শঠে শঠে (কুটিল কৌশলের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত!)

শঠে শঠে (কুটিল কৌশলের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত) 

ঘটনাচক্রে পড়িয়া একটি অদ্ভুত মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হয়। আমি যে বিষয় অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহা পাঠকগণকে বলিবার পূর্ব্বে তদ্বিষয়-সংস্পৃষ্ট পূৰ্ব্বৰ্গত ঘটনাগুলি বর্ণনা করা যুক্তি-সঙ্গত বিবেচনা করিয়া প্রথমে তাহাই পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি। কারণ, শঠের শঠতার সীমা কতদূর পর্য্যন্ত হইতে পারে, তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ ইহার ভিতর দিয়া সুন্দররূপে দেখা যাইতে পারিবে। 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কালীপ্রসন্ন ঘোষ ও নগেন্দ্রনাথ ঘোষ দুইজন জ্ঞাতিভ্রাতা, বাসস্থান গোবিন্দপুরে। উভয়ে একই-বংশ-সম্ভূত। উভয়েরই অতি-বৃদ্ধ-প্রপিতামহ একজন। উভয়ের বৃদ্ধ-প্রপিতামহদ্বয় পরস্পর সহোদর ভ্রাতা ছিলেন। উভয় ভ্রাতার মধ্যে সম্পূর্ণরূপ সৌহার্দ্য না থাকায় উভয়েই পৃথক্ হন, ও পৃথক্ পৃথক্ বাটী প্রস্তুত করিয়া উভয়েই বসবাস করিতে থাকেন। সেই সময় হইতে উভয়ের মধ্যে যে মনোবিবাদ পরিলক্ষিত হইত, অদ্যাবধি তাহার শেষ হয় নাই; বংশানুক্রমে সেই বিবাদ চলিয়া আসিতেছে। 

কালীপ্রসন্ন ঘোষ ও নগেন্দ্রনাথ ঘোষের মধ্যে কত দেওয়ানী মোকদ্দমা হইয়া গিয়াছে, তাহার সংখ্যা করা সহজ নহে। উভয়েই কিন্তু অতিশয় চতুর ও কৌশলাবলম্বী সুতরাং তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে কেহই কাহাকে দেওয়ানী মোকদ্দমায় পরাজিত করিতে সমর্থ হন নাই। উভয়েই যেরূপ মোকদ্দমাপ্রিয় ও কৌশলাবলম্বী, তাহাতে উভয়েরই যদি প্রচুর অর্থ থাকিত, তাহা হইলে যে কি প্রকার বীভৎস ব্যাপার সংঘটিত হইত, তাহা বলা নিতান্ত সহজ নহে। ঈশ্বর কিন্তু সেই বিষয়ে সবিশেষ কৃপণতা প্রকাশ করিয়া ছিলেন বলিয়াই মঙ্গল। 

কালীপ্রসন্ন যখন দেখিলেন যে, দেওয়ানী মোকদ্দমায় নগেন্দ্রনাথের কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না, তখন মনে মনে সতত চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে নগেন্দ্রনাথকে জেলে পাঠাইতে সমর্থ হইবেন। একদিবস রাত্রিতে কালীপ্রসন্ন আহারাদি সমাপন পূর্ব্বক শয়ন করিলেন; কিন্তু নগেন্দ্রনাথকে কি প্রকারে জেলে পাঠাইতে পারিবেন, সেই চিন্তার দারুণ অত্যাচারে তাঁহার নিদ্রায় বিষম ব্যাঘাত উপস্থিত হইল। শুইয়া শুইয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন। ভাবিতে ভাবিতে একটি উপায়ও মনে মনে স্থির করিলেন, এবং পরদিবস হইতে সেই নূতন উপায় অবলম্বন করিয়া নগেন্দ্রনাথের সর্ব্বনাশ সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। 

তিন চারি দিবস পরেই দেখা গেল, সেইস্থানের পুলিস নগেন্দ্রনাথকে ধরিয়া লইয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট চালান দিলেন। সকলেই শুনিলে, এবার নগেন্দ্রনাথ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছেন,—বল প্রয়োগে একটি দরিদ্রা স্ত্রীলোকের গৌরবের ধন সতীত্ব-রত্ন নষ্ট করিয়াছেন। এই কথা প্রথমে তিনিই শ্রবণ করিলেন, তিনিই নগেন্দ্রনাথের উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন, তিনিই তাঁহাকে অযথারূপে গালি প্রদান করিলেন, এবং যাহাতে নগেন্দ্রনাথের বিলক্ষণ শাস্তি হয়, সকলে কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের নিকট তাহারই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। 

মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ করিয়া, ক্রমে ক্রমে ফরিয়াদী পক্ষীয় সমস্ত সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করিলেন। সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, বল-প্রয়োগে সতীর সতীত্ব নষ্ট করা অপরাধে নগেন্দ্রনাথ বাস্তবিক‍ই অপরাধী, সে বিষয়ে প্রমাণের অভাব নাই। যাহা হউক, পরিশেষে মাজিষ্ট্রেট সাহেব নগেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ মোকদ্দমায় এখন আপনার কিছু বলিবার আছে, কি না?” 

উত্তরে নগেন্দ্রনাথ কেবল এইমাত্র কহিলেন, “এই মোকদ্দমায় আমি সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। এ বিষয়ে আমার যাহা বলিবার আছে, তাহা এখন আমি এই শত্রুমণ্ডলীর ভিতর বলিতে ইচ্ছা করি না। দেখিতেছি, আপনি এই মোকদ্দমা দায়রায় পাঠাইতেছেন; সুতরাং যাহা বলিবাব, তাহা সেইস্থানেই বলিব।” নগেন্দ্রনাথ যাহা বলিলেন,—মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহাই লিখিয়া এই মোকদ্দমা দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। 

নিয়মিত সময়ে দায়রা বসিলে, এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল। সরকারী উকীল এই মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। আসামী নগেন্দ্রনাথের উকীল নাই। তিনি উকীল নিযুক্ত করিতে সমর্থ হন নাই, বা ইচ্ছা করিয়া কোন উকীলের সাহায্য গ্রহণ করেন নাই, তাহা আমি অবগত নহি। বিনা-উকীলেই কিন্তু তাঁহার মোকদ্দমা চলিতে লাগিল। সরকারী উকীল মোকদ্দমার অবস্থা জুরিগণকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন। 

জজ। আসামী! তোমার উপর এই গুরুতর অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে। ইহাতে তুমি কি বলিতে চাহ? মোকদ্দমায় তুমি দোষী কি নির্দোষ? 

নগেন্দ্র। ধর্ম্মাবতার! এ মিথ্যা মোকদ্দমা, এ মোকদ্দমায় আমি সম্পূর্ণরূপে নিদোষ। 

আসামীর এই কথা শ্রবণ করিয়া জজসাহেব সরকারী উকীলকে কহিলেন, “আসামী যাহা বলিতেছে, তাহা আপনি শ্রবণ করিলেন ত। এখন আপনি সাক্ষীগণকে ডাকিয়া এই মোকদ্দমা প্রমাণ করিতে পারেন।” 

উকীল মহাশয় জজসাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া ক্রমশ সাক্ষীগণকে ডাকিতে লাগিলেন। সাক্ষীগণ যেরূপ জবানবন্দী দিয়াছিল, তাহা বিস্তারিতরূপে লিখিতে হইলে, এই প্রবন্ধ অতিশয় দীর্ঘ হইয়া পড়ে, অথচ না লিখিলেও পাঠকগণ এই মোকদ্দমার অবস্থা সম্যকরূপে বোধগত করিতে সমর্থ হইবেন না, তাই বলিয়াই সাক্ষীগণের সংক্ষিপ্ত জবানবন্দী এইস্থানে প্রদত্ত হইল। উকীল মহাশয় যেরূপ পরপর সাক্ষীগণকে ডাকিয়াছিলেন, আমরাও পর পর তাহাদিগের সংক্ষিপ্ত জবানবন্দী এইস্থানে প্রদান করিলাম। 

প্রথম সাক্ষী কামিনী দাসী কহিল,—“ নগেন্দ্রনাথ যে পাড়ায় বাস করে, আমিও সেই পাড়ায় থাকি। আমরা গরিব লোক, পরের বাড়ী কৰ্ম্ম না করিলে আমাদিগের চলে না; সুতরাং রাস্তা দিয়া সর্ব্বদাই আমাকে একাকী গমনা—গমন করিতে হয়। রাস্তাঘাটে আমাকে একাকী দেখিলে নগেন্দ্রনাথ সৰ্ব্বদা ঠাট্টা তামাসা করিত। আমি তাহার অভিপ্রায় মন্দ বুঝিতে পারিয়া, সর্ব্বদা তাহার ভয়ে ভীত থাকিতাম, দূর হইতে তাহাকে দেখিতে পাইলে অন্য পথে গমন করিতাম। গত ২৫শে অগ্রহায়ণ তারিখে সন্ধ্যার পর কর্ম্ম করিয়া আমি আমার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম। আমার বাড়ীতে গমন করিতে হইলে, নগেন্দ্রনাথের বাড়ীর সম্মুখবর্তী পথ ব্যতীত অন্য পথ দিয়া গমন করিবার আর উপায় নাই। আমি নগেন্দ্রনাথের বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইবামাত্র কি জানি, কোথা হইতে নগেন্দ্রনাথ বহির্গত হইয়া বলপূর্ব্বক আমার হস্ত ধরিল। আমি হাত ছাড়াইতে সবিশেষ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। তখন অন্য উপায় না পাইয়া চীৎকার আরম্ভ করিলাম; তাহাতেও সে কিছু না মানিয়া, আরও বল-প্রয়োগ পূর্ব্বক ধরিয়া আমাকে তাহার বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে একটি জঙ্গলের ভিতর লইয়া গেল। আমি দুৰ্ব্বল স্ত্রীলোক, কাজেই বলবান্ পুরুষের সহিত যুঝিতে পারিলাম না। সে বলপূর্ব্বক আমার ধর্ম্ম নষ্ট করিয়া, আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিল। আমি উপায়হীন হইয়া কেবল চীৎকার করিতে লাগিলাম। এই সময়ে আমাদিগের পাড়ার রামসদয় দাস ও গফুর সর্দ্দার আমার সাহায্যের নিমিত্ত উপস্থিত হইল। তাহারা আসিয়া নগেন্দ্রনাথকে বিলক্ষণরূপে গালি দিলেও সে প্রথমে আমাকে পরিত্যাগ করিল না বটে, কিন্তু পরিশেষে উহাদিগের নিকট হইতে মার খাইয়া আমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিল ঐ দুই ব্যক্তিই আমাকে সেইস্থান হইতে আনয়ন করে। তৎপরে আমি থানায় গিয়া, উহার নামে নালিস করিয়াছিলাম। থানার দারোগা মহাশয় আমার নালিস লিখিয়া লইয়া, পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত আমাকে একজন ডাক্তারের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন।” 

জজ। আসামী! ফরিয়াদী যাহা বলিল, তাহা ত তুমি শ্রবণ করিলে। এখন তুমি উহাকে জেরা করিতে পার।

নগেন্দ্র। ও যাহা বলে—বলুক, আমি যখন এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ, তখন উহাকে আর কি জেরা করিব? কিন্তু ধর্ম্মাবতার যখন বলিতেছেন, তখন উহাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি। “তুমি যে বলিলে, থানার দারোগা তোমার নালিস লিখিয়া লইয়া পরীক্ষার নিমিত্ত তোমাকে ডাক্তারের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু তুমি আমাকে বলিতে পার যে, দারোগা জোর করিয়া তোমাকে ডাক্তারের নিকট পরীক্ষার নিমিত্ত পাঠাইয়াছিলেন, কি তোমার অভিমতে সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছিল।” 

কামিনী। দারোগা আমাকে জোর করিয়া পাঠান নাই, আমার মত লইয়াই পাঠাইয়াছিলেন। 

নগেন্দ্র। তুমি সতীসাধ্বী স্ত্রীলোক হইয়া নিজদেহ পুনরায় পরপুরুষকে স্পর্শ করিতে দিতে কিরূপে মত দিলে? কামিনী এ কথার কোন প্রকার উত্তর দিতে সমর্থ হইল না। উকীল তখন তাঁহার দ্বিতীয় সাক্ষীকে ডাকিলেন। দ্বিতীয় সাক্ষী রামসদয় দাস কহিলেন, “নগেন্দ্রনাথ যে পাড়ায় বাস করে, আমিও সেই পাড়ায় থাকি। ২৫শে অগ্রহায়ণ সন্ধ্যার পর কামিনীর চীৎকার শ্রবণ করিয়া আমি ও গফুর সর্দার নগেন্দ্রনাথের বাটী-অভিমুখে গমন করি, ও সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া গমন করিতে করিতে দেখি যে, একটি জঙ্গলের ভিতর নগেন্দ্রনাথ কামিনীর ধৰ্ম্ম নষ্ট করিতেছে। আমার হস্তে একটি লন্ঠন ছিল; সুতরাং সেই আলোর সাহায্যে আমরা সমস্তই দেখিতে পাইয়াছিলাম। আমরা প্রথমে নগেন্দ্রনাথকে গালি-গালাজ দিয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতেও সে কামিনীকে পরিত্যাগ করে নাই। তখন গফুর সর্দ্দার অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার হস্তস্থিত যষ্টিদ্বারা নগেন্দ্রনাথকে প্রহার করিয়াছিল। মার খাইয়া পরে নগেন্দ্রনাথ কামিনীকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছিল। আমরা কামিনীকে উলঙ্গ অবস্থায় জঙ্গলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া আনি, ও উহার বস্ত্র অন্বেষণ পূর্ব্বক উহাকে প্রদান করিয়া উহার লজ্জা নিবারণ করিয়াছিলাম।” 

এই সাক্ষীকে নগেন্দ্রনাথ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। 

তৃতীয় সাক্ষী গফুর সর্দ্দার। রামসদয় যাহা বলিয়াছিল, গফুরও তাহাই কহিল। ইহাকেও নগেন্দ্রনাথ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। 

চতুর্থ সাক্ষী ডাক্তার ব্রজনাথ বসু। ইনি কহিলেন, ২৫শে অগ্রহায়ণ রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমি কামিনীকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়াছিলাম। স্ত্রীলোকের উপর অকথ্য অত্যাচার করিয়া সতীত্ব নষ্ট করিলে, যে সকল চিহ্ন পাওয়া যায়, সে সমস্তই আমি উহার শরীরে দেখিতে পাইয়াছি। এই বলিয়া তিনি পরীক্ষায় যাহা যাহা দেখিয়াছিলেন, এক এক করিয়া তাঁহার সমস্তই বর্ণনা করিলেন। 

পঞ্চম সাক্ষী অনুসন্ধানকারী দারোগা হামিদুল্লা কহিলেন “আমি থানার দারোগা। এই কামিনী দাসী আমার নিকট এজাহার দেয় যে, ২৫শে অগ্রহায়ণ সন্ধ্যার পর সে যখন আসামী নগেন্দ্রনাথের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছিল সেই সময় নগেন্দ্রনাথ তাহার বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। সে কামিনীকে দেখিয়া বলপূর্ব্বক তাহার হাত ধরে। কামিনী বলপূর্ব্বক হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিলেও তাহাকে বল পূর্ব্বক বাড়ীর পশ্চাতে একটি জঙ্গলের ভিতর লইয়া যায় এবং সেইস্থানে বলপূর্ব্বক তাহার সতীত্ব নষ্ট করিয়াছে। কামিনী সেই সময়ে চীৎকার করিতে থাকায়, প্রতিবেশী রামসদয় দাস ও গফুর সর্দ্দার আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহারা স্বচক্ষে এই নৃশংস ব্যাপার দর্শন করে, ও বলপ্রকাশ করিয়া এমন কি প্রহার পর্যন্ত করিয়াও নগেন্দ্ৰনাথকে তাড়াইয়া দিয়াছিল। এই সংবাদ আমি ‘প্রথম এতেলায়’লিখিয়া লইয়া অনুসন্ধানে নিযুক্ত হই, ও সাক্ষীগণের এজাহার গ্রহণ করি। পরে কামিনীকেও পরীক্ষার নিমিত্ত ডাক্তারখানায় পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। আসামী নগেন্দ্রনাথকে পরিশেষে ধৃত করিয়া হুজুরে চালান দিয়াছি।” 

নগেন্দ্র দারোগাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। এই কয়েকটি সাক্ষীর এজাহারেই মোকদ্দমা শেষ হইল। সরকারী উকীল পূর্ব্বেই জুরিদিগকে মোকদ্দমার অবস্থা উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সাক্ষীগণের জবানবন্দী শেষ হইয়া গেলে, জুরি ও জজের ভাবভঙ্গিতে বেশ বোধ হইল যে, তাঁহারা এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিয়াছেন, এবং নগেন্দ্রনাথই যে এই ভয়ানক দোষে দোষী, তাহাও সকলে মনে মনে সাব্যস্ত করিয়া লইয়াছেন। 

জজসাহেব নগেন্দ্রনাথকে কহিলেন, “আসামী! তোমার বিরুদ্ধে এই গুরুতর মোকদ্দমা পরিষ্কাররূপে প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে। তুমি কোন সাক্ষীকে এমন কি কামিনীকে পর্যন্ত দস্তুরমত জেরা না করায় বোধ হইতেছে যে, তাহারা সকলে তোমার বিপক্ষে যে সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহা মিথ্যা নহে। এরূপ অবস্থায় এখন তুমি কি বলিতে চাহ?” 

নগেন্দ্র। ধর্ম্মাবতার! আমি এখনও বলিতেছি যে, আমি এই মোকদ্দমায় সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। আর ইহাও বলিতেছি যে, এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে আমি কোন কথা বলিতে চাহি না। আমার দুইজনমাত্র সাক্ষী আছেন। তাঁহাদিগের মধ্যে একজনকে আদালতে উপস্থিতও দেখিতেছি। আমি তাঁহাদিগকে ডাকিয়া দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি। তাঁহাদিগের কথা শুনিলেই আপনারা জানিতে পারিবেন, এই মোকদ্দমা মিথ্যা কিনা? 

নগেন্দ্রনাথের এই কথা শ্রবণ করিয়া জজসাহেব অল্প হাসিয়া কহিলেন, “মোকদ্দমা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহা দুইজন সাক্ষীর দ্বারা তুমি উড়াইয়া দিতে চাহ! না জানি তোমার সাক্ষীই বা কেমন! আচ্ছা, তুমি তোমার সাক্ষীকে ডাকিয়া যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহ, তাহা করিতে পার।” 

এই কথা শ্রবণ করিয়া নগেন্দ্রনাথ তাঁহার সাক্ষী শ্রীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র রক্ষিতকে ডাকিলেন। 

নগেন্দ্র। আপনি কি কাজ করেন? 

রামচন্দ্র। আমি ডাক্তারি করি। 

নগেন্দ্ৰ। কত দিবস হইতে আপনি ডাক্তারি করিতেছেন। 

রামচন্দ্র। প্রায় বিশ বৎসর হইতে। 

নগেন্দ্র। আপনি ডাক্তারিতে পাস করিয়াছেন কি না? 

এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া জজ ও জুরিগণ কহিলেন! “এ সম্বন্ধে রামচন্দ্র বাবুকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার আবশ্যক নাই। কারণ, রামচন্দ্র বাবু যে এই স্থানেই একজন প্রসিদ্ধ পাসকরা ডাক্তার, তাহা সকলেই অবগত আছেন এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে তুমি রামচন্দ্র বাবুকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহ, তাহাই জিজ্ঞাসা কর।” 

নগেন্দ্র। মহাশয়! আপনি আমাকে কত দিবস হইতে চিকিৎসা করিতেছেন? কোন রোগের চিকিৎসা করিতেছেন? এবং যদি আমার কোন প্রকার রোগ থাকে, তাহা অবস্থাই বা কি? 

রামচন্দ্র। আমি প্রায় পাঁচ বৎসর হইতে তোমায় চিকিৎসা করিতেছি। তোমার এক প্রকার রোগ জন্মিয়াছে যাহাতে তোমাকে Impotent করিয়াছে, অর্থাৎ তোমার পুরুষত্ব একেবারে নষ্ট করিয়াছে। এই রোগ যে সহজে আরোগ্য হইবে, তাহাও আমার বোধ হয় না। 

নগেন্দ্র। মহাশয়! আমার যে রোগ আছে কহিলেন, তাহাতে আমি ঈশ্বরের সকল নিয়ম প্রতিপালন অথবা আমার সমস্ত মনোবৃত্তির ইচ্ছানুযায়ী কার্য্য করিতে সমর্থ আছি কি না? 

রামচন্দ্র। এ রোগ যাহার হইয়াছে, সে তাহার মনোবৃত্তির সকল বৃত্তির কার্য্য সম্পন্ন করিতে কখনই সমর্থ হয় না। কারণ, বিষয়-বিশেষে ঈশ্বর প্রদত্ত মনুষ্যের স্বাভাবিক যে ক্ষমতা থাকে, এই রোগে সেই ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। 

এই কথা বলিয়া রামচন্দ্র আরও অনেক কথা জজ ও জরিদিগকে ইংরাজীতে বলিলেন। বাঙ্গালায় সেই সকল কথা লিখিতে হইলে, অশ্লীলতার হস্ত হইতে কোনরূপেই পরিত্রাণ নাই বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। 

রামচন্দ্রের সাক্ষ্য শেষ হইয়া গেলে, জজসাহেব সরকারী উকীলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ সাক্ষীর উপর আপনি কি বলিতে চাহেন?” 

সরকারী উকীল। আমি রামচন্দ্র বাবুকে দুই একটি কথায় জেরা করিতে চাহি। “রামচন্দ্র বাবু! আপনি কহিলেন, আপনি অনেক দিবস হইতে উহার চিকিৎসা করিতেছেন। বোধ করি, আপনি নিশ্চয়ই জানকীনাথ ঘোষকে চিনেন।” 

রামচন্দ্র। হাঁ চিনি, জানকী নগেন্দ্রনাথের পুত্র 

সরকারী উকিল। যে রোগে নগেন্দ্রনাথ আক্রান্ত কহিলেন, তাহাতে তাহার পুত্র হইল কি প্রকারে? 

রামচন্দ্র। নগেন্দ্রনাথ কেবল পাঁচ বৎসর হইতে এই রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। ইহার পূর্বে তাহার পুত্র হওয়ার আশ্চর্য কি? জানকীনাথের বয়ঃক্রম বোধ করি, এখন বার কি তের বৎসরের ন্যূন নহে 

সরকারী উকীল রামচন্দ্র বাবুকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া বসিয়া পড়িলেন। নগেন্দ্রনাথ পুনরায় আরও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে চাহিলেন, কিন্তু জুরিগণ আসামীকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন, “রামচন্দ্র বাবুকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন নাই। এখন দেখিতেছি তুমি নির্দোষ; আর এই মোকদ্দমা তোমার বিরুদ্ধে অন্যায় রূপে আনা হইয়াছে।” 

জুরিগণের এই কথা শ্রবণ করিয়া জজসাহেব কহিলেন “আমারও ঐ মত। যে ব্যক্তি আপনার স্ত্রী-সহবাস করিতে কোনক্রমে সমর্থ নহে, তাহা দ্বারা এই কার্য্য কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারে না; সুতরাং আমি নগেন্দ্রনাথকে নির্দোষ সাব্যস্ত করিয়া মুক্তি প্রদান করিলাম।” 

প্রহরিগণ নগেন্দ্রনাথকে ছাড়িয়া দিল। নগেন্দ্রনাথ হাসিতে হাসিতে আদালতের বাহিরে আসিলেন। আদালতের বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, কালীপ্রসন্ন দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাকে দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ কহিলেন, “খুব এক খেলা খেলিয়াছিলে কিন্তু আমিও নগেন্দ্রনাথ, আমিও ইহার প্রতিশোধ লইতে একবার চেষ্টা করিব, তাহা পূর্ব্বেই তোমাকে বলিয়া দিলাম। তুমি পার ত এখন হইতে সাবধান থাকিও।” এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ আপনার বাটী-অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। এইস্থানে পাঠকগণকে বোধহয় বলিয়া দেওয়া উচিত যে, কামিনী আদালতে যেরূপ সতীত্বের ভান করিয়াছিল, বাস্তবিক সে সেরূপ নহে। তাহার কলঙ্কের কথা পূর্ব্বে অনেকেই শ্রবণ করিয়াছিল। সে কালীপ্রসন্নের নিতান্ত বশীভূতা বলিয়াই তাঁহার পরামর্শে নগেন্দ্রনাথের নামে এই মিথ্যা মোকদ্দমা রুজু করিয়াছিল। আর সাক্ষী রামসদয় ও গফুর সম্পূর্ণ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছিল। ডাক্তার ব্রজলালবাবু কিন্তু মিথ্যা কথা কহেন নাই। তিনি কামিনীর অঙ্গে যে সকল চিহ্ন দেখিবার কথা বলিয়াছিলেন, তাহা কামিনীর সঙ্গে প্রকৃতই ছিল; কিন্তু সেই সকল চিহ্ন নগেন্দ্ৰ-কর্তৃক কৃত নহে, কালীপ্রসন্নের পরামর্শ মত অন্য পুরুষ কর্তৃক। নগেন্দ্রনাথ যখন দেখিলেন, এই মোকদ্দমা মিথ্যা হইলেও তাঁহার বাঁচিবার আর উপায় নাই, তখন তিনি রামচন্দ্রবাবুর হাতে পায়ে ধরিয়াই হউক বা ভিজিটের জোরেই হউক, তাঁহাকে বশীভূত করিয়াছিলেন বলিয়াই, রামবাবু তাঁহার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিলেন। বাস্তবিক রামবাবু-বর্ণিত কোন প্রকার পীড়াই নগেন্দ্রনাথের ছিল না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

নগেন্দ্রনাথ এইরূপ কৌশল অবলম্বন পূর্ব্বক দায়রা হইতে মুক্তিলাভ করিয়া আপনার বাটীতে গমন করিলেন। আদালত হইতে বহির্গত হইবার সময় তিনি যদিও কালীপ্রসন্নকে বলিয়া আসিয়াছিলেন, “আমি ইহার প্রতিশোধ লইব”, কিন্তু পরে মনে মনে ভাবিলেন, কালীপ্রসন্ন যদিও আমাকে নানারূপ মোকদ্দমায় বার বার বিশেষ কষ্ট দিয়াছে, কিন্তু হঠাৎ আমি আর কিছু করিব না। ঈশ্বরই ইহার বিচার করিবেন। তবে ইহার পরও কালীপ্রসন্ন যদি আমাকে আবার বিপদগ্রস্ত করে, তাহা হইলে পরিশেষে আমি এক বারে সকলের প্রতিশোধ লইতে চেষ্টা করিব। এই ভাবিয়া নগেন্দ্রনাথ কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিতে নিরস্ত হইলেন। 

এদিকে কালীপ্রসন্ন বিশিষ্টরূপে লজ্জিত ও অবমানিত হইয়া আপনার স্থানে গমন করিলেন। তিনি মনে মনে সৰ্ব্বদাই ভাবিতে লাগিলেন, “নগেন্দ্রনাথ না জানি কি উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক আমার কৃত শঠতা-কার্য্যের প্রতিশোধ লইতে চেষ্টা করিবে!” এইরূপ চিন্তায় প্রায় এক মাস অতীত হইয়া গেল। কালীপ্রসন্ন এক মাস চিন্তার পর স্থির করিলেন যে, নগেন্দ্রনাথ তাঁহার উপর যাহাতে কোনরূপ মোকদ্দমা না আনিতে পারেন, তাহার বন্দোবস্ত পূর্ব্ব হইতেই করা আবশ্যক। 

একদিবস কালীপ্রসন্ন স্বয়ং থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন, ও দারোগার নিকট যেরূপ এজাহার দিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এই; নগেন্দ্রনাথ মোকদ্দমা হইতে নিষ্কৃতি পাইবার পর হইতেই তাঁহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করিবে, এইরূপ ভয় প্রদর্শন করিতেছে। সেই ভয়ে তিনি নিতান্ত ভীত হইয়া, অদ্য কেবলমাত্র সাতদিবস হইল, বেচু সিং নামক একজন ক্ষত্রিয়কে তাঁহার নিজের দ্বারবান্ নিযুক্ত করিয়াছিলেন; এবং নগেন্দ্রনাথকে দেখাইয়া দিয়া তাহাকে বলিয়া দিয়াছিলেন যে, সেই ব্যক্তি তাঁহার বিশেষ শত্রু, অতএব সে যেন কোনরূপে তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে। বেচু সিং তাঁহার আজ্ঞা প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত সর্ব্বদাই তাঁহার দ্বারে বসিয়া থাকিত। অদ্য পাঁচদিবস হইল অর্থাৎ বেচু সিং তাঁহার কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার দ্বিতীয় দিবসের রাত্রিতে, নগেন্দ্রনাথ একাকী তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা করেন; কিন্তু বেচু সিং কর্তৃক প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইয়া বাড়ীতে প্রবেশ করিতে সমর্থ হন নাই। বরং বেচুর নিকট বিলক্ষণরূপে অবমানিত হইয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন। যখন এই সকল অবস্থা ঘটিয়াছিল, তখন তাহার কিছুই তিনি জানিতে পারেন নাই; কিন্তু পরদিবস প্রাতঃকালে দ্বারবানের মুখে এই অবস্থা শুনিতে পাইয়াছিলেন। সে দিবস আর কোন ব্যাপার ঘটে নাই; কিন্তু তাহার পরদিবস প্রাতঃকালে যখন কালীপ্রসন্নবাবু বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে আসেন, তখন দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, তাঁহার সদর দ্বার খোলা রহিয়াছে, আর দ্বারবান্ নাই। প্রথমে মনে করিয়াছিলেন যে, সে বাহিরে কোনস্থানে গমন করিয়াছে; কিন্তু যখন দেখিলেন, আর সে কোন প্রকারে ফিরিল না, তখন ক্রমে ক্রমে নানারূপ চিন্তা আসিয়া তাঁহার মনে উপস্থিত হইল। তখন তিনি তাহার অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। প্রথমে তাহার কোন প্রকার সন্ধানই পান নাই; কিন্তু গত রাত্রিতে তিনি জানিতে পারিয়াছেন যে, নগেন্দ্রনাথ তাঁহার সেই দ্বারবানকে হত্যা করিয়াছে, তাহার মৃতদেহ কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছে। 

দারোগা তখন সমস্ত শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, নগেন্দ্রনাথই আপনার দ্বারবানকে হত্যা করিয়াছে?” 

কালীপ্রসন্ন উত্তর করিলেন, “মহাশয়! আমি যাহা বলিতেছি, আপনি সন্ধান করিলেই তাহা জানিতে পারিবেন। তাহাকে হত্যা করিতে কেহ কেহ স্বচক্ষে দেখিয়াছে, এবং নগেন্দ্রনাথ ও তাহার চাকর সেই হত দ্বারবানের মৃতদেহ লইয়া যখন গমন করিতেছিল, তখন তাহা যাহারা দেখিয়াছে তাহাদিগকে আপনি জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন। এই বলিয়া তিনি চারি পাঁচজন সাক্ষীর নাম দারোগার নিকট লিখাইয়া দিলেন। 

হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাইয়া দারোগা হামিদুল্লা আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। তখনই তিনি ঘটনাস্থানে গমন করিয়া অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। দারোগা সাহেব যদিও বিলক্ষণ চালাক-চতুর ছিলেন; কিন্তু সেই কার্য্যে তিনি অতি অল্প দিবসই ব্রতী হইয়াছিলেন। অনুসন্ধানে তিনি আসামী নগেন্দ্রনাথ ও তাঁর চাকর কৈলাসকে ধৃত. করিলেন। তাঁহাদের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষী সংগ্রহ হইল, তাহাদের এজাহার গ্রহণপূর্বক আসামীদ্বয়ের এজাহার লইতে ইচ্ছা করিলেন। তাঁহারা উভয়েই কিন্তু কহিলেন, “এ মোকদ্দমায় আমাদিগের কিছুমাত্র দোষ নাই।” আরও কহিলেন, “আমরা এখন খুনি মোকদ্দমায় আসামী। কোন্ কথা বলিলে আমাদিগের বিপক্ষে যাইলে বা কোন্ কথায় এখন আমাদিগের উপকার দর্শিতে পারে তাহা আমরা এখন বুঝিতে পারিব না। সুতরাং আমাদিগকে যাহাই আপনি জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহারই উত্তরে আমরা দোষী নই’ ভিন্ন অন্য কোন কথা আমরা বলিব না।” এই কথা শ্রবণ করিয়া দারোগা সাহেব তাঁহাদের এজাহার লইতে অপারক হইলেন। 

এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া দারোগার বিশ্বাস হওয়ায়, তিনি উহা মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেব সাক্ষীগণের জবানবন্দী গ্রহণপূর্ব্বক আসামীদ্বয়কে দায়রায় সোপরদ্দ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকটও আসামীদ্বয় কহিলেন, “এই মোকদ্দমায় আমরা অপরাধী নহি। আরও যখন দেখিতেছি, এই মোকদ্দমা বিচারার্থ আপনি দায়রায় পাঠাইতেছেন, তখন আমাদিগের যাহা বলিবার আছে, তাহা জজসাহেবের নিকটেই বলিব।” 

আসামীদ্বয় দুইমাস কাল হাজতে থাকিলে পর, দায়রায় মোকদ্দমা উপস্থিত হইল। এবারও সরকারী উকীল মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। 

আসামীদ্বয়ের উকীল নাই। নগেন্দ্রনাথের কোন কোন আত্মীয় নগেন্দ্রনাথকে কহিলেন, “তুমি খুনি মোকদ্দমায় পড়িয়াছ, জুরিগণ তোমার মোকদ্দমার বিচার করিবেন; এরূপ অবস্থায় উপযুক্ত উকীল, কৌন্সলি ভিন্ন জুরিগণকে তোমাদিগের কথা কে বুঝাইয়া দিবে? অতএব অন্ততঃ একজন ভাল উকীল নিযুক্ত কর। যদি তুমি তাঁহার “ফি” প্রভৃতি সংস্থান না করিতে পার, তাহাও আমাদিগকে বল, আমরা তাহার উপায় করিব।” এই কথায় নগেন্দ্রনাথ একটু হাসিলেন এবং কহিলেন, “আমার অদৃষ্টে যদি কষ্ট থাকে, তাহা হইলে কোন উকীলের সাধ্য নাই যে, তিনি তাহা দূর করিতে পারেন। আপনাদিগের কোনরূপ ব্যস্ত হইবার আবশ্যক নাই। যাহা করিতে হয়, তাহা আমিই করিব। আমার নিজের অবস্থা আমি যতদূর বুঝিতে পারিব, উকীলে তাহা বুঝিবে কোথা হইতে? আমার সম্বন্ধে আপনাদিগের কোন প্রকার বন্দোবস্ত করিতে হইবে না। তবে আমার এই বিপদের সময় আপনারা অনুগ্রহ পূর্ব্বক যে এখানে আমাকে দেখিতে আসিয়াছেন, তাহাতেই আমি আপনাদিগের নিকট সবিশেষ কৃতজ্ঞ রহিলাম।” এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ নীরব হইলেন। তাঁহার আত্মীয়গণ ক্ষুণ্নমনে দর্শকের স্থানে গিয়া উপবেশন পূর্ব্বক ভাবিতে লাগিলেন, “নগেন্দ্রনাথের মস্তিষ্ক কি বিকৃত হইয়া গিয়াছে? একথা পাগলের কথা ভিন্ন মনে আর কি বলিয়া ভাবিতে পারি?” 

মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল। ইংরাজ জজের দক্ষিণ পার্শ্বে পাঁচজন জুরি উপবেশন করিলেন। সরকারী উকীল মোকদ্দমার অবস্থা সকলকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন। 

জজসাহেব তখন আসামীদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন,– 

“তোমাদের উপর দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারামতে খুনি মোকদ্দমা আনা হইয়াছে। এই মোকদ্দমায় তোমরা অপরাধী কি না।” 

আসামী। আমরা অপরাধী নহি। 

ইহার পরেই সাক্ষীগণের জবানবন্দী আরম্ভ হইল। 

প্রথম সাক্ষী কালীপ্রসন্ন। তিনি দারোগার নিকট যেরূপ বলিয়াছিলেন, মূলে ঠিক রাখিয়া তাহাই একটু বাড়াইয়া বলিলেন মাত্র। 

দ্বিতীয় সাক্ষী কেবলরাম দাস কহিল,—“রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় আমি ও সেখ জুম্মন, কালীপ্রসন্ন বাবুর বাড়ীর নিকট দিয়া গমন করিতেছিলাম। সেই সময় দেখিলাম, যে নগেন্দ্রবাবু ও ইঁহার চাকর এই কৈলাস, কালীপ্রসন্ন বাবুর বাড়ীর ভিতর হইতে বেচু সিংকে বাহির করিয়া আনিলেন, ও সে বলপ্রকাশ করিলেও উহাকে ধরিয়া লইয়া প্রস্থান করিলেন। বেচু চীৎকার করিতে চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু বোধহয়, তাহার মুখের ভিতর কাপড় দেওয়া হইয়াছিল বলিয়াই, সে চীৎকার করিতে পারিতেছিল না। এই দেখিয়া আমরা ভীত হইয়া চলিয়া গেলাম। এই কথা কিন্তু প্রথমে কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে আমরা সাহসী হই নাই। কারণ, নগেন্দ্রনাথ অতিশয় ভয়ানক লোক। তাঁহার ভয়ে তাঁহার বিপক্ষে কোন কথা বলিতে কেহই সাহসী হয় না।” 

তৃতীয় সাক্ষী সেখ জুম্মন। কেবলরাম যেরূপ সাক্ষ্য দিয়াছিল, এ ব্যক্তিও সেইরূপ বলিল। 

আসামীদ্বয়কে জজসাহেব জেরা করিতে বলায়, নগেন্দ্রনাথ কহিলেন, “ধর্ম্মাবতার! আমরা জেরা করিতে ইচ্ছা করি না। এ সমস্ত সাক্ষীই মিথ্যা কথা কহিতেছে। সুতরাং মিথ্যা সাক্ষীগণকে জেরা করায় কেবল আদালতের নিরর্থক সময় নষ্ট করা হয় মাত্র, তদ্ভিন্ন ইহাতে অন্য কোন উপকার দেখিতে পাওয়া যায় না।” 

চতুর্থ সাক্ষী গদাধর দাস কহিল,—“আমার একখানি মাত্র গৃহ, তাহাও সরকারদের বাগানের ভিতর। রাত্রি প্রায় আড়াইটার সময় ‘গোঁ গোঁ শব্দে হঠাৎ আমাদিগের নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমি যে গৃহে ছিলাম, আমার স্ত্রী সুখদাও সেই গৃহে ছিল। আমার বিধবা ভগিনী অলকাও সেই গৃহের দাওয়ায় শুইয়াছিল। উক্ত শব্দে আমাদিগের তিনজনেরই নিদ্রাভঙ্গ হইল। পরিষ্কার জ্যোৎস্নার আলোকে আমরা দেখিলাম, আমাদিগের গৃহের অনতিদূরে নগেন্দ্রবাবু তাঁহার চাকর কৈলাস একটি লোককে নির্দয়রূপে প্রহার করিতেছেন। সে যাতনায় যতই ছট ফট করিতে লাগিল ইঁহারা ততই উহাকে মারিতে লাগিলেন, এমন কি নির্দয় রূপে প্রহার করিতে করিতে সে মরিয়া গেল। তখন একটি জঙ্গলের ভিতর সেই মৃতদেহ রাখিয়া ইঁহারা কোথায় গমন করিলেন। যে ব্যক্তি মরিয়া গেল, তাহাকে আমরা পূর্বে চিনিতে পারি নাই; কিন্তু নগেন্দ্রবাবু ও তাঁহার চাকরকে উত্তমরূপে চিনিয়াছিলাম। তাঁহারা মৃতদেহ সেইস্থানে রাখিয়া গমন করিলে, আমরা তিনজনেই আস্তে আস্তে তথায় গিয়া সেই মৃতদেহ দেখিতে পাই, ও তাহাকে কালীপ্রসন্নবাবুর নূতন দ্বারবান্ বলিয়া চিনিতে পারি। নগেন্দ্রবাবু যেরূপ ভয়ানক লোক, তাহাতে একথা প্রকাশ করিয়া কে আপনার সর্ব্বনাশ-সাধনের উপায় আপনিই আনয়ন করিবে? এই ঘটনার প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে নগেন্দ্রবাবু, এই কৈলাসচাকর ও আরও এক ব্যক্তি যাহাকে আমরা পূর্ব্বে কখন দেখি নাই, এই তিনজনে একখানি চারিপায়ার সহিত আগমন করিলেন, ও লাসটি সেই চারিপায়ার উপরে উঠাইয়া লইয়া তিনজনেই প্রস্থান করিলেন।” 

পঞ্চম সাক্ষী গদাধরের স্ত্রী সুখদা, এবং ষষ্ঠ সাক্ষী তাঁহার সেই বিধবা ভগিনী অলকা। গদাধর যেরূপ বলিয়াছিল ইহারাও তাহাই বলিল। নগেন্দ্রনাথ ইহাদিগকেও কোনরূপ জেরা করিলেন না। 

সপ্তম সাক্ষী কেদার গোয়ালা। নগেন্দ্রবাবু, তাঁহার চাকর কৈলাস ও অপর এক ব্যক্তি, একটি লাস লই য়া গ্রামের বাহিরে ময়দান-অভিমুখে গমন করিতেছিল, এই ঘটনা সে দেখিয়াছে কহিল। তাহার একটি গরু হারাইয়া গিয়াছিল, সেই গরুর অনুসন্ধানে বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল বলিয়াই, সে এই ব্যাপার দেখিতে পাইয়াছিল। 

অষ্টম সাক্ষী অনুসন্ধানকারী দারোগা হামিদুল্লা। তিনি অনুসন্ধান করিয়া যাহা যাহা বাহির করিয়াছিলেন, তাহাই বলিলেন। যেরূপ উপায়ে এই সকল সাক্ষীগণকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহাও প্রকাশ করিলেন, এবং আরও কহিলেন, বিশেষ চেষ্টা করিয়াও তিনি এ পর্যন্ত লাসের কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হন নাই। 

এই সাক্ষী কয়েকটি যেরূপ সাক্ষ্য প্রদান করিল, তাহাতে কাহারও মনে কোন প্রকার সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে না। এইরূপ দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল যে, জজ ও জুরিগণ সকলেরই এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণরূপে সত্য বলিয়া ধারণা হইয়াছে। জজসাহেব আসামীগণকে স্পষ্টই কহিলেন, তোমাদের বিপক্ষে যাহারা সাক্ষ্য প্রদান করিল, তাহাদের উপর একটিমাত্রও জেরা করিয়া যখন তাহাদের কথা মিথ্যা প্রমাণ করিবার চেষ্টাও করিলে না, তখন আমি কি করিয়া বিশ্বাস করিব যে, এই মোকদ্দমায় তোমরা নিরপরাধ?” 

জজসাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া নগেন্দ্রনাথ কহিলেন, “ধর্ম্মাবতার! আমি যদিও সাক্ষীগণকে জেরা করিলাম না, তথাপি এমন ভরসা করি যে, আমি প্রমাণ করিতে পারিব, এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। এই মোকদ্দমা—সম্বন্ধে আমি তাধিক কথা বলিতে চাহি না; তবে এইমাত্র বলিতে চাহি যে, কালীপ্রসন্ন যে আমার কিরূপ শত্রু, তাহা ধর্ম্মাবতার আপনি কতক অবগত আছেন। আমাকে চির নির্ব্বাসিত করিবার অভিপ্রায়ে, কামিনীর সাহায্যে যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়াছিল, তাহা আপনি স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন এবং আপনার সুবিচারের ফলে আমি সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইয়াছি। একমাস গত হইতে না হইতেই দেখুন, পুনরায় কালীপ্রসন্ন আমাকে কিরূপ বিপজালে পুনরায় জড়ীভূত করিতে চেষ্টা করিতেছে। যাহা হউক, সে বিষয়ে আমি এখন অধিক আর কিছু বলিতে চাহি না। আমার কেবল দুইটিমাত্র সাক্ষী আছে, তাহাদের মধ্যে একজনকে ডাকিলেই আপনারা জানিতে পারিবেন, এই মোকদ্দমা সত্য, কি মিথ্যা। পরে আবশ্যক হয়, দ্বিতীয় সাক্ষীকেও ডাকিব।” 

এই কথা শ্রবণ করিয়া দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই হাসিয়া উঠিলেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন আস্তে আস্তে ইহাও কহিলেন, “না জানি নগেন্দ্র! এখন তুমি স্বর্গ হইতে এমন কোন দেবতাকে ডাকিবে যে, তিনি এক কথায় এই মোকদ্দমা উড়াইয়া দিবেন!” 

জজ। তোমার যে সাক্ষী থাকে, তাহা তুমি এখন ডাকিতে পার। 

নগেন্দ্র। ধর্ম্মাবতার! আমার বিপক্ষে সরকারী উকিল মহাশয়ের যাহা কিছু বলিবার আছে, তাঁহার সমস্ত বলা না হইলে, আমি আমার সাক্ষী ডাকিতে ইচ্ছা করি না। 

জজ। তোমার বিপক্ষে যাহা বলিবার বা প্রমাণ করিবার আবশ্যক, তাহার সমস্তই শেষ হইয়াছে। তোমার বিপক্ষে আর কিছুই নাই, বা যদি আরও কিছু থাকে, তাহা আইন অনুসারে আর শুনা যাইতে পারিবে না। এখন তুমি তোমার সাক্ষীকে ডাকিতে পার। 

জজসাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া, নগেন্দ্রনাথ তাহার একজন সাফাই সাক্ষীকে ডাকিলেন। 

নগেন্দ্র। তোমার নাম কি? 

সাক্ষী। আমার নাম ঘরভরণ সিং। 

নগেন্দ্র। তোমার দেশ কোথায়, এবং কোথায় থাক? 

ঘরভরণ। আমার জন্মস্থান—আরা জেলায়। এখন গোবিন্দপুরে আমি সুবলবাবুর দরোয়ানী করি। 

নগেন্দ্র। বেচু সিং তোমার কে হয়? 

ঘরভরণ। বেচু সিং আমার পুত্র। 

নগেন্দ্র। বেচু সিং কি কোন কৰ্ম্ম করিত? 

ঘরভরণ। হাঁ, কৰ্ম্ম করিত। 

নগেন্দ্র। সে কোথায় কৰ্ম্ম করিত, এবং সেখানে কিরূপেই বা তাহার কর্ম হইয়াছিল? 

ঘরভরণ। হঠাৎ একদিবস একটি লোক আসিয়া আমাকে কহিল, কালীপ্রসন্ন বাবু একজন দরোয়ানের অনুসন্ধান করিতেছেন। সেই সময় আমার পুত্র বেচু সিং বেকার অবস্থায় বসিয়াছিল। এই সংবাদ পাইয়া আমি আমার পুত্রকে সঙ্গে লইয়া কালীপ্রসন্ন বাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। তিনি আমার পুত্রকে দেখিয়া তাহাকে মনোনীত করেন, এবং মাসিক আট টাকা বেতনে তাঁহার বাড়ীর দরোয়ান কার্য্যে নিযুক্ত করেন। 

নগেন্দ্র। তুমি কালীপ্রসন্নবাবুকে চেন? 

ঘরভরণ। হাঁ মহাশয়! খুব চিনি, এই তিনি দাঁড়াইয়া আছেন। ইনিই আমার পুত্র বেচুসিংহের মনিব ছিলেন। এই সময় কালীপ্রসন্নবাবুর মুখে আর হাসি ধরে না তিনি অতিশয় আনন্দিত হইলেন। তাঁহার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল, সেই দেখিল যে, তাঁহার মনে যেন কি অপূর্ব্ব ভাবের আবির্ভাব হইয়াছে। আনন্দে হৃদয় উচ্ছ্বসিত হইতেছে। তিনি সেই অন্তরের ভাব গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু কোন প্রকারেই যেন কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছেন না। 

কালীপ্রসন্ন ঘরভরণের একটিমাত্র কথাতেই যে কেন এত আনন্দিত হইলেন, তাহা এইস্থানে সংক্ষেপে পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া কৰ্ত্তব্য। 

কালীপ্রসন্ন যখন এই ভয়ানক খুনি মোকদ্দমায় নগেন্দ্রনাথকে আসামী করেন, তাহার পূর্ব্বে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া অনেক পরামর্শ করিয়া, এই মোকদ্দমার সূত্র স্থাপিত করেন। এক কথায় তাহার মর্ম্ম পাঠকগণকে বলিয়া দেয় যে, দারোগা এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়া মাজিষ্ট্রেট জজ ও জুরিগণ এই মোকদ্দমার অবস্থা সাক্ষীগণের মুখে শ্রবণ করিয়া যতই কেন বিশ্বাস করুন না যে, ইহা একটি প্রকৃত মোকদ্দমা, ও নগেন্দ্রনাথ ক্রোধান্ধ হইয়াই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছেন; কিন্তু পাঠকগণ নিঃশঙ্কচিত্তে বিশ্বাস করিতে পারেন যে, এই মোকদ্দমার অণুমাত্রও সত্য নহে, সমস্তই মিথ্যা। যে যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহাদের মধ্যে দারোগা ব্যতীত সত্য কথা একজনও কহে নাই। কালীপ্রসন্ন যাহাকে যেরূপ বলিতে বলিয়াছেন, সে তাহাই বলিয়াছে। সকলেই তাঁহার বশীভূত লোক, ও সকলেরই জীবিকা নির্ব্বাহের উপায় কালীপ্রসন্নের হাতে। এই সাক্ষীগণের উপর যদি জেরা হইত, তাহা হইলে সত্যকথা নিশ্চয়ই প্রকাশ হইয়া পড়িত; কোন্ সাক্ষী কি চরিত্রের লোক, তাহাও সকলে জানিতে পারিতেন; জজ ও জুরিগণের মনে এখন যেরূপ ধারণা হইয়াছে, তাহা বোধ হয় হইত না। এই মোকদ্দমায় যে দরোয়ানের কথা উল্লিখিত হইয়াছে, যে দরোয়ানকে হত্যা করা অপরাধে নগেন্দ্রনাথ ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে গমন করিতেছেন, সে নামের কোন দরোয়ানই কালীপ্রসন্নের কখন ছিল না, বেচু সিং নামক কোন ব্যক্তি কখন তাহার দরোয়ানী করে নাই। সমস্তই মিথ্যা সাজাইয়া নগেন্দ্রনাথকে জনমের মত ইহলোক হইতে বিদায় দিবার অভিপ্রায়ে এই ভয়ানক ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি, ও এই প্রাণ-ধ্বংসকারী মোকদ্দমার অবতারণা! আর আসামী-পক্ষীয় সাক্ষীর দ্বারা, তাঁহার সেই মিথ্যা কথার সত্যতা প্রতিপাদিত হইল দেখিয়াই কালীপ্রসন্নের এত আনন্দ! তিনি যে কল্পিত দরোয়ানের মৃত্যুসংবাদ দিয়াছেন, এখন সেই বেচু সিংহের পিতা আসিয়া স্পষ্টই বলিতেছেন যে, তাঁহার পুত্র কালীপ্রসন্ন বাবুর বাড়ীর দরোয়ান ছিল। তাঁহার মিথ্যা কথা এখন সত্যই প্রমাণিত হইল; কাজেই কালীপ্রসন্ন এত আনন্দিত! 

নগেন্দ্র। তোমার পুত্র বেচু সিং এখনও কি কালীপ্রসন্ন বাবুর বাড়ীতে আছেন? 

ঘরভরণ। না মহাশয়! সে যদি এখন সেইস্থানে কর্ম্ম করিত, তাহা হইলে আমাকে আজ এখানে সাক্ষী দিতে আসিতে হইবে কেন? 

এই উত্তর শ্রবণ করিয়া দর্শকবৃন্দের ভিতর হইতে এক ব্যক্তি হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্র! তোমার গলায় দড়ি! যাহা একটু ঢিলা ছিল, তাহা দেখিতেছি, আরও আঁটিয়া দিতেছ!” 

কালীপ্রসন্ন এতক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়াছিলেন, কিন্তু আর তিনি থাকিতে পারিলেন না, তাঁহার মুখ দিয়া হঠাৎ বহির্গত হইল, “ঘরভরণ ঠিক কথাই বলিতেছে।” এই কথা জজ ও জুরিগণ প্রভৃতি সকলেই শুনিতে পাইলেন। 

এই সময়ে নগেন্দ্রনাথ একজন চাপরাসীকে কহিলেন, “ঐ যে লোকটি দণ্ডায়মান রহিয়াছে, তুমি উহাকে সৰ্ব্বসমক্ষে আনয়ন কর।” 

যে পর্য্যন্ত বিচারের নিষ্পত্তি না হয়, সেই পর্যন্ত খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত আসামীর সকল কথা বিচারক মাত্রেই শুনিতে বাধ্য। কাজেই নগেন্দ্রনাথের নির্দেশ মত সেই ব্যক্তি সৰ্ব্বসমক্ষে আনীত হইল। 

নগেন্দ্র। (সেই ব্যক্তির প্রতি নির্দ্দেশ করিয়া) ঘরভরণ! দেখ দেখি, তুমি এই লোকটিকে চেন কি না? ঘরভরণ। চিনি বই কি, ইহাকে আর চিনিব না? 

জজ। (নির্দেশিত ব্যক্তির প্রতি) তোমার নাম কি? 

সেই ব্যক্তি জজসাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া, সর্ব্বসমক্ষে স্পষ্ট করিয়া আপনার নাম বলিল। সে আপনার নাম বলিবামাত্রই আদালতের ভিতর ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। সকলেই অতিশয় বিস্মিত হইলেন। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাইতে লাগিলেন। জুরিগণ একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “আসামীদ্বয় নিরপরাধ, উহাদিগকে এই মুহূর্তেই ছাড়িয়া দেওয়া উচিত।” 

জজসাহেবও সেইমতে মত দিলেন, কিন্তু কহিলেন, “আর দুই একটি কথামাত্র জিজ্ঞাসা করিয়া আসামীদ্বয়কে মুক্তিপ্রদান করা কর্ত্তব্য।” 

জজ। (ঘরভরণের প্রতি) এই ব্যক্তি যে নাম বলিল, উহাই কি ইহার প্রকৃত নাম? 

ঘরভরণ। এই উহার প্রকৃত নাম, এই আমার পুত্র বেচু সিং। 

ইহার পর জজসাহেব সেই ব্যক্তিকে ডাকিয়া দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। সে যেরূপ উত্তর দিল, তাহার সারমর্ম্ম এই;—

“আমি কালীপ্রসন্ন বাবুকে চিনি। আমার পিতা ঘরভরণ সিং একদিবস আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যান, আট টাকা বেতনে আমি তাঁহার কর্মে নিযুক্ত হই। আমি দুই দিবস মাত্র সেইস্থানে কর্ম করিয়াছিলাম। একদিবস আমাকে বিশেষরূপে তিরস্কার করিয়া কিছু না বলিয়া। পিতার নিকটেই অবস্থান করি। পরিশেষে সফিনা পাইয়া আমরা উভয়েই সাক্ষ্য দিতে আসিয়াছি। আমি মরি নাই বা নগেন্দ্রবাবু আমাকে হত্যা করিয়া আমার লাস লুক্কায়িত রাখেন নাই।” 

জজসাহেব এই কথা শ্রবণ করিয়া নগেন্দ্রনাথ ও কৈলাসচন্দ্রকে তখনই মুক্তি প্রদান করিলেন। তাঁহারা হাসিতে হাসিতে সেই আদালত হইতে বহির্গত হইলেন। জজসাহেব কালীপ্রসন্ন ও তাঁহার সাক্ষীগণের অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু সেইস্থানে আর কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। সেই গোলযোগের ভিতর কে যে কোথায় পলায়ন করিল, তাহার ঠিকানা তখন কেহই করিতে পারিল না। 

কালীপ্রসন্ন যেমন চতুরতা পূর্ব্বক মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইয়া নগেন্দ্রনাথকে ফাঁসী দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, নগেন্দ্রনাথও সেইরূপ মিথ্যা বেচু সিং ও মিথ্যা কথা ঘরভরণ সিং সাজাইয়া সেই ফাঁসী হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন এবার কিন্তু তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন,—“এরূপ ভয়ানক শত্রুর বিনাশ সাধন যেরূপেই হউক করিব। ইহাতে পাপ নরকেরও ভয় করিব না।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

মিথ্যা খুনি মোকদ্দমায়, মিথ্যা উপায় অবলম্বন করা হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়া যেরূপ ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হইল তাহা পাঠকগণ অবগত আছেন। নিষ্কৃতিলাভ করিয়া নগেন্দ্রনাথ কয়েকদিন নিজ আলয়ে অবস্থান পূর্ব্বক যে কোথায় গমন করিলেন, তাহা পাড়ার কেহ জানিলেন না। বাড়ীর পরিবারবর্গ সে বিষয়ে কিছু জানিতেন কি না, জানি না, কিন্তু তাঁহাদিগের নিকট হইতে কেহই কোনরূপ সন্ধান পাইলেন না যে, তিনি কি অভিপ্রায়ে এবং কোথায় গমন করিয়াছেন। কেহ বলিল, কালীপ্রসন্ন কর্তৃক তিনি মিথ্যা মোকদ্দমায় বার বার বিলক্ষণ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন বলিয়াই বোধ হয়, লোক-লজ্জায় দেশত্যাগী হইয়াছেন। কেহ কহিলেন, হয় ত কালীপ্রসন্ন আবার তাঁহাকে কোনরূপ বিপজালে জড়ীভূত করিয়া, কোনস্থানে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন। এইরূপ যাঁহার মনে যাহা আসিল, তিনি তাহাই বলিতে লাগিলেন। 

উক্তরূপে ক্রমে দেড়মাস অতিবাহিত হইয়া যায়, এরূপ সময়ে একদিবস প্রাতঃকালে সকলেই দেখিলেন, নগেন্দ্রনাথ বাটীতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। তিনি কোথায় গমন করিয়াছিলেন, এবং এতদিবস কোথায় বা ছিলেন, তাহা অনেকেই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,; কিন্তু উত্তরে সকলেই এইমাত্র অবগত হইলেন, তিনি কার্য্যোপলক্ষে কোনস্থানে গমন করিয়াছিলেন। প্রকৃতকথা তিনি কাহারও নিকট কহিলেন না, সুতরাং প্রকৃতকথা কেহই অবগত হইতে পারিল না। 

সেইদিবস—যে দিবস তিনি প্রত্যাগমন করিলেন, সেই দিবস বেলা দ্বিপ্রহরের সময় অনেকেই একটি ভয়ানক দৃশ্য অবলোকন করিলেন। এই দৃশ্যে সকলেই বিস্মিত, ভীত ও চিন্তিত হইয়া আপন আপন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ পূর্বক সদর দ্বার বন্ধ করিলেন। 

২৫শে আষাঢ় দিবা বারটার সময় কালীপ্রসন্ন নদী হইতে স্নান করিয়া, আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন। যে সময় তিনি তাঁহার বাড়ীর নিকটবর্ত্তী হইলেন, সেই সময় কে জানে, কোথা হইতে একখানি তরবারি হস্তে করিয়া নগেন্দ্রনাথ কালীপ্রসন্নের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন, ও কালীপ্রসন্নকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কালীপ্রসন্ন! তুই আমাকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়াছিস, তুই দুইবার আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা আনিয়া আমার সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিয়াছিস্; কিন্তু ঈশ্বর আমার সহায় ছিলেন, তাহাতেই তুই কিছুই করিয়া উঠিতে পারিস্ নাই। তাঁহারই প্রসাদে আমি যোগাড় করিয়া, মিথ্যা সাক্ষী আনয়ন পূর্ব্বক কোন প্রকারে উদ্ধার পাইয়াছি। প্রথম মোকদ্দমায় তোর চেষ্টা ছিল, যাহাতে আমি চিরদিবসের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হই। যখন তাহা পারিলি না, যখন দেখিলি, আমি অনায়াসে মুক্তিলাভ করিলাম, তখন কি না এক মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইলি, যাহাতে কোন গতিতে আমি ফাঁসী হইতে নিষ্কৃতি না পাই। যে আমার এরূপ শত্রু, তাহার নিমিত্ত আজ আমি ফাঁসী যাইতে প্রস্তুত। আজ আমি কৃতসঙ্কল্প হইয়াছি যে, এই শাণিত তরবারিকে আজ তোর উত্তপ্ত শোণিত পান করাইব যে তোর সহায় থাকে, তাহাকে ডাক্, তাহাকেও আজ তোর সহিত একসঙ্গে শমনসদনে প্রেরণ করিয়া ক্ষণকালের নিমিত্তও শান্তিলাভ করি।” 

এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ তাঁহার সেই তরবারি উত্তোলন করিলেন। কালীপ্রসন্ন তখন কি করিবেন, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে করিতে যে দিক্ হইতে আগমন করিতেছিলেন, সেই দিকেই ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলেন। তরবারিহস্তে নগেন্দ্রনাথও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলেন। দুই চারিজন লোকও আসিয়া উপস্থিত হইল। সকলেই দেখিল, নগেন্দ্রনাথ কালীপ্রসন্নকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তরবারিহস্তে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতেছেন। 

দেখিতে দেখিতে নগেন্দ্রনাথ কালীপ্রসন্নের উপর গিয়া পতিত হইলেন। সেই সুশাণিত তরবারি কালীপ্রসন্নের শোণিতে পিপাসা নিবারণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। প্রথম কোপে কালীপ্রসন্নের মস্তকের কিয়দংশ কাটিয়া গেল। অজ্ঞান হইয়া তিনি সেইস্থানে পতিত হইলেন। তাহার উপর দ্বিতীয় কোপ! দ্বিতীয় কোপে তাঁহার স্কন্ধদেশ বিচ্ছিন্ন হইল! তৃতীয় কোপে বক্ষঃস্থল কাটিল! তাহার উপর ক্রমে ক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ কোপ পড়িল! সেই প্রখর রৌদ্রের সময়, সেই প্রশস্ত রাজবর্ণের উপর, সর্ব্বসমক্ষে নগেন্দ্রনাথ এই ভয়ানক নরহত্যা সমাপন পূর্ব্বক পশ্চাৎ ফিরিলেন। দেখিলেন, তাঁহার সন্নিকটে অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু তাহারা আপনার প্রাণের ভয়ে কেহই অগ্রসর হইতে সাহসী হইতেছে না। নগেন্দ্রনাথ তাঁহার সেই রুধিররঞ্জিত তরবারি সকলকে দেখাইয়া কহিলেন, “যিনি কালীপ্রসন্নের আত্মীয় থাকেন, তিনি আমার সম্মুখে আসুন। যে তাঁহার বন্ধু বা পরামর্শদাতা থাকেন, তিনিও এই সময়ে একবার অগ্রসর হউন। অথবা যদি কেহ এখন আমাকে ধরিবার ইচ্ছা করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনিও আসুন। দেখুন, আমি তাহাদিগেরই বা কি করিয়া উঠিতে পারি। এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ এক লম্ফে সেই লোকদিগের দিকে অগ্রসর হইলেন। তাঁহার রুধিরাক্তকলেবর, হস্তে রুধির রঞ্জিত তরবারি ও বিঘূর্ণিত আরক্ত চক্ষু দর্শন করিয়া, সকলেই আপন আপন প্রাণ লইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। নিকটে যাঁহাদিগের বাড়ী ছিল, তাঁহারা সকলেই আপন আপন বাড়ীর দ্বার বন্ধ করিলেন। 

এই ভয়ানক নরহত্যা দিবা দ্বিপ্রহরের সময় সৰ্ব্বসমক্ষে সমাপন করিয়া, নগেন্দ্রনাথ সেই নদী-অভিমুখে চলিলেন। নদীতে উত্তমরূপে গাত্রাদি ধৌত করিয়া, রক্তাক্ত বস্ত্রগুলি উত্তমরূপে পরিষ্কার করিয়া, সেই নদীগর্ভে সেই নররুধির রঞ্জিত তরবারি নিক্ষেপ করিলেন, এবং সন্তরণপূর্ব্বক সেই স্রোতস্বতী পার হইয়া অপর পারে গমন করিলেন। সেই স্থানে একটি জঙ্গল ছিল। সকলেই দেখিলেন, তিনি সেই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিলেন। কিন্তু তাহার পর যে কোথায় যাইলেন, তাহা আর কেহই দেখিতে পাইল না। 

গ্রামের চৌকিদার থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করিল। সংবাদ পাইয়া সেই দারোগা হামিদুল্লা—যিনি ইতিপূর্ব্বে দুই দুইবার ইঁহাদিগের মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। যাঁহার প্রেরিত উভয় মোকদ্দমার আসামী, দায়রা হইতে নিরপরাধ সাব্যস্ত হওয়াতে পরিত্রাণ পায়, দুই দুই বার যিনি ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীগণের নিকট সেই মোকদ্দমার নিমিত্ত সবিশেষরূপে লজ্জিত হন, সেই দারোগা হামিদুল্লা পুনরায় এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। 

এই সংবাদ প্রাপ্তিমাত্রই দারোগা সাহেব ঘটনাস্থানে উপস্থিত হইলেন। লাস দেখিয়া তাহার “সুরতহাল” করিলেন। তাহার পর “মায়নার” নিমিত্ত লাস জেলায় প্রেরিত হইল। এদিকে তখন অপরাধীর অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। 

গ্রামে অধিকাংশ লোকই—যাহারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইতে স্বচক্ষে দেখিয়াছিল, তাহারা প্রায় সকলেই—কহিল যে, তাহারা কিছুই অবগত নহে। কারণ, মনে ভয়, যদি নগেন্দ্রনাথ পুনরায় আগমন করিয়া, সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে তাহাদিগকেই পাছে হত্যা করে। এদিকে কিন্তু অনুসন্ধানের বাকি থাকে নাই। নগেন্দ্রনাথ যখন এই হত্যাকাণ্ড সমাপন করেন, তখন সেইস্থানে উপস্থিত থাকিয়া, সমস্ত স্বচক্ষে দেখিয়াছে, একথা পরিশেষে কিন্তু অনেকের মুখেই শুনা গিয়াছে। যাহা হউক, দারোগা সাহেব এইস্থানে বসিয়া প্রায় সাতদিবসকাল সাক্ষীগণের জবানবন্দী গ্রহণ করিলেন; আসামীর অনুসন্ধানও করিতে লাগিলেন, কিন্তু নগেন্দ্রনাথের কোন সন্ধানই পাইলেন না। পরিশেষে দারোগা সাহেব সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া ক্রমে বিরক্ত হইয়া গাত্রোত্থান করিলেন, এবং পরিশেষে আপনার থানায় প্রস্থান করিলেন। নগেন্দ্রের নামে ৩০২ ধারার অপরাধে এক গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির হইল। 

প্রায় দুই মাস ধরিয়া নগেন্দ্রের অনুসন্ধান হইল; কিন্তু কোন ফলই ফলিল না। নগেন্দ্রনাথ যে কোথায় আছেন, একথা কেহই বলিতে পারিলেন না। 

দুই মাস পরে একদিবস এক ব্যক্তি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট একখানি দরখাস্ত করিল, তাহার মর্ম্ম এই প্রকার;—“আমি শুনিলাম, আমার নামে এক ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। যদি একথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আমি হুজুরে হাজির হইতেছি, উপযুক্ত আদেশ প্রদানের আজ্ঞা হয়।” 

মাজিষ্ট্রেট সাহেব দরখাস্ত পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোমার নাম কি?” 

দরখাস্তকারী তখন বলিলেন, “ধর্ম্মাবতার! আমার নাম শ্রীনগেন্দ্রনাথ ঘোষ।” 

মাজিস্ট্রেট বলিলেন, “ওঃ নগেন্দ্রনাথ! তোমার নামে ওয়ারেন্ট আছে। অভিযোগ যে, তুমি কালীপ্রসন্ন ঘোষকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছ।” এই বলিয়া তিনি সেই দরখাস্তের উপর হুকুম প্রদান করিলেন, “যে পৰ্য্যন্ত মোকদ্দমায় বিচার শেষ না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত নগেন্দ্রনাথ হাজতে থাকিবে। আর পুলিসে সংবাদ দেওয়া হউক যে, পুলিস সাক্ষীগণকে নির্দ্দিষ্ট দিবসে আদালতে যেন হাজির করে।” 

এই আদেশ প্রাপ্তিমাত্র আদালতের জনৈক কর্ম্মচারী নগেন্দ্রনাথকে হাজতে রাখিয়া আসিলেন। 

নগেন্দ্রনাথের মোকদ্দমার দিন স্থির হইল। দারোগা হামিদুল্লা এই মোকদ্দমার বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। এবার সরকারী উকীল এই মোকদ্দমা—এই বিচারালয় হইতেই চালাইতে লাগিলেন। মহারাণীর পক্ষ হইতে অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য গৃহীত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেব যখন বুঝিলেন, মোকদ্দমা যথেষ্ট প্রমাণিত হইয়াছে, তখন তিনি আসামীকে কহিলেন “দায়রায় তোমার বিচার হইবে; তোমার যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা আমার নিকট বলিবে, না দায়রায় বলিবে?” 

নগেন্দ্র। আমার যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা আমি দায়রাতেই কহিব। 

মাজিষ্ট্রেট। তুমি কোন সাফাই সাক্ষী মান্য করিতে চাও? 

নগেন্দ্র। হাঁ ধর্ম্মাবতার! আমার সাফাই সাক্ষী ডাকিবার ইচ্ছা আছে। 

মাজিষ্ট্রেট। সাক্ষীগণের নাম বল, আমি লিখিয়া লই। 

নগেন্দ্র। আমি এইস্থানে আমার সাক্ষীগণের নাম প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি না। যে স্থানে এই মোকদ্দমার চূড়ান্ত বিচার হইবে, সেইস্থানে আমি আমার সাক্ষীগণের নাম প্রকাশ করিব। 

মাজিষ্ট্রেট। আইন অনুযায়ী এইস্থানে অভাব পক্ষে একজনও সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা আবশ্যক। 

নগেন্দ্রনাথ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া, একটু চুপ করিয়া রহিলেন। পরিশেষে কহিলেন, “যখন আইনমত আমি অভাব পক্ষে একজন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করিতে বাধ্য, তখন অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক লিখিয়া লউন, যে আমার সাক্ষী আমার পুত্র শ্রীমান জানকীনাথ ঘোষ। অবশিষ্ট সাক্ষীগণের নাম আমি দায়রায় প্রকাশ করিব।” 

নগেন্দ্রনাথ দায়রায় সোপরদ্দ হইলেন। প্রায় দুই মাস পরে ইংরাজ জজ ও পাঁচজন এদেশীয় জুরির নিকট তাঁহার বিচার আরম্ভ হইল। প্রথমেই জজসাহেবের জিজ্ঞাসার উত্তরে নগেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি নিরপরাধ।” 

তাহার পর মোকদ্দমা আরম্ভ হইল। সরকারী উকীল এই হত্যাকাণ্ডের সমস্ত অবস্থা তন্ন তন্ন করিয়া জজসাহেব ও জুরিদিকে বুঝাইয়া দিলেন। তৎপরে এরূপ ভাবে সাক্ষীগণকে ডাকিতে লাগিলেন যে, কেহ কোন প্রকারে অণুমাত্র ছিদ্রানুসন্ধান করিতে সমর্থ না হন। এই উকীল মহাশয়ই ইতিপূর্ব্বে দুই দুই বার এই নগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালাইয়াছিলেন। 

উকীল মহাশয় এবার প্রথমে ডাকিলেন, গ্রামের চৌকিদারকে। এই ব্যক্তি থানায় গিয়া প্রথমেই সংবাদ দেয়। তাহার পর দ্বিতীয় সাক্ষী দারোগা হামিদুল্লাকে ডাকিলেন। ইনি প্রথম এতেলা দাখিল করিলেন। কি প্রকারে লাসের “সুরতহাল” করিয়াছেন, কিরূপে এবং কাহা-কর্তৃক এই লাস সনাক্ত হইয়াছে, সেই সকল কথা স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিলেন। আরও কহিলেন যে, তরবারির নিমিত্ত সেই নদীর ভিতর তিনি বিশিষ্ট অনুসন্ধান করেন, কিন্তু অগাধ জলের ভিতর খুঁজিয়া উহা বাহির করিতে সমর্থ হয়েন নাই। পলায়িত আসামীকেও অনেক অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার কোন সন্ধান প্রাপ্ত হন নাই। 

তৃতীয় সাক্ষী—যে ব্যক্তি লাস সনাক্ত করিয়াছিল, এবং পূর্ব্বেই যে বলিয়াছিল; “ইহাই কালীপ্রসন্নের মৃতদেহ।”

চতুর্থ সাক্ষী—লাস মায়নাকারী সরকারী ডাক্তার। কিরূপ আঘাত, কিসের আঘাত, এবং কয়টি আঘাতের দ্বারা কালীপ্রসন্ন হত হন, তাহাই তিনি সকলকে বুঝাইয়া দিলেন। 

পঞ্চম সাক্ষী—গ্রামের পঞ্চায়েৎ। ইনি প্রমাণ করিলেন যে, কালীপ্রসন্ন ও নগেন্দ্রনাথের মধ্যে অনেক দিবস হইতে মনোবিবাদ চলিয়া আসিতেছিল। ইঁহাদিগের মধ্যে অনেক দেওয়ানী ও পরিশেষে দুইটি ফৌজদারী মোকদ্দমা পৰ্য্যন্তও হইয়া গিয়াছে। 

ইহার পর ষষ্ঠ হইতে পঞ্চদশ পৰ্য্যন্ত দশজন সাক্ষীও এইরূপ প্রমাণ করিল যে, তাহারা সকলে স্বচক্ষে দেখিয়াছে,—নগেন্দ্রনাথ কালীপ্রসন্নকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে। 

নগেন্দ্রনাথের পক্ষে উকীল, মোক্তার প্রভৃতি কেহই ছিল না। তিনি নিজেই সাক্ষীগণকে রীতিমত জেরা করিতে লাগিলেন। তাঁহার জেরায় এই কয়েকটি কথা বাহির হইল:—

১ম। ইতিপূৰ্ব্বে কালীপ্রসন্ন তাঁহার নামে দুইবার মিথ্যা ফৌজদারী মোকদ্দমা উপস্থিত করিয়াছিলেন। 

২য়। উক্ত মোকদ্দমায় সেই গ্রামের কয়েক ব্যক্তি কালীপ্রসন্নের পক্ষ সমর্থন করিয়া মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিলেন।

৩য়। যে তারিখে কালীপ্রসন্ন হত হন, তাহার প্রায় দেড়মাস পূৰ্ব্ব হইতে নগেন্দ্রনাথ গ্রামে উপস্থিত ছিলেন না।

৪র্থ। ঘটনার দিবস কোথা হইতে হঠাৎ তিনি আগমন করেন, এবং দিবা বারটার সময় সৰ্ব্বসমক্ষে তিনি এই হত্যাকাণ্ড সমাপন পূর্ব্বক প্রস্থান করেন। 

৫ম। এই হত্যাকাণ্ডের দুইমাস কাল পর পর্য্যন্ত আর কেহ নগেন্দ্রনাথকে দেখিতে পায় নাই। 

৬ষ্ঠ। কালীপ্রসন্ন যেরূপ দুর্দান্ত বলিয়া গ্রামের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন, সেরূপ ব্যক্তি আর কেহ নাই। 

৭ম। নগেন্দ্রের বিপক্ষে এ পর্য্যন্ত কেহ কখন কোনরূপ অন্যায় আচরণের কথা শ্রবণ করে নাই। একবার যাহা শ্রবণ করিয়াছিল, বিচারে তাহা মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। 

৮ম। নগেন্দ্রনাথ ব্যতীত সেই প্রদেশে কালীপ্রসন্নের শত্রু অনেক আছে। 

এই কয়েকটি সাক্ষীর জবানবন্দী শেষ হইয়া গেলে সরকারী উকীল কহিলেন, “ইহা ব্যতীত অধিক সাক্ষী আমি আর ডাকিতে চাহি না। বিশেষতঃ খুনি মোকদ্দমায় ইহা অপেক্ষা অধিক প্রমাণ হওয়া একেবারেই অসম্ভব।” 

মোকদ্দমার অবস্থা এবং সাক্ষীগণের জবানবন্দী শ্রবণ করিয়া, জজ ও জুরিগণের মনে একরূপ বিশ্বাস হইয়া গেল, যে নগেন্দ্রনাথই এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। জজসাহেব তখন নগেন্দ্রনাথকে কহিলেন, “তোমার বিপক্ষে এই মোকদ্দমায় যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহা ত শ্রবণ করিলে। এক্ষণে তোমার যদি কিছু বক্তব্য থাকে, তাহা বলিতে পার।” 

জজসাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া নগেন্দ্রনাথ কহিলেন “ধর্ম্মাবতার! আমি একজন গরিব প্রজা। আমার সাধ্য নাই যে, আমি সকলকে সমভাবে সন্তুষ্ট করিতে পারি। সুতরাং এই মুসলমান দারোগা হামিদুল্লা আমার উপর সন্তুষ্ট হইবেন কেন? কালীপ্রসন্ন আমার সরিক, এবং তাহার সহিত বিষয় উপলক্ষে আমার মনোবিবাদ চলিয়া আসিতেছে, একথা সত্য আমাকে আমার সেই পৈতৃক বিষয় হইতে বঞ্চিত করিবার অভিপ্রায়ে, এই মুসলমান দারোগা হামিদুল্লার সহিত তিনি বিশেষ বন্ধুত্ব স্থাপিত করেন। জানি না, কালীপ্রসন্নের কি গুণে দারোগা সাহেব ভুলিলেন, তাঁহার পক্ষ হইয়া আমার সর্ব্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রথমে মনোপ্রসন্নের বশীভূতা, এবং তাহারই অন্নে প্রতিপালিত কামিনীনাম্নী একটি স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট করিয়াছি বলিয়া, আমার নামে এক অভিযোগ আনয়ন করিলেন। কিন্তু আমার সৌভাগ্যক্রমে সেই মোকদ্দমার বিচারের ভার হুজুরের হস্তেই ন্যস্ত হইল। সুবিচারে আমি সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম। ধর্ম্মাবতার তখন বেশ বুঝিতে পারিলেন, আমার উপর কিরূপ ভয়ানক মিথ্যা অভিযোগ আনা হইয়াছিল। ইহার পর দারোগা সাহেব দেখিলেন, তাঁহার সমস্ত মন্ত্রণা বিফল হইল, তিনি তাঁহার পরম বন্ধুর নিকট লজ্জিত হইলেন; সুতরাং আবার নূতন ষড়যন্ত্রের আবিষ্কার হইল। এবার আমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইবার বন্দোবস্ত করিলেন। খুনি মোকদ্দমায় আসামী হইয়া পুনরায় আমি হুজুরের নিকট আনীত হইলাম। হুজুর পুনরায় আমার সেই মোকদ্দমার বিচার করিলেন। যাহাকে হত্যা করিয়াছি বলিয়া আমি অভিযুক্ত, ভগবান্ তাহাকেই হুজুরের সম্মুখে প্রেরণ করিলেন। তাহাকে দেখিবামাত্র সেই মোকদ্দমা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া আপনি আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। এই মোকদ্দমার পরেই আমি অতিশয় ভীত হইলাম। দারোগা সাহেব পুনরায় অপর এক কোন উপায় উদ্ভাবন পূর্ব্বক আমাকে বিপদগ্রস্ত করিবেন ভাবিয়া, আমি গ্রাম পরিত্যাগ করিলাম। বিনাসম্বলে ও বিনা-সহায়ে অপরিচিত স্থানে গমন করায় আমার দারুণ কষ্ট হইল। এমন কি দুই এক দিবস অনশনেও কাটিয়া গেল। তাহার পর পেটের জ্বালায় আমাকে যে কার্য্য করিতে হইল, তাহাও ধর্ম্মাবতার এখনই অবগত হইতে পারিবেন। যখন দেশে প্রত্যাগমন করিলাম, সেই সময় শ্রবণ করিলাম যে, ‘কালীপ্রসন্ন হত হইয়াছেন, এবং আমিই এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছি বলিয়া, আমার নামে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে।’ এই কথা শ্রবণ মাত্রেই আমি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গিয়া উপনীত হইলাম। সত্য মিথ্যা নথি দেখিলেই তাহা জানিতে পারিবেন। কালীপ্রসন্ন ঘোষ যেমন আমার শত্রু ছিলেন, গ্রামের ভিতর অনেক লোকও তেমনি তাঁহার শত্রু আছেন। এই অবস্থায় কে তাঁহাকে হত্যা করিল, তাহার ঠিকানা নাই। কিন্তু দারোগা সাহেব তাঁহার কালীপ্রসন্ন বাবুর মৃত্যুতে নিতান্ত দুঃখিত হইলেন, ও আমার মস্তকের উপর সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া তাঁহার বন্ধুত্বের পরিচয় দিলেন, এবং তাঁহার কর্তৃকই এই খুনি মোকদ্দমার উপায় হইয়াছে বলিয়া, তাঁহার উপর-ওয়ালাকে সন্তুষ্ট রাখিবার চেষ্টা করিলেন। এই হত্যা যদি আমিই করিব, তাহা হইলে আমি কি এতই মূর্খ যে, দিনমানে ও সর্ব্বসমক্ষে এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া, আমি নির্জ্জন রাত্রিকালে এই কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিতে পারিতাম না? ধর্ম্মাবতার! আমি যদি ইচ্ছা করিতাম, তাহা হইলে সকলের অগোচরে এবং নিশীথ রাত্রিতে আমি অনায়াসেই এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে পারিতাম। ধর্ম্মাবতার! এ মোকদ্দমাতেও আমি সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধ। যদি আমার কথায় হুজুরের অবিশ্বাস হয়, তাহা হইলে আমি তিনজনমাত্র সাক্ষীকে হুজুরের নিকট উপস্থিত করিতেছি। তাহাদিগের নিকট হইতেই আপনি জানিতে পারিবেন যে, এই হত্যাকাণ্ড আমাদ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে কি না?” এই বলিয়া নগেন্দ্র তাঁহার প্রথম সাক্ষী সেখ আলাউদ্দিনকে ডাকিতে কহিলেন। 

চাপরাসী আলাউদ্দিনকে ডাকিলে দুইজন কনষ্টেবলের সহিত আলাউদ্দিন আসিয়া উপস্থিত হইল।

আলাউদ্দিনের পরিধানে কয়েদীর পোষাক, হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ি। 

নগেন্দ্র। তোমার নাম কি? 

সাক্ষী। আমার নাম সেখ আলাউদ্দিন। 

নগেন্দ্র। তুমি কোথায় থাক? 

আলাউদ্দিন। আমি ঢাকা জেলের একজন কয়েদী। 

নগেন্দ্ৰ। তুমি কত দিবসের কয়েদী? 

আলাউদ্দিন। আমি গত সাত বৎসর হইতে ঢাকা জেলার জেলে আছি। 

নগেন্দ্র। তুমি আমাকে চেন? 

আলাউদ্দিন। হাঁ, খুব চিনি। 

নগেন্দ্র। আমাকে তুমি কি প্রকারে চেন, তাহা হাকিমের সম্মুখে সমস্ত প্রকাশ করিয়া বল। 

আলাউদ্দিন। আমি ঢাকার জেলে গত সাত বৎসর পর্য্যন্ত আছি। তাহার মধ্যে গত চারি বৎসর হইতে আমি মেটের” কার্য্য করিতেছি। তুমি চুরি মোকদ্দমায় কয়েদী হইয়া যখন ঢাকার জেলে যাও, সেই সময় আমি সেই স্থানেই ছিলাম। তুমি যতদিবস উক্ত জেলে ছিলে, ততদিবস আমার অধীনে কর্ম্ম করিতে, এই নিমিত্তই আমি তোমাকে চিনি। 

নগেন্দ্র। আমি কতদিবস জেলের মধ্যে ছিলাম? 

আলাউদ্দিন। তোমার তিন মাস কয়েদ হয়। সেই তিন মাসই তুমি জেলের ভিতর ছিলে। 

নগেন্দ্র। তুমি মনে করিয়া দেখ দেখি, আমি কোন সময়ে উক্ত জেলে গমন করি? 

আলাউদ্দিন। আমার বোধ হয়, তুমি জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ অংশে জেলে গমন কর, ও সেই সময় হইতে তিন মাস জেলের ভিতর থাক 

নগেন্দ্র। আযাঢ় মাসের কোন দিবসে আমি জেলের বাহির হইয়াছি, বলিতে পার? 

আলাউদ্দিন। তিন মাসের মধ্যে তুমি একবারও জেলের বাহিরে আইস নাই। 

কয়েদীর এই কথা শ্রবণ করিয়া সকলে বিস্মিত হইলেন। নগেন্দ্রনাথ তাহার পর তাঁহার দ্বিতীয় সাক্ষীকে ডাকিলেন। সেই ব্যক্তি ঢাকা জেলের “ওয়াডার”। আলাউদ্দিন যাহা যাহা বলিয়াছিল, এই ব্যক্তিও তাহাই বলিল। ওয়ারডারের সাক্ষ্য গৃহীত হইলে, নগেন্দ্রনাথ তাঁহার তৃতীয় বা শেষ সাক্ষীকে ডাকিলেন। ইনি ঢাকা জেলের জেল-দারোগা। 

জেল-দারোগা তাঁহার জেলের রেজিষ্টারী পুস্তক জজের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “আমি এই ব্যক্তিকে উত্তমরূপে চিনি। ২০শে জ্যৈষ্ঠ তারিখে গরু-চুরি মোকদ্দমায় ঢাকার মাজিষ্ট্রেটের কোর্ট হইতে ইহার তিন মাস কঠিন পরিশ্রমের সহিত মেয়াদ হয়। সেইদিবস যখন ইহাকে প্রথমে জেলের ভিতর আনয়ন করে, সেই সময়ে আমি উহার নাম, উহার পিতার নাম, “হুলিয়া” প্রভৃতি জেলের নিয়মানুযায়ী সমস্ত বিষয় এই পুস্তকে লিখিয়া লই। সেইদিবস হইতে এ ব্যক্তি জেলের ভিতরেই ছিল, পরিশেষে মেয়াদ পূর্ণ হইলে, ১৯শে ভাদ্র তারিখে ইহাকে জেলের ভিতর হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হয়।” 

জেল-দারোগা এই কথা শ্রবণ করিয়া, জজসাহেব উক্ত পুস্তকের সহিত নগেন্দ্রনাথের হুলিয়া মিলাইয়া দেখিলেন, ও পরিশেষে সেই পুস্তক জুরিগণের হস্তে প্রদান করিলেন। জুরিগণও পুস্তকের সহিত সবিশেষরূপে নগেন্দ্রনাথের হুলিয়া মিলাইয়া দেখিয়া সকলে একবাক্যে কহিলেন, “এই আসামী কর্তৃক এই হত্যা কোন প্রকারেই সম্ভবপর নহে। অন্য কোন ব্যক্তি এই হত্যা সম্পন্ন করিয়াছে। সমস্ত সাক্ষী নগেন্দ্রনাথের বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছে।” 

জজসাহেবও জুরিগণের মতে মত দিয়া আসামী নগেন্দ্রনাথকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি প্রদান করিলেন; কিন্তু “দারোগার চরিত্র-সম্বন্ধে অনুসন্ধান হওয়া কৰ্ত্তব্য” এই বলিয়া এক পত্র সেইস্থানের পুলিসের বড়সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলেন, এবং তাহার সহিত আসামীর জবাবের নকলও একখণ্ড পাঠাইয়া দিলেন। আর ইহাও কহিলেন, “ডাক্তার ব্যতীত অপরাপর সমস্ত সাক্ষীগণকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে চালান দেওয়া উচিত।” 

নগেন্দ্রনাথ প্রভূত আনন্দ প্রকাশ করিতে করিতে আপন আলয়াভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কিন্তু দারোগা সাহেব নিতান্ত দুঃখিত অন্তঃকরণে খোদার নাম করিতে করিতে আপনার থানা-অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ভয়ে তিনি আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বদাই ভাবিতে লাগিলেন, “বিনাদোষে পাছে আমার অনিষ্ট হয়!” 

জজসাহেবের পত্র পাইবামাত্র পুলিস সাহেব দারোগাকে সপেণ্ড করিয়া, তাঁহার বিপক্ষে অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। 

.

এই ঘটনায় প্রায় এক মাস পরে জানি না, উক্ত অনুসন্ধানের ভার কিরূপে আমাদিগের হস্তে পতিত হইল। একদিবস আমার জনৈক উর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী আমাকে ডাকিয়া এই মোকদ্দমার সমস্ত কাগজ-পত্র আমার হস্তে প্রদান করিয়া, ইহার প্রকৃত অবস্থা কি, তাহার অনুসন্ধান করিতে কহিলেন। সমস্ত কাগজ-পত্র পাঠ করিয়া আমি একবারে ঢাকায় চলিয়া গেলাম। যে থানায় নগেন্দ্রনাথ গরু-চুরি মোকদ্দমায় ধৃত হইয়াছিলেন, সেই থানায় যাইয়া সেই গরু-চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। উভয়ে নগেন্দ্রনাথের গ্রামে উপস্থিত হইলাম। কৰ্ম্মচারী নগেন্দ্রনাথকে উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “সেই গরু চোর প্রায়ই ইহার মত; কিন্তু আমার বোধ হইতেছে, এ ব্যক্তি সেই গরু-চোর নহে।” কর্ম্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে অতিশয় সন্দেহ হইল, আমি পুনরায় ঢাকার জেলে গমন করিলাম। সেইস্থানে সেই জেল-দারোগার নিকট আদ্যোপান্ত অনুসন্ধান করাতে জানিতে পারিলাম যে, যে সময়ে গো-চোর নগেন্দ্রনাথ জেলের ভিতর ছিল, সেই সময়ে একটি লোক তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত একখানি দরখাস্ত করেন। তাঁহার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়। তিনি উহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া চলিয়া যান। যে ব্যক্তি দরখাস্ত করে, তাহার সহিত সেইস্থানের একজন মোক্তার ছিল। অনুসন্ধানে সেই মোক্তারকে পাওয়া গেল, কিন্তু তাহার নিকট হইতে সবিশেষ কিছুই জানিতে পারিলাম না। তিনি কেবল এইমাত্র কহিলেন যে, “যাহাকে আমি সঙ্গে করিয়া জেলে লইয়া গিয়াছিলাম, বোধ হয় তাহাকে দেখিলে, আমি চিনিতে পারিব। সে আমার পূর্ব্ব-পরিচিত ব্যক্তি নহে।” এরূপ অবস্থায় আর যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। 

এদিকে নগেন্দ্রনাথ মোকদ্দমা হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়া, নিষ্কণ্টকে আপনার বাড়ীতেই বাস করিতে লাগিলেন। সেই সময় তাঁহার স্ত্রী অসুস্থতা-নিবন্ধন গৃহকার্য্যের অতিশয় কষ্ট হয় বলিয়া তিনি একটি চাকরাণীর অনুসন্ধান করিতেছিলেন। আমি এই সংবাদ জানিতে পারিয়া একটি চতুরা স্ত্রীলোককে তাঁহার বাড়িতে পাঠাইয়া দিলাম। সে সেই সময়ে অনায়াসেই নগেন্দ্রনাথের বাড়ীতে সেই চাকরীর বন্দোবস্ত করিয়া লইল। সেই স্ত্রীলোকটি যদিও সেইস্থান হইতে কিছু কিছু পাইতে লাগিল সত্য, কিন্তু আমার নিকট হইতে সে তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক পাইতেছিল। সময় বিশেষে অধিক পারিতোষিকের প্রলোভনও ছিল। সে নগেন্দ্রনাথের কাজ-কর্ম্ম বিলক্ষণ চতুরতার সহিত করিয়া, ক্রমে বাড়ীর সকলেরই সবিশেষ প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিল। নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী আরোগ্যলাভ করিলেন, তথাপি তাহার চাকরী গেল না। 

এইরূপে দুই মাস গত হইয়া গেলে, একদিবস সেই স্ত্রীলোকটি আমার নিকট আগমন করিয়া কহিল, “যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনি আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি অবগত হইতে পারিয়াছি; কিন্তু আদালতে তাহার কোন প্রমাণ হইবে না।” 

স্ত্রীলোকটি বলিতে লাগিল,—“একদিবস গভীর রাত্রিতে অতিশয় গ্রীষ্ম হওয়ায় হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমি যে গৃহে শয়ন করিয়া থাকি, সে গৃহে বায়ু চলাচলের ভাল বন্দোবস্ত নাই। সুতরাং গ্রীষ্মের জন্য আমার বড় কষ্টবোধ হইতে লাগিল। দেখিলাম, সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ, সকলেই নিদ্রাগত। আমি আস্তে আস্তে উপরে উঠিয়া বাবুর গৃহের সম্মুখে ছাদে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তথায় অপেক্ষাকৃত কিছু শীতল বোধ হওয়াতে ছাদের উপর অঞ্চল পাতিয়া শয়ন করিলাম। কিছুক্ষণ পরে শুনিতে পাইলাম, যেন বাবু গৃহের ভিতর কাহার সহিত কথা কহিতেছেন। আমি কান পাতিয়া শ্রবণ করিলাম, আমার অনুমান সত্য বলিয়া বিশ্বাস হইল। কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া বাবুর গৃহের দ্বারের নিকট উপস্থিত হইলাম। শ্রবণ করিলাম, নগেন্দ্রবাবু তাঁহার স্ত্রীর নিকট বলিতেছিলেন, “আমি যখন দেখিলাম, কালীপ্রসন্ন আমাকে বিশিষ্টরূপে বিপদগ্রস্ত করিতে আরম্ভ করিল, সেই সময়ে আমি উহাকে হত্যা করিব স্থির করিয়া বাড়ি হইতে বহির্গত হইলাম। দেবীপুর গ্রামে আমার সবিশেষ পরিচিত একটি লোক আছে, তাহার আকৃতির সহিত আমার আকৃতির অনেক সাদৃশ্য আছে। আমার শরীরে অস্বাভাবিক চিহ্ন যেখানে যেরূপ ছিল, তাহার শরীরের সেই সেই স্থানে সেই প্রকার চিহ্ন করিয়া দিয়া, তাহাকে কিছু অর্থ প্রদান করিলাম। একে বন্ধুত্বের অনুরোধ, তাহার উপর আশাতীত অর্থ পাইয়া সে আমার কোন প্রস্তাবে সম্মত হইল। সে বাটী পরিত্যাগ পূর্ব্বক ঢাকা জেলার ভিতর গমন পূর্ব্বক একটি গরু চুরি করিয়া সহজেই পুলিসের নিকট ধৃত হইল। সেইস্থানে সে আমার নামে তাহার পরিচয় দিল। আমার পিতার নাম তাহার পিতার নামের স্থানে লিখাইল। এককথায় আমার যে যে পরিচয়, সে সেইস্থানে সেই সকল পরিচয়ই অবিকল আমার পূর্ব্ব-পরামর্শ অনুযায়ী প্রদান করিল। মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট গরু-চুরি মোকদ্দমায় পুলিস তাহাকে প্রেরণ করিলে, সে আপন দোষ স্বীকার করিয়া, তিন মাসের নিমিত্ত কঠিন পরিশ্রমের সহিত কারারুদ্ধ হইল। সে যখন জেলের ভিতর আবদ্ধ, সেই সময় আমি এই গ্রামে আসিয়া স্বহস্তে কালীপ্রসন্নকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিলাম। আমার সেই বন্ধুর মেয়াদ যখন অতিবাহিত হইয়া গেল, যখন সে খালাস পাইয়া আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিল, সেই সময় আমি ঢাকার জেলে গমন করিয়া জেল-দারোগা, ওয়ার্ডার ও মেটের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহাদিগকে কিছু কিছু নজর দিয়া কহিলাম, ‘মহাশয় যখন আমি এই জেলে আবদ্ধ ছিলাম, সেই সময়ে আমার একজন শত্রু এক মিথ্যা মোকদ্দমা আনিয়া, আমার নামে এক ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছে। আমি সেই এক মিথ্যা মোকদ্দমা হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত আপনাদিগকে সাক্ষীরূপে মান্য করিব।’ তাঁহারা আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমাকেই সেই গো-চোর সাব্যস্ত করিয়া লইলেন, এবং খাতা খুলিয়া তল্লিখিত চিহ্নের সহিত আমার শরীরের চিহ্ন মিলাইয়া বুঝিলেন, আমি প্রকৃতই সেই সময়ে সেই জেলে ছিলাম। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া, অধিকন্তু আমার নিকট হইতে যথেষ্ট প্রণামী পাইয়া, তাঁহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। পরিশেষে তাঁহাদের সাক্ষ্যের গুণেই আমি নিষ্কৃতিলাভ করিলাম।” 

এতদিবস পরে আমার কার্য্য শেষ হইল। স্ত্রীলোকটিকে অঙ্গীকার মত পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলাম। যাহা হউক, এতদিবস পরে এইরূপে প্রকৃতকথা অবগত হইয়া সেইরূপ ভাবেই আমি রিপোর্ট করিলাম; কিন্তু নানারূপ চেষ্টা করিয়াও এই সকল কথার প্রমাণ করিতে পারিলাম না। দেবীপুর হইতে সেই ব্যক্তিকেও বাহির করিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কোন কথাই স্বীকার করিল না। 

প্রকৃতকথা সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িল সত্য; কিন্তু নগেন্দ্রনাথের আর কিছুই করিতে পারিলাম না। কেবল সেই দারোগা হামিদুল্লা নিরপরাধ সাব্যস্ত হইলেন, ও তাঁহার কার্য্যে পুনরায় নিযুক্ত হইয়া আমাকে বার বার “দোয়া” দিতে লাগিলেন। 

[শ্রাবণ, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *