শতাব্দীর ওপার থেকে – সমরেশ বসু
হুগলি জেলা সম্পর্কে একটি প্রাচীন কাব্যে এইরকম উল্লেখ আছে— ‘গঙ্গার পশ্চিম কূল। বারাণসী সমতুল।’
কাব্যের উক্তিতে কতখানি স্থানমাহাত্ম্যের কথা বলতে চাওয়া হয়েছে জানিনা, তবে হুগলির প্রাচীনত্ব বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। কবি যদি এক্ষেত্রে ত্রিবেণীর কথা মনে রেখে বলে থাকেন, তা হলে আলাদা। কিন্তু আদি সপ্তগ্রাম, যা একদা, মুসলমান যুগেরও আগে অতি সম্পন্ন স্থান ছিল তার কথাও মনে রাখা দরকার।
কিন্তু ইতিহাস আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। যদিও এক সময়ে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই আমি হুগলি জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই ঘুরে বেড়ানোর কাজটা খুব সহজ ছিল না। শহরে বন্দরে ঘোরাঘুরির অনেক সুবিধা। পকেটে টাকা থাকলেই সেখানে পান্থশালার খাদ্য আর আশ্রয়ের অভাব হয় না। পান্থশালা বলতে আমি হোটেল রেস্তোরাঁর কথাই বোঝাচ্ছি।
প্রায় বছর পনেরো আগে কলকাতার এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তির বাড়িতে আমি একজনের সাক্ষাৎ পাই যাঁর একটিই নেশা— প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ করা। এই মুদ্রাসংগ্রহকারী ভদ্রলোকের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় তখন তাঁর কাছে আমি একটি লক্ষ্মণ সেন আমলের স্বর্ণমুদ্রা দেখতে পাই। তিনি আমাদের কাছে অকপটেই স্বীকার করলেন, মুদ্রাটি তিনি মহানাদ গ্রামের গঙ্গার ধার থেকে কিঞ্চিৎ দূরে একটি পোড়ো ভিটার ধুলা থেকে আবিষ্কার করেন। ভদ্রলোকের এইরকম আরও কিছু সংগ্রহ আমি দেখেছি।
ভদ্রলোকের নাম প্রাণনিধি বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকাল সচরাচর এরকম নাম বড়ো একটা দেখা যায় না। প্রাণনিধিবাবুকে প্রথম আমি নিতান্ত একজন মুদ্রাসংগ্রহের নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কিছু আলাপ—আলোচনার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনিও একজন ইতিহাসবেত্তা পণ্ডিত ব্যক্তি। এমনি সাধারণভাবে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমানো খুবই কঠিন। কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ চুপ করে যান। দীর্ঘ সময় অন্যমনস্ক থাকেন এবং ঘনঘন নস্যি টানেন।
তাঁর আচরণের মধ্যে আরও কিছু কিছু খারাপ ব্যাপার আছে। যার থেকে মনে হয় তিনি কিছুটা ছিটগ্রস্ত লোক। যদিও তিনি আদৌ তা নন। আসলে তাঁর চিন্তার গভীরে বহমান নানা অন্তঃস্রোতের জটিলতাই এর কারণ— মনে মনেই তিনি যার জট খুলতে সচেষ্ট হন।
প্রাণনিধিবাবু মহানাদেরই এক প্রাচীন পরিবারের একমাত্র বংশধর। প্রায় চল্লিশোর্ধ বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করেননি। ইতিপূর্বেই আমার জানা ছিল মহানাদ গ্রামের গঙ্গার ধারে নাকি বিশাল শঙ্খ সমুদ্র থেকে ভেসে আসে। তার ভেতর বায়ু প্রবেশ করলেই মহানাদ ধ্বনিত হত, সেই থেকেই গ্রামের নাম মহানাদ। আমি হুগলি জেলার নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি শুনে প্রাণনিধিবাবু আমাকে তাঁর মহানাদ গ্রামের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি বিশেষ কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিলাম।
প্রাণনিধিবাবুর সঙ্গে কলকাতায় সাক্ষাতের মাসখানেক পরে আমি বিনা সংবাদেই একদিন তাঁর গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ভেবেই রেখেছিলাম প্রাণনিধিবাবুর দেখা পাই ভালো, নচেৎ গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে ঘুরে রাত্রের গাড়িতেই কলকাতায় ফিরে আসব। পরে আবার পত্রে যোগাযোগ করা যাবে।
মহানাদ অতি প্রাচীন গ্রাম এবং এক সময়ে বিশেষ সম্পন্ন ছিল। অতি প্রাচীন হলেই যা হয় তাই, ধ্বংসাবশেষের বহু চিহ্ন ছড়ানো। পোড়ো অট্টালিকা, ভাঙা মন্দির, বট অশ্বত্থের আক্রমণে সব কিছু ধ্বংসোন্মুখ। বেলা দশটাতেই ঝিঁঝির ডাকে নিঝুম মনে হল। বিশাল ভগ্ন ইমারতগুলো দেখলেই অনুমান করা যায় গৃহবাসীরা এখন প্রবাসী। সারা দেশের নানান জায়গায় চাকুরি ও ব্যবসা উপলক্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাঙা পোড়ো অট্টালিকা এখন বাস্তুসাপ গোখরোর নিশ্চিন্ত বিচরণ ক্ষেত্র। দু—চারটি ভাঙা পোড়োবাড়িতেই দেখা যায় দরিদ্র বংশধরেরা এখনও কেউ কেউ টিকে আছে, তাও নিতান্ত যেন দায়ে পড়ে। অন্যান্য দরিদ্র গৃহস্থের কুটিরও কিছু কম নেই। সম্ভবত তারা কৃষি ও মৎস্যজীবী শ্রেণির। সমস্ত প্রাচীন বাড়িই যে একেবারে ভেঙে পড়েছে এমন কথা বলা যায় না। এবং সেই সব প্রাচীন অট্টালিকায় এখনও মানুষের বাস বোঝা যায়। বড়ো বড়ো পুকুর, অধিকাংশ ঘাট ভাঙা শ্যাওলায় বিবর্ণ, ফাটলে ফাটলে সাপের অস্তিত্ব যেন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। জলও সবুজ পানায় ভরতি।
কিন্তু প্রাণনিধিবাবুর বাড়ি কোনটি এবং কোন পাড়ায়? আমি খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত সংগ্রহ করে রাখিনি। গ্রামের পথে লোকজনের দেখাও তেমন পাচ্ছি না, যাকে জিজ্ঞেস করা যায়। এক—আধজন যাদের দেখছি হয় স্ত্রীলোক, নাহয় ঘাটে মাঠে খাটা মানুষ। একটু ভদ্রগোছের লোক পেলে সুবিধে হয়। চলতে চলতে ইতিমধ্যেই বারকয়েক চমকে উঠেছি রাস্তার দু—পাশের ঝোপে হঠাৎ সড়সড় শব্দে। তারপর তাকিয়ে দেখেছি, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গোসাপ হিসহিস করে চলে যাচ্ছে।
একটি লোকের দেখা পেলাম ছাতা মাথায় ময়লা ধুতি—পাঞ্জাবি পরা। চশমা চোখে প্রৌঢ়। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, প্রাণনিধি বন্দ্যোপাধ্যায় মশায়ের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?
ভদ্রলোক অনুসন্ধিৎসু চোখে আমার দিকে তাকালেন। দেখবার কিছু ছিল না। আমারও ধুতি— পাঞ্জাবিই সম্বল, বাড়তির মধ্যে চোখে সানগ্লাস আর ঘাড়ে কাপড়ের ব্যাগ ঝোলানো।
ভদ্রলোক বললেন প্রাণনিধি মানে— পানুর কথা জিজ্ঞেস করছেন?
মাথাটা একটু ইয়ে তো? —মানে বায়ুগ্রস্ত— বে—থা করেনি, তার ওপর বেশি লেখাপড়া শিখলে যা হয়। ছেলে অবিশ্যি ভালো—
আমি তাড়াতাড়ি বললাম ছেলে না উনি একজন—
ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভদ্দরলোক এই তো। তা অন্যর কাছে যাই হোক, পানু আমাদের কাছে ছেলেমানুষই। কিন্তু আপনি একটু ভুল রাস্তায় এসেছেন। একি আর ছোটোখাটো গ্রাম? চলুন, আপনাকে আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে ওদিকেই যেতে হবে।
ভদ্রলোকের কথা যথার্থই মনে হল। গাঁয়ের ছেলেদের বয়স, বড়োদের কাছে কোনোদিনই বাড়ে না। পথে চলতে চলতে ভদ্রলোক আমার বিষয়ে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করলেন, যতটা সম্ভব তাঁর কৌতূহল নিবারণ করলাম। তিনি নিজের তাঁর নাম বললেন, বৃন্দাবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। প্রাণনিধিবাবুর বিষয়ে বললেন পানু ছেলেটি পণ্ডিত। এমএ পাশ করেছে, কিন্তু মাথাটা তেমন ঠিক নেই। বিয়ে—থা করেনি, বিরাট ভূতুড়ে বাড়িতে একা পড়ে আছে। তবে হ্যাঁ, গুণী ছেলে। ওর যা সঞ্চয়, তা একটা জাদুঘরের মতো। কত পুরোনো জিনিস যে জোগাড় করেছে তার ঠিক নেই। তবে ও সেসব কারোকে দেখাতে চায় না, একটা ঘরের মধ্যে সব বন্ধ করা আছে।
ভদ্রলোক হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, একদিন হয়তো দেখা যাবে ডাকাতরা ওকে মেরে রেখে সব নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কিছুই বলা যায় না। যা দিনকাল পড়েছে। বুঝলেন তো।
বুঝেছি। এবং বৃন্দাবনবাবু খুব একটা অন্যায়ও বলেননি বোধহয়। প্রাচীন নামি—দামি সংগৃহীত বস্তু যদি এরকম গ্রামের কোনো ঘরে থাকে, তবে বিপদ—আপদ ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাণনিধিবাবু প্রাণ ধরে কিছুতেই সেসব সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে তুলে দিতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ওসব জায়গায় নাকি আরও বড়ো শিক্ষিত ডাকাতদের ভিড়।
যাই হোক, বৃন্দাবনবাবুর সঙ্গে আমি সুদীর্ঘ প্রাচীরবেষ্টিত একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। মনে হয় ১০/১২ বিঘা জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যার অনেক জায়গায় নোনা ধরে অশ্বত্থের চারা গজিয়ে ক্ষয় হতে বসেছে। যার ভিতরে নানান গাছপালা ঘেরা। দরজা জানালা বন্ধ, দোতলা নিঝুম বাড়ি চোখে পড়ছে। আমাদের সামনেই অর্ধবৃত্তাকার খিলানের নীচে মোটা মোটা গজাল পোঁতা। সেকালের ভারী পাল্লার বড়ো দরজা। ভিতর থেকে বন্ধ। বৃন্দাবনবাবু সন্দেহ প্রকাশ করলেন, পানু কি বাড়িতে আছে? কড়া নেড়ে দেখা যাকে, পাগলের ডিম কোথায় হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলাম, প্রাণনিধিবাবু কি একেবারেই একা থাকেন? তাঁর রান্নাবান্না, ঘরদোরের কাজকর্ম কে করে?
বৃন্দাবনবাবু বললেন, সেসব কাজের জন্য একটি লোক আছে। মাঝবয়সি বুড়ো, এই গাঁয়ের লোক, নাম কড়ি বৈরাগী। সেই পানুর সব কাজ করে, খায় থাকে। তিনি আবার দোরের কড়া নাড়া দিয়ে চিৎকার করে ডাকলেন, পানু আছ না কি হে, অ পানু।
তাঁর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে ভারী হুড়কো খোলার শব্দ হল। দরজা খোলার পরে দেখতে পেলাম ছোটোখাটো ধুতি পরা, গায়ে শুকনো গামছা জড়ানো, বয়স্ক লোক। মাথায় বড়ো বড়ো বাবরি কাঁচা পাকা চুল। গোঁফ—দাড়ি কামানো, কণ্ঠি, কপালে ও নাকে তিলক কাটা।
বৃন্দাবনবাবু বললেন, এই যে কড়ি, পানু আছে? উনি কলকাতা থেকে এসেছেন পানুর সঙ্গে দেখা করতে।
কড়ি বৈরাগী ঘাড় কাত করে অতি কোমলভাবে বলল, আছেন। আপনি আসুন।
বৃন্দাবনবাবু বিদায় নিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকে ডানদিকে দেখলাম ঠাকুর দালান। পাশেই অতি প্রাচীন একটি চারচালা মন্দির। সংলগ্ন আরও দুটি ছোটো ছোটো মন্দির—সবই ধ্বংসোন্মুখ। আশেপাশে আম জাম নারকেল গাছ।
কড়ি বৈরাগী দরজা বন্ধ করে আমায় ডাকল— আসুন বাবু।
কড়ি বৈরাগীর কথার উচ্চারণ পরিচ্ছন্ন, স্বর কোমল। তাকে ভক্ত মানুষ বলে মনে হয়। সে আমাকে ঠাকুর দালানের উত্তরদিকে একটি একতলা বাড়ির দিকে নিয়ে গেল। মূল দোতলা বাড়ি থেকে সেটি বিচ্ছিন্ন। একতলা বাড়িটির সামনের বারান্দা ছাদঢাকা। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই একটি খোলা দরজা দিয়ে প্রাণনিধিবাবু বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে খুব একটা বিস্মিত হলেন না। একটু হেসে বললেন, ওহ আপনি! কোনো চিঠিপত্র দিয়েছিলেন নাকি?
সংকুচিত হয়ে বললাম, না, চিঠি না দিয়েই চলে এলাম। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় ভালোই, তা না হলে আজ অন্যদিকে ঘুরে চলে যেতাম।
প্রাণনিধিবাবু আমায় ঘরে নিয়ে গেলেন, পুরোনো বিরাট ঘর। স্থানে স্থানে পলেস্তারা খসে পড়ছে। পুবদিকের জানালা ঘেঁষে একপাশে একটি বড়ো টেবিল, খানকয়েক পুরোনো চেয়ার। টেবিলের ওপর লেখার কাগজ কলম ও কিছু বইপত্র দেখে মনে হল, প্রাণনিধিবাবু বোধহয় লেখাপড়া করছিলেন।
সংকুচিত হয়ে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি এসে ব্যাঘাত ঘটালাম।
প্রাণনিধিবাবু বললেন, এমন কিছু না। আমার কাজ তো সারা দিন মাস বছরই লেগে আছে। ক—দিন ধরে ভাবছি, একটু গৌড় আর পাণ্ডুয়া যাব। সময় পেলে আপনাদের কুমড়াকাটা গ্রামেও একবার ঘুরে আসতে পারি।
কামরূপ জেলার কুমড়াকাটা গ্রামের নাম আমার জানা। নরকাসুর আর কামাখ্যা দেবীর একটি বিশেষ কিংবদন্তি সেই গ্রামকে নিয়ে প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রাণনিধিবাবু সেখানে যাবেন কেন? জিজ্ঞাসাটা মনে মনেই রাখলাম।
তিনি আবার বললেন, তবে, এখনই কোনো ব্যস্ততা নেই। কড়ি বৈরাগীর দিকে ফিরে আমার আহারাদির বন্দোবস্ত করতে বললেন। আমি ভদ্রতা করে বললাম, থাকনা আমি চারদিক একটু দেখেশুনে—
প্রাণনিধিবাবু বললেন, এসেছেন যখন ২/১ দিন থেকে আশেপাশে ঘুরে যান। অসুবিধে তো কিছু নেই। খাওয়াদাওয়ার একটু কষ্ট হবে। আমার এখানে নিয়মিত ডাল ভাত ছাড়া আর কিছু পাবেন না।
আমি বললাম, যথেষ্ট।
প্রাণনিধিবাবু আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। কাঠের পাল্লার নিশ্ছিদ্র আলমারি খুলে অতি সাবধানে রক্ষিত কয়েকটি পুঁথি পুস্তকের সংগ্রহ দেখালেন। আপনি ইচ্ছা করলে আপনার মনমতো বিষয়ের বই পড়তে পারেন।
—ধন্যবাদ।
—অ্যাঁ! প্রাণনিধিবাবু বিস্ময়ে যেন চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। তারপরে বললেন, ওহ হ্যাঁ, বুঝেছি।
তাঁর কথার ভঙ্গিতে আমারই চমকে ওঠার অবস্থা। তারপরে তিনি আমাকে নিয়ে একতলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে উত্তরদিকে গেলেন। সেদিকে বিশাল বাগান ও পুকুর। মূল বাড়ির এটা পিছন দিক। পিছন দিক দিয়েই তিনি আমাকে নিয়ে ছোটো একটি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, একটু অন্ধকার, দেখে আসবেন। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বাড়ি। এখনও যে টিকে আছে তাই যথেষ্ট।
অতি যথার্থই কথা। অন্ধকার কেবল নয়, বেশ ঠান্ডা ভেজা—ভেজা নোনা ইটের গন্ধ ছড়ানো। তিনি বিভিন্ন সরু দালানের ভিতর দিয়ে চলেছেন। আর ছায়াতে দেখতে পাচ্ছি, অনেক ঘর এবং সব ঘরেরই দরজা বন্ধ। একটি বড়ো দালানের প্রান্তে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে ডাকলেন— কড়ি, কড়ি!
মনে হল, দেওয়ালের ওপাশ থেকে কড়ির গলা শোনা গেল— যাই বাবা।
দেখলাম, ডানদিকের একটি দরজা খুলে কড়ি বৈরাগী ঢুকল।
প্রাণনিধিবাবু বললেন, দোতলার সব ঘর খোলা আছে তো? তালাচাবি দেওয়া নেই তো?
—না, শুধু শেকল তোলা আছে।
—আসুন।
আমি প্রাণনিধিবাবুকে অনুসরণ করলাম। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, কিন্তু তার মধ্যেই গোটা কয়েক পাক দিতে হল। দোতলায় উঠে চৈত্রদিনের আলো দেখতে পেলাম। তিনি বড়ো চওড়া দালানের দরজা খুলে দিতেই দখিনা বাতাস বয়ে গেল। সেই বাতাসে পেলাম একটি মৃদুমধুর সুবাস। কনকচাঁপার গন্ধ।
প্রাণনিধিবাবু বড়ো দালানের মাঝামাঝি একটি দরজা খুলে স্বল্প পরিসর আর একটি দীর্ঘ দালানে ঢুকলেন। দু—পাশে ঘর—দরজা বন্ধ। তিনি এই স্বল্প পরিসর দালানের শেষ প্রান্তে গিয়ে আর একটি দরজা খুললেন। সামনেই বারান্দা, উত্তরদিকের বাগান আর পুকুর দেখা যাচ্ছে।
আবার আমার ঘ্রাণে একটি মিষ্টি গন্ধ পেলাম। এটিও চেনা গন্ধ বাতাসি ফুলের গন্ধ। এখন মৃদু, কিন্তু সন্ধেবেলায় এ গন্ধ নিশ্চয়ই অনেক তীব্র হবে। প্রাণনিধিবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন— অর্থহীন।
বারান্দা থেকে আবার ঢুকে পুবের একটি দরজার শিকল খুললেন। অন্ধকার ঘর। তিনি ভিতরে ঢুকে দুটি জানালা ও একটি দরজা খুলে দিতেই ঘরে আলো ঢুকল। সেই আলোয় দেখলাম, ঘরের একপাশে প্রাচীন উঁচু খাট। তার ওপরে বিছানাপাতা এবং তা মোটামুটি পরিষ্কার।
প্রাণনিধিবাবু বললেন, কয়েকটা ঘর নিয়মিত পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। আপনি এ ঘরে শোবেন। উত্তরদিকের বারান্দা দিয়ে পায়খানায় যাওয়া যাবে। আমি থাকি বড়ো দালানের পুবদিকের ঘরে। এ ঘরে আপনার অসুবিধে হবে না তো?
আমি ব্যস্তভাবে বললাম, না না, অসুবিধে হবে কেন? কিন্তু আপনি তখন অর্থহীন শব্দটা বললেন কেন?
বাড়ি করার মানে হয় মশাই! ইট কাঠের স্তূপ।
আমি হেসে বললাম, আপনার পূর্বপুরুষেরা হয়তো বংশধরদের সুখে থাকবার জন্যেই এইসব করেছিলেন। তখন জানতেন না বাড়ি এরকম খালি পড়ে থাকবে।
প্রাণনিধিবাবু বললেন, বংশধরেরা সবাই থাকলে অবশ্য বাড়ি এরকম খালি পড়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু অনেকেই গত চার পুরুষ ধরে উত্তরপ্রদেশের নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু তিনি নিজে কেন এখনও এই গ্রামের বাড়ি আগলে বসে আছেন তা বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি উত্তরদিকের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, আপনি যখন বারান্দায় যাবেন তখন ঘরের ভিতর দিয়েই যাবেন। ইচ্ছে হলে এই দালানের দরজাও খুলতে পারেন।
আমাকে সব দেখিয়ে শুনিয়ে প্রাণনিধি আবার নীচে নেমে এলেন। তাঁর সংগ্রহশালা আমাকে দেখালেন না, আমিও কিছু বললাম না।
প্রাণনিধিবাবু আমায় বাইরে একতলা বাড়িতে রেখে স্নান করে কাপড় বদলে এলেন। তারপর খেতে বসলাম। একান্তই নিরামিষ। কড়ি বৈরাগীর হাতের রান্নাটি ভালো। অতঃপর বিশ্রাম। দোতলায় যাবার আগে আলমারি থেকে আমি একটি তুলোট—বাঁধানো হাতে লেখা প্রাচীন পুঁথি পড়বার জন্য নিলাম।
নাম ‘আত্মা পরলোক সম্বন্ধ’।
চৈত্রের নিদাঘের একটি বিশেষ মাদকতা আছে। পুবের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছিল। ঘরের খাটের বিছানায় তুলোট কাগজের হাতে লেখা পুঁথি পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটি শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল, ঘরের মধ্যে কেউ পাঁয়জোর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম, দিনের আলো ঘরে, কিন্তু শব্দটা যেন তখনও মেঝের ওপর দিয়ে ঝুমঝুম শব্দে হেঁটে, খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে তাকালাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। শব্দও থেমে গেল।
উঠে বসে ভাবলাম, হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু কিছু মনে করতে পারলাম না, দেখলাম বালিশের কাছে পুঁথিটি তেমনি রয়েছে। তারপর মনে হল, আদৌ কিছু শুনেছি কি? নিশ্চয়ই না। বাঁ হাতের মণিবদ্ধে ঘড়িটা পরাই ছিল। সময় দেখলাম, তিনটে বেজেছে।
তখনএ একটু তন্দ্রাভাব রয়েছে। আবার বালিশে মাথা দিলাম। একটু পরে মনে হল, সেই ঝুম ঝুম শব্দ কানে আসছে। কিন্তু অনেক দূর থেকে। যেন সামনের চওড়া দালানে, পাঁয়জোর বা বাজুবন্ধ পরে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। শব্দ বেশ হালকা। যেন শিশুর পায়ের মতো।
কিন্তু এ বাড়িতে শিশু বা নারীর কোনো অস্তিত্ব আছে বলে শুনিনি। তবে এই শব্দ কার! কীসের? আমি এখন পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত। শুনতে ভুল হবার কোনো কারণ নেই।
মুহূর্তেই আমার সকল ইন্দ্রিয়কে সচকিত করে দিয়ে দক্ষিণের বড়ো ঘর থেকে ঝুমঝুম শব্দ স্বল্প পরিসর দালান দিয়ে এ ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে রইলাম। কে আসছে বা কে আসতে পারে এইরকম ঝুমঝুম শব্দ করে?
আমি স্পষ্ট টের পেলাম ঝুমঝুম শব্দ যেন আমার ঘরের দরজার সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়াল। আমি আস্তে আস্তে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য! কেউ নেই। খোলা দরজা, দক্ষিণ দিক থেকে দালানে দীর্ঘ সরু আলো এসে পড়েছে।
শুয়ে তাকতে পারলাম না। উঠে বসলাম। একটু অপেক্ষা করে খাট থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দক্ষিণ দিকে উঁকি দিলাম। কেউ নেই। মুখোমুখি বন্ধ ঘরগুলোর মাঝখানের সরু দালানে দক্ষিণের বাতাস ঢুকে, নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে না পেয়ে যেন একরকমের হাহাশ্বাস তুলেছে।
আমি সরু দালান পেরিয়ে দক্ষিণের বড়ো দালানে গেলাম। আমার বাঁদিকেই একটি ঘরের দরজা খোলা এবং অংশত দৃষ্ট খাটে, প্রাণনিধিবাবুর শায়িত শরীরের অংশবিশেষ চোখে পড়ল। কাছে গিয়ে দরজার সামনে থেকে দেখলাম, তিনি গভীর দিবানিদ্রায় মগ্ন।
দরজার কাছ থেকে ফিরতে উদ্যত হতেই সরু দালানে ঝুমঝুম হালকা শব্দ শুনতে পেলাম। অথচ আমি বড়ো দালানের দক্ষিণ খোলা জানালার আলোতে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে, সরু দালানের ভিতর দিয়ে সেই শব্দ যেন এদিকেই আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। দৃষ্টি সরু দালানের দরজার দিকে নিবদ্ধ। শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল। আমার বুকের তাল দ্রুত হয়ে উঠল। কিছু একটা দেখবার প্রত্যাশায় আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় আমার দৃষ্টিতে কেন্দ্রীভূত হল।
কিন্তু সরু দালানের দরজার কাছে এসেই আড়ালে সে শব্দ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গেলাম। কেউ নেই, দালান শূন্য। অভাবিত ব্যাপার। আমি ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছনে তাকালাম। কোথাও কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। যেন জেগে স্বপ্ন দেখার মতো। মুখ ফিরিয়ে প্রাণনিধিবাবুর ঘরের দিকে গেলাম। একই দৃশ্য।
সেই মুহূর্তেই সিঁড়ির মুখে ঝুমঝুম শব্দ জেগে উঠল এবং শব্দ যেন সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল, আমি এগিয়ে গেলাম। শব্দ অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। ঝুমঝুম শব্দ সিঁড়ির নীচে অবধি গিয়েই স্তব্ধ হল আর আমি শুনলাম টং টং করে একতারা বাজছে সিঁড়ির পাশের দেওয়ালের আড়ালে। সেদিকে একটা দরজা আছে, সেটা ভেজানো। আমি একরাশ ঝংকারের সঙ্গে গম্ভীর কিন্তু কোমল স্বরের গান শুনতে পেলাম—
ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজে
রাধারানী যায় অভিসারে
কী বা অপরূপ সাজে।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা আস্তে ঠেলে খুললাম। দেখলাম, কড়ি বৈরাগী চোখ বুজে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। ঘরটিতে পেতল—কাঁসার রান্নার বাসন সাজানো, কড়ি আমার উপস্থিতি টের পেল না। আমি তাকে না ডেকে দরজা আস্তে টেনে দিয়ে ফিরে দাঁড়ালাম।
নীচের সব কিছুই বন্ধ ও অন্ধকার। দরজা জানালার ফুটোফাটা দিয়ে যা সামান্য আলো আসছে। নীচের বড়ো দালানের মাঝখানে, দোতলার মতোই ছোটো দরজা রয়েছে এদিক থেকে শিকল টেনে আটকানো। বাড়ির পিছন দিয়ে ওই দরজা দিয়ে প্রাণনিধিবাবুর সঙ্গে এদিকে এসেছিলাম।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না। আবার ওপরে উঠলাম। দীর্ঘ সরু দালানের দরজা দিয়ে ঢুকে নিজের ঘরে গেলাম এবং ঘরের উত্তরদিকের দরজা খুলে দিয়ে আবার পুঁথি নিয়ে বসলাম।
খানিকক্ষণ বাদেই প্রাণনিধিবাবু এলেন। সদ্য ঘুম—ভাঙা চোখের ফোলা মুখ। জিজ্ঞাসা করলেন, একটু কি দিবানিদ্রা দিলেন, নাকি সেই থেকে পড়ছেন?
—না, একটু ঘুমিয়েছিলাম।
—আমি আবার একটু না ঘুমিয়ে পারি না। চা চলবে তো?
—চলবে।
—তাহলে চলুন মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে নীচে যাই। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ব, একেবারে ঘুরে—টুরে ফিরব।
বললাম, তাই চলুন।
সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই আমরা ফিরে এলাম। গ্রামের কোন পাড়ায় তিনি স্বর্ণমুদ্রাটি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তা দেখালেন। প্রাচীন গ্রাম আর গঙ্গার ধারেই আমাদের বেড়ানো সীমাবদ্ধ রইল।
বাড়ির মধ্যে হ্যারিকেনের আলো। একতলায় বাইরের বাড়িতে প্রাণনিধিবাবু তাঁর নানাবিধ বস্তুর সংগ্রহের কাহিনি শোনালেন। রাত্রি প্রায় সাড়ে ন—টার সময়ে কড়ি বৈরাগী আমাদের খেতে ডাকল। দেখা গেল রাত্রে লুচির ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে একটু দুধ।
পরদিন সকালে গুপ্তিপাড়া, বোগুলা ইত্যাদি গ্রাম ঘুরতে যাবার প্রোগ্রাম করে শুতে গেলাম।
ঘরে ঢুকে দেখলাম খাটে মশারি টাঙানো, চারিদিক গোঁজা। হ্যারিকেন জ্বলছে। একপাশে জলের কুঁজো ও কাঁসার গ্লাস।
হ্যারিকেন কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘুম এল না। বাইরের গাছপালায় চৈত্র বাতাসের হু হু শব্দ, কনকচাঁপা আর লেবু ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছে। ঘুমটা ঠিক এসেছিল কি না বুঝে ওঠবার আগেই আবার সেই ঝুমঝুম শব্দ ঘরের মেঝেয় শোনা গেল। মনে হল, হেঁটে সেই শব্দ আমার খাটের সামনে এসে থামল।
আমি বালিশ থেকে মুখ তুলে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দেখলাম, ছোটোখাটো একটা ছায়ামূর্তি মশারির বাইরে আমার দিকেই যেন তাকিয়ে রয়েছে। আমি উঠে বসতে বসতেই, কমানো হ্যারিকেনের আলোয় সেই মূর্তি যেন অনেকটা স্পষ্ট রূপ ধারণ করল। দেখলাম একটি ৭/৮ বছরের ফরসা মেয়ে, লাল পাড় শাড়ি পরা। কপালে এবং সিঁথেয় সিঁদুর। গায়ে কোনো জামা নেই, কিন্তু সর্বাঙ্গে সোনার গহনা। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি, ডাগর কালো চোখের স্থির দৃষ্টি আমার দিকে।
কয়েক মুহূর্ত সেই চোখের দিকে চেয়ে থেকে আমি কেমন যেন আচ্ছন্নতা বোধ করলাম। দেখলাম, সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মশারির বাইরে খাট থেকে নেমে দাঁড়াতেই বালিকা বধূ দরজার কাছ থেকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আমাকে খিল খোলবার ইঙ্গিত করল। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললাম। সে আমাকে বড়ো দালানের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। বালিকা আমার আগে ঝুমঝুম শব্দে এগিয়ে চলেছে, আমি তাকে অনুসরণ করে চলেছি।
বড়ো দালানে পৌঁছে সে সিঁড়ির মুখে গিয়ে আমাকে নীচের দিকে যাবার সংকেত করল। অন্ধকারে বালিকার মূর্তি কেমন করে এত স্পষ্ট ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, সে প্রশ্ন আমার মনে একবারও জাগল না। নীচে নেমে, বড়ো দালানের মাঝামাঝি সরু দালানের দরজার কাছে গিয়ে বালিকা দাঁড়াল। আমাকে আবার সরু দালানের দিকে যেতে ইশারা করল। নিজের সম্পর্কে কোনো চেতনাই আমার তখন নেই শুধু বালিকাকে অনুসরণ করা ছাড়া। একটা ঠান্ডা বাতাসের ভেজা স্পর্শ অনুভব করলাম। সরু দালানের খানিকটা গিয়ে বালিকা আমাকে ইশারায় বাঁদিকের একটি ঘরের মধ্যে ডাকল।
সেই ঘরে ঢুকে দেখি, হ্যারিকেন জ্বলছে এবং ছ—টি নারী মূর্তি সকলেই কোনো কাজে ব্যস্ত। আমি ঢুকতেই সকলে আমার দিকে তাকাল। দেখি, দশ থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স এবং সকলেই বিবাহিতা। কপালে ফোঁটা, সিঁথেয় সিঁদুর, কারোর শুধু লাল পাড়, কারোর লালের ওপর কল্কা দেওয়া জলকাচা শাড়ি পরা। কারোরই গায়ে জামা নেই, হাতে গলায় কানে নাকে পায়ে সোনার অলংকার। সকলেই ফরসা আর সুন্দরী। আমার এই বালিকাটিকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে সাত জন।
সকলেই আমার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে যেন অর্থবহ হাসি হাসল। ওদের মধ্যে কেউ শিলে কিছু বাটছে, কেউ হামানদিস্তায় কিছু গুঁড়ো করছে, কেউ জলের পাত্রে পাথরের গেলাস নিয়ে জল ঢালা তোলা করছে।
তাদের মধ্যে ১৬/১৭ বছরের একটি তরুণী হঠাৎ যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল এবং তার বুকের আঁচল খসে পড়ল। কান্নার কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। সে তার স্বাস্থ্যোদ্ধত তরুণী বুকে হাত দিয়ে সজোরে চাপড়াতে লাগল।
একটু বয়োজ্যেষ্ঠ আর একজন তাকে বুকে টেনে নিয়ে নানাভাবে যেন সান্ত্বনা দিতে লাগল। সেই ৭/৮ বছরের বালিকাও ওদের মাঝে পড়ে কাঁদতে লাগল। কোনো শব্দ নেই কান্নায়। কোনো রুদ্ধ কান্নার দমকা নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে সকলেই কান্না থামাল। আবার তারা যে যার কাজে ব্যস্ত হল। তারা নিজেদের শিথিল এবং স্খলিত শাড়ি ও উদাম উন্মুক্ত অঙ্গের জন্য কেউ লজ্জিত নয়। এবং নিজেদের মধ্যে নিঃশব্দে কথা বলাবলি করছে, হাসাহাসি করছে। তাদের সুবর্ণমণ্ডিত যৌবনোচ্ছল শরীরগুলো যেন বিবসনা সুন্দরীদের মতো আমার সামনে জীবন্ত প্রতিমাবৎ আচরণ করছে।
তাদের কথাবার্তা আচার—আচরণ আমার খুব স্বাভাবিক লাগছে না। আমি বুঝতে পারছি, আচ্ছন্নতার মধ্যেও একটি মুগ্ধতা আমার প্রাণের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নানান বয়সের এই বিবাহিতা নারীরা কী করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা আমার খুব কাছেই, তবু যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটা তীব্র গন্ধ আমার ঘ্রাণকে অতিমাত্রায় উত্তেজিত করে তুলতে লাগল।
তারপর আবার তারা পরস্পরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের দীর্ঘ কেশরাশি আলুলায়িত, শাড়ির কোনো স্থিরতা রইল না। প্রস্তুত তরল পদার্থ তারা পাথরের পাত্রে ভরে সকলে পান করল। ক্রমে তাদের মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে লাগল। তারা সকলে যেন যন্ত্রণায় ছটফট করে কুঁকড়ে, বুক চাপড়াতে লাগল। সকলের আগে ৬/৭ বছরের সেই বালিকা প্রায় নগ্নাবস্থায় সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেল এবং তার স্বর্ণকান্তি নীলবর্ণ ধারণ করল।
একে একে সকলের দশাই এক হল।
আমার চোখের সামনে সাতটি বিভিন্ন বয়সের বালিকা, কিশোরী, যুবতী চোখ বুজে মৃতবৎ পড়ে রইল। এবং সকলের বর্ণই নীল হয়ে উঠল।
সহসা একতারার ঝংকার শুনে চমকে উঠলাম এবং মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে দৃশ্য অপসারিত হল। দেখলাম আমি একটা অন্ধকার ঘরে ভূতগ্রস্তের মতো যেন সদ্য স্বপ্ন ভেঙে জেগে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কেবল একটা চামচিকে ফরফর করে আমার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে।
আমার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল, তৎক্ষণাৎ ঘরের বাইরে এলাম। সরু দালানে পা দিতেই দক্ষিণের বড়ো দালানে নজর পড়ল। ভাঙা দরমার ফাঁক দিয়ে সেখানে ভোরের আলোর ইশারা চোখে পড়ছে। একতারার শব্দও এদিক থেকেই আসছে। আমি দ্রুতপদে বড়ো দালানে গেলাম এবং দেখলাম, কড়ি বৈরাগী দালানের বড়ো দরজার সামনে বসে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। তার চোখ বোজা, সে আমাকে দেখতে পেল না। তার গানের কথাগুলো শুনলাম।
আমার রাইবিনোদিনী
সঙ্গী সঙ্গে যাবে মথুরা
এ বৃন্দাবন গোকুল
রাইগোপিনী হারা
আমি প্রায় মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে তার গান শুনলাম। আবার বড়ো দালানের ভিতর দিয়ে বাঁদিকে তাকালাম। আলো নেই, কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। সাতটি স্বর্ণ প্রতিমাবৎ নারী তো দূরের কথা। অথচ সারারাত আমার একভাবে দাঁড়িয়ে কেটে গিয়েছে।
আমি আমার শোবার ঘরের চেহারা দেখবার জন্য কৌতূহলী হয়ে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গিয়ে বড়ো দালান পেরিয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম, রাত্রের সেই ঘর। হ্যারিকেন তেমনি কমানো। আমি যেখান দিয়ে মশারি ফাঁক করে বেরিয়েছিলাম, সেখানে মশারি এখনও তেমনি আলগা করা। আমার চোখের সামনে সেই বালিকার মূর্তি ভেসে উঠল তারপর বাকি ক—জনের মূর্তিও। আমি অভাবিত বিস্ময় নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলাম না। মনে হল চোখ দুটো জ্বালা করছে, বুজে আসছে। আমি মশারির মধ্যে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। প্রায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। রাত্রের সমস্ত কথাই মনে পড়ল। যদিও কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছি না এবং এখন সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক আর অবাস্তব মনে হচ্ছে। আমি উত্তরের দরজা খুলে বাথরুমে গিয়ে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে ঘরে গিয়ে দেখলাম মশারি তোলা হয়ে গেছে। প্রাণনিধিবাবু বসে আছেন খাটের ওপর। জিজ্ঞেস করলেন, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?
আমি নির্দ্বিধায় বললাম, প্রথম রাত্রে তেমন হয়নি, নতুন জায়গা তো। তাই বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল।
প্রাণনিধিবাবু এ বিষয়ে আর কিছু না বলে অন্য কথা বললেন, তাহলে চলুন একটু কিছু খেয়ে ঘুরে আসা যাক।
—চলুন।
আমরা দুপুর পর্যন্ত ঘুরে এসে স্নান খাওয়াদাওয়া সারলাম। স্বভাবতই রাত্রে ঘুম হয়নি বলে দিনের বেলা ঘুম পেল। এবং আবার সেই ঝুমঝুম শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ ছাড়া দিনের বেলা কিছু দেখতে পেলাম না। কেবল নীচের দালানে গিয়ে সেই শব্দ হারিয়ে গেল এবং কড়ি বৈরাগীর একতারা বাজিয়ে গান শোনা গেল।
এ বিষয়ে প্রাণনিধিবাবুকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারলাম না। আরও একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করল, তা হল প্রাণনিধিবাবু তাঁর সংগ্রহশালা একবারও আমাকে দেখাবার কথা বললেন না।
রাত্রে ঘুমোতে যাবার পরে আবার সেই বালিকার আবির্ভাব ঘটল। এবং গত রাত্রের মতোই হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। আজ যেন আমার নিশিঘোরের কৌতূহলই বেশি। আজও আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাত সোনার প্রতিমার সেই একই আচার—আচরণ এবং নিদ্রাভিভূত অবস্থায় নীল হয়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু তার আগেই আমি ব্যাকুলভাবে বলে উঠলাম, তোমরা কারা? তোমরা কী করছ?
জবাবে আমি কড়ি বৈরাগীর একতারার ঝংকার শুনলাম এবং অন্ধকার দেখলাম। বাইরে সেই ভোরের আলো।
ঘুম ভাঙল তেমনি বেলাতেই। আজ আমার কলকাতায় ফেরার দিন। অথচ সাতটি স্বর্ণ প্রতিমার আকর্ষণ যেন কিছুতেই কাটাতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সারাজীবন দুপুর ও রাত্রিগুলোর অন্ধকারে, আমি সাত স্বর্ণপ্রতিমার সান্নিধ্য খুঁজে ফিরি।
কিন্তু সেকথা প্রাণনিধিবাবুকে বলতে পারলাম না, তবে আজ বলেই ফেললাম, আপনার সংগ্রহশালাটি দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল।
প্রাণনিধিবাবু বললেন, চলুন।
তিনি একগোছা চাবি নিয়ে দোতলার সরু দালানের মধ্যে সেই তালাবন্ধ ঘরের তালা খুললেন। দরজা খুলে জানালা উন্মুক্ত করতেই দীর্ঘ টেবিলের ওপর নানারকমের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা দেখতে পেলাম। নানারকম দামি ও মহার্ঘ পাথরও রয়েছে। সব কিছুরই পরিচয় ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাশে পাশে কাগজের বোর্ডে লেখা আছে। আমি চমৎকৃত হয়ে গেলাম। শুধু নেশা নয়, অতি নিষ্ঠা না থাকলে এরকম সংগ্রহ কেউ করতে পারে না।
একপাশে একটি বড়ো কাঠের বাক্সের ঢাকনা খুলে চমকে উঠলাম। দেখলাম কতকগুলো লাল এবং লালের ওপর কল্কা দেওয়া শাড়ি, তার ওপরে স্তূপীকৃত সোনার গহনা। আমার খুবই চেনা শাড়ি ও গহনা— যা আমি সেই সাত সোনার প্রতিমার গায়ে দেখেছিলাম।
আমি প্রাণনিধির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কীসের সংগ্রহ প্রাণনিধিবাবু?
তিনি বললেন, ওগুলো আমার পারিবারিক সংগ্রহ। এক ট্র্যাজেডির সাক্ষী।
আমি ব্যাকুল বিস্ময়ে ও কৌতূহলে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ট্র্যাজেডি?
প্রাণনিধিবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ট্র্যাজেডিটা ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। আমার প্রপিতামহের সাত বোনকে এক রাত্রে এক বৃদ্ধ কুলীনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাত বছর বয়স থেকে কুড়ি পঁচিশের মধ্যে তাঁদের সকলের বয়স ছিল।
প্রাণনিধিবাবু থামলেন। আমি রুদ্ধশ্বাস হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?
তিনি বললেন, কুলীনদের ব্যাপার তো সবই জানেন। কিন্তু ঘটনাটা যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ঘটত কী হত জানি না, কিন্তু শেষের দিকে হাওয়া একটু অন্যরকম ছিল। প্রপিতামহের বোনেরা সে বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। সকলেই একরাত্রে বিষ খেয়ে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলেন। এসব চিহ্ন তাঁদেরই।
আমি অপলক চোখে সেই বাক্সের শাড়ি আর গহনাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার কানে বাজতে লাগল ঝুমঝুম শব্দ ও চোখের সামনে ভাসল সাতটি জীবন্ত সুবর্ণ প্রতিমা।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি কাঠের বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করলাম। শতাব্দীর ওপারের সাতটি প্রাণের যন্ত্রণা আমাকে আহ্বান করছিল। জাতির এক অভিশপ্ত খেলার করুণ সেই চিহ্ন আমি দেখেছি।
দুপুরের খাওয়ার পর পরই সোজা কলকাতায় রওনা হয়ে গেলাম।