1 of 2

শকওয়েভ – ৫

পাঁচ

গ্রামের ভিতর দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথটুকু সামান্যই কথা হলো ওদের।

ভক্সলটা ছেড়ে দিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল পার্ক সংলগ্ন ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলল রানা-সেলেনা। পরিবেশটা মনোরম।

সেলেনার টেনশন যেন একটু হলেও সংক্রমিত হয়েছে রানার মাঝেও। সেলেনাকে যা-ই আতঙ্কিত করে থাকুক না কেন—মনে হচ্ছে, এক বিন্দু আতিশয্য নেই তাতে।

হয় অসময়ের সূর্যতাপ, নয় তো ইংরেজ ছেলেপিলেদের নয়া এই প্রজন্মন্টা কমপিউটার-গেমসেই বেশি অনুরক্ত বলে উদ্যানটা প্রায় জনশূন্য। শুধু ছোটখাটো গড়নের সুন্দরী এক তরুণী মাকে দেখা যাচ্ছে দূরের দোলনাগুলোর কাছে। পাঁচ- ছয় বছরের বাচ্চাটাকে তুলে বসিয়ে দিল দোলনায়।

ভঙ্গুর চেহারার বয়স্ক এক দম্পতি হাতে হাত রেখে মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছিলেন ফুটপাথ ধরে। পাশ কাটানোর সময় হাসলেন তাঁরা রানাদের দিকে চেয়ে। শুভেচ্ছা জানালেন ‘শুভ দিন’ বলে।

রানাও জানাল পাল্টা শুভকামনা।

প্রসন্ন চিত্তে নিজেদের পথে চলে গেলেন বুড়ো-বুড়ি।

শেওলা ধরা পাথরের পাঁচিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে ফুটপাথটা। পাঁচিলের ওপাশে লাগানো গাছপালার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে দূরবর্তী অর্ধনির্মিত দালানকোঠা আর হেভি মেশিনারিগুলো। সাইটের জালের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ট্রান্সপোর্টগুলো। আজ মনে হয় সকাল সকালই প্যাক-আপ হয়ে গেছে ওদের কাজকর্ম। গ্রামবাসীদের ক্রমাগত আপত্তি-প্রতিবাদ ও আবেদন স্থানীয় কাউন্সিল নাকচ করার পর নতুন করে হাউসিং এস্টেট গড়ে তুলছে ওখানে কোম্পানি।

‘বসা যাক কোথাও,’ আরও কিছু দূর এগোনোর পর বলে উঠল রানা। আঙুল তুলে দেখাল একটা কাঠের বেঞ্চের দিকে। কাস্ট আয়ার্নের খুঁটির সঙ্গে স্ক্রু আঁটা দুটো তক্তা।

মাথা দুলিয়ে সেদিকে পা বাড়াল সেলেনা।

বসল ওরা পাশাপাশি। বাচ্চাটা দোল খাচ্ছে যেখানে, তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। আনন্দিত শিশুটির অনাবিল হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা।

‘শুরু থেকে শুরু করো।’

রানার ইঙ্গিত পেয়ে গড়গড় করে বলতে শুরু করল সেলেনা বার্নহার্ট।

‘বছর কয়েক আগে যখন শিক্ষকতা করতাম প্যারিসে, তখন থেকে পরিচয় আমার ক্যারেনের সঙ্গে। সরবান ইউনিভার্সিটির লেকচারার ছিল তখন মেয়েটা। মিউচুয়াল এক ফ্রেণ্ডের মারফত আলাপ হয় আমাদের। দু’জনের চিন্তাধারা- আদর্শ মিলে যাওয়ায় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি ধীরে ধীরে।

‘বেশ চলছিল। প্যারিসের পাট চুকিয়ে এক সময় যখন চলে গেলাম ক্যানাডায়, তখনও যোগাযোগ ছিল আমাদের। জন্মদিন, উৎসবে মাঝে মাঝেই ফোন করত ক্যারেন, কিছু দিন পর পর ই-মেইলে জানাত ওর বর্তমান রিসার্চ সম্পর্কে। সেগুলোর কোনও-কোনটা ছিল সত্যিই কৌতূহল জাগানোর মত। আগ্রহ দেখিয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইতাম আমি।

‘বেশ কিছু দিন ওর কাছ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবলাম, ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হয়তো অন্য কিছু নিয়ে। তার পরই রেজিস্টার্ড মেইলে চিঠি পেলাম গত কাল। রাতেই প্যারিসের পথে রওনা হয়ে যাই আমি। …অবাক লেগেছিল, জানো?’

‘কেন?’

‘ই-মেইল না করে চিঠি লিখেছে বলে। অবশ্য চিঠি না বলে চিরকুট বলাই ভালো ওটাকে। খোলার পর বুঝতে পারছিলাম, খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠিটা লেখা হয়েছে খুবই তাড়াহুড়ো করে।

‘অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে, নিশ্চিত ছিল ক্যারেন। নজর রাখা হচ্ছিল ওর প্রতিটি গতিবিধির উপর। খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে ওর, আঁচ পাচ্ছিল মেয়েটা। অনুসরণকারীরা টের পেয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ফোনে বা ই-মেইলে কনট্যাক্ট না করার অনুরোধ করেছে আমাকে চিঠিতে।’

‘কাদের কাজ এটা?’ রানার জিজ্ঞাসা।

‘জানলেও, লেখেনি চিঠিতে।’

‘দেখতে পারি—সঙ্গে এনেছ চিঠিটা?’

মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘না, ওটা আর আমার কাছে নেই।’

‘কেন? হারিয়ে ফেলেছ?’

‘প্যারিস পুলিসের জিম্মায় রয়েছে ওটা।’

‘ও। তো, যা বললে, ওটুকুই? আর কিছুই লেখেনি চিঠিতে?’

‘লিখেছে।’ ক্লিষ্ট হাসল সেলেনা। ‘সাহায্য চাইছিল আমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, দেখা করতে বলেছিল প্যারিসে গিয়ে… বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।’

‘কীসের সঙ্গে জড়িয়েছে, উল্লেখ করেনি সেটা? কোনও আভাস-ইঙ্গিত?’

‘এক বর্ণও না। শুধু লিখেছে, পৃথিবীতে যে-দু’জন মানুষের উপর ভরসা রাখতে পারে, তাদের একজন নাকি আমি। সেজন্যে সামনাসামনি খুলে বলবে সব কিছু।’

‘পুলিসকে জানায়নি কেন?’ প্রশ্নটা সঙ্গত।

‘আছে হয়তো কারণ। চাইলেও যাওয়ার উপায় ছিল না হয়তো পুলিসের কাছে। দ্রুত লেখার কারণে হিজিবিজি হয়ে গেছে চিঠির শেষ লাইনটা: ‘যদি কিছু ঘটে’। ব্যস, এটুকুই। নিচে এক গাদা সংখ্যা আর অক্ষর। নিজের নামটা পর্যন্ত লেখেনি ও চিঠিতে! বুঝতে পারছ, কেমন তাড়ায় ছিল মেয়েটা?’

‘সংখ্যা? অক্ষর?’ আগ্রহ বাড়ছে রানার।

হ্যাণ্ডব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল সেলেনা, তুলে দিল রানার হাতে। দুমড়ে গেছে কাগজটা।

‘পুলিসকে দেয়ার আগে কপি করে নিয়েছি ওই অংশটুকু… যদিও এখন পর্যন্ত আইডিয়াই করতে পারিনি, কী হতে পারে লেখাটার মানে।

দেখল রানা কাগজটা। পড়ল লাইন তিনটে

4920N।570E
3।57
।82554।।92

কোনও ধরনের সাইফার নাকি?

সঙ্কেত-টঙ্কেত প্রিয় বিষয় নয় রানার। পত্রিকা পড়ার সময় সযত্নে এড়িয়ে যায় ও ক্রসওঅর্ড বা সুডোকু-জাতীয় পাজলগুলো। অথচ খেয়াল করে দেখেছে, এ ধরনের সমস্যাগুলোই বার বার এসে হাজির হয় ওর সামনে। এই যেমন এখন।

কয়েক মুহূর্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রানা কাগজটার দিকে। বাংলা পাঁচের মত বানিয়ে রেখেছে মুখের চেহারাটা।

শেষমেশ যখন হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবতে যাচ্ছিল: এ জিনিস ডিকোড করা ওর কম্ম নয়, তক্ষুণি বিদ্যুৎ-ঝলকের মত অর্থবোধক চেহারা নিয়ে ধরা দিল প্রথম লাইনের অক্ষরগুলো। আর্কিমিডিসের অবিস্মরণীয় চিৎকার ধ্বনিত হলো মনের মাঝে: ইউরেকা!

নর্থ আর ইস্ট ওগুলো! উত্তর আর পূর্ব!

‘বাকিটা এখনও অন্ধকারে,’ বলল রানা সেলেনাকে ব্যাখ্যা করার পর। ‘কিন্তু নিঃসন্দেহে শুরুর লাইনটা ভৌগোলিক কোনও লোকেশনের জিপিএস কো-অর্ডিনেট নির্দেশ করছে।’

‘নিশ্চিত তুমি?’ অথই সাগরে কূল পেয়েছে যেন মেয়েটা।

‘হানড্রেড পারসেন্ট।’

‘কোন্ জায়গার কথা বলা হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে সেটা?’

‘তা যাচ্ছে না অবশ্য। তবে ওটা কোনও ব্যাপারই নয়। ইণ্টারনেটে সার্চ দিলে কয়েক সেকেণ্ডের মামলা। পরে দেখব, কোন্ জায়গা। আপাতত যা বলছিলে, বলে যাও।’

‘হ্যাঁ…’ শুরু করল আবার সেলেনা। ‘চিরকুট পেয়েই সব কাজ ক্যানসেল করে রওনা হয়েছিলাম প্যারিসের পথে। শেষ ফ্লাইটটা ধরতে পেরেছি কোনও রকমে।

‘একটা কাজই করার ছিল প্লেনে বসে। হতচ্ছাড়া সংখ্যাগুলোর পাঠোদ্ধারের চেষ্টা। আগেই বলেছি, লাভ হয়নি কোনও।

‘সাতটার ঠিক পর পর প্যারিসে পৌঁছুই আমি। একটা ক্যাব নিয়ে সোজা চলে যাই ক্যারেনের অ্যাপার্টমেন্টে। একলাই থাকত ও মনমাট্রার ক্যু দে টোস ফেয়াস-এ ধ্যাদ্দেড়ে এক পুরানো বিল্ডিঙের টপ ফ্লোরে।

‘গিয়ে দেখি, পুলিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দালানের বাইরে। তখনও সরেজমিন তদন্ত চলছে ওদের। শুরুতে কোনও হেলদোল হয়নি আমার। সিঁড়ির দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছি, বিল্ডিঙের কেয়ারটেকারের সঙ্গে নামতে দেখলাম পুলিস আর ফরেনসিকের লোকদেরকে। জিজ্ঞেস করলাম, কোনও ধরনের গণ্ডগোল হয়েছে কি না।

‘কার কাছে এসেছি, জানতে চাইল ওরা। নাম বললাম বান্ধবীর। এর পরই জানতে পারলাম সব কিছু।’

চুপ করল। ওকে ভাবাবেগ সামলে নেয়ার সময় দিল রানা।

‘প্রতিবেশী মাদাম গোলতিয়েই খুনের পরের দিন সকালে লাশটা দেখতে পান। খোলা ছিল অ্যাপার্টমেন্টের দরজা, খাটের পাশে মেঝেতে পড়ে ছিল ডেড বডি। উহ… কী করুণভাবে মরতে হলো মেয়েটাকে… চিন্তা করতে পারো, রানা! এতটাই শকড হয়েছে মাদাম গোলতিয়েই, হাসপাতালে নিতে হয়েছে তাকে।’

‘হ্যাঁ, মেনে নেয়া কঠিন,’ স্বীকার করল রানা। ‘অন্তরে বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা।

অশ্রু মুছল সেলেনা। ফোঁত করে নাক টেনে, বলতে শুরু করল আবার।

‘চিঠিতে যে-পোস্টমার্ক দেয়া ছিল, ওই একই দিনে মারা গেছে আমার বান্ধবী। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেই বোধ হয় পোস্ট করা হয়েছিল চিঠিটা।

‘একা থাকত, বললে। তা, ওর পরিবার?’

‘বহু দিন ধরেই যোগাযোগ ছিল না পরিবারের সঙ্গে। সায়েন্স নিয়ে ক্যারিয়ার গড়বে মেয়ে, এতে অনুমোদন ছিল না গোঁড়া ধার্মিক বাপ-মায়ের।’

‘বয়ফ্রেণ্ড-টয়ফ্রেণ্ড?’

মাথা ঝাঁকাল সেলেনা। ‘ওর জীবনে একমাত্র পুরুষ বলতে ছিল গ্যাসপার নামে নিষ্কর্মা এক ছোকরা। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ওদের। কিন্তু যখন সম্পর্ক ছিল, সশরীরে ক্যারেনের আশপাশে কোথাও দেখা যায়নি লোকটাকে। অদ্ভুত না? সে- কারণেই এখন পর্যন্ত ট্রেস করতে পারেনি ওকে পুলিস।

‘ক্যারেনের এক কলিগ মর্গে আইডেন্টিফাই করে লাশটা। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাকে করতে হয়নি এই কাজটা!’

শিউরে উঠল সেলেনা। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইল যেন কল্পনায় ফুটে ওঠা মৃত দেহের বীভৎস ছবিটা।

‘ডিএনএ, ইত্যাদি এভিডেন্সের জন্যে চিরুনি-তল্লাশি চলছিল অ্যাপার্টমেন্টে। চুরি-ডাকাতির কেস যে না, সেটা পরিষ্কার। কে আমি, কেন গেছি ওখানে — স্বাভাবিকভাবেই জানতে, চেয়েছে এসব পুলিস। সেসময় দেখাই ওদের চিঠিটা।

‘ক্যারেন যে বিপদের আভাস পেয়েছিল, বিষয়টাকে গুরুত্বই দিল না ওরা। ওদের একমাত্র মাথাব্যথা ছিল রিপেয়ারম্যানকে নিয়ে।

‘এক ফাঁকে আলাপ করি কেয়ারটেকার মাদাম বার্দোর সঙ্গে। মহিলাকে নিজের নাম্বার দিয়ে অনুরোধ করি, তদন্তের অগ্রগতি হলে তখুনি যেন ফোন করে জানায় আমাকে।

‘আর তখনই লক্ষ করি আবার লোকটাকে!’ নাটকীয় একটু বিরতি দিল সেলেনা।

‘কার কথা বলছ?’ চোখ জোড়া সরু হয়ে এসেছে রানার।

‘খাটো। কালো চুল। পঁয়তিরিশ থেকে চল্লিশের ঘরে বয়স। প্রথমে ভেবেছিলাম, সাদা পোশাকের পুলিস বুঝি। ইউনিফর্ম পরা পুলিসের লোকেরা যখন জেরা করছিল আমাকে, ঘুরঘুর করছিল আশপাশেই। তার পর কেয়ার- টেকারের সাথে আলাপের সময় দেখি দ্বিতীয় বার।

‘অবশ্য খুব একটা পাত্তা দিইনি তখন বিষয়টা নিয়ে। ভদ্রমহিলাকে ভিজিটিং কার্ড দিয়েই চলে আসি ওখান থেকে।

‘হাঁটছিলাম আমি। বন্ধুর নৃশংস মৃত্যুতে নাড়া খেয়ে গিয়েছিলাম ভীষণ। কোথায় রয়েছি, কোথায় চলেছি—কিছুই খেয়াল করার অবস্থা ছিল না। অবচেতনভাবে ঢুকে পড়ি একটা মেট্রো স্টেশনে। অ্যাব্যাসেস সম্ভবত। ওখানেই তৃতীয় বারের মত দেখতে পেলাম লোকটাকে!

‘অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল সে আমার দিকে। টানেল আর এসকেলেটরে জোঁকের মতন লেগে রইল সে আমার পিছনে। আমি যে তাকে চিনে ফেলতে পারি, সেরকম কোনও সতর্কতা দেখিনি লোকটার আচরণে। থাকলে, দেখা দিত না ওভাবে।

‘হাঁটতে লাগলাম আমি। পিছন পিছন আসছিল সে-ও। চেষ্টা করলাম ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয়ার। ভেবেছিলাম, সফল হয়েছি কাজটায়। কারণ, প্ল্যাটফর্মে ওঠার পর দেখা গেল না আর জোঁকটাকে।

‘ভাবছিলাম, ফলো করার বিষয়টা আমার কল্পনা কি না। কিন্তু ট্রেনটা যেই প্রবেশ করল প্ল্যাটফর্মে, তক্ষুণি আবার উদয় হলো ব্যাটা কোত্থেকে জানি! নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। এবার জাস্ট কয়েক কদম দূরে। …প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, জানো!’

‘কিছু কি করেছে লোকটা?’ রানার প্রশ্ন।

‘তা অবশ্য করেনি। এমনকী একটি বারের জন্যেও কাছে আসেনি, কিংবা কথা বলার চেষ্টা করেনি আমার সঙ্গে।

‘লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি আমি। একই কাজ করে সে-ও। সরাসরি তাকাইনি একবারও লোকটার দিকে, তবে ক্যারিজের জানালায় দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিচ্ছবি। একই বগিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল দূরত্ব বজায় রেখে, ভয় ধরানো বিচিত্র দৃষ্টিতে দেখছিল আমাকে। সেফটি স্ট্র্যাপ ধরা ছিল এক হাতে। চেইন খোলা জ্যাকেটের তলায় অস্ত্র ছিল একটা, টের পেয়েছি… কালো একটা হ্যাণ্ডগান—গ্লক অথবা অন্য কিছু।’

সেলেনার প্রথম ধারণাটাই ঠিক, মনে হলো রানার। প্লেইন-ক্লোদ ফরাসি পুলিসের দিকে আঙুল তুলছে ঘটনার বর্ণনা। ওর অভিজ্ঞতা বলে, বরাবরই সাইড-আর্মস লুকিয়ে বহন করে ওরা শোলডার হোলস্টারে। কখনও কখনও এমনকী ডিউটি না থাকলেও।

কিন্তু কোনও মন্তব্য করল না।

কথা চালিয়ে গেল মেয়েটা।

‘শঙ্কায় ছিলাম, কখন না আবার ফাঁকা হয়ে যায় ক্যারিজ… একা হয়ে পড়ি রহস্যময় লোকটার সঙ্গে। অপেক্ষা করলাম ক’টা স্টপ পর্যন্ত, তার পর সুযোগ বুঝে নেমে গেলাম সেইন্ট-জর্জেসে।

‘মিস্টার সুপারগ্লুও একই কাজ করল। ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ সময় সিনেমায় দেখা ট্রিক খাটালাম আমি। স্টেশনে নামা প্যাসেঞ্জারদের ঠেলে-ধাক্কিয়ে ফের উঠে পড়লাম ক্যারিজে, এক্কেবারে সময়মত। বেকুবের মতন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল জনাব আঠা। টা-টা দিতে দিতে বেরিয়ে গেলাম আমি।’

‘তার পর?’

‘ঘটনা এখানেই শেষ। ট্রেনে চেপেই গেলাম আমি কনকর্ড পর্যন্ত। ক্যারিজ থেকে নেমেই কুকুরের তাড়া খাওয়া মানুষের মত ছুটতে শুরু করলাম স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। একটা ক্যাব চোখে পড়া মাত্র ডাক দিলাম ওটাকে।’

এক সেকেণ্ড নীরব রইল রানা। তার পর বলল, ‘হুম্।’ সাপের মত ফোঁস করে উঠল সেলেনা। ‘হুম্ মানে? কী শুনতে চেয়েছিলে তুমি? পিস্তলের মুখে অপহরণের চেষ্টা করেছে আমাকে? মারধর করেছে লোকটা ট্রেনের ভিতর?’

‘ঠিক তা নয়—’

‘ওখানে ছিলে না তুমি, রানা!’ অনুযোগের মত শোনাল কথাটা। ‘কী যে ভয় পেয়েছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না তোমাকে! তখন তখনই মনে হলো, যোগাযোগ করি তোমার সঙ্গে। তোমার দেয়া নাম্বারে ফোন করে যখন জানতে পারি, লিটন ডেণ্টনে রয়েছ তুমি, দেরি না করে উঠে পড়ি পরবর্তী ইয়োরোস্টারে।

‘কয়েক ঘণ্টা আগে লণ্ডন পৌঁছেছি আমি, ভাড়া করেছি ভক্সলটা। খেপার মতন ড্রাইভ করে এসেছি সারাটা পথ। এক সাগর আকুতি ঝরছে যেন ডাগর চোখ দুটো থেকে। ‘প্লিজ, রানা… সাহায্য করবে না আমাকে?’

আরও একটা মুহূর্ত নীরব থাকল রানা।

‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আভাসে-ইঙ্গিতে বান্ধবীর খুনি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছ লোকটাকে,’ মন্তব্য করল ও।

‘হতে পারে না?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দাবি করল সেলেনা।

‘একটু চিন্তা করে দেখো,’ বলল রানা আপত্তির সুরে। ‘সিরিয়াল কিলার হয় কী করে ওই লোক? সত্যিই কি বিশ্বাস করো, সাদা পোশাকের পুলিসের ছদ্মবেশে ক্রাইম সিনে থাকবে অতক্ষণ রিপেয়ারম্যান, কিংবা যে-ই হোক না কেন লোকটা-পরবর্তী শিকার বেছে নেয়ার ধান্দায়? ম্যানিয়াক হতে পারে, কিন্তু অতটা পাগল বোধ হয় নয়।’

অধৈর্যের সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল সেলেনা। ‘আমি যেটা বিশ্বাস করি… পুরোপুরি বোগাস এই সিরিয়াল কিলার থিয়োরি । ছাতার কোনও রিপেয়ারম্যান খুন করেনি ক্যারেনকে। সেট-আপ ওটা, বুঝতে পারছ না তুমি? পুলিসকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার টেকনিক। ভুল দিকে পা বাড়াবে ওরা, আর এই সুযোগে… ও কী, রানা… ওভাবে তাকাচ্ছ কেন আমার দিকে?’

‘কই, না তো… কীভাবে তাকাচ্ছি?’

‘তোমার চাউনি দেখে মনে হচ্ছে, কোনও ধরনের ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের গালগল্প ফাঁদতে চলেছি আমি।’

‘না, সেলেনা,’ বলল রানা মাথা নেড়ে। ‘সেরকম কিছুই ভাবছি না আমি। ভাবছি, কথিত ওই রিপেয়ারম্যান যদি না মেরে থাকে, তবে কার হাতে খুন হলো তোমার বান্ধবী?’

‘কার না, বলো— কাদের!

‘কাদের?’

‘কাদের আবার-ওদের! ওভাবেই সব সময় কাজ করে ওরা… পথের কাঁটা যখন দূর করতে চায়।’

‘বুঝতে পারছি না, কাদের কথা বলছ!’

‘সরকারি গোপন সংস্থা!’ মহারহস্যের মোড়ক উন্মোচন করল যেন, এমনিভাবে নেচে উঠল সেলেনার চোখের মণি।

‘এবার কিন্তু সত্যিই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের মত শোনাচ্ছে।’

‘আমার থিয়োরির কথা বললাম আমি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। হাত নাড়ল রানা। ‘তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম তোমার কথা। এখন তা হলে বলো: কেন তোমার পিছু নেবে ওরা?’

‘জানি না, রানা… কিচ্ছু জানি না!’ ভেঙে এল গলাটা। রীতিমত অসহায় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ‘পরিস্থিতি মোটেই ভালো ঠেকছে না আমার!’

‘আমার পরামর্শ যদি শোনো… পুলিসের বক্তব্য মেনে নেয়াটাই তোমার জন্যে সহজ সমাধান।

‘কবে থেকে পুলিসের প্রতি ভক্তি জন্মাল তোমার, রানা?’ ফুঁসে উঠল সেলেনা। ‘আমি তো জানতাম, আমার চেয়েও কম আস্থা রাখো তুমি ওদের উপর। একটু চিন্তা করে দেখো,’ বলল ও রানার সুর নকল করে। ‘বিষয়টা যে অতখানি সাধারণ নয়, চিঠিটাই তো তার অকাট্য প্রমাণ।

ওই চিঠি বা চিরকুট নেই এখন আমাদের হাতে। আর থাকলেও ও-দিয়ে কিছু প্রমাণ হতো না।’

‘বিপদের ইঙ্গিত দিয়েছিল ক্যারেন, এটা কোনও প্রমাণ নয়?’ একটুখানি অভিমান ফুটল যেন কণ্ঠে।

‘সিরিয়াল কিলারের থিয়োরিটা কিন্তু মোটেই অযৌক্তিক নয়, সেলেনা,’ আবারও পুলিসের পক্ষ নিল রানা।

‘শুনি একটু যুক্তিগুলো!’ বলল সেলেনা তির্যক ভঙ্গিতে।

‘খুনি যদি এখনও ধরা না পড়ে থাকে, একটাই কারণ সেটার—অতিরিক্ত সাবধানী লোকটা। যেমনটা হয়ে থাকে সাইকোপ্যাথরা। অসুস্থ হলেও অত্যন্ত ধূর্ত আর জটিল মনের অধিকারী হয়ে থাকে তারা। কৌশলী। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ধরে ছক কাটে কাজ হাসিলের।

‘কী বলতে চাইছ তুমি, রানা?’

‘চূড়ান্ত হামলার আগে কিছু সময়ের জন্যে নজর রাখা হচ্ছিল বোধ হয় ক্যারেনের ওপর। তবে অতখানি সতর্কতা বোধ হয় বজায় রাখতে পারেনি লোকটা… যে-কারণে ধরা পড়ে যায় মেয়েটার চোখে। নিশ্চয়ই কোনও অস্বাভাবিকতা দেখেছিল ও খুনির মধ্যে। ফলাফল: আতঙ্কিত হয়ে পড়া। বিপদের পূর্বাভাস দেয়ারও এটাই সহজ ব্যাখ্যা।’

‘সবই তোমার অনুমান, রানা।’ খুশি নয় সেলেনা।

‘অবশ্যই যৌক্তিক অনুমান সেটা,’ বলল রানা জোরের সঙ্গে। ‘পুলিসও নিশ্চয়ই এভাবেই ভেবেছে।’

‘বেশ, বেশ,’ তাচ্ছিল্য ঝরল সেলেনার কণ্ঠে। ‘তা হলে ট্রেনের ওই কিম্ভূতটার ব্যাপারে যৌক্তিক অনুমান করো তো, শুনি!’

শ্রাগ করল রানা। ‘তোমার আগের ধারণাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। সাদা পোশাকের পুলিস। ওদের ভাবচক্কর সম্বন্ধে জানা আছে নিশ্চয়ই? হয়তো কোনও প্রশ্ন করার ছিল তোমাকে… ধরা যাক, ওই চিরকুটটার ব্যাপারে। নয় তো গোটা ব্যাপারটাই স্রেফ…’ শেষ করল না ও কথাটা। তার কারণ, আগুন দেখতে পাচ্ছে সেলেনার চোখে।

‘নয় তো… স্রেফ’?’ শাণিত কণ্ঠে জানতে চাইল মেয়েটা।

‘ঠাণ্ডা মাথায় তলিয়ে দেখতে পারো, সেলেনা,’ বলল রানা শান্ত স্বরে। ‘আমার তো মনে হয়, ঠিক পথেই চলেছে প্যারিসের পুলিস বিভাগ

‘স্রেফ উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা আমার ধারণাগুলো— এটাই তো বলতে চাইছ, রানা, তা-ই না? এবার সত্যিই অভিমান ঝরল মেয়েটার কণ্ঠ থেকে।

‘নিজেই তো বলেছ… ক্যারেনের ওখান থেকে বেরোনোর সময় নিজের মধ্যে ছিলে না তুমি। বড় ধরনের আবেগজনিত কোনও চাপের মধ্যে থাকলে ওরকম বিভ্রান্তিতে পড়তেই পারে যে-কেউ।’

‘সংখ্যাগুলোর ব্যাপারে কী বলবে তা হলে?’

‘আপাতত কিছু বলার নেই, সেলেনা।‘

‘জিপিএস লোকেশনের ব্যাপারে?’

‘হ্যাঁ, দেখতে হবে, কোন জায়গা ওটা।’

‘আমার ধারণাটা শুনবে, রানা? রহস্যটার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে জায়গাটার … আমার সাহায্য চেয়েছিল ক্যারেন। সুতরাং, পুলিসের মত কল্পিত এক সিরিয়াল কিলারের ঘাড়ে দায় চাপিয়েই বসে থাকছি না আমি। ভালো করেই জানি, আরও গভীর কিছু রয়েছে এর মধ্যে… আর যা-ই ঘটুক, সেটার তদন্ত করব আমি।

হাঁটুর উপর কনুই দুটো রেখে সামনে ঝুঁকে এল রানা, সামনের জমিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। দলছুট একটা পিঁপড়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে ওখানে।

হাড়ে হাড়ে চেনে ও সেলেনাকে। একে বাড়ি ফিরে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে লাভ হবে না।

‘অল রাইট,’ বলল ও শেষমেশ। ‘বলো তা হলে, কীসের কারণে খুন হতে পারে তোমার বান্ধবী? শুনতে চাইছি তোমার ধারণার কথা

চোখের উপর এসে পড়া এক গোছা লাল চুল সরাল মেয়েটা। কুঁচকে এসেছে ধনুকের মত ভ্রু জোড়া।

‘কিছুটা মনে হয় আন্দাজ করতে পারছি। সম্ভবত ক্যারেনের গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়টা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *