1 of 2

শকওয়েভ – ১৪

চোদ্দ

সন্ধ্যার মধ্যেই পদধূলি দিল ওরা প্রেম, পেইন্টিং আর কবিতার নগরী প্যারিসে। রানার হিসাবের চাইতেও সংক্ষিপ্ত হয়েছে যাত্রাটা।

প্রায় গোটা রাস্তাতেই ভাবনার সমুদ্রে তলিয়ে ছিল রানা। সেতার-মায়েস্ত্রোর অনবদ্য সুরলহরী পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করেছে ওকে। এখন নগরীর কেন্দ্রস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে ওরা সাঁঝবেলার সদাব্যস্ত ট্রাফিকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।

বুলেভার্ড দেস বাতিনিয়োলেস থেকে ডানে মোড় নিল ও, এগোচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর ক্য দো কিশি-র দিকে।

রানার দিকে ঘাড় ঘোরাল সেলেনা। ‘মনমাট্রা তো এদিক দিয়ে নয়।’

‘জানি। রাতের কোনও এক সময় যাওয়া যাবে ওদিকে।’

চুপচাপ ভাবল মেয়েটা। ‘এখন তবে কোথায় চলেছি?’

‘এমন কোথাও, তোমার বন্ধুরা যেখানে খুঁজে পাবে না আমাদের। জায়গাটা চেনো তুমি।’

‘দোহাই, রানা! হারামিগুলোকে ‘আমার বন্ধু’ বলা বন্ধ করবে দয়া করে?’ বলল সেলেনা তিতিবিরক্ত কণ্ঠে

প্রত্যুত্তরে ফাজিল-মার্কা হাসি দিয়ে মেয়েটার রাগ আরও চড়িয়ে দিল রানা।

‘চেনা জায়গা বলছ,’ বলল সেলেনা বিরক্তি চাপা দিতে! ‘তার মানে কি….?’

‘ঠিকই ভাবছ।’

সাধারণ চেহারার ছোটখাটো সেফহাউসটাই গন্তব্য ওদের। গত বারের মিশনে দু’রাতের জন্য ওখানটায় আশ্রয় নিয়েছিল ওরা দু’জনে।

ধনী এক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল রানা জায়গাটা। বিরাট এক গাড্ডায় পড়ে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির শরণাপন্ন হয়েছিল মাঝবয়সী এ-মক্কেল। অভাবিত উপকার পেয়ে প্রতিদান দিয়েছিল।

প্রায় অস্তিত্বহীন বলা চলে সেন্ট্রাল প্যারিসের মৌচাক- সদৃশ দালানবাড়ির অনেকটা ভিতরের দিকের গোপন এই ডেরা।

বুলেভার্ড হসমান ধরে চলতে চলতে আরেক বার ডানে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বুলেভার্ড দেস ইটালিয়েনস-এ নিয়ে ফেলল রানা গাড়িটাকে। অচিরেই তীক্ষ্ণ এক বাঁক নিয়ে চলে এল রাস্তাটার এক পাশে। ঢালু এক র‍্যাম্পে উঠে প্রতিধ্বনিময় অন্ধকার আণ্ডারগ্রাউণ্ড টানেলে ঢুকে পড়ল অ্যালপিনা। লোকের চোখ এড়িয়ে গুপ্ত আস্তানায় প্রবেশের পথ এই একটাই।

ছায়ায় ডুবে থাকা পার্কিং লটে গাড়ি ত্যাগ করে যে যার জিনিসপত্র তুলে নিল ওরা।

কংক্রিটের প্যাসেজওয়েতে সেলেনাকে পথ দেখাল রানা, নিয়ে এল অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িটার পিছনদিককার পরিচিত সিঁড়িপথে। পরিবর্তনের মধ্যে আর্মারড ফটকে স্প্রে দিয়ে আঁকা বিজাতীয় গ্রাফিতি। চোর-ডাকাতের সাধ্য নেই, স্টিলের গেট কিংবা রি-ইনফোর্সড দেয়াল ভেদ করে অনুপ্রবেশ করে এখানে।

অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে, সুইচ টিপে লাইট জ্বালল রানা।

আঁধারে এত দিন ‘শীতনিদ্রা’ দিচ্ছিল নিরাপদ ঘাঁটিটা। ছোট ছোট জানালাগুলোর সব ক’টাতে পর্দা টেনে দেয়া।

বাতাস শুঁকতে শুঁকতে ভিতরে পা রাখল সেলেনা। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত দৃষ্টিতে নজর বোলাচ্ছে চারপাশে। পর্যাপ্ত আলোবাতাস না পাওয়ায় গুমোট একটা গন্ধ ভাসছে অ্যাপার্টমেন্টে। জানালা-দরজা বন্ধ থাকলেও কীভাবে জানি মিহি ধুলোর আস্তর পড়েছে সব কিছুর উপর।

বাইরের মতই অত্যন্ত সাধারণ অন্দরটা। সাদামাটা একটা ডেস্ক আর একটা আর্মচেয়ার-লিভিং রুমে আসবাব বলতে এ-ই। কোনও ধরনের ডেকোরেশনের বালাই নেই ফ্ল্যাটটায়। ফ্লোরে কার্পেট তো নেই-ই, বিনোদনের জন্য এমনকী নেই কোনও টেলিভিশনও। দরকারি জিনিস ছাড়া বাড়তি কিচ্ছু নেই রান্নাঘর কিংবা বেডরুমে।

‘সেবারের পর বদলায়নি বোধ হয় খুব একটা,’ দেখেশুনে মন্তব্য করল সেলেনা। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে

রানার চোখে।

রানাকেও পেয়েছে স্মৃতি রোমন্থনের মুডে। মাত্র দুটো দিন এখানে থাকলেও ঘটনাবহুল ছিল সময়টা। সেসব টক- ঝাল-মিষ্টি মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে এখন। আর কী টেনশন!

‘গলা ভেজাবে তো?’ সংবিৎ ফিরে পেতেই জানতে চাইল ও।

‘শাওয়ার নেব প্রথমে,’ চাহিদা জানাল মেয়েটা।

‘নিশ্চয়ই মনে আছে, কোন্ দিকে বাথরুম?’ ইশারা করল রানা অপ্রশস্ত হলওয়ের দিকে। ‘পরিষ্কার তোয়ালে পাবে ওখানে।’

‘ইঁদুর-আরশোলার রাজ্য হয়ে গেছে কি না, কে জানে!’

‘হওয়াটা অসম্ভব নয়।’ চিন্তিত দেখাচ্ছে রানাকে। ‘বন্দুকটা নিয়ে যাও সাথে করে। তাতে যদি কিছুটা নিরাপদ বোধ করো!’

‘নাহ… তার চেয়ে একটা সোলার ঝাড়ু পেলে বেশি কাজে দিত।’

গোসলে ঢুকে পড়ল সেলেনা। অল্পক্ষণ পরই শোনা গেল ঝরনার আওয়াজ।

শোয়ার ঘরে প্রবেশ করল রানা। খাটের কিনারে বসে হাতে নিল ফোনটা। ওয়াই-ফাই অ্যাকটিভেট করে টেসলা লিখে ওয়েবে সার্চ দিতেই মুহূর্তে হারিয়ে গেল টেকনিকাল আর সায়েন্টিফিক টার্মের জগাখিচুড়ির মধ্যে।

টেক্সট সার্চের ফলাফলগুলোতে আলগোছে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ইমেজে সুইচ করল রানা। একটু পরেই দেখা গেল, মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে সার্বিয়ান বিজ্ঞানীর ছবিগুলোর দিকে।

পুরোধা রহস্য-সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পোর সঙ্গে খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে যেন কৃশকায়, বেদনার্ত চেহারাটার। খানিকটা যেন পাগলাটে গোছের। তেল-চকচকে চুলগুলো উনিশ শ’ বিশের দশকের কেতায় সিঁথি করা। ব্রাশের মত চিলতে গোঁফ সুন্দর করে ছাঁটা।

তীক্ষ্ণ চোখ দুটো যেন মোবাইলের স্ক্রিন ভেদ করে দেখে নিচ্ছে রানার অন্তরাত্মা। দৃষ্টিতে কৌতুকের আভাস।

এই লোকটাই যদি ওদের এত দৌড়ঝাঁপের কারণ হয়ে থাকে—ভাবছে রানা–অনেক প্রশ্নের জবাব জানতে হবে তা হলে।

শরীরের ব্যথাবোধ জানান দিল আশু উপশমের প্রয়োজনীয়তা।

ঊরু পরীক্ষার জন্য খুলে হাঁটুর কাছে নামাল ও জিনস প্যান্টটা।

অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলে আছে লাল, থকথকে হয়ে। প্রায় নিখুঁতভাবে বেরেটা ম্যাগাজিনের আয়তাকার ছাপ বসে গেছে চামড়ায়। ধরতেই যন্ত্রণায় বেঁকে গেল মুখটা। অভিজ্ঞতা বলছে, দিন দুয়েকের মধ্যেই রামধনুর সাত রং ফুটে উঠবে ওখানটায়।

প্যান্টটা আবার পরে নিল রানা।

বুকের বাঁ দিকটাও চিনচিন করছে বেজায়। ককিয়ে উঠল টি-শার্ট খুলতে গিয়ে।

কালশিটে পড়া আরেকটা লালচে ম্যাপ ওখানে। পাঁজরের একটা হাড়ে চিড় ধরেছে বলে মনে হলো ওর।

মুখ তুলতেই দেখতে পেল সেলেনাকে। দাঁড়িয়ে আছে বেডরুমের দরজায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *