শকওয়েভ – ৫৮

আটান্ন

প্রথমটায় মনে হয়েছিল রানার, আবার ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরেক দফা মারধরের জন্য। ধীরস্থিরভাবে পা ফেলছে ও। যন্ত্রণা, ভয়, এমনকী দুর্বলতার সামান্যতম চিহ্ন দেখাতে ইচ্ছুক নয়। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে এনসিও-র পিস্তলটার বাঁটের দিকে। স্রেফ ছোঁ মারার দূরত্বে রয়েছে হোলস্টারের বাইরে বেরিয়ে থাকা বাঁটটা।

মনের মাঝে স্লো মোশনে দেখে নিচ্ছে রানা, ঠিক কীভাবে ব্যবহার করবে পিস্তলটা। অফিসারের কপালে নয় মিলিমিটারের নিখুঁত টিপটা পরিয়ে দেয়ার আগে হত্যা করবে ও চার সৈন্যের প্রত্যেককে। হাত রীতিমত চুলবুল করছে ওর। দ্রুত হতে শুরু করেছে হৃৎস্পন্দন।

এনসিও-র বেল্টে একটা রিং থেকে ঝুলছে সেলের চাবিগুলো।

হয়তো… ভাবছে রানা। হলেও হতে পারে উপায়…

কিন্তু ওর বেপরোয়া, বিপজ্জনক চিন্তাটা বাদ দিতে হলো, যখন বুঝতে পারল, অত্যাচারের জন্য নেয়া হচ্ছে না ওকে। কমাণ্ড বেইসে আনার পর প্রথম যে-অফিস-কক্ষটায় ঢোকানো হয়েছিল, সেটার সামনে এসে উপস্থিত হলো ওরা।

দরজায় ঠেলা দিল অফিসার।

কামরায় প্রথম যেটা চোখে পড়ল রানার, সেটা হলো সেলেনার চেহারা। ঘুরে তাকিয়ে ওকে ভিতরে আসতে দেখে বিস্ফারিত হলো মেয়েটার চোখ, ভাংচুর শুরু হলো মুখটায়।

‘হায়, যিশু!’ কান্না চেপে রাখতে পারল না সেলেনা। ‘এ কী অবস্থা করেছে ওরা তোমার!’

‘ও কিছু না,’ এত কিছুর পরেও হাসির চেষ্টা করল রানা। যদিও কষ্ট হচ্ছে মুখ খুলতে।

কারও বাসায় প্রথম আসা মেহমানের মত কামরার চারদিকে নজর বোলাল ও অপরিচিত আরও পাঁচ সৈন্য পাহারা দিচ্ছে ওদেরকে।

কিন্তু একজন অনুপস্থিত এখানে।

‘মিস্টার ভিকান্দার কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘আটকা পড়ার পর থেকে আর দেখিনি লোকটাকে।’

সহসাই ব্যস্ততা দেখা গেল সৈন্যদের মাঝে। মুখ বন্ধ রাখার হুকুম দেয়া হলো বন্দিদের। অস্ত্রের মুখে দেয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল ওরা রানা-সেলেনাকে।

ধনুকের ছিলার মত টান টান পরিবেশ। এনসিও আর ওর বশংবদরা যেন অপেক্ষা করছে কোনও কিছুর জন্য। ওয়েটিং ফর গড়ো…

অথবা কারোর।

খুলে গেল আরেকটা দরজা। কর্নেলের ইনসিগনিয়া পরা বছর পঞ্চাশের বেঁটে-মোটা এক ইন্দোনেশিয়ান অফিসার হেঁটে এল কামরায়। চেহারাটা হনুমানের মত।

ঝটাং করে স্যালুট ঠুকল এনসিও। অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল সৈন্যরা, বন্দিদের উপর থেকে নজর ও গানসাইট না সরিয়ে যতখানি পারা যায়।

কিন্তু ইন্দোনেশীয় আর্মি অফিসারকে দেখছে না রানা। চোখ দিয়ে গিলছে ও কর্নেলের সঙ্গে কামরায় প্রবেশ করা আরেকজনকে। অশুভ একটা ছায়া পড়ল মনের উপর। অবাস্তব, ভৌতিক লাগছে লোকটার নীরব উপস্থিতি।

মিলিটারি কস্টিউম নেই দ্বিতীয়জনের পরনে। স্রেফ সাদামাটা অ্যাশ-কালারের শার্ট আর ট্রাউযার। অথচ এনসিও আর সৈনিকগুলো এমনভাবে সম্মান দেখাচ্ছে তাকে, যেমনটা দেখিয়ে থাকে উঁচু র‍্যাঙ্কের কোনও অফিসারকে।

‘আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি?’ বলল সেলেনা ফিসফিস করে। কেউ যেন ছুরি বসিয়ে দিয়েছে ওর বুকের মধ্যে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কর্নেলের সঙ্গীর দিকে। ‘কীভাবে সম্ভব এটা?’

ভিন্ন মানুষ বলে মনে হচ্ছে এখন গুস্তাফ ভিকান্দারকে। অভিনয় খতম হয়েছে তার। ভয়কাতুরে, স্নায়ুবিকারগ্রস্ত খোলসটা ত্যাগ করেছে।

প্রশান্ত, কর্তৃত্বপরায়ণ অভিব্যক্তি লালচে চেহারাটায়, যেটা ওরা চাক্ষুষ করেনি আগে। দাঁড়িয়ে আছে সিনা টান করে। এমনকী বদলে গেছে লোকটার হাঁটার ভঙ্গিও।

সত্যিকারের গুস্তাফ ভিকান্দারকে দেখছে এখন রানা- সেলেনা।

রানার থেঁতলানো মুখটার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল লোকটা। মাথা নাড়ল কপট সহানুভূতিতে।

‘নর্দমার বিষ্ঠা!’ হিসিয়ে উঠল সেলেনা। চটাস করে চাপড় মেরে সরিয়ে দিল এক সৈনিকের রাইফেলের মাযল। ‘সরাও এটা সামনে থেকে!’ চেঁচিয়ে উঠল চিলের মত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে।

গটগট করে এগিয়ে গেল সে গুস্তাফের দিকে। দৃষ্টির আগুনে ভস্ম করে দেবে যেন নেমকহারামটাকে।

রে-রে করে উঠে, পিঁপড়ার মত চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরল ওকে সৈন্যরা। হুকুমের আশায় তাকাল ওদের সেনানায়কের দিকে। ইশারা পেলেই গুলি করবে।

হস্তক্ষেপ করল স্বয়ং ভিকান্দার। নড করল আমি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে অধস্তনদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিল অফিসার চাঁছাছোলা স্বরে।

তৎক্ষণাৎ তামিল হলো হুকুম। পরিষ্কার হয়ে গেল, কার হাতে রয়েছে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব।

তেলতেলে মসৃণ হাসি নিয়ে সেলেনার দিকে তাকাল গুস্তাফ ভিকান্দার। ‘চমকটা কেমন দিলাম, বলুন তো!’ এমনকী বদলে গেছে লোকটার বাচনভঙ্গিও। পুরোপুরি মার্কিনি উচ্চারণ এখন।

‘আর্টা বিচের ব্যাপারে যা যা বলেছেন, সব তা হলে মিথ্যা?’ রাগে ফুঁসছে সেলেনা। ‘সব ব্যাপারেই বানোয়াট তথ্য দিয়েছেন! আপনিও ওদেরই লোক… বরাবরই!’

চওড়া হলো গুস্তাফের হাসি। ‘না, মিস বার্নহার্ট, সব কথা মিথ্যে বলিনি আমি। গোপন ওই ঘাঁটির অস্তিত্ব যে আছে, নিশ্চিত থাকুন সে-ব্যাপারে। আসলে, এ কারণেই ইন্দোনেশিয়ানদের কাস্টডি থেকে মুক্ত করা হয়েছে আপনাদের। এক্ষুণি ছোট্ট একটা ট্রিপ দিচ্ছি আমরা আর্টা বিচের উদ্দেশে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *