1 of 2

শকুনির ছক

শকুনির ছক

আনন্দ সান্যাল একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বসেছিলেন। নিজের সিগারেট-লাইটারটা দশ আঙুলে নাড়াচাড়া করছিলেন। আচমকা মুখ তুলে তাকালেন আশিস চৌধুরীর দিকে—অধৈর্যভাবে বললেন, ‘আশিস, কিছু একটা বল।’

উত্তরে হাসলেন আশিস চৌধুরী: ‘এতটা অধৈর্য হোস না, আনন্দ। আমি বোধহয় কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।’

আশিস চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল নন্দন, নন্দন দেবনাথ।

সাদরে আহ্বান জানালেন আশিস চৌধুরী, ‘এই যে নন্দন, এসো—। আনন্দ আজ একটা নতুন ধাঁধা এনেছে আমাদের জন্যে।’

‘খুবই আনন্দের কথা আনন্দবাবু।’ পরিহাস তরল কণ্ঠে বলল দেবনাথ, ‘সাংঘাতিক কঠিন কিছু নিশ্চয়ই নয়?’

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল দেবনাথ।

‘আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন,’ গম্ভীর গলায় জানালেন আনন্দ সান্যাল, ‘এখন—।’

‘আশিসদা ভরসা।’ বললেন দেবনাথ, ‘কিন্তু আশিসদা, আগে এককাপ করে চা হয়ে যাক।’

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল মোতি চৌধুরী।

‘মোতি, আর-এককাপ,’ বললেন আশিস চৌধুরী, ‘আমাদের মিথ্যান্বেষীর জন্যে।’

কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল সবাই তৈরি হয়ে বসেছেন। মোতি চৌধুরীও একপাশে বসেছেন নতুন ধাঁধা শোনার জন্য।

‘আবার কেঁচে গণ্ডূষ কর, আনন্দ—শ্রোতা আরও দুজন বেড়ে গেল।’ এ-কথা বলে পাইপ ধরালেন আশিস চৌধুরী।

আনন্দ সান্যাল গুছিয়ে বসলেন। পুরো ব্যাপারটা মনে-মনে সাজানোর চেষ্টা করলেন। তারপর ধীরে-ধীরে শুরু করলেন, ‘আশিস, আমি পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে বলছি…।

‘করঞ্জাক্ষ বোস গত মাসের ১৭ তারিখে মারা যান। আপাতদৃষ্টিতে হার্ট ফেলিয়োর কেস বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ওঁর ভাই, ডক্টর নলিনাক্ষ বোস সন্দেহ করায় ডেডবডি পোস্টমর্টেম করা হয়। তাতে জানা যায় যে, ওঁর মৃত্যুর কারণ মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড। এই পদার্থটি যদি একগ্রেন পরিমাণ কারও পেটে যায়, তবে তার যমালয়ে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। করঞ্জাক্ষ বোসের বডি পোস্টমর্টেম করে প্রায় দু-গ্রেন মরফিন পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে পুলিশ মিস্টার বোসের একমাত্র মেয়ে অমিতা বোসকে অ্যারেস্ট করে। ওঁর এগেইনস্টে যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলো নাকি মারাত্মক।

‘করঞ্জাক্ষ বোসের স্ত্রী, শ্রীমতী অণিমা বোস, খুবই ভেঙে পড়েছেন। করঞ্জাক্ষ বোসের বাড়িতে ওঁর স্ত্রী ও মেয়ে ছাড়া আর থাকেন ওঁর ভাই নলিনাক্ষ বোস আর এক ভাগ্নে সুকর্ণ রায়। ওর মা-বাবা নেই। আমি তদন্তে নেমে যেসব তথ্য আর প্রমাণ জোগাড় করেছি তা থেকে অমিতা বোসের ফেবারে কিছুই পাওয়া যায়নি।

‘করঞ্জাক্ষ বোস পয়সাওয়ালা। মাঝবয়েসি। কলকাতায় তার বসতবাড়ি ছাড়া আরও দু-তিনটে বাড়ি আছে। নিজের বসতবাড়িটিকে তিনি মন-প্রাণ ঢেলে সাজিয়েছেন। বাড়িতে ঢুকতেই গেটের কাছে বাঁ-দিকে একটি সুন্দর গোপাল গাছ লতিয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বাড়ির ভেতরে কম্পাউন্ডে একটা বাগান মতো আছে। সেটা নানান সিজন ফ্লাওয়ার সাজানো। কিন্তু সৌন্দর্যের পূজারি হওয়া সত্ত্বেও করঞ্জাক্ষ বোস চরিত্রহীন, মাতাল ছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি ওয়াইফের ওপরে অকথ্য টরচার করেছেন।

‘এমনকী বাধা দিতে এলে মেয়ে অমিতাকেও আঘাত করতে ছাড়েননি। এহেন ব্যক্তির মৃত্যুতে একমাত্র অণিমা দেবী ছাড়া কেউই ঠিক দুঃখিত নন। তবু সকলেই জানতে চান যে, করুণার পাত্র এই করঞ্জাক্ষ বোসকে খুন করল কে?

‘নলিনাক্ষ বোস ডাক্তার, বিয়ে করেননি, কোনওদিন কারো সাতে-পাঁচে নাক গলাননি। ভাইকে একদম পছন্দ না করলেও মুখ ফুটে সেকথা প্রকাশ করতেন না। কারণ, হাজার হলেও ভাইয়ের বাড়িতেই আছেন। সুকর্ণ রায় সত্যি-সত্যিই একজন ”গুড বয়”। মেডিকেল কলেজে পড়ে। ক্লাসে বরাবর স্ট্যান্ড করে। স্বভাব-চরিত্র ধোয়া তুলসীপাতা। মামার থেকে মামিকে বোধহয় একটু বেশি পছন্দ করে। অত্যন্ত আদর্শবাদী যুবক।

‘অমিতা বোস একটু যে অদ্ভুত ধরনের মেয়ে তাতে সন্দেহ নেই। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর আর পড়াশোনা করেননি। বাড়ির কাজকর্ম করে সময় কাটান। রীতিমতো সুন্দরী। গত মাসের ২২ তারিখে, অর্থাৎ খুনের পাঁচদিন পরে, ওঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার নিজের সাফাইয়ে একটা কথাও তিনি এ পর্যন্ত বলেননি। কিন্তু আমার ইনট্যুইশন বলছে যে, অমিতা দেবী নির্দোষ, তিনি খুন করেননি।’

এইখানে আনন্দ সান্যালকে বাধা দিলেন আশিস চৌধুরী, বললেন, ‘তার মানে, তুই বলতে চাইছিস যে, অমিতা বোস কাউকে শিল্ড করছেন?’

‘এক্স্যাক্টলি তাই—’ বললেন আনন্দ সান্যাল, ‘নয়তো সে আমাদের একটা কথারও অন্তত প্রতিবাদ করত। আমরা তাকে যা-যা বলেছি, সবই সে মেনে নিয়েছে কী কারণে? হোয়াই?’

‘ঠিক আছে, তারপর থেকে বলে যা—।’

‘হ্যাঁ বলছি,’ আবার শুরু করলেন আনন্দ সান্যাল, ‘১৭ তারিখ বিকেলে খাবার টেবিলে হাজির ছিলেন করঞ্জাক্ষ বোস, অমিতা বোস, সুকর্ণ রায় আর নলিনাক্ষ বোস। অণিমা বোস সেইসময় ঠাকুরঘরে ছিলেন। অমিতা দেবী সকলের জন্যে স্যান্ডউইচ তৈরি করে রান্নাঘরে রেখে মা-কে ডাকতে ঠাকুরঘরে যান। অণিমা বোস মেয়েকে বলেন যে, ওঁর যেতে একটু দেরি হবে। ওখান থেকে মিস বোস গাছে জল দিতে বাগানে যান। প্রায় মিনিটকুড়ি পর তিনি রান্নাঘরে ফিরে যান। গিয়ে দেখেন রান্নাঘরে স্যান্ডউইচের কাছে দাঁড়িয়ে নলিনাক্ষ বোস সন্ধানী দৃষ্টিতে এপাশ ওপাশ চাইছেন। সম্ভবত মিস বোসকে খুঁজছিলেন। অমিতা দেবীকে দেখেই তিনি বললেন, ‘কীরে, অমি, তুই কোথায় গিয়েছিলি? আমরা সব টেবিলে বসে থেকে-থেকে হয়রান হয়ে গেলাম। তারপর দাদা তোকে ডাকতে পাঠাল।” মিস বোস জবাব দিলেন, ”ছোটকা, তুমি খাবার ঘরে বোসো গিয়ে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।” ‘

‘নলিনাক্ষ বোস চলে গেলেন। তখন মিস বোস স্যান্ডউইচগুলো নিয়ে খাবার ঘরে যান। প্রত্যেককে স্যান্ডউইচ পরিবেশন করে নিজেও একটা নেন। এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। করঞ্জাক্ষ বোস চিকেন স্যান্ডউইচ ছাড়া খেতেন না। তাই আর সকলে ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ খেলেও ওঁর জন্যে চিকেন স্যান্ডউইচের ব্যবস্থা করা হত।

‘খাওয়াদাওয়ার পর মিস বোস চা তৈরি করেন দুজনের জন্যে। দুজন মানে, নলিনাক্ষ বোস আর করঞ্জাক্ষ বোস। এ ছাড়া বাড়ির আর কারও চা খাওয়ার অভ্যাস নেই। এরপর এঁটো বাসনপত্র নিয়ে মিস বোস রান্নাঘরে যান। প্রায় একইসঙ্গে সুকর্ণ রায় খাবার টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যান। একটু পরেই নলিনাক্ষ বোস, ‘শরীরটা উইক লাগছে” বলে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে খাবার ঘর ছেড়ে চলে যান।

‘প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর অণিমা বোস ঠাকুরঘর ছেড়ে নীচে এসে ডক্টর বোসের ঘরে যান। সেখান থেকে খাবার ঘরে গিয়ে দেখেন টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন করঞ্জাক্ষ বোস। মাথাটা টেবিলে রাখা খবরের কাগজের ওপর কাত করে শোয়ানো। বাঁ-হাতটা ঝুলে আছে টেবিলের বাইরে। ডানহাতটা টেবিলে ভাঁজ করে রাখা । খবরের কাগজের একটা পৃষ্ঠা টেবিলের নীচে পড়ে আছে। মিসেস বোসের চিৎকারে সবাই ওই ঘরে এসে হাজির হয়। এবং দেখা যায় যে করঞ্জাক্ষ বোস মারা গেছেন।

‘সকলের জবানবন্দি নিয়ে জানতে পেরেছি, স্যান্ডউইচে বিষ মেশানোর সুযোগ পেয়েছিলেন তিনজন। অমিতা বোস, অণিমা বোস ও নলিনাক্ষ বোস। যে-ই বিষ দিয়ে থাকুক না কেন, সে এটা জানত যে, চিকেন স্যান্ডউইচটা শুধুমাত্র করঞ্জাক্ষ বোসের জন্যে। আমরা পরে ঘরের কোনায় একটা ছেঁড়া লেবেল কুড়িয়ে পাই। তাতে লেখা ছিল, ‘morphin hyd’ এবং তার নীচে লেখা ছিল, “grains 1/2”। তবে তাতে কোনও ছাপ-টাপ পাওয়া যায়নি।

‘মোটিভের ব্যাপারে আমরা অণিমা বোস, নলিনাক্ষ বোস ও সুকর্ণ রায়কে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ, করঞ্জাক্ষ উইলে ওঁর স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেছেন মিস অমিতা বোসকে। এ ছাড়া মদ্যপ, চরিত্রহীন পিতা, যে নিজের স্ত্রীর ওপর দিনরাত অকথ্য অত্যাচার করত, তার জন্যে মিস বোসের মনে নিশ্চয়ই এতটুকুও দয়া, মমতা বা ভালোবাসা ছিল না। তাই অমিতা বোসের এই চাপা রাগের বিস্ফোরণ ঘটেছে এই খুনের মধ্যে দিয়ে।

‘একমাত্র নিরুপায় হয়ে আমরা এ ধরনের মোটিভের কথা চিন্তা করেছি। কিন্তু অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেনছ যে, মেয়ে হয়ে বাবাকে খুন করা প্রায় অসম্ভব। অথচ কোনও প্রমাণ কিংবা আশার আলো আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

আনন্দ সান্যাল একটু থেমে দম নিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ঘটনার দিন বিকেল চারটের কিছু আগে প্রতিদিনের মতোই নলিনাক্ষ বোস বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার সময় বাড়ির দরজায় যে-গোলাপ গাছ আছে তার কাঁটায় হাত লেগে ডক্টর বোসের বাঁ-হাত খুব সামান্য ছড়ে গিয়ে একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মিসেস বোস পাঁচটা পঁয়তাল্লিশের সময় ঠাকুরঘর থেকে নীচে নেমে আসেন। প্রথমে তিনি দেওরের ঘরে যান কয়েকটা অ্যাসপিরিন ট্যাবলেটের জন্যে। কারণ ওঁর মাথা ধরার হ্যাবিট ছিল। ট্যাবলেট নেওয়ার সময় অসাবধানতায় ডক্টর বোসের বাঁ-হাতের সঙ্গে ওঁর হাতের ধাক্কা লাগে। তখনই নলিনাক্ষ বোস জানান যে, ওঁর হাত সামান্য কেটে গেছে, তাই তিনি একটু ব্যথা পেয়েছেন। অ্যাসপিরিন নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় মিসেস বোসের টিফিন খাওয়ার কথা মনে পড়ে। খাওয়ার ঘরে ঢুকেই স্বামীকে শোওয়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন—।

‘তোকে তো সবই খুলে বললাম—এখন কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’ আনন্দ সান্যাল কথা শেষ করে উদগ্রীব হয়ে তাকালেন আশিস চৌধুরীর দিকে।

‘কী ব্যবস্থা? অমিতা দেবীকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা?’ জানতে চাইলেন আশিস।

‘তা ছাড়া আর কী?’

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আশিস মুখ খুললেন, ‘তোর মনে হচ্ছে যে, অমিতা বোস সেন্ট পার্সেন্ট নির্দোষ। ও কাউকে শিল্ড করার জন্যে দোষ স্বীকার করছে?’ একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি।

‘হ্যাঁ—’ এবারও একইভাবে আত্মবিশ্বাসী সুরে জবাব দিলেন আনন্দ সান্যাল।

‘ঠিক আছে, আমি কাল করঞ্জাক্ষ বোসের বাড়িতে যাব—কিছু দেখাশোনা আর এনকোয়ারির জন্যে। নন্দনও আমার সঙ্গে যাবে। আমি একটা মোটামুটি স্কিম ঠিক করেছি। দেখি কাল কী হয়—।’

আনন্দ সান্যাল উঠে দাঁড়ালেন। বিদায় নেওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘আশিস, অমিতার ফেবারে কিছু প্রমাণ তোকে জোগাড় করতেই হবে। মার্ডারার ধরা না পড়ে না পড়ুক—কিন্তু একজন নির্দোষ যেন শাস্তি না পায়—।’

আনন্দ সান্যাল চলে যাওয়ার পর আশিস চৌধুরী একটু হেসে মোতি চৌধুরীর দিকে ফিরলেন, বললেন, ‘মোতি, আনন্দ মজেছে—।’

‘কী?’ কথাটা ঠিকমতো খেয়াল না করায় প্রশ্ন করল দেবনাথ।

‘কিছুই না—। শুধু একটা নেমন্তন্ন খাওয়ার জন্যে তৈরি থাকো বৎস,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন আশিস চৌধুরী।

পরদিন দুজনকে করঞ্জাক্ষ বোসের বাড়ির সমানে দেখা গেল। আশিস চৌধুরীর দৃষ্টি বাধা পেল বাঁ-পাশের গোলাপ গাছটায়। নীচু গলায় বললেন তিনি, ‘আশ্চর্য, ভারি আশ্চর্য—!’

‘কী হল, আশিসদা?’ আশিস চৌধুরীর কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল দেবনাথ।

‘তেমন কিছু নয়। আচ্ছা, নন্দন, তুমি জানো, কী নাম এই গাছটার?’

‘উহুঁ—’ মাথা নাড়ল দেবনাথ।

‘হুঁ—এই গাছটার নাম হল জেফিরিন ড্রাউহিন (zephyrine drouhin)। এ ধরনের গোলাপে খুব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ হয়, আর রং হয় অনেকটা গোলাপি। এই গাছগুলো মাধবীলতার মতো লতিয়ে বেয়ে ওঠে। এটাকে মোটামুটিভাবে এক ধরনের লতানে গোলাপগাছ বলতে পারো।’

‘কিন্তু এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো কী হল, আশিসদা?’

‘সত্যিই তাই, নন্দন, আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই হত না, যদি না এই গোলাপ গাছটার নাম জেফিরিন ড্রাউহিন হত।’ নিষ্পৃহ কণ্ঠে বললেন আশিস চৌধুরী, ‘যাকগে, চলো, এখন বাড়ির ভেতর যাওয়া যাক।’

দুজনে পায়ে-পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। টুকরো বাগানটাকে পাশে ফেলে বসার ঘরে গেলেন। দেখলেন, আনন্দ সান্যাল আগেই সেখানে হাজির হয়েছেন। তিনি যার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সম্ভবত তিনি সুকর্ণ রায়। ওদের ঢুকতে দেখে আনন্দ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সুকর্ণ রায়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘মিস্টার রায়, এঁরা হলেন আশিস চৌধুরী আর নন্দন দেবনাথ। আমাদের লাইনে খুব নাম।’

নমস্কার প্রতি-নমস্কারের পালা শেষ হলে আশিস চৌধুরী বললেন, ‘আনন্দ, আমি একবার মিসেস বোসের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তিনি বাড়িতে আছেন?’

এ-কথার জবাব আনন্দ সান্যাল দিলেন না, দিলেন সুকর্ণ রায়, ‘মামিমা বোধহয় ওপরে পুজোয় ব্যস্ত। আপনারা একটু বসুন, আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’ সুকর্ণ রায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

‘ছেলেটিকে কেমন বুঝলি?’ আনন্দ সান্যাল প্রশ্ন করলেন। তাঁর চোখে কৌতুকের হাসি।

‘অতিমাত্রায় স্মার্ট,’ বলল দেবনাথ।

‘এবং বুদ্ধিমান,’ জানালেন আশিস চৌধুরী।

এমন সময় প্রবেশ করলেন অণিমা বোস। ধীরপায়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। চটপট চেয়ার ছেড়ে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। আনন্দ সান্যাল ‘আপনি বসুন, মিসেস বোস’ বলে ওঁকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন।

শান্ত স্বরে অণিমা বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা বসুন।’

সবাই আবার বসলেন।

আশিস চৌধুরী মিসেস বোসকে লক্ষ করছিলেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। বয়সকালে যে সুন্দরী ছিলেন সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিধবার সাজে বেমানান লাগছে। কী করে এই মহিলার ওপর অত্যাচার করতেন করঞ্জাক্ষ বোস? নিতান্ত পশু না হলে এই প্রতিমার ওপরে হাত তোলা যায় না। যেন শান্ত স্থির কোনও নীল সায়রের মুখোমুখি বসেছেন আশিস চৌধুরী।

‘বলুন আপনাদের কী জানার আছে?’ মিসেস বোসের গলার স্বরে চমক ভাঙল আশিস চৌধুরীর। আনন্দ সান্যালকে ইশারা করতে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন।

এবার নিজেকে তৈরি করে আশিস চৌধুরী প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘আচ্ছা, মিসেস বোস, আপনার স্বামীকে আপনি ভালোবাসতেন?’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘জানি প্রশ্নটা ভীষণ বাজে ধরনের। নিতান্ত অমানুষ না হলে কেউ এ অবস্থায় এরকম প্রশ্ন করে না। কিন্তু এই সিচুয়েশানে আমার কাছে আর কোনও অপশন নেই…।’

‘ভালোবাসা বলতে ঠিক যা বোঝায় তা হয়তো আমার মনে ছিল না। কিন্তু ওঁর মৃত্যুকামনাও করতাম না। বরং ওঁর ওপর আমার করুণা হত।’ থেমে-থেমে জবাব দিলেন তিনি।

‘এবারে মিসহ্যাপের দিন বিকেলের কথা কিছু বলুন। কী করছিলেন আপনি?’

‘মোটামুটি যতটা মনে আছে বলার চেষ্টা করছি, আমি সাড়ে চারটের সময় পুজো করতে তিনতলায় যাই। চারটে চল্লিশ নাগাদ, মানে মিনিট-দশেক পর, অমিতা আমাকে ডাকতে যায়। আমি তখন বলি যে, একটু পরে যাচ্ছি। তারপর পুজো সেরে, দু-একটা টুকিটাকি কাজ করে নীচে নামতে আমার বেশ দেরি হয়ে যায়। মাথাটা ধরেছিল, তাই তখন আমি ঠাকুরপোর ঘরে যাই অ্যাসপিরিন আনতে। ট্যাবলেটের শিশিটা যখন ওর হাত থেকে নিই, তখন আমার হাতের বালাটা ঠাকুরপোর বাঁ-হাতে লাগতেই ও ”উঃ” করে ওঠে। আমি জিগ্যেস করি, ”কী হল?” ও বলল, ”ও কিছু নয়।” আমি চেপে ধরতে তখন ঠাকুরপো বলল, ”গেটের গোলাপ গাছটায় হাত লেগে সামান্য কেটে গেছে।” আমি দেখলাম, বাঁ-হাতের কবজির কাছে। একফোঁটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। একটু ফুলে আছে চারপাশটা। বললাম, ”ওসব বাজে কথা বাদ দিয়ে চটপট ওষুধ লাগাও।” আমি ঘর থেকে বেরোতেই আমার খাওয়ার কথা মনে পড়ল। তখন খাওয়ার ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকেই যা দেখলাম তাতে পাথর হয়ে গেলাম।’ মিসেস বোসের গলা বুজে গেল। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

আশিস চৌধুরী সেটা লক্ষ করলেন, বললেন, ‘ঠিক আছে, মিসেস বোস, আর কিছু আমি জানতে চাই না।’

‘আপনারা কি কিছু খাবেন? চা—টা—?’ ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন অণিমা দেবী।

‘নাঃ, তার কোনও দরকার নেই,’ হেসে বলল দেবনাথ, ‘আপনাকে আর কষ্ট দেব না। আচ্ছা আশিসদা, এবার ওঠা যাক।’

তিনজনেই উঠে দাঁড়ালেন।

মিষ্টি হেসে নমস্কার করে বিদায় জানালেন অণিমা বোস।

বাড়ির বাইরে এসে আশিস চৌধুরী বললেন, ‘আনন্দ, আজ বিকেলে আমি নলিনাক্ষ বোসের সঙ্গে দেখা করব। তুই এখানে প্রেজেন্ট থাকিস।’

‘ঠিক আছে। চারটে সাড়ে-চারটের মধ্যেই আমি এখানে চলে আসব। এখন চলি।’

দুজন সেপাই কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ এগোতেই ওরাও ‘স্যার’-এর পিছু নিল।

আশিস চৌধুরী একবার তাকালেন হাতঘড়ির দিকে। বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি।

বিকেলে ডক্টর নলিনাক্ষ বোসের সঙ্গে মাঝরাস্তাতেই দেখা হল। বোধহয় রোজকার ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন আশিস চৌধুরী, ‘আমার নাম আশিস চৌধুরী, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে আপনিই বোধহয় ডক্টর বোস?’

‘হ্যাঁ, আমিই। কিন্তু—’ ভদ্রলোকের কপালের ভাঁজ বেড়ে গেল।

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। ইন্সপেক্টর আনন্দ সান্যালের বন্ধু আমি। আপনার দাদার মার্ডারের ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়েছে, তাই আপনার সঙ্গে সামান্য একটু আলোচনা করতে চাই—ওই খুনের ব্যাপারটা নিয়েই—।’

‘চলুন, তা হলে বাড়িতে গিয়ে বসা যাক—রাস্তায় দাঁড়িয়ে তো আর কথা হতে পারে না।।’

‘তাই চলুন।’

ওঁরা দুজনে এগিয়ে চললেন ‘বোস ভিলা’র দিকে। বসবার ঘরে গিয়ে মুখোমুখি বসলেন। একজন কাজের লোককে ডেকে দু-কাপ চা, জলখাবারের কথা বললেন ডক্টর বোস। তারপর আশিস চৌধুরীর দিকে ফিরে বললেন, ‘বলুন, মিস্টার চৌধুরী—কী জানতে চান আপনি?’

আশিস চৌধুরী স্থির দৃষ্টিতে নলিনাক্ষ বোসকে লক্ষ করেছিলেন। বয়েস পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হবে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। রগের কাছে চুল পুরোপুরি সাদা। ভাবলেশহীন ছাঁচে ঢালা মুখ। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেশ মানিয়েছে।

এমন সময় চা-জলখাবার হাতে ঘরে ঢুকলেন অণিমা বোস।

‘এ কী, বউদি, তুমি কেন?’ আশ্চর্য হয়ে বললেন ডক্টর বোস, ‘সুরেনের কী হল? তোমাকে বারণ করলেও তুমি শুনবে না, বলে আর কী হবে!’ একটু রেগেই কথা শেষ করলেন তিনি।

‘ঠাকুরপো, এতে আমার কোনও অসুবিধেই হয়নি। তা ছাড়া একটু-আধটু কাজ করলে কী আছে—’ হাসিমুখে তরল কণ্ঠে জবাব দিলেন মিসেস বোস। তারপর আশিস চৌধুরীকে লক্ষ করে বললেন, ‘মিস্টার চৌধুরী, কদ্দুর কী হল?’ অর্থপূর্ণভাবে থামলেন তিনি।

‘চেষ্টা তো করছি,’ মৃদুস্বরে বললেন আশিস চৌধুরী। কিন্তু তিনি ভাবছিলেন অণিমা বোসের মানসিক দৃঢ়তার কথা। এতবড় আঘাতে মনে-মনে ভেঙে পড়লেও বাইরে তা এতটুকুও প্রকাশ করছেন না। আশ্চর্য!

‘দেখুন কী করতে পারেন,’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন মিসেস বোস।

আশিস চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলেন। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলেন আনন্দ সান্যাল, সঙ্গে দুজন পুলিশ কনস্টেবল।

ওঁকে দেখেই ডক্টর বোস উঠতে যাচ্ছিলেন, সম্ভবত আর-এককাপ চায়ের কথা বলতে, ওঁকে বাধা দিলেন আনন্দ সান্যাল: ‘না, মিস্টার বোস, আমি চায়ের ব্যাপারটা সেরে এসেছি। ডোন্ট মাইন্ড—। যাকগে, আশিস, আর দেরি কেন? শুরু কর।’ বলে বসলেন আনন্দ সান্যাল।

‘আচ্ছা, ডক্টর বোস, আপনি কি বাড়িতেই ওষুধপত্তর রাখেন?’ প্রশ্ন করলেন আশিস চৌধুরী।

‘হ্যাঁ।’

‘তার মধ্যে মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

‘ঘটনার দিন, অথবা তার আগে, কি আপনার কোনও ওষুধের ফাইল চুরি গিয়েছিল?’

‘আপনি যা হিন্টস দিচ্ছেন, তা সত্যি,’ ইতস্তত করে জবাব দিলেন নলিনাক্ষ বোস, ‘গতমাসের ১৬ তারিখে, রাতে, আমি লক্ষ করি যে, আমার স্টক থেকে একটা মরফিনের ফাইল হারিয়ে গেছে।’

‘হারিয়ে গেছে বলছেন কেন?’

‘প্রথমে ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি হারিয়ে নয়—চুরিই গিয়েছিল ওটা।’

‘এবং চুরি যাওয়াটা স্বাভাবিক।’ বললেন আশিস চৌধুরী। একটু থেমে আবার বললেন, ‘আপনি এ নিয়ে কোনও হইচই করেননি?’

‘হ্যাঁ, বউদিকে দাদাকে জিগ্যেস করেছিলাম। তা ছাড়া অনেক খোঁজাখুজিও করেছিলাম। কিন্তু কোথাও পাইনি। পরে ভেবেছি যে, আমার নিজের হয়তো হিসেবে ভুল হয়েছে। তাই ও নিয়ে আর চিন্তা করিনি।’

‘আপনি সুকর্ণবাবুকে প্রশ্ন করতে পারতেন। তিনি হয়তো তার কোনও দরকারে নিয়ে থাকতে পারেন…।’

‘ও নরমালি আমার কাছ থেকে কোনওদিন ওষুধ নেয় না। আর নিয়ে থাকলে ও আমাদের খোঁজাখুঁজি করতে দেখে আমাকে জানাত। তা ছাড়া নেওয়ার সময় আমাকে বলেই নিত সুকর্ণ।’

ভদ্রলোকের যুক্তিনিষ্ঠ মানসিকতার পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হলেন আশিস চৌধুরী। একটু থেমে বললেন, ‘ডক্টর বোস, এবার আপনাকে যে-প্রশ্নটা করব সেটার উত্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এ বিষয়ে আপনার মতামত ভীষণ ইমপরট্যান্ট।’

‘বলুন—।’

‘আপনার দাদার ক্যারেক্টার কী টাইপের ছিল? এ সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী?’

‘বলাটা কী উচিত হবে না,’ ইতস্তত করে বললেন ডক্টর বোস, ‘তবু এটুকু আমি বলব যে, দাদা মানুষ ছিলেন না।’ তার মুখ কুঁচকে গেল। সম্ভবত ঘেন্নায়।

‘আপনার মতামতের জন্যে ধন্যবাদ।’

‘কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, দেখবেন, এ-কথা যেন বউদি না জানতে পারে।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন,’ আশ্বাস দিলেন আশিস চৌধুরী, ‘আচ্ছা, এবার ঘটনার দিন বিকেলে যা-যা, যেভাবে ঘটেছিল, বা আপনি যেভাবে ঘটতে দেখেছিলেন তা খুলে বলুন।

‘তার মানে আমার হোয়্যার অ্যাবাউটস? সে তো পুলিশকে একবার বলেছি—’ আনন্দ সান্যালের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বিরক্ত স্বরে জবাব দিলেন তিনি।

‘আমি আপনার মুখ থেকেই আবার শুনতে চাই।’ দৃঢ়স্বরে বললেন আশিস চৌধুরী।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মুখ খুললেন ডক্টর নলিনাক্ষ বোস, ‘ঠিকমতো মনে নেই, তবু যতটা পারি গুছিয়ে বলছি। সেটা ছিল ১৭ তারিখ। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটের সময় আমি প্রতিদিনের মতো ইভনিংওয়াক সেরে বাড়ি ফিরি—।’

এইসময় বাধা দিলেন আশিস চৌধুরী, বললেন, ‘তখন আপনার বাঁ-হাতে গোলাপের কাঁটা ফুটে যায়—।’

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করলেন ডক্টর বোস, ‘ওটা খুবই সামান্য ব্যাপার, অথচ সেটা নিয়ে বউদি হইহই কাণ্ড শুরু করে দিয়েছিল—’ আনমনেই হাসলেন তিনি। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘বাড়ি ফিরে খাওয়ার টেবিলেই দেখা হল দাদা আর সুকর্ণর সঙ্গে। আমিও গিয়ে বসলাম ওদের পাশে। এমন সময় অমিতা এসে ঘরে ঢুকল, বলল, ”তোমাদের খাবারটা দিই এখন?” দাদা বললেন, ”হ্যাঁ দে—।” অমিতা চলে গেল। সুকর্ণর সঙ্গে আমার টুকটাক কিছুক্ষণ কথা হল। হঠাৎ দাদা বললেন, ”নলিন, দ্যাখ তো, অমিতা রান্নাঘরে এতক্ষণ ধরে কী করছে?” আমি মিনিটখানেক পরেই উঠলাম—।’

‘তখন ক’টা বেজেছিল বলতে পারেন?’ জানতে চাইলেন আশিস চৌধুরী।

‘চারটে বেজে মিনিট-পঁয়তাল্লিশ হবে—একজ্যাক্টলি মনে নেই। যা হোক, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি অমি সেখানে নেই। এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছি, এমন সময় ও এসে ঢুকল। আমি বললাম, ”কী রে অমি, তুই কোথায় গিয়েছিলি? আমরা সব টেবিলে বসে থেকে-থেকে হয়রান হয়ে গেলাম। তারপর দাদা তোকে ডাকতে পাঠাল।” ও জবাব দিল, ”ছোটকা, তুমি খাওয়ার ঘরে বোসো গিয়ে—আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।” তখন আমি আবার ডাইনিং রুমে ফিরে আসি। দাদা তখন টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা পড়ছিল, আর সুকর্ণ চুপচাপ বসেছিল।

‘খাওয়াদাওয়ার পর অমিতা আমার আর দাদার জন্যে চা তৈরি করে। বাড়ির আর কেউ চা খায় না। আমি টি-পট থেকে চা ঢেলে দাদাকে দিই, নিজেও নিই। চা খাওয়ার পর অমিতা এঁটো কাপ-টাপগুলো নিয়ে যায় রান্নাঘরে। সুকর্ণ উঠে চলে যায় নীচে। আমার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করাতে আমিও আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।

‘প্রায় পাঁচটা পঁয়তাল্লিশের সময় বউদি এল অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট নিতে। ট্যাবলেট দেওয়ার সময় বউদির বালায় আমার বাঁ-হাতের কবিজতে ঠোকা লাগে। আমি যন্ত্রণায় ”উঃ” করে উঠি। বউদির পীড়াপীড়িতে আমি কীভাবে হাতে কেটে গেছে সেটা বলি। তখন বউদি আমাকে ওষুধ লাগাতে বলে চলে যায়। তার মিনিটখানেক পরেই বউদির চিৎকার আমার কানে আসে—।’ নলিনাক্ষ বোস থামলেন।

‘ডক্টর বোস, আপনার কাটা জায়গাটা দেখাবেন?’

‘এখন আর কিছুই বুঝতে পারবেন না। তবে দেখতে চান দেখুন—’ নিস্পৃহ গলায় এ-কথা বলে নলিনাক্ষ বোস বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আশিস চৌধুরীর দিকে। খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন আশিস চৌধুরী। এতদিন পর ক্ষতের কোনও চিহ্নই আর নেই।

‘আচ্ছা, ডক্টর বোস,’ হাত তুলে নমস্কার জানালেন আশিস চৌধুরী, ‘আজ আমরা উঠি, রাত হয়ে গেল।’

‘আচ্ছা, নমস্কার—।’

বাইরে বেরিয়ে আশিস চৌধুরী বললেন, ‘আনন্দ, স্যান্ডউইচে মরফিন মেশানোর সুযোগ ডক্টর বোস পেয়েছিলেন।’

‘কখন?’

‘যখন তিনি অমিতা বোসকে ডাকতে রান্নাঘরে যান।’

‘কিন্তু আশিস, তা যদি হত তবে অমিতা বোস একটু অন্যরকম জবানবন্দি দিতেন।’

‘তার মানে?’ উৎসুক হলেন আশিস।

‘মিস বোস যদি কাকাকে শিল্ড করতে চাইতেন তবে বলতেন যে, তিনি গাছে জল দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার পর ডক্টর বোস ওঁকে খুঁজতে রান্নাঘরে আসেন, তাই না?’

‘হুঁ,’ চিন্তিতভাবে বললেন আশিস চৌধুরী, ‘ব্যাপার ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে।’

পরদিন সকালে আশিস চৌধুরী একাই ‘বোস ভিলা’র দিকে রওনা দিলেন। আজ তিনি সুকর্ণ রায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এই করঞ্জাক্ষ বোস। যতই দিন গেছে মৃত্যু ততই নিশ্চিতভাবে ওঁর দিকে এগিয়ে এসেছে। তিনি কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে, ওঁর প্রিয় চিকেন স্যান্ডউইচই ওঁর মৃত্যু ডেকে আনবে?

পায়ে-পায়ে ‘বোস ভিলা’র সামনে এসে হাজির হলেন আশিস চৌধুরী। দরজার সামনেই সুকর্ণ রায়ের সঙ্গে দেখা হল। বোধহয় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলেন। আশিস চৌধুরীকে দেখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। উত্তরে হাসলেন আশিস চৌধুরী: ‘আপনাকেই দরকার, কিছু কথা ছিল—।’

‘আসুন—ভেতরে আসুন।’ আশিস চৌধুরীকে ভেতরে নিয়ে চললেন সুকর্ণ রায়। সুকর্ণর বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশ। মুখমণ্ডলে বুদ্ধির ছাপ। অতল চোখে সপ্রতিভ দৃষ্টি। সরু গোঁফ, তীক্ষ্ন নাক, পরনে সাহেবি পোশাক।

ড্রইংরুমে গিয়ে বসলেন দুজনে। কোনওরকম ভূমিকা না করেই প্রশ্ন করলেন আশিস চৌধুরী, ‘মিস্টার রায়, আপনি এখানে মামার কাছে আছেন তাই না?’

‘হ্যাঁ,—’ মাথা নীচু করে জবাব দিলেন সুকর্ণ রায়।

‘কিছু মনে করবেন না। আমাদের সব ব্যাপারেই নির্লজ্জ হতে হয়। সেজন্যে আমাদের কেউ পছন্দ করে না।’ চেষ্টা করে হাসলেন আশিস চৌধুরী।

‘ছি—ছি, মিস্টার চৌধুরী, এ আপনি কী বলছেন? আমি কিছুই মনে করিনি। আপনি বলুন, আর কী জানতে চান?’

‘আপনি জানতেন যে, একটা মরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের ফাইল গত মাসের ১৬ তারিখে, মানে, আপনার বড়মামা মারা যাওয়ার আগের দিন রাতে, ডক্টর বোসের স্টক থেকে চুরি গেছে?’

‘হ্যাঁ, ছোটমামাই আমাকে বলেছিলেন সে-কথা। আমি শুনে খুবই অবাক হয়েছিলাম। কারণ আজ পর্যন্ত ছোটমামার স্টক থেকে কোনওদিনই কিছু চুরি যায়নি।’

চুরি যায়নি বলতে কি আপনি হারায়নি বলতে চাইছেন?’ জিগ্যেস করলেন আশিস চৌধুরী।

‘হ্যাঁ। কিন্তু পরদিন মরফিন পয়জনিং-এ বড়মামা মারা যাওয়ায় এখন মনে হচ্ছে ওটা চুরিই গিয়েছিল।’

‘আচ্ছা, আপনার বড়মামার ব্যবহার কেমন ছিল?’

‘আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করতেন।’ ‘আমার সঙ্গে’ কথাটার ওপরে জোর দিলেন সুকর্ণ।

‘তার মানে আর সবায়ের সঙ্গে ওঁর ব্যবহার ভালো ছিল না?’

‘দেখুন, ব্যাপারটা ডেলিকেট। সেটা কি বলা ঠিক হবে!’ ইতস্তত করতে লাগলেন সুকর্ণ রায়।

‘আপনি যা বলবেন তা আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’ সুকর্ণকে আশ্বাস দিলেন আশিস চৌধুরী।

‘ব্যাপারটা কী জানেন? মামা একজন ড্রাংকার্ড ছিলেন। হয়তো সেইজন্যেই মামার ব্যবহার একটু রুক্ষ ছিল। মামিমার ওপর তিনি যা টরচার করতেন সেটা আর কেউ হলে হয়তো সহ্য করত না।’ আবেগের গলায় বললেন সুকর্ণ।

‘আর কেউ বলছেন কেন? আপনার মামিমাও হয়তো সহ্য করেননি… তাই…’ ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে সুকর্ণর দিকে তাকালেন আশিস চৌধুরী।

‘অসম্ভব!’ উত্তেজিত হয়ে বললেন সুকর্ণ।

‘কেন? অসম্ভব কেন?’

‘কারণ মামিমা সেখানে, মানে, স্পটে ছিলেন না।’

‘স্যান্ডউইচে মরফিন মেশানোর জন্যে স্পটে থাকার দরকার হয় না, মিস্টার রায়। যাকগে, বাজে কথায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ১৭ তারিখ বিকেলের ঘটনাগুলো আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।’

‘মিস্টার চৌধুরী, এতদিন পরে স্মৃতি কিছুটা ঝাপসা হলেও হতে পারে। তবে আপনার বুঝতে বোধহয় অসুবিধে হবে না। চারটে কুড়ি নাগাদ আমি খাওয়ার টেবিলে যাই। ওখানে বড়মামা একাই ছিলেন। একটু পরে ছোটমামা আসেন। অমিতা এসে জিগ্যেস করল খাবার দেবে কিনা। বড়মামা বললেন, ”হ্যাঁ, দে—।” ও চলে যাওয়ার পর ছোটমামার সঙ্গে ওয়েদার নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। অমিতার দেরি হচ্ছে দেখে বড়মামা হঠাৎ ছোটমামাকে খোঁজ নিতে পাঠালেন। ছোটমামা চলে গেলেন। বড়মামা আমাকে জিগ্যেস করলেন, ”সুকর্ণ, পড়াশোনা কেমন চলছে?” ”হচ্ছে একরকম।” বললাম আমি। এরপর বড়মামা চুপচাপ খবরের কাগজটা নিয়ে পড়তে থাকেন।

‘একটুপরে ছোটমামা এলেন। অমিতা এসে আমাদের খাবার পরিবেশন করল। তারপর ছোটমামা আর বড়মামা চা খেলেন। চা খাওয়ার শেষে শরীরটা ভালো লাগছে না বলে ছোটমামা উঠে চলে গেলেন। আমিও প্রায় একই সঙ্গে খাওয়ার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যাই। অনেকক্ষণ পর মামিমার চিৎকারে ওপরে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি বড়মামা টেবিলে পড়ে আছেন।’ থামলেন সুকর্ণ রায়।

‘আপনি তো ডাক্তারি পড়েন—মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড সম্বন্ধে আপনার মত কী?’ প্রশ্ন করলেন আশিস চৌধুরী।

‘আমার চেয়ে ছোটমামাই হয়তো ভালো বলতে পারবেন।’

‘আমি আপনার কাছ থেকেই শুনতে চাই।’

‘এক গ্রেন মরফিন একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট।’ জানালেন সুকর্ণ। এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সুকর্ণ একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন। ওঁর মুখে এবার সেই বিরক্তির ছাপ দেখা গেল: ‘আপনি কী চান বলুন তো?’

‘আপনার বড়মামার আসল মার্ডারারকে খুঁজে বের করতে—।’

‘অমিতাকে আপনি নির্দোষ মনে করেন?’

কিছুক্ষণ চিন্তা করে আশিস চৌধুরী বললেন, ‘যদি বলি তাই?’

‘কিন্তু অমিতা নিজে কনফেস করেছে।’

‘সেটা আর কাউকে বাঁচানোর জন্যে।’ আশিস চৌধুরীর কথাগুলো বজ্রপাতের মতো গিয়ে বাজল সুকর্ণ রায়ের কানে। হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন তিনি। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন: ‘আর-কাউকে বাঁচানোর—?’

সুকর্ণ রায়কে বিহ্বল অবস্থায় রেখে নিঃশব্দে ‘বোস ভিলা’র বাইরে পা দিলেন আশিস চৌধুরী। একটা জিনিস তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সুকর্ণ রায়কে বাঁচানোর জন্য অমিতা বোস মিথ্যে কথা বলছেন না।

‘আশিসদা, তার মানে একটা সিদ্ধান্তেই আমরা পৌঁছতে পারছি—সেটা হল অমিতা বোস যাকে শিল্ড করতে চাইছেন, তিনি অণিমা বোস ছাড়া আর কেউ নন।’ আশিস চৌধুরীর মুখ থেকে সব শোনার পর বলল দেবনাথ।

‘ঠিক তাই,’ বললেন আশিস চৌধুরী, ‘কিন্তু কেন? মিসেস বোসের অ্যালিবাইতে কি কোনও ফাঁক আছে?’

‘থাকতেই হবে। এমন ফাঁক, যাতে অমিতা বোস মনে করেছেন যে, ওঁর মা ওই সময়টা স্যান্ডউইচে মরফিন মেশানোর কাজে খরচ করেছেন। তাই পুলিশের কোনও কথারই প্রতিবাদ করছেন না।’

‘হতে পারে। কিন্তু আজই আমাকে অমিতা বোসের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দেখি আনন্দকে একবার ফোন করে—।’ বলে ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন আশিস চৌধুরী। ডায়াল করলেন।

‘হ্যালো, ইন্সপেক্টর সান্যাল আছেন?’

‘কথা বলছি। আশিস নাকি?’

‘হুঁ—।’

‘আরে কী ব্যাপার? কিছু সূত্র-টুত্র পেলি নাকি? যাতে অমিতা বোসকে ছাড়ানো যায়, আর…।’

‘আসল মার্ডারার কে, সেটা তোর জানার ইচ্ছে নেই?’

‘জেনে কী হবে?’

‘দারুণ জবাব দিলি। সাবাশ। এই তো চাই। ভালোবাসার জন্যে প্রমোশনের মোহ ক’জন ইন্সপেক্টর ছাড়তে পারে!’

‘ইয়ার্কি ছেড়ে আসল কথা বল—।’

‘আজ আমি তোমার ওই ইয়ের সঙ্গে থানার দেখা করতে যাব। কিছু কথাবার্তা আছে।’

‘অমিতার সামনে আমার প্রেস্টিজ ডোবাস না মাইরি!’

‘কোনও ভয় নেই, বৎস। শুধু গুরুর বচন ফলো করে যা। আমি বিকেলে যাচ্ছি—তুই থাকিস।’

‘আচ্ছা—।’

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন আশিস চৌধুরী। তারপর মোতি চৌধুরীর দিকে ফিরে বললেন, ‘ভালো দেখে একটা শাড়ি কিনে রেখো।’

মোতি চৌধুরীর চোখে অর্থহীন দৃষ্টি দেখে আবার বললেন, ‘কাল-পরশুই আমি এ ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব। আর আমার ধারণা যদি ভুল না হয়, তবে তারপরই’, ভুরু নাচিয়ে হাসলেন আশিস চৌধুরী: ‘সানাই বাজবে।’

আশিস চৌধুরীর মুখোমুখি বসে ছিলেন শ্রীমতী অমিতা বোস। দুজনের মধ্যে ব্যবধান শুধু একটা আয়তাকার কাঠের টেবিল। আশিস চৌধুরীর ডানপাশে একটা চেয়ার দখল করে বসেছিলেন আনন্দ সান্যাল। এক অদ্ভুত মনোযোগে তাকিয়ে ছিলেন অমিতা বোসের বিষাদ মধুর মুখের দিকে।

‘মিস বোস,’ নিস্তব্ধতা ভাঙলেন আশিস চৌধুরী, ‘গত ১৭ তারিখের ব্যাপারগুলো আমাকে একটু খুলে বলুন। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেবেন না।’

অমিতা বোসের মুখে বিরক্তির ছায়া খেলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ খুললেন তিনি, ‘দেখুন মিস্টার…।’

‘চৌধুরী। আশিস চৌধুরী।’

‘দেখুন, মিস্টার চৌধুরী, আমার ঠিকমতো সবকিছু মনে নেই। তবু যা-যা মনে আছে বলছি…।’

‘ঘটনর দিন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ আমি খাওয়ার ঘরে যাই। তখন সেখানে ছিলেন ছোটকাকা, সুকর্ণদা আর বাবা। আমি জিগ্যেস করি যে, খাবার আনব কি না। তখন বাবা বললেন, ”হ্যাঁ, দে—।” আমি স্যান্ডউইচগুলো আনতে রান্নাঘরে যাই। তারপর মায়ের কথা মনে পড়তে স্যান্ডউইচগুলো রেডি করে মা-কে ডাকতে তিনতলায় ঠাকুরঘরে গেলাম। মা পুজো করছিল। আমি ডাকতে বলল, ”যাচ্ছি, যা—।” সেখান থেকে আমি গাছে জল দেওয়ার জন্যে বাগানে যাই।

‘গাছে জল দিয়ে রান্নাঘরে ফেরার পথে মা-কে আর-একবার তাড়া দিয়ে গেলাম। ফিরে গিয়ে দেখি ছোটকাকা রান্নাঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক দেখছেন। আমাকে দেখে বললেন যে, বাবা নাকি দেরি হচ্ছে দেখে আমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন। ট্রে-র ওপর স্যান্ডউইচগুলো সাজানোই ছিল। ছোটকাকা চলে যাওয়ার পর আমি সেগুলো খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেলাম—।’

এইখানে বাধা দিলেন আশিস চৌধুরী। বললেন, ‘আচ্ছা, একমিনিট। রান্নাঘরে স্যান্ডউইচগুলো যেভাবে রেখে আপনি মিসেস বোসকে ডাকতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসেও কি দেখেন যে, সেগুলো একইভাবে রয়েছে?’

‘না, মানে—আমার ঠিক মনে নেই। বোধহয় ঠিকই ছিল। আর ওগুলোতে কেই-বা হাত দেবে?’

‘হুঁ, সত্যিই তো! আর কেই বা হাত দেবে? খুনি ছাড়া আর কারও তো হাত দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না!’

‘কী বলতে চাইছেন আপনি? তার মানে ছোটকা—।’

‘—এবং অণিমা বোস এবং সুকর্ণ রায় এবং অমিতা বোস।’ আশিস চৌধুরীর কণ্ঠস্বর যেন মিছরি মাখা ছুরি।

আনন্দ সান্যাল চেয়ারের তলা দিয়ে বাঁ-হাত বাড়িয়ে আশিস চৌধুরীকে ছোট্ট চিমটি কাটলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আশিস, কী হচ্ছে এসব?’

আশিস চৌধুরী বন্ধুকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রসঙ্গ পালটালেন: ‘যাকগে—ওসব ছেড়ে দিন, মিস বোস, আপনি বরং তার পর থেকে বলুন…।’

অমিতা বোস ধীর স্বরে আবার শুরু করলেন, ‘কিছুক্ষণ পর আমি খাবার নিয়ে গেলাম। সবার খাওয়ার পর বাবা আর ছোটকাকার জন্যে চা তৈরি করলাম। খাওয়ার পাট চুকে গেলে আমি এঁটো কাপ-প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যাই। ওগুলো ধুয়ে, মেজে, পরিষ্কার করে, গুছিয়ে রাখার সময় হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে ছুটে খাওয়ার ঘরে যাই। গিয়ে দেখি বাবা টেবিলে লুটিয়ে পড়ে আছেন। বুঝলাম, বাবা আর নেই।’ দু-হাতে মুখ ঢাকলেন অমিতা বোস।

‘মিস বোস,’ আশ্বাস ও সান্ত্বনার স্বরে বললেন আনন্দ সান্যাল, ‘দয়া করে ধৈর্য হারাবেন না। আপনার বাবার জঘন্য খুনের জন্যে যে দায়ী তাকে আমরা কোর্টে তুলবই।’

‘আমিই দায়ী, আমিই দায়ী। আমাকে ফাঁসি দিন আপনারা—।’ কান্নায় ভেঙে পড়লেন অমিতা বোস।

আশিস চৌধুরী আনন্দ সান্যালের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকালেন। তারপর অমিতা বোসের দিকে চেয়ে বললেন, ‘মিস বোস, আপনার মা খুন করেননি। শি ইজ ক্লিন—।’

অমিতা বোস মাথা নীচু করে বসেছিলেন। এ-কথায় যেন মন্ত্রের মতো কাজ হল। চমকে মুখ তুলে তাকালেন। জল ভরা টানা চোখে বিহ্বল চাউনি। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিস্ময়ে ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘মা নির্দোষ?’

‘হ্যাঁ, মিস বোস, আপনার মা পুরোপুরি ইনোসেন্ট।’

হঠাৎই নিজের অবস্থার কথা অমিতা বোসের খেয়াল হল। চোখের জল মুছে আশিস চৌধুরীর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বললেন, ‘আপনি হঠাৎ এ-কথা বললেন কেন, মিস্টার চৌধুরী?’

‘কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি যে, আপনি অণিমা দেবীকে বাঁচানোর জন্য নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিচ্ছেন। আপনার জবাববন্দিতে একটু আগেই আপনি বলেছেন, ”ফেরার পথে মা-কে আর-একবার তাড়া দিয়ে গেলাম।” অথচ আপনার মা বলেছেন যে, আপনি ওঁকে মাত্র একবারই ডেকেছেন—আপনার কথা মতো দুবার নয়। তার মানে, দ্বিতীয়বার আপনার মা ঠাকুরঘরে ছিলেন না। রান্নাঘরে ফেরার সময় আপনি হয়তো ওঁকে রান্নাঘর থেকে বেরোতে দেখেন। আপনার মা হয়তো অন্য কোনও তুচ্ছ কারণে ওখানে গিয়ে থাকবেন। কিন্তু আপনি ভাবলেন, যদি পুলিশ এই কথা জানতে পারে তবে অণিমা বোস রেহাই পাবেন না। আপনি একরকম ধরেই নিয়েছিলেন যে, আপনার মা এই খারাপ কাজটা করেছেন। তাই ওঁকে বাঁচানোর জন্যে এ-কথাটা চেপে গেলেন। অণিমা দেবী ওঁর জবানবন্দিতে এ-কথাটা সামান্য বলেই উল্লেখ করেননি। কিন্তু, মিস বোস, আপনার কোনও ভয় নেই। অণিমা দেবী কালপ্রিট নন।’ থামলেন আশিস চৌধুরী।

‘মিস্টার চৌধুরী, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না—’ আনন্দে অমিতা বোসের গলা বুজে গেল। ওঁর চোখে সজীব প্রাণবন্ত ভাব আবার ফিরে এল।

আশিস চৌধুরী বললেন, ‘মিস বোস, এবার জানা গেল যে, স্যান্ডউইচে বিষ আপনি মেশাননি—।’

‘—মা-ও মেশাননি।’ ধরিয়ে দিলেন অমিতা বোস।

‘সম্ভবত। আপনার মা যদি হত্যাকারী না হন, তবে আমিই বোধহয় সবচেয়ে খুশি হব।’

‘তা হলে কি…’ সন্দেহ-কুটিল ছায়া কেঁপে উঠল অমিতা বোসের চোখের পাতায়, ‘তা হলে কি…?’

‘ঠিকই ধরেছেন। আপনি যে নির্দোষ, সেটা আপনার মুখ থেকে আমার শোনা দরকার ছিল।’

আনন্দ সান্যাল পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘মিস বোস, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। আপনার মা, মানে, অণিমা বোসের স্বপক্ষে প্রমাণ আমরা পেয়েছি। খুনি হয় সুকর্ণ বোস, নয় ডক্টর নলিনাক্ষ বোস।’

আনন্দ সান্যালের আশ্বাস কিছুটা কাজ হয়তো হল। কারণ অমিতা আর কোনওরকম অস্থির ভাব দেখালেন না। মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলেন।

‘আচ্ছা মিস বোস,’ আবার শুরু করলেন আশিস চৌধুরী, ‘আপনি কাকে সন্দেহ করেন?’

‘কী করে বলব—?’ দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন অমিতা।

‘আপনার বাবা কি সুইসাইড করতে পারেন বলে মনে হয়?’

‘কক্ষনো নয়—’ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন অমিতা বোস, ‘বাবা এই দুনিয়াটাকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত উপভোগ করে যেতে চেয়েছিলেন। দু-হাতে পয়সা ছড়িয়েছেন। তাঁর আরও বহুদিন বাঁচার ইচ্ছে ছিল। তাঁর মৃত্যু কখনওই সুইসাইড হতে পারে না।’

‘করঞ্জাক্ষ বোস অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিলেন।’ আপনমনেই বললেন আশিস চৌধুরী, ‘যাক, মিস বোস, আমার আর কিছু জানার নেই।’ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়ার আগে আনন্দ সান্যালকে বললেন। ‘আনন্দ, মিস বোসকে আমার দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করিস।’

‘আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে ফেলছি,’ চটপট জবাব দিলেন আনন্দ সান্যাল।

হঠাৎ কী মনে পড়তেই যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন আশিস চৌধুরী, বললেন, ‘ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম। আনন্দ, মরফিনের ছেঁড়া লেবেলটা আমাকে দে এক্ষুনি—।’

‘দিচ্ছি। পাঁচমিনিট অপেক্ষা কর’, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আনন্দ সান্যাল।

কিছুক্ষণ অখণ্ড নীরবতার পর আশিস চৌধুরী বললেন, ‘আপনার এই রিলিজের জন্যে আনন্দকে আপনার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ও দিনরাত ঘোরাঘুরি করে, আমার কাছে গিয়ে, নানাভাবে আমাকে কনভিন্স করিয়েছে যে, আপনি নির্দোষ। তখনই আমি কেসটা টেকআপ করেছি।’

অমিতা বোস কোনও কথা বললেন না।

আনন্দর সপক্ষে কিছু বলতে পেরে একটু হালকা হলেন আশিস চৌধুরী।

এমন সময় একটা সাদা খাম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন আনন্দ সান্যাল: ‘এই নে তোর মরফিনের লেবেল।’

হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন আশিস চৌধুরী। ‘লেবেলটা হাতে ধরছি কিন্তু,’ বলে ওটাকে বের করলেন খামের ভেতর থেকে। কিন্তু বের করেই চমকে উঠলেন। এ কী? মুখে বললেন, ‘আনন্দ, লেবেলটার ব্যাপারে আমি যা ভাবছি, তা যদি সত্যি হয় তা হলে মার্ডারার কে তা আমি বোধহয় ধরে ফেলেছি। আশ্চর্য…! আচ্ছা, আনন্দ—আগামীকাল বিকেলে সবাইকে আসতে বলিস আমার বাড়িতে। আর তুই মার্ডারারকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে আসিস। আমি তোর জন্যে ওয়েট করব।’ দ্রুতপদে থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন আশিস চৌধুরী।

নাটকের শেষ অঙ্ক, শেষ দৃশ্য আশিস চৌধুরীর বাড়ির ড্রইংরুমে। একনজর দেখলেই বোঝা যায় মঞ্চসজ্জার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছেন তিনি। ন’টা চেয়ার গোল করে সাজানো। মাঝের খালি জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলেন আশিস চৌধুরী। পাইপ জ্বালিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। ওঁর চোখের নজর সবার মুখের ওপর দিয়ে পিছলে গেল। মোতি চৌধুরী, নন্দন দেবনাথ, আনন্দ সান্যাল, অমিতা বোস, অণিমা বোস, নলিনাক্ষ বোস, সুকর্ণ রায় ও আরও দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক। সকলেই দু-চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন আশিস চৌধুরীর দিকে। উৎকণ্ঠার সুতোয় ঝুলছেন যেন প্রত্যেকে!

‘এই দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে বোধহয় আপনাদের আলাপ নেই,’ অপরিচিত দুজনকে দেখিয়ে আশিস চৌধুরী শুরু করলেন, ‘ইনি হলেন, মিস্টার অমিতাভ ভট্টাচার্য, ডক্টরেট ইন কেমিষ্ট্রি—এবং ইনি হলেন মিস্টার সোমনাথ ঘোষ, করঞ্জাক্ষ বোসের অ্যাটর্নি। আজ এখন যে সমাধান আমি আপনাদের সামনে পেশ করব তাতে এঁদের অবদান কম নয়।

‘করঞ্জাক্ষ বোস নিজেই নিজের মৃত্যুবীজ পুঁতেছিলেন। ওঁর মৃত্যু-রহস্য এতই অদ্ভুত যে, শুনলে অবাক হতে হয়। হত্যাকারী তার পরিকল্পনায় বিদ্যে-বুদ্ধির চমৎকার মিলন ঘটিয়েছে। আপনারা জানেন, করঞ্জাক্ষ বোস মারা গেছেন মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড পয়জনিং-এ। সেই অনুযায়ী মরফিনের একটা ছেঁড়া লেবেলও আমরা ঘটনাস্থলে পেয়েছি। এই সেই লেবেল—’ পকেট থেকে ছেঁড়া লেবেলটা বের করে সবাইকে দেখালেন আশিস চৌধুরী: ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এটা মরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের লেবেল। আনন্দর মুখে শুনে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু লেবেলটি দেখামাত্রই আমার সন্দেহ হয়। লেবেলে মরফিন শব্দের ”এম” অক্ষরটি ছোটহাতের। কিন্তু কেন? আমি সন্দেহ যাচাই করতে একজন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট-এর দোকানে গেলাম। লেবেলটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম সেটা মরফিনেরই লেবেল কিনা। ভদ্রলোক সেটিকে একনজর দেখেই বললেন যে, না, ছেঁড়া লেবেলটি মরফিনের হলে ”এম” অক্ষরটি বড়হাতের হত। আমার ধারণা যে ঠিক সেটা প্রমাণ হল।

‘কিন্তু তাই যদি হয়, তবে কীসের লেবেল এটি? ভদ্রলোককে আমি প্রশ্ন করলাম, ”আপনি কি বলতে পারেন, এটা কীসের লেবেল?” ‘

‘তিনি জবাব দিলেন, ”হ্যাঁ কেন পারব না?”

‘কীসের—?’

‘ ”অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের লেবেল।”

‘ ”এটা দেখে আর কিছু কি বলা সম্ভব?”

‘ ”হ্যাঁ। ছেঁড়া লেবেলের নীচের অংশে যে grains 1/2 লেখাটা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে 1/20 হবে। লেবেলটি ছেঁড়া হওয়ায় 2-এর পর ‘0’-টি বাদ গেছে।”

‘এ-কথা শুনে আমি খুবই অবাক হয়ে যাই। তা হলে কি করঞ্জাক্ষ বোস মরফিন হাইড্রোক্লোরাইডে মারা যাননি? কিন্তু তা কী করে হয়? কারণ, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নির্ভুলভাবেই বলছে যে, করঞ্জাক্ষ বোসের মৃত্যুর জন্যে দায়ী শুধুমাত্র মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড—অন্য কিছু নয়। তবে এই অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের ছেঁড়া লেবেলটা অকুস্থলে কে রাখল? যিনি রেখেছেন তিনিই হত্যাকারী।

‘আচ্ছা, ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনি কি দয়া করে বলবেন এই অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের প্রপার্টি কী এবং কীভাবে এটা তৈরি হয়?’ বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অমিতাভর দিকে তাকালেন আশিস চৌধুরী।

চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে গলাখাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অমিতাভ। বললেন, ‘মিস্টার চৌধুরী, আপনাকে আমি আগেও একবার বলছি, এখনও বলছি—মরফিনকে ডায়লুট হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সঙ্গে সিলড টিউবে গরম করে স্যাপনিফাই করলে অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইড তৈরি হয়।’

‘কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, আপনি এই অ্যাপোমরফিনের পেছনে এতক্ষণ ধরে লেগে রয়েছেন কেন?’ অসহিষু� স্বরে বলে উঠলেন সুকর্ণ রায়।

‘কারণ, এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। মিস্টার রায়, এই যে ওষুধটার কথা আমরা এতক্ষণ ধরে আলোচনা করছি এটাই হত্যাকারীর সবচেয়ে ইনটেলিজেন্ট স্টেপ। এবং সেটা হয় আপনি, নয় ডক্টর নলিনাক্ষ বোস।’

‘আমি?’ নিজের বুকে ডানহাতের বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন সুকর্ণ রায়।

‘হ্যাঁ, আপনিও সন্দেহের পাত্র ছিলেন। কিন্তু এখন সমস্ত সন্দেহ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় ইতি টেনে আমি জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, মার্ডারার আমাদের খুব চেনা—এই রহস্যযজ্ঞের হোতা ডক্টর নলিনাক্ষ বোস!’

সব চোখের তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিমেষে গিয়ে পড়ল ডক্টর বোসের মুখে। সেটা লক্ষ করে রাগে উঠে দাঁড়ালেন নলিনাক্ষ বোস। প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘স্টপ টকিং ননসেন্স, মিস্টার ডিটেকটিভ। ইউ আর আ লায়ার—ড্যাম লায়ার।’

‘আপনিও কিন্তু মিথ্যে কথা বলায় কম যান না, ডক্টর বোস,’ ব্যঙ্গের হাসি হেসে আশিস চৌধুরী বললেন, ‘নইলে এ-কথাটা একবার ভাবেননি কেন যে, ”বোসভিলা”র গোলাপ গাছটার নাম জেফিরিন ড্রাউহিন?’

‘তার মানে?’ নলিনাক্ষ বোস চেঁচিয়ে উঠলেন—সম্ভবত মনের জোর ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু ধপ করে আবার বসে পড়লেন চেয়ারে।

‘তার মানে অতি সরল,’ শান্তস্বরে বললেন আশিস চৌধুরী, ‘আপনার হাতে কোনওদিন ওই গোলাপ গাছ থেকে কাঁটা ফোটেনি, ফুটবে না—ফুটতে পারে না।’ সকলের হতবাক দৃষ্টি তখন আশিস চৌধুরীর দিকে।

‘ইউ নো, ডক্টর বোস,’ আশিস চৌধুরী বলে চললেন, ‘ওই গাছ থেকে কাঁটার আঘাত পাওয়া?—আই অ্যাম হেল্পলেস টু সে দ্যাট ইট ইজ কোয়াইট ইমপসিবল। কারণ, ওই গোপাল গাছটায় কোনও কাঁটা নেই। জেফিরিন ড্রাউহিন গোলাপ গাছে কোনওদিন কাঁটা হয় না।’

ঘরের মধ্যে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।

‘রিয়্যালি?’ সুকর্ণ রায়ের কণ্ঠ সরব হল।

নলিনাক্ষ বোস হায়েনার হাসি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। ওঁর পা দুটো বেঁকে গেল। হাতের আঙুলগুলো গুটিয়ে ধীরে-ধীরে যেন নেকড়ের থাবার চেহারা নিল। মুখ রাগে কুঁচকে গেল। চোখ লালচে হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে, তিনি শয়তানের প্রতিমূর্তির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আশিস চৌধুরীর দিকে। ওঁর কষ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছিল: ‘ইউ ডার্টি ডগ—আই উইল কিল ইউ…।’

আনন্দ সান্যাল আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এলেন। নিজের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটা দখল করে বললেন, ‘আশিস, বাকিটা—।’

ঘরে নলিনাক্ষ বোস ছাড়া সকলেই উপস্থিত । ডক্টর বোসের শূন্য চেয়ারটা দখল করলেন আশিস চৌধুরী, এবং বলতে শুরু করলেন, ‘আমি যখন ”বোসভিলা”য় প্রথম যাই, তখনই আমার চোখে পড়ে গোলাপ গাছটা। দেখে অবাক হয়ে যাই। নন্দনকে আমি সে-কথা বলি। অবশ্য অবাক হওয়ার কারণ হল ওই জাতের গোপাল গাছে কাঁটা হয় না। তা হলে নলিনাক্ষ বোস জবানবন্দিতে আনন্দ সান্যালের কাছে মিথ্যে কথা বললেন কেন? এই সামান্য মিথ্যে কথাটার কি প্রয়োজন ছিল? হ্যাঁ, প্রয়োজন ছিল। সব শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন। এবং এই সামান্য মিথ্যে কথাটা বলার জন্যেই নলিনাক্ষ বোসের ওপর আমার নজর পড়ে।

‘করঞ্জাক্ষ বোসের মার্ডারের ইনভেস্টিগেশানের সময় সকলের লক্ষ ছিল স্যান্ডউইচের দিকে। কিন্তু চায়ের কথা কেউ ভেবেও দেখেননি। প্রথমে আমিও এটা ভাবিনি। বরং আমি মিসেস বোসকেই সন্দেহ করতে শুরু করি। কারণ ওঁর জোরালো মোটিভ। কিন্তু আনন্দের কাছ থেকে ছেঁড়া লেবেলটা পাওয়ার পর সেটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েই আসল রহস্যটা আমার কাছে ক্লিয়ার হয়।

‘ঘটনার দিন চা খেয়েছিলেন দুজন—নলিনাক্ষ বোস আর করঞ্জাক্ষ বোস। যদি মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড ওই চায়েই মেশানো হয়ে থাকে, তা হলে একটা কথা ভেবে দেখুন, মারা যাওয়ার আগে করঞ্জাক্ষ বোস খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এটা কেউই উল্লেখযোগ্য মনে করেননি। আমার ধারণা এটা ওঁর অভ্যেস ছিল। ডক্টর বোস এই সুযোগটাই নিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ”আমি চা ঢেলে দাদাকে দিই আর নিজেও নিই।” করঞ্জাক্ষ বোস তখন খবরের কাগজ পড়ছিলেন। অমিতা বোস চা দিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর বোস তাতে মরফিন মেশান। তারপর সেই চা দুজনে খেলেন। এটা করার কারণ ছিল একটাই। তা হল, সকলের যেন ধারণা হয় মরফিন মিস্টার বোসের পেটে গেছে স্যান্ডউইচের মাধ্যমে, চায়ের মাধ্যমে নয়। অবশ্য চায়ে মরফিন মেশানোর জন্যে ডক্টর বোস একটা বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য প্রায় সফল হতে চলেছিল। কারণ, পোস্টমর্টেম করে বিষ প্রয়োগের মাধ্যম বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু যেহেতু একই চা খেয়ে ডক্টর বোসের কিছুই হয়নি, তাই সবাই ধরে নিলেন, মরফিন মেশানো হয়েছে স্যান্ডউইচে, চায়ে নয়!

‘মরফিন খাওয়ার পর তার অ্যাকশান শুরু হতে কিছুটা সময় লাগে। চা খাওয়ার পর ডক্টর বোস টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে যান। সেখানে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাঁ-হাতের কবজিতে অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের একটা ইঞ্জেকশান নেন। এটা নেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই কাজ শুরু হয়। ডক্টর বোসের পাকস্থলীর সব খাবারই বমি হয়ে যায়। এর ফলে ওঁর আর মারা যাওয়ার ভয় রইল না। বমি করার পর ওঁর শরীর স্বাভাবিক কারণেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই তিনি নিজের ঘরেই বিশ্রাম করতে থাকেন। এরপর অ্যাসপিরিন নিতে এসে অণিমা দেবী ডক্টর বোসের বাঁ-হাতে ইঞ্জেকশান নেওয়ার জায়গায় একফোঁটা রক্ত দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠেন। ডক্টর বোস পড়লেন বিপদে। তিনি বুঝলেন, বউদি এ নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করবে। তাই তাড়াতাড়ি একটা কৈফিয়ত দিয়ে বোঝালেন যে, বাইরের গোলাপ গাছটার কাঁটায় খোঁচা লেগে গেছে। তাড়াতাড়িতে এই ব্যাখ্যাতেই ওঁর মনে এসেছিল। কিন্তু তিনি এটা জানতেন না বা খেয়াল করেননি যে, ওই গোলাপ গাছটার কোনও কাঁটা নেই। এ ছাড়াও চা খাওয়ার আগে কেউই ডক্টর বোসের হাতের ক্ষতটা দেখেননি, কারণ ডক্টর বোস ইঞ্জেকশান নিয়েছিলেন চা খাওয়ার পর। তাই কারও পক্ষে চা খাওয়ার আগে ক্ষতটা দেখা সম্ভব ছিল না।

‘ডক্টর বোস ঘটনার আগের দিন রাতে রটিয়ে দিলেন যে, ওঁর স্টক থেকে মরফিনের একটা ফাইল চুরি গেছে। এতে সন্দেহটা সবার ওপরেই পড়ার সুযোগ পেল। আসলে ওঁর স্টক থেকে কোনও কিছু চুরি যায়নি। অ্যাপোমরফিনের ছেঁড়া লেবেলটা ঘটনাস্থলে কী করে পাওয়া গিয়েছিল তা এখনও আমি জানি না। হতে পারে, ডক্টর বোস ইচ্ছে করেই ওটা ওখানে ফেলে রেখেছিলেন, যাতে ওটাকে মরফিনের লেবেল মনে করে আমরা ধাঁধায় পড়ি। আবার এও হতে পারে যে, ওটা সম্পূর্ণ অজান্তেই ওখানে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু যেভাবেই পাওয়া গিয়ে থাক না কেন, ওই লেবেলটা আর একটা গোলাপ গাছই ডক্টর বোসের সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছে।

‘সবকিছু জানার পরেও আমি ডক্টর বোসের মোটিভ খুঁজে পাইনি। এ বিষয়ে সোমনাথবাবু আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। বাস্তবের সঙ্গে অনুমানকে যোগ করে মোটিভ সম্বন্ধে যে-সিদ্ধান্তে আমি আসতে পেরেছি তার দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, মিসেস বোসকে নলিনাক্ষ বোস ভালোবাসতেন। যার জন্যে তিনি দাদাকে খুন করেছেন। আমার কাছে তিনি মিস্টার বোস সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন যে, ”দাদা, মানুষ ছিলেন না।” এ থেকে আভাস পাওয়া যায় তিনি বউদিকে হয়তো ভালোবাসতেন। দ্বিতীয় যে ব্যাখ্যাটা পাওয়া যায় তা হল করঞ্জাক্ষ বোসের উইল। মিস্টার ঘোষ আমাকে জানান যে, করঞ্জাক্ষ বোস মৃত্যুর দিন-পনেরো আগে উইল পালটেছিলেন। প্রথম উইলে ওঁর সমস্ত সম্পত্তির ওয়ারিশ ছিলেন ডক্টর নলিনাক্ষ বোস। আর দ্বিতীয় উইলে ওঁর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ করেন অমিতা বোসকে। আমরা ভেবেছিলাম যে, খুনটা করেছেন অমিতা বোস, মোটিভ—করঞ্জাক্ষ বোসের উইল। কিন্তু এমনও তো হয়ে থাকতে পারে যে, নলিনাক্ষ বোস উইল পালটানোর কথা না জেনেই খুনটা করেছেন? এ সম্ভাবনাটার কথা আমরা প্রথমে ভেবে দেখিনি। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিল ঠিক তাই। নলিনাক্ষ বোস উইল পালটানোর কথাটা জানতেন না। তিনি ভেবেছিলেন যে, ওয়ারিশ তিনিই আছেন। তাই এক ঢিলে দু-পাখি মারার জন্যে তিনি খুনের ঝুঁকি নিলেন।’ আশিস চৌধুরী থামলেন।

ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই একমনে শুনছিলেন। আশিস চৌধুরী থামতেই আনন্দ সান্যাল বললেন, ‘আশিস, রিয়্যালি ব্রিলিয়ান্ট…।’

অণিমা বোসের বুক ভেদ করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

কয়েকদিন পরের কথা। আশিস চৌধুরী বাড়িতে বসে আছেন। কাছেই একটা মোড়ায় বসে একমনে সেলাই করছেন মোতি চৌধুরী। এমন সময় এসে হাজির হলেন আনন্দ সান্যাল আর অমিতা বোস।

‘কী রে, ব্যাপার কী?’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন আশিস চৌধুরী।

‘এই—এলাম আর কী?’ জবাব দিলেন আনন্দ সান্যাল।

‘বোস। অমিতা, আপনিও বসুন—।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘মিস বোস, আনন্দ দেখছি আসল অপরাধীকে পাকড়াও করেছে!’

কোনও জবাব দিলেন না অমিতা বোস। লজ্জায় চোখ নামালেন।

‘তুই না, একটা ইয়ে…।’ আনন্দ সান্যাল হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠলেন।

‘তা আর হবে না। ভোটে জিতে ভোটারকে আর কে-ই বা মনে রাখে?’ কপট ক্রোধে বললেন আশিস চৌধুরী, ‘মিস বোস তোর মতো একটা আস্ত গাধার মধ্যে কী যে পেল ছাই বুঝি না—।’

এবার চাপা কণ্ঠে প্রতিবাদ করে অমিতা বোস বললেন, ‘আশিসদা, আপনি না ভীষণ বাজে!’

সিলিং-এর দিকে চেয়ে উদাসভাবে কড়িকাঠ গুনতে-গুনতে আড়চোখে মোতির দিকে চেয়ে জবাব দিলেন আশিস চৌধুরী, ‘কেউ-কেউ তা বলে বটে—।’

এ-কথা বলে উচ্চরোলে হাসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মোতির চোখের দিকে চোখ পড়তেই হাসির দমকটাকে গোটাকয়েক ঢোক গিলে চটপট সামলে নিলেন।

আশিসের মুখের অবস্থা দেখে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন আনন্দ সান্যাল আর অমিতা বোস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *