শত্রুমিত্র শনাক্তকরণ
যে ও যা বাঙলা ভাষার পক্ষে, সে ও তা-ই বাঙলার মিত্র; আর যে ও যা বাঙলা ভাষার বিপক্ষে, সে ও তা-ই বাঙলার শত্রু। প্রকাশ্যে এখন বাঙলার সাথে কেউ শত্রুতা করেন না, কিন্তু গোপনে করেন অনেকেই। এ-শত্রুসংঘে আছে ব্যক্তি, গোষ্ঠি, প্রতিষ্ঠান, বিশেষ একটি সামাজিক শ্রেণী, ও বাঙালির আন্তর মানসিকতা। মানুষ তারই সাথে শত্রুতা করে, যা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। বাঙলাদেশে আছে এখন এমন কিছু দল গোষ্ঠি শ্রেণী, বাঙলা ভাষার প্রতিষ্ঠা যাদের স্বার্থের পরিপন্থী; তাই তারা বাঙলা ভাষার সাথে প্রত্যক্ষপরোক্ষ শত্রুতায় লিপ্ত। আমাদের শক্তিমান প্রতিষ্ঠানগুলো— ব্যাংক, করপোরেশন, বিচারালয়, সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি- সক্রিয়নিষ্ক্রিয়ভাবে বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতা করে যাচ্ছে। আমাদের শাসকসম্প্রদায়- এর মাঝে আছেন সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী থেকে ন্যূনতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তি—, ও সামাজিক সুযোগসুবিধাভোগী শ্রেণীটি প্রধানত বাঙলার বিপক্ষে। আমাদের শাসকসম্প্রদায় ও সুবিধাভোগী শ্রেণীটি দেশের জন্যে যদিও বেশ ক্ষতিকর, তবু তাঁরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, তাই তাঁদের শত্রুতায় বাঙলা ভাষা অপ্রতিষ্ঠিত থেকে যাচ্ছে। বাঙালির হীনমন্য মানসিকতাও অনেকটা বাঙলার বিরুদ্ধে যায়। বাঙালির কাছে বাঙলা এখনো পুরোপুরি ‘শ্রদ্ধেয়’ হয়ে ওঠে নি। আড়াই শতাব্দী আগে তারা শ্রদ্ধা করেছে ফারসিকে, গত দু-শো বছর ধ’রে শ্রদ্ধা ক’রে আসছে ইংরেজিকে : দুটিই সাম্রাজ্যবাদী রাজভাষা, যা বাঙালির কাছে আভিজাত্যের প্রতীক। বাঙলা শুধুই গ্লানি সঞ্চার করে।
আমাদের রুগ্ন সমাজব্যবস্থা এমন কিছু মানুষ ও তাদের একটি শ্রেণী প্রজননে সফল হয়েছে, যাঁরা অসুস্থভাবে ইংরেজিমনস্ক। এ-শ্রেণীর কাছে বাঙলা শ্রদ্ধেয় নয়, বাঙলাদেশও শ্রদ্ধেয় নয়। এ-শ্রেণীটি অন্তঃসারশূন্য, তবে তাঁরাই সংগ্রহ করেছেন দেশের যা-কিছু ধনসম্পদ- শক্তি স্বাস্থ্য সৌন্দর্য- বিভীষিকার মতো যেনো। এ-শ্রেণীটির বিভিন্ন সদস্যই বিরাজ করেন শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রে কেন্দ্রে, ব্যবসাবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের শিল্প ও পণ্য, এবং তাঁরাই বাঙলা ভাষার সংঘবদ্ধ শত্রু। বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে তাঁদের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে : বাঙলা ভাষা যথেষ্ট উন্নত নয়, এ-ভাষায় প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দ নেই, জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতির জটিল প্রক্রিয়া ব্যাখ্যার মতো প্রকাশভঙ্গি নেই ইত্যাদি। কিন্তু এ-অভিযোগগুলো যেহেতু সত্য নয়, তাই তারা বাঙলা নিন্দা ত্যাগ ক’রে ইংরেজির প্রশংসা করেন। ‘ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা’, ‘আমরা সব কিছুতে পরনির্ভর, তাই পরের কাছে আবেদননিবেদনের জন্যে ইংরেজি