1 of 2

শকওয়েভ – ৪২

বেয়াল্লিশ

‘আগে শুনে নিই, কতটুকু জানেন আপনারা ক্যারেনের কাজ সম্পর্কে।’ নার্ভাস দৃষ্টি ফেলল লোকটা দরজার দিকে। ল্যাপল্যাণ্ডের বুনো অঞ্চলেও কেউ যেন আড়ি পাতবে ওদের কথায়।

‘চিঠিতে দেয়া নাম্বার কোড থেকে জানতে পেরেছি, কোথায় লুকিয়েছে রিসার্চ মেটেরিয়াল,’ বলল মেয়েটা।

নোটবুক কমপিউটার আর কফিনে পাওয়া রিমোট হার্ড ড্রাইভটা বের করল রানা ব্যাগ খুলে। কমপিউটারটা টেবিলে রেখে ড্রাইভটা সংযুক্ত করল ওটার সঙ্গে। এর পর পাওয়ার অন করল মেশিনের।

চেয়ার ছাড়ল গুস্তাফ। ডেস্ক থেকে চশমাটা তুলে নিয়ে ফিরে এল কমপিউটারের কাছে।

‘এখানে টেসলার উপর করা গবেষণাগুলো পাব বলে আশা করেছিলাম আমরা,’ বলল সেলেনা। কিন্তু আরও অনেক জিনিসই দেখছি রয়েছে হার্ড ড্রাইভে। সাইসমোলজি রিপোর্ট, ভূমিকম্প-এলাকার চিত্র… ইত্যাদি ইত্যাদি। যা বুঝলাম, ক্যারেনের রিসার্চের সঙ্গে কোনও ধরনের সম্পর্ক রয়েছে এগুলোর। আর এটাই বুঝতে পারছি না আমরা। ঠিক কী নিয়ে কাজ করছিল ও, মিস্টার ভিকান্দার?’

দ্রুত একের পর এক ফাইলে ক্লিক করতে করতে দুঃখ- জর্জরিত চেহারাটা কঠোর হয়ে এল গুস্তাফ ভিকান্দারের। একটা ইমেজ খুলে আঙুল তাক করল স্ক্রিনে। ধুলোয় মিশে যাওয়া কোনও এক শহরের ছবি কমপিউটারের পর্দায়। ‘জানেন, কোথায় এটা?’

‘কোনও ছবিতেই তো লেবেল দেয়া নেই,’ বলল সেলেনা। ‘তবে দেখেশুনে লাতিন আমেরিকা মনে হয়েছে আমাদের।

‘টারাকা, মাথা দুলিয়ে বলল গুস্তাফ। ‘বলিভিয়া আর প্যারাগুয়ের মাঝে ছোট্ট এক প্রজাতন্ত্র। স্যান ভিসেন্তের ছবি এটা, রাজধানী শহর, সতেরো মাস আগে দেশ জুড়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তোলা।’

‘হ্যাঁ, টিভিতে দেখেছিলাম খবরটা। কিন্তু বুঝতে পারছি
না-’

‘আর কিছু পাননি ড্রাইভটা ছাড়া?’

‘আর কী থাকবে? ভিকান্দারকে বাজিয়ে দেখতে চাইল রানা।

‘ছোট ইলেকট্রনিক ডিভাইস… ধাতব, আয়তাকার, সাত ইঞ্চিমত লম্বা?’

‘টেসলা অসিলেটরের কথা বলছেন?’ জিজ্ঞেস করল সেলেনা।

‘পেয়েছেন তা হলে। জানতাম, ক্যারেন লুকিয়ে রাখবে ওটা। কোনও ধারণা রয়েছে যন্ত্রটার ক্ষমতা সম্পর্কে?’

‘হ্যাঁ!’ হেসে, মুখ খুলল রানা। ‘জবর অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে!’

‘পেয়েছি, কিন্তু সাথে নেই ওটা!’ মুখ বেজার করল সেলেনা। ‘রেখে আসতে হয়েছে হাজার টন পাথরের নিচে। তা না হলে বেরোতে পারতাম না সমাধির কারাগার থেকে।’

‘এর সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘আপনিও কি ক্যারেনের মত রিসার্চার?’

‘না।’ মাথা নাড়ল গুস্তাফ। ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক আমি, ফ্রিল্যান্সার। মানে, ছিলাম আর কী। বেশ কিছু দিন আমেরিকায় কাটাতে হয়েছে কাজের সূত্রে। পরের কয়েকটা বছর অনুসন্ধানের প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছি ইয়োরোপের এখান থেকে ওখানে।

‘কীসের অনুসন্ধান?’

‘পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপার… বাস্তুসংস্থান, গ্রিন ইস্যু… এসব আর কী। কাজের সুবাদে সময় কাটাতে হতো প্রতিবাদী সংস্থাগুলোর সঙ্গে; প্রমাণ সংগ্রহ করতাম মোটরওয়ে কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে; প্রথাবিরোধী মানুষ, নৈরাজ্যবাদী, সমাজ পরিবর্তনের বিকল্প ব্যবস্থা—এসবই ছিল আমার বিষয়বস্তু। এক সময় টের পেলাম, ভালোই প্রভাব বিস্তার করছে এগুলো আমার উপর। প্রবেশ করতে শুরু করি কন্সপিরেসি থিয়োরির গভীর থেকে অতলে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস জন্মাল এখন যে-বাস্তবতা দেখানো হচ্ছে আমাদের, অতি যত্নে তৈরি করা মিথ্যার জাল ছাড়া কিচ্ছু নয় সেটা। অভিজাত শাসক গোষ্ঠী আড়ালে-আবডালে কী করে বেড়াচ্ছে, কী ধরনের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছে তারা পৃথিবীর জানো নগুলো গোপন রাখার স্বার্থেই ভুজংভাজাং দেয়া হচ্ছে বিশ্ববাসীকে।

‘তদন্ত করতে গিয়ে এমন এক নেটওঅর্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি, কেঁচো খুঁড়তে পারা কেউটের অস্তিত্ব খুঁজে বের করছে নিয়মিত। এসব তথ্য প্রকাশ্যে এলে আঁতকে উঠবে মানুষ। সেসময় আমার প্রধান আগ্রহ ছিল গ্লোবাল ওয়ার্মিং কন্ট্রোভার্সির উপর। ক্রমে পরিষ্কার হয়ে এল, এই পুরো কনসেপ্টটার জন্ম দেয়া হয়েছে তথাকথিত গ্রিন ট্যাক্সের নামে বিপুল রাজস্ব পকেটে পোরার জন্যে। জনসাধারণের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনায্যভাবে নিজের করে নিচ্ছে তারা পরিবেশ আন্দোলনগুলোকে।

‘যখনই পয়সা আসত হাতে, ইয়োরোপ চষে বেড়াতাম আমারই মত সত্যানুসন্ধানীর খোঁজে। প্রচুর খেয়ালি ও বড় ধরনের ছিটঅলা মানুষের সাক্ষাৎ পাই এই ঘোরাঘুরির সূত্রে।

‘আসল কথায় আসুন।’ অধৈর্য হয়ে উঠেছে রানা।

‘আসছি। এমনই এক ট্রিপে, লণ্ডনের এক অল্টারনেটিভ সায়েন্স কনফারেন্সে পরিচয় হয় ক্যারেনের সঙ্গে। আলাপের শুরুতেই বুঝে গেলাম, গতানুগতিক পাগল-ছাগলের মত নয় মেয়েটা—অন্য রকম। হুজুগে নাচে না— সিরিয়াস। শিগগিরই আবিষ্কার করলাম, কনফারেন্সের টপিকের চাইতেও ইন্টারেস্টিং কিছু শেয়ার করার রয়েছে আমাদের। অতএব, সম্মেলন ত্যাগ করি আমরা। একটা ড্রিঙ্ক দিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচনা, সেটা গড়ায় ডিনার অব্দি। রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়ার আগতক উঠতেই পারলাম না ওখান থেকে। কিন্তু তখনও কথা শেষ হয়নি আমাদের। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে এবারে ওর হোটেল কামরায় আমন্ত্রণ জানাল মেয়েটা।

‘ওই দিন যতটুকু শুনেছিলাম ক্যারেনের মুখ থেকে, সেসব ছিল বিশাল সাগরের সামান্য এক ঘটি পানি। নিজের রিসার্চ সম্বন্ধে আরও বহু কিছু বলার ছিল আমাকে। আচমকা উপলব্ধি করি, ও যে-রহস্য উন্মোচন করতে চলেছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আমার ওসব খোঁড়াখুঁড়ি তার কাছে কিচ্ছু না। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম মেয়েটার কথা, যদিও অসম্ভব- অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল অনেক কিছুই। টেসলার মূল মেশিনের উপর ভিত্তি করে নিজেরটা তৈরি করল কীভাবে, বলছিল ও আমাকে। একদমই বিশ্বাস করিনি প্রথমে। তখন বলল, দেখাতে পারবে ডেমনস্ট্রেশন করে।

‘পরদিনই মেয়েটার সঙ্গী হয়ে রওনা হই ফ্রান্সের দিকে। প্যারিসে নামার পর, গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল এক গ্রাম অঞ্চলে। জনবিচ্ছিন্ন, পরিত্যক্ত ফার্মহাউসটা দৈবাৎ পেয়ে যাই ওখানে।’

কমপিউটার হার্ড ড্রাইভে দেখা পুরানো বাড়িটার কথা মনে পড়ল রানার। অনুমান করল, কী আসছে এর পর।

‘পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরের এক দেয়ালে মেশিনটা সেট করতে দেখলাম ক্যারেনকে। তখনও খাড়া রয়েছে দেয়ালগুলো। যদিও বহু বছর ধরে বাস করে না কেউ ও- বাড়িতে। আন্দাজে আসছিল না, কী ঘটতে চলেছে এর পর। যখন সুইচ টিপল মেয়েটা-–‘

‘দেখেছি আমরা, কীভাবে কাজ করে ওটা,’ বাধা দিল সেলেনা। ‘বাড়িটার রেজোনেন্ট ফ্রিকিউয়েন্সির সঙ্গে নিজে থেকে টিউন হয়ে গেল ডিভাইস, আর কাঁপতে আরম্ভ করল গোটা বাড়ি?’

‘রীতিমত অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা!’ স্মরণ করে আতঙ্কের ছায়া পড়ল গুস্তাফের চেহারায়। ‘একটা দেয়াল হুড়মুড় করে পড়ে গেল, তার পর আরেকটা… একেবারে আমার চোখের সামনে! সময়মত মেশিন যদি বন্ধ না করত, পুরো বাড়িটাই পরিণত হতো ধ্বংসস্তূপে। টেসলা অসিলেটরের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের আর উপায় রইল না।’

আরেক ডোজ ভোদকা নিয়েছে লোকটা। লম্বা এক ঢোক গিলে নিয়ে ভারি চেহারায় তাকাল ওদের দিকে।

‘এরকম একটা প্রযুক্তি মন্দ লোকের হাতে পড়লে কী হতে পারে, বুঝতে পারছেন তো? ওটাই আসলে ভয়ের ব্যাপার।

‘উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সালের সাতই জানুয়ারি, টেসলার মৃত্যুর পর পরই ব্লয়স ফিটজেরাল্ড এবং রালফ ডোটি নামে দু’জন ইউএস সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট হানা দেয় নিউ ইয়র্ক হোটেলে। বিজ্ঞানীর সেফ থেকে সরিয়ে ফেলে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রগুলো। এক শত তিন নং সেফটি ডিপোজিট বক্সও সরিয়ে নেয়া হয় গভর্নর ক্লিনটন হোটেল থেকে। পরে আসা ট্রাম্প ইনকোয়ারির তদন্ত কর্মকর্তাদের জন্যে বিপদের সম্ভাবনা নেই, এমন কিছু নকল কাগজপত্র ফেলে যাওয়া হয় দুই হোটেলে; মানুষকে যাতে বিশ্বাস করানো যায়—শত্রুদেশের গুপ্তচরদের সামরিক স্বার্থ রয়েছে, এ ধরনের কোনও কিছু নিয়ে কাজ করছিলেন না মৃত বিজ্ঞানী। ট্রাম্প ইনকোয়ারি রিপোর্ট দেয়— জীবনের শেষ দশ বছর ক্রমশ পাগলাটে, খামখেয়ালি হয়ে উঠছিলেন টেসলা, সম্ভবত অসুস্থ ছিলেন মানসিকভাবে। কিছুই তৈরি করেননি এ সময়টায়, কেবল অর্থহীন কিছু ধারণা দেয়া ছাড়া। ব্যবহারিক কিংবা বৈজ্ঞানিক মূল্য নেই যেগুলোর।’

‘ওদিকে আসল জিনিসগুলো পাচার করে দেয়া হলো গোপন কোনও সরকারি ওয়্যারহাউসে, আপন মনে বিড়বিড় করল সেলেনা।

‘ওয়্যারহাউসের চাইতেও বেশি ল্যাবোরেটরি, শুধরে দিল সুইডিশ সাংবাদিক। ক্যারেনের বিশ্বাস ছিল, বিপুল পুঁজির গবেষণা ও ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের কেন্দ্র ওটা! টেসলার উদ্ভাবনগুলোর পরীক্ষা ও ব্যাপ্তি বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে ওখানে। বিগত আটাত্তর বছর ধরে গোপনে গোপনে এগিয়ে নিয়েছে ওরা সার্বিয়ান বিজ্ঞানীর গবেষণাকর্ম, বাড়িয়েছে তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর ক্ষমতা, নিখুঁত করেছে ফাইন-টিউনের মাধ্যমে।

আরও পানীয় গলায় ঢালল গুস্তাফ। গ্লাসটা মৃদু কাঁপছে তার হাতে। ‘এখন বুঝছেন তো, কী নিয়ে এসব? বছরের পর বছর লাগিয়ে এসমস্ত সাইসমোলজিকাল ডেটা, গ্রাফ, ছবি সংগ্রহ করেছে মেয়েটা; করেছে বিশ্লেষণ; পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে গেছে অনুসন্ধান।’

‘কীসের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, মিস্টার ভিকান্দার?’ শঙ্কা মেশানো স্বরে জিজ্ঞেস করল সেলেনা। আগে থেকেই জানা আছে যেন উত্তরটা।

হাতের চেটোয় ঠোঁট মুছল গুস্তাফ। ‘সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা লার্জ স্কেলের দুর্যোগ, ধ্বংসলীলা, অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি–এর সবগুলো কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি। যদিও সবার ধারণা তা-ই।’

‘তার মানে…’

‘বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটানো হয়েছে ওগুলো!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *