শতাব্দী গাছ
সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ জানতে চেয়েছে তার সৃষ্টির কথা৷ শুধু তার নয়, এই পৃথিবী, মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা—প্রাণ সৃষ্টির কথা৷ নানান রকম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে ফিরে যেতে চেয়েছে আদিম ইতিহাসে৷ ইতিহাস, ধরা দিতে চায়নি; মানুষ যত আধুনিকতার পথে এগিয়েছে, তত দূরে চলে গেছে, তার অতীত৷ কিন্তু সত্যি কি আমরা জানতে চাই? আমাদের পক্ষে যতটা ভাবা সম্ভব, তার থেকেও সহস্র কোটিগুণ বড় আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, আমরা সত্যিই কি মানে খুঁজতে চাই, আমাদের অস্তিত্বের?
এ গল্পটা শুধুমাত্র সায়েন্স ফিকশন নয়—এ হল সত্যিকারের ভয়ের গল্প৷ এই মুহূর্তে আর্থার সি ক্লার্কের একটা কথা মনে পড়ছে— ‘‘Two possibilities exist, either we are alone in the Universe or we are not. Both are equally Terrifying.’’
হয় আমরা এই মহাবিশ্বে একা, নতুবা নয়—দুটোই সমান ভয়ঙ্কর৷
বেস ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে একবার উপরে তাকালেন ডক্টর স্টারলিং৷ হেলিকপ্টারের গমগমে আওয়াজটা ধীরে-ধীরে মিলিয়ে আসছে, চারপাশে তাকালে অন্তত জনা পনেরো বন্দুকধারী গার্ডকে চোখে পড়ছে৷ ডক্টর স্টারলিংকে বাইরে আসতে দেখে তাদের একজন কপালে হাত ঠেকিয়ে অভিবাদন জানাল৷ স্টারলিং হাসলেন৷ মিলিটারির লোকজনকে তিনি সাধারণত এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসেন৷ নীচে তাকালে মনে হয় যেন চারপাশ জুড়ে অন্তহীন মরুভূমি৷ অথচ এটা মরুভূমি নয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একপ্রান্তে দক্ষিণ নেভাডার কোল জুড়ে একটা মিলিটারি বেসক্যাম্প৷ আসল নাম ৪৮০৮ নর্থ৷ পোশাকি নাম এরিয়া ৫১৷ এখানে আসার আগে জায়গাটা সম্পর্কে স্টারলিং প্রায় কিছুই জানতেন না৷ এখানে যে ঠিক কী ধরনের কাজ হয় তা আমেরিকার কিছু উঁচুতলার রাজনৈতিক নেতা আর মিলিটারি পারসোনেল ছাড়া আর কেউ জানে না৷ সাধারণ লোকজনকে এটুকুই বলা হয় যে এখানে নবনির্মিত অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের টেস্টিং চলে৷ স্বভাবতই এর চারপাশে জনবসতির চিহ্ন মাত্র নেই৷ তিনদিন আগে জরুরি তলবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে স্টারলিংকে৷ চিঠিটা পেয়ে প্রবীণ বিজ্ঞানী নিজেও খানিকটা হতবাক হয়েছিলেন৷ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই৷ তিনি মহাকাশ বিজ্ঞানী, নাসার বিভিন্ন রিসার্চ সেন্টারে দীর্ঘদিন সিগন্যাল এনালসিস এর কাজ করেছেন৷ বছর তিনেক হল প্রায় সমস্ত কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন বাড়িতে ফুলের বাগান করবেন বলে৷ এ শখটা তাঁর বহুদিনের৷ প্রথমে বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই আসতে মন চায়নি তাঁর৷ বলেছিলেন, ‘আমার তো বয়স হয়ে গেছে, মহাকাশ বিজ্ঞানে আর তেমন আগ্রহও পাই না, আমার ছেড়ে দাও ভাই৷’ কিন্তু ভবি ভুলবার নয়৷ অগত্যা প্রিয় ফুলের বাগান আর পরিবার ছেড়ে তাঁকে আসতে হয়ছে জনহীন এই মিলিটারি এয়ারবেসে৷ বাইরের খোলা হাওয়ায় কয়েকটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে এলেন স্টারলিং৷ ঠিক সামনেই একটা এলিভেটার, এটায় করে মাটির প্রায় একশো মিটার নীচ অবধি যাওয়া যায়৷ সমস্ত রিসার্চের কাজই এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে হয়৷ মাটির নীচে যে এত ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন৷ এখানেও জনাপাঁচেক বন্দুকধারী মিলিটারি গার্ড চোখে পড়ে৷ এলিভেটারে নীচে নামার পর থেকে মোবাইল নিজে থেকেই অকেজো হয়ে যায়৷ স্টারলিং মূল ল্যাবরেটরির দিকে পা বাড়ালেন৷
ল্যাবরেটরির ভিতরটা বেশ ছোট, প্রফেসর আগেই বলেছিলেন, বেশি লোকজন সাথে নিয়ে কাজ করাটা এই বয়সে আর ভালো লাগে না৷ তাঁর রিটায়ারমেন্টের পরে মহাকাশবিজ্ঞান বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে; সেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে তাঁর খানিকটা অসুবিধাই হয়৷ অবশ্য জেনারেল হেনরি লুকাস কাল নিজে তাঁর সাথে দেখা করে বলে গেছেন যে স্টারলিং- এর গবেষণার ব্যাপারে কোনওরকম আপস করা হবে না, যে মুহূর্তে যেটা তাঁর দরকার হবে সাথে-সাথে হেলিকপ্টারে হাজির করা হবে৷ যাই হোক, যে কাজের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীকে এতদূর উড়িয়ে আনা হয়েছে সেই প্রসঙ্গে আসা যাক৷
এরিয়া ৫১-এ আধুনিক অস্ত্রের গবেষণা চলে বলে মাঝে-মধ্যেই বিদেশি বিমান এসে হানাদারি করে যায় আশেপাশে৷ বছর কয়েক হল এই এলাকাটাকে হাইলি রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়ছে; বসানো হয়ছে আধুনিক রাডার, রেডিও টেলিস্কোপ৷ শত্রুপক্ষের যে কোনও বিমান দু-মাইলের ধারে কাছে এলেই সতর্ক হয়ে ওঠে সৈন্যরা৷ কয়েক সপ্তাহ হল টেলিস্কোপে একটা অদ্ভুত ন্যারোব্যান্ড রেডিও সিগনাল ধরা পড়ছে, দিনে দু-একবার ঠিক বাহাত্তর সেকেন্ডের জন্য স্থায়ী হচ্ছে সিগন্যালটা৷ তারপর আর ধরা যাচ্ছে না তাকে৷ এখানকার কর্মরত বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন যে ব্যাপারটা আশপাশের কোনও রেডিও থেকে ট্রান্সমিট হচ্ছে৷ এরপরেই ডাক পড়ে স্টারলিং-এর, তিনি কাজ হাতে নিয়ে প্রাথমিক কিছু গবেষণা করেই জানান যে বাহাত্তর সেকেন্ডের এই রেডিও সিগন্যাল পৃথিবীর কোনও রেডিও থেকে ট্রান্সমিট হচ্ছে না৷ হচ্ছে এই সোলার সিস্টেমের বাইরের কোনও গ্রহ থেকে৷ ব্যাপারটা জানাজানি হতেই স্টারলিং-এর সঙ্গে দেখা করেন খোদ জেনারেল হেনরি লুকাস৷ রেডিও সিগন্যালের উৎস কোথায় হতে পারে সেই নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হয়৷ অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা গুটি কয়েক বিজ্ঞানী ছাড়া আর কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি৷ যদি সিগন্যালের কোনও এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল অরিজিন থাকে তাহলে তার অবশ্যই কোনও অর্থ থাকবে৷ সেইটা খুঁজে বের করতেই ডাক্তার স্টারলিং-এর এখানে আসা৷ অবশ্য তার বাড়ির লোককে প্রায় কিছুই জানতে দেওয়া হয়নি৷
স্টারলিং চেয়ারে বসে একটা কাগজ হাতে তুলে নিলেন৷ কাগজের উপর থেকে নীচ অবধি লিস্টের মতো প্রচুর সংখ্যা লেখা আছে৷ যে কোনও রেডিও ট্রান্সমিটার প্রতি মুহূর্তে এরকম সংখ্যা আউটপুট দিতে থাকে৷ কাগজের একটা জায়গা লাল কালি দিয়ে গোল করা, একমাত্র সেখানে, নম্বরের সাথে-সাথে কতগুলো অ্যালফাবেট লেখা আছে৷ 6EQJ5111৷ এই সিগন্যালটাই ভাঁজ ফেলেছে পৃথিবীর বাঘা-বাঘা বিজ্ঞানীদের কপালে৷ এর উৎস কোথায়? মহাবিশ্বের ঠিক কোথা থেকে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে এই সংকেত? প্রায় দিন তিনেকের গবেষণায় এর অরিজিনের খানিকটা ধারণা করা গেছে৷ সাজিটেরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে অবস্থিত কোনও গ্রহ থেকে আসছে রেডিও সিগন্যালটা৷
দরজার কাছে খসখস শব্দ হতে স্টারলিং মুখ তুলে তাকালেন৷ তারপর একগাল হেসে বললেন, ‘এসো কেভিন, আজ হাতে বন্দুক নেই যে!’
কেভিন ভিতরে এসে মাথার টুপিটা খুলে টেবিলে রাখল৷ একটা রিভলভিং চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, ‘আপনি দেখছি মনস্থির করে ফেলেছেন৷’
‘কী মনস্থির করেছি বল তো?’
‘এলিয়েন যে আছে সেটা প্রমাণ করেই ছাড়বেন৷’
বিজ্ঞানীর ঠোঁটের এক কোনায় হালকা হাসি ফুটে উঠল, ‘হঠাৎ এরকম মনে হল?’
‘কেন? আপনিই তো বলেছেন ওই সিগন্যালটা আসছে ভিনগ্রহ থেকে৷’
‘সেটা আর নতুন কথা কী?’
‘মানে? আপনি বলছেন আগেও এরকম সিগন্যাল এসেছে?’
‘প্রতিদিন আসছে৷’
কেভিন আর কিছু বলল না৷ মাথা নামিয়ে নিল৷
‘তুমি জানতে চাও কেন আমি বলছি এই সিগন্যালের পিছনে এলিয়েন থাকলেও থাকতে পারে৷’
‘বোধহয়৷’
‘বেশ তাহলে শোন৷ ধরে নাও এই গোটা মহাবিশ্বটা হল একটা বিরাট বড় পুকুর৷ এবার তুমি তার মাঝে একটা ঢিল ছোঁড়, যেখানে ছুঁড়লে তার চারপাশের জল কাঁপতে থাকবে৷ কাঁপতে-কাঁপতে জলে হালকা ঢেউ উঠবে৷ সেটা চারদিকে এগিয়ে যাবে৷ আমাদের এই মহাবিশ্ব ঠিক পুকুরের মতোই৷ আর জলটা হল বায়ু৷ যখনই ঢিল ছুঁড়ে তুমি জলে ঢেউ তুললে, সাথে-সাথে একটা তরঙ্গ একদিক থেকে আর একদিকে ছুটে গেল৷ আমাদের গ্যালাক্সিতে সব থেকে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন, অর্থাৎ ভিনগ্রহীরা যদি আমাদের গ্রহে কোনও সংকেত পাঠাতে চায় তাহলে তারা হাইড্রোজেন লাইনেই পাঠাবে৷ হাইড্রোজেন লাইনের ভ্যালু প্রায় 1420 mhz৷ আমরা এখানে যে সিগন্যালটা পেয়েছি তার ফ্রিকোয়েন্সি 1420 mhz৷’
‘কিন্তু সেটা তো পৃথিবী থেকেও পাঠানো হতে পারে৷’
‘নাহ, এত হাই ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যাল এখানে ব্যবহার করা প্রহিবিটেড৷’
কেভিন দু-বার মাথা দুলিয়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করল৷ সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে গুলিয়ে গেছে৷ ডাক্তার স্টারলিং তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ‘এলিয়েনরা থাকলেই বা তোমার কী? তারা তো…’
কথাটা শেষ না করেই তিনি উঠে পড়লেন, তাঁর চোখে মুখে কেমন যেন স্তম্ভিত ভাব৷ তাঁকে হঠাৎ করে এরকম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে দেখে কেভিন খানিকটা চমকে গেল৷ সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রফেসর তাকে থামিয়ে দিলেন, মাথায় একটা হাত দিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘এখন এসো, আমার কিছু কাজ আছে৷’
কেভিন বেশি কিছু না ভেবে চলে গেল; এসব পাগলাটে খামখেয়ালি লোকেদের তার এমনিতেই পছন্দ হয় না৷ মুহূর্তে-মুহূর্তে এদের মন বদলায়; এখন আবার কী পাগলামি চেপেছে কে জানে৷ সে চলে যেতে প্রফেসার সামনের জায়ান্ট স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে পড়লেন, একটা অসম্ভব ব্যাপার মাথায় আসছে৷ যেখানে সিগন্যালের অরিজিন বলে ধরা হছে সেখানে কোনও গ্রহ এমনকি কোনও নক্ষত্রও নেই৷ তাহলে সিগান্যালটা আসছে কোথা থেকে? একটু আগেই একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এসেছিল তাঁর, সেটাকেই একবার খতিয়ে দেখতে ইচ্ছা করল৷ সিগন্যালে পাওয়া আলফানিউমেরিক ডিজিটগুলোকে সংখ্যায় ভেঙে ফেললে কি মহাকাশের কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নির্দেশ করে? অর্থাৎ আলফানিউমেরিক ডিজিট দিয়ে কি কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী তাদের অবস্থান বোঝাতে চায়?
স্ক্রিনের নীচের দিকে হাত ছোঁয়াতে স্ক্রিন জুড়ে একটা নতুন উইন্ডো ফুটে উঠল, ধীর গতিতে তার উপর কয়েকটা সংখ্যা টাইপ করলেন স্টারলিং৷ কিছুক্ষণ সব শান্ত, কয়েকটা যান্ত্রিক শব্দের পর স্ক্রিনে যা ফুটে উঠল সেটা দেখে প্রবীণ প্রফেসরের মনে হল তাঁর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, সমস্ত শরীর থেকে ফেটে বেরোচ্ছে অসহ্য উত্তাপ৷ না, কোনও গ্রহ নয়, যদি যন্ত্রের হিসেব ভুল না হয় তাহলে সিগন্যালটা আসছে ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বাইরে অন্য কোনও গ্যালাক্সি থেকে৷
পরদিন সকালটা অন্যদিনের মতোই ঝলমলে৷ আকাশের এক কোণে হালকা মেঘ জমছে, তাও সূর্য থেকে বহু দূরে তারা৷ চারপাশে যতদূর চোখ যায় কোথাও কিছু নেই৷ অনন্ত শূন্যতা৷ যেন একটা বিরাট দৈত্য এই মাত্র এসে বসবে৷ একটু দূরেই একটা ছোট লেক আছে, ভোরের প্রথম আলো তার উপর পড়ে জলটাকে সোনালি করে তুলেছে৷ মনে হচ্ছে খয়েরি নরম বালির প্রান্তরে হঠাৎ করে কেউ খানিকটা তরল সোনা ঢেলে দিয়েছে৷ লেকের ধারে বসে ছিলেন স্টারলিং, এই সকালে বাইরে না বেরোলে তাঁর মাথা কাজ করে না; যন্ত্রপাতির একটানা শব্দে বিরক্তি লাগে৷ বাইরে বেরোতেই বাড়ির কথা মনে পড়ল৷ ভোরে বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে ঠিক এরকমই একটা আকাশ দেখা যায়৷ জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলেন তিনি, এখানে খুব অল্প নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়৷ বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করার চেষ্টা করলেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অপারেটার মিহি গলায় জানাল, ‘‘the number is not available right now.’’৷
অগত্যা স্টারলিং ইনবক্সে ঢুকলেন, ঢুকতেই তাঁর ঠোঁটের কোনায় অজান্তে একটা হাসি ফুটে উঠল৷ ইনবক্সে সবার উপরে যে নামটা দেখাচ্ছে সেটা তার স্ত্রীর৷ মিয়া উস্তিনভিচ৷ মেসেজটা বেশি বড় নয়৷ লেখা আছে— ‘‘no flowers on the Canadian plant. Will it ever blossom?’’
নিজের অনুপস্থিতিতে গাছগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব স্ত্রীকেই দিয়ে এসেছেন৷ বছর কয়েক আগে কেনা কানাডিয়ান সেঞ্চুরি প্ল্যান্টগুলোতে এখন ফুল আসেনি, অবশ্য আসার কথাও নয়৷ হঠাৎ প্রফেসরের মনে পড়ল কাল সকালের কথা৷ এই একটা গুণ তাঁর ছোটবেলা থেকেই আছে, দরকার পড়লেই যে-কোনও টেনশন মাথা থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন৷ এখন ব্যাপারটা আবার মাথায় আসতেই তিনি উঠে পড়লেন৷ যদি সিগন্যালটা অন্য কোনও গ্যালাক্সি থেকে এসে থাকে তাহলে হাইড্রোজেন লাইন ব্যবহার না করে অন্য কোনও প্রসেসে পাঠানো হয়ছে৷ কিন্তু মহাকাশে নিজেদের লোকেশন জানিয়ে কী বলতে চায় তারা? পৃথিবীর মানুষের পক্ষে অতদূর মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার কথা কল্পনা করাও মূর্খামি৷ এলিভেটার থেকে নেমেই কেভিনকে দেখা গেল, অন্য সঙ্গিসাথীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল সে৷ প্রফেসরকে নামতে দেখেই এগিয়ে এল৷
‘কাল যে ল্যাব থেকে তাড়িয়ে দিলেন, কী হয়েছিল বলুন তো?’
স্টারলিং একবার ভাবলেন কথাটা কেভিনকে বলা উচিত হবে কি না৷ লোকটা খালি গুলিগোলাই চালাতে জানে৷ পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কি না জানার থেকেও তার কাছে বেশি দরকারি কিম্ভূত চেহারার এলিয়েনরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পৃথিবী দখল করতে আসছে কি না৷ তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন প্রফেসর৷ কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, ‘আধঘণ্টা পরে দু-কাপ কফি নিয়ে মনিটর রুমে এসো, কথা আছে৷’
মনিটর রুমটা ল্যাবের থেকে বেশ বড়৷ প্রায় ছ-মিটার উঁচু, মেঝেটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ৷ চারপাশ জুড়ে অনেকগুলো রাডারের মতো দেখতে যন্ত্র, একটা বিরাট স্ক্রিনে সারভিলেন্স ক্যামেরায় পাওয়া ছবি দেখানো হচ্ছে৷ ঘরে ঢুকে কেভিন একটু থমকে দাঁড়াল৷ টেবিলের উপর মাথা রেখে কী যেন ভাবছেন প্রফেসর৷ মাথার পিছনে সাদাকালো মেশানো চুল পাতলা হয়ে এসেছে; হাত দুটো টেবিল থেকে নীচে ঝুলছে৷ হাতের পাশে কফির মগটা রেখে কেভিন তার পিঠে হাত ছোঁয়াল, সাথে-সাথে তিনি চোখ মেলে চাইলেন৷ সবসময় লেগে থাকা হাসিটা আজ কিন্তু দেখা গেল না৷ বিবর্ণ মুখে তিনি কেভিনকে বসতে ইশারা করলেন৷ সে বসতে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা আগেই বলা উচিত ছিল, বলা হয়নি৷’
‘কী কথা?’ কিছু যেন একটা আঁচ করতে পেরেছে কেভিন৷
‘এখনই এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামিও না, তবে জেনে রাখলে ভালো৷’
‘আপনি খুলে বলবেন?’
প্রফেসর চেয়ার থেকে উঠে ঘরের অন্য দিকে গেলেন৷ বলার কথাগুলো বোধহয় মনের মধ্যে গুছিয়ে নিলেন, তারপর শুরু করলেন, ‘আজ থেকে প্রায় বছর ষাটেক আগের কথা, ডোনাল্ড কিহো নামে এক মহাকাশ বিজ্ঞানী দাবি করেন যে ইউএস এয়ারফোর্স আকাশের গায়ে পৃথিবীর প্রায় সাথে-সাথে একটি ঘূর্ণায়মান কালো রঙের বস্তুকে দেখেছে; সেটা নাকি পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের মতোই পাক খাচ্ছে৷ প্রথমে স্বভাবতই ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করেনি, তো কাগজপত্রে এই নিয়ে অনেক লেখালিখি হতে গবেষণা করে জানা যায় ওখানে সত্যি একটা কিছু আছে, অনেকটা কৃত্রিম উপগ্রহের মতোই কিন্তু পৃথিবীর নয়৷ ১৩০০০ বছর আগে থেকে পৃথিবীর ৭৯° দ্রাঘিমা রেখা বরাবর ঘুরছে৷ এরপরেই বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে যায়৷ নাসা অবশ্য ব্যাপারটাকে মিথ্যে বলে ধামাচাপা দিতে চায়৷ যাই হোক এর ৪০ বছর পরে অর্থাৎ নব্বই এর দশকে sts-৪৪ মিশনে কিছু অদ্ভুত ছবি আসে, সে ছবি তুমিও ইন্টারনেট খুললেই দেখতে পাবে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ছুঁচলো রকেটের মতো মহাকাশযান ক্রমাগত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে, অবশ্য আকারে সেটা যথেষ্ট ছোট কিন্তু তাও…’ প্রফেসর কেভিনের মুখের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়লেন, ‘গুপ্তচর আমরা কোথায় রাখি?’
‘শত্রুপক্ষে৷’
‘এ স্যাটেলাইটটা যদি এলিয়েন আরটিফেক্ট হয় তাহলে তারা নিশ্চয়ই আমাদের মিত্রপক্ষ ভাবে না৷’
কেভিন কিছু ভাবার চেষ্টা করল৷ আর সাথে-সাথে তার মুখে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল, মাথা নেড়ে বলল, ‘ধুর, আপনি মজা করছেন আমার সাথে৷’
স্টারলিং-এর মুখ এখন থমথমে হয়ে আছে৷ হাতটা মাথার পিছনে বুলাতে-বুলাতে বললেন ‘বি মাই গেস্ট৷ যে-কোনও বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করে নিও৷’
কেভিন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমনসময় একটা প্রচণ্ড যান্ত্রিক শব্দে দু-জনেই চমকে উঠল৷ তবে এ শব্দটা তাদের অচেনা না, প্যারালাল ইউনিভার্স রেডিও টেলিস্কোপে আবার ধরা পড়েছে কোনও মহাজাগতিক সিগন্যাল৷ ট্রান্সমিশন রুমে ঢুকেই প্রফেসর ঘড়ি দেখলেন, নাহ, কোনও ভুল হবার নয়, প্রতিদিন একই সময়ে এসে পৌঁছায় সিগন্যালটা৷ অর্থাৎ সেটা যারা পাঠাচ্ছে, তাদের পৃথিবীর সময়ের হিসেব আছে, শুধু আছে যে তাই নয়, তারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! হাইড্রোজেন নয়, প্রাণ নয়, শক্তি নয়—মহাবিশ্বে এক মাত্র ধ্রুবক হল সময়৷ ৫০ লক্ষ আলোকবর্ষ পার করে সময়কে ধ্রুবক রেখে পৃথিবীকে কিছু বলতে চাইছে কেউ! কেভিন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল স্ক্রিনের উপরে৷ সেখানে আবার ফুটে উঠেছে কিছু আলফানিউমেরিক সংকেত৷ ঠিক বাহাত্তর সেকেন্ড স্থায়ী হবে সেগুলো তারপর আবার মিলিয়ে যাবে মহাশূন্যে৷ হঠাৎ কেভিন লক্ষ করল তার ঠিক পিছনেই কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে রয়েছেন প্রফেসর স্টারলিং; তাঁর চোখ মুখ বিস্ফারিত, গোটা মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে কাঁপছে, যেন কিছুর একটা আকস্মিকতায় নিথর হয়ে গেছেন তিনি৷ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে কেভিন তার কাঁধে হাত দিল৷
‘ডক্টর স্টারলিং, কী হয়েছে আপনার?’
স্টারলিং কাঁপা-কাঁপা হাতে তার জামাটা চেপে ধরে প্রায় ডুকরে উঠলেন, ‘হা ঈশ্বর! আ…আমি আসতে চাইনি এখানে, যদি জানতাম…’
রাত প্রায় সাড়ে তিনটে৷ নিউ ইয়র্কের একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন হেনরি লুকাস৷ হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতে তার ঘুমটা ভেঙে গেল৷ অন্য দিন ঘুমানোর সময় ফোনটা বন্ধ করে দেন তিনি, আজ সেটা করার কথা মনেও ছিল না৷ গত তিন রাত ঘুম হয়নি, গোটা আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছুটে দৌড়েই কেটে গেছে৷ প্রাথমিক বিরক্তিটা কাটিয়ে নিয়ে কোনওরকমে একটা হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে ধরল হেনরি, ওপাস থেকে স্টারলিং-এর গলা শোনা গেল, ‘হিস্ট্রি ইজ ইন আওয়ার হ্যান্ড লুকাস, history is in our hand.’ স্টারলিং প্রায় চিৎকার করে উঠলেন৷
হেনরি প্রথম কিছু বুঝতে পারলেন না, প্রফেসর বয়স্ক মানুষ, ছাত্রাবস্থায় কখনও তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখেনি সে৷ দু-মিনিট চুপচাপ থেকে সে বলল, ‘প্রোফেসার, এত রাতে, কী ব্যাপার?’
‘পৃথিবী সৃষ্টি হল কীভাবে, প্রাণ এল কীভাবে, কীভাবে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখল, কীভাবে তৈরি হল ইজিপ্টের পিরামিডগুলো?’
‘এত রাতে এইসব প্রশ্ন করে কী লাভ প্রফেসর! এগুলোর উত্তর কেউ জানে না৷ সিগন্যালটা ডেসিফার করতে পারলেন?’ হেনরির বিরক্তিটা আবার দানা বাঁধছে৷ লোকটার কি ভীমরতি হল নাকি?
‘ওয়েল, কেউ জানে, জানে বলেই আমাদের জানাতে চাইছে৷’
‘বলে যান৷’ দীর্ঘদিন নানা পাগলাটে বৈজ্ঞানিকের সাথে কাজ করার ফলে তাদের এই স্বভাবটা ভালোই জানা আছে হেনরির৷ কোনও একটা ব্যাপার নিয়ে মেতে উঠলে স্থান কাল পাত্র আর মাথায় থাকে না৷
‘যে রেডিও সিগন্যালটা আমাকে ডেসিফার করতে দিয়েছিলে, সেটা সাজিটেরিয়াস থেকে নয়, আসছিল গ্যালাক্সি 3c348 থেকে৷’
‘গ্যালাক্সি!!’ একঝটকায় বিছানার উপর সোজা হয়ে বসল হেনরি, লোকটা বলে কী! মাথার ঠিক আছে তো?
‘হ্যাঁ গ্যালাক্সি, সেটা আমাদের সোলার সিস্টেম থেকে ৫ বিলিয়ান আলোকবর্ষ দূরে, অর্থাৎ পৃথিবীর থেকে সেখানে আলো পৌঁছাতে লাগবে ৫ বিলিয়ন বছর৷ আমাদের পৃথিবী সৃষ্টি হয়ছে সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে৷’
হেনরির এতক্ষণে সব গুলিয়ে যাচ্ছে, সে কোনওরকমে উচ্চারণ করল, ‘হ্যাঁ, তো?’
‘এই মুহূর্তে একটা টেলিস্কোপ নিয়ে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের দিকে তাকালে তারা আমাদের এই ছোট্ট গ্রহটাকে দেখতে পাবে না৷ কারণ সেটা এখনও সৃষ্টিই হয়নি, পৃথিবী সৃষ্টির ছবি তাদের চোখে পৌঁছাতে এখনও প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি বছর দেরি৷’
হেনরি চুপ৷ তার দিক থেকে কোনও শব্দ এল না৷
স্টারলিং একটু থেমে আবার বলে চললেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, এই ভিনগ্রহীরা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; আলোর ধর্মকে কাজে লাগিয়ে অতীতের ছবি তুলে আনতে পারে৷ আমি যদি ভুল না হই তাহলে এরা আমাদের গ্রহের ইতিহাস আমাদেরকেই জানাতে চায়৷ তুমি ভাবতে পারছ হেনরি? হেনরি?’
প্রফেসর একবার ভাবলেন লাইনটা কেটে গেছে৷ প্রায় দু-মিনিট চুপ করে থাকার পর হেনরি উত্তর দিল, ‘আপনার কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’
‘না৷ দু-দিন টানা লক্ষ করেছি সিগন্যালগুলো, ভুল হতেই পারে না৷’
‘ব্যাপারটা আর কাউকে জানিয়েছেন?’
‘নাহ৷ এখানে আর কারও সাথে যোগাযোগ করার ফেসিলিটি নেই৷’
ওপাস থেকে হেনরির ঠান্ডা গলা শোনা গেল, ‘বেশ৷ আমরা কালই একদল এস্ট্রো- ফিজিসিস্টকে পাঠাচ্ছি৷ congratulation প্রফেসর স্টারলিং, আপনার নোবেলটা এবার আটকায় কে৷’
স্টারলিং-এর গলায় এখনও উত্তেজনার স্রোত বইছে৷ তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘এই বয়সে আর এসব ভালো লাগে না৷ অনেকদিন বাড়ির বাইরে, আমার ফেরার ব্যবস্থা কর৷’
‘আমাদের টিম সাইটে পৌঁছালেই আপনার ছুটি৷’
ফোনটা রেখে হেনরি উঠে বসল, মাথাটা এখনও কেমন যেন গুলিয়ে আছে৷ একটা সিগারেট ধরাল সে, তারপর ল্যাপটপটা খুলে তাড়াহুড়ো করে হাত চালাল কি-বোর্ডের উপরে৷
এরিয়া ৫১-এ গ্রুম লেকের ধারে বালির উপর বসে জলের দিকে একটানা চেয়ে ছিল কেভিন৷ একটু আগেই তার কাছে কতগুলো ইনস্ট্রাকশন এসেছে; তার বাকি সঙ্গিসাথীদের সেটা জানানো হয়নি, জানানো হয়নি স্টারলিংকেও৷ মাটিতে একটু দূরেই পড়ে আছে P11-lsat রাইফেলটা৷ আর দেরি করলে চলবে না, এখুনি উঠতে হবে৷ হঠাৎ কেভিন থেমে গেল, একটু দূরে আস্তে- আস্তে ফুটে উঠছে প্রফেসর স্টারলিং-এর শরীরটা৷ বালির উপর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে তার দিকেই এগিয়ে আসছেন, মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকা সেই হাসিটা৷ প্রফেসর তার পাশে এসে বসলেন, কেভিন একটাও কথা বলল না৷ লেকের জলের উপর দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে, বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ৷ প্রফেসর একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে উপরে তাকালেন, আকাশে অগণিত উজ্জ্বল তারা ঝলমল করছে৷ সম্মোহিতের মতো কী যেন দেখতে- দেখতে প্রফেসর বললেন, ‘তুমি ভগবানে বিশ্বাস কর কেভিন?’
‘হুম৷’
‘উপরে তাকাও, কত বড় এই মহাবিশ্ব কল্পনাও করা যায় না৷ তার উপর রোজ নাকি বেড়ে চলেছে৷ আর আমরা? প্রবল হারিকেনের মুখে এক দানা ধুলোর মতো, কোনও গুরুত্ব নেই, সারাক্ষণ শুধু আমাদের অস্তিত্বের কারণ খুঁজছি—ডেস্টিনি, ডেস্টিনি খুঁজছি৷ তোমাকে যে স্যাটেলাইটের কথা বলেছিলাম, ব্ল্যাকনাইট স্যাটেলাইট৷ ওটা একটা গুজব, মহাকাশে ভাসমান একটা থার্মাল ব্লাঙ্কেট, ক-দিন কাগজে লেখালিখি হয়েছিল, ব্যস৷ এইটাই মেনে নেওয়া কঠিন, এই অবিশ্বাস্য নগণ্যতা, অসহ্য৷ পঞ্চাশ থেকে ষাট, ষাট থেকে সত্তর আশি নব্বই একশো বছর কোনওরকমে বাঁচার চেষ্টা, অথচ এই মহাকালের তুলনায় সেটা কিছুই নয়, চোখের পলক ফেলার মতো৷ মাঝে-মাঝে খুব হতাশ লাগে, মনে হয় মানুষ হয়ে জন্মেছি তার কোনও কারণ নেই? নিশ্চয়ই আছে৷ আমার বাড়ির ঠিক নীচেই একটা ছোট বস্তি আছে, বৃষ্টি এলে বস্তির বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় উন্মাদের মতো ফুটবল খেলে, গোল দিয়ে আনন্দে গান গাইতে-গাইতে নাচে৷ তখন আমার মনে হয় হয়তোকোনও কারণ নেই৷ এই বিরাট আকাশের নীচে আমরা, আমাদের মূল্য শুধু আমাদের কাছে৷’
‘মানে আপনার মৃত্যুভয় নেই?’
‘আছে৷ আমার বাড়ি আছে, স্ত্রী আছে, বাড়ির ঠিক সামনেই মস্ত ফুলের বাগান আছে৷ অনেকদিন বাড়ির বাইরে, পোষা কুকুরটা হয়তো দুঃখে খায়নি এই ক-দিন৷ তাদের মধ্যে থাকলে আর আকাশের দিকে চোখই পড়ে না৷ এদের ছেড়ে যেতে মন চাইবে না৷ চোখ বুজলেই আর কিছু নেই, অন্ধকার, এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর৷ আমরা চেহারায় না হলেও বয়সে এই মহাবিশ্বের সমান হতে চাই৷’
‘হুম৷’
স্টারলিং এবার কেভিনের দিকে তাকালেন, ‘তোমার কী হয়েছে বল তো? হুম হুম করছ যে! এই খ্যাপা বিজ্ঞানীকে আর সহ্য করতে হবে না, নতুন রিসার্চ টিম আসছে৷’
কেভিন মাথা নামিয়ে নিল, কোনওরকমে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার কাছে একটা ইনস্ট্রাকশন আছে৷’
‘কী ইনস্ট্রাকশন?’
‘আপনাকে দেখামাত্র গুলি চালানোর৷’
কথাটা বলে কেভিন শক্ত করে ধরল রাইফেলটা৷ মুহূর্তের জন্য সে প্রোটোকল ভুলে গেছিল, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপরাধীর সামনে যে-কোনও অস্ত্র ভালনারেবেল৷ অন্ধকারে প্রফেসারের মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ কেভিন সেদিকে তাকাতে পারল না, রাইফেলটা হাতে ভারী হয়ে আসছে৷
এত জটিল ক্যালকুলেশনের মাঝে এই ছোট্ট হিসেবটা মাথায় আসেনি স্টারলিং-এর৷ পৃথিবীর কোনও ধর্ম বিজ্ঞানকে ইচ্ছামতো আবিষ্কারের অনুমতি দেয় না, সব সত্যি উৎঘাটনের অনুমতি দেয় না৷ কারণ সেটা হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে তাদের সাজানো বুজরুকি৷ সেই সঙ্গে তাদের উপর মানুষের বিশ্বাস৷
প্রফেসরের ডান হাতটা এখনও কেভিনের পিঠের উপর রাখা, মিলিটারি পোশাকটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরা৷ পাঁচ মিনিট কেউ কোনও কথা বলল না; যেন দুটো মাটির পুতুল, পাশাপাশি বসানো আছে৷
‘আমি একটা ফোন করব৷ বাড়িতে৷’ স্টারলিং-এর গলা আশ্চর্যরকম শান্ত৷
‘লাভ নেই, আপনি পালাতে পারবেন না, চারদিক ইলেকট্রিক ফেন্স দিয়ে ঘেরা৷ আমি নিজে হাতে আপনাকে হত্যা করতে পারব না, আপনার কাগজপত্র আর এখানকার সব যন্ত্রপাতি নষ্ট করতে মিলিটারি ট্রুপ আসছে,তারাই হয়তো…’
‘আমি পালাব না৷ ভয় নেই, আমি বাড়িতে ফোন করে রিসার্চের ব্যাপারে কিছু জানাব না৷’
‘তাহলে?’
‘উস্তিনা আমার স্ত্রী, তাকে কয়েকটা কথা বলব৷’
‘আমি দেখছি৷ জানি না…’ কথাটা বলে কেভিন উঠে পড়ল৷
স্টারলিংও উঠে দাঁড়ালেন, মাথা নীচু করে হাঁটতে থাকলেন বালির উপর দিয়ে৷ জীবনের এই শেষ কয়েকটা মুহূর্ত নষ্ট করার কোনও মানে হয় না৷ স্বর্গ নেই, নরক নেই, কতগুলো ব্যাকটেরিয়া আর ডিকম্পজিটারের হাতে রক্তমাংসের যন্ত্রটা ছেড়ে দেওয়ার আগে, কিছু করা উচিত৷ খুব ক্ষীণ একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উপর থেকে, হেলিকপ্টার৷ তারা কত দূরে এসেছে বোঝা যাচ্ছে না৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কেভিন বাইরে বেরিয়ে এল, প্রফেসরের হাতে তুলে দিল একটা ফোন৷ ছোট রিভলভারটা নিজের পায়ের দিকে তাক করে গুলি চালাল, গুলির আঘাতে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ল তার শরীরটা৷ প্রফেসর বাড়ির নম্বর ডায়াল করলেন৷ ওপাস থেকে উস্তিনার গলা শোনা গেল, ‘হ্যালো…’
‘উস্তিনা, আমি রিচার্ড৷’
‘ওফ, শেষ পর্যন্ত ফোন করলে তাহলে! এরা তো আমায় কিছুই জানায় না, কাজ শেষ হল তোমার?’
‘না, শেষ হয়নি৷ আর একটু সময় লাগবে৷’ আকাশের এককোণে হেলিকপ্টারগুলোকে উড়ন্ত বাজপাখির মতো দেখা যাচ্ছে৷ স্টারলিং বুঝলেন, আর বেশি সময় নেই৷
‘শোন, আমি একটা কথা বলার জন্য কল করলাম৷’
‘তা নাহলে আর কেন করবে? বল৷’
‘আমার কানাডা থেকে কেনা গাছগুলো সেঞ্চুরি প্ল্যান্ট৷ গাছটার একটা বিশেষত্ব আছে, জীবনকালে মাত্র একবার ওই গাছে ফুল আসে৷ মৃত্যুর ঠিক আগে, সারা শরীর ফুলে সেজে শুকিয়ে যায় আস্তে-আস্তে৷ মানে, আর কুড়ি বছর পর ফুল ফুটবে আমাদের গাছগুলোতে, ততদিন ওগুলোকে বাঁচিয়ে রেখ৷’
কথাটা শুনে কেমন যেন থমকে যায় উস্তিনা, জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ফিরবে কবে?’
হেলিকপ্টারগুলো একদম মাথার উপরে এসে আকাশ ঢেকেছে৷ প্রফেসরের কথা আর শোনা যায় না৷ ১৪ বিলিয়ন বছরের পুরনো এই ইউনিভার্স, ১৪ হাজার লক্ষ কোটি, আর মানুষের বয়স তিরিশ লক্ষের বেশি হবে না৷ এখনও তার রূপকথার গল্প শোনার বয়স, মহাবিশ্বের সব সত্যি জানার বয়স হয়নি তার৷ ওই সেঞ্চুরি প্ল্যান্টগুলোর মতোই, ফুল ফুটতে বহু দেরি৷
চারটে SUV হেলিকপ্টার থেকে ছুটে আসা গুলির ঝাপটায় দু-মিটার দূরে ছিটকে পড়লেন প্রফেসর স্টারলিং৷ হাত দুটো দু-পাশে ছড়িয়ে রক্তাক্ত শরীরে নিথর হলেন তিনি, রাতের আকাশে অজস্র আলোকবিন্দুতে চেয়ে রইল তাঁর চোখ৷