1 of 2

শকওয়েভ – ১৭

সতেরো

সভয়ে পিছু হটল সেলেনা।

‘ক্-কে ওখানে?’ মনে হলো, অন্য কারও গলায় কথা বলছে ও।

‘আমি!’ সামান্য বিরক্তির ছোঁয়া ছায়ামূর্তির কণ্ঠে। ‘কার কথা ভেবেছিলে? রিপেয়ারম্যান?’

‘রানা?’

পুলিসের লাগানো টেপ খুলে ফেলে হাতছানি দিল শ্ৰীমান মাসুদ রানা। ‘এসো, ভেতরে এসো!’

‘জাদু জানো নাকি তুমি?’ দরজাটা লাগিয়ে দেয়ার পর প্রশ্ন রাখল সেলেনা।

ম্যাগলাইট অন করল রানা।

‘উঁহু, সিম্পল ম্যাজিক।’ ছাতের দিকে তাক করে ধরল আলোটা। ‘দেখলাম কাজ করে কি না বুদ্ধিটা।’

‘বুঝলাম না।’

‘ওপর দিয়ে এসেছে ক্যারেনের হত্যাকারী। স্কাইলাইট প্যানেল রয়েছে বাথরুমের ওপর… ফ্রেমের ধুলোয় ছাপ পড়েছে গ্লাভসের। ফাসেনার গায়েব ওটার। হয় সে-ই খুলেছে স্ক্রু, নয় তো কোনও মিস্তিরি। সেক্ষেত্রে সুবিধে হয়ে গেছে রিপেয়ারম্যানের। যেটাই হোক না কেন, পুলিস এর কিনারা করতে পারেনি।’

‘তুমিও কি ওপথেই ঢুকেছ?’

‘তবে আর কীভাবে?

‘ছাতে উঠলে কেমন করে? তুমি তো দেখলাম নিচে নেমে গেছ!’

‘গলির ওপাশের হোটেলটা,’ ব্যাখ্যা করল রানা। ‘এক্সটারনাল ফায়ার এসকেপ রয়েছে ওটার। সেটা ধরে ওপরে উঠলাম। তার পর লাফিয়ে নামলাম এই বিল্ডিঙের ছাতে।’

‘রানা!’

‘এমন কিছু বেশি নয় দূরত্ব, অনায়াসেই পার হওয়া যায়। অন্ধকারে দেখতে পাবে না কেউ। অন্ততপক্ষে আমাকে যে দেখেনি, এই গ্যারান্টিটুকু দিতে পারি।’

‘ধুপ’ শব্দের রহস্যটা পরিষ্কার হলো সেলেনার কাছে।

‘ক্যারেনের খুনিও সম্ভবত একই কাজ করেছে,’ বলল রানা। ‘কারও চোখে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায়নি। সেজন্যেই এই বিল্ডিঙের ফায়ার এসকেপ ব্যবহার না করে হোটেল থেকে লাফ দিয়েছে ছাতের উপর। সহজ কাজ। সহজ আর নিখুঁত।’

‘পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙতে যদি?’

‘বললামই তো, সেরকম কোনও সম্ভাবনা নেই। তার পরও, থ্যাঙ্কস ফর কেয়ারিং।’

‘সিরিয়াসলি, রানা। তোমার কিছু হয়ে গেলে অকূল পাথারে পড়ে যেতাম না আমি?’

‘রাঙার মার মত বাজে বকছ তুমি।’

‘কে রাঙার মা? কার কথা বলছ?’ আসমান থেকে পড়ল যেন মেয়েটা।

উত্তর না দিয়ে ছোট্ট লিভিং রুমে ঢুকে পড়ল রানা। অভিজ্ঞ নজর বোলাতে লাগল ক্রাইম সিনের খুঁটিনাটির উপর।

ওর সেফহাউসের চেয়ে খুব বেশি বড় নয় অ্যাপার্টমেন্টটা। ক্যারেনের মৃত্যুর আগে যেরকম ছিল, তেমনটাই রয়ে গেছে বোধ হয়।

কামরাটা অগোছাল। ব্যস্তবাগীশ সায়েন্স শিক্ষয়িত্রীর কাজের জায়গা যেমনটা হয়ে থাকে সাধারণত। শত শত ভলিউম, ফোল্ডার আর বক্স ফাইলে উপচে পড়া অবস্থা তাকগুলোর। বোঝা যায়, এসবের পিছনে দিনের অনেকটাই সময় ব্যয় হতো মেয়েটার।

জানালার কাছে চলে গেল রানা। ধীরে, সতর্কতার সঙ্গে টেনে দেয়া পর্দার প্রান্ত সরিয়ে দেখে নিল রাস্তাটা।

দুশ্চিন্ত করার মত কোনও কিছু চোখে পড়ল না ওখানে। পুলিস-টুলিসও নেই। তা-ও বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক হবে না।

ঘুরে দাঁড়াল ও। ‘বলছ, চুরি যায়নি কিছু?’

মাথা ঝোঁকাল সেলেনা। ‘পুলিস তা-ই বলছে— স্রেফ খুন করে বেরিয়ে গেছে খুনি। সেরকম হলে, মানেটা দাঁড়াচ্ছে: টেসলা-সংশ্লিষ্ট কিছুই ছিল না এখানে।’

‘তার পরও, এলাম যখন, চেক করে দেখি।

মাথা নেড়ে সায় দিল মেয়েটা।

‘ফাইলগুলো দেখো তুমি,’ ওকে বলল রানা। ‘আমি অন্য কিছু দেখছি।’

মোটা মোটা কয়েকটা ফাইল নামাল সেলেনা। সোফার উপর ফেলে দ্রুত উল্টে চলল ভিতরের কাগজপত্রগুলো।

‘ভালো লাগছে না, রানা!’ পাতার পর পাতা দেখে বাতিল করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফোঁস করে। ‘মনে হচ্ছে, ক্যারেনের কবর খুঁড়ছি আমি!’

সেলেনার মৃত বান্ধবীর অগোছাল ডেস্কে স্থির হলো রানার দৃষ্টি। ওর কমপিউটারটা দেখছি না…’

‘নিয়ে গেছে পুলিস, ফাইল থেকে চোখ তুলে বলল সেলেনা। ‘কেন, বলতে পারো?’

‘ই-মেইল, কমপিউটার ফাইল—এসব চেক করবে আর কী। হয়তো লিড পাওয়ার আশা করছে।’

অকাজের নয় মেথডটা। চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে প্রায়শই হপ্তা-মাস ধরে শিকারকে অনলাইনে অনুসরণ করে থাকে কিলাররা। কার্যকর আক্রমণ-পরিকল্পনা সাজানোর জন্য সোশ্যাল নেটওঅর্কিং সাইটগুলোর তথ্য সংগ্রহের সহজ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রোফাইল তৈরি করে টার্গেটের দৈনন্দিন রুটিন আর লাইফস্টাইল সম্বন্ধে। আর ফ্রেণ্ডলিস্টে একবার ঢুকতে পারলে তো কথাই নেই, প্রাইভেট তথ্যও পেয়ে যাচ্ছে শিকারের কাছ থেকে। এজন্যই একই সঙ্গে আশীর্বাদ আর অভিশাপ অন্তর্জালের দুনিয়াটা। বদ লোকদের জন্য স্বর্গবিশেষ।

যদিও মোটামুটি শিয়োর রানা, এ ক্ষেত্রে হতাশই হতে হবে পুলিস ডিপার্টমেন্টকে। ট্রেইল রেখে যাওয়ার মত কাঁচা কাজ করবে না খুনি।

খুলল ও ডেস্কের একমাত্র দেরাজটা। খচখচ করছে মন। অন্যের জিনিস ঘাঁটা অনেকটা কবর থেকে মানুষের হাড় চুরি করার মতই।

সাধারণ সব জিনিস বেরোল ভিতর থেকে পেপারক্লিপ, কলম, স্টেপলার, পাঞ্চ মেশিন আর খুচরো কিছু পয়সা। সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স, বার্থ সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট আর কয়েকটা রসিদ।

পাসপোর্টটায় চোখ বোলাল রানা।

‘বেশ ঘোরাঘুরি করত দেখছি তোমার এই বন্ধুটি।’

‘ফান করছ, তা-ই না?’ বিশ্বাস করল না সেলেনা। ‘সব সময়ই বলত, প্লেনে চড়াটা সহ্য হয় না ওর।’

‘অতটা নয় বোধ হয়। অন্তত ভিসা স্ট্যাম্পগুলো সেকথা বলছে না। গত কয়েক বছরে গেছে সে মেলা জায়গায়।

‘বৈজ্ঞানিক সম্মেলন-টম্মেলন হবে হয়তো।’ পরের ফোল্ডারে খোঁজা শুরু করল সেলেনা। ইন্টারেস্টিং কিছু পাওয়া যায়নি প্রথমটায়।

অন্য কামরাগুলোতে তল্লাশি করতে চলল রানা। প্রথমে রান্নাঘর দেখল, তার পর বেডরুম। বাথরুমগুলোও বাদ পড়ল না। চেক করল সবগুলো দেরাজ আর কাবার্ড ক্যারেনের নানা রকম ড্রেস ঝুলছে হ্যাঙারে। ওয়ার্ডরোবের নিচের দিকে সার দিয়ে রাখা সুন্দর ডিজাইনের কয়েক জোড়া ছোট সাইজের জুতো।

একদমই স্বাভাবিক রয়েছে যেন সব কিছু। যে-কোনও মুহূর্তেই এসে হাজির হবে যেন অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। ফরেনসিক এগজামিনারদের উপস্থিতির চিহ্ন ধরা পড়ছে কামরায়। অথচ দক্ষতার সঙ্গে নিজের ট্র্যাক গোপন করেছে হত্যাকারী। ভাবতেই পারবে না কেউ, মাত্র কয়েক দিন আগেই ভয়ঙ্কর একটা খুন হয়েছে এখানে।

লিভিং রুমে ফিরে এল রানা।

ছড়ানো-ছিটানো কাগজ, বক্স ফোল্ডার আর খালি ফাইলের সমুদ্রে পেরেশান নাবিক যেন সেলেনা। অনুভূতি অবদমনের চেষ্টা টের পাওয়া যাচ্ছে ওর চেহারার অভিব্যক্তি দেখে।

‘কিছুই পাওয়া গেল না এগুলোতে,’ অনুযোগ করল সেলেনা। ‘টেসলা নিয়ে একটা শব্দও না। অবশ্য ভাবিওনি যে, থাকবে। পুলিসের বাজেয়াপ্ত করা কমপিউটারেও কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ক্যারেন জানত, চোখে চোখে রাখা হচ্ছে ওকে। সুতরাং, কাজের এভিডেন্স রেখে দেয়ার মত বোকামি করবে না ও কিছুতেই।’ হতাশায় মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘খারাপ দিকটা হলো—যে বা যারা ওকে মেরেছে, তারাও হয়তো নিশ্চিত ছিল, পাওয়া যাবে না কিছু। সেজন্যেই হয়তো গরজ বোধ করেনি জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার।’

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল রানা মেঝের দিকে তাকিয়ে। ‘ভাগতে হবে এ বেলা। তার আগে আবার আগের মত গুছিয়ে রাখতে হবে সব কিছু। দেখা শেষ আমার।

‘তার মানে, তুমিও পাওনি কিছু!’

‘একেবারে কিছুই যে পাওয়া যায়নি, তা নয়।’

‘কী পেয়েছ, রানা?’

‘ইনফর্মেশন।’

‘ওহ, ওই পাসপোর্ট! ওটা আর কী কাজে লাগবে?’

মিনিট কয়েক পর বেরিয়ে এল ওরা। পাল্লা টানতেই ‘ক্লিক’ করে জায়গামত বসে গেল ডোরনবের ল্যাচ। আগের মতই প্রবেশমুখে লাগিয়ে দিল রানা হলুদ টেপগুলো।

আপসেট হয়ে আছে সেলেনা। ল্যাণ্ডিঙের জানালা দিয়ে আসা নীল আলোয় মেয়েটার চোখে অশ্রু চিকচিক করতে দেখল রানা। কী বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে না পেয়ে আলতো করে স্পর্শ করল কাঁধ।

ভিজে চোখ তুলে চাইল সেলেনা। হাসল বিষাদবিধুর হাসি।

সিঁড়ির উদ্দেশে কদম বাড়িয়েছে ওরা, ঠাস করে খুলে গেল বিপরীত দিকের দরজা। কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই মুখের উপর এসে পড়া চোখ ধাঁধানো টর্চের আলোয় অন্ধ হয়ে গেল রানা-সেলেনা।

‘কারা তোমরা?’ মিহি একটা রূঢ় কণ্ঠ প্রশ্ন ছুঁড়ল ফরাসিতে। ‘খবরদার, নড়বে না! গুলি করতে বাধ্য কোরো না আমাকে!’

সারেণ্ডারের ভঙ্গিতে দু’জনের দু’জোড়া হাত ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে উপরদিকে; এ অবস্থায় তারও চেয়ে ধীরে আর সাবধানে পিছন-দেয়ালে বসানো সেকেলে ঘরানার লাইটের সুইচে পিঠ দিয়ে চাপ দিল রানা। যতখানি সম্ভব, শান্তিপ্রিয় নিরীহ লোক বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা দরকার নিজেদের।

না, অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে যাননি ক্যারেনের প্রতিবেশী

পায়ে চটি, চুলে কার্লার। একহারা কাঠামোটা ঢলঢলে ড্রেসিং গাউনে মোড়া। মহিলার হাতের চাইতেও মোটা স্টিলের উদ্যত টর্চলাইটটা। ছোট যে কালো পিস্তলটা উঁচিয়ে রেখেছেন আরেক হাতে, গুলি নয়, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার কার্যকর যন্ত্র বলা যায় ওটাকে। একা বাড়িতে বয়স্ক, অরক্ষিত ফরাসি ভদ্রমহিলাদের মানসিক শান্তি দেয় এ-জাতীয় অস্ত্র।

‘জিজ্ঞেস করেছি, কারা তোমরা! পিস্তল দোলালেন বৃদ্ধা। ‘অ্যাই… আবার নড়ে! যেখানে রয়েছ, দাঁড়িয়ে থাকো গ্যাঁট মেরে। চোখে-মুখে এটা ছিটিয়ে দিলে কেঁদে কূল পাবে না। তার পর জায়গামত একটা কল দিলেই শ্রীঘরের টিকেট পেয়ে যাবে!

রানার মনের একটা অংশ ভরে উঠল শ্রদ্ধা আর মমতায়। আরেক অংশের কাছে মোটেই উপভোগ্য মনে হলো না টিয়ার গ্যাসে চোখ জ্বলার ব্যাপারটা। সিভিলিয়ানদের জন্য তৈরি জিনিসটার ধক যদি কমও হয়, তবু ওটা চেখে দেখার খায়েশ ওর নেই।

বুড়ির হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নেয়ার বেশ ক’টা অপশন উঁকি দিয়ে গেল মনে, ওস্টিয়োপোরোসিসে আক্রান্ত হাড় বা টিসুর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না যেগুলো।

কিন্তু ও সক্রিয় হয়ে ওঠার আগেই নিষেধ অমান্য করে আগে বাড়ল মেয়েটা।

‘মাদাম গোলতিয়েই? ইটস অল রাইট,’ বলল ও ফরাসিতে। ‘ক্যারেনের বন্ধু আমরা।’ প্যারিসে অনেক দিন কাজ করার সুবাদে ভাষাটা বেশ সড়গড় ওর।

নিজের আর ক্যারেনের নাম শুনে দ্বিধা খেলে গেল মাদামের চেহারায়। তবে পিস্তলটা উঁচানোই রইল ওদের উদ্দেশে।

‘ক্যানাডা থেকে উড়ে এসেছি আমি,’ বলে চলল সেলেনা। ‘আসার জন্যে চিঠি পাঠিয়েছিল ও আমাকে।’

মোলায়েম হয়ে এল ভদ্রমহিলার সন্দেহের চাউনি। গাউনের পকেটে পিস্তলটা ফেলে দিয়ে নিচু করে নিলেন লম্বা হাতলের টর্চলাইটটা। হাত ব্যথা হয়ে গেছে ওজনদার জিনিসটা ধরে রাখতে রাখতে।

‘ক্যারেনের বন্ধু?’ বললেন তিনি বিমর্ষ কণ্ঠে। ‘জানো নিশ্চয়ই, জীবিত অবস্থায় আমিই শেষ দেখেছি বেচারিকে। আমিই পাই ওর লাশ।’

‘জি, মাদাম, জানি জবাব দিল সেলেনা। ‘অভিজ্ঞতাটা কী রকম ছিল আপনার জন্যে, বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার!’

পকেটে চাপড় দিলেন মাদাম গোলতিয়েই। ‘সেজন্যেই কিনেছি এই বন্তরটা।’ ইঙ্গিত করলেন কানের দিকে। ‘আর এই হিয়ারিং এইড। চোর-ছ্যাঁচড় আর জেল পালানো পাগল-ছাগল গিজগিজ করছে যেখানে, সেখানে সদা-সর্বদা চোখকান খোলা রাখাটা বড্ড মুশকিল। বহু আগে থেকেই সে-কারণে বলে আসছি আমি, কল্লাগুলো আলাদা করার জন্য আবার ফিরিয়ে আনা উচিত গিলোটিন। কথা তো ঠিক, তা-ই না? দেখো দেখি এখন, কী থেকে কী হয়ে গেল…’

‘আমার নাম সেলেনা, সেলেনা বার্নহার্ট। আর ইনি আমার আরেক বন্ধু—মোসিউ রানা। আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি আমরা,’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল মেয়েটা। ‘এসেছি স্রেফ বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।’

‘বার্নহার্ট… বার্নহার্ট…’ আওড়াচ্ছেন বৃদ্ধা। কী যেন মনে পড়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখটা। ‘তোমার স্বামীর নাম কি ডক্টেয়ার বার্নহার্ট?’

‘সরি?’ চোখ পিটপিট করছে সেলেনা।

‘ক্যানাডার কোন্ এক ডক্টেয়ার বার্নহার্টের উদ্দেশে লেখা হয়েছিল চিঠিটা,’ বললেন মহিলা।

‘আমিই সেই ডক্টর বার্নহার্ট,’ হেসে, খোলসা করল মেয়েটা। ‘কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে–কোথায়, কার কাছে পাঠানো হয়েছে চিঠি?’

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছেন গোলতিয়েই। প্রফেশনাল টাইটেলওয়ালি কোনও মহিলার কথা জিন্দেগিতে শোনেননি যেন।

‘কারণ, আমিই পোস্ট করি ওটা,’ বিষাদ আর গর্ব মিশ্রিত স্বরে জবাব দিলেন। ‘শেষ যখন জীবিত দেখি ওকে, ওর দুটো চিঠি পোস্ট করার জন্যে অনুরোধ করে আমাকে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাকি, বলছিল বার বার। একটা ক্যানাডার, আরেকটা সুইডেনের।

চাউনি বিনিময় করল রানা আর সেলেনা।

‘ঠিক জানেন—সুইডেন?’ শুধাল মেয়েটা।

মাথা ঝাঁকিয়ে নিশ্চয়তা দিলেন ফরাসি মহিলা।

‘মাদাম গোলতিয়েই,’ বলল রানা বিনয়বিগলিত কণ্ঠে। ‘সুইডেনের চিঠিটাও কি রেজিস্টার্ড মেইলে পাঠানো হয়েছে—-ক্যানাডারটার মত?’

বৃদ্ধার কাছে ফরাসিভাষী ভিনদেশি সেলেনাই বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে আরও একজন ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে ওঠায় চক্ষু ছানাবড়া হলো তাঁর। ঘন ঘন মাথা উপরনিচ করে বোঝালেন—হ্যাঁ, হয়েছে।

‘তা হলে নিশ্চয়ই কাস্টমার রিসিপ্ট রয়েছে আপনার কাছে?’ আশায় দুলছে রানার মন। ‘বুঝতেই পারছেন, ক্যারেনের এই সুইডেননিবাসী বন্ধুটির সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন আমাদের। মেয়েটার পরিণতি সম্বন্ধে হয়তো জানেই না এখনও বেচারা…’

সোৎসাহে মাথা ঝাঁকালেন বয়স্ক মহিলা। কারও কাজে আসতে পারছেন ভেবে খুশি ধরছে না তাঁর।

‘একটু দাঁড়াও,’ বলে, উধাও হলেন ফুলেল ওয়ালপেপার সাঁটা আলো-ঝলমলে অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর।

বাইরে থেকে শুনতে পেল ওরা, নিজের মনে বকবক করে চলেছেন বৃদ্ধ মহিলা। কয়েক সেকেণ্ড পর ফিরলেন দু’খানা চিরকুট নিয়ে। বাড়িয়ে দিলেন সেগুলো রানাদের দিকে।

‘সুযোগই পেলাম না হতভাগীকে এগুলো বুঝিয়ে দেয়ার।’ মাথা নাড়ছেন আফসোসে। কেঁদে ফেলবেন যেন। ‘আর ওই ঘটনাটার পর… ভুলেই গিয়েছিলাম কাগজগুলোর কথা।’

আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে রসিদ দুটো পরীক্ষা করল রানা।

দুটো স্লিপেই হাতে লেখা হয়েছে প্রাপকের নাম আর ঠিকানা। একটা অ্যাড্রেস সেলেনার অটোয়া অ্যাপার্টমেন্টের, আরেকটার প্রাপক জাকউইক, সুইডেনের হের গুস্তাফ ভিকান্দার। একই সময় আর তারিখে, রেজিস্টার্ড ইন্টারন্যাশনাল ডেলিভারি সিস্টেমে মেইল করা হয়েছে পত্ৰ দুটো।

.

‘এখন প্রশ্ন: কে এই গুস্তাফ ভিকান্দার?’ ফ্ল্যাট-বাড়িটা ত্যাগ করার পর, রাস্তায় পার্ক করা বিএমডাব্লিউ গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠল সেলেনা।

‘ক্যারেনের কলমবন্ধু বলে মনে হচ্ছে না আমার,’ মন্তব্য রানার।

‘নতুন বয়ফ্রেণ্ড?’

‘এমন কেউ, যে-কোনও মূল্যে যাকে বিশ্বাস করা যায় বলে ভেবেছে তোমার বান্ধবী।’

‘কী মনে হয় আমাকে যা লিখেছে, ওই লোককেও একই কথা লিখেছে ও?’

‘একই সময়ে দু’জনকে লিখেছে—কো-ইনসিডেন্স হতে পারে না এটা। দৈবেরও মাত্রা আছে। বুড়ির বক্তব্য অনুযায়ী, একই সমান গুরুত্ব বহন করছে চিঠি দুটো। সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা রয়েছে বিষয়বস্তুও এক হওয়ার।’

‘অবাক লাগছে… কখনও এই গুস্তাফের কথা বলেনি আমাকে ক্যারেন!’

‘আমার তো মনে হচ্ছে, আরও অনেক কিছুই বলেনি তোমাকে।’

স্টিয়ারিঙে উঠে বসার আগে অ্যালপিনা আনলকের কমাণ্ড উচ্চারণ করল রানা।

‘ফোন করবে লোকটাকে?’ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসে জানতে চাইল সেলেনা। ‘নাম্বারটা ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন ডিরেক্টরিতে থাকবে নিশ্চয়ই!’

‘আগে ঘুরে আসি গ্যাসপারের ওখান থেকে। তার পর দেখব হের ভিকান্দারের ব্যাপারটা।

স্টার্ট নিতে বলতেই সগর্জনে সাড়া দিল ইঞ্জিন।

‘মনে হয় না, কথা-শোনা গাড়িতে কখনও অভ্যস্ত হতে পারব,’ বিড়বিড় করল সেলেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *