নয়
‘রানা!’ ছায়ার ভিতর থেকে ভেসে এল ফিসফিসানি। উদ্বেগ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সেলেনা। ‘কীভাবে ঠেকাবে ওদেরকে?’
‘এখনও জানি না,’ স্বীকার করল মাসুদ রানা।
‘কারাতের ক্লাসে শেখানো কৌশলগুলো ভালোই মনে আছে আমার,’ তেমনি ফিসফিসাল মেয়েটা। ‘প্রয়োজনে লড়তে পারব তোমার পাশে।
দেখা যাচ্ছে, অতর্কিত হামলার প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে সেলেনা। এখন আত্মরক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ পাচ্ছে ওর কথায়।
কিন্তু আজ এ মুহূর্তে কারাতের চেয়েও বেশি কিছু দরকার দুই মৃত্যুদূতকে মোকাবেলার জন্য।
‘থাকো আপাতত ওখানেই,’ বলল রানা মৃদু কণ্ঠে। ‘খবরদার, ফাঁস করবে না নিজের উপস্থিতি!’
ঝট্ করে পাশে সরে এল ও জানালার কাছে কারও অস্তিত্ব টের পেয়ে।
কমবয়সী লোকটা জানালায় পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অন্ধকারাচ্ছন্ন দালানের মধ্যে, শিকারি পেঁচার মত ডানে-বাঁয়ে জরিপ করছে। জানেও না, সামনেই ছায়ার আড়াল নিয়ে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে ওর শিকার।
জানালার সামনে থেকে সরে সাবধানী পদশব্দ যতক্ষণ না মিলিয়ে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রতীক্ষা করল রানা। সময়টা মনে হলো যন্ত্রণাদায়ক রকমের দীর্ঘ পায়ের আওয়াজ এবার কাছিয়ে আসছে দরজার দিকে।
সেলেনার অবস্থানের দিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রানা। আঁধার কোনায় ঠাহর করতে পারল ভীত চোখ জোড়ার আবছা চাঞ্চল্য।
আরও কিছু একটা ঘাপটি মেরে রয়েছে আবছায়ার মাঝে!
নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ও লম্বা হাতলঅলা বেলচাটার দিকে। দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা ওটা।
কংক্রিটের মেঝেতে যাতে ঘষা না খায় বেলচার ধারাল প্রান্ত, সেদিকটায় সতর্ক রয়েছে রানা। শক্ত মুঠোয় দু’হাতে তুলে নিল জিনিসটা। শুকনো সিমেন্টের কারণে খসখসে হয়ে আছে কাঠের হাতল।
দরজায় উদয় হলো অবয়বটা। কাঁধে অস্ত্র নিয়ে আগে বাড়ল এক কদম, ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে সামান্য কাত করল ঘাড়। ছায়ামূর্তির মত দেখাচ্ছে তাকে বাইরের উজ্জ্বল রোদের বিপরীতে। সূক্ষ্মতম আওয়াজ শোনার আশায় সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা একত্রীভূত হয়েছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে এসে। ভিতরের স্বল্প আলোয় সইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে দৃষ্টি।
না রানা, না সেলেনা – কেউই নড়ল না দালানের অভ্যন্তরে। বিম ঢাকা দেয়া প্লাসটিক শিটের মৃদু ফরফরানি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
আরও এক পা এগোল মানুষটা সন্তর্পণে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তার পর আরেক কদম।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাতাস চিরল বেলচার ফলা। প্রতিক্রিয়ার সময় বা সুযোগ পেল না আগ্নেয়াস্ত্রধারী।
ধারাল কিনারা দিয়ে যদি আঘাত করত রানা, ছুরির পোঁচে সেদ্ধ ডিম কেটে নেয়ার মত দু’ভাগ হয়ে যেত হিটম্যানের খুলি। বদলে ‘ঘটাং’ অনুনাদ তুলে নাকের ব্রিজে আছড়ে পড়ল বেলচার চ্যাপ্টা দিকটা। হাত থেকে ছুটে গিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে গেল এমএক্সফোর। পরমুহূর্তে দড়াম করে মেঝেতে পড়ল ওটার মালিক!
কুঠারের মত অস্ত্রটা দু’হাতে মুঠো করে ধরে লোকটার উপর ঝুঁকে দাঁড়াল রানা। অসংলগ্নভাবে গোঙাচ্ছে বেচারা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখটা। কপালের পাশে নিষ্ঠুর একটা লাথি খেয়ে ঝপ্ করে আঁধার নেমে এল অর্ধচেতন লোকটার চারপাশে।
সাব-মেশিন গানটা কুড়িয়ে নিল রানা। স্থূলকায় অস্ত্রটার ব্যারেলের শেষ প্রান্তে বড়সড় এক সাউণ্ড সাপ্রেসর লাগানো। এখনও বারো রাউণ্ড গুলি রয়েছে পিস্তল গ্রিপ ম্যাগাজিনে, চেম্বারে আরও একটা।
আগ্নেয়াস্ত্রটা এক পাশে সরিয়ে রেখে ত্বরিত হাতে আততায়ীর পকেট চেক করল ও। মোবাইল, আইডি, ওয়ালেট—না, কিচ্ছু নেই। এমনকী নেই কোনও খুচরো পয়সাও। বেল্টের লেদার পকেটে শুধু গাড়ির ইগনিশন কি আর একখানা পাউচের মধ্যে বাড়তি দুটো তিরিশ রাউণ্ডের স্টিল ম্যাগাজিন পাওয়া গেল।
কখন জ্ঞান আসবে বাছাধনের, কখন তাকে জেরা করবে, সেই অনিশ্চয়তায় বসে থাকার উপায় নেই এখন; ফার্স্ট প্রায়োরিটি এ মুহূর্তে সেলেনার নিরাপত্তা।
চাবি আর ম্যাগাজিন দুটো নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল রানা। সাব-মেশিন গানটা তুলে নিয়ে অজ্ঞান শরীরটা টপকে আগে বাড়ল। দরজার কাছ থেকে আশপাশটা দেখে নিয়ে ইশারা করল মেয়েটাকে: চলো, বেরোই!
বিল্ডিং আর কনস্ট্রাকশন প্ল্যান্ট মেশিনারির চিপাচাপা দিয়ে চলেছে ওরা এঁকেবেঁকে। লক্ষ্য: বেড়ার ফটক।
বড় কঠিন কাজ। কিন্তু ভাগ্য সহায় থাকলে ফটক আর মাঠ পেরিয়ে ফের পৌঁছে যাবে ভক্সলের কাছে, দ্বিতীয়জন কিছু টের পাওয়ার আগেই। ভাগ্যিস, বেরেটাটা রয়েছে! ওটা যেন পুরানো দোস্ত রানার, অন্ধের যষ্টি হয়ে এসেছে বিপদের সময়ে।
কয়েক কদম করে এগিয়েই পিছনটা একবার দেখে নিচ্ছে ও। শত্রু আর সেলেনার খেয়াল রাখার জন্য। সামান্য খোঁড়াচ্ছে এখনও মেয়েটা, অদম্য মনোবলে চলেছে তবু রানার ছায়াসঙ্গী হয়ে।
চষা একটা অপরিচ্ছন্ন এলাকা অতিক্রম করল দু’জন। ভবিষ্যতে হয়তো বাগিচায় রূপ দেয়া হবে জায়গাটা। এর পর এগোল ভারা-বাঁধা দুই দালানের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ অলিপথ ধরে। বাঁয়ের বিল্ডিংটার কোণের কাছে আসতেই দৃষ্টিসীমায় এল শেকলভাঙা গেটটা। মাত্র তিরিশ গজ দূরে ওটা। মাঝে এক টুকরো খোলা জমিন।
অত্যন্ত সতর্কতায় কোনা থেকে একটা চোখ বের করল রানা। স্তূপ করে রাখা কংক্রিটের ব্লক দেখতে পাচ্ছে ও হাতের ডানে। এবার বাঁয়ে তাকিয়ে অর্ধনির্মিত দেয়াল এবং আরও কিছু ফাঁকা দালানের মাঝে ধরা পড়ল না কোনও ধরনের নড়াচড়া। পথ মনে হচ্ছে পরিষ্কার।
‘এসো,’ অভয় দিল ও সেলেনাকে।
আড়াল ছেড়ে এক কদম বেরোতেই বাঁ দিকের দালানের কোনা থেকে ছুটে এল একটা বুলেট। বাম ঊরুতে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার জোগাড় হলো রানার। পরমুহূর্তে কানে এল গুলির তীক্ষ্ণ শব্দ:
‘কড়াৎ!’
কী ঘটেছে টের পেয়ে চিৎকার করে উঠল সেলেনা: ‘কী হলো, রানা?’