1 of 2

শকওয়েভ – ২৫

পঁচিশ

সেফহাউসে ফিরে আর্মারড গেটটা যখন লক করল রানা, সময় তখন রাত তিনটে।

সঙ্গত কারণেই ঘুম দরকার ওদের। অথচ তরও সইছে না সমাধিকক্ষ থেকে উদ্ধার করে আনা হার্ড ড্রাইভটা দেখার জন্য।

চটজলদি সাফ-সুতরো হলো দু’জনে। কড়া করে ধূমায়িত কালো কফি তৈরির পর, বহু দিনের অব্যবহৃত নোটবুক কমপিউটারটা বের করল রানা।

‘অতটা আধুনিক নয় এটা,’ বলল ও। ‘তবে কাজ চলে যাবে।’

খালি ডেস্কের উপর কমপিউটারের ছোট সংস্করণটা রেখে দুটো চেয়ার টেনে নিল রানা। আর ওর ক্যানভাস ব্যাগ থেকে হার্ড ড্রাইভ বের করল সেলেনা। ‘দেখা যাক, অমূল্য কী রতন রয়েছে এর মধ্যে।

‘অথবা জাহান্নামের আগুনে বাষ্প হয়ে গেছে কি না ভিতরের জিনিস…’

‘কুফা লাগিয়ো না তো, রানা!’

কুফা নয়, হার্ড ড্রাইভ লাগাল রানা নোটবুকে।

‘আমারও অবশ্য ভয় লাগছে কিছুটা,’ নিজেই স্বীকার করল সেলেনা নোটবুকটা টেনে নিয়ে। ‘এটাই আমাদের একমাত্র সূত্র। আর এটাই যদি নষ্ট হয় তো…’

কিয়ৎক্ষণের উত্তেজিত প্রতীক্ষা শেষে সমন্বয় হলো মেশিন আর হার্ডওয়্যারের।

‘এই তো!’ ড্রাইভে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সেলেনা। ‘ক্যারেনের টেসলা নিয়ে গবেষণা! দেখা যাক, কোনও পথ দেখায় কি না আমাদের।

‘সেরেছে!’ বলে উঠল রানা ডেটা ফাইলের তালিকা দেখে। ‘বড় কম তো নয় দেখার জিনিস।

‘সারা রাত লেগে যাবে,’ লিস্টে চোখ বুলিয়ে সায় দিল সেলেনা।

‘শুরু করে দাও তা হলে।’ গরম কফিতে চুমুক দিল রানা।

‘রেডি!’ স্ক্রিনের কাছাকাছি চোখ নিয়ে এসেছে সেলেনা। ‘দেখে মনে হচ্ছে, টেকনিকাল বিষয়-আশয় রয়েছে পিডিএফ ফাইলগুলোতে।’

একের পর এক খুলে দেখতে লাগল ডকুমেন্টগুলো। বিশ শতকের শুরুর দিকের বিচিত্র, বিস্ময়কর টেকনোলজিকাল ডিভাইসসমূহের অরিজিনাল ব্লুপ্রিন্টের স্ক্যানড কপি ওসব।

‘যা যা দেখছি, সবই টেসলার নিজের ডিজাইন করা,’ বলল সেলেনা। ‘যিশুই জানেন, কোত্থেকে এগুলো জোগাড় করল ক্যারেন!!

দেখতে দেখতে একটা ফাইল ওপেন করে পাওয়া গেল সেলেনার বান্ধবীর তৈরি আধুনিক টেসলা অসিলেটরের ড্রইং, সঙ্গে ওর নিজস্ব প্রতিবেদন এবং নির্মাণ ও পরীক্ষার পর্যায়ক্রমের ইমেজগুলো।

‘টেকনিকাল এসব ড্রইঙের চাইতে ভালো কিছু দরকার বিষয়টা বোঝার জন্যে।’ খানিকটা বিরক্তি লাগছে রানার।

ফাইলটা ক্লোজ করল সেলেনা। স্ক্রল করে নিচে নামল আরও। ‘অনেক জিনিস… কোনটা যে খুলি! দাঁড়াও… এটা মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং কিছু।’

TUNGUSKA লেখা ডকুমেন্ট ফাইলটায় ক্লিক করল। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞান সাময়িকীর স্ক্যান করা পৃষ্ঠা ওটা।

‘টুঙ্গুসকা-কাহিনী?’ স্বগতোক্তি করল রানা ডকুমেন্টটা স্ক্রিনে আসতেই। জনশূন্য বিধ্বস্ত ল্যাণ্ডস্কেপ দেখা যাচ্ছে হাফটোনের একরঙা ছবিতে। অসংখ্য মহীরুহ লুটিয়ে পড়ে আছে অতিকায় এক ভূ-গহ্বর ঘিরে।

পাতাটার নিচে চলে এল সেলেনা। ‘জানো তুমি এটার ব্যাপারে?’

‘বিস্তারিত না।’

‘ঠিক আছে, অল্প কথায় ব্যাখ্যা করছি।

‘সময়টা উনিশ শ’ আট সালের জুন মাস। ঘটনাস্থল: সাইবেরিয়ার টুঙ্গুসকা। পৃথিবীর উপর ইতিহাসের বৃহত্তম উল্কাপিণ্ড বা ধূমকেতুর প্রভাব মানে, তেমনটাই বলা হয়ে থাকে আর কী। অনুমান করা হয়, দশ থেকে পনেরো মেগাটন টিএনটির সমান ছিল ওটার বিধ্বংসী ক্ষমতা। অর্থাৎ, হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার চাইতেও এক হাজার গুণ শক্তিশালী। দুই হাজার বর্গ কিলোমিটার জঙ্গলের আট কোটি গাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে লোকালয় থেকে জায়গাটা বহু দূরে বলে উল্লেখযোগ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’

‘উল্কাপাতের ব্যাপারে ইনফর্মেশন জড়ো করার প্রয়োজন পড়ল কেন ক্যারেনের?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল রানা। ‘উল্কা জিনিসটা তো ন্যাচারালিই পৃথিবীতে এসে পড়ে প্রায়শ, তা-ই না?’

‘আশ্চর্য ব্যাপার হলো, টুঙ্গুসকার ওটা কিন্তু মোটেই হিট করেনি পৃথিবীতে, ‘ বলল সেলেনা। ‘যদিও সংঘর্ষ ক্যাটাগরিতেই ফেলা হয়েছে ঘটনাটাকে। এমনকী প্রমাণ হিসেবে মেলেনি কোনও উল্কাপিণ্ডও। তা হলে ঘটল কেন ওরকম একটা এক্সপ্লোশন? আজও তা রহস্য। তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, কারণটা বিরাট কোনও ধরনের শকওয়েভ।’

‘কিন্তু টেসলার সঙ্গে সম্পর্ক কী এটার?’ জিজ্ঞাসা রানার। ‘শকওয়েভের ধারণাটা সত্যি হলে ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। কারও কারও বিশ্বাস, টেসলাই দায়ী ওই শক- ওয়েভের জন্যে।’

‘ঠাট্টা করছ?’

‘এই ডকুমেন্টটাও ওই কন্সপিরেসি নিয়ে।’ স্ক্রল করে নিচে নামছে সেলেনা। ‘এই যে… এখানে দেখো… ‘সেসময় ধারণা করা হয়, ওয়ার্ডেনক্লাইফ টাওয়ারের সাহায্যে ওরকম ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে ঘটনা ঘটাতে সক্ষম বিশাল শক্তিচার্জ পাঠিয়েছিলেন ওখানে টেসলা।’‘

‘ওয়ার্ডেনক্লাইফ টাওয়ার?’

‘বিশেষভাবে তৈরি এক ল্যাবোরেটরি। নিউ ইয়র্ক থেকে পঁয়ষট্টি মাইল দূরের লং আইল্যাণ্ডে, অতিকায় এক টাওয়ারের মধ্যে ছিল ওটার অবস্থান। ইউএস স্টিলের প্রতিষ্ঠাতা জে. পি. মরগান অর্থায়ন করেন এর পিছনে। টেসলার সবচেয়ে বড় প্রাইভেট স্পনসর ছিলেন তিনি।

‘ইস্পাতের মাশরুমের আদলে গড়া হয়েছিল প্রায় দু’শ’ ফুট উঁচু এই টাওয়ার, উনিশ শ’ এক কি দুই সালের মধ্যে। নয়া জমানার বৈপ্লবিক ওয়াওয়ারলেস টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিটার হিসেবে নির্মিত হলেও, টেসলা ওটাকে মারণরশ্মি মেশিনের আঁতুড়ঘর বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তলে তলে। তিনি অবশ্য বলতেন—শান্তিরশ্মি। সার্বিয়ান বিজ্ঞানী নাকি দাবি করেছিলেন, ওই রশ্মি দিয়ে এমন এক বৈদ্যুতিক শিল্ড তৈরি করা যাবে, যা ভেদ করে কোনও দেশেরই আমেরিকার উপর আক্রমণ করার সাধ্য হবে না; উল্টো আমেরিকাই অকল্পনীয় শক্তির রশ্মি ছুঁড়তে পারবে দুনিয়াব্যাপী।’

‘আই সি…’

‘জানি, কেমন শোনাচ্ছে। তবে, সামান্য ভাইব্রেশনের মাধ্যমে ইমারত ধ্বংসের মতনই সহজ এটা। ছোটখাটো গৃহস্থালি যন্ত্রে যে-তড়িৎপ্রবাহ চালিত হয়, এর সঙ্গে ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত তড়িৎপ্রবাহের পার্থক্যটা কেবল সময়ের। দু’শ’ চল্লিশ ভোল্টের কোনও যন্ত্র এক ঘণ্টা চালাতে যতটুকু এনার্জি প্রয়োজন, একই এনার্জি সেকেণ্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ে প্রয়োগ করলে বার্স্ট হয়ে যাবে যন্ত্রটা। এবার একটা ট্রান্সমিটারের কথা কল্পনা করো, এক শত মিলিয়ন ভোল্টের প্রেশার এবং এক শ’ বিলিয়ন ওয়াটের তড়িৎপ্রবাহ উৎপাদন করতে পারে যেটা। একই সঙ্গে অনুরণিত হচ্ছে দুই মেগাহার্টজ রেডিয়ো ফ্রিকিউয়েন্সিতে। মানেটা হলো, অসিলেশনের এক সাইকেলে উৎপন্ন এনার্জি হবে দশ মেগাটন বিধ্বংসী ক্ষমতার অধিকারী। তুমিই দেখো না… আলোর গতিসম্পন্ন রেডিয়ো সিগনাল ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের শক্তি পাচ্ছ না তুমি? তার পর তো বাটন স্পর্শ করেই মুহূর্তের মধ্যে নরক নামিয়ে আনতে পারছ পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায়।’

এমন বিশ্বাসযোগ্য শোনাচ্ছে সেলেনার কথাগুলো যে, সন্দেহ পুষে রাখার আর উপায় দেখছে না রানা।

‘হিটলারের চাইতেও সর্বকালের সবচেয়ে বিপজ্জনক উন্মাদ মনে হচ্ছে এই টেসলাকে,’ না বলে পারল না ও।

‘মজার ব্যাপার কী, জানো? ওয়ার্ডেনক্লাইফের পৃষ্ঠপোষকেরাও একই কথা ভেবেছিল, যখন জানতে পারল, কী নিয়ে মেতে ছিলেন টেসলা। বিনা নোটিসে ফাণ্ডিং বন্ধ করে দেয় তারা, একই সঙ্গে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয় টাওয়ারে। তবে কারও কারও মতে, এতেও নাকি দমানো যায়নি বিজ্ঞানীকে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে প্রজেক্ট চালু রাখার আর কোনও উপায় ছিল না তাঁর। অভিযোগ রয়েছে, ওই ঘটনার অনেক পরে, উনিশ শ’ আট সালে নাকি মারণরশ্মি নিয়ে গোপনে এক্সপেরিমেন্ট চালান টেসলা।’

আর্টিকেলের লেখাটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেল রানা। বেশির ভাগ টেকনিকাল ইনফর্মেশনই অবশ্য মাথার উপর দিয়ে গেল। তবে ধরতে পারল নিবন্ধটার সারসংক্ষেপ।

টুঙ্গুসকা দুর্ঘটনার পর, তহবিল হারিয়ে হতাশ টেসলার ব্যাপারে রিপোর্ট আসে, তিনি নাকি এনার্জি বিম পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন আর্কটিক সার্কেলে। উদ্দেশ্য: অ্যাডমিরাল রবার্ট পিয়েরির দৃষ্টি আকর্ষণ। উনিশ শ’ আট সালের জুলাই মাসে প্রথম অভিযাত্রী হিসেবে উত্তর মেরুতে পদার্পণের লক্ষ্যে বহর নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পিয়েরি। এর মাস কয়েক আগে প্রভাবশালী এ-মেরু-অভিযাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন টেসলা। অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা ঘটে কি না অভিযানের সময়, খেয়াল রাখার অনুরোধ করেন পিয়েরিকে।

ছোট্ট যন্ত্রটাকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে চাওয়াটাই যদি টেসলার উদ্দেশ্য হতো, ব্যর্থতার দায় চাপত ঘাড়ে। কারণ, বিপজ্জনকভাবে ভুল দিকে মোড় নিয়েছিল ওঁর এক্সপেরিমেন্ট। নির্ধারিত লক্ষ্য ছাড়িয়ে সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলে গিয়ে পড়ে রশ্মি, ছারখার হয়ে যায় বিশাল এলাকা। টেসলার ভাগ্য ভালো, লোকবসতি থেকে দূরে ছিল জায়গাটা। উনিশ শ’ সতেরো সালের রুশ বিপ্লব, এবং তারই পথ ধরে গৃহযুদ্ধের সূচনায় টুঙ্গুসকা-দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ অপ্রকাশিতই থেকে যায় উনিশ শ’ সাতাশ সালের আগপর্যন্ত।

‘অনুমাননির্ভর ধারণা নিশ্চয়ই এগুলো?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘সত্যিকারের প্রমাণ কি রয়েছে?’

‘কবেই বা ছিল!’ শুকনো হেসে, ফাইলটা বন্ধ করল সেলেনা। এবার খুলল।UNGUSKA 2 লেখা ওটার পরের ফাইল।

সাম্প্রতিক কালের কোনও বিজ্ঞান সাময়িকীর নাতিদীর্ঘ এক প্রতিবেদনের স্ক্যান-কপি ওটা।

‘আরে, অদ্ভুত তো!’ বিস্ময় প্রকাশ করল সেলেনা। ‘শোনো, কী লিখেছে:

‘মার্চ মাসের ঘটনা। প্রাচীন কালের হারানো হিন্দু মন্দিরের খোঁজে বন ইউনিভার্সিটির ডক্টর ক্রিস্টোফ ওয়াল্টসের নেতৃত্বে কাজাখস্তান ও মঙ্গোলিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালানো প্রত্নতাত্ত্বিক দলটির সদস্যরা বিমূঢ় হয়ে পড়েন বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ভয়াবহ এক ধ্বংসক্ষেত্র চাক্ষুষ করে, তখনও পর্যন্ত যেটার কথা অজানা ছিল বিশ্ববাসীর। ধ্বংসের প্রকৃতির সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে আজও-রহস্যাবৃত টুঙ্গুসকার ঘটনাটির। তবে ক্ষয়ক্ষতিতে ওটাকে ছাড়িয়ে গেছে বহু গুণে। শুরুর দিকের প্রতিবেদনগুলোতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে—গ্রহাণু-সদৃশ কিছু হয়তো আঘাত হেনেছে দূরবর্তী এলাকাটিতে; যদিও এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে প্রথম সারির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের মধ্যে।’

‘এটার জন্যে কি দায়ী করা যাবে টেসলাকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বোধ হয় না। কীভাবে হলো তা হলে এমনটা?’ ফাইলটা বন্ধ করল সেলেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বোলাতে লাগল আবার তালিকা ধরে। ‘বেশ কিছু ইমেজ ফাইলও দেখতে পাচ্ছি, রানা। দেখা যাক, কী আছে এগুলোর মধ্যে।’

ক্লিক করে করে খুলতে লাগল ও ইমেজগুলো।

‘এবারে সত্যিই উদ্ভট হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা,’ মন্তব্য করতে বাধ্য হলো মেয়েটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *