০৮. শত্রুপক্ষের কবলে
ট্রেন জার্নির ধকল এবং প্রচণ্ড শীতের দরুন কর্নেলের সঙ্গে বেরুনোর ইচ্ছে ছিল না। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল সেই তুর্কি প্রজাপতির খোঁজে বেরুচ্ছেন বলে গিয়েছিলেন। এই সাংঘাতিক শীতেও নাকি ওই প্রজাতির প্রজাপিত কাবু হয় না। ধরতে না পারুন, ক্যামেরায় তার ছবি না তুলে ছাড়বেন না।
একটা নাগাদ প্রকৃতিবিদ ফিরলেন। ততক্ষণে আমি গরম জলে স্নান করে। ফিট হয়ে গেছি। কর্নেল সপ্তাহে একদিন স্নান করেন। আজ তার মানের দিন নয়। পোশাক বদলে বৈজুকে লাঞ্চ রেডি করতে বললেন।
জিজ্ঞেস করলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ারের দেখা পেলেন নাকি?
নাহ্। সারা তল্লাটে পিকনিকবাজদের হুল্লোড়। আর মাইক্রোফোনে ফিল্মি। গান! মুনলেকের চারদিকেও একই অবস্থা, কালো দৈত্য হানা দিলে খুশি হব।
সন্ধ্যানীড়ে যাননি?
কর্নেল হাসলেন। একটা উঁচু টিলার মাথায় চড়ে বাইনোকুলারে বাড়িটার ওপর লক্ষ্য রেখেছিলাম কিছুক্ষণ। সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। দেখলে ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে ছবি তুলে নিতাম।
কথাটা সেই মুহূর্তে মাথায় এল। বললাম, আচ্ছা কর্নেল, ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। কিন্তু শ্যামবাবুর লাশের ছবি তোলেননি কেন?
এতদিন পরে কথাটা তুমি জিজ্ঞেস করছ?
খেয়াল হয়নি। আপনার কথায় এটা এতদিন পরে মাথায় এল।
কর্নেল আস্তে বললেন, তখন ক্যামেরায় আর ফিল্ম ছিল না। তুমি তো দেখেছিলে, সেদিন বিকেলে মুনলেকে ফিল্মের রোলটা উজাড় করে ফেলেছিলাম। পাখি আর প্রজাপতির অবাধ রাজত্ব তখন। কালো দৈত্যের ভয়ে শরৎকালে তল্লাটে তখন ট্যুরিস্ট বা পিকনিকবাজরা পা বাড়ায় না।
ডাইনিং রুমে জোরা কৃপাসে পায়ের ধুলো দেওয়ার জন্য ডাকতে এল বৈজু। লোকটি অত্যন্ত বিনয়ী এবং সত্যিকার সেবাভক্তিপরায়ণ।
খাওয়ার সময় এতক্ষণে সাইকেলে চেপে নবাবু এলেন। নমস্কার করে বললেন, বাজার-টাজার করে দিয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম ইনি ঘমোচ্ছেন। ডিসটার্ব করলাম না। বৈজু বলল, কর্নেলসায়েব বেরিয়েছেন। আপনারা খাওয়া-দাওয়া করুন স্যার। আমি চৌহদ্দি ঘুরে দেখি, সব ঠিকঠাক আছে কি না। সায়েব বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। লনে একটু কিছু পড়ে থাকলে কিংবা বাগানের গাছপালার তলায় আবর্জনা দেখলে খাপ্পা হন। লোক আসছে। বিকেলের মধ্যে সব ঝকঝকে তকতকে করে ফেলবে।
খাওয়ার পর ফুলবাগানের মধ্যে একটা গোলাকরা খোলামেলা বেদিতে গিয়ে। বসলাম দুজনে। ততক্ষণে এক ঝাড়ুদারনী এবং একজন লোক এসে গেছে। মনে হল, দরকার ছিল না ওদের। বৈজু সব ঝকঝকে করেই রেখেছে।
নন্দবাবু তদারক করছিলেন। কর্নেল ডাকলেন, আসুন নন্দবাবু! একটু গপ্প করা যাক।
নন্দবাবু কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনি শ্যামসুন্দরবাবু নামে কাউকে চেনেন?
শ্যামসুন্দর স্যার?
হ্যাঁ। আপনার সায়েবের কলকাতার অফিসে একসময় চাকরি করতেন ভদ্রলোক।
নন্দবাবু বিকৃত মুখে বললেন, একের নম্বর ধড়িবাজ। সায়েবের মুখে শুনেছি, চুরিচামারি করে পালিয়েছিল।
আপনার সায়েব বলছিলেন গত অক্টোবরে এই বাংলোবাড়িতে সে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
হ্যাঁ স্যার। দুপুরে এসেছিল। সেই প্রথম ওকে মুখোমুখি দেখেছি। খুব ভঁট দেখাচ্ছিল এসে।
কী ব্যাপারে?
নন্দবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, সেটা ঠিক বলতে পারব না স্যার! মনে হচ্ছিল খুব ভঁটের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। সায়েব ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা এঁটে কথা বলছিলেন। আবছা কানে এসেছিল খুব তর্কাতর্কি হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে সায়েব ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। হুমকি দিয়ে বললেন, ফের যদি আমার সামনে কখনও দেখি, গুলি করে মারব। শ্যামসুন্দর চুপচাপ চলে গেল।
আপনি সায়েবকে জিজ্ঞেস করেননি কিছু?
না স্যার! আমি ওঁর কর্মচারী। উনি আমার রুজির মালিক। তবে সায়েব পরে শুধু বললেন, জানো, নন্দ? এই বদমাইসটা আমার কলকাতার অফিসে ক্লার্ক ছিল। খুব বিশ্বাস করতাম ওকে। আমার একটা ইমপর্ট্যান্ট ফাইল চুরি করে পালিয়েছিল। তো সায়েবের এই কথা শুনে মনে হয়েছিল, শ্যামসুন্দর সায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতেই এসেছিল। সায়েবের দেশবিদেশে ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার আছে। বুঝতেই পারছেন, আজকাল এই কারবারে অনেক বে-আইনি কাজকর্ম হয়। আমি আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবরে আমার কাজ কী?
আপনার সায়েবের সঙ্গে তার বৈমাত্রেয় দাদার এখানকার একটা বাড়ি নিয়ে নাকি মামলা চলছে?
সন্ধ্যানীড় নিয়ে। সব জানি। এখন মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। তবে স্যার বাড়িটার খুব বদনাম আছে। বাড়ি ফেলে রাখলেই ভূতপ্রেতের আখড়া হয়। বুঝি না, সায়েবের কেন এত জিদ!
আপনি কখনও ঢুকেছেন ও বাড়িতে?
নন্দবাবু হাসলেন। আমার মাথা খারাপ হয়েছে? দিনদুপুরেই ওই হানাবাড়ির। কাছ ঘেষে না স্থানীয় লোকেরা। তাছাড়া দরজায় তালা বন্ধ। আদালতের হাতে। বাড়িটার জিম্মা। পুলিশ আর ভূত উভয়কেই মানুষ ভয় করে স্যার!
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। ঠিক বলেছেন! বলে বাইনোকুলারে সম্ভবত কোনও পাখি দেখতে থাকলেন।
নন্দবাবু ঝাড়ুদারনীকে তম্বি করতে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, অনবরত কোনও না-কোনও গাছে হলুদ পাতা খসে পড়ছে। শীতের হাওয়া এই উঁচুতে বেশ জোরে বইছে। কাজেই বেচারির দোষ কী? একটু পরে নন্দবাবু আবার আমাদের সঙ্গে গল্প করতে এলেন। বরমডিহিতে একসময় বাঙালিদের কত রবরবা ছিল, কত দাপট ছিল এবং কোন পুজোয় কত ধুমধাম হত, এইসব নিয়ে বকবক করে চললেন।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল তাঁর কথা শুনছিলেন। বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনার সায়েবের দাদা শচীনবাবু–
বৈমাত্রেয় স্যার! সেইজন্যেই তো এই মামলা মোকর্দমা!
শচীনবাবু আর এখানে আসেন না?
কই, তাকে তো অনেক বছর এখানে আসতে দেখি না। ওই বাড়িটা নিয়ে মামলা খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু আমি তো স্যার, বাড়িটার চেহারা বরাবর একইরকম দেখছি। সায়েবের বাবার তৈরি বাড়ি। কখনও-সখনও কলকাতা থেকে বড়সায়েবের লোকজন এসে থাকত দেখেছি। কিন্তু ভূতের বদনাম ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি।
এই বাড়িটা হিলটপ–দেখলাম তিন বছর আগে তৈরি হয়েছে। আপনি কি গোড়া থেকেই কেয়ারটেকারের কাজ করছেন?
না স্যার! আমি আমার সায়েবের ব্রাঞ্চ অফিসে চাকরি করতাম। বছর দুই হয়ে এল, সায়েব আমাকে এই কাজ দিয়েছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমরা একটু বেড়িয়ে আসি। মিঃ মুখার্জি সম্ভবত সন্ধ্যার আগে পৌঁছুতে পারবেন না। আমরা তার আগেই ফিরে আসব। বলে লনে হাঁটতে থাকলেন।
ওঁকে অনুসরণ করে বললাম, বাপস্! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। আপনিও কিন্তু আজকাল বড্ড বেশি কথা বলেন।
কর্নেল হাসলেন। তোমাকে বলেছিলাম, কথা বলতে বলতে দরকারি কথা বেরিয়ে আসে। মোটামুটি একটা ছবি পাওয়া গেল কি না বলো? তবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, কালো দৈত্যের হামলার দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর শ্যামসুন্দর এই বাংলোবাড়িতে এসেছিল এবং তরুণ মুখার্জির সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তারপর সেদিনই সন্ধ্যায় সে সন্ধ্যানীড়ের দোতলায় খুন হয়েছিল। আমরা দৈবাৎ ওই সময় গিয়ে পড়ায় ঝটপট একটা নাটকের দৃশ্য অভিনীত হয়।
তা ঠিক। তাতে হারাধন অন্যতম অভিনেতা। কিন্তু শচীনবাবুর ভূমিকায় কে ছিল?
তুমি নাকি উঠোনের জঙ্গলে একটা ছায়ামূর্তি দেখেছিলে বিদ্যুতের ছটায়?
হ্যাঁ ঠিকই দেখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বলেছিলাম।
তাহলে তিনজন ভিলেন, একজন ভিকটিম। ভিকটিম শ্যামসুন্দর। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, সে একটা ফাঁদে পা দিয়েছিল। কর্নেল গেট থেকে বেরিয়ে বললেন, ও সব কথা এখন থাক। আমরা প্রকৃতিকে কলুষিত করতে চাই না খুনোখুনির কথা বলে। চলো, নিষ্পাপ সৌন্দর্যের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করি।
প্রকৃতি এখন বেজায় হিংস্র। ভীষণ ঠাণ্ডা।
কর্নেল চুপচাপ বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেন। আমরা আজ সকালে এই জঙ্গলের উল্টোদিক হয়ে এসেছি। এদিকে পাথর নেই। গাছগুলো উঁচু। শীতে পাতা ঝরে প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে এবং ভেতরটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শুকনো পাতার স্তূপ সর্বত্র। পা ফেললেই বিচ্ছিরি শব্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম, এদিকে যাচ্ছিটা কোথায়?
একটা ঝরনা আছে এদিকে। ছোট্ট হলেও সুন্দর। তবে টুরিস্ট বা পিকনিকবাজদের ওটা পছন্দসই নয়। পাথর আর বালির ওপর দিয়ে ছটফটিয়ে চলা একফালি স্রোত ত্র। কর্নেল চোখ নাচিয়ে বললেন, ঝরনার ধারে পাথরের ফাঁকে এক বিরল প্রজাতির ক্যাকটাস দেখেছি। এসব ক্যাকটাস বালি পাথর এবং জল এই তিনটেই চায়। রোদ্দুরও চায় এরা–ওয়াটার ক্যাক্টি বলা হয়। সচরাচর মরূদ্যানেই এদের দেখা মেলে। তাই আমার অবাক লেগেছে।
ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে জঙ্গলটা। তারপর সতেজ গুল্মলতা চোখে পড়ল পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে। আবছা জলের শব্দ কানে এল। কিছুক্ষণ পরে ঝরনাটা দেখতে পেলাম। সুন্দর ঝরনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুধারে ঘন কাটাঝোপ। কর্নেল কাটাঝোঁপের সমান্তরালে ঝরনার ভাটির দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ভুল করছি না তো? দুপুরে দেখে গেছি। ছবি। তুলেছি। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি খুঁজে দেখি।
বলে কর্নেল কাঁটাঝোপ সাবধানে ফাঁক করে ঝরনার পিচ্ছিল পাথরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পা ফেলতে ফেলতে অদৃশ্য হলেন। বুঝলাম, ওইভাবে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই কর্নেল একা গেলেন। মিলিটারির লোক বলে কথা।
অবশ্য আমিও কিছুদিন মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলাম ওঁর পরামর্শে। কি খবরের কাগজের একজন রিপোর্টারের পক্ষে সেই ট্রেনিং কী কাজে লাগবে ভেবে পুরো কোর্স শেষ করিনি।
তবে কর্নেলের ওইভাবে পিছল পাথরে নেচে-নেচে চলা সম্ভবত পর্বতারোহীদেরও দুঃসাধ্য। সত্যিই যেন ঝরনার সঙ্গে ব্যালে নৃত্য করতে গেলেন।
গেলেন তো গেলেনই। আর ফিরে আসার নাম নেই। একবার ডাকলাম, কর্নেল!
কোনও সাড়া এল না। তখন কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। এখানে মাটিটা ভেজা এবং পাথরের ফাঁকে ঘন সবুজ ঘাস গজিয়েছে। বাঁদিকে কাটাঝোঁপের নীচে ঝরনা। ডানদিকে নিরেট পাথরের পাঁচিল মতো।
আচমকা সেই পাঁচিল থেকে দুটো লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। এক পলকের জন্য দেখলাম তাদের মুখে রাক্ষসের বা ভয়ঙ্কর কিছুর মুখোস।
ভিজে ঘাসে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পিঠে বসে একজন ছুরির ডগা ঠেকাল গলায়। অন্যজন মুখে টেপ সেঁটে দিল। চোখে রুমাল বাঁধল। তারপর পিঠমোড়া করে আমার দুটো হাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। পা দুটোও বেঁধে ফেলল। আমি আতঙ্কে হতবুদ্ধি হলেও চেঁচানোর চেষ্টা করিনি। কারণ গলায় ছুরির ডগা।
ওই অবস্থায় তারা আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। কখনও টের পেলাম চড়াইয়ে উঠছি, কখনও বুঝলাম ঢাল বেয়ে নামছি। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কতক্ষণ পরে একখানে আমাকে মড়ার মতো নামিয়ে রেখে একজন চাপা স্বরে বলল, একটু পরে রাস্তা পেরোতে হবে। এখনও পিকনিকওয়ালাদের গাড়ি যাচ্ছে।
এখানেই শেষ করে দে না খুদে টিকটিকিটাকে।
নাহ্। বুড়ো টিকটিকিটার সঙ্গে রফা করতে হলে এটাকে এখনও জ্যান্ত রাখতে হবে। ও ব্যাটা এক ঘুঘু। মালের হদিস ও ব্যাটা ঠিকই জানে।
বুঝতে পারলাম, কর্নেলের ওপর আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।