শনিবারে কালো কুকুরকে লুচি

শনিবারে কালো কুকুরকে লুচি

জন্মাবধি শুনে আসছি আমার নাকি শনির দশা। তার ওপর দুশ্চিন্তার বিষয় হল, আমার জন্মও হয়েছিল শনিবারে। ফলে, তাঁর বড় ছেলেটিকে নিয়ে মায়ের ছিল স্থায়ী এক দুশ্চিন্তা। দুষ্ট শনি কখন ছেলের কোন বিপদ ডেকে আনে, সেই চিন্তায় তাঁর দিন-রাত কাটত। আমার দিকে মা মাঝে মাঝেই জুলজুল করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। হয়তো ভাবতেন, ছেলেটা কি বাঁচবে? তাই বরাবর আমিই ছিলাম আমার মায়ের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। শনির হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য মা যে কত কী করতেন, তার লেখাজোখা নেই। আর মায়ের কল্যাণে আমাদের বিশাল যৌথ পরিবারের সবাই ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। চাউর হয়ে গিয়েছিল পাড়া-প্রতিবেশী, অতিথি-অভ্যাগতদের মধ্যেও। সবাই জানত, রুণুর শনির দশা। আর তাই আকাশে মেঘ দেখলেই ঠাকুমা আমাকে ঢেকেঢুকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, মাটিতে নামাতেন না। এই সব দেখেশুনে একটু বড় হয়ে আমারও ধারণা হয়েছিল, আমার দুনিয়াদারি বেশি দিনের নয়। শনি ঠাকুর আড়ায় আড়ায় ঘুরছেন। তক্কে তক্কে আছেন। এক দিন ছোঁ মেরে তুলে নেবেন।

আমাদের বাড়িতে বরাবরই সাধুসজ্জন এবং জ্যোতিষীদের আনাগোনা। ময়মনসিংহের বাড়িতে যেমন, পরে আমাদের বিভিন্ন জায়গার রেলের বাংলোতেও তেমন। কত রকমের সাধু যে আসতেন, তার হিসেব নেই। তেমনই আসতেন জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ফকির। অনেকে দু-চার দিনের আতিথ্যও নিতেন। সাধু-সেবায় মায়ের ক্লান্তি ছিল না। আমার যে ফাঁড়া আছে, সে বিষয়ে জ্যোতিষীরা প্রায় সবাই ছিলেন একমত। তাঁরা নানা বিচিত্র নিদান দিয়ে যেতেন এবং সেগুলো অভ্রান্ত ভাবে পালন করতেন মা। কপালে সিঁদুরের টিপ, পরনে রক্তাম্বর, জটাধারী এক ভয়ংকর ভোজপুরি সাধু আমার হাত দেখে যে নিদান দিয়েছিলেন, তা ছিল ভারী কঠিন। প্রতি শনিবারে সরষের তেলে একটা আটার লুচি ভেজে, তাতে একটা সিঁদুরের টিপ পরিয়ে আমাকে সেটা বাঁ হাতে ধরে একটা কালো কুকুরকে খাওয়াতে হবে। শনিবারে মা তো লুচি ভেজে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে আমাদের বাচ্চা চাকর টুনটুনিয়াকে পাঠিয়েছেন রাস্তা থেকে একটা কালো কুকুর ধরে আনতে। অনেক ক্ষণ পর টুনটুনিয়া নারকোলের দড়িতে বেঁধে একটা কালো কুকুরকে এনে আমগাছের সঙ্গে বাঁধল। কিন্তু সে লুচি খাবে কী, কেঁউকেঁউ করে এমন লাফালাফি করতে লাগল যে বলার নয়। শেষ পর্যন্ত লুচিটা তার সামনে ফেলে চলে আসতে হল। খেয়েছিল কি না কে জানে।

আমি আদ্যন্ত মায়ের ছেলে। মা ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার। দিনের মধ্যে যে কত বার খেলা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের গায়ের গন্ধ শুঁকে আসতাম, তার হিসেব নেই। মাকে ছেড়ে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কিন্তু কপালের ফের আর ঠেকাব কী করে?

আমার জীবনের সুস্পষ্ট দুটো ভাগ। দেশভাগের আগে, আর পরে। যে ভুক্তভোগী নয়, তার বোঝার সাধ্যই নেই যে, পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে আসার বিষাদ কত গভীর হতে পারে। মুড়ির মোয়ার মতো আঁটবাঁধা একটা যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। ডাক-খোঁজ ছিল, মায়া-বন্ধন ছিল, আত্মীয়তা কাকে বলে, তা আমরা জানতাম। একটা যৌথ পরিবারে বাস করলে মানুষ আপনা থেকেই শেখে ভাগ করে খেতে-শুতে। লোকে আমরা কয় ভাই-বোন জিজ্ঞেস করলে আমি আমার চার জ্যাঠতুতো দাদাকেও হিসেবে ধরে নিয়ে বলতাম। যেন একটা বোমা এসে পড়ল আর গোটা পরিবারটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে এক টুকরো, ওখানে এক টুকরো হয়ে গিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে পর হয়ে গেল আপনজনেরা। আর মায়ের সঙ্গেও সেই থেকে একটু ছাড়াছাড়ি। বাবা অসমে, আমি আর দিদি জলপাইগুড়ির আত্মীয়বাড়ি।

পুজোর ছুটিতে লামডিঙে মায়ের কাছে এসেছি। সেই সময় আমার হল টাইফয়েড। কোনও চিকিৎসা নেই ওই রোগের। শুধু কিছু সহায়ক ওষুধ। আমাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। ঘোর জ্বরের আচ্ছন্নতায় শুধু দেখতে পেতাম মায়ের দুখানা করুণ আর ছলছলে চোখ। বাহান্ন দিন পর ভাত পথ্যি।

সেই সময় আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন এক জ্যোতিষী। কানে শুনতেন না বলে সঙ্গে এক জন স্লেট-পেনসিলধারী অ্যাসিসট্যান্ট। কেউ প্রশ্ন করলে লোকটা স্লেটে লিখে দিত, সেটা দেখে জ্যোতিষী বিধান দিতেন। তিনি নাকি ছিলেন নেপালের রাজ-জ্যোতিষী। লামডিঙে তখন তাঁর প্রবল পসার। এক দিন বিকেলে আমি আমাদের বাংলোর বাঁধানো চাতালে খেলছি। জ্যোতিষী বারান্দায় বসে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। হঠাৎ জ্যোতিষী আমাকে দেখিয়ে বাবাকে বললেন, আপকো ইয়ে লেড়কা তো মর জায়গা! শুনে বাবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কদাচিৎ বাবাকে এমন নার্ভাস হতে দেখেছি। বাবা কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন। জ্যোতিষী বললেন, ফাঁড়াটা কাটবার নয়। তবু তিনি একটা মাদুলি দেবেন। দাম কুড়ি টাকা।

তখনকার কুড়ি টাকা মানে কিন্তু অনেক টাকা। বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কয়েক দিন পর জ্যোতিষী মাদুলি এনে আমার ডান হাতে তাগা দিয়ে বেঁধে বলে দিলেন, কোনও নোংরা জায়গায় যাবে না। গেলে তাবিজ হাত থেকে ছিটকে যাবে।

তখন আমার বয়স বোধহয় এগারো বা বারো। তবু আমার কেন যেন জ্যোতিষীটাকে বিশ্বাস হত না। মনে হত ওর ওই কানে না শোনাটা একটা ভান। আসলে ভালই শোনে। অ্যাসিসট্যান্টটা খদ্দেরের সঙ্গে অবিরল কথা বলে নানা খবর জেনে নেয়। সেই সব থেকেই জ্যোতিষী নানা কথা বলে দিতে পারে। একটি চতুর পরিকল্পনা।

আমার বয়সি আমার আর এক বন্ধুকেও অনুরূপ কবচ ওই জ্যোতিষী দিয়েছিলেন। আমার সেই বন্ধুটিরও জ্যোতিষীর ওপর বিশ্বাস ছিল না। বলত, লোকটা ভণ্ড।

লামডিঙের থানার মাঠে তখন আমরা ক্রিকেট খেলতাম। খেলার পর সন্ধে পর্যন্ত মাঠে বসে নানা গল্প হত। বন্ধুদের প্রায় সবার বাড়িতেই নেপালের রাজ-জ্যোতিষীর আনাগোনা ছিল। সেই সব নিয়েও আমাদের অনেক কথা হত। জ্যোতিষীর ভিকটিম অল্পবিস্তর সবাই।

তবে একটা কথা স্বীকার করতে হবে, জ্যোতিষীর মুখখানা ছিল ভারী ভালমানুষের মতো। খুব আস্তে কথা বলতেন। খুব বেশি বকবক করতেন না।

ক্রিকেট বল প্রায়ই মাঠের প্রান্তে ড্রেনে গিয়ে পড়ত। আমি বা আমার তাবিজওয়ালা বন্ধু ড্রেন থেকে বল তুলতাম না, বারণ আছে বলে। কিন্তু এক দিন বেখেয়ালে একটা ক্যাচ লুফতে গিয়ে আমার বন্ধুটি পিছোতে পিছোতে সেই ড্রেনেই গিয়ে পড়ল। বল তুলে আনার পর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এই রে! আমার মাদুলি!

আমি অবাক। সবাই মিলে খুঁজে খুঁজে মাদুলি উদ্ধার হল। দেখা গেল তাগাটা ছেঁড়া।

তবু সন্দেহটা ছিল। পরের ঘটনাটা চমকপ্রদ। আমাদের আর এক বন্ধুর ভাই হয়েছে। সেটা ততটা জানা ছিল না। এক দিন কী করতে তাদের বাড়িতে গেছি। বন্ধু তার সদ্যোজাত ভাইকে দেখাবে বলে সেই ঘরে নিয়ে গেল। আর ঘরে ঢুকতেই পটাং করে একটা শব্দ হল। আমার মাদুলিটা ছিটকে গিয়ে একটা পেতলের কলসির গায়ে লেগেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *