চব্বিশ
আগেই খেয়াল করেছে রানা। স্টেশন থেকে বেরোনোর মুহূর্তেই। লোকটার সামান্য সন্দেহজনক অঙ্গভঙ্গি সতর্কঘণ্টি বাজিয়ে দিয়েছে ওর মনের মধ্যে।
‘থেমো না, সেলেনা।’ বাহু ধরল ও মেয়েটার। ‘হাঁটতে থাকো স্বাভাবিকভাবে। পিছনে তাকিয়ো না আর।’
রাস্তা পেরোল ওরা। চলেছে নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশনের দিকে। রু সেইন্ট-ল্যাজার আর প্লেস দিউ হ্যাভারের কোনায় ওটা।
চোখের কোনা দিয়ে অনুসরণকারীর উপর নজর রেখেছে রানা। গম্ভীর হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর। যে-কোনও মুহূর্তে হুডির পকেট থেকে অস্ত্র বেরিয়ে আসতে পারে লোকটার হাতে।
এত তাড়াতাড়ি কীভাবে ওদের ট্রেইল খুঁজে পেল ওরা?
শঙ্কা আর সতর্কতায় বেড়ে যেতে লাগল নাড়ির গতি।
ফকফকা আলোয় আলোকিত সাবওয়েতে নামার পরও পিছু ছাড়ল না লোকটা।
এ-লোক যদি ওদেরই একজন হয়ে থাকে, খুব সম্ভব একা নয় সে। যখন-তখন উদয় হতে পারে অন্যরা।
স্টেশনে জনপ্রাণী নেই বললেই চলে। দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা সর্পিল টানেলে।
পকেটে ঢোকানো ডান হাতের আঙুলগুলো ছুরির বাঁটের উপর এঁটে বসা, দু’জনে একটা বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হতেই চলার গতি বাড়াল অনুসরণকারী।
কিন্তু কোনাটা ঘুরতেই বুদ্ধ বনে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে চকিতে দৃষ্টি বোলাতে লাগল চারপাশে।
গেল কোথায় ওরা?
হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন!
অপ্রত্যাশিত এক বেমক্কা ধাক্কায় বুক থেকে বেরিয়ে গেল সবটুকু বাতাস। সজোরে আছড়ে পড়ল সে সুড়ঙ্গের টাইলস বসানো দেয়ালে।
একবার নয়, পর পর দু’বার আছড়াল ওকে রানা দ্রুততম সময়ে।
আঘাতটা সামলাতে পারল না বেচারা। থপ করে লুটিয়ে পড়ল দেয়াল ঘেঁষে। ধারাল অস্ত্র ধরা হাতটা দুর্বল ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল পকেট থেকে।
ইঞ্চি চারেক দূরে ছিল রানা। ফলাটা ওর দিকে এগিয়ে আসতেই নিঠুরভাবে মুচড়ে দিল ছুরি ধরা হাতটা।
কর্কশ আর্তধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো নির্জন টানেলে। কিছু বুঝতে পারার আগেই ছুরিটা চেপে বসল অস্ত্রধারীর গলায়।
‘হু দ্য হেল আর ইউ?’ লৌহকঠিন কণ্ঠে উত্তর দাবি করল রানা। ‘মুখ খোলো!’
চোখমুখ—দুই-ই বিস্ফারিত বদমাশটার। এক তিল নড়ার সাধ্য নেই রানার বজ্র-আঁটুনির মাঝে।
‘ইহ-ইংরেজি বুঝি না…’ ফরাসিতে বলতে পারল কোনও রকমে।
‘জিজ্ঞেস করেছি, কোন্ ঝাঁকের কই তুমি!’ ফ্রেঞ্চে বলল এবার রানা। ‘পাঁচ সেকেণ্ড সময় পাচ্ছ জবাব দেয়ার জন্যে। ভেবো না যে, কল্লা ফাঁক করব না তোমার। এর চেয়ে অনেক কম অপরাধ করেও জবাই হয়েছে লোকে আমার হাতে।’
ও যে মিথ্যা হুমকি দিচ্ছে না, চেহারার অভিব্যক্তি আর কণ্ঠস্বরে বিশ্বাস করতে এতটুকু কষ্ট হলো না ছুরিধারীর।
‘ইভ… ইভ যঁতাদ নাম আমার!’ পরিচয় দিল সে নিজের।
‘কাদের হয়ে কাজ করছ তুমি?’ রানার পরের প্রশ্ন।
‘কারও হয়েই না! বিশ্বাস করুন! বেকার মানুষ আমি!’
ছাড়ল না ওকে রানা। গলায় ছুরির চাপ বাড়াল আরেকটু। তা সত্ত্বেও প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে লোকটার বক্তব্যের স্বপক্ষে।
ধারহীন, সস্তা চাকু। ঘাম আর বাসি অ্যালকোহলের বদবু আসছে চাকুর মালিকের গা থেকে। চেহারা আর পোশাক- পরিচ্ছদে প্রকট হয়ে ফুটে রয়েছে দারিদ্র্যের চিহ্ন।
ফোঁপাতে লাগল হেঁচকি তুলে। ভেজা মানচিত্র তৈরি হচ্ছে জিনসের প্যান্টের ঊরুসন্ধিতে। পেশাব করে দিয়েছে ভয়ের চোটে।
করুণায় ভরে উঠল রানার অন্তর। না, ওদের দলের হতে পারে না এ। মুনশিয়ানা কিংবা পেশাদারিত্বের ছিটেফোঁটাও নেই এর মধ্যে। সুযোগসন্ধানী ছিনতাইকারী ইভ মতাদ। ভেবেছিল, সুনসান সাবওয়ে স্টেশনে চাকু দেখিয়ে কেড়ে নিতে পারবে ওয়ালেট।
চাপ শিথিল করল রানা। মাথা ঝাঁকাল সেলেনার দিকে তাকিয়ে।
‘ঈশ্বরের দোহাই, মেরো না আমাকে!’ ফোঁপানি থামছে না ছিনতাইকারীর। ‘কসম খাচ্ছি, ভুলেও আর এ কাজ করব না… স্রেফ ক’টা টাকার জন্যে…’
‘আজকের দিনটা লাকি ছিল তোমার জন্যে।’ হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করল রানা। ‘কিন্তু পরেরজন এতটা নরম না-ও হতে পারে।’ ক’খানা ইউরো লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘রাখো এগুলো। ভাগো এখন এখান থেকে।’
পলকহীন বিস্ময়ে চেয়ে রইল ছিনতাইকারী।
হুডির পকেটে টাকাগুলো গুঁজে দিল রানা।
ঝটকা খেয়ে ফিরে এল লোকটা নিজের মাঝে। হাতের পিঠে চোখ দুটো মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল দেয়াল ধরে। পরক্ষণে চোঁ-চাঁ দৌড়।
সিধে হয়ে দাঁড়াল রানাও। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে ওর।