শকুন
এ হচ্ছে বিষ্টু ঘোষের পুকুর। গত মাসে পুকুরের সব মাছ মরে গিয়ে ভেসে উঠেছিল। সবাই বলাবলি করেছিল কে না কে ফলিডল মিশিয়ে দিয়েছে পুকুরে। মার কাছে শুনেছে আলোমণি, আকাশের তারা খসে পুকুরে পড়লে নাকি এ রকম হয়। মাথার বোঝাটা পুকুর পাড়ে রাখে আলোমণি, কয়লার আঁচের মতো গন্ গন্ করে জ্বলে চরাচর। রুটি তৈরির চাটুর মতো তেতে গেছে পিরথিমি। আলোমণি দুই ক্রোশ পেরায় হেঁটে এসেছে, পায়ে আর বশ নাই। ‘দণ্ডে দণ্ডে ভিজায়ে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’—আলোমণির বচন মনে পড়ে। আলোমণি তাই পা ভেজাতে পুকুরে নামে, ঘাট বাঁধানো পুকুর। ভালই হল, জলও খিয়ে লিব; পা ভিজিয়ে লিয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে, একটা বিড়ি খিয়ে নিলেই খাটুনি তরল হয়ে যাবে। আলোমণি জলে নামে…হেইরররে—একটু পেছলে পড়লেই হয়েছিল। কচির মাথার চুলের মতো পুরু শ্যাওলা জমেছে সিঁড়িতে। ভর পোয়াতি আলোমণি সাবধানে জলে নামে। চারিদিকে ধু-ধু রোদ্দুর। রোদ্দুরে নারকেল গাছগুলো কাঁপছে, কেউ নেই। আলোমণি অনেকদূর পর্যন্ত কাপড় উঠিয়ে দাঁড়ায়। শরীর ঠান্ডা হোক। জলও গরম, তবুও আরাম লাগে ওর। কলমি-শুশনির ঝোপের ছায়ায় ফড়িং বসে থাকে, চোখকুনি মাছ শুড়শুড়ি দেয় আলোমণির ঊরুতে।
হাতিয়াড়ার হাট থেকে দশ কিলো চাল চাপিয়ে দিয়েছে ওর সোয়ামি আলোমণির মাথায়। যা বাগুইআটিতে বেচে আয়,—সাবধানে যাস, সাড়ে তিন টাকার কমে বেচবিনি, পুলিশে ধরলে পায়ে উলটি খেয়ে কাঁদবি, ফিরতি আসার সময় মহিমের দোকান থিক্যে আমার জন্য চার বান্ডিল লালসুতোর বিড়ি লিয়ে আসিস।
হাজারি সামন্ত চালের কারবারি, তেনার বাড়ির পুকুর কাটার সময় মুনিষ খেটেছিল আলোর সোয়ামি নারায়ণ। সেই খাতিরে ধারে চাল পায় নারায়ণ। আলোমণি কিলোয় চার আনা লাভ করলে দশ কিলোয় আড়াই টাকা হবে।
হপ্তায় দু’বার করে পেরায় পাঁচ মাস যাবৎ আলোমণি এই কারবার করে। প্রথম বার চাল নিয়ে যাবার আগের দিন নারায়ণ শানের মধ্যে বাটখারার পোঁদ অনেকক্ষণ ধরে ঘষেছিল, তাতে বাটখারার ওজন একটু কমবে, প্রতি পাল্লায় যদি একমুঠি চাল ওজনে মারতে পারে, তবে দশ কিলো চালে একজনার একবেলার খোরাকি উঠে আসে। একটু বুদ্ধি খরচা করিস মাগী,—এই আমার মতন, বুকে চাপাটি মেরে বলেছিল নারায়ণ।
আলোমণি পুলিশের ভয়ে পাকা রাস্তা ধরে না। মাঠ পেরুলেই খাল, তারপর খাল ধার দিয়ে চলে যাবে বাগুইআটি, মাঠের পাশে তাকাতেই ধাঁধা লাগে দুই চক্ষে কী রোদ—মাগো।—
ধুর তাতে কী। শালগেরাম চিবিয়ে খেনু, চালতা আছে বাকি। বোশেখ মাসে কতবার এই পথ পেইরেছি, এ ত ভাদর মাস।
খোঁচা খোঁচা শন পায়ে বিঁধে যায় আলোমণির, চোরকাঁটা সারা শাড়িতে আটকে গেছে। মাথার উপর দশসেরি ভারে একটু পর পরই হাঁপি লাগে। ধম্মশাস্তরের হনুমান কী এক পব্বত মাথায় করে মস্ত লম্ফ দিয়েছিল, আহা আলোমণি যদি পারত, এক লাফেই পৌঁছে যেত বাগুইআটির বাজার। আজ আড়াই টাকা লাভ হলে আলোমণি চার আনা পয়সা লুকিয়ে রাখবে। বাচ্চাটা হলে মিছরির জল খাওয়াবে। আগের বাচ্চাটা ছ’মাসে মরল, আটা গোলা সইতে পারেনি, পেট ছাড়ল আর পরল না; লাইন দিয়ে হাসপাতালের লাল ওষুধ খাইয়েছে, তাতে কমল না, তারপর পাঁচির কথামতো গ্যাঁদালিপাতায় লোহা পোড়া দিয়ে খাইয়েছে, পির মোছলমানের ফুঁ দিয়েছে, কমল না, তারপর সেই শীতকালে বাবুদের বাড়ির ছাতে রোদে শুইয়ে বাসন মেজে চ্যান করে যখন খোকার কাছে গেল, তখন দেখল গু-রক্তের মধ্যে মাখামাখি করে চক্ষু মুদে আছে তার ‘কচি’ আর ভন্ ভন্ করতেছে শ্যালদার ভিড়ের মতো মাছিরা সব।
সেই সন্তানের বাপ ছিল কানাই ডোম৷ কলকাতার বেলগাছিয়ার খালপুলের পাশে মস্ত হাসপাতালে কাজ করত কানাই। কানাই এর কথা ভাবলে এখনও ডর লাগে আলোমণির, বুকে কাঁপন আসে। আলোমণির উঁচু পেটে হাত বুলাতে বুলোতে কানাই বলেছিল, তোর পেটের বাচ্চাটা এখন উলটে আছে, তার পেটটা মোটা, হাত দুটো সরু সরু, চোখ ফোটেনি এখনও। বলত, আলো, তোর ধুকপুকির যন্তরটা এই—এইখেনে, তোর নাইকুণ্ডুলির তলায় এইখানে জমছে তোর গু। বলেই ফিক ফিক হাসত কানাই ডোম।
কানাইয়ের হাত ছিল এক মস্ত শুঁয়োপোকার মতো, মুখে মদের গন্ধ। কানাই পেটের উপর কান চেপে বলত, দেখি দেখি আমার ব্যাটার ধুকপুকি শোনা যায় কি না, ভয়ে সিঁটকে যেত আলোমণি, রা কাড়ত না। কানাই ছিল হাসপাতালের ডোম। মরামানুষ কাটত, হাড়গোড় চুরি করে এনে বাড়িতে রাখত আর দাদাবাবু-দিদিমণির কাছে বিক্রি করে মদ খেত। ঘিন্নেপিত্তি ছিল না শরীলে। মা গো—একদিন একটা ফ্যাকাশে মাংসের দলা এনে নাড়তে নাড়তে বলেছিল আলোমণিকে—দ্যাখ দ্যাখ—এই হচ্ছে জন্ম যন্তর, এর থেকেই আমরা বেরুই, তোর পেটেও যেমন আর ঘড়ি চশমাপরা ইংরিজি বলা ছুঁড়িদের পেটেও তেমন; আলোমণি ভয়ে মুখ ঢাকলে খ্যাক খ্যাক হেসে উঠত কানাই। লোকটাকে বড় ডরাত আলোমণি, লোকটা বেবুশ্যে বাড়িতেও যেত, আলোমণিকে ঠ্যাঙাত মাঝে মধ্যে, আলোর ইচ্ছে করত না লোকটার ঘর করতে; তবু আলোমণি ঘরের কোনার কলসির মতো চুপ করে থাকত। খেতে তো দেয় তবু যা হোক।
খালধারের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলে আলোমণি। একটু একটু বাতাস দিচ্ছে, এখানে ওখানে বক বসে আছে খাল ধারে, আলোমণির কেমন গা গুলোয়, একটু জিরেন দিতে পারলে হত। কাছাকাছি গাছগাছালির ছায়া নেই। কী আর করবে। আলোমণি হাঁটে,—জোরে জোরে পড়ে ওর শ্বাসপ্রশ্বাস। কে বেঁধেছে গোরুটাকে এখানে, কী আক্কেল বলদিকি, মোটে ঘাস নাই এদিকে, গোরুটা খুঁটি ছিঁড়বার জন্য টানাটানি করতিছে, দূরে যাবে যেখানে সবুজ রং আছে, খাবার আছে।
আলোমণিদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল পেরায় তিন বচ্ছর। সেবার সন্দেশখালিতে বন্যা হল, হু হু করে গাঙের জল ঢুকল গেরামে। তারপর বন্যা থেমে গেলে খাবার নেই, ওলকচু সব পচে গেল, কলাগাছ, পেঁপেগাছ কিছু রইল না, মাঠের মধ্যে শুধু কচুরিপানার বংশ। আলোমণির মা-বাবা মুনিষ খাটত পরের জমিতে, আলোমণি আর ভাইবোনেরা কলমি শাপলা ওলকচু খুঁজে আনত। আর-বছর কচুর লতি তুলতে গিয়ে পগারের ধারে সাপে মেরেছিল আলোমণির দাদাকে। তাই খুব ডর লাগত আলোমণির, বাঁশের ডগা দিয়ে না খুঁচিয়ে ঝোপে হাত দিত না। বন্যার পর মুনিষ খাটার কাজ নেই, রুজি-রোজগার বন্ধ এক্কেবারে। মগরাহাটে সড়ক তৈরির জন্য গেরামের কেউ কেউ কাজ পেয়েছিল; আলোমণির বাবাও গিয়েছিল কাজের জন্য, কিন্তু সেবার হাঁপির টান এত বেশি হয়েছিল যে সড়ক তৈরির বাবুরা কাজটা দিল না আলোর বাপকে। তাই হারাধনের বাপ-মার সাথে সাথে আলোমণির বাপ-মাও সপরিবারে পাটি, বঁটি, দুটো থালা আর একটা পুঁটলি নিয়ে কলকাতা চলে এল। বাঁশের মাচাটা আর পা ধোবার কালো শানটা ভারী বলে আনতে পারেনি। সেই পেরথম রেলগাড়িতে চড়ল আলোমণি। টিকিট কাটেনি। হারাধনের বাপ আগেও কলকাতা এসেছে। খালধারের পাটগুদোমে কুলির কাজ করত, থাকত খালপুলের নীচে। সেইখানে গেল ওরা। কী আশ্চর্য, পুলের তলা তখন মানুষে ভরতি, মোটা মোটা নলগুলোর ভিতরে পর্যন্ত মনিষ্যি; শেষকালে একটা নলের উলটো ধারে ওরা বাসা বাঁধল। ভারী রগড় লাগত, একটা নলের একদিকে এক পরিবার, অন্যদিকে আরেক পরিবার—মাঝখানে একটা ছালা টানাবার উপায় নেই নলটাতে। লোহার, তাতে পেরেকও পোঁতা যায় না, ফুটোও করা যায় না। নলের ভিতর কথা বললে গম্গম্ শব্দ হত। পেরথম দিন শোবার সময় মনে হয়েছিল, নলটা যদি গড়িয়ে যায়?
আলোমণির মা বাবুদের বাড়িতে কাজ পেয়ে গিয়েছিল। আলোমণিও মায়ের সঙ্গে কাজে যেত, আর আলোর বাপের হাঁপির টান বাড়তেই লাগল, কাজকম্ম কিছুই করতে পারত না। খালধারে বসে বসে নারকোল শলা তার দিয়ে বেঁধে ঝাঁটা বানাত, একশো বাঁধলে আট আনা মুজুরি। আর কোলের ভাইকে হাগাত, ঘুম পাড়াত।
কানাই ডোমের সাথে খাল পাড়েই আলাপ। সেদিন পাইপের উপর শুকোচ্ছিল আলোমণির শাড়ি, ইট চাপা দেওয়া ছিল যাতে না উড়ে যায় দমকা বাতাসে। মায়ে-ঝিয়ে মালসায় সেদ্ধ করছিল শাকপাতা, পিঁয়াজ আর খালধারের মরা কাঁকড়া। লোকটা কখন পাইপগুলোর পাশে গ্যাঁজা খাবার দলবল নিয়ে এসে গেছে রোজকার মতো, কখন যে পটাপট কাপড় চাপা ইটগুলো উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বসবার পিঁড়ে বানিয়ে ফেলেছে লোকটা, আলোমণি জানতেই পারেনি। হঠাৎ ওঠা দমকা বাতাসে যখন শুকুতে দেয়া কাপড়টা উলটি খেয়ে হামলে পড়ল রাস্তায়, তখন হেইরে বলে আলোমণি ছুট মারে, ততক্ষণে একটা কাদামাখা লরি কাপড়টাকে পিষ্টে দিয়েছে। আলোমণির যেন কোলের বাচ্চা চাপা পড়েছে, এমনভাবে দলাপাকানো কাপড়ের উপর হামলে পড়ে রক্ত পোছানোর মতো কাদাগুলোর উপর হাত বোলাতে গিয়ে দেঁখে সবটাই ছিঁড়ে গেছে। তখন কাপড়ের দলাটা বুকে চেপে ধরে—মা গো কী হল গো—বলে আর্তনাদ করে উঠলে পুলের থেকে দুটো শকুন উড়ে যায়। তারপর বটগাছের তলায় ইটের উপর ঠানা ধরে বসে থাকা লোকটাকে দেখে, বোঝে ইটগুলো কে সরিয়েছে, তখন লোকটার উপর অসম্ভব রাগে-ক্ষোভে আর ঘেন্নায় লোকটার দিকে হঠাৎ-ওঠা ধুলোঝড়ের মতো ছুটে যেতে যেতে বলে—হারামির পো! কেন তুই আমার ইট সইরে লিইচিস। মর! মর! আবাগীর ব্যাটা—দ্যাখ আমার কাপড় ছিঁড়ে নিইচিস, তুই দ্যাখ। তুই রক্ত উঠে মর, এক্ষুনি মর। তুই এইখেনে মর।
থাম। চিল্লাচিল্লি করে মেজাজ খারাপ করাসনি, উলটো সোজা হয়ে যাবে। আগে তোর বুকের কাপড় ঠিক করে লে। ততক্ষণে আলোমণির গোটা পরিবার জড়ো হয়ে গেছে।
কানাই ডোম তারপর বলেছিল—আমনাদের বাত বাত্তেলার দরকার নেই, আরেকটা কাপড় দিয়ে দেব কাল। ব্যস।
কানাই একটা ডুরে কাপড় দিয়েছিল আলোমণিকে।
আলো কি তখন জানত, ওটা মরা মেয়েমানুষের কাপড়।
কাপড়টা পেয়ে বড় খুশি হয়েছিল আলো। আগের কাপড়ে না হোক তার ছ’টা গেরো ছিল। এটা একটুও ছেঁড়েনি। পরদিন শাড়িটা পরে আলো জুতোর দোকানের কাচে নিজের অঙ্গ দেখে নিজেরই সোহাগ করতে ইচ্ছে হল, ইচ্ছে হচ্ছিল এই সময় লোকটা তাকে এক চোখ দেখুক। আলোমণি তাই হাসপাতালের ওখানটায় ঘোরাঘুরি করছিল। কিন্তু বিড়ি খেতে খেতে লোকটা আসতেছে দেখেই আলোমণি ঝেঁকে পালিয়েছিল তার ডেরায়।
কানাই ডোমের বউ পালিয়ে গেছিল প্রায় ছ’মাস আগে। সব বিত্তান্তি বলেছিল আলোমণির মাকে। আর এও বলেছিল আলোমণিকে তার মনে ধরেছে।
আলো যখন পাকাপাকি ভাবে কানাই ডোমের ঘরে যায় তার কিছুদিন পরেই আলোর বাপ মরে যায়। হাসপাতালে ভরতির ব্যবস্থা করেছিল বটে, কিন্তু পেরমায়ু ফুরুলে বেম্মার বাপেরও সাধ্যি নেই, তাই আলোমণি বেশি কান্নাকাটি করেনি। শ্মশানে পুড়োতে আবার পয়সাকড়ির ঝামেলা, তাই কানু ডোম বলেছিল হাসপাতাল থেকেই বাপের মড়া নষ্ট করে দেবে, চিন্তার কিছু নেই, তাই আলোর মা সিঁদুর ঘষে স্বামীর গায়ে খালের জল ছিটিয়ে পেন্নাম করে চলে এসেছিল। ওটাই গঙ্গা। খাল তো গঙ্গারই ছা।
আলোর পেটে ততদিনে খোকা এয়েছে। তার কিছুদিন পরে কানাই ডোম একরাশ হাড়গোড় ঘরে নিয়ে আসে৷ পোয়াতি মেয়ের ঘরে এসব থাকলে অমঙ্গল হয়, অনেক বুঝিয়েছে আলো। কানাই বলেছিল, আর সাত দিন সবুর কর, সব বেচে দেব। একদিন এক ছোকরা এসে নগদ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সব হাড়গোড় কিনে নিয়ে গেল! সেদিন পাঁঠার মাংস কিনে এনে কানাই বলেছিল, খা— আমার ব্যাটা যেন পুরুষ্টু হয়, ভাল করে খা।—
তখন কি আলোমণি জানত ওই সমস্ত অস্থি-কঙ্কাল তার বাপের, তার বাপের হাড় বেচে পুষ্টির খাবার খাচ্ছে আলোমণি?
কচিটা হবার পরই কী যে সর্বনেশে রোগে ধরল আলোমণিকে। কেবল রোগা হতে লাগল, বুকের দুধ পেরায় বন্ধ, মাথার জট ছাড়াবার সময় উঠে আসে শুকনো পচা কচুরিপানার মতো কালো চুল। মা বলেছিল নাড়িপচা রোগ, সদাসব্বদা ঝিমঝিম করত মাথা, যেন চব্বিশ ঘণ্টা টেরাম চলতিছে মাথার ভিতরে। কানাই ডোম যা চাইত আর পেত না সে মরা ইন্দুরের মতো আলোমণির শরীরে। একদিন আলোমণি রাগের চোটে লাথি মেরেছিল, কানু ডোম খুব ঠেঙিয়ে সেই রাত্তিরেই বিদেয় করে দিল আলোমণিকে। কোলের কচি নিয়ে মার কাছে ফিরে গেল, দু’দিন পর আলো আর আলোর মা অনেক বিনয়-মিনতি করলে কানুর পা চেপে, কানাই বললে, এমন মাগ এই শালার দরকার নেই, পয়সা ফেললেই বহুত যন্তর মিলবে।
বাচ্চাটা মরার কিছুদিন পরেই নারায়ণের সঙ্গে বে হল আলোমণির। নারান হাতিয়াড়ার বাসিন্দে, এয়েছিল খাল চওড়া করার সময় মাটি কাটতে। ওদের বে হলে দুটিতে একসঙ্গে একদিন বাইস্কোপের খেলা দেখেছে। সেদিন ফিরতি পথে আলুর চপ খেয়েছে ওরা। খুব ইচ্ছে করছিল আলোমণির, এই সময় কানাই ডোম একবার ওদের দেখুক, দেখুক কানাই ডোম তাড়িয়েছে বলে আবার ভাতার জুটল কি না! আলোমণির কল্পনায় তখন কানাই ডোম ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আর আলোমণি বলছে, তোর মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব।
