এগারো
নেমে এল ওরা উপর থেকে।
ফেলে দেয়া সাব-মেশিন গানটা সংগ্রহ করল রানা। অত উঁচু থেকে পড়েও আঁচড় লাগা ছাড়া আর কোনও ক্ষতি হয়নি ওটার। এ-জাতীয় আঘাত সহ্য করার উপযুক্ত করেই তৈরি করা হয় এ ধরনের যুদ্ধাস্ত্রগুলো।
ঝাড়াঝুড়ো দিয়ে হাতেই রাখল ও অস্ত্রটা। বিপদ কাটেনি এখনও। অচেতন লোকটাকে যেখানে ফেলে গিয়েছিল, চলেছে ওরা সেই বিল্ডিঙের দিকে। কিছু প্রশ্নের জবাব জানতে হবে।
মনের কোণে যে-সংশয় জেগেছিল, সেটাই সত্যি হতে দেখল জায়গায় পৌঁছে। রক্তের ছোপছাপ ছাড়া অকুস্থলে আর কোনও চিহ্ন নেই রুপালিচুলোর। পালিয়েছে পাখি!
‘আমারই দোষ,’ আফসোস করল রানা। ‘ঘণ্টা কয়েক অজ্ঞান থাকার মত ওষুধ দেয়া উচিত ছিল শয়তানটাকে।
‘বাদ দাও,’ সান্ত্বনা দিল সেলেনা। ‘পরে কখনও সুযোগ পেলে সুখ মিটিয়ে নিয়ো।’
এগিয়ে চলল ওরা কনস্ট্রাকশন এলাকা পিছনে রেখে। খোলা মাঠ পেরিয়ে হনহন করে পা চালাচ্ছে পার্কের দিকে।
‘তার পর, রানা?’ হাঁটতে হাঁটতে পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে জানতে চাইল মেয়েটা।
‘এখানে আসার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে তোমার।’ অদ্ভুত এক কাঠিন্য ফুটল রানার কণ্ঠ আর চেহারায়। ‘সমস্ত কিছু জানতে চাই আমি ক্যারেনের রিসার্চ সম্বন্ধে।’
মৃদু একটু হাসি ফুটল সেলেনার ঠোঁটে। ‘আমি যা জানতাম, সবই বলেছি তোমাকে।’
‘সেক্ষেত্রে মগজ খাটিয়ে খাপে খাপে বসাতে হবে সব কিছু। ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে জুড়তে হবে ছেঁড়া সুতোগুলো। …গোড়ালির কী অবস্থা?’
‘ব্যথা আর তেমন নেই বললেই চলে।’
‘ভালো খবর।’ নড করল রানা। ‘সামনে কিছু ঘোরাঘুরি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বিল্ডিং সাইট থেকে জোগাড় করা খালি একখানা সিমেন্ট ব্যাগে এমএক্সফোরটা মুড়িয়ে নিয়েছে ও।
পাঁচিল টপকাল ওরা পার্কের সীমানায় পৌঁছে। গুলিতে ঝাঁঝরা বেঞ্চটা পার হয়ে সাইডওয়াক ধরে চলল কারপার্কের দিকে।
পার্কিঙের কাছাকাছি এসে কালো একটা অডি এসসিক্স পারফর্মেন্স স্যালুনকে দেখতে পেল ওরা ভাড়াটে ভক্সলের সামনে। নেই কেউ গাড়িতে। কাছে পৌঁছুনোর পর সাবধানে হাত ঢোকাল রানা ট্রাউযারের পকেটে, ব্যথা যাতে না লাগে ছেঁচে যাওয়া ঊরুতে। ইগনিশন কি-টা বের করে নিয়ে রিমোট বাটনে চাপ দিতেই ‘ব্লিপ’ আওয়াজ আর ইণ্ডিকেটরের ঝলকানির সঙ্গে খুলে গেল অডির সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম।
‘মালসামান নিয়ে এসো তোমার।’ রেন্টাল কারটার দিকে ইঙ্গিত করল রানা। সেলেনার ট্র্যাভেল ব্যাগটা রাখা ওটার পিছনের সিটে। ‘আমরা অডিটা নিচ্ছি।’
ভ্রু কোঁচকাল মেয়েটা। ‘তোমার কি ধারণা, ভক্সলটার কারণেই সারাটা পথ ট্র্যাক করেছে ওরা আমাকে?’
‘যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পথে থেমেছ কোথাও তেল নেয়ার জন্যে? পে করেছ কার্ডে?’
‘অক্সফোর্ডশায়ারে পৌঁছে ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়েছি। গ্রামে ঢোকার আগমুহূর্তে তেলের জন্যে থামতে হয় একটা ফিলিং স্টেশনে। কোনও ইউকে কারেন্সি ছিল না সঙ্গে। ক্রেডিট কার্ডেই পে করতে হয়েছে সেজন্যে। কীভাবে জানব, নজর রাখা হয়েছে আমার গতিবিধির উপর?’
‘যতটুকু বুঝতে পারছি… রাম-শ্যাম-যদু-মধু নয় তোমার এই নতুন দোস্তোরা,’ রানা বলল। ‘অনেক গভীর জলের মাছ এরা… পুরোপুরি অর্গানাইজড। …আবারও ভুল লোককে দুশমন বানিয়েছ তুমি।’
‘কাউকে দুশমন বানাইনি আমি, রানা!’
‘সেক্ষেত্রে দোষটা তোমার বান্ধবীর।
‘কারা ওরা?’ বলল সেলেনা ভয় পাওয়া গলায়।
‘কারা আবার? ওরা!’ অর্থবোধক চাউনি দিল রানা, ‘তুমিই তো বলেছ।’
ভয় আরেকটু বাড়ল মেয়েটার। ‘খুনখারাবি তো তা হলে ছেলেখেলা ওদের কাছে!’
‘সে তো বটেই। আর কথা না বাড়িয়ে নিয়ে এসো ব্যাগটা।’
ছোট্ট ব্যাগটা নেয়ার জন্য ভক্সলের তালা খুলল সেলেনা।
‘গাড়িতেই রেখে দাও চাবিটা,’ রানার পরামর্শ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিয়ার সিটে ছুঁড়ে দিল ওটা সেলেনা। সশব্দে লাগাল গাড়ির দরজা।
‘বাকি জীবনের জন্যে রেন্টাল কোম্পানির কালো তালিকায় পড়ে গেলাম বোধ হয়,’ বলল মৃদু অসন্তোষের সঙ্গে। ‘অবশ্য এখন আর কী-ই বা এসে যায় তাতে!’
‘ব্ল্যাকলিস্টেড ক্লাবে সুস্বাগতম।’ হাসল রানা ঠোঁট টিপে। নিজেও এই তালিকার বড় মাপের কালপ্রিট ও। ‘ফোনটা দাও তো!’ চাইল হাত বাড়িয়ে।
কিঞ্চিৎ সতর্ক হলো সেলেনা। ‘কার ফোন, আমার? কী জন্যে চাইছ?’
‘আরে, দাও না, বাবা!’
তার পরও খানিক ইতস্তত করে পকেট থেকে ব্ল্যাকবেরিটা বের করল মেয়েটা, তুলে দিল রানার হাতে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কংক্রিটের রাস্তায় ফেলে জুতো দিয়ে ভর্তা বানাল ওটাকে রানা। এক লাথিতে কাছের ঝোপের দিকে পাঠিয়ে দিল টুকরো-টাকরাগুলো।
‘ত্-তুমি… তুমি…’ রাগে তোতলাচ্ছে সেলেনা।
‘মুভমেন্ট ট্র্যাক করার অপশন কমিয়ে দিলাম কিছুটা, ‘ নির্বিকার উত্তর রানার।
‘তোমার মাথা!’ কচু দেখাল সেলেনা। ‘অফিশিয়াল ওয়ারেন্ট ছাড়া কেউ কারও ফোন ট্র্যাক করতে পারে?’
‘ওরা পারে,’ এক কথায় মেয়েটাকে চুপ করিয়ে টান দিয়ে খুলল অডির ড্রাইভিং সিটের দরজা।
রি-ইনফোর্সমেন্ট এসে হাজির হওয়ার আগেই চম্পট দিতে সাহায্য করবে কারটা। তবে আশা করছে না ও—গানম্যানদের পরিচয় কিংবা কাদের হয়ে কাজ করছে ওরা, সে-ব্যাপারে কোনও ব্লু পাবে গাড়িতে। অত বোকা নয় এরা।
ব্যাকসিটে ছুঁড়ে দিল বস্তায় মোড়ানো অস্ত্রটা।