শঠে শাঠ্যং – চারু বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতার চৌরঙ্গী রোডের উপর সন্তরাম জীবনরাম ভাটিয়ার মস্ত বড় দোকান ; সেই দোকানে অতি পুরাতন দুর্লভ ও নানা দেশ-বিদেশের বিচিত্র শিল্প-সম্ভারের কারবার করে সে। তিব্বতের তৈরি মণিপদ্মে হুং, নেপালের ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি, চীনের প্রাচীন পোর্সিলেন, জাপানের মাৎসুমা পোর্সিলেনের বাসন, বর্মার ছাতা, চীনা মান্দারিনের প্রাচীন ড্রাগন আঁকা জোব্বা, চীনা চিত্রকরের প্রাচীন ছবি, জাপানী কিমোনো, জাপানী ছবি, সামুরাইয়ের তরোয়াল, বলীদ্বীপের ঘণ্টা, যবদ্বীপের দেবমূর্তি, সিংহলের রূপা-বাধানো নারিকেল-মালার বাটি, গান্ধারের মূর্তি, ওয়াজিরিদের চাপ্লি জুতা, মেক্সিকোর ডাকাতদের ছোরা, কর্সিকার ডাকাতের কোমরবন্ধ, বেলোয়ারী কাচের সুতোয় বোনা নেকটাই, র্যাফেল মুরিলো জশুয়া রেনলডসের ছবি—এমনি কত কি দামী আর দুর্লভ অদ্ভুত শিল্প-সম্ভারে তার দোকান সৌন্দর্য আর বিস্ময়ের বিলাসভবন হয়ে আছে। দেশ-বিদেশের রাজা, মহারাজারা আর আমেরিকার মালটি-মিলিওনিয়ার বা ক্রোড়পতিরা শীতকালে যখন কলকাতায় আসে, তখন জীবনরাম বেশ মোটা রকম লাভ করে। অন্য সময়েও তার দোকানে লোকের ভিড় কম হয় না ; ক্রেতা বেশি না থাকুক, কৌতূহলী দর্শকের আনাগোনায় জীবনরামের দোকান সর্বদাই সরগরম থাকে। তার দোকানে দামী জিনিস যেমন আছে, সস্তা অথচ সুন্দর জিনিসেরও অভাব নেই ; সিংহলের তালকাঠের ছড়ি, বর্মার গালার রঙে ছবি আঁকা বাঁশের কৌটা, দার্জিলিঙের রংচঙা পাথরের চেন, হার, দুল, জাপানের খড়ের চটি জুতা, উড়িষ্যার আবলুশ কাঠের উপর হাড়ের কাজ-করা লাঠি আর বাক্স, খুব অল্প দামেই বিক্রি হয়। যারা দোকানের শোভা আর দুর্লভদৰ্শন দ্রব্য দেখতে দোকানে যায়, তারা চক্ষুলজ্জার খাতিরে অল্পদামী একটা দুটো জিনিস কিনে আনে। এতেই জীবনরামের জীবনযাত্রা বেশ সুখ-স্বচ্ছন্দেই চলতে থাকে।
কিন্তু পুলিশের সন্দেহ দৃষ্টি লেগে থাকে এমনি প্রাচীন আর দুর্লভ মনিহারী ও মনোহারী দোকানের উপর। পুরনো জিনিসের বেশির ভাগ চোরাই মাল হওয়া সম্ভব, নইলে এমন সব দুর্লভ দ্রব্য স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করবে, এমন হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া জগতে খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। পুলিশ খবর পেয়েছে, জীবনরাম চোরাই মালের কারবার করে ; চোরাই মাল কিনে সে এমন নিপুণভাবে সেগুলির গঠনে আর চেহারায় অদল-বদল ঘটায় যে, সেই দ্রব্য যার চোখের সামনে থেকে থেকে অতি পরিচিত হয়ে গেছে, সেই মালিকও আর তার নিজের মাল চিনতে বা সনাক্ত করতে পারে না। পুলিশের গোয়েন্দারা সাধারণ ভদ্রলোক ক্রেতার বেশে প্রত্যহ দোকানে এসে ঘোরাফেরা করে ; অদ্ভুত বা দামী বা দুর্লভ জিনিস চুরি যাওয়ার খবর পেয়েই পুলিশের লোক জীবনরামের দোকানে ছদ্মবেশে এসে ঘুরে যায়; কিন্তু তাকে ঘূর্ণাক্ষরেও কলঙ্কভাগী করতে পারে, এমন চিহ্ন তারা এ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি । পুলিশের কাছে খবর এল, এক সৌখীন ধনীর বৈঠকখানা থেকে একটা তিব্বতী মনিপদ্মে হুং চুরি গেছে। সেই জিনিসটা হচ্ছে একটি রূপার অষ্টদল পদ্ম। পদ্মকোষটা সোনার, তার উপরে অষ্টধাতুর একটি বজ্র আছে। বজ্রটির দুই মুখে আর মধ্যদেশে তিনটি মরকত মণি বসানো আছে ; পদ্মের আটটি পাপড়িতে বিচিত্র কারুকার্য করা, একটি পাপড়ি একটু ভাঙা ; পদ্মকেশরগুলি সোনার তারের মুখে মুক্ত লাগিয়ে তৈরি ; পদ্মটি একটি বেদীর আকারের যন্ত্রের উপর স্থাপিত ; সেই যন্ত্রবেদী ধরে পদ্মটি শূন্যে তুললে পদ্মের অষ্টদল মুদিত হয়ে পদ্মকোষস্থিত বজ্রটিকে আবৃত করে, আর পদ্মটিকে শূন্যে থেকে নামিয়ে যন্ত্রবেদীকে কোনো আধারের উপর স্থাপন করলে পদ্মটির অষ্টদল বিকশিত হয়ে খুলে ছড়িয়ে পড়ে আর পদ্মকোষস্থিত বজ্রটি প্রকাশিত হয়ে যায়। পুলিশের সন্দেহ হল, এমন দুর্লভ বিচিত্র দ্রব্য নিশ্চয়ই জীবনরামের দোকানে গোপন অভিসার করেছে বা করছে। পুলিশ বহুদিন তাকে তাকে ফিরল, কিন্তু চোরাই মালের কোনই সন্ধান মিলল না।
একদিন জীবনরাম তার দোকান থেকে বেরিয়ে মোটর গাড়িতে চড়তে যাবে, এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে তাকে বললে, আপনার নামে একটা ওয়ারেন্ট আছে।
জীবনরাম আশ্চর্য ও ভীতস্বরে জিজ্ঞাসা করলে, আমার নামে ওয়ারেন্ট ?
পুলিশ অফিসার বললে, হ্যাঁ, এই দেখুন। পুলিশ অফিসার জীবনরামের সামনে একখানা ওয়ারেন্ট মেলে ধরলে । জীবনরাম সেই কাগজখানার উপর চোখ ফেলেই প্রফুল্ল হয়ে উঠল ; এ ওয়ারেন্ট তো নেকিরাম জীবনরামের নামে ; আমার নাম তো সন্তরাম জীবনরাম। এ ওয়ারেন্ট আমার নয় ।
অফিসার বলল, আপনি হয়তো নাম বদ্লেছেন।
জীবনরাম হেসে বললে, বদলাতে হলে লোকে নিজের নামটাই বদলায়, বাপের নাম কেউ বদলায় না। আমি সন্তরামের পুত্র জীবনরাম ; আর এই ওয়ারেন্ট যার নামে সে নেকিরামের পুত্র জীবনরামের।
অফিসার বললে, তা হবে। তাহলে আপনি যদি একবার অনুগ্রহ করে পুলিশ কমিশনারের অফিসে গিয়ে কমিশনার সাহেবকে এই কথাটা বুঝিয়ে বলেন, তবে সকল গোল মিটে যায়।
জীবনরাম বললে, চলুন ; কমিশনার সাহেবের সঙ্গে তো আমার পরিচয় আছে ; তিনি তো আমার দোকানের খরিদ্দার।
অফিসার বললে, তাহলে তো কোন ভাবনাই নেই। আমার বেয়াদপি মাপ করবেন, আমরা হুজুরের চাকর, আপনাকে একটু কষ্ট দিলাম।
জীবনরাম এ কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, এ ওয়ারেন্ট কিসের জন্য ?
অফিসার বললে, এ সি. আই. ডি’র ওয়ারেন্ট, এর কারণ বলবার নয়। তবে আপনি যখন সেই লোকই নন, তখন আপনাকে বলি—রাওয়ালপিণ্ডিতে যে পুলিশ অফিসার খুন হয়েছে সেই সম্পর্কেই।
জীবনরাম বললে, ওঃ! আমার কোন পুরুষের সঙ্গে রাওয়ালপিণ্ডির কোন লোকের সম্পর্কই নেই। আমি তো ছ মাসের মধ্যে কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাই-ইনি, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
অফিসার বললে, তাহলে আপনি একবার গিয়ে এই কথাটা বললেই হবে। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট দিতে বাধ্য হচ্ছি। মাপ করবেন ।
জীবনরাম মনে মনে বিরক্ত ও একটু ভীতও হয়েছিল, তাই পুলিশ অফিসারের ক্ষমা প্রার্থনার উত্তরে সে বিনয় প্রকাশ করতে পারছিল না যে, আপনার আর দোষ কি অথবা আমার এতে আর কষ্টই বা কি ! সে অফিসারের কোন কথার উত্তর না দিয়ে নিজের দোকানের কর্মচারীকে ডেকে বলল, ‘এ ভাই দৌলতরাম, আমি পুলিশ-কমিশনারের অফিসে যাচ্ছি ; এই অফিসার এক নেকিরাম জীবনরামের নামে ওয়ারেন্ট এনে আমাকে গ্রেপ্তার করতে চান। আমি পুলিশ-কমিশনার সাহেবকে বললেই তিনি এই অফিসারের ভুল বুঝতে পারবেন, কারণ তিনি তো আমাকে ভালো ভাবেই চেনেন।
এই বলে জীবনরাম পুলিশ অফিসারের মোটরে চড়ে চলে গেল।
জীবনরাম পুলিশ-কমিশনারের অফিসে গিয়ে পুলিশ-কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে, ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার বললেন, ‘পুলিশ-কমিশনার এখন নেই। কিন্তু আপনি ব্যস্ত হবেন না, আপনার কোন আশঙ্কাও নেই। আপনি যে একজন নামজাদা ব্যবসাদার, তা কলকাতা শহরের কে না জানে ? তবে একটা সন্দেহ মীমাংসা করবার জন্যই আপনাকে একটু কষ্ট দিতে বাধ্য হয়েছি। আপনি আমাদের সেই বেয়াদপি মাপ করবেন। আপনি বসুন। হর্ষবাবু, সেই নেকিরাম জীবনরামের ফাইলটা নিয়ে আসুন দেখি ।
যে পুলিশ-অফিসার জীবনরামকে গ্রেপ্তার করে এনেছিল সে ঘরের এক পায়রাখোপ আলমারি থেকে একটা ফাইল এনে ডেপুটি পুলিশ-কমিশনারকে দিল। ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার সেই ফাইলের ভিতর থেকে একখানা লেখা কাগজ বের করে জীবনরামকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন তো, এ লেখা কি আপনার ?
জীবনরাম সেই গুজরাটি লেখা কাগজখানা হাতে নিয়ে পড়েই বললে, না, এ লেখা আমার নয়।
ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার বললেন, আপনি একখানা কাগজে এই কাগজের লেখা কথা কটা অনুগ্রহ করে লিখুন ; আমাদের হ্যান্ডরাইটিং একস্পার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখতে চাই। সে যদি বলে, এই দুই কাগজের লেখা এক হাতের নয়, তাহলেই আপনাকে আর আমরা কষ্ট দেব না।
জীবনরাম একখানা কাগজের উপর পূর্বপ্রদর্শিত কাগজের লেখা কথাগুলি লিখল।তার মর্ম হচ্ছে : ‘পুলিশ সব টের পেয়েছে, এই পত্রবাহক যা বলবে, সেই রকম ব্যবস্থা করবে। বেশি লেখবার সময় ও সুবিধা নেই।’
লেখা শেষ করে জীবনরাম কাগজখানা ডেপুটি-কমিশনারকে দিতে উদ্যত হল। ডেপুটি কমিশনার বললেন, ওর নিচে আপনার নামটা সই করুন, তাহলে আমরা বুঝতে পারব, কোনটা আপনার লেখা।
জীবনরাম নাম সই করে দিল।
হর্ষবাবুকে সেই কাগজ দুখানা দিয়ে ডেপুটি কমিশনার বললেন, হর্ষবাবু, হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টকে লেখা দুটো দেখিয়ে তাঁর অভিমত লিখিয়ে নিয়ে আসুন।
হর্ষবাবু কাগজ নিয়ে চলে গেল।
জীবনরাম বসেই আছে। হর্ষ আর ফেরে না। প্রতীক্ষার প্রত্যেক ক্ষণ জীবনরামের কাছে যুগান্ত বলে বলে মনে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে ডেপুটি কমিশনারের ঘরের টেলিফোনের ঘণ্টা বেজে উঠল। ডেপুটি কমিশনার টেলিফোন ধরে কথা শুনে বললেন, আচ্ছা। তারপর টেলিফোনের চোঙ্ রেখে দিয়ে ডেপুটি কমিশনার জীবনরামকে বললেন, আপনি এখন যেতে পারেন। আমাদের হস্তাক্ষর-পরীক্ষক বললেন যে, আপনার হস্তাক্ষরের সঙ্গে আমাদের কাগজের লেখা মিলল না। আপনাকে যে আমরা অকারণে একটু কষ্ট দিলাম, তার জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন।
জীবনরাম খুবই রুষ্ট হয়েছিল ; সে কোন কথা না বলে ডেপুটি কমিশনারকে অভিবাদন করল এবং জোরে জোরে পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে গেল। জীবনরাম একটা ট্যাক্সি ডেকে নিজের দোকানে ফিরে গেল। সে গাড়ি থেকে নেমেই দেখল একখানা মোটর-লরিতে তার দোকান থেকে বহু সামগ্রী বাহির করে এনে তোলা হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের কর্মচারী দৌলতরাম আর একজন অপরিচিত গুজরাটি পোশাক পরা লোক।
জীবনরাম আশ্চর্য হয়ে দৌলতরামকে জিজ্ঞাসা করলে, এ সব জিনিস কোথায় যাচ্ছে ? সব কি বিক্রি হয়েছে ?
জীবনরামের এই প্রশ্নে দৌলতরাম আশ্চর্য হয়ে বললে, বিক্রি তো হয়নি ; এই বাবু আপনার চিঠি নিয়ে এসে বললেন যে, পুলিশ চোরাই মালের খবর পেয়েছে ; এখনই খানা-তল্লাসী করতে আসবে, তার আগে সব মাল সরিয়ে ফেলতে হবে। এই তো আপনার চিঠি—
দৌলতরাম জীবনরামের হাতে চিঠি দিল। জীবনরাম বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষু কাগজের উপর স্থাপন করে দেখে, পুলিশ অফিসে যে কাগজে সে লিখেছিল— ‘পুলিশ সব টের পেয়েছে ; এই পত্রবাহক যা বলবে সেইরকম ব্যবস্থা করবে। বেশি লেখার সময় সুবিধা নেই।’ জীবনরাম বিহ্বল দৃষ্টি তুলে অপরিচিত গুজরাটি লোকটার দিকে তাকাল। সেই লোকটি মৃদু হেসে বলল, আমি পুলিশের লোক।
ঠিক সেই সময় হর্ষবাবু হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল, ‘জীবনরামবাবু, আমি আপনাকে ব-মাল গ্রেপ্তার করছি। আপনাকে আর একবার আমার সঙ্গে যেতে হচ্ছে। তবে এবার একলা নয়, আপনার সঙ্গী হবেন দৌলতরাম।
জীবনরাম বজ্রাহতের মতন নীরব নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের ধূর্ত কৌশলের কথাই ভাবতে লাগল।