আমাদের সব সময় দরকার’, ‘পৃথিবীর সব জ্ঞান ইংরেজিতে পাওয়া যায়, তাই ইংরেজি অত্যাবশ্যক’ ইত্যাদি নানা যুক্তি তাঁরা পেশ করেন ইংরেজির পক্ষে। আন্তর্জাতিকতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের দাবি দুটি বেশ প্রতারক- তাঁরা জ্ঞানবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিকতার কথা তুলে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে চান যেনো বাঙলার সবাই পৃথিবীর সব জ্ঞান আহরণ করতে চায়, না করলে তারা খুবই মূর্খ হয়ে পড়বে, আর বাঙলার সব মানুষ— চাষী, দারোগা, হাকিম, জেলাশাসক, নানা মানের সচিব ও মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি- সারাক্ষণ বিদেশিদের সাথে ইংরেজিতে মত বিনিময় ক’রে যাচ্ছেন। বাঙলাবিরোধিতা ও বিদেশি ভাষার পক্ষাবলম্বন উভয়ই বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতা; আর এতে বিশিষ্ট হচ্ছেন আমাদের আর্থ সামাজিক রাজনীতিক সুবিধাভোগী শ্রেণীটি।
রাষ্ট্রের শক্তিমান প্রতিষ্ঠানগুলো- ব্যাংক, বীমাপ্রতিষ্ঠান, বিচারালয়, সচিবালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট, বাণিজ্যসংস্থা, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, এবং কিছু পরিমাণে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো— কার্যকলাপে বাঙলাবিরোধী। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে এখনো ইংরেজির প্রাধান্য, বাধ্য হয়ে এরা কখনোকখনো নথিপত্রে বাঙলা ব্যবহার করে, কিন্তু শক্তির ভাষারূপে বাঙলা ব্যবহার করে না। অথচ এগুলোর ব্যবহারের ওপরই বাঙলা প্রচলন নির্ভর করে শতকরা আশিভাগ। পেশার ভাষা না হ’লে অধিকাংশ মানুষ ভাষাকে গুরুত্ব দেয় না, কেননা দৈনিক জীবনযাপনের জন্যে একটি ভাষা প্রত্যেকে জন্মসূত্রেই লাভ করে। পেশার ভাষা আয়ত্তের জন্যে মানুষ চরম পরিশ্রম করতেও প্রস্তুত, কেননা ওই ভাষাদক্ষতা তাকে পেশাগত জীবনকে নানাভাবে পুরস্কৃত করে। ভারতীয়রা প্রথম ইংরেজি শিখেছিলো পেশাগত কারণেই, ইংরেজি সাহিত্য পাঠের জন্যে নয়। বাঙলা যদি হতো পেশাগত উন্নতির ভাষা, তবে তা আয়ত্ত না ক’রে উপায় থাকতো না। ভারতবর্ষীয়রা আঠারো শতকেই যে ইংরেজি শিখতে শুরু করেছিলো, তা শেক্সপিয়র মিল্টন চসারের আকর্ষণে নয়; শাদা সাম্রাজ্যবাদী সওদাগরদের স্নেহ ও সুবিধা পাওয়ার জন্যেই। আমাদের সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীটির অনৈতিকতা এখন কিংবদন্তিতূল্য। ব্যবসায়ী আমলা কালোবাজারী রাজনীতিক ও আরো অজস্র প্রতারকে গ’ড়ে ওঠা এ-শ্রেণীটি কোনো কিছুকেই মহৎ পবিত্র ভাবে না; এরা সব কিছুকে টাকায় পরিণত করতে চায়; এবং বাঙলা প্রচলনের বিষয়টিকে দেখে দু-দৃষ্টিতে : শত্রুতার ও উপহাসের।
বাঙালি ফারসি যুগে লিখতো ‘গরিবনেওয়াজ সেলামত’, ইংরেজি যুগে লিখতো ‘ইওর মোস্ট অবিডিয়েন্ট সারভেন্ট’, কেউ কেউ ‘ইওর মোস্ট অবিডিয়েন্ট স্লেভ’ও লিখতো। আমাদের পূর্বপুরুষদের দাস-মানসিকতা এখনো আমরা লালন ক’রে চলেছি বিশ্বস্তভাবে। কয়েক শতাব্দীর হীনমন্যতা জড়ো হয়ে আছে আমাদের রক্তমাংসে। যাঁরা উচ্চপদস্থ— শক্তিশালী, তাঁরা ইংরেজি বলেন নিজেদের উচ্চতা রক্ষার জন্যে, আর যাঁরা নিম্নপদস্থ শক্তিহীন, দারিদ্র্য ও অন্যান্য কারণে আয়ত্ত করতে পারেননি ইংরেজি, তাঁদের ধারণা ইংরেজি বললে ‘স্ট্যান্ডার’ থাকে। উর্দি অস্ত্র দারোয়ান দিয়ে শক্তিমানেরা যেমন ‘সাধারণ’দের সন্ত্রস্ত করে রাখেন, তেমনি ইংরেজি দিয়েও তাঁরা শক্তিহীনদের ভয় দেখান : জানিয়ে দেন যে তাঁরা উচ্চ, ও অন্যভাষী- অন্যশ্রেণীর মহামানুষ। ষাটের দশকে ইংরেজির এক অধ্যাপক, যিনি সাধারণত প্রবন্ধ লেখেন না, বাঙলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উত্তেজিত হয়ে এক ইংরেজি মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখে জানিয়েছিলেন যে তাঁর শ্রদ্ধের পিতা ত্রিশের দশকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেছিলেন, তিনি পাশ করেছিলেন চল্লিশের দশকে, আর তাঁর পুত্র বা কন্যা ইংরেজিতে পাশ করবে সত্তর-দশকে। তাঁর ও তাঁর শ্রেণীর মানসিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট : ইংরেজিতে তাঁরা গৌরব বোধ করেন, এবং ভোগ করেন আর্থসুবিধা। নিম্নপদস্থরা ইংরেজি জানেন না, জানেন আঞ্চলিক বাঙলা; আর সারা জীবন ইংরেজি না-জানার গ্লানি ও অভিশাপ বহন করেন। তাই তাঁরা শ্রদ্ধা করেন ইংরেজিকে, কেননা তাদের ‘প্রভু’রা ইংরেজিভাষী। এ-মানসিকতা একটি সরল সমীকরণ উপস্থিত করে- ইংরেজি = আভিজাত্য (উচ্চপদ, শক্তি, ধন); আর বাঙলা = অনাভিজাত্য (নিম্নপদ, শক্তিহীনতা, দারিদ্র্য)।
তাহলে বাঙলায় মিত্র কারা?- ন-কোটি মানুষের কতো ভাগ মিত্র, কতোভাগ শত্রু? নির্ভুল হিশেব কেউ জানেন না; তবে, সম্ভবত, কয়েক লক্ষ মানুষ, যাঁরা দেশ ও সমাজকে ইচ্ছে মতো ঘোরাচ্ছেন ফেরাচ্ছেন চালাচ্ছেন, তাঁরাই বাঙলার (গোপন) শত্রু; আর মিত্র সে-সাধারণ মানুষের শ্রেণী, যাঁরা শক্তির উৎস হ’লেও প্রত্যক্ষ শক্তিহীন। তাঁদের অনেকে চাষী, অনেকে শ্রমিক, বা রিকশাচালক, অনেকেই ভিক্ষুক; তাঁদের একটি বড়ো অংশ ছাত্র, একটি বড়ো অংশ নিম্নপদস্থ পেশাজীবী। তাঁদের একটি বড়ো অংশ হয়তো জানেনও না যে তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা যে-ধ্বনিগুলোর সাহায্যে তাঁরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করেন, তার নাম বাঙলা ভাষা। তাঁরা সম্ভবত কৃতজ্ঞ কোনো অদৃশ্যের কাছে; কেননা তাঁদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তিনটি অমূল্য সামগ্রী- বায়ু, জল, ভাষা কোনো দোকান থেকে কিনতে হয় না, ভিক্ষে করতে হয় না। তবে জল ও বায়ু নিয়ে তাঁদের কোনো বিপদ নেই, কিন্তু ভাষাটি তাঁদের সংকটে ফেলে। তাঁদের ভাষার কোনো মূল্য নেই। যদি তাঁদের ভাষা মূল্য পায় সরকারের কাছে, বিচারালয়ের বিকট অশুদ্ধ অপভাষী বিভাষী মাননীয়দের কাছে, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের প্রচণ্ড কর্মকর্তাদের কাছে, দশতলা সৌধে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে, সম্মেলনে, তবে তাঁরাও মূল্য পাবেন ওই সমস্ত সুরক্ষিত এলাকায়। যদি না পায়, তবে তাঁরা ও তাঁদের ভাষা প’ড়ে রইবে দেয়ালের বাইরে— প্রতারিত, পরিত্যক্ত, শোষিত, অসহায়।