তেরো
কিডলিংটনের অক্সফোর্ড লণ্ডন এয়ারপোর্টের টারমাকে, প্রাইভেট হ্যাঙারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁ-চকচকে একখানা টুইন-ইঞ্জিন লাইট এয়ারক্রাফটের উদ্দেশে হেঁটে চলেছে রানা-সেলেনা। ওটার এক ডানা থেকে আরেক ডানার বিস্তার তেরো মিটার। এগারো মিটার লম্বা নাক থেকে লেজ পর্যন্ত। দাম হবে ল্যামবরগিনি রেবেনটনের সমান। দুপুরের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে ছোট্ট উড়োজাহাজটার মুক্তো সফেদ ফিউযেলাজে।
‘মন্দ নয়, কী বলেন?’ বলে উঠল রানার পরিচিত একটা কণ্ঠ।
ঘুরে তাকিয়ে হ্যাঙার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল ও পাইলট রবার্ট স্টিফানকে।
‘কেমন আছেন, মিস্টার রানা?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
সেলেনার উদ্দেশে নড করল পাইলট।
প্রত্যুত্তরে মাথা ঝোঁকাল মেয়েটাও।
‘রেঞ্জ কত এটার?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ফিউল ভরা থাকলে এক হাজার সাত শ’ নটিকাল মাইলের ওপরে,’ জানাল স্টিফান। ‘রওনা হওয়ার সময়ই তেল ভরে নিয়েছি। অর্ধেক ইয়োরোপ পাড়ি দিয়ে ফিরেও আসতে পারবেন আবার।’
‘চমৎকার।’ অতখানি যাওয়া লাগবে না অবশ্য রানাদের। হিসাবমতে, এক শত চল্লিশ মাইলের মধ্যে হবে দূরত্বটা।
‘ব্রেনেভ করপোরেশনের পরিবেশবান্ধব নতুন এসটি- ওয়ান টারবোপ্রপ এটা। গর্বের সঙ্গে ঝকঝকে প্লেনটার গায়ে চাপড় দিয়ে আদর করল স্টিফান। ওটা কোনও আরবি ঘোড়া যেন। ‘ইকো-ফ্রেণ্ডলি এভিয়েশন প্রোমোট করছে এখন মিস্টার ব্রেযনেভের কোম্পানি, শুনে থাকবেন বোধ হয়!’
মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘প্রোটোটাইপ ডিজাইন। এখন পর্যন্ত বানানো হয়েছে এই একটাই। এই ক্লাসের যে-কোনও এয়ারক্রাফটের তুলনায় বিশ পারসেন্ট কম জ্বালায় ফিউল। আর যেটা না বললেই নয়… প্রায় পুরো বিমানটাই তৈরি হয়েছে রিসাইকলড মেটেরিয়াল দিয়ে।’
‘অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার স্টিফান। ইউনাকে আমার ভালোবাসা জানাবেন।’
খাঁটি বিস্ময়ে রসগোল্লা হয়ে উঠল রবার্ট স্টিফানের চোখ দুটো। ‘ফিরে যেতে বলছেন? প্লেন কে চালাবে তা হলে?’
হাসল রানা। ‘চিন্তা করবেন না। মিস্টার ব্রেযনেভকে বলবেন আমার দ্বারা যদি এটার কোনও ক্ষতি হয়, আরেকটা তৈরি করার সমস্ত খরচ আমি দেব। উনি রাজি হলে সত্যিই খুশি হব। সম্ভব হলে এখুনি একবার যোগাযোগ করুন না?’
.
এসটি-ওয়ান টারবোপ্রপের ককপিট কন্ট্রোলের সামনে বসে আছে রানা। ডায়াল আর রিড-আউটের প্যানেল, এবং হাই- টেক কমপিউটারের বিশাল, জাদুময় অ্যারের উপর চোখ বুলিয়ে তারিফ ফুটল দৃষ্টিতে। অন্য দিকে, রিয়ার সেকশনে পরিবেশবান্ধব সিটগুলো পরখ করে দেখছে সেলেনা। চামড়ার বদলে দামি কাপড়মোড়া আসনে পাঁচজনের বসার ব্যবস্থা।
‘স্বীকার করছি, এরকম বিলাসবহুল ভ্রমণের আশা করিনি আমি।’ দরজা খুলে ছোট্ট বাথরুম আর আরেক পাশের মিনি কিচেনে উঁকি দিল সেলেনা। ‘আরে! কিচেনও রয়েছে দেখছি একটা। বলতেই হবে, রুচি আছে তোমার নানাশ্বশুরের, ‘ মুগ্ধতা ঝরল ওর কণ্ঠে।
প্লেনের বাইরে, মিস্টার ব্রেযনেভের ব্যক্তিগত পাইলট ঢুকে পড়ল হ্যাঙারে। যোগাযোগ করবে মালিকের সঙ্গে। এয়ার-ডিফেণ্ডার আর রিফ্লেকটিভ ভেস্ট পরিহিত রানওয়ে অ্যাটেণ্ড্যান্টরা হাজির হলো টেক-অফের জন্য প্রস্তুত এয়ারপ্লেনটাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে।
শনশন শব্দে ঘুরতে আরম্ভ করল জোড়া প্রপেলার। ইঞ্জিন চালু করেছে রানা। শিগগিরই গর্জনে পরিণত হলো সে- আওয়াজ, ইনসুলেটেড কেবিনের ভিতর চাপা শোনাচ্ছে যদিও।
‘জানতাম না যে, প্লেনও চালাতে পারো তুমি।’ দূরের গোলাকার পোর্টহোল জানালার পাশে বসে সিটবেল্টের স্ট্র্যাপ বাঁধছে মেয়েটা। ‘সত্যিই পারো তো?’
মুচকে হাসল রানা।
‘ওয়েল… এ ধরনের প্লেন আগে চালিয়েছি বললে মিথ্যে বলা হবে।’ রানাও মুগ্ধ প্রযুক্তির আধুনিকতম নিদর্শনটায়। অপেক্ষা করছে প্রপেলারে পূর্ণ গতি আসার। তা ছাড়া বুড়ো দাদুর ফাইনাল অনুমতি না পেলে প্লেন থেকে নেমে যাবে বলে ঠিক করেছে ও।
শেষ যে-প্লেনটা উড়িয়েছে ও, সেটা ছিল এয়ারক্রাফট ফিউলের ড্রাম-বোঝাই প্রাগৈতিহাসিক এক সুপারমেরিন সি অটার। এটার সঙ্গে তুলনা করলে আকাশ আর পাতাল। আগুনে-বোমার মত শত্রুপক্ষের সেইলিং ইয়টের ডেকে ফেলতে হয়েছিল ড্রামগুলো। জাহাজ আর ওটার আরোহীদের ধরিয়ে দিয়েছে নরকের টিকেট। সেলেনা গল্পটা উপভোগ করবে বলে মনে হলো না রানার। ওর স্বীকারোক্তি শুনে আতঙ্ক ভর করেছে মেয়েটার চোখে-মুখে।
‘কী বলছ তুমি এসব!’
‘ট্রাস্ট মি,’ আশ্বস্ত করল রানা মেয়েটাকে। ‘অনেকটা বাইসাইকেল চালানোর মতই সহজ ব্যাপার এটা। কারণ, চালানোর বেসিক প্রিন্সিপল সব প্লেনেরই এক।’
‘কিন্তু একটা বাইসাইকেলও তো চালাতে পারি না আমি!’ আপন মনে বিড়বিড় করল সেলেনা। ‘আমার নিজেরই হয়তো উচিত ছিল বদমাশগুলোর মুখোমুখি হওয়া! তা হলে আর তোমার সঙ্গে এক প্লেনে চাপতে হতো না।’
‘এত আফসোস কেন, সেলেনা?’
‘সেই পুরানো ট্রাবল… উচ্চতাভীতি। তোমার মত একটা আনাড়ির হাতে পড়েছি বলে ভয়টা বেড়ে গেছে আরও।’
হ্যাঙার থেকে বেরিয়ে এসে হাত তুলে গ্রিন সিগনাল দেখাল পাইলট। অর্থাৎ, মিস্টার ব্রেনেভ রাজি।
রবার্ট স্টিফানের শঙ্কা থই থই দৃষ্টির সামনে ট্যাক্সিইং করে দূরে সরে যাচ্ছে ব্রেনেভ এসটি-ওয়ান। প্রয়োজনীয় গতি পেতেই মসৃণভাবে মায়া কাটাল রানওয়ের। শঙ্খচিলের মত উড়াল দিল কুয়াশাঘেরা দুপুরের আকাশে।
দু’শ’ পঁচাশি নটে স্থির করল রানা ওড়ার গতি, ক্রুজ আলটিচ্যুড দিল চব্বিশ হাজার ফুট। তার পর পাইলটের সিটে ফিরে গিয়ে কোর্স সেট করল নরম্যাণ্ডির। ইংলিশ কান্ট্রিসাইড কিংবা চ্যানেলে নামাচ্ছে না ও যান্ত্রিক পাখিটাকে।
ঘটনাবিহীন ছাব্বিশ মিনিট পর বিয়ারিং চেক করল রানা। আলটিচ্যুড কমিয়ে চোখ রাখল উত্তর দিগন্তে। পয়েন্ট দে বাখফ্লেয়ারের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে এখন ওরা। লোয়ার নরম্যাণ্ডির উপকূল দেখা যাচ্ছে বহু দূরে। শান্ত নীল সাগরঘেরা পাহাড়ের মাঝে আকাশের গায়ে খোঁচা মারছে যেন সুউচ্চ গেটেভিল বাতিঘর।
সেইন্ট-ভাস্ট এবং ভ্যালোনেসের বিস্তৃত প্রান্তসীমা ধরে উড্ডয়নের কয়েকটা মিনিট কোর্সে স্থির রইল বিমান। তার পর ক্রমশ নিচে নামতে শুরু করল। এগিয়ে চলেছে লক্ষ্যস্থলের দিকে। ক্যারেনটানের কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রাম এলাকায় অবস্থিত অব্যবহৃত সেই এয়ারফিল্ড। ঘাসের মাঠের মাঝে কংক্রিটের রানওয়েটা যখন ভালোভাবে দৃষ্টিগোচরে এল, স্বস্তির সঙ্গে নিশ্চিন্ত হলো রানা, ঠিকই বলেছিল টম। শেষ বার দেখার পর একদমই বদলায়নি জায়গাটা।
ইন্সট্রুমেন্ট পরীক্ষা করল ও, করে নিল চূড়ান্ত সমন্বয়। ফ্ল্যাপ, আণ্ডারক্যারিজ, স্পিড, আলটিচ্যুড—সবই ঠিকঠাক।
নড়বড়ে কাঁটাতারের বেড়া, পরিত্যক্ত দালান আর গ্রাফিতি ভরা হ্যাঙারটা ছাড়িয়ে আরও নিচু হলো কলের পাখি। টায়ারের ঝাঁকুনির সঙ্গে স্পর্শ করল রানওয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে থ্রটল অফ করে দিল রানা। অসমান স্ট্রিপে ক্রমশ গতি কমে আসছে বিমানের, স্থির হলো রোদে পোড়া ঘাসের এলাকা ছাড়িয়ে আরও গজ পঁয়তাল্লিশ এগিয়ে। কমে এল ইঞ্জিনের আওয়াজ। বন্ধ হলো প্রপেলারের ঘূর্ণি।
হেডসেটটা টেনে খুলে প্রথমেই ওমেগা রিসেট করল রানা ফরাসি সময় অনুসারে। এর পর এয়ারক্রাফটের সাইড-হ্যাচ খুলতে হাইড্রলিকস অ্যাকটিভেট করার জন্য চাপ দিতে হলো কন্ট্রোলে।
ওয়েল, ফাটল ধরা কংক্রিটে পা রেখে মুখ খুলল সেলেনা। ‘বলতেই হবে যে, কোনও রকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই চলে এলাম যেন।’
শেষ বিকেলটা ইংল্যাণ্ডের চেয়ে উষ্ণ। ঘাসের তাজা গন্ধ আর ঝিঁঝির অসময়ের কোরাসে ভরে আছে মৃদুমন্দ বয়ে চলা বাতাস।
রিমোট বাটনের সাহায্যে হ্যাচ বন্ধ করল রানা, লক করে দিয়ে সেট করল অ্যালার্ম।
চারদিকে নজর চালাতেই চোখে পড়ল, ল্যাণ্ডিং স্ট্রিপের অনতিদূরে, নাতিদীর্ঘ হলদে ঘাসের গালিচায় দাঁড়িয়ে রয়েছে গাঢ় নীল রঙের অ্যালপিনা বি-সেভেন। কথা রেখেছে ওর ইংরেজ বন্ধু।
‘ওটাই কি আমাদের বাহন?’ হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল বিমুগ্ধ সেলেনা।
মাথা ঝাঁকাল রানা।
ড্রাইভারের জানালায় উঁকি দিল মেয়েটা। ‘কোনও চাবি- টাবি নেই দেখছি।’
‘চাবি লাগবে না।’ ড্রাইভারের দরজার সামনে এসে উচ্চারণ করল রানা: ‘ওপেন।’
‘ক্লাঙ্ক’ করে একটা আওয়াজের সঙ্গে ম্যাজিকের মত খুলে গেল লক। মন্ত্র পড়ে গাড়ির তালা খুলেছে যেন জাদুসম্রাট প্রফেসর মাসুদ রানা।
অ্যালপিনার সফিস্টিকেটেড ভয়েস রিকগনিশন লকিং সিস্টেমে প্রোগ্রাম করা কণ্ঠস্বর দুটোর একটি হচ্ছে ওর, অপরটি টম হার্ডির।
লিভার টেনে বুটের ঢাকনা তুলল ও। স্পেশাল আর্মারড কমপার্টমেন্ট রয়েছে ওটার তলার দিকে।
দ্রুত হাতে সবুজ ক্যানভাস থেকে বেরেটা স্টর্মটা মুক্ত করল রানা। ঢুকিয়ে রাখল গোপন জায়গাটায়। তার উপর চড়িয়ে দিল নিজেদের ব্যাগগুলো।
এর পর গিয়ে বসল স্টিয়ারিঙে। শেষ চালিয়েছে, বেশি দিন হয়নি। ম্যাপ কমপার্টমেন্টে এখনও শোভা পাচ্ছে পণ্ডিত রবি শঙ্করের বহু-ব্যবহৃত সেতারের সিডি। চালিয়ে দিল মৃদু ভলিউমে। সম্মিলন ঘটল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার- পাশ্চাত্যের গাড়িতে অপূর্ব আবেশ ছড়াচ্ছে প্রাচ্যের সঙ্গীত।
‘স্টার্ট,’ উচ্চারণ করল ও আগের মত।
টগবগ করে প্রাণের সঞ্চার হলো টিউন করা ইঞ্জিনে।
‘বাব্বাহ!’ একটা ভ্রু উঁচু করে তারিফ করল সেলেনা।
গিয়ার দিল রানা। চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘প্যারিস কত দূর এখান থেকে?’ জিজ্ঞেস করল সেলেনা।
‘দু’শ’ মাইলের কিছু কম হবে।’
‘কতক্ষণ লাগবে পৌঁছুতে? তিন ঘণ্টা?’
‘আড়াই ঘণ্টার মত লাগার কথা এই গাড়িতে।’ অ্যাকসেলারেটরে পা দাবাল রানা।
‘বুঝেছি!’ অস্ফুটে বললেও কান এড়াল না ওর।
গতির ঝড় তুলতে যাচ্ছে মাসুদ রানা!