ঊনচল্লিশ
সাড়ে চার ঘণ্টা আকাশে ওড়ার পর, রিফিউলিঙের জন্য ডেনমার্কের থিসটেড এয়ারপোর্টে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতি নিয়ে, লুকা ব্রেযনেভের দেয়া কো-অর্ডিনেট অনুযায়ী পিয়েলজেকেইস ন্যাশনাল পার্কের কিনারা স্পর্শ করল এসটি- ওয়ানের চাকা।
ঝাঁকুনিবিহীন মসৃণ হলো ল্যাণ্ডিংটা। তীক্ষ্ণ আওয়াজে রানওয়ে ছুঁয়েছে বিমান।
ট্যাক্সিইং করে মেইন স্ট্রিপ ছেড়ে চলল রানা হ্যাঙারের দিকে। নানান ধরনের এয়ারক্রাফটের সমাহার ওখানে। এমনকী রয়েছে আংশিক খুলে ফেলা, পুরানো এক সুইডিশ মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট প্লেনও।
ইঞ্জিনের পাওয়ার বন্ধ করে, রেডিয়ো হেডসেট খুলে ফেলল রানা। হাই তুলল আড়মোড়া ভেঙে।
‘যার পর নাই সন্তুষ্ট আমি তোমার ওপর,’ বলল সেলেনা আরামদায়ক প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ থেকে।
‘কেন, আমার কৃতিত্ব?’
‘এই যে… আস্ত অবস্থায় নিয়ে এলে এখানে!’
‘তা-ই বলো। হুম… নিজের এহেন পারফর্মেন্সে আমিও
কম চমৎকৃত নই।’
বেরিয়ে এল ওরা বিমান থেকে।
উজ্জ্বল আর ঝকঝকে একটা সন্ধ্যা।
গাছগাছালি ভেদ করে একটা মাত্র আঁকাবাঁকা রাস্তা চোখে পড়েছে উপর থেকে, চলে গেছে আধ কিলোমিটারমত দূরের এক গাঁয়ের দিকে।
চমৎকার সজীব আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। নর্ডিক শৈত্যের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন সান্ধ্য বাতাসে।
সুসজ্জিত এক সারি কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে এয়ারস্ট্রিপের দূরপ্রান্তে। বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা বাইরে। কিন্তু থিসটেডে যেখানে পরিপাটি ওভারঅল পরা ডজন খানেক কর্মী এসেছিল এয়ারক্রাফটটাকে অভ্যর্থনা জানাতে, সেরকম কাউকে দেখা যাচ্ছে না. এখানে। এমনকী চোখে পড়ছে না কোনও নড়াচড়াও।
চারপাশের জঙ্গল, আর পিছনে মাথা উঁচিয়ে থাকা পর্বতসারির দিকে তাকাল রানা। শান্ত, সমাহিত জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলল মুহূর্তে। সম্ভব হলে এখানেই কাটিয়ে দিত ও বাকি জীবনটা। সভ্যতা থেকে বহু দূরে, নির্জন এই প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দিত নিজেকে। কোনও ঝুটঝামেলাই স্পর্শ করতে পারত না ওকে। কর্তব্যের উছিলায় বিস্তর ক্লেদ জমেছে ওর মনে, অনেক মানুষের রক্ত লেগেছে হাতে।
‘নর্দার্ন ক্যানাডার মত লাগছে জায়গাটা,’ মন্তব্য করল সেলেনা।
‘হ্যাঁ, বেশ নিরিবিলি!’
‘গুস্তাফ ভিকান্দার এখানে কী করছে বলে ধারণা তোমার?’
‘মুনি-ঋষিদের মত সন্ন্যাসব্রত পালন করছে হয়তো।’
‘ক্যারেনের সঙ্গে এ-লোকের পরিচয় হলো কীভাবে, সেটাই ভাবছি।’
ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাল রানা। ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে জানা যাবে না সেটা।’ এয়ারফিল্ড গেটের ওদিকটা দেখাল আঙুল দিয়ে—ঘন জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে রাস্তাটা। ‘ওপর থেকে দেখেছি, একটা গ্রাম রয়েছে ওদিকে, মিনিট কয়েকের হাঁটা দূরত্বে। গাড়ি-টাড়ি পাওয়া যাবে হয়তো ওখানে।
‘যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার,’ আশাবাদী নয় সেলেনা।
বিস্মিত হলো না রানা ওর কথার সত্যতা আবিষ্কার করে। গাছের ছায়ায়, লতায়-পাতায় ডুবে রয়েছে যেন অঞ্চলটা। কাঠের ঘরবাড়ি ছাড়া গির্জা, মুদি দোকান, ফিলিং স্টেশন, ছোটখাটো আরও দুয়েকটা স্থাপনা আর দু’-তিনটে অপরিসর রাস্তা—এই নিয়ে গ্রাম। দর্শনীয় বলতে, আলপাইন শ্যালের মত ছোট একটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সরাইখানা।
প্রতিটি উঠনে সদ্য কাটা লাকড়ির বহর দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, গ্রীষ্মের বেশির ভাগটাই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে এরা তুষার-মৌসুমের মোকাবেলার কাজে। শীতের সময়টা সম্ভবত কয়েক মাসের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এখানে। বল্গা হরিণে টানা স্লেড আর স্লোমোবাইল ছাড়া উপায় থাকে না যাতায়াতের।
রানা আর সেলেনা সরাইখানায় প্রবেশ করতেই কৌতূহল নিয়ে ঘুরে তাকাল কয়েকজন।
গ্রামীণ পানশালা হিসাবে নিচতলাটা সচরাচর যেমনটা হয়ে থাকে, আয়তনে তার দ্বিগুণ।
সরাইমালিকের নাম ম্যাগনাস। গোলগাপ্পা চেহারার অমায়িক এক যুবক। ইংরেজি জানে অল্পবিস্তর।
ডাবল শট উইস্কির অর্ডার করল রানা নিজের জন্য। সেলেনা চাইল স্রেফ কড়া কফি। অনেকক্ষণ যাবৎ পছন্দের পানীয়ের তেষ্টায় প্রাণটা আইঢাই করছিল ওর।
অর্ডার সার্ভ করার ফাঁকে হাসিমুখে ওদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল ম্যাগনাস।
উইস্কিতে লম্বা চুমুক দিল রানা। তরল আগুনে জিভ ও গলা জ্বালিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা করল, হিচ-হাইকিং করে স্টকহোম থেকে উত্তরে চলেছে ও স্ত্রীকে নিয়ে (এই পর্যায়ে রানার উদ্দেশে ভ্রুকুটি করল সেলেনা)। ল্যাপল্যাণ্ডের ন্যাশনাল পার্কগুলোতে টুর দেয়ার ইচ্ছা। গাড়ি ভাড়া করতে কিংবা কিনতে আগ্রহী এখান থেকে, যদি পাওয়া যায়।
কান খাড়া করে শুনছিল অন্য খরিদ্দাররা। তুমুল তর্ক শুরু হলো ওদের। কার্যকর কোনও সাজেশন যখন এল না কারও মগজ থেকে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিল রিকার্ডো নামে এক ড্রাইভার। বলল, লরি বোঝাই ফেন্সিঙের সরঞ্জাম নিয়ে জাকউইকের দিকে রওনা হচ্ছে ও পরদিন সকালে। ভিনদেশি দম্পতির যদি লিফট নিতে আপত্তি না থাকে, গাড়ি নিতে পারবে ওরা ওখান থেকে।
লরি চালককে আন্তরিক ধন্যবাদ দিল রানা। ঠিক হলো, সাড়ে আটটার সময় মিলিত হবে ওরা সরাইয়ের বাইরে।
‘স্বামী-স্ত্রী’-র মুশকিল আসান হওয়ায় প্রফুল্ল মেজাজে আড্ডায় ফিরে গেল স্থানীয়রা।
‘ব্যবস্থা তো হলো,’ বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল সেলেনা। ‘আর তো কিছু করার নেই এখন সময় কাটানো ছাড়া। না বলে পারছি না… ক্লান্তিতে খুন হয়ে যাচ্ছি, রানা!’
রানার অবস্থাও ওর চেয়ে ভালো নয়। মাথা ধরেছে প্রচণ্ড। আরেকটা উইস্কির অর্ডার দিল ও।
‘রাতের জন্যে ভালো একটা কামরা আর ডিনার চাই তো?’ এক গাল হেসে জানতে চাইল সরাইমালিক। ‘মেনু দেখাচ্ছি, দাঁড়ান। ঝাক্কাস রাঁধে আমার হোম মিনিস্টার।’
ছোট্ট, নিরিবিলি ডাইনিঙে ঠাণ্ডা করল ওরা পেটের চিল্লাপাল্লা। খদ্দের বলতে স্রেফ ওরা দু’জনই।
একদম সাধারণ মেনু। তবে বউয়ের রান্নার হাত নিয়ে একটুও বাড়িয়ে বলেনি সরাইখানার মালিক। অমৃতের মত লাগল ওদের মাংসের স্টু-টা। যদিও ওটা কিংবা তার সঙ্গে নেয়া বিয়ারও খুব একটা দূর করতে পারল না ওদের অবসাদ।
আহারপর্ব শেষ হলে, ম্যাগনাসের কিশোরী মেয়ে ক্যাচম্যাচ করা সিঁড়ি বেয়ে উপরে এনে কামরা দেখিয়ে দিল ওদের।
দেয়াল, ছাত, আরামপ্রদ দেখতে বড়সড় ডাবল বেড—ঘরের সব কিছুই বার্নিশ করা কাঠের। আসবাব- পত্রগুলো পুরানো, কিন্তু পরিচ্ছন্ন।
‘স্বামী-স্ত্রী, না?’ কিশোরী বিদায় নিলে ভ্রু নাচাল সেলেনাঁ। ব্যস, ওই পর্যন্তই। জানালার কাছে গিয়ে টেনে দিল পর্দা। সুদূর এই উত্তরে বছরের এই সময়টায় মাঝরাতের আগে অস্ত যায় না সূর্য, আর কয়েক ঘণ্টার বেশি থাকেও না অন্ধকার।
‘রেডি হচ্ছি শোয়ার জন্যে,’ বলতে বলতে উঁকি দিল বাথরুমের দরজা খুলে। ‘আগে বাথরুমে ঢুকলে মনে করবে কিছু?’
‘উঁহুঁ। লেডিজ ফার্স্ট।’
তোয়ালে কাঁধে ফেলে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল সেলেনা, কিন্তু খিল দিল না দরজায়। একটু পরেই দেখা গেল, মাসুদ রানাও ঢুকছে ওই দরজা দিয়ে।
ঢুকেই আটকে দিল ছিটকিনি।