটা ঠিক অন্য গ্রহের মতো নয়। মনে হয় কেমন যেন লম্বাটে মতন—দুপাশে যেন কি বেরিয়ে আছে। আর কাছে গিয়ে দেখ তার গায়ের চমৎকার আংটিটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পৃথিবী থেকে ছোটোখাটো দূরবিন দিয়ে যেমন দেখেছি এখন শুধু চোখেই সেইরকম দেখতে পাচ্ছি। আংটিটা বাসনের কানার মতো, উকিলের শামলার ঘেরের মতো—খুব পাতলা আর চওড়া। শনি গ্রহকে আমরা যে দেখি, সবসময়ে ঠিক এরকম দেখি না—কখন একটু উঁচু থেকে, কখন একটু নীচু থেকে, কখন আংটির ওপর দিকটা, কখন তার তলাটা, কখন সামনে ঝোঁকা, কখন পিছন-হেলান। যখন ঠিক খাড়াভাবে আংটির কিনারা থেকে দেখি, তখন আংটিটাকে দেখি সরু একটু রেখার মতো—এত সরু যে খুব বড়ো দূরবিন না হলে দেখাই যায় না।

প্রায় চল্লিশ বৎসর হল আমরা পৃথিবী ছেড়েছি—এখন আর আট-দশ বৎসর গেলে আমরা শনিতে পৌঁছিব। ততদিনে তোমার চুল দাড়িগোঁফ সব পেকে যাবে—তুমি ষাট বছরের বুড়ো হয়ে যাবে। শনিকে অনেকখানি ডাইনে রেখে আমরা ছুটে চলেছি। শনিও ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে ওই বাঁয়ের দিকে ছুটে আসছে, আর কয়েক বৎসর পরে সে ঠিক আমাদের সামনে এসে হাজির হবে। সেও কিনা সূর্যের প্রজা, কাজেই সূর্যের চারিদিকে তাকেও প্রদক্ষিণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের ঊনত্রিশটা বছরেও তার একটা পাক পুরো হয় না।

যাক—এতদিন পথের শেষ হয়েছে, আমরা শনি গ্রহের ওপরে এসে পৌঁছেছি। ‘আংটিটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আকাশের ওপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত যেন আলোর খিলান গেঁথে দিয়েছে। খিলানের মধ্যে খিলান, তার মধ্যে ঝাপসা আলোর আরেকটি খিলান। তার ওপর আবার শনি গ্রহের ছায়া পড়েছে। সূর্যের এই প্রকাণ্ড রাজত্বের মধ্যে যতদূর যাও, এমন দৃশ্য আর কোথাও দেখবে না—আমাদের পৃথিবীর দূরবিনের দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যায়, এমন জিনিস আর দ্বিতীয় কোথাও পাওয়া যায়নি।

আকাশে কত চাঁদ! একটি নয়, দুটি নয়, একেবারে আট-দশটা চাঁদ—ছোটো-বড়ো মাঝারি নানারকমের! সওয়া দশ ঘন্টায় এখানকার দিনরাত—ঘুমের পক্ষে ভারি অসুবিধা। দিনটাও তেমনি—পৃথিবীর রোদ এখানকার চাইতে একশ গুণ কড়া। পৃথিবী থেকে সূর্যকে যদি চায়ের পিরিচের মতো বড়ো দেখায়, তবে এখান থেকে তাকে দেখায় যেন আধুলিটার মতো। যখন তখন চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ ত লেগেই আছে, তার ওপর আবার থেকে চাঁদে চাঁদেও গ্রহণ লেগে যায়, এক চাঁদ আর-এক চাঁদকে ঢেকে ফেলে। এখানকার জন্য যদি পঞ্জিকা তৈরি করতে হয়, তবে তার মধ্যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কেবল গ্রহণের হিসেব লিখতেই কেটে যাবে।

আংটিগুলি যেন অসংখ্য চাঁদের বাঁক—ছোটো ছোটো ঢিপির মতো, পাথরের ভেলার মতো, কাঁকড়ের কুচির মতো, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি চাঁদ কেউ কারও গায়ে ঠেকে না, আশ্চর্য নিয়মে প্রত্যেকে নিজের পথে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। আর সমস্তে মিলে আশ্চর্য সুন্দর আংটির মতো চেহারা হয়েছে।

এখন অসুবিধার কথাটাও একটু ভাবা উচিত। গরম বাতাস আর ধোঁয়ার ঝড় ত এখানে আছেই। তার ওপরে সবচাইতে অসুবিধা এখানে দাঁড়াবার মতো ডাঙা পাবার যো নাই—ডাঙা খুঁজতে গেলে অনেক হাজার মাইল গভীর গরম ধোঁয়াটে মেঘের সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিতে হবে। সেই মেঘের মধ্যে জীবজন্তু কেউ বাঁচতে পারে কিনা খুবই সন্দেহ। সুতরাং এখন ফিরবার উপায় দেখতে হবে!

এসেছিলাম কামানের গোলার মতন বেগে—কিন্তু তার চাইতেও তাড়াতাড়ি চলা যায় কি? আলো চলে সবচাইতে তাড়াতাড়ি—প্রতি সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ নব্বই হাজার মাইল। তা হলে সেইরকম বেগে আলোর সওয়ার হয়ে ছোটা যাক। পৃথিবীতে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে? এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *