শকুন্তলা নিধন
আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগেকার এক রাত।
১৯৮৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।
হাওড়ার বালি থানায় কাজ করছিলেন সাব—ইনস্পেক্টর বংশীধর মুখার্জি। তাঁর ডিউটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একটু পরেই রওনা দেবেন বাড়ি অভিমুখে। কাজও বিশেষ কিছু বাকি নেই। পেন্ডিং ফাইলগুলো তিনি ধীরেসুস্থে গুছিয়ে রাখছিলেন টেবিলে।
ঠিক এমনসময় থানার টেলিফোন বেজে উঠল ক্রি—রি—রিং শব্দে।
”হ্যালো, এ—এটা কি বালি থানা?”
”হ্যাঁ, বলুন?”
”স্যার, আপনারা স্টেশন রোডের ৮/৩ শ্রীচরণ সরণীর বাড়িতে এক্ষুনি চলে যান! ওদের বাড়ির বউকে ওরা খুন করেছে! দেরি করলেই লাশ কিন্তু সরিয়ে ফেলবে। শিগগিরই!”
বংশীধর মুখার্জি রিসিভারটাকে কানে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”আপনি কে কথা বলছেন? হ্যালো? হ্যালো?”
কিন্তু ফোন—টা ততক্ষণে পিঁ পিঁ শব্দ করে কেটে গেছে।
তখন থানায় থানায় কলার আইডেন্টিফায়ার লাগানো থাকত না। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যোগাযোগ করলে হয়তো জানা যেত কে ফোন করেছে, কিন্তু ওই কাজে বংশীধর মুখার্জি আর সময় নষ্ট করলেন না। তিনি তড়িঘড়ি ফোন করলেন অফিসার ইন চার্জ প্রিয়তোষ সরস্বতীকে।
”স্যার, একটা ফোন এসেছিল এক্ষুনি, বলছে শ্রীচরণ সরণীর একটা বাড়িতে নাকি …!”
প্রিয়তোষবাবু সব শুনেই ফোনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন, ”আমি এক্ষুনি আসছি। বংশীবাবু, আপনি কিরণশঙ্করকে বলুন কেসটা এন্ট্রি করতে।”
ওসি সাহেব এর কথামতো ইনস্পেক্টর কিরণশঙ্কর ঘোষ টেলিফোনে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে এন্ট্রি করলেন ডায়েরি নম্বর ৩৪৫ এফ।
সবাই মিলে প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলেন শ্রীচরণ সরণীতে। ওসি সাহেব প্রিয়তোষ সরস্বতী অন্যত্র কাজে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে তিনি সরাসরি এসে পৌঁছলেন অকুস্থলে।
সব এলাকাতেই পুলিশের নিজস্ব দু—একজন চর মোতায়েন করা থাকে। তারাই সব খবর পৌঁছে দেয় থানায়। এই পাড়ায় সেই চর হল অলোক। সে আরও কিছু স্থানীয় লোক জোগাড় করে পুলিশকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
”আসুন স্যার! এ—এইদিকে, হ্যাঁ, এই গলিতে আসুন …!”
৮/৩ শ্রীচরণ সরণীর বাড়ির কিছু আগে একটা রিকশা স্ট্যান্ড। ওসিসাহেবের নির্দেশে পুলিশের গাড়ি সেখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে সবাই নিঃশব্দে হেঁটে চললেন গন্তব্য অভিমুখে।
একটা দোতলা বাড়ির কাছাকাছি এসে অলোক ফিসফিস করল, ”স্যার, ওই বাড়িটা!”
বাড়িটার একতলায় একটা দোকান, সেখানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। প্রিয়তোষ চোখ সরু করে দেখলেন দোকানের বাইরে একটা লোক লুঙ্গি পরে বসে আছে।
ঘড়িতে রাত ন—টা। প্রিয়তোষ এগোনোর আগে অলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ”ওই লোকটা কে?”
”ওরই তো দোকান স্যার। দোতলায় পরিবার থাকে। ওর নাম ভরত পাণ্ডে। নীচের দোকানটা চুন ভুসির। ভরত পাণ্ডের দুই ছেলে। বড়ো বিনোদ ব্যাবসা করে, ছোটো স্কুলে পড়ে। বিনোদের আবার দুটো বউ স্যার, ওর মাটা হেব্বি দজ্জাল। ভরত পাণ্ডে লোক খারাপ না।” অলোক গড়গড়িয়ে বলে গেল।
তার মানে এই বাড়িতে শাশুড়িকে বাদ দিলে দুটো বউ আছে, তাও একই পুরুষের। প্রিয়তোষ মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ভরতের দোকানের দিকে।
ভরত ভাবলেশহীনভাবে দোকানের সামনের বেঞ্চটায় বসে ছিল। আকস্মিক পুলিশ দেখে যে তার মুখটা সাদা হয়ে গেল, তা এই অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারা গেল।
প্রিয়তোষ সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, ”এই বাড়িটা আপনার?”
”হ্যাঁ স্যার!” ভরত জবাব দিল।
”আমাদের কাছে খবর আছে, এই বাড়িতে একটা খুন করা হয়েছে। আপনি জানেন কিছু?” প্রিয়তোষ বললেন।
”খুন? না স্যার, খুনখারাপি কেন হবে! গৃহস্থ বাড়ি …!” ভরত প্রাণপণ হাসার চেষ্টা করল।
প্রিয়তোষ বললেন, ”আপনাদের বড়ো ছেলের নাম বিনোদ পাণ্ডে, তাই তো? সে কোথায়? তাকে ডাকুন।”
”বিনোদ তো বাড়ি নেই স্যার!”
”কোথায় গেছে?”
”তা জানি না।”
প্রিয়তোষ এবার বললেন, ”আমরা এই বাড়িটা তল্লাশি করব। আপনি ঘরগুলো দেখান।” কথাটা বলেই তিনি সঙ্গীসাথীদের কিছু নির্দেশ দিলেন ইশারায়।
ভরতের মুখটা ভয়ে এইটুকু হয়ে গেল, তবু সে কোনো দ্বিরুক্তি করল না। উঠে দাঁড়িয়ে পুলিশকে পথ দেখাতে শুরু করল।
একতলাটা দোকান এবং নানারকম মালপত্রে ঠাসা, সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না।
প্রিয়তোষ বললেন, ”দোতলায় চলুন। সিঁড়ি কোনদিকে?”
ভরতের পেছন পেছন প্রিয়তোষ আর সাব—ইনস্পেক্টর বংশীধর একসাথে সিঁড়িতে উঠতে গিয়েও পারলেন না। সিঁড়িটা এত সরু, একজনকেই কষ্টে সৃষ্টে উঠতে হবে।
আসার পর থেকে উচ্চকণ্ঠে কেউ কথা না বলায় পুলিশের এই সহসা আগমনবার্তা দোতলার বাসিন্দাদের কানে পৌঁছোয়নি।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই একটা খোলা বারান্দা, সেই বারান্দায় আলো—আঁধারির মধ্যে দু—জন মহিলা নিশ্চিন্তমনে একটা চটের বস্তার মধ্যে কিছু জিনিসপত্র ঢোকাচ্ছিল।
আচমকা পুলিশ এবং লোকজন দেখে কী করবে বুঝতে না—পেরে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বংশীধর একটুও সময় নষ্ট করলেন না, ওসিসাহেব প্রিয়তোষের অনুমতির অপেক্ষা না—করেই ত্বরিতগতিতে এগিয়ে গিয়ে জোরালো টর্চ ফেললেন বস্তার মধ্যে। ইনস্পেক্টর কিরণশঙ্কর এগিয়ে গিয়ে সুইচবোর্ডের সব কটা সুইচ অন করলেন।
বস্তার মধ্যে পাওয়া গেল একটা খণ্ডবিখণ্ড পোড়া শাড়ি। দুই মহিলার হাতেও ছোটো ছোটো পোড়া বস্ত্রখণ্ড। দু—জনেরই মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।
প্রিয়তোষ ভরতের দিকে তাকাল, ”এঁরা কে হয় আপনার?”
ভরত তুতলে বলল, ”আজ্ঞে স্যার, ইনি আমার স্ত্রী রাজরানি; আর ও আমার ছেলে বিনয়ের বউ, মধুবালা।”
প্রিয়তোষ বললেন, ”আপনার ছেলের তো দুটো বউ। ইনি কোনজন?”
”আজ্ঞে, এ ছোটোবহু আছে আমাদের।” ভয়ে ভরতের মুখ দিয়ে দেশের দেহাতি ভাষা বেরিয়ে এল।
”বড়ো বউ কোথায়?” কড়াসুরে ধমকে উঠলেন প্রিয়তোষ।
ভরত মৃদুস্বরে কী বিড়বিড় করল ঠিক শোনা গেল না। তবে উত্তর মিলল একটু পরেই।
বারান্দায় একদিকে পর পর তিনটে ঘর। না, তিনটে না—তো, প্রিয়তোষ ভালো করে উঁকি মেরে দেখলেন, আরও একটা ঘুপচি মতো ঘর আছে একদম শেষে। তিনি অধস্তনদের নির্দেশ দিলেন, ”সার্চ করো সব কটা রুম।”
তিনটে ঘরেই আলো জ্বলছে। তৃতীয় ঘরটা থেকে তারস্বরে ভেসে আসছে হিন্দি গানের চটুল সুর।
প্রিয়তোষ ভরতের দিকে তাকাতেই ভরত কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”আমার ছোটো ছেলে মনোজ স্যার। ও খুব গানবাজনা ভালোবাসে।”
”তা সে গানবাজনা ভালোবাসুক না, গানবাজনা ভালোবাসা কোনো খারাপ জিনিস নয়।” কথাটা বলেই প্রিয়তোষ সরাসরি ভরতের স্ত্রী রাজরানির দিকে তাকালেন, ”আপনি এগুলো কী পুরছেন বস্তাতে?”
রাজরানি মধ্যবয়স্কা দেহাতি রমণী। তার শাণিত জিভ আর মেজাজের কথা সারা পাড়ায় সুবিদিত। মনে মনে ভড়কে গেলেও সে পুলিশের সামনে বেশ সপ্রতিভভাবে বলল, ”আসলে রান্নাঘরের পুরোনো ন্যাকড়া সাব, তাই পুড়িয়ে দিচ্ছিলাম।”
”তাই?” বলতে বলতে প্রিয়তোষ এগিয়ে গেলেন তিনটে ঘর পেরিয়ে শেষের ঘরটার দিকে। এই ঘরটা অন্ধকার, বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
”এই ঘরটা বন্ধ কেন?” প্রিয়তোষ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, ”শিগগিরই চাবি আনুন।”
ততক্ষণে বাকি তিনটে ঘর পুলিশের থানাতল্লাশি শেষ, বিনোদের ছোটো ভাই মনোজের সংগীতচর্চায় বাঁধা পড়ায় সে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। বিনোদের দ্বিতীয়া স্ত্রী মধুবালা আর মা রাজরানি বস্তাটাকে পুলিশের চোখের আড়াল করার চেষ্টা করছিল, এমন সময় এই ছোটোঘরটার তালা খুলতে বলাতে সবাই যেন দিশেহারা হয়ে গেল।
এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।
”কী হল? শুনতে পাচ্ছেন না?” প্রিয়তোষ তাড়া দিলেন, ”চাবিটা আনুন, ক্যুইক!”
রাজরানি তার সিন্থেটিকের ঝলমলে শাড়ি সামলে হঠাৎ এগিয়ে এল। এসে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগল, ”হে হে সাব, ওইঘরটা তো আমরা খুলি না, চাবিটা যে কোথায় হারিয়ে …।”
প্রিয়তোষ আর দ্বিরুক্তি করলেন না। ততক্ষণে তাঁর ইনটিউশন মস্তিষ্কে অন্যকিছু সংকেত পাঠাচ্ছে।
তালাটা ভাঙতে মিনিটতিনেকের বেশি লাগল না। হুড়মুড়িয়ে সবাই ঘরে ঢুকতেই অকস্মাৎ তীব্র সস্তা পারফিউমের গন্ধে সবার নাক—মুখ বন্ধ হয়ে এল।
ইনস্পেক্টর কিরণশঙ্কর ঘোষ হাতড়ে হাতড়ে ঘরের আলোটা জ্বালতেই দেখা গেল, ঘরটার একদম সামনে আড়াআড়ি একটা দড়ি টাঙানো। আর সেই দড়িতে টানটান ভাবে মেলা রয়েছে একটা শাড়ি, এমনভাবে যাতে শাড়ির ওপারে কী আছে তা দেখা না—যায়।
প্রিয়তোষ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে শাড়িটা টান মেরে সরাতেই চোখে পড়ল একটা ছোটো খাট। তার উপরের তোষকটা জায়গায় জায়গায় পোড়া। চৌকিদার চারপাশে টাঙানো রয়েছে একটা জ্যালজেলে মশারি।
বংশীধর অস্ফুটে বলে উঠলেন, ”স্যার, ওই দেখুন চৌকির ওপরটা …!”
প্রিয়তোষ মশারিটা তুলতেই সামনের নারকীয় দৃশ্যটা উন্মোচিত হয়ে পড়ল সবার কাছে।
শাড়ির আড়ালে, মশারির ভেতরে চৌকির ওপর পড়ে রয়েছে একটা পোড়া পচে গলে যাওয়া মৃতদেহ! মাংস মধ্যে মধ্যে গলে গেলেও চামড়াটা যে বীভৎস পোড়া তা বোঝা যায় বিলক্ষণ।
লম্বা চুলসমেত মাথাটা এলিয়ে রয়েছে একদিকে।
লাশটার ওপর বাজারচলতি পাউডারের পুরু স্তর, তার ওপর সেখান থেকে ভেসে আসছে উগ্র পারফিউমের গন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে, গ্যালন গ্যালন সেন্ট আর পাউডার ঢালা হয়েছে মৃতদেহর গন্ধ চাপা দেওয়ার জন্য।
এই হল বালির অভাগি মাত্র তেইশ বছরের গৃহবধূ শকুন্তলা পাণ্ডের মর্মান্তিক হত্যার সারমর্ম। হিন্দুস্থান পার্কের অভিজাত বণিকবাড়ির বধূ দেবযানী বণিক হত্যার পরে পরেই হাওড়ায় খুন হয়েছিল শকুন্তলা। কিন্তু ধনী পরিবারের দেবযানী বণিক হত্যা মামলা তার বাবার অর্থের জোরেই হোক বা যেকোনো কারণে, যেমন সাড়া ফেলেছিল জনতার মধ্যে, ততটা গরিব ঘরের মেয়ে শকুন্তলা ফেলতে পারেনি।
যদিও তার পরিণতিও কিছু কম নিষ্ঠুর ছিল না।
কেন মাত্র তেইশ বছর বয়সে খুন হতে হয়েছিল শকুন্তলাকে? আসুন দেখে নিই।
এই ঘটনার চারবছর আগে, ১৯৮২ সালে হাওড়ার বালির ভরত পাণ্ডের বড়ো ছেলে বিনোদ পাণ্ডের সাথে বিয়ে হয় বিহারের গোপালগঞ্জের শিউপ্রসাদ সিংহের কন্যা শকুন্তলার।
শকুন্তলার বাবা শিউপ্রসাদের অবস্থা একদমই ভালো ছিল না। বিনোদদের বাড়ির আশানুরূপ ‘দহেজ’ দেওয়ার ক্ষমতাও তার ছিল না। তবু বিয়েটা হল। কারণ ছেলের বাবা ভরত পাণ্ডের শকুন্তলাকে ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।
উনিশ বছরের শান্তশিষ্ট কোমল স্বভাবা শকুন্তলার মতো মেয়েরা তো চিরকালই শ্বশুরবাড়ির মাপকাঠিতে প্রাথমিকভাবে বেশ উঁচু নম্বর পায়, যদিও পরে কাঞ্চনলোভের আশায় সেই লক্ষ্মীকে পুড়িয়ে মারতে এদের দ্বিধা হয় না।
যাইহোক, ভরতের ইচ্ছায় বিয়েটা হলেও শাশুড়ি রাজরানি একটুও খুশি হতে পারল না। এই সংসারের আসল হর্তাকর্তা রাজরানি। তার দাপটে স্বামী ভরত থেকে শুরু করে ছেলে বিনোদ আর মনোজ কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারে না।
স্বামী একেবারে বিয়ের কথা দিয়ে চলে আসায় রাজরানি তো গালমন্দ অভিশাপ কিচ্ছু দিতে ছাড়ল না স্বামীকে, তারপর বউ আসতে সব রাগ গিয়ে পড়ল শকুন্তলার ওপর।
”কবে থেকে ভেবে এসেছিলাম, বিনোদের পয়সাওলা ঘরে বিয়ে দেব, শ্বশুরের দেওয়া দহেজেই আমাদের বাড়ি ভরে যাবে; তা—না কোত্থেকে একটা হাভাতের মেয়ে এসে জুটল!” শকুন্তলার হাত থেকে লালচোখে চা জলখাবার নিয়ে স্বামীকে গঞ্জনা দেয় বসে বসে রাজরানি, ”সব তোমার বোকামির জন্য। বিয়ের পর থেকে একটা দিনও তুমি শান্তি দিলে না!”
শকুন্তলা মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওর এখন অনেক কাজ। বাসন মাজা, ঘর মোছা, রান্না করা। এইসব কথা ওর আস্তে আস্তে সয়ে যাচ্ছে।
ভরত চায়ে চুমুক দিয়ে মিনমিন করে, ”কেন মেয়েটা তো ভালোই! সাত চড়ে রা কাড়ে না, শান্তশিষ্ট। সবই তো করছে ঘরের!”
”থামো!” স্বামীকে ঝঙ্কার দেয় রাজরানি, ”শান্তশিষ্ট! হুহ! অমন শান্তশিষ্ট ভিখিরির মেয়ে বড়োলোক বাড়িতে মানায়, এখানে নয়। শান্তশিষ্ট ন্যাতপেতে মেয়ে কি অত খাটতে পারবে? শক্তপোক্ত মেয়ে হলে আরও বেশি কাজ করতে পারত! আর তুমি কিনা এখনও মুখে মুখে তর্ক করছো? তোমার জন্য আজ ছেলেটার এই হাল হল। বেচারা কত কী লিস্টি করে রেখেছিল বিয়েতে নেবে বলে।’
অতঃপর শুরু হল শকুন্তলার নরক জীবন। বিহারের গ্রামে সে কিছুদূর লেখাপড়া করেছিল, মনে মনে আর কিছু না—হোক স্বপ্ন দেখেছিল ন্যুনতম সম্মান সে পাবে শ্বশুরবাড়িতে।
কিন্তু বিধাতা তার জন্য অন্য কিছু স্থির করে রেখেছিলেন। রাজরানির রক্তচক্ষুর ওপর ওকে উঠতে—বসতে হত। পান থেকে চুন খসলে রাজরানি অকথ্য গালিগালাজ, সঙ্গে মারধোর করতেও ছাড়ত না। শ্বশুর, স্বামী, দেওর—সবাই মূক হয়ে যেত তখন।
রাজরানি ছেলে বিনোদকে পরিষ্কার বলে দিল, ”ওর সাথে শোওয়া তো দূর, যদি কথা বলতেও কখনো দেখি, বাড়ি থেকে তোকে তাড়িয়েই ছাড়ব মনে থাকে যেন!”
বিনোদ তৈরি ছেলে। নানারকম নেশা থেকে শুরু করে খারাপ পাড়া—সবেতেই তার অবাধ যাতায়াত। বউকে স্পর্শ করতে না—দিলে তার খুব একটা কিছু যাবে আসবে না। শকুন্তলা আজ মাংসটা বেড়ে রেঁধেছিল, একটা বিশাল ঢেঁকুর তুলে ও বলল, ”সে ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা?”
”আমি নতুন বউ আনব। ক—দিন সবুর কর।” রাজরানি কথাটা বলেই বারান্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ”এই হতচ্ছাড়ি, তোকে যে বললাম এঁটোকাঁটাগুলো বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে, কুকুরগুলো খাবে, তুই কি করছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”
শকুন্তলা থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নামতে লাগল। খাসির মাংস তার খুব প্রিয়, ছোটোবেলা থেকে মাত্র তিন—চার বার খেয়েছিল; তবু এমন সুন্দর রাঁধতে পারে সে সবাই খেয়ে ধন্য ধন্য করে।
বিয়ের আগে শেষবারের মতো ওর বাবা ওকে মাংস খাইয়েছিল, সেটা মনে পড়তেই ওর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আজ রান্নার সময় রাজরানি কড়া নজর রেখেছিল, ভুলেও যেন ও একটুও খেতে না—পারে। এখন একটু আলু ঝোল ও লুকিয়ে রেখেছিল, ভেবেছিল স্বাদটা অন্তত পাবে, কিন্তু শাশুড়ি তাও দেখে ফেলল।
কষ্টে—দুঃখে ওর বুকের ভেতরটা দলা পাকিয়ে গেল। ওর স্থান এই বাড়িতে কুকুরের থেকেও নীচে। একটা বিনাপয়সার দাসী ও, এ ছাড়া কিচ্ছু নয়। বাবা যতবার এসেছে, রাজরানি কড়া দৃষ্টি রেখেছে ও যাতে কিছু না বলতে পারে। তবু তো আকারে ইঙ্গিতে ও বাবাকে বুঝিয়েছে, ”আমি ভালো নেই বাবা!”
কিন্তু বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে ”মানিয়ে নে মা একটু!” বলে মেয়ের শ্বশুরালয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে গেছে।
ওর সবচেয়ে কষ্ট হয়, স্বামী বিনোদও ওর সাথে এমনই ব্যবহার করে। ভালোবাসা তো দূর, সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ওর শোয়ার জায়গা হয় বাইরের বারান্দায়।
কী দোষ করেছে ও? যে যা বলে ও তো সবই করে দেয়; তবু সবার ওর ওপর এত রাগ কেন? শুধু ওর বাবা বিয়েতে কিছু দিতে পারেনি বলে?
রাজরানি বেশি দেরি করল না। শকুন্তলাকে বউ করে বাড়িতে আনার ঠিক দু—বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে বিনোদের দ্বিতীয় বিবাহ দিয়ে নিয়ে এল মধুবালাকে।
এবার আর হিসাবে কোনো ভুলচুক হয়নি। মধুবালা পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে, যৌতুকে ভরে উঠল ঘর। শকুন্তলা চিরকালের মতো পরিণত হল বাড়ির বিনাপয়সার দাসীতে।
ভরত দু—একবার আপত্তি করতে গিয়েছিল, ”দুটো বিয়ে কিন্তু এখন আইনত অপরাধ, তা ছাড়া শকুন্তলা মেয়েটা তো খুবই ভালো …!”
”চুপ করো তুমি!” রণচণ্ডীনি রাজরানি দাবিয়ে দিয়েছিল স্বামীকে, ”ভালো! হু! না আছে টাকা, না হল বাচ্চাকাচ্চা! একটা বাঁজা মাগির তুমি আবার সুখ্যাতি করছো!”
”বাচ্চা হবে কী করে? তুমি তো …!” ভরত আর কথা শেষ করতে পারে না, রাজরানির চোখ দেখে চুপ করে যায়।
শকুন্তলার দিন শুরু হত সূর্য ওঠার আগে। ছাদ পরিষ্কার করে, সারা বাড়ি মুছে নিয়ে সকলের ঘরে ঘরে চা পৌঁছে দেয়। তারপর সারা বাড়ির লোকের জামাকাপড় কেচে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। বাড়িতে কোনো ঠিকে কাজের লোক রাখার মতো অপচয় রাজরানি করেনি, কাজেই শকুন্তলাকেই সব করতে হত।
বিনোদের দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালা এমনিতেই ধনীর কন্যা, তার ওপর সে বুঝে গিয়েছিল, রাজরানিকে খুশি করে চলতে পারলে এই সংসারে তার রাজত্ব পাকা। আর সতিনকে কেই—বা কবে ভালোবেসেছে, মধুবালাও শাশুড়ির সাথে হাতে হাত মেলাল।
ওদিকে বিনোদ নতুন বউ পেয়ে খুব খুশি। সারাদিন সংসারে খেটে খেটে গায়েগতরে কালি পড়ে যাওয়া শকুন্তলাকে সে আর সহ্য করতে পারছিল না। একদিন চায়ে চিনি বেশি দেওয়ার মতো একটা সামান্য কারণে সে জোরে লাঠি কশিয়ে দিল শকুন্তলার গায়ে।
শকুন্তলা রোজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দার রেলিং—এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত, তবু ঘুমতে পারত না।
সে কি সহ্য করতে করতে পাথর হয়ে গিয়েছিল? কে জানে!
শকুন্তলাকে উদয়াস্ত খাটিয়েও রাজরানির শান্তি হয়নি। মাঝেমাঝে সে শকুন্তলাকে চাপ দিত দেশে যে একফালি জমি শকুন্তলার বাবার আছে, সেটা বিক্রি করে টাকা পাঠাতে।
শকুন্তলা মুখ বুজে মার খেত, কিন্তু বাবাকে কিচ্ছু জানাত না।
অবশেষে একদিন এই নিয়ে তর্ক হতে হতে রাজরানি আর বিনোদ গলা টিপে খুন করল শকুন্তলাকে। রাগের মাথায় খুন, শকুন্তলা এমনিই আধপেটা খেয়ে খেয়ে আর অমানুষিক খেটে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, রাজরানি আর বিনোদকে বেশি পরিশ্রম করতে হল না।
কিন্তু শকুন্তলা মরে যাওয়ার পরেই সবাই ভাবতে লাগল, তাই তো! এখন লাশ নিয়ে কী করা যায়!”
ছোটোবউ মধুবালা বুদ্ধি দিল, ”এক কাজ করলেই তো হয়। কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দাও। তাহলে বলবে রান্না করছিল, স্টোভ ফেটে পুড়ে গিয়েছিল।”
পুলিশ যেদিন রাতে টেলিফোন পেয়ে বাড়ি তল্লাশি করতে এসেছিল, সেদিন আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ঠিক হয়েছিল পোড়া লাশটাকে বিচালি দিয়ে ঢেকে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু তা আর হল না।
যথাসময়ে কেস উঠল হাওড়ার দায়রা আদালতে। বিচারপতি ছিলেন দায়রা জজ পি কে সেন। পাবলিক প্রসিকিউটর চিন্ময় চৌধুরী। একটা নিষ্পাপ গৃহবধূকে টাকার লালসায় এমন নৃশংসভাবে খুন, লোক ভেঙে পড়ল আদালতে।
ঘটনাচক্রে যেদিন রাতে পুলিশ বাড়ি গিয়ে শকুন্তলার মৃতদেহ উদ্ধার করে, সেদিন রাতেই এসে পৌঁছেছিল শকুন্তলার বাবা শিউচরণ। সে মেয়ের পাঠানো একটা চিঠি পেয়ে আর থাকতে পারেনি, ছুটে এসেছে হাওড়ায়। মেয়ের পোড়া মৃতদেহ দেখে সে ভেঙে পড়ল কান্নায়।
এদিকে বিনোদ পাণ্ডে নিখোঁজ। ওসি প্রিয়তোষ মৃতদেহের সুরতহল রিপোর্ট তৈরির জন্য পাঠিয়ে দিলেন পোস্ট মর্টেমে, পোস্ট মর্টেম করলেন ড গোপিকারঞ্জন চক্রবর্তী।
সেই রিপোর্টে প্রকাশ পেল, শকুন্তলাকে প্রথমে হত্যা করা হয় গলায় ফাঁস লাগিয়ে। ঠোঁটে ছিল জখমের দাগ, দু—পায়ে মারের চিহ্ন।
পুলিশ তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করল রাজরানি, মধুবালা, ভরত আর মনোজকে। মনোজ তখনও নাবালক, কিন্তু যে দেওর পাশের ঘরে বউদির লাশ রাখা হয়েছে জেনেও বেমালুম গান শুনতে পারে, সে কেমন নাবালক কে জানে!
প্রায় দু—মাস পালিয়ে পালিয়ে থাকার পর ১৯৮৬ সালের ২১ নভেম্বর হাওড়ার বিচারবিভাগীয় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিল বিনোদ।
সাব—ইনস্পেক্টর বংশীধর মুখার্জি তাঁর জীবনের সেরা কাজ করেছিলেন এই তদন্তে। মাত্র দু—মাসের মধ্যে সমস্ত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট জমা দিয়েছিলেন তিনি ২৮ নভেম্বর। এত চমকপ্রদ মামলার চার্জশিট এত অল্প সময়ের মধ্যে দেখা যায় না।
শকুন্তলা মরে গেলেও তার বাবাকে লিখে যাওয়া হিন্দিতে দুটো চিঠিই যথেষ্ট ছিল। প্রতিটা চিঠির পরতে পরতে লেখা ছিল কী অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল তাকে।
হাওড়া কোর্টের আইনজীবী শিবশংকর সাউ সেই চিঠিগুলি বাংলায় অনুবাদ করে আদালতে পেশ করেছিলেন।
”বাবা, আমার মতো দুর্ভাগ্য নিয়ে বোধ হয় কেউ কোনোদিন পৃথিবীতে আসেনি। শাশুড়িমা সবসময় আমাকে যা—তা বলেন, গায়ে হাত তোলেন। কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলে না বাবা … সেদিন ওইটুকু ছেলে মনোজ, সেও তার জামা ঠিকমতো কাচা হয়নি বলে গরম চা ছুঁড়ে মারল আমার দিকে … আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে নিয়ে যাও বাবা … আমি জানি না পুজো অবধি আমি বেঁচে থাকব কি না! আমি এখানে একাই সব কাজ করি, তবুও দিন রাত গালমন্দ মার খেতে হয়। আমাকে না—নিয়ে গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে …!”
ভারতীয় সমাজে আজও কিছু কিছু পরিবারে মেয়েদের অবস্থান যে কী, তা এই চিঠি পড়ে বোঝা যায়। চোখ জলে ভরে আসে না, বরং রাগে শরীর গরম হয়ে ওঠে, যখন দেখি এত কিছুর পরেও বাবা—মা সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েকে স্তোক দিচ্ছেন, ”মানিয়ে নে।”
শকুন্তলার গ্রামের বাড়িতে তার দাদার বউ ছিল তার দিদির মতো। সেই বউদিকেও শকুন্তলা লিখছে,
”ভাবি, আগেই জানতে পেরেছ আমার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। শাশুড়ি আমাকে ডাইনি মেয়েছেলে বলে দিন রাত গাল দিচ্ছে। আমাকে সারাদিন এঁরা ঝিয়ের মতো খাটায় ভাবি। তোমাদের কথা ভাবলে কষ্ট হয়, আমাকে এত কষ্ট করে বিয়ে দিয়েও তোমরা শান্তি পেলে না …সতিন আর শ্বাশুড়ির অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখায় জানো ভাবি … আমাকে পেটভরে খেতে দেয় না, তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তবু তোমরা এসো না, এলে ওরা অপমান করবে। তোমাকে কোনোদিনও ভুলব না ভাবি, মা ছিল না বলে তুমি আমাকে মায়ের মতো ভালোবেসেছ। আমার জন্য তুমি আর ভেব না, মনে কোরো তোমার কোনো ননদ ছিল না, ভাইয়াকে বোলো তার বোন হারিয়ে গেছে। আমি অত্যাচারে পাথর হয়ে গেছি … ওরা ভাবছে অত্যাচার না সইতে পেরে আমি আত্মহত্যা করব, কিন্তু আত্মহত্যা করারও মনোবল আমি হারিয়ে ফেলেছি … এই হয়তো আমার শেষ চিঠি ভাবি। ভালো থেকো।”
শকুন্তলার ওপর এই নির্মম অত্যাচার পাড়ার সবাই জানত।
সবাই আদালতে এল এই পাশবিক পরিবারকে শাস্তি দিতে। ৮/১ শ্রীচরণ সরণীর শঙ্কর রুস্তেগি বলল, ”বউটার ওপর ওরা খুব অত্যাচার করত হুজুর! আমি অনেক বার গিয়ে বাঁচিয়েছি। বিনোদ প্রায়ই মারত ওকে।”
রাজরানি, মধুবালা, বিনোদ যতই বলুক, স্টোভ ফেটে শকুন্তলার মৃত্যু হয়েছে, আদালতে এই অজুহাত ধোপে টিকল না। ঘটনাস্থলে কোনো স্টোভ ছিল না। তা ছাড়া মেডিক্যাল জুরিস প্রুডেন্সে স্পষ্ট লেখা ছিল, শকুন্তলার গলার হাড় ভাঙা ছিল এমনভাবে যে অন্য কোনো ব্যক্তি চাপ না—দিলে সেই হাড় ভাঙা সম্ভব নয়।
দায়রা আদালত বেশি দেরি করলেন না, ভরত পাণ্ডেকে দিলেন চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। রাজরানি আর মধুবালাকে দেওয়া হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর মূল অপরাধী বিনোদ, যে কিনা শকুন্তলার স্বামী, যার কিনা শকুন্তলার দেখভাল করার কথা, তার এমন অপরাধে দেওয়া হল ফাঁসির সাজা।
মধুবালার বাবা ছিল পয়সাওয়ালা, সে মেয়ে ও মেয়ের শ্বশুরবাড়িকে বাঁচাতে আপিল করল হাইকোর্টে।
মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিল ১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর।
ততদিনে মধুবালার কোলে সন্তান এসেছে। তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে জজ বিনোদের ফাঁসির সাজা মকুব করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে, রাজরানির কোনো অনুতাপের চিহ্ন ছিল না। তাকে দেখতে আদালতে ভিড় হলে সে অশ্রাব্য ভাষায় লোককে গালিগালাজ করত, থুতু দিত। খোদ বিচারক পর্যন্ত তাদের অনুশোচনাহীন ব্যবহারে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
তবে কে যে সেদিন থানায় ফোন করে খবর দিয়েছিল, তা কিছুতেই জানা যায়নি।
বিনোদ পাণ্ডে হয়তো এখনও জেল খাটছে, কিন্তু যে নিরপরাধ মেয়েটাকে চলে যেতে হয়েছিল মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তার কী অপরাধ ছিল?
আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়, গৃহবধূ ঘরের লক্ষ্মী। তাকে সম্মান না—দিলে ঘর তাসের ঘরে পরিণত হয়। অথচ এই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারক সখেদে বলেছিলেন, “That the instance of bride killing is alarmingly on the increase and society to be ridden of this deep seated malady!”
সেই ঘটনার পর কেটে গেছে বত্রিশ বছর।
তবু আজও এভাবেই মরে যেতে হয় যাদবপুরের মিতা বা বারাসতের পায়েলকে। তবু আজও অনেক বাবা—মা মেয়ের লেখাপড়ার চেয়ে বিয়ের জন্য টাকা জমাতেই বেশি পছন্দ করেন।
মেয়েদের আসলে লক্ষ্মী হওয়ার চেয়েও সরস্বতী হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন যাতে সুশিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সে স্বাবলম্বী হতে পারে। যাতে প্রয়োজনে গর্জে উঠতে পারে, অন্যকে খুশি করার চেয়েও নিজে খুশি থাকতে পারে। আত্মসম্মানের সাথে!