মাটিকাটার জনমনুষ্যরা খালধারে ঝুপড়ি বেঁধেছে। আলোমণি নারানের ঝুপড়িতে চলে গেল, বেশিদিন থাকতে হল না। মাটিকাটার কাজ শেষ হয়ে গেল দিন সাতেকের মধ্যেই। নারান বলেছিল—এখন দেশে যাই আলো, হাঁড়ি ডেকচি আর্শি চিরুনি কিনে লিই তারপর তোকে লিয়ে যাব। পুরুষ মানুষকে বিশ্বেস করা আর সাপ বিশ্বেস করা—তাই আলোমণি নারানের কাছ ছাড়তে চায়নি৷ নারান আলোর চুলে বিলি কেটে বলেছিল, দ্যাখ তোকে পিরিত করে বে করেছি, তোকে ছাড়া থাকতে পারবনি। তোকে এসে লিয়ে যাব মাইরি। মাসখানেক সবুর কর শুধু।
পেটটা টনটন করে ওঠে আলোমণির। কেমন খিঁচুনির মতো লাগে। সামনেই অশ্বত্থ গাছ আর বিশ-পঁচিশ পা মাত্তর। ওখানে একটু বিশ্রাম করবে। আলোমণি নিশ্চিন্তি যে এ ব্যথা গভ্ভ-বেদনা নয়। পৌষে ভাদরে আট মাস। ওর এখন আট মাসের বেশি হতেই পারে না। কচি পেটের ভেতরে বোধহয় পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করতিছে কিংবা একটু খেলা করতিছে তাই জন্য অমন একটু লাগবেই তো। এর পর আর কারবারে যাবে না আলোমণি। আলোমণি গাছতলায় এসে চালের বস্তাটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে। গাংচিলের চিৎকারে কী দুঃখু। হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে কী দুঃখু। অশ্বত্থপাতার ফাক-ফোকর দিয়ে চুঁয়ে পড়া রোদ্দুরে কী দুঃখু।
আলোর ছেলে হবে সেয়ানা। বড় হলে একটা কলের গান কিনবে। তক্তাপোষে তোষক পেতে শুবে। আলোমণির বড় শখ বাবুদের বাড়ির মতো মুখে ঢুকিয়ে দেয় গোটা রসগোল্লা, বড় শখ পেলেট আর চামচে দিয়ে চিংড়ি মাছের ল্যাজ বার করা চ্যাপটা চ্যাপটা বড়া খায় মরিচগুঁড়ো ছিটিয়ে, আহা কী আহ্লাদে ঢুকে যাবে মুখের ভিতরে বেগুনি লম্বা পিঁয়াজের আঁশ। আর দু’মাস, খোকা হোক, আর বারো বছর, খোকা সেয়ানা হোক তারপর তো—চনমন করে ওঠে পেট, যন্তরনায় একটা খালি পা ধুলোয় ঘষে, বাঁ হাতে দুব্বো ছিঁড়ে নেয় একরাশ। গভ্ভ যন্তরনা নয়তো, সন্দেহ আলোমণির।
সোয়ামি জানে না সে বেত্তান্ত, লজ্জার মাথা খেয়ে বলবে বলবে করেও বলতে পারেনি—নারানরা দেশে যাবার পর এক রাত্তিরে একদল ফুলপ্যান্টলুন পরা ছেলে ওকে টেনে বার করেছিল যেমন খাঁচা থেকে মুরগি টেনে বার করে। ছেলেগুলোকে পাড়ায় দেখেছে আগে। শুধু আলোমণিকে নয়, সমস্ত পাইপের ভিতরের গোটা পাঁচ-ছয় যুবতী মেয়েমানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আলোমণি লাথি মারতেই চকচক করেছিল ছোরার ফলা টর্চ লাইটের আলোয়, আলোমণির মা-ভাই, ছোটবোন শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছে। কতকাল পর জানে না, আলোমণি আর মদের গন্ধ পায় না, তখন সারাগায়ে বিচুটি পাতার চুলকানি, মানে খামচির জ্বালা, আলোমণি তখন খালের নোংরা জলে স্নান করে এসে ভেউ ভেউ কেঁদেছিল, আলোমণির ইচ্ছে করেছিল আকাশ-নক্ষত্র-তারা-রেলপুল-দোতলা বাস, সবকিছু লাথি মেরে ভেঙে দেবে, ধম্মশাস্তরের সতীর মতো লণ্ডভণ্ড করে দেবে স্বর্গ-নরক-বিশ্বচরাচর—সেই ইচ্ছেগুলো বর্ষার মাছের ঝাঁকের মতো কিলবিল করে শুধু কান্না এনে দিচ্ছিল। আলোমণি দেখেছিল সেই রাত্তিরে পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খইনি খাচ্ছিল। আলোমণির গায়ে একটা নোক ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আলোমণি চিৎকারে বলেছিল পুলিশকে—তোমরা রাজার নোক হয়েও বাঁচাবে না গো—
সকালে শুনেছিল পাশের পাইপের ময়নাকে পুলিশে নিয়ে গিয়েছিল পুলের পিছনে।
আলোমণির মা পরদিন বাবুদের বাড়ির মাকে খুলে বলে সব বেত্তান্ত। বাবুদের বাড়িতে দু’দিন রাত্তিরের আশ্রয় চায় আলোমণির জন্য। আলোমণি ছাতের সিঁড়ির তলায় আশ্রয় পায়।
দ্বিতীয় রাত্তিরেই শকুন এসেছিল। মানে কানাই ডোম, মানে ছোরাহাতে গুণ্ডা, মানে পাঞ্জাবি পরা ছোটবাবু। আকাশে তারা নক্ষত্র চন্দ্র সব ঠিকমতো আলো দিচ্ছিল, একতলায় ঠিকমতোই পাহারা দিচ্ছিল নেপালি দারোয়ান। ছোটবাবুর মুখে মদের গন্ধ ছিল না, ছিল ফুলের গন্ধ, মাথার চুলে ফুলের গন্ধ, ছোটবাবুর হাতে ছোরা ছিল না, টাকা ছিল। ছোটবাবু চেঁচিয়ে বলেনি, ফিসফিস করে বলেছিল—কোনও কথা বলবি না, টাকা দেব। টাকা চাই না, ছেড়ে দিন বাবু, আমি বে-হয়ে যাওয়া বউ—ছোটবাবু ভদ্দর লোকের মতো আস্তে বলেছিল ‘নিকুচি করেছে’—তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত নক্ষত্র তারা আর চন্দ্রের আলো দেখতে পায়নি আলোমণি। আগের বার গু সরিয়ে খালের জলে চান করতে পেরেছিল, ছোটবাবু চলে যাবার পর স্নানও করতে পারল না, শুধু গুটলি পাকানো দু’টাকার নোটের উপর থুকথুক করে থুথু ছিটিয়ে শেষ পর্যন্ত রাত্তিরের দিকে খুঁটে বেঁধে নিয়েছিল।
যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল আলোমণি, কাছ দিয়ে দু’জন মানুষ চলে গেল, জোরে ডাকতে গিয়েও ডাকল না, চালের বস্তাটা আঁকড়ে ধরে রইল। তারপর ভাবল ডাকলে হয় এবং ডাকল, কিন্তু যত জোরে ডাকা উচিত ছিল তত জোরে ডাকতে না পারায় ওরা শুনতে পেল না।
ক্রমশ যন্ত্রণা বাড়তে লাগল। আলোমণির মনে হল এ নিশ্চয়ই গভ্ভ যন্তরনা, আট মাসে হয় কী করে? তবে কি হিসেবের ভুল, তবে কি ছোটবাবু? তবে কি পুলিশ? নাকি ছোরাহাতে গুণ্ডা, —নাকি—সোয়ামি গো, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো…
যন্ত্রণায় দু’ভাগ হয়ে যাবে মনে হল, পেটটা হাপরের মতো লাফাচ্ছে। আলোমণি একবার পাশ ফিরল, তারপর চিত হয়ে শুল, পা দুটো হাঁটুর কাছে বেঁকিয়ে নিতে একটু স্বস্তি বোধ হল।
আলোমণি শুয়ে থাকে, শুকনো মাটিতে ঘষে পায়ের গোড়ালি। হে ভগবান, আমার স্বামীকে একবারটি এনে দাও। ফড়িংরে ফড়িং, আমার স্বামীকে একবার খবর দিবি ফড়িং, আমার কচি আসছে, খোকা আসছে। গাংচিলের ডাকে আর দুঃখু নেই, আনন্দ! হঠাৎ-ওঠা ধুলোঝড়ে দুঃখু নেই, আনন্দ, আনন্দ! অশথপাতার ফাঁক দিয়ে চোয়ানো হলুদ রোদ্দুরে আনন্দ! কোথায় ফোটে বিকেলের মালতী রে, যোগিনী আশা?—কোথায় আছ শিবঠাকুর, আমার অশথতলায় আঁতুড়ঘরে এসো। কোথায় ভাঙছ ঢেঁকিতে চাল ঘরের বউ, এসো, একবারটি এসো গো। কোথায় গোবর দিচ্ছ ধাই মা, আমার খোকার কাছে এসো, গোরুর খুঁটো তুলতে বিকেল হলে যে আসবে, সে একবারটি আমার কাছে এসো।
আলোমণির নজরে পড়ে গাছের মরা ডালে শকুনেরা বসে আছে, আলোমণি আঁতকে ওঠে। আলোমণি একবার উঠে বসে, খালের ওপারে কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে, আলোমণির ইচ্ছে হয় নিশেন উড়িয়ে ডাকে। একবার চিৎকার করে ডাকে—এদিকে এসো না গো কেউ। হু হু করে মনখারাপের বাতাসে জোলো গন্ধ। বিকেল হল, কেউ কি আসবে না! বেহুলা মা, সাবিত্রী মা, কাউকে পাঠিয়ে মা গো, শকুন, শকুন ভাই, কাউকে পাঠিয়ে দে ভাই মাইরি, পাঠিয়ে দে ভাই। কোথায় যায় খালের জল, গঙ্গাসাগরে নাকি? কোথায় যায় বাতাস, কোথায় যায় গাংচিলের শব্দ? হায়রে। আমার খোকা। আসছে—ওকে আমি মিছরির জল খাওয়াব। সন্দেশখালির পাকা রাস্তায় দুটো তালের আঁটি পুঁতেছি আমি। এক পুরুষ রোয় আঁটি, পর পুরুষ খায় পরিপাটি। আমার খোকা খাবে তাল হলে, আমার খোকার হবে কলের গান, খোকা দেবে দই সন্দেশ—ওঃ আরতির ঢাকের শব্দ সারা শরীলে বাজে সারা শরীলে ঢং ঢং কাঁসর ঘন্টা সারা শরীলে শাঁখের আওয়াজ। ফড়িংরে ফড়িং, মাইরি যা না একবার উড়ে গিয়ে বলে আয়…
আলোমণি চোখ বন্ধ করে। আলোমণি জানে না তার শরীরের ভিতরে, শিরা-উপশিরায় আগমনীর সুরের মতো সেতারের সুরে সুরে তখন জটিল আলোড়নে, এক আশ্চর্য পরিবর্তন হয়ে চলেছে।
তার স্তনে দুধের প্রবাহ, বাৎসল্য স্নেহ মমতা রক্তের সঞ্চারণে সঞ্চারণে তরঙ্গিত হচ্ছে সারা শরীরে। এক মায়াবী সুড়ঙ্গপথে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে এক নতুন মানুষ। সে সন্তানের পিতা কে, তার সঠিক প্রমাণ নেই। আলোমণি তার মা, আলোমণির শ্রমে, স্বেদে, রক্তে, অভিমানে, স্নেহে তার জীবন প্রতিষ্ঠা। আলোমণির সারা শরীরে ঢাক বাজে।
দু’হাতে তালি মেরে মরা ডালে বসে থাকা শকুন তাড়ায় আলোমণি—যাঃ দূর যাঃ—
ভূমিসূত্র
রচনাকাল ১৯৭৫