দুই
এই ঘটনার আট মাস পর।
জুনের এক উজ্জ্বল রৌদ্রালোকিত দুপুর।
ভারি কার্টেন টেনে দেয়ার কারণে আধো-অন্ধকারে ডুবে রয়েছে ক্যারেন ল্যানকাউমের অ্যাপার্টমেন্ট।
বিষয়টা স্বস্তিদায়ক নয় ওর জন্য। তার উপর অস্বস্তিকর, ভ্যাপসা গরম পড়েছে গত দুই দিন ধরে।
তবে কেউ গোপনে অনুসরণ করছে ওকে, যে-কোনও মুহূর্তে খুন করার চেষ্টা চালাবে, সেটাও কি স্বস্তিকর কিছু?
আঁধারিতে ভরা অপরিসর হলওয়েতে সন্তর্পণে পা ফেলছে ক্যারেন। উদ্বেগে আঁকড়ে রয়েছে ভিতরটা। মনে মনে প্রার্থনা করছে, যাতে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ না ওঠে পায়ের নিচের পাটাতনগুলোয়। তাতে ফাঁস হয়ে যাবে অ্যাপার্টমেন্টে ওর উপস্থিতির ব্যাপারটা। একটু আগে মনে হয়েছিল, কার জানি পায়ের আওয়াজ শুনেছে সদর-দরজার বাইরে। এখন আবার শুনতে পাওয়া গেল শব্দটা। না, কোনও ভুল নেই শোনায়।
নিঃশ্বাস চেপে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ক্যারেন। ঢিপঢিপ করছে বুক-চোখ রাখল ফিশ-আই লেন্সে। ঝাপসা কাঁচের পিপহোল ভেদ করে প্রথমেই চোখে পড়ল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের আদ্যি কালের প্লাস্টার আর আপার ল্যাণ্ডিঙের বাঁকাচোরা রট আয়ার্ন রেইলিং। লেন্সের ভিতর দিয়ে বহু দূরের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে।
পরক্ষণে পড়শি মাদাম গোলতিয়েইকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে গেল মনে। একই ফ্লোরের বাসিন্দা এই বৃদ্ধা। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ।
নিজ অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা দিয়ে নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন অশীতিপর বিধবা। সঙ্গে শপিঙের ঝুড়ি। বাজারসদাই করতে বেরোচ্ছেন বোধ হয়।
তড়িঘড়ি করে দরজার নিরাপত্তা-শেকল খুলে ফেলল ক্যারেন। খুলল হুড়কো দুটো। এর পর চাবি দিয়ে তালা, আর সব শেষে কবাটটা খুলে ডাক দিল বৃদ্ধাকে।
‘মাদাম গোলভিয়েই! মাদাম গোলতিয়েই! দাঁড়ান, প্লিজ… একটু দাঁড়ান!’
বয়স হলেও অটুট স্বাস্থ্য বুড়ির। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বছরের পর বছর সিঁড়ি ভেঙে ছ’তলা অবধি ওঠানামা করছেন রোজ দু’-তিন বার করে। একটাই সমস্যা, কানে খুবই কম শোনেন তিনি—বৃক্ষের মত বধির।
মহিলার মনোযোগ আকর্ষণ করতে আরও দু’বার তাঁর নাম ধরে ডাকতে হলো ক্যারেনকে।
‘বঁযুখ, ম্যাদেমোয়যেল ল্যানকাউমে,’ মিষ্টি হাসিতে সম্ভাষণ জানালেন পড়শি বুড়ি। ‘কেমন আছ তুমি?’
‘এই তো… আছি। বেরোচ্ছেন নাকি, মাদাম?’ কয়েক পর্দা চড়া স্বরে জানতে চাইল ক্যারেন।
‘হ্যাঁ… কেনাকাটা রয়েছে কিছু। কেন, তোমার কিছু লাগবে? কেমন জানি লাগছে তোমাকে, বাছা! কোনও সমস্যা হয়নি তো?’
ক্যারেন জানে, কেমন দেখাচ্ছে ওকে। গত দুটো রাত এক সেকেণ্ডের জন্যও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি ও। টেনশনের কাছে পাত্তাই পায়নি ক্লান্তি।
‘মাইগ্রেনের ব্যথা,’ সত্যের কানে একটু মোচড় দিল ক্যারেন। ‘খারাপ ধরনেরটা। সেজন্যেই বেরোতে পারছি না। আমার দুটো চিঠি পোস্ট করে দেবেন দয়া করে?’
স্নেহের দৃষ্টিতে পড়শি মেয়েটার দিকে চাইলেন মাদাম গোলতিয়েই। মাথার ব্যথায় না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে বেচারি!
‘এ আর এমন কী, সোনা!’ বললেন তিনি। ‘আর কিছু লাগবে না? ওষুধ-টষুধ?’
‘না-না, ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। … এক সেকেণ্ড দাঁড়ান, প্লিজ।’
ছুটে বৈঠকখানায় ফিরল ক্যারেন।
মুখবন্ধ খামে ভরা দু’খানা চিঠি পড়ে রয়েছে টেবিলের উপর। কেবল ডাকটিকেট লাগানো বাকি। দুটো চিঠির বিষয়বস্তু একই। তবে গন্তব্য ভিন্ন। বলতে গেলে, পৃথিবীর এমাথা আর ওমাথা।
চিলের মত ছোঁ দিয়ে খাম দুটো তুলে নিয়েই দরজার দিকে ছুট দিল ক্যারেন।
এটা যাবে সুইডেনে, ‘ বলল ও। ‘আর এটা… ক্যানাডায়।’
‘কী–সুইট্যারল্যাণ্ড? ঝোপের মত ভ্রু জোড়া কপালে তুলে কান এগিয়ে আনলেন বৃদ্ধা।
‘পোস্ট অফিসের কাউন্টারে দেখালে, ওরাই করবে যা করার,’ ধৈর্যহারা হলো না মেয়েটা। ‘আপনি শুধু বলবেন, ইন্টারন্যাশনাল মেইল হিসেবে রেজিস্ট্রি করতে হবে এ-দুটো, এক্সপ্রেস ডেলিভারি। …বুঝতে পেরেছেন, মাদাম?’
‘আরেক বার বলো তো, ডিয়ার।’
‘রেজিস্টার্ড ইন্টারন্যাশনাল মেইল,’ থেমে থেমে, প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে উচ্চারণ করল ক্যারেন। ‘খুবই… খুবই জরুরি চিঠি এগুলো। আজই পোস্ট করতে হবে।‘
নাকের কাছে এনে দুটো চিঠিই উল্টেপাল্টে দেখলেন মহিলা। যেন চোখেও সমস্যা রয়েছে তাঁর।
‘সুইডেন! ক্যানাডা!’ এমনভাবে উচ্চারণ করলেন, ও- দুটোয় যেন উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর তফাত।
‘হ্যাঁ, ক্যানাডা আর সুইডেন।’ প্যান্টের পকেট থেকে মুঠো ভর্তি ইউরো নিয়ে বাড়িয়ে ধরল ক্যারেন। ‘ডাকখরচ হয়েও বেঁচে যাবে কিছু। ওগুলো আর ফেরত দিতে হবে না।’
মহিলা সিঁড়ির উদ্দেশে রওনা হতেই এক মুহূর্ত আর দাঁড়াল না ক্যারেন। ত্বরিত তৎপরতায় আবার গৃহবন্দি করল নিজেকে।
একটা প্রার্থনাই করতে পারে এখন পড়শি যাতে ভুলে না যান, কিংবা হারিয়ে না ফেলেন চিঠি দুটো। বিশ্বাস করার মত দু’জন মাত্র সুহৃদ রয়েছে ওর দুনিয়ায়। ওদের কাছে বার্তা পৌঁছনোর জন্য পত্র- যোগাযোগ ছাড়া আর কোনও মাধ্যম নেই। ফোন বা ই-মেইলের প্রাইভেসির উপর ভরসা করার উপায় নেই এ বুগে। চিঠিগুলো যদি জায়গামত পৌঁছে, হয়তো সাহায্যের হাত বাড়াবে ওর বন্ধুরা।
যদি না এরই মধ্যে খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়ে থাকে!
বুকে ক্রস এঁকে জানালার কাছে চলে গেল ক্যারেন। নার্ভাস আঙুলে ফাঁক করে ধরল পর্দার প্রান্ত। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার কারণে চোখ কোঁচকাতে বাধ্য হলো। .
ছ’তলা নিচে অপ্রশস্ত রাস্তায় গাড়িঘোড়ার মন্থর স্রোত। ঝিমিয়ে আছে যেন শহরটা।
কিন্তু ওসব দেখছে না মেয়েটা। ওর মনোযোগ অন্য কিছুতে।
পেভমেন্টের পাশের পার্কিং স্পেসে আগের জায়গাতেই রয়েছে এখনও টিনটেড গ্লাস লাগানো গাড়িটা, জানালার ঠিক নিচে। গত কাল থেকেই দেখছে ওখানে দাঁড়িয়ে।
ঢোক গিলল ক্যারেন। গলার ভিতরটা যেন শিরিশ কাগজ হয়ে আছে।
একদম শিয়োর ও―দিন তিনেক আগে গ্যাসপারদের এস্টেট থেকে ফেরার পথে কালো যে-অডিটা ফলো করছিল ওকে, এটাই সেই গাড়ি।
তারও আগে, এই একই গাড়ি ধাওয়া করেছিল ওকে রাস্তায়!
ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় এখনও!
একটুর জন্য বেঁচেছে ক্যারেন গাড়িচাপা পড়ার হাত থেকে!
তাড়াতাড়ি করে পর্দার ফাঁকটা বুজিয়ে দিল আবার। আশা করছে ক্যারেন, গাড়ির লোকগুলো লক্ষ করেনি ওকে জানালায়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, সংখ্যায় অন্তত তিনজন হবে ওরা।
গ্যাসপারদের ওখান থেকে ফেরার সময়, যখন উপলব্ধি করল, অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে, এই বিল্ডিঙে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করেনি আতঙ্কিত ক্যারেন। ক’টা জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়েই যেত, কিন্তু আত্মগোপনে যাওয়ার আগেই মূর্তিমান বিভীষিকার মত আবির্ভাব ঘটল আবার সেই কালো গাড়িটার।
কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ক্যারেন! অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে।
এদের ব্যাপারেই কি তবে সাবধান করতে চেয়েছে ওকে গুস্তাফ? এদের ভয়েই কি সরে গেছে মানুষটা ওর কাছ থেকে?
তা-ই যদি হয়, তবে তো রিসার্চের প্রতিটা খুঁটিনাটিই জেনে গেছে ওরা! এ-ও নিশ্চয়ই অজানা নয়, কী কী জেনেছে ও ওদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা সম্বন্ধে। সর্বনাশ!
একবার যদি কায়দামত পায়, বাঁচতে দেবে না প্রাণে! যে-সত্য ও আবিষ্কার করেছে, তার পর তো নয়ই!
কত দিন পর্যন্ত সইতে হবে ওকে এ বন্দিদশা?
রয়েসয়ে খরচ করলে, দুটো হপ্তা চালানোর মত পর্যাপ্ত টিনের খাবার মজুত রয়েছে ঘরে। ব্র্যাণ্ডির জোগানও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু তার পর? হতচ্ছাড়াগুলো যদি জায়গা ছেড়ে না নড়ে?
পরবর্তী আধঘণ্টা কামরার এমাথা-ওমাথা পায়চারি করে কাটাল ক্যারেন। দেয়ালঘড়ির কাঁটা আর নিজের হৃৎপিণ্ড একই ছন্দে চলছে বলে মনে হচ্ছে ওর। প্রতিবেশী চিঠিগুলোর গতি করতে পারলেন কি না, তাই ভেবে অস্থির হয়ে রয়েছে মনটা।
শেষমেশ আর উত্তেজনা সইতে না পেরে চলে এল ছোট্ট কিচেনটায়। গলা ভেজানো দরকার।
ব্র্যাণ্ডির বোতলটা তুলে নিল ক্যারেন টামলার থেকে। ঢেলে নিল আধ গেলাস তরল। দু’-তিন ঢোকে ওটুকু গিলে নিয়ে আবার নিল একই পরিমাণ।
বেশিক্ষণ লাগল না ব্র্যাণ্ডির প্রভাব পড়তে। খালি পেটে অ্যালকোহল পড়ায় ঘুরছে মাথাটা। গলায় কেমন যেন বমি বমি ভাব।
ড্রইং রুমে ফিরে গিয়ে ধপ্ করে বসল কাউচে, তার পর গা এলিয়ে দিল ও। পাঁচ মিনিটও লাগল না, ঢলে পড়ল ও ঘুমপাড়ানি মাসির কোলে।
.
ধড়মড় করে উঠে যখন চোখ মেলল, ততক্ষণে ঘুটঘুটে আঁধার হয়ে গেছে কামরাটা।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, কে জানে!
কিন্তু স্বাভাবিকভাবে তো ভাঙেনি ঘুমটা! কিছু একটা জাগিয়ে দিয়েছে ওকে। কোনও ধরনের আওয়াজ-টাওয়াজ?
পাগলা নাচন শুরু হলো বুকের মধ্যে। ঢোক গেলার ভঙ্গিতে কণ্ঠার হাড়টা উঠল, নামল; কিন্তু ভিজল না গলা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে ভিতরটা।
কীসের শব্দ, বুঝে গেল একটু পরেই পর্দার মাঝের চিলতে ফাঁকে তীব্র উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখে।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল ক্যারেন। বাইরে ঝড় হচ্ছে। দামাল হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে জানালায়। গুমোট গরমটা নেই আর এখন।
উঠে পড়ল ও কাউচ থেকে। হাত বাড়াল টেবিল- ল্যাম্পটার সুইচের দিকে।
মিটমিটিয়ে জ্বলে উঠল বাতি।
সেরেছে!
যত বারই ঝড়বৃষ্টি হয়, এমনিভাবে মিটমিট করে জ্বলে পুড়ে যাওয়ার হুমকি দেয় প্রাচীন ইলেকট্রিসিটি লাইন।
দশটা পঁয়তিরিশ দেখাচ্ছে ম্যান্টলপিসের উপর রাখা ঘড়িটা। চিঠিগুলো পোস্ট করতে পারলেন কি না, আজ আর জিজ্ঞেস করা হলো না মাদাম গোলতিয়েইকে। দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়েন মহিলা বরাবর। জানতে হলে, অপেক্ষা করতে হবে সকাল পর্যন্ত। সেটাও সাতটার আগে নয়।
বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে জানালার দিকে চলল ক্যারেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে কোথাও দেখতে পেল না গাড়িটাকে।
স্বস্তিতে ভরে উঠল ওর বুকের ভিতরটা। মনে হলো, যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করে এই মাত্র বেরিয়ে এসেছে কারাগার থেকে।
চলে গেছে ওটা!
হ্যাঁ, চলে গেছে। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল, স্ট্রিটলাইটের আলোয় জায়গাটা এখন চকচক করছে বৃষ্টির পানিতে। ছোট ছোট পুকুর হয়ে রয়েছে রাস্তার বুকে খানাখন্দগুলো।
চোখ মিটমিট করল ক্যারেন। কিছুটা বিভ্রান্তি বোধ করছে এ মুহূর্তে।
গোটা ব্যাপারটা ওর কল্পনার ফসল নয় তো? আসলেই কি কেউ অনুসরণ করছিল ওকে?
তিন দিন আগের সম্ভাব্য দুর্ঘটনাটা কি তবে দৈব সংযোগ? অন্ধের মত গাড়ি চালাচ্ছিল বেপরোয়া কোনও মাতাল চালক? হয়তো হ্যাঁ। হয়তো বা না।
স্বস্তিটাকে ছাপিয়ে উঠল বিব্রতকর একটা অনুভূতি। না দেখেও বুঝতে পারল, লাল হয়ে উঠেছে কান দুটো। ব্যাপারটা যদি নিছকই মনের খেয়াল হয়ে থাকে, তবে কি উচিত হলো চিঠিগুলো পাঠানো? … ধুর, বোকামিই হয়ে গেল বোধ হয়!
চিঠি দুটো যেন পোস্ট করতে ব্যর্থ হন ভদ্রমহিলা, এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।
জানালার পর্দা সরিয়ে দিল ক্যারেন।
ঝড়ের বিরাম নেই। একটু পর পর আকাশের বুকে চাবুক চালাচ্ছে বিদ্যুৎশিখা। আর তার মুহূর্ত কয়েক বাদেই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে বজ্রের হুঙ্কার।
বেশ বুঝতে পারছে ক্যারেন, আজ আর ঘুম আসবে না। ইতস্তত হাঁটতে আরম্ভ করল ছোট্ট বেডরুমে। দুশ্চিন্তা বিদায় নিয়েছে। তা-ও কেন আসতে চাইছে না স্বস্তিবোধ?
এক পর্যায়ে সাইড-লাইটটা জ্বেলে দিয়ে, বাক্স খুলে হাতে তুলে নিল শখের ভায়োলিনটা।
একই ফ্লোরের প্রতিবেশী কানে খাটো হওয়ার সুবিধা এ-ই—মন চাইলেই বাজাতে পারে বাজনা। বাজ পড়ার বিকট আওয়াজও বোধ করি জ্বালাতন করতে পারে না একাকী বৃদ্ধাকে। ব্যাপারটার অবশ্য সুবিধা-অসুবিধা—দুই-ই রয়েছে।
ভাগ্যিস, বিক্ষিপ্ত মনটাকে আরেক দিকে ব্যস্ত রাখার উপকরণ রয়েছে ওর হাতে! দীর্ঘ রাতটা পার করা মুশকিল হয়ে যেত নইলে!
চারটে তার সুরে বেঁধে নিয়ে থুতনির নিচে বাদ্যযন্ত্রটা জুত করে ধরল ক্যারেন। বেহালার ছড় স্পর্শ করল বেহালার তার। তার আর ছড়ের জাদুতে বাজতে শুরু করল জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ-এর সোনাটা। কয়েক হপ্তা ধরেই আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে ও সুরটা।
জানালার ওপাশে আরও একবার ঝলসে উঠল আলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দপ করে নিভে গেল বাতি। আঁধারে ডুবে গেল গোটা অ্যাপার্টমেন্ট।
বজ্রের গুড়গুড়র মাঝে ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিল ক্যারেন। বাজনা বন্ধ করল না অবশ্য। রাস্তার ওপাশের হোটেলের নিয়ন সাইনের নীল আলো দেখেই বাজাতে পারছে বেশ। আলো-আঁধারিতে মূর্ত হতে থাকল বেহালার মূর্ছনা।
কিন্তু থেমে যেতে হলো একটা পর্যায়ে।
না, আলোর অভাবে নয়।
কুঁচকে গেছে ক্যারেনের ভ্রু জোড়া।
শব্দ হলো না একটা?
বজ্রগর্জন নয়। অন্য কিছু!
আওয়াজটা এসেছে সম্ভবত ছাত থেকে। কিন্তু আর তো কোনও ফ্লোর নেই উপরে!
বাতাসে পড়ে-টড়ে গেছে বোধ হয় কিছু। নয় তো কোনও কিছুর ভাঙা টুকরো পড়েছে ছাতে।
নাকি বিড়াল-টিড়াল?
নাহ! এমন ঝড়-দুর্যোগের রাতে বিড়াল বেরোবে না।
আবারও বাজতে লাগল বাখ সোনাটা।
যদিও ক’টা নোটের বেশি তুলতে পারল না এবার। তার আগেই তারের গায়ে বেসুরোভাবে গুঙিয়ে উঠল ছড়টা।
আরেকটা আওয়াজ কানে এসেছে এবার!
সন্দেহ নেই, কেউ হাজির হয়েছে ওর অ্যাপার্টমেন্টে! পদশব্দ লুকানোর কোনও চেষ্টাই করছে না অনুপ্রবেশকারী।
শীতল পরিবেশেও ঠাণ্ডা ঘাম ফুটল ক্যারেনের কপালে। হঠাৎই কাঁপুনি শুরু হয়েছে হাঁটু দুটোয়। জোর পাচ্ছে না পায়ে। যেন নরম রবারে তৈরি পা জোড়া।
কোনও অস্ত্র দরকার নিজেকে রক্ষার জন্য। কিচেন- টেবিলে রাখা চাকুর সেটটার কথা মনে হতেই বেহালা আর ছড়টা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলেই ছুট দিল ক্যারেন দরজার দিকে। নিজেকে মনে হচ্ছে সাসপেন্স মুভির কোনও চরিত্র।
দু’কদমও এগোয়নি, থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো মেয়েটা। কার্পেটবিহীন কাঠের মেঝেতে পিছলে যাওয়ার উপক্রম হলো পা দুটো। ধড়াস করে এক লাফ মেরেছে হৃদযন্ত্রটা।
চোখ ধাঁধানো আরেকটা বিজলিঝলক কামরাটা আলোকিত করে তুলতেই দেখতে পেয়েছে ও দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটা—কিচেনে যাওয়ার পথ রুদ্ধ!
অবর্ণনীয় আতঙ্কে পেছোতে শুরু করল ক্যারেন। দলা পাকানো কান্নার মত অনুভূতি গলার কাছে।
অনুপ্রবেশকারী পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ল ওর শোয়ার ঘরে। বিজলির আলো আর হোটেল-সাইনের নীল আভায় আগন্তুকের ভীতি জাগানো দেহাবয়ব দেখতে পাচ্ছে তরুণী।
লম্বায় ইলেকট্রিকের খাম্বা যেন লোকটা। কাঁধ বুনো মোষের মত। পরনের সব কিছুই কালো তার। সোনালি চুলগুলো খাটো করে ছাঁটা। নিষ্ঠুর, চোখা চেহারাটা হোমোসেক্সুয়ালদের মত। পাতলা, লালচে ঠোঁট। সরু হয়ে এসেছে সবুজরঙা চোখ দুটো। কোমরে ইউটিলিটি বেল্ট। যেমনটা পরে থাকে ছুতোর মিস্তিরি ও নির্মাণশ্রমিকেরা।
যুক্তিহীন একটা সম্ভাবনার উদয় হলো ভীতবিহ্বল মেয়েটার মনে—বাথরুম মেরামতের কাজে এসেছে কোনও ওঅকম্যান?
বেল্টের খোপ থেকে ক্ল-হ্যামারটা হাতে উঠে আসতেই দূর হয়ে গেল সম্ভাবনাটা। সাক্ষাৎ যমের মত এগিয়ে আসছে মূর্তিমান আতঙ্ক।
খাবলা দিয়ে খাটের উপর থেকে ভায়োলিনের সরু অংশটা মুঠো করে ধরল ক্যারেন। ধাঁই করে সামনের দিকে চালাল বেহালার চওড়া দিকটা।
এতটাই জোরে মেরেছে যে, প্রকাণ্ডদেহীর কপালে লেগে দু’টুকরো হলো বাদ্যযন্ত্রটা। কাঠের টুকরোর আঁচড়ে ত্বক চিরে বেরিয়ে এল রক্ত-নীল আলোয় কালো দেখাচ্ছে।
অতর্কিত এই আক্রমণেও এক বিন্দু টলেনি যেন সোনালিচুলো আগন্তুক। পাল্টা হাতুড়ি চালিয়ে ভাঙা বেহালা খসিয়ে দিল ক্যারেনের হাত থেকে।
মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে গেল মেয়েটা।
‘দয়া করে…’ বলে মিনতি করতে যাচ্ছিল, শেষ হলো না কথা।
সাঁই করে বাতাস কাটল আবার হ্যামারটা।
দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো তরুণীর। অন্ধ করে দেয়া যন্ত্রণার উজ্জ্বল বিস্ফোরণ ঘটল মগজে। চিত হয়ে পড়ল সে বিছানায়।
দশাসই লোকটা ঝুঁকে এল ক্যারেনের উপর, পেশল মুঠোয় ধরা মারাত্মক হাতুড়ি। রক্তাক্ত ক’টা লম্বা চুল আলগোছে লেগে রয়েছে ইস্পাতের গায়ে।
কোনও তাড়া নেই লোকটার। ধীরেসুস্থে বিছানার চাদরে মুছে পরিষ্কার করল হাতিয়ারটা। ফেরত গেল ওটা বেল্টের নির্দিষ্ট জায়গায়।
এবার বেলনাকৃতি একটা টিউব বেরোল লম্বা এক থলে থেকে। স্বচ্ছ প্লাসটিকের নজল আর প্লাঞ্জারের মত কী যেন যুক্ত রয়েছে টিউবে।
আরও ঝুঁকে এল লোকটা।
পুরোপুরি চেতনা হারায়নি ক্যারেন, ব্যথার কুয়াশার মাঝে হাসতে দেখল লোকটাকে। হোটেলের নিয়ন আলোয় পিশাচের মত দেখাচ্ছে ওকে।
‘সময় এসেছে সুন্দর মুখটা জন্মের তরে বুজে দেয়ার,’ বিড়বিড় করে উঠল ইংরেজিতে।
হাতুড়ির আঘাতে বধির ক্যারেন শুনতে পেল না সেটা। মৃত্যুদূতের হাতে ওটা কী, হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে প্রাণভয়ে ফোঁপানি বেরোল অসাড় ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। বিছানায় কেঁচোর মত শরীর কুঁকড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ও মরিয়ার মত।
খপ্ করে ওর চুল চেপে ধরল অনাহূত আগন্তুক এক হাতে, থেঁতলানো মাথাটা ঠেসে ধরল বিছানায়। হাতে-মুখে ক্যারেনের দুর্বল আক্রমণগুলো কেয়ারই করছে না।
নজলটা ভরে দেয়া হলো চিৎকাররত মুখটায়।
শক্ত প্লাসটিকে দাঁত বসাল ক্যারেন গুঙিয়ে উঠে, মুখের ভিতর থেকে প্রাণপণে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছে টিউবটা। নির্দয়ভাবে ওটা গলা পর্যন্ত ঠেলে দেয়ায় রোধ হয়ে এল কণ্ঠনালি।
প্লাঞ্জারে চাপ দিল আগন্তুক।
নরম, উষ্ণ, কটু স্বাদের কিছুতে ভরে উঠল ক্যারেনের মুখগহ্বর।
চেষ্টা করল কাশি দিয়ে উগরে দেয়ার, হাঁসফাঁস করে উঠল বাতাসের অভাবে। তরল জিনিসটা পরিমাণে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চাপে ফেটে যাওয়ার জোগাড় হলো ওর ফুসফুস।
শ্বাস নিতে পারছে না ক্যারেন, চিৎকার তো দূরের কথা! নাড়ানোর জো নেই চোয়াল।
এতক্ষণে সাঙ্গ হলো বাঁচার জন্য নিষ্ফল জোরাজুরি। অনুভব করল, ঘন ফেনা গড়াচ্ছে দু’ঠোঁটের কশ বেয়ে।
খালি হয়ে যাওয়া ক্যানিস্টারটা বিছানায় ফেলে দিল নকল রিপেয়ারম্যান। খিঁচুনি ওঠা নারীদেহটা টেনে নামাল খাট থেকে।
ইতোমধ্যে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে ক্যারেনের গোটা দেহে। বাতাসের জন্য বার কয়েক প্ৰবল ঝাঁকুনি খাওয়ার পর শিথিল হয়ে এল ওর শরীর।
সিধে হলো জল্লাদ।
দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে মেয়েটার। আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে ওর দুনিয়াটা। আরও কয়েকটা সেকেণ্ড চেয়ে থাকতে পারল নীল আলোয় আলোকিত আবছা আকৃতিটার দিকে।
মাথাটা সামান্য কাত করে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে খুনি।
চার সেকেণ্ড পর জীবনের তরে সমস্ত দৃশ্য মুছে গেল ক্যারেনের চোখ থেকে। খোলা অবস্থাতেই নিথর হয়ে গেল চোখের পাতা।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, মেয়েটার পালস দেখল আততায়ী। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে, নিশ্চিত হয়ে কামরা ত্যাগ করল সন্তুষ্ট চিত্তে।
ফ্ল্যাটের দরজা আধভেজানো রেখে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল সে সিঁড়ির দিকে।