ঊনত্রিশ
নিজের ডেস্কে বসে, নীরব-নির্জন অফিসরুমের একদিকের প্রায় গোটা দেয়াল জুড়ে লটকে থাকা বিশাল স্ক্রিনটার দিকে চেয়ে রয়েছে চিফ। ঠোঁটে কুঞ্চন। গভীর অভিনিবেশের কারণে কুঁচকে রয়েছে কাঁচাপাকা ভুরু জোড়াও। পরস্পরের খাঁজে খাঁজে এঁটে বসা দু’হাতের আঙুলগুলো।
মসৃণ ভঙ্গিতে পর্দা জুড়ে ভেসে চলেছে বিশাল এক কনটেইনার শিপ। ওটার হাই-ডেফিনিশন ভিডিয়োর দিকে তাকিয়ে থাকলেও বৃদ্ধের ভাবনার খেয়া ভাসছে অন্যত্র। ক’দিন আগেও যে-জাহাজখানা ছিল তার পরিকল্পনার সবটা জুড়ে, এ মুহূর্তে সেটার লেশটুকুও মিলবে না মনোজগৎ তালাশ করে।
রিমোটটা তুলে নিয়ে বাটন চাপল স্ক্রিনের দিকে লক্ষ্য স্থির করে। জাহাজের ছবি চলে গিয়ে নিউজ রিপোর্টের ফুটেজ এসে ঠাঁই নিল তার জায়গায়। একটু আগে খবরটা প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুড়োর।
ইলিয়েলদের পারিবারিক গির্জার পোড়া ধ্বংসাবশেষে অনুসন্ধান শেষ হয়েছে ফ্রেঞ্চ এমার্জেন্সি সার্ভিসের। সামনের আরেকটা স্ক্রিনে শোভা পাচ্ছে ওদের অফিশিয়াল রিপোর্টটা। জোর দিয়ে বলা হয়েছে ওতে: একটা মাত্র ডেড বডিই পাওয়া গেছে ওখানে, আর সেটা হলো পারিবারিক সমাধিতে গোর দেয়া মানুষটার।
সাত ঘাটের পানি খাওয়া মানুষ চিফ। অথচ তাকেই কিনা টেক্কা দিয়ে গেল মাসুদ রানা নামের উড়ে এসে জুড়ে বসা এক খেলোয়াড়!
ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চলে এসেছে চিফের টেবিলে । ঘটনাস্থলে পাওয়া অ্যালপিনাটা নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সির নামে রেজিস্টার করা। চুরি হয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছে থানায়!
এর মানে হলো- বৃদ্ধের উপলব্ধি—নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছিল রানা, ট্র্যাকিং ডিভাইস প্ল্যান্ট করা হয়েছে গাড়িতে। আরও বোঝা যায়, ওদের চাইতে এক কদম এগিয়ে রয়েছে টার্গেট। চিফের এতগুলো বছরের অভিজ্ঞতায় যা অভূতপূর্ব!
গির্জার কারাগার থেকে পালানোর মত আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটা কীভাবে যে করল ওরা, ঈশ্বরই জানেন! কোথায় যে ডুব মারল এর পর, তিনিই কেবল বলতে পারবেন!
অনিশ্চয়তা পছন্দ নয় চিফের। পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভুল করেছে গিবসন। মাফ করা যায় না এ ধরনের ভুলভ্রান্তি। আবার যাতে না ঘটে এমনটা, দেখতে হবে সেটা।
সময় হয়েছে বাংলাদেশি যুবকের ব্যাপারে রেড অ্যালার্ট জারি করার। আরও কোনও ক্ষতি করার আগেই দমন করতে হবে অতি বিপজ্জনক এই লোকটাকে। টপ-লেভেল প্রায়োরিটি এটা।
ইন্টারকম বেজে ওঠায় ব্যাহত হলো চিন্তার গতি। বাটন টিপে নিজের রাইটহ্যাণ্ডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল বৃদ্ধ চিফ। সামান্য অস্থিরমতি হলেও সতেরো বছরের ঝানু টিমমেম্বার গ্রেগর সামসা।
‘ভালো খবর, স্যর। সিকিউরিটি ক্যামেরার ছবি পাওয়া গেছে মাসুদ রানা আর সেলেনা বার্নহার্টের। পনেরো মিনিট আগে ঢুকেছে ওরা প্যারিসের ব্যাঙ্ক ন্যাশনালে-র বুলেভার্ড জর্ডান শাখায়। ফেইশাল রিকগনিশন সফটওয়্যার নিশ্চিত করেছে দু’জনের পরিচয়।’
‘কোথায় আছে এ মুহূর্তে?’
‘ভিতরেই, স্যর। বেরোয়নি এখনও ব্যাঙ্ক থেকে।’
‘আমার স্ক্রিনে দাও ভিডিয়োটা।’ আবার রিমোট চাপল চিফ।
নিউজ রিপোর্ট গায়েব হয়ে গিয়ে ভিডিয়ো প্লেব্যাকে ছেয়ে ফেলল দেয়াল।
ব্যাঙ্কের বাইরের রাস্তায় পেডেস্ট্রিয়ানদের চলমান স্রোত ঈগলের নজরে জরিপ করতে লাগল কুঞ্চিত চোখ দুটো। ধূসর একখানা মার্সিডিস ট্যাক্সিকে উঠে আসতে দেখল কার্বসাইডে। যাত্রীরা বেরিয়ে এসে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরল ওপারের পেভমেন্ট অভিমুখে, রাস্তা পেরিয়ে এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে পড়ল ব্যাঙ্কে।
চামড়ার জ্যাকেট পরা কালো চুলের যুবক ও তার সঙ্গিনীই মাসুদ রানা আর সেলেনা বার্নহার্ট।
‘ভিতরের কী অবস্থা?’ জানতে চাইল চিফ। ‘ওখানকার ভিডিয়ো সিস্টেমের অ্যাকসেস পাওনি?’
‘চেষ্টার ত্রুটি করছে না হ্যাকাররা, স্পিকারে শোনা গেল গ্রেগর সামসার কণ্ঠ। ‘যে-কোনও মুহূর্তে পেয়ে যাব বলে আশা করছি; স্যর।
‘ভালো মার্কস দিতে পারছি না তোমাদের, ‘ অননুমোদনের সুর ফুটল বৃদ্ধের কণ্ঠে। ‘আরও তাড়াতাড়ি ইমপ্রুভমেন্ট চাই। গিবসন কোথায়?’
‘এরই মধ্যে রওনা হয়ে গেছে, স্যর। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা ওখানে।
‘সমস্ত এক্সিটে নজর রাখা হোক ক্যামেরার চোখ দিয়ে। এই বার যেন না ফসকায়। বোঝাতে পেরেছি?’ শেষ হলো কথা।
আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে মুদল বৃদ্ধ ক্লান্ত চোখ দুটো। যে-গতিতে এগোচ্ছে কাজ, মোটেই খুশি নয় তাতে।