শত্রুপক্ষ
সকালেই অরূপার গলা পাওয়া গেল।
সে কী যেন বলছে। বেশ জোরে জোরে। কিছুটা তিরস্কারের ঝাঁঝ আছে কথায়।
সাধারণত এত সকালে কেউ বাড়িতে জোরে কথা বলে না। তিরস্কার তো নয়ই। জোরে কেউ কথা বললেই সে রেগে যায়।
তার তো বাড়িতেও থাকার কথা না। স্কুলে চলে যাওয়ার কথা।
আজ স্কুলে গেল না কেন তাও বুঝতে পারছি না।
সকাল আটটার আগে আমার সাধারণত ঘুম ভাঙে না। শীতের সকাল দেখতে দেখতে বেলা হয়ে যায়। অরূপার মর্নিং স্কুল। কখন সে স্কুলে বের হয়ে যায় টেরও পাই না। কারণ নিঃশব্দে অরূপা সিঁড়ি ধরে নামে। চা করে এবং খায়। তার এই সকালে বের হয়ে যাওয়ার দরুন কারও বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়, কিংবা ঘুম ভেঙে যাক, সে চায় না। অরূপার সহজে স্কুল কামাইও করে না। শরীর খারাপ হলে সে আগেই জানিয়ে দেয়, জ্বরজ্বালা যাই হোক না, স্কুলে যে সে যাচ্ছে না জানতে আমার অসুবিধে হয় না।
সে ইংরেজির শিক্ষিকা। সে মনে করে ছাত্রীদের সম্পর্কে তার আলাদা একটা দায় আছে।
এমনিতেই স্কুলে ইংরেজি পড়ানো নিয়ে সরকার যেভাবে বিরূপ হয়ে উঠছে এবং সরকার যেভাবে স্কুল থেকে ধীরে ধীরে ইংরেজি তুলে দেবার তালে আছে তাতে সে ক্ষুব্ধ। গোড়াতে ইংরেজি পড়িয়ে যাদের শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না, ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি পড়িয়ে তাদের কতটা উপকার হবে অরূপা বুঝতে পারে না।
অরূপার এখন শত্রুপক্ষ, সরকার।
ইংরেজি তুলে দেওয়ার বিষয় ছাড়া তার যেন আর কোনও অভিযোগ নেই।
আবার অরূপার গলা পাওয়া গেল।
শত্রু, সব শত্রু।
আমি সব শুনতে পাচ্ছি।
কে শত্রু? সরকার, না আমি, ঠিক বুঝতে পারছি না। রেগে গেলে তার মুখে এক কথা, জানা আছে—সবাই একরকম। তুমি সাধু সেঝে কাঁহাতক আর জ্বালাবে।
সংসারে এমনই বুঝি হয়। অরূপার মান-অভিমান বোঝাও ভার। কেন যে হঠাৎ হঠাৎ বিরূপ হয়ে যায় তাও বুঝি না।
আজ এমন শত্রুপক্ষকে নিয়ে পড়েছে, যে স্কুল পর্যন্ত কামাই করতে বাধ্য হয়েছে। কাজের মেয়েটিকে বলছে, দ্যাখ তো এবার এল কিনা।
না, আর শুয়ে থাকা নিরাপদ নয়। সামান্য জটিলতা থেকে কীভাবে যে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়, এবং একমাত্র আসামি বলতে এই মহাপুরুষটি, ঠিক অভিযোগের অজুহাত শেষ পর্যন্ত আমার উপরই বর্তাবে।
বললেই হল, তুমি শুয়ে থাকতে পারলে! বাড়িতে কত বড় সর্বনাশ, আর তুমি শুয়ে শুয়ে মজা উপভোগ করছ, তুমি মানুষ না অপদেবতা!
কাজের মেয়েটি বোধহয় অরূপার কথায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, তা যে কোনও কারণেই হোক অরূপা চেঁচাচ্ছে, তোকে কী বললাম, কাকটা আবার এল কিনা দ্যাখ।
না, মারাত্মক কিছু নয়। সামান্য একটা কাক। আজ তবে একটা কাক নিয়ে অরূপা দুশ্চিন্তায় ভুগছে, স্কুলে ইংরেজি পড়ানো নিয়ে নয়।
আড়মোড়া ভেঙে লেপ-টেপ সরিয়ে উঠে পড়লাম। ডাকলাম, এই লক্ষ্মী, লক্ষ্মী চা দে।
ঘুম থেকে উঠে আমার এক কাপ চা চাই। চা না হলে শরীরের জড়তা কাটে না। শুতে শুতে রাত বারোটা হয়ে যায়। পড়াশোনার বাতিক থাকলে যা হয়। এখন বদ অভ্যাসটি এমন হয়েছে যে একটু সকাল সকাল শুলে রাত একটা দুটোর আগে ঘুম আসে না।
কিন্তু কারও কোনও সাড়া পেলাম না।
খাট থেকে নেমে চটিতে পা গলাতে গেলাম।
নীচে সাড়া নেই কেন, এমন তো হয় না!
শালটা গায়ে জড়িয়ে বেশ জোরেই হাঁকলাম, আমার চা, চায়ের কী হল?
নীচ থেকে ঝাঁজের গলা, রাখো তোমার চা, এই লক্ষ্মী, খবরদার চা-ফা এখন হবে না। তোর কাজ তুই কর—যা গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে থাক। এলেই ঢিল ছুঁড়ে মারবিশেষের কথাটা আমাকে না কাকটাকে উদ্দেশ্য করে বুঝতে পারলাম না।
বাড়িটার কথা এবারে বলা যাক।
বাড়িটা আমার দোতলা। উপরতলায় থাকি। নীচে বসার ঘর, ডাইনিং হল, কিচেন, সামনের খোলা বারান্দায় একটি বোগে ভেলিয়ার গাছ ঢাউস একটি টবে ডালপালা মেলে অজস্র ফুল নিয়ে ফুটে আছে। আমার পড়ার বাতিক, আর অরূপার গাছ লাগাবার বাতিক। আপাতত এই সকালে আমি উপরে, ও নীচে।
মানুষ নানারকমের দুশ্চিন্তা নিয়ে বাস করতে এমনিতেই একটু বেশি ভালোবাসে। দুশ্চিন্তা না থাকলে মানুষের বেঁচেও সুখ নেই। তাও সামান্য একটা কাক, সাতসকালে কাকটা এমন কী উপদ্রব শুরু করল যে অরূপার এত মাথা গরম।
আর অরূপা এও জানে সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতের কাছে চা না পেলে মেজাজ গরম হয়ে যায়। অথচ কারও সাড়া নেই—কী করছে ওরা?
খেপে গিয়ে বললাম, কাকটা কি তোমার মাথার চুল ঠুকরে তুলে নিচ্ছে। কোনও সাড়া নেই।
চুল ঠুকরে তুলে নিলেই দেখছে কে। মরেছি কি বেঁচে আছি, তাও কি কেউ দ্যাখে। এ বাড়িতে কারও তো কুটো গাছটি নেড়ে দেখার অভ্যাস নেই। মুখে মারিতং জগৎ–কখন থেকে শুধু চা আর চা করছে। নীচে এসে দ্যাখ, শুধু হুকুম করে খালাস। এমন লক্ষ্মীছাড়া বাড়ি—কাকটাও টের পেয়েছে।
এরপর আর উপরে চায়ের আশায় বসে থাকা ঠিক না। নিশ্চয়ই বাড়িতে কাকটার উপদ্রবে সবাই তটস্থ। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নীচে নামতেই হল, নীচে ঠান্ডা একটু বেশি।
নীচের করিডোরে উঁকি দিলাম। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ডাইনিং স্পেস পার হয়ে খোলা বারান্দায় চোখ গেল—দেখি অরূপার হাতে একটা লম্বা ঝুল ঝাড়ার বাঁশ-রণ-রঙ্গিনী চেহারা।
লক্ষ্মী ধারে কাছে কোথাও নেই।
হলটা কী তোমাদের। সক্কালবেলায় শেষে একটা কাকের পেছনে লেগেছ!
লাগব না! গাছটাকে কী করেছে দ্যাখো।
খোলা বারান্দার টবের সেই বোগেনভেলিয়া গাছটা—শহরের বাড়ি-ঘরে যা হয়, জায়গা কম, অথচ ইচ্ছে অনেক—যেখানে যতটুকু ফাঁকা জায়গা, নানা গাছ আর ক্যাকটাসে ভর্তি। টবটায় বোগেনভেলিয়ার ঝোপ-শীত বসন্তে যেন ফুলের দ্যাখরে বাহার। তবে বছর দুই-তিন আগে গাছটা তেমন ফুল দিচ্ছিল না। গাছ বুড়ো হলে এমনই হয় বলেছিলাম।
আমার দিকে তাকিয়ে অরূপা শুধু বলেছিল, তোমার মুণ্ড হয়।
বুঝতে পারলাম অরূপা আমার সিদ্ধান্ত মানতে রাজি না।
সে সার এনে গুঁড়ি খুঁড়ে এবং গত বর্ষার কিছুটা ডালপালা হেঁটে গাছটাকে আবার সতেজ করে তুলেছে। এটা যে বুড়ো গাছ বোঝাই যায় না এখন। ফুলও এসেছে কেঁপে। গোটা বারান্দা এবং বাড়ির আলাদা সৌন্দর্য গড়ে তুলেছে গাছটা। বাড়িটার কথা কারও মনে থাকলেও, একবার দেখলে গাছটার কথা কেউ ভুলতে পারে না। গেরস্থের রুচিবোধের প্রশংসা করতেই হয়।
যেন এই বোগেনভেলিয়া গাছটা বাড়ির প্রাণ। আর কারও কাছে না হলেও, অরূপার বুঝতে কষ্ট হয় না।
এটা অরূপার স্বভাব। যেখানে যেটুকু ফাঁকা জায়গা সেখানেই ফুলের গাছ। পেছনের খালি জায়গায় রজনিগন্ধা, গন্ধরাজ, কাঠমালতী ফুলের গাছও লাগিয়েছে অরূপা। কামিনী ফুলের গাছটা লাগাবার সময় না বলে পারিনি—তুমি কি পাগল! কামিনী ফুলের গাছ কত বড়ো হয় জানো?
সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঝাঁজ-সরো তো, কাজের নামে অষ্টরম্ভা, কেবল পেছনে লাগা। আমাকে তুমি শেখাতে এস না।
তা অবশ্য ঠিক, সে জানতেই পারে, কারণ বি. টি কলেজের একটা কামিনী ফুলের গাছের নীচেই অরূপার সঙ্গে প্রথম আলাপ আমরা তখন বিটি ট্রেনিং, কলেজের আলাদা ছাত্রাবাসে থাকি। একসঙ্গে কমিউনিটি ডাইনিং হলে খাই, ক্লাস করি একই হলঘরে। ডাইনিং হলে যেতে, ক্লাসরুমে যেতে, এমনকি ক্যান্টিনের রাস্তায় যেতেও গাছটা পড়ে। গাছ কত বড়ো হয়, আমাদের সংসারই তার প্রমাণ। গাছ কত বড়ো হয় বলা বোধহয় খুবই অনুচিত কাজ হয়েছে।
আসলে গাছটার নীচে দাঁড়িয়েই সে ডেকেছিল—এই যে শুনুন।
আমাকে না অন্য কাউকে, বুঝতে পারিনি। তবু ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে গেলে হাতের ইশারায় ডেকেছিল, শুনুন না।
মাসখানেক হল ছাত্রাবাসে তখন আমরা আছি। একজন সুন্দরী যুবতী ডাকলে এমন কোন মহাপুরুষ আছে যে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে! আমিও পারিনি। যতদিন যতবার সে আমার খোঁজ করেছে, ততবারই দেখেছি, সে দাঁড়িয়ে আছে কামিনী ফুলগাছটার নীচে। বর্ষা আসতে না আসতেই টের পেলাম, গাছটা আর একা নেই, ডালপালা ঝাঁকিয়ে অজস্র রেণুর মতো সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে। ফুলের সুঘ্রাণে চারপাশটা ম-ম করছে।
অবশ্য সেসব কবেকার কথা—বিশ-বাইশ বছর আগেকার স্মৃতি। অরূপা আর কামিনী ফুলের গাছটা কেন যে আমার স্মৃতিতে এখনও সমার্থক হয়ে আছে বুঝতে পারি না।
সে যাই হোক বাড়িটা করার পর যেখানে যেটুকু ফাঁকা জায়গা ছিল সব শান বাঁধানো হয়ে যেতেই অরূপা ক্ষেপে গেল—এটা কী করলে! একটু মাটি নেই।
চারপাশের পাঁচিল আগেই তোলা হয়ে গেছে। চারকাঠা জমি, জমির এদিক ওদিক কিছু ফাঁকা জায়গা রাখলে যেন ভালোই হত। গৃহপ্রবেশের দিনই অরূপা বলল, বাড়িতে না থাকলে এমনই হবে জানতাম। আমার মতামতের কোনও দাম নেই।
তারপরেই অভিযোগ, একটু মাটি রাখলে না, ফুল ফলের গাছ না লাগালে বাড়িটা কখনও বাড়ি মনে হয়!
কথাটা মিছে না। কিন্তু অরূপা বোঝে না—আগাছা সাফ করার লোক শহরে কম। বৃষ্টিবাদলার দিনে এত বুনো ঘাস জন্মায় যে সাফ করে কুল করা যায় না। পোকামাকড়ের উৎপাতও থাকে। এসব আছে বলেই তিনকাঠা জমিতে বাড়ি করে বাকি ফাঁকা জায়গা ইট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলেছি। অরূপার আগ্রহও বজায় থাকবে, তাকে বলেছিলাম, তোমার জন্য সুন্দর সব টব বানিয়ে দেব। যত পার ফুলের গাছ লাগিও। এবং অরূপার ইচ্ছেতেই বারান্দায় বিশাল ঢাউস টব, পেছনেও আছে ফুলের টব। এবং অরূপার ইচ্ছেতেই মাটি ফেলে কিছুটা জায়গা করে দেওয়া হল—কোথাও সে মরসুমি ফুলের চাষ পর্যন্ত করেছে।
কিন্তু বারান্দা এবং পেছনের ঢাউস দুটো টব তাকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে। কী লাগানো যায়! অর্থাৎ এমন গাছ লাগাতে হবে—যাতে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ে অথচ গাছের ডালপালায় বাড়িটা না ঢেকে যায়।
এরপর বারান্দায় ঢাউস টবটায় সে কোথা থেকে সব ক্যাকটাস এনে লাগাতে থাকল। ক্যাকটাসগুলোর কপাল খারাপ—বছরখানেক যেতে না যেতেই অরূপার কেন যে মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর ছিমছাম বাড়িটায় ক্যাকটাস বেমানান। এটা তার আরও মনে হয়েছিল চন্দননগরে আমার কাকার বাড়ি গিয়ে। বাড়িটা ঘুরে দেখল, বোঝাই যায় তিনি খুবই শৌখিন মানুষ, তাঁকে তার নিজের বাড়িটা না দেখালেই নয়, এবং তিনি এসে বললেন, খোলা বারান্দার টবে ক্যাকটাস কেন? বাড়ির সামনে ক্যাকটাস লাগাতে নেই। বরং এখানে একটা বোগেনভেলিয়া লাগিয়ে দাও। ফুল ফুটলে বাড়িটার এক আশ্চর্য আকর্ষণ তৈরি হয়।
বোগেনভেলিয়া লাগাবার সময় তার সতর্কতা ছিল প্রখর। অবশ্য শুধু বোগেনভেলিয়া কেন, সব ব্যাপারেই। ভালোবেসে একজন বেকার মানুষকে বিয়ে করার পর থেকে সে চারপাশের কীটপতঙ্গ সম্পর্কে বড়ো সজাগ ছিল। সজাগ ছিল বলেই আমার বাড়ি হয়েছে, কৃতী মানুষ হয়েছি—ছেলেরা জয়েন্ট দিয়ে কৃতী হবার মুখে।
নার্সিংহোম থেকে বের হচ্ছি, সবই অবশ্য কবেকার কথা, বৃষ্টি পড়ছিল, অরূপা ডাকল, এই যে শোনো—সেই গলা যেন, সেই কামিনী ফুলের গাছটার নীচে সে আমায় যেভাবে ডাকত। কোলে তার নবজাতক, মহীয়সীর মতো তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।
চলে যাচ্ছ, পাজিটা যা জ্বালায়! বললে না তো কী রকম হয়েছে দেখতে!
ভালোই তো! বেশ সুন্দর!
চলে আসছি, ফের ডাকল, এই যে শোনো।
বলো।
এতদিন ছিল অরূপা, এখন একেবারে রাজমহিষী।
অর্ডার—
যাবার সময় রথের মেলা থেকে একটা কামিনী ফুলের গাছ নিয়ে যাবে।
গাছ!
হ্যাঁ চারাগাছ। বলেই আমার কোলে তুলে দিয়ে বলল, একটু আদর কর না। লজ্জা এবং সঙ্কোচ দুই তখন আমাকে কাতর করেছে। কী যে করি!
কামিনী ফুলের গাছটা না থাকলে, তার ফুল না ফুটলে, তার সুঘ্রাণ না ছড়ালে সে আমরা কেউ কাউকে চিনতামই না।
গাছটা লাগানো খুবই জরুরি।
কোথায় লাগাব?
আমি যাই। দুজনে লাগাব। অরূপার দুচোখ দুষ্টুমিতে ভরা।
কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে দুজনের মিলিত সংগ্রামে বিশ-বাইশ বছরে এতদূরে আসা কম মানুষের সৌভাগ্যেই ঘটে। এসবের জন্য সব কৃতিত্বই অরূপার প্রাপ্য। বাড়ির গাছপালা সম্পর্কে যেমন সজাগ, ছেলেদের সম্পর্কেও তেমনি। আসলে অরূপা বোধহয় ভেবেছে, জীবনটাই ফুলের বাগান। তার জন্য জল চাই, সার চাই, আগাছা বেছে দিতে হয়। এই আন্তরিকতাই আজ আবার তাকে নতুন একটা বিপাকের মুখে ফেলে দিয়েছে। সেটি একটি সামান্য কাক।
আরে ছুটছ কেন, পড়ে যাবে তো। ঝুলঝাড়ার বাঁশ নিয়ে ছুটতে গেলে আমার এমনই মনে হল।
সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঝাঁজ-সরো, সরো, সব শত্রু, শত্রু শত্রু। এই তো বড়োটা হোস্টেলে গেছেন-ইঞ্জিনিয়ারিং আর কেউ পড়ে না। বাড়ির কথা কারও মনে থাকে না। একটা চিঠি পর্যন্ত নেই, বাড়ির কারও হুঁশ আছে।
আরে গেছে, চিঠি দেবে। পোস্টঅফিসেরও তো গণ্ডগোল হতে পারে। ছেলেমানুষ।
বাড়ির সবাই ছেলেমানুষ? আমার হয়েছে মরণ—
কাকটা কোথায় জানি না। কথার সোজা জবাব দিচ্ছে না। বাঁকা-ত্যাড়া জবাব রাগ হয় না! সক্কাল বেলা, এক কাপ চা পর্যন্ত নেই। লক্ষ্মী কলপাড়ে—কী করছে। সেখানে?
যাই হোক কিছুটা বেহায়ার মতোই বললাম, কাকটা কোথায়? কী ক্ষতি করছে তোমার?
আমার মাথা চিবোচ্ছে! তোমার তাতে জল ঢালতে হবে না।
ঝুলঝাড়ার বাঁশটা হাতে নিয়ে অরূপা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখে জ্বালা। যেন কাকটা এসে কখন বোগেনভেলিয়া গাছটার বসবে এবং সে তাকে আড়াল থেকে মারবে সেই অপেক্ষায় আছে। এতক্ষণে লক্ষ্মী আমার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে গেছে—এমনকী আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি তাও খেয়াল নেই। আমিও অরূপার এধরনের ছেলেমানুষি ক্ষোভে মজা পাই—পৃথিবীতে সবকিছু এত অনিত্য অথচ তার মধ্যে অরূপার হাবভাব যেন, বাড়িটা থেকে সে কোনওদিনই নড়বে না, তার একই রকম বয়স থাকবে। একই দুর্ভাবনা থাকবে। একই আন্তরিকতা থাকবে পৃথিবীতে মেয়েরা বোধহয় সব কিছু এতটা চিরস্থায়ীভাবে বলেই সামান্য একটু এদিক ওদিকেই তারা সহজে ভেঙে পড়ে।
যাই হোক আমি বললাম, কাকটা কী ক্ষতি করেছে তোমার?
কী আবার করবে! কাল সারাদিন গাছটার এসে ঝাপটাচ্ছে। গাছটার কী কালশত্রু রে বাবা!
ঝাপটালে ক্ষতির কী?
ক্ষতি! আমার মুণ্ড। এই লক্ষ্মী, শিগগির ওদিকে যা।
পাঁচিলটার পাশে গিয়ে কামিনী ফুল গাছটার আড়ালে বসে পড়।
তা হলে কাকের প্রতিপক্ষ এখন দুজন। দুজন দু’দিক থেকে কাকটাকে জব্দ করবে বলে বসে আছে। আমি তৃতীয় পক্ষ হতে চাইলে গলায় আবার ঝাঁজ। তোমাকে দিয়ে হলেই হয়েছে!
কেন হবে না?
তোমাকে দেখলে কাকটা আরও বেশি মজা পাবে।
কেন মজা পাবে!
পুরুষমানুষের নির্বুদ্ধিতা ওরা ঠিকই টের পায়।
তার মানে?
মানে আর কী? অতশত বলতে পারব না।
কাকটা কি মেয়ে কাক?
তবে আর বলছি কী!
কী করে বুঝলে?
বা রে, বুঝব না! কাল থেকে গাছটার ঝাপটাচ্ছে আর যাবার সময় ঠোঁটে ডাল নিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
ডাল নিয়ে উড়ে যাবে কেন? কাকটার কি শত্রুতা আছে তোমার সঙ্গে?
কী জানি, কার কী শত্রুতা কখন কীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আমি কী করে বুঝব!
আর সেই সময় ঠিক উড়ে এল কাকটা। উড়ে এসে বসল পাশের বাড়ির কার্নিশে। গাছটার সঙ্গে তবে সত্যি শত্রুতা আছে কাকটার। গাছটাকে প্রায় ন্যাড়া করে দিয়েছে। আরও অবাক, কিছু বোঝার আগেই গাছটা থেকে ছোঁ মেয়ে একটা ডাল মুখে নিয়ে উড়ে চলে গেল। দুজন প্রতিপক্ষ ঠায় দাঁড়িয়ে। কিছুই করার বিন্দুমাত্র সময় পেল না।
কাকটা উড়ে যাচ্ছে। ডালের সর্বত্র লাল সাদা ফুল। হালকা সরু তারের মতো ফুলের ডাল-বড়ো হালকা, সহজেই মট করে ভেঙে নেওয়া যায়।
অরূপা আর অপরূপা থাকল না। সেই এক অরূপা হয়ে গেল। হা-হা করে উঠল—দেখলে তো! দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছ, একবার তেড়ে গেলে না!
আমি বললাম, অরূপা বুঝছ না কাকটা বাসা বানাবে। নিতে দাও না।
বাসা!
হ্যাঁ তাই। মাঘ-ফাল্গুন মাসে এরা বোধহয় গর্ভবতী হয়।
তাই বলে আমার অমন সুন্দর গাছটাকে ন্যাড়া করে দেবো ফুলের ডাল নিয়ে উড়ে যাবে! আর কোথাও কিছু পেল না।
সবাই তো সুন্দর ফুলের ডালপাতা দিয়ে বাড়িঘর সাজাতে চায়। কাকটার দোষ কোথায়?
অরূপা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, কাকের আবার সুন্দর অসুন্দর কী! তুমিও যেমন। আসুক ফের, দেখাচ্ছি মজা!
তখন কাকটা পাশের বাড়ির নিমগাছটার বসে আছে। ঠোঁটে ফুলের ডাল। উড়বার জন্য ঘাড় বাঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, নিমগাছের ডালেই বোধহয় বাসা বানাচ্ছে।
অরূপা বলল, তাড়িয়ে দিয়ে এস না। মনে হয় ওই গাছটাতেই থাকে কাকটা। দূরে কোথাও তাড়িয়ে দিলে পথ ভুল করে আসতে পারবে না। যাও না গো!
এমন অনুরোধ উপেক্ষা করি কী করে! নামতে যাব, দেখি কাকটা আবার উড়তে শুরু করেছে। এখন পাঁচিল না টপকালে চলবে না। হাতে ইটের টুকরো হুস করলেই কাক উড়ে পালায় জানি। আর তখনই দেখি কাকটা ফের উড়তে শুরু করেছে। ঠোঁটে ফুলের ডাল। উড়তে উড়তে পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছের ডালে বসে গেল।
অরূপাকে বললাম, কাছে কোথাও কাকটা বাসা বানাচ্ছে। বাসাটা ভেঙে দিতে পারলে কাকটার উচিত শিক্ষা হবে।
অরূপাও বলল, চল তো দেখি। লক্ষ্মীর হাতে এখন ঝুল ঝাড়ার বাঁশ, সেও লাফিয়ে বাড়ির পেছনে ঢুকে গেল।
কিন্তু হাতে একগাদা কাজ। সক্কাল বেলায় একটা কাকের পিছ ধাওয়া করলে, কত দূরে নিয়ে যাবে কে জানে! মনে মনে খুবই বিরক্ত। কিন্তু সংসারের শান্তি বলে কথা, অরূপার অনুরোধ উপেক্ষাও করতে পারছি না। বললাম, আমি দেখছি, ডালটা নিয়ে কোথায় যায়—লক্ষ রাখছি।
এতক্ষণে মনে হল, অরূপা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে। কাকটাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলে কিংবা তার পিছু ধাওয়া করলে এদিকে আসতে আর সাহস পাবে না। চুপিচুপি তাড়া করতে গিয়ে দেখি বাড়ির পেছনে কামিনী ফুলের গাছটার কাকটা নিশ্চিন্তে উড়ে এসে বসেছে। আর দেখলাম, গাছটার মাথায় পরিপাটি করে সে তার বাসা বানাতে ব্যস্ত। বোগেনভেলিয়ার ডাল দিয়ে সে তার বাসস্থান গড়ে তুলছে। পাশে আর একটা কাক—বাসাটা ভেঙে না দিলে সমূহ বিপদ। এত কাছে বাসা বানাবার উপকরণ থাকতে কাকটা দূরে উড়ে যাবে ভাবাই যায় না। সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে ঝুল-ঝাড়ার বাঁশটার খোঁজ করতেই অরূপা বলল, কী ব্যাপার? পেলে?
বললাম, এই লক্ষ্মী, দে তো। পেয়েছি।
অরূপা বলল, কী পেয়েছ?
বাসাটা।
কোথায়?
এতক্ষণে লক্ষ্মী এসে বাঁশটা আমার হাতে তুলে দিয়েছে।
আমি ছুটে বাড়ির পেছনটায় বের হয়ে গেলাম। পেছনে অরূপা কেবল বলছে, কোথায় যাচ্ছ।
আরে, তোমার সেই কামিনী ফুলের গাছটায় কাকটা বাসা বানাচ্ছে। তোমার বাড়িতেই তার সংসার।
অরূপা থমকে গেল। তারপর কী ভেবে সঙ্গ নিল। যেতে যেতে বলল, বাঁশটা আমাকে দাও।
অরূপা চাইতেই পারে। এত জ্বালিয়েছে, তার সাধের ফুলগাছ ন্যাড়া করে দিয়েছে কাকটা—তাকে শায়েস্তা করার অধিকার তারই।
আর কেবল প্রশ্ন, কোথায়, কই দেখছি না তো!
গাছটার নীচে নুয়ে কিছুটা এগিয়ে ডালপালার মধ্যে মাথা গুঁজে কানে কানে বললাম, ওই দ্যাখো গাছের মাথায়।
অরূপা কী দেখল কে জানে! তারপর আমার হাত থেকে ঝুল-ঝাড়ার বাঁশটা কেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
ছোটো পুত্রও তখন নেমে এসেছে, কেবল বলছে, কী হয়েছে বাবা?
আমি বললাম, কিছু না।
শুধু জোরে ডাকলাম, কী হল অরূপা, দাও।
না, এবারেও সাড়া পাওয়া গেল না।
ভিতরে ঢুকে বললাম, দাও। কোথায় রাখলে বাঁশটা!
অরূপা কিছুটা ক্ষোভের গলায় বলল, নিজের কাজ কর গে। ওটা আছে, থাক না। বাড়িতে গাছ থাকবে, পাখি থাকবে না, সে কী করে হয়! বলে মুচকি হেসে সিঁড়ি ধরে সে বাঁশটা নিয়ে উপরে উঠে গেল।
ছোটো পুত্রও সিঁড়ি ধরে মাকে অনুসরণ করছে, আর কেবল বলছে, কী হয়েছে মা–বাঁশটা দিয়ে বাবা কী করবে?
কী করবে তিনিই জানেন। তোমার বাবা তো ওইরকমেরই!