শঙ্খমালা

শঙ্খমালা

অনেক রাতে খেতে বসেছি, মা ধরা গলায় বললেন, খবর শুনেছিস ছোটন?

কী খবর?

পরী এসেছে।

আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। মা থেমে-থেমে বললেন, পরীর একটা মেয়ে হয়েছে।

মায়ের চোখে এইবার দেখা গেল জল। আমি বললাম, ছিঃ মা, কাঁদেন কেন?

মা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, না কাঁদি না তো; আর দুটি ভাত নিবি?

আমি দেখলাম মার চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মায়েরা বড় দুঃখ পুষে রাখে।

ছবছর আগের পরী আপাকে ভেবে আজ কি আর কাঁদতে আছে? হাত ধুতে বাইরে এসে দেখি ফুটফুটে জোছনা নেমেছে। চারদিকে কী চমৎকার আলো। উঠোনের লেবু গাছের লম্বা কোমল ছায়া সে আলোয় ভাসছে। কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেমন অচেনা লাগছে আজ।

বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন আমার অন্ধ বাবা। তার পাশে একটি শূন্য টুল। ঘরের সমস্ত কাজ সেরে আমার মা এসে বসলেন সেখানে। ফিসফিস করে কিছু কথা হবে। দুজনেই তাকিয়ে থাকবেন বাইরে। একজন দেখবেন উথাল-পাথাল জোছনা, অন্যজন অন্ধকার।

বাবা মৃদু স্বরে ডাকলেন, ছোটন, ও ছোটন!

আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তাঁর অন্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পরী এসেছে শুনেছিস?

শুনেছি।

আচ্ছা যা।

আজ আমাদের বড় দুঃখের দিন। পরী আজ এসেছেন। কাল খুব ভোরে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হয়তো দেখা যাবে তিনি হাসি-হাসি মুখে শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। শিমুল তুলো উড়ে এসে পড়ছে তার চোখেমুখে। আমাকে দেখে হয়তো খুশি হবেন। হয়তো বা হবেন না। পরী আপাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে।

আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন আমাদের কত পুরনো কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর আচমকা ধাক্কা লাগে। চোখে জল এসে পড়ে। এমন কেন আমরা?

দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি, আমার মা হাত ধুতে কলঘরে যাচ্ছেন। মাথার কাপড় ফেলে তিনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর অনেক সময় নিয়ে অজু করলেন। একসময় এসে বসলেন শূন্য টুলটায়। বাবা ফিসফিস করে বললেন, খাওয়া হয়েছে তোমার?

হুঁ। তোমার বুকে তেল মালিশ করে দেব?

না।

তারপর দুজন নিঃশব্দে বসেই রইলেন, বসেই রইলেন। লেবু গাছের ছায়া ক্রমশ ছোট হতে লাগল। এত দূর থেকে বুঝতে পারছি না কিন্তু মনে হচ্ছে আমার মা কঁদছেন। বাবা ভঁর শীর্ণ হাতে মার হাত ধরলেন। কফ-জমা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কাঁদে না, কাঁদে না।

বাবা তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে আজ আবার তিরিশ বছর আগের মতো ভালবাসুক। আমার মার আজ বড় ভালোবাসার প্রয়েজন। আমি তাঁদের ভালোবাসার সুযোগ দিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। মা ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, কোথায় যাস ছোটন?

এই একটু হাঁটব রাস্তায়।

দেরি করবি না তো?

না।

মা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, ছোটন তুই কি পরীদের বাসায় যাচ্ছিস? আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বললেন, যেতে চায় যাক না। যাক।

রাস্তাটি নির্জন। শহরতলীর মানুষরা সব সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। তারস্বরে ঝিঝি ডাকছে চারপাশে। গাছে-গাছে নিশি-পাওয়া পাখিদের ছটফটানি। তবু মনে হচ্ছে চারপাশ কী চুপচাপ।

রাস্তায় চিনির মতো শাদা ধুলো চিকমিক করে। আমি একা একা হাঁটি। মনে হয় কত যুগ আগে যেন অন্য কোনো জন্মে এমন জোছনা হয়েছিল। বড়দা আর আমি গিয়েছিলাম পরী আপাদের বাসায়। আমার লাজুক বড়দা শিমুলগাছের আড়াল থেকে মৃদুস্বরে ডেকেছিলেন, পরী ও পরী ।

লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন পরীর মা। হাসিমুখে বলছিলেন,

ওমা তুই? কবে এলি রে? কলেজ ছুটি হয়ে গেল?

ভালো আছেন খালা? পরী ভালো আছে?

খবর পেয়ে পরী হাওয়ার মতো ছুটে এসেছিল ঘরের বাইরে।

এক পলক তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল, ইশ! কতদিন পর কলেজ ছুটি হল আপনার।

আমার মুখচোরা লাজুক দাদা ফিসফিসিয়ে বলছিলেন—পরী, তুমি ভালো আছ?

হ্যাঁ। আপনি কেমন আছেন?

ভালো। তোমার জন্য গল্পের বই এনেছি পরী।’

এসব কোন্ জন্মের কথা ভাবছি? হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এসব কি সত্যিসত্যি কখনো ঘটেছিল? একজন বৃদ্ধা মা, একজন অন্ধ বাবা-— এরা ছাড়া কোনোকালে কি কেউ ছিল আমার?

পরী আপার বাড়ির সামনে থমকে দাড়ালাম । খােলা উঠোনে চেয়ার পেতে পরী আপা চুপচাপ বসে আছেন। পাশে একটি শূন্য চেয়ার। পরী আপার বর হয়তো উঠে গেছেন একটু আগে। পরী আপা আমাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বললেন, ছোটন না?

হ্যাঁ।

উহ! কতদিন পর দেখা। বোস এই চেয়ারটায়।

আপনি ভালো আছেন পরী আপা?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে দেখবি? বেস নিয়ে আসছি।

লাল জামা গায়ে উল-পুতুলের মতো একটি ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে করে ফিরে আসলেন তিনি।

দেখ, অবিকল আমার মতো হয়েছে। তাই না?

হ্যাঁ, কী নাম রেখেছেন মেয়ের?

নীরা। নামটা তোর পছন্দ হয়? চমৎকার নাম।

অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমি। একসময় পরী আপা বললেন, বাড়ি যা ছোটন। রাত হয়েছে।

বাবা আর মা তেমনি বসে আছেন। বাবার মাথা সামনে ঝুঁকে পড়েছে। তার সারা মাথায় দুধের মতো শাদা চুল। মা দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। পায়ের শব্দে চমকে উঠে বাবা বললেন, ছোটন ফিরলি?

জি।

পরীদের বাসায় গিয়েছিলি?

হ্যাঁ। অনেকক্ষণ আর কোনো কথা হল না। আমরা তিনজন চুপচাপ বসে রইলাম।

এক সময় বাবা বললেন, পরী কিছু বলেছে?

না।

মার শরীর কেঁপে উঠল। একটি হাহাকারের মতো তীক্ষ্ণস্বরে তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, আমার বড় খোকা। আমার বড় খোকা।

এনড্রিন খেয়ে মরা আমার অভিমানী দাদা যে প্রগাঢ় ভালোবাসা পরী আপার জন্যে সঞ্চিত করে রেখেছিলেন তার সবটুকু দিয়ে বাবা আমার মাকে কাছে টানলেন। ঝুঁকে পড়ে চুমু খেলেন মার কুঞ্চিত কপালে। ফিসফিস করে বললেন, কাঁদে না, কাঁদে না।

ভালোবাসার সেই অপূর্ব দৃশ্যে আমার চোখে জল আসল। আকাশ ভরা জোছনার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বললুম–পরী আপা, আজ তোমাকে ক্ষমা করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *