ল অ্যান্ড হোম-এর রুম

হ্যাঁ, ঠিকভাবে বললে, এ রকম বলতে হয়, ল অ্যান্ড হোম-এর রুম। জাজেস বা ম্যাজিস্ট্রেটস বা পুলিশের অনেক ইয়ে মানে হো-হোমরাচোমরা–মানে কর্তাব্যক্তিরা আসেন, বাবার যাঁরা বন্ধু, এবং তারা সকলে একসঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে ভালবাসেন। অবিশ্যি লইয়ার্সরাও অনেকে আসেন, তারাও সেখানেই বসেন, সকলেই ভীষণ ডিবেট করেন, কিন্তু আমি ও সবের কিছুই। বুঝি না বলে, কেবল ইয়ে হা করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, এবং বলতে গেলে, ঢুকিইনা, ও রকম তাকিয়ে থাকতে হয় বলে, যদিও তাদের অনেকেই আমাকে খুব ইয়ে-স্নেহ করেন। তিতিরের উৎসাহ দেখে আমার খুব অদ্ভুত লাগছে। এক বছর মাত্র এসেছে, এর মধ্যেই বাবার গেস্ট আর বন্ধুদের সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে। এ বাড়িতে তিতিরের রোলটা কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে এ বাড়িতে কোনও মেয়ের ঠিক এ রকম রোল ছিল না। কিছুটা বড়দির (তোতা) ছিল, কিন্তু ওর উৎসাহটা বেশি ছিল শিল্পীদের সম্পর্কে, নাচগানের দিকে, এবং বাবার সেই জাতীয় বন্ধুদের বা গেস্টদের সঙ্গে ও খুব মিশত। তিতিরের মতো, সকলের সঙ্গেই মেলামেশা বা কথাবার্তা বলতে পারত না।

দরজার সামনে এসে, আমার এ ঘরে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না ভাবছি, তখনই বাইরে থেকেই শুনতে পেলাম, হেই মাই লাভ, মাই সুইটহার্ট, হোয়্যার ইজ মাই রোজ বাড।বলতে বলতেই, দেখতে পেলাম, একটি হাত তিতিরের কাঁধের ওপর পড়ল।

তিতির ফিরে তাকিয়েই, কেমন খুশি হয়ে উঠল, অন্তত এক্সপ্রেশনটা তা-ই অথচ ওর হাত দিয়ে কাঁধের ওপর থেকে হাতটা আস্তে আস্তে নামিয়ে দিতে দিতে খুশির স্বরে বলল, ওহ, আপনি এসেছেন? আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম।

আহ, রিয়্যালি! আয়াম সো ফরচুনেট, বাট অ্যাট দ্য সেমটাইম আয়াম অ্যাফ্রেড!

যিনি চোখ বড় করে এ কথা বললেন, তাঁকে আমি চিনি, কলকাতা কোর্টের তিনি একজন ইয়ে– মানে, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, মিঃ বাসু। বাবার বন্ধু, হাসিখুশি, সব সময়েই জোভাইল মুডে থাকেন। বিরাট লম্বা চওড়া চেহারা, মাথার পাতলা চুল ধবধবে সাদা, মোটা ভুরু, চোখা নাক। তিতির সন্তোষকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, মতিয়া কোথায়, ডেকে দাও। আচ্ছা, থাক, আমিই যাচ্ছি।

বলতে বলতে ও মিঃ বাসুর দিকে ফিরে বলল, এক মিনিট, আসছি। বলতে বলতে ও রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

মিঃ বাসু সেদিকে তাকিয়ে বললেন, দশ মিনিট অপেক্ষা করতে রাজি আছি, বাট আই মাস্ট হ্যাভ মাই রোজ।

তিতির ফিরে কোনও জবাব দিল না, মিঃ বাসু এ বার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে, মাথাটা একটু পিছনে হেলিয়ে, ভুরু কুঁচকে দেখলেন, তারপরে বলে উঠলেন, হ্যালো মদন, কবে এসেছ?’ বলে আমার দিকে তার চওড়া মোটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

আমি ওঁর সুন্দর টাই-এর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আজ ও বেলা এসেছি।

মিঃ বাসু আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন, (এখনও হাতে বেশ জোর।) বললেন, গুড! ওহ্, মানথস এগো, য়ু ওয়্যার সাচ এ হট স্টোরি ইন আওয়ার ফ্রেন্ড সারকল! আয়াম রিয়্যালি সরি ফর য়ু–আর কোনও কারণে না, অন্যায় না করে তোমাকে পানিশমেন্ট পেতে হল। এমন ব্যাপার যে, মহাদেবেরও কিছু করার ছিল না।

এ ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে বা শুনতে আমার আর ইচ্ছা করছে না। বললাম, যা হবার তা হয়ে গেছে, মানে।

ইয়েস, দ্যাট’জ রাইট, বাট ইট ওয়াজ এ ফিলদি কনসপিরেসি এগেনস্ট য়ু।বলতে বলতেই তিনি গলার স্বর নামিয়ে, প্রায় হুইসপারিং করলেন, লায়লী সিং-এর সঙ্গে তোমার কোনও অ্যাফেয়ার ছিল নাকি?

অ্যাফেয়ার? না না। আমি বলতে গিয়ে ঢোক গিললাম।

 মিঃ বাসু আমার হাতে আঁকুনি দিয়ে বললেন, থাকলেও ইট ম্যাটারস নাথিং। মুশকিলটা হচ্ছে, রাস্তায় দিনের বেলা পাবলিকের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে কিনা, উই জাজেস আর আওয়ারসেলভ কনভিক্টেডনা, কনভিক্টেড বলব না, আমাকে ঘটনা আর সাক্ষীপ্রমাণাদির ওপরে রায় দিতে হবে, আইনমাফিক বিচারের রায় দেবার দায়িত্ব আমার ওপরে দেওয়া হয়েছে, (কিন্তু এ সব আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।) সমাজের কল্যাণের জন্য, দো আই নো ভেরি ওয়েল, হিউম্যান বিইংস আর ভেরি পিকুলিয়র, তাদের ওয়ে অব লাইফ অ্যান্ড থিংকিং ফার অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য ল, কিন্তু সেটা জাজ হিসেবে না, বি. বি. বি. হিসাবে–আই মিন বঙ্কিমবিহারী বসু।

আহ, কেন যেন ভগবানকে ডাকতে শিখি নি!

আমি জানি লায়লী সিং-এর একটা অবসেশন ছিল তোমার সম্পর্কে!

তিতির এসে পড়ল, ওর হাতে একটি তাজা লাল গোলাপের কুঁড়ি-আহ, ভগবানকে ডাকার কথা ভাবছিলাম, তিতির এসে পড়তেই মিঃ বাসু আমার হাত ছেড়ে দিয়ে, ঝুঁকে নিচু হয়ে পড়লেন, বলে উঠলেন, ওহ মাই ডার্লিং চাইল্ড, মাই সুইটহার্ট, (আরও এক বার বলেছিলেন, সুসুইটহার্ট-মানে কী? তিতির তো হাসছে ঠোঁট টিপে) এই তো আমার পাওনা।

তিতির মিঃ বাসুর কোটের বুকে গোলাপ কুঁড়ি গুঁজে দিতে দিতে বলল, আপনাকে তো বলেছি, যেদিনই আসবেন, আমার কাছ থেকে একটি গোলাপ কুঁড়ি পাবেন।বলতে বলতে ফুলটা গুঁজে দিল, মিঃ বাসু ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, নাউ লেট মি শো মাই প্রাইড টু আদারস, চলো ঘরের মধ্যে।

তিতির আমার দিকে তাকিয়ে, ওর সেই চোখে যেন কী একটা ইয়ে-মানে, ইশারা করল, ঘাড় ঝাঁকিয়ে ডাকল, আসুন!

মিঃ বাসুও ডাকলেন, এসো মদন।

বলে উনি তিতিরকে নিয়ে পরদা সরিয়ে ঢুকলেন, আর পরদাটা আমার গায়ের ওপর এমনভাবে পড়ল, আমার অর্ধেক শরীর ভিতরে, হাফ বাইরে। প্রায় সাত-আটজন বসে ছিলেন, এখানে স্কচ পান চলছে, সকলকেই প্রায় আমি চিনি, এবং অনেকেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, হেইল বি. বি. বি.!

অ্যান্ড হিয়ার ইজ মাই রোজ বাড!’ বলে মিঃ বাসু বুকের দিকে দেখালেন।

এক জন, মিঃ কর, পুলিশের একজন বড় কর্তা, জিজ্ঞেস করলেন, হোয়্যার? অন য়োর কোট অর ইন য়োর হ্যান্ড?

মিঃ বাসু বললেন, দু জায়গাতেই।

সকলেই গলা খুলে হেসে উঠলেন। আর এক জন মিঃ ঘোষ, এ ফেমাস ক্রিমিনাল ল’ইয়ার জিজ্ঞেস করলেন, তা ফুলটি কি তুমি মহাদেবের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলে?’ বলে তিতিরের দিকে তাকিয়ে ইয়ে, ভুরু নাচালেন।

মিঃ বাসু বললেন, নো নো, শি ওয়াজ ওয়েটিং ফর মি৷

আহ, হোয়াট এ লাকি ডগ য়ু আর।কয়েকটি স্বর বলে উঠল।

 তিতির আবার মিঃ বাসুর হাত কঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে একটু সরল, এবং বলল, আপনি বসুন।

 মিঃ বাসু একটি সিঙল সোফায় বসতে গিয়ে বললেন, তুমি কোথায় বসবে?

মিঃ কর বলে উঠলেন, রজনী আমার কাছে বসবে। বলে তিতিরকে ডাকলেন, এসো রজনী, আমার কাছে এসো।

তিতির বলল, আপনারা বসুন, আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি।

এ সময়ে দিবাকর ঢুকল হুইস্কির গেলাস নিয়ে, এগিয়ে দিল মিঃ বাসুর দিকে। মিঃ বাসু গেলাসটি হাতে তুলে নিলেন, আর এ সময়েই কে বলে উঠলেন, আরে তুমি মদন না?

যিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি মিঃ দাশগুপ্ত, হাইকোর্টের বড় কাউনসেল। সকলেই আমার দিকে তাকালেন, এমনকী তিতিরও। আমি একটু হাসবার চেষ্টা করলাম–মানে, হাসলাম, আর স্লাইট ঘাড় ঝাঁকালাম, যার মানে, হ্যাঁ। ক্রিমিনাল লইয়ার মিঃ ঘোষ বলে উঠলেন, আরে তোমার জন্য আমি দিল্লিতে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মহাদেব যেতে দিল না। (ওহ, এগেন দ্যাট এপিসোড।) বলল যে, গিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু সেটা আমার ব্যাপার ছিল, লাভ লোকসান কিছু হত কি না।

মিঃ বাসু বলে উঠলেন, কিছুই হত না।

মিঃ ঘোষ বললেন, কী হতে পারত না পারত, য়ু জাজেস ক্যানট সে৷ উই দ্য লইয়ারস নো, কী হতে পারে না পারে। আমরা হওয়াতে পারি, না হওয়াতেও পারি।

নো, নট দ্যাট, ইট ডিপেন্ডস-’ মিঃ দাশগুপ্ত বললেন, তুমি পাঁকাল মাছের মতো খেলতে পারো, কিন্তু জাজমেন্টের পয়েন্ট হচ্ছে ল।

তারপরে সকলেই এমনভাবে ল অ্যান্ড অর্ডার নিয়ে তর্কে মেতে উঠলেন, যেন একটা ঝড় বইতে শুরু করল। তিতির বলে উঠল, উহ আপনারা ভীষণ দলাদলি আর ঝগড়া করছেন, এত কচাকচি কেন?

মিঃ বাসু তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, সরি ডার্লিং, আমরা একদম বোকা, তুমি বসো৷

 আপনি বসুন।’ তিতির বলল, আপনার সঙ্গেই আমার দরকার। সে দিন আপনিও আমার কথা এড়িয়ে গিয়ে, পাঁকাল মাছের মতো পালিয়ে গেলেন।

মি?’ মিঃ বাসুর সুন্দর মুখে অ্যাস্টাউন্ডেড ভাব।

হ্যাঁ’, তিতির বলল, আপনি ত্রিদিবেশ রায়ের জাজ, জাজমেন্ট কী হবে আপনি বলুন।

মিঃ বাসুর মুখে হা হয়ে গেল, এবং সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার তিতিরের দিকে এক সেকেন্ড দেখে বললেন, ওহ মাই ডার্লিং চাইল্ড, আমি তার কিছুই জানি না। ত্রিদিবেশ রায়ের মামলা এখনও চলছে।

তিতির মিঃ ঘোষের দিকে তাকাল। মিঃ ঘোষ বললেন, জানি, তুমি আমার দিকে তাকাবে। এসো, তুমি আমার কাছে এসে বসো, আমি বলে দিচ্ছি।’

মিঃ বাসু তিতিরের একটা হাত ধরে বললেন, না, ও আমার পাশে, হাতলের ওপর বসবে, তোমার যা বলার আছে বলো।

তিতির সকলের দিকে চেয়ে হাসল, এবং বলল, আমি কোথাও বসছি না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনছি, বলুন।

মিঃ ঘোষ বললেন, বঙ্কিমরা কী জানে জান তো? সাধারণ লোকদের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, আর কিশোর কিশোরীরাও তাই, তারা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এমন কিছুই চলতে দেবে না ওরা।

মিঃ বাসু বললেন, দ্যাট’জ ল’

 কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করো, গীতগোবিন্দের জাজমেন্ট কী হবে?’ মিঃ ঘোষ বললেন।

ওটা ধর্মীয় গ্রন্থ, ওটাকে আমার এজলাসে প্রসিকিউশনের জন্য আনছে কে? দ্যাট’জ অলসো ল।

কেবল কৃষ্ণের জায়গায় যদি বঙ্কিমবিহারী বসু করে দেওয়া যায়?’ ঘোষ বলতেই সবাই হেসে উঠলেন।

কিন্তু আমাদের বর্তমান জীবনটা?’ তিতির জিজ্ঞেস করল, যে সমাজ এখন আমাদের চারপাশে, আপনারা, আমরা, এত ফিল্ম পোস্টার, শোজ, অ্যাডভারটাইজমেন্ট–মানে টোটাল চেহারাটা, ইভন পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর নানান কেচ্ছা–এ সব কি কিশোর-কিশোরী আর সাধারণ মানুষকে মোটেই পারভার্ট করছে না? আর এ সব বলতে গেলেই ত্রিদিবেশ

জাজ দাশগুপ্ত বললেন, কিন্তু আমার আদালতে ও সব বিচারের জন্য আনছে কে? কেউ না। আর আনলেও, ওই যে ক্রিমিনাল লইয়ার বসে আছে, ফিল্ম-টিল্ম আর কোম্পানিগুলোর কথা যা বললে, সব তো ওদের সাজেশন নিয়ে করে।

আমি কেমন টায়ার্ড ফিল করছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, অনেক কথা বলবার আছে, অথচ বলা যাবে না, যেমন, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে, তা হলে ত্রিদিবেশের বিরুদ্ধে লোকটি কে–মানে পাবলিকের সেই লোকটির শিক্ষা আর চরিত্র আর মন আমার ভাবনাটা শেষ হবার আগেই, তিতির বলল, কেষ্টবাবুই ঠিক বলেন, আপনারা কিছু নন।

কে কেষ্টবাবু? দ্যাট কেষ্ট চৌধুরি? এ হোকস, জেলাস র‍্যাট!’ মিঃ বাসু বলে উঠলেন, আমাদের তো তবু ল পয়েন্টে চলতে হয়, ও সাহিত্যের কী বোঝে?

জাজ দাশগুপ্ত বললেন, সামটাইমস উই জাজেস ক্যান অ্যাপ্রিসিয়েট লিটারেচর, কিন্তু ক্রিটিকগুলো সব 

আমি ঘরের বাইরে চলে এসেছি, সত্যি টায়ার্ড। আমি জানি না, বা বুঝি না, এ সব থেকে মানুষের জীবন বা আর্ট অ্যান্ড লিটারেচর কী ইয়ে–মানে বেনিফিট হবে। ওঁরা সবাই তিতিরকে নিয়ে খুব ইয়ে–আর তিতির সকলের সঙ্গেই খুব ইয়ে মানে, সবাইকে ও খুব ইয়ে করতে পারে, কিন্তু বাবার বুক থেকে তিতিরকে (গোলাপকুঁড়িকে?) ছিনিয়ে নেবার কথা কে যেন বললেন? তার মানে কী?

উম! না।

কে? আমি ওপরের বারান্দায় এসে পড়েছি, এবং বাবার ঘর পার হয়ে, যে ঘরটা বারান্দা থেকে সরে গিয়েছে, মানে ইস্ট সাইড ওপনিং–যে দিকে যেতে হলে, প্রায় একটা করিডর রয়েছে, সেখানেই যেন একটা ফিমেল ভয়েস শুনতে পেলাম, আর আমার গায়ের মধ্যে কেমন করে উঠল, একটা প্রায় ভয়ের শিরশিরানির মতো। তারপরেই, ঘরের খোলা জানালা দিয়ে, (ওহ, কেন ভগবানকে ডাকতে শিখিনি।) ঘরের মধ্যে জিরো পাওয়ারের নীল আলোয় দেখতে পেলাম–ইমপসিবল, দু-দুজন ইয়ে, ম্যান অ্যান্ড উয়োম্যান, ওরা ইয়ে–মানে এমব্রেসিং? কিন্তু ইয়ে মানে সে রকম গরম তো নেই, ওরা গায়ে কিছু দেয় নি কেন? দুটো কালো পাথরের মূর্তির মতো ওদের দেখাচ্ছে, এবং আবার আমি ফিমেল ভয়েস শুনতে পেলাম, তোমার খুব সাহস হয়ে গেছে, না? কেউ এসে পড়ে যদি?

কেউ আসবে না। মেল ভয়েস শুনতে পেলাম। কিন্তু আমি এসে পড়েছি যে? কথাটা মনে হতেই, তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিকে ফিরে গিয়ে, নামতে আরম্ভ করলাম। নীচে আসতেই, তিতিরের সঙ্গে দেখা, ও বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে, আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছলেন, কখন। চলে এলেন?

বললাম, এ–এই তো, একটু আগে, ওপরে গেছলাম।

তিতির ওর সেই ডিপ চোখে, দু সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, সেই রকম, যেন কিছু খুঁজছে, তারপরেই হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি হিরা আর সন্তোষকে ওপরে দেখলেন?

হি-হিরা আর–? আমার চোখের সামনে, এই মাত্র দেখে আসা ছবিটা ভেসে উঠল, এবং উইদন এ মোমেন্ট, আমার মধ্যে একটা কী হয়ে গেল, আমি বললাম, দেখেছি, ওরা একটু ব্যস্ত আছে।

তিতিরের চোখে পলক নেই, আর মনে হল, জীবনে ও এ রকম কথা শোনেনি। তারপরেই ও বলে উঠল, ওহ, আমিই ভুল করেছি হিরাকে ওপরে থাকতে বলে, আরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। নীচে সকলের মাঝখানে থাকলে–’কথা শেষ না করেই ও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল।

আমি বললাম, ইয়ে–মানে, লেট দেম বি বিজি, অ্যাঁ?

লেট দেম বি বিজি?’ তিতির থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কী বলছেন? হিরার যদি একটা কিছু হয়ে যায়কনসেপশন?

অবাক হয়ে বললাম, তাতে কী?

তিতির আরও বেশি অবাক হল। যে কারণে হঠাৎ কথাই বলতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড পরে বলল, তারপরে যদি সন্তোষ ভেগে পড়ে, তখন? তখন হিরাকে নিয়ে কী করবেন আপনারা?

ভে–ভেগে পড়ে মা-মানে?

আসুন আমার সঙ্গে।’ বলেই তিতির ওপরে উঠে গেল অন্ধকারে। আমি এত ভাবতে পারি না তিতিরের মতো, এত বেশি দূর পর্যন্ত, কিন্তু ওপরে ওঠাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। আশ্চর্য, সন্তোষ চলে যাবে কেন? আর চলে গেলেই কি হিরার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে? মানুষকে অবিশ্যিই ভাবতে হয়, তবু এতটা পরাধীনতা–হ্যাঁ, সমস্ত ব্যাপারেই আমরা বড় ইয়ে–ডিপেনডান্ট, ভিকটিম অব দ্য সারকামসট্যান্সেস। ওপরে এখন কী ঘটছে? তিতিরের যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে? কিন্তু তিতির তো যেন একটা ইয়ে–যাকে বলে অতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনে ছুটে গেল। কর্তব্য? কিন্তু ওদের দুজনের ব্যাপারটানা, সন্তোষ নাকি চলে–মানে ভেগে পড়তে পারে। আথিংকে। হঠাৎ আমার চোখ গেল বারান্দার একেবারে এন্ডে, রান্নাঘরের সামনে, জানকী ঠাকুর আর মতিয়া এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই ওরা আড়ালে চলে গেল। আমি ওপরেই যাই, অন্তত তিতির যদি খুব রেগে যায়, (তিতিরের মর্যালিটি বিষয়ে আমি কিছুই জানি না) তা হলে ওকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করা যাবে। ভেবে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই দেখলাম, সন্তোষ নেমে আসছে, এবং ওহ কী স্বস্তি, ও জামাকাপড় পরে আছে। ও আমার দিকে না তাকিয়েই মাথা নিচু করে নেমে চলে গেল, অথচ কোনও মানে হয় না–এই মাথা নিচু করার। লজ্জা? হ্যাঁ, সেটা বোধ হয় সম্ভব। আমি ওপরে উঠে এলাম, এবং বাবার ঘরের পরের ঘরে এখন বেশি পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখতে পেলাম, হিরা দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে কাঁদছেই তো, কারণ শব্দটা সেই রকমই হচ্ছে, অনেকটা ইয়ে–হেঁচকি তোলার মতো, দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকা, আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিতির, শক্ত মুখে, চোখ দুটো কেমন যেন রাগে ঝকঝক করছে। মেরেছে নাকি? সেটা তা হলে খুবই অন্যায় করা হয়েছে। শুনতে পেলাম, তিতির বলছে, জানকী ঠাকুর তোকে কোনদিন বিষ দিয়ে মারবে, সেই তোর ভাল। আমি কোথায় ভাবছি, মেসোমশাইকে বলে সন্তোষের জন্য আর একটা কাজের কথা বলব, যাতে ও বেশি মাইনে পায়, বিয়ে করতে পারে, তা সে সবুর তোদের সইছে না। যা, বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে।

হিরা হঠাৎ নিচু হয়ে পড়ল, ওকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, তিতির বলে উঠল, থাক, আমার পায়ে ধরে কিছু হবে না। নিজের পায়ে কুড়োল (কুড়োল! হ্যাঁ জানি।) মারলে, নিজেই মরবে।

বলেই ও ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল, এবং আমাকে দেখে দাঁড়াল। বাঁ হাত দিয়ে দেওয়ালে সুইচ টিপে বারান্দার আলো জ্বালল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল, আর তার মধ্যেই ওর মুখের এক্সপ্রেশন বদলে গেল, খানিকটা হতাশ স্বরে বলল, ওহ, দে আর সো কুইয়ার।

হ্যাঁ, পিপল আর কুইয়ার, কিন্তু–তিতির জিজ্ঞেস করল, আপনি কী ভাবছিলেন?

 মা-মানুষের পরাধীনতার কথা।

তিতির আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, একটু যেন অবাক হল, ভুরু কোঁচকাল, তারপরে কেমন একটু আনমাইন্ডফুল, এবং তার ওপরে ও যেন কেমন ফ্রিজ হয়ে গেল, কেবল ওর চোখের দৃষ্টি অন্য রকম, ও আমার মুখের দিকে যেন কেমন করে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটো যেন চিকচিক করছে। আমি আমার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।

.

ইয়ে, বাবা আর তিতিরনা, তার আগে সেই হররষ্ট্রিকন ঘটনা আমি এখনও ভুলতে পারছি না, যদিও তার সঙ্গে বাবা আর তিতিরের বিষয়ে চিন্তার কোনও যোগাযোগ ঠিক নেই, অথবা হয়তো আছেও। আসলে আমি পাজলড। লায়লী সিং আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ঘটনা দু সপ্তাহ আগের, আমি দিল্লি থেকে ফিরে আসার তিন দিন পরে, বেলা তখন তিনটে হবে, আমাদের বাড়ি সাইলেন্ট, লোকজনরা সবাই ঘুমোচ্ছিল, অথবা আর কিছু করছিল, আমি জানি না, আমি আমার ঘরে ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম না, চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম, তার একটু আগেই চে গুয়েভারার নোটস পড়ছিলাম, আর একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক, যাতে এ রকম চিঠি ছাপানো হয়েছে, কলকাতার কোনও কোনও এরিয়ায়, চে গুয়েভারার নীতিতে লড়াই চলছে, এবং সে সব এরিয়া বিপ্লবীদের দখলে, রাস্তায় বেরিয়ে যার কিছুই আমি দেখতে পাইনি। চোখ বুজে শুয়ে আমি সে সব ভাবছিলাম না, আমার ভিতরে কোথায় কতগুলো গোলমাল ঘটছিল–মানে আমার মনে এবং চিন্তার মধ্যে, সেগুলো বোঝবার চেষ্টা করছিলাম। আমার ঘরের দরজা খোলাই ছিল, হঠাৎ একটা খসখস বা আরও কোনও রকম শব্দে আমি চোখ খুলে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পাই দরজার সামনে লায়লী সিং, তার হাত ধরে সুদীপ্তা চ্যাটার্জি দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনে নাথু, যার চোখমুখের ভাব দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, গোঁফ জোড়া পাকানো, খাকি ট্রাউজারের ওপর হাতকাটা গেঞ্জি পরা, বলল, মেমসাহেবরা বললেন, আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিতে। যেন আমাকে জিজ্ঞেস করবার কোনও দরকার নেই। অবিশ্যি সুদীপ্তা চ্যাটার্জি এ বাড়িতে আরও অনেক। বার এসেছেন, নাথু ওঁকে চেনে, এবং আমার মনে হল, উনিই লায়লী সিং-কে নিয়ে ও রকম একটা। সময়ে এসেছিলেন। উনি হাত নেড়ে নাথুকে বললেন, তুম্ চলা যাও।নাথু চলে গেল। লায়লী সিং-কে। নিয়ে সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, এবং দরজা বন্ধ করলেন, আমি আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসলাম, আমার বুকের মধ্যে ড্রাম পিটতে আরম্ভ করেছে। দুজনের দু রকম পোশাক। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ডার্ক ব্লু টাইট ট্রাউজার-ওটাকে কী বলে আমি জানি না, মনে হয় ওঁর গোড়ালির কাছ থেকে কোমর পর্যন্ত চামড়ার সঙ্গে ইয়ে মানে লেপটে আছে, তার ওপরে বাসন্তী না মাস্টার্ডকালার কলার তোলা ফুলস্লিভ সিনথেটিক জামা, কোমরে চওড়া বেল্ট, আর, ওহ আমি জানি না, লায়লী সিং যা পরে আছে, তাকেই মিনি শাড়ি বলে কি না, কিন্তু সেটা শাড়ি এবং হাঁটুর ওপরে তোলা, টকটকে ইন্ডিয়ান রেড তার রং, আর সেই শাড়িতেই এক দিকের কঁধ ঢাকা, আর এক দিকের কাধ একদম বেয়ার, আই ডোনো রিয়্যালি, এটা কী এবং এভাবে কেউ বাইরে বেরোতে পারে, বিশেষ কোনও শো করা ছাড়া। আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুজনেরই ঘাড় অবধি চুল খোলা, ঠোঁটে মুখে তেমন রং নেই, দুজনকেই কেমন টায়ার্ড দেখাচ্ছে, আর চোখা, যা দেখলে ভয় পাই, ঠিক তাই, লাল। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, কী করব। মদনবাবু, লায়লী কিছুতেই ছাড়ল না, লাঞ্চ টেবল থেকে জোর করে আমাকে তুলে নিয়ে এল, আপনার সঙ্গে মিট করবে বলে। ও তো কোনও দিন আপনাদের বাড়ি আসেনি, তাই আমাকেই (একটা পাঁচতারা হোটেলের নাম করলেন) হোটেল থেকে নিয়ে আসতে হল।

আমি বলে উঠলাম, ওহ, আচ্ছা বববসুন। কমপেনসেট! আমার মনে পড়ল।

আহ, মাদান!’ লায়লী সিং তখনও সুদীপ্তা চ্যাটার্জির হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল, আমার কানে বো– বোম ফাটল, লায়লী সিং সুদীপ্তাকে ছেড়ে দিয়ে, আমার দিকে দু পা এগিয়ে এল। ওহ, কেন ভগবানকে ডাকতে শিখিনি, ইংরেজিতে বললাম, দয়া করে বসুন মিসেস সিং, আমি দরজাটা খুলে দিই।

ওহ, নো মাদান, দরজা খুলো না। আমাকে লায়লী বলে ডাকো। তোমার যা ইচ্ছা করো, ক্রাশ মি, আয়াম ডায়িং ফর য়ু৷ লায়লী সিং দু হাত বাড়িয়ে দিল, আর আমি দেখতে পেলাম, তার কঁধ ঢাকা আঁচলের ওপরে একটা মস্তবড় বাটারফ্লাই গোল্ডেন ব্রোচ। ঠিক যেন সিনেমা হলের মাথায় বড় পোস্টার, নীচে জনতা সেই দিকে তাকিয়ে টিকেট বুকিংয়ের লাইনে মারামারি করছে, আমার চোখের। সামনে ভেসে উঠল। আমি সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে তাকালাম, উনি কোমরে হাত দিয়ে পা দুটো অনেকখানি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট টিপে হাসছেন, এক বার আমাকে, আর এক বার লায়লী সিং-কে দেখছেন। বললেন, আমার জন্য ভাববেন না মদনবাবু, আমি নেই মনে করুন।

তার মানে কী, কেন আমি তা মনে করতে যাব? লায়লী সিং কাঁধের ব্রোচটা এক সেকেন্ডে খুলে ফেলল, আমি বাথরুমের দরজার দিকে তাকালাম। কমপেনসেশন! ওহ, এ বার তোমাকে ডাকতে দাও হে–দরজায় নকিং হল, লায়লী সিং-এর মিনি শাড়ির আঁচল যেন ইয়ে–ঝর্নার জলের মতো গড়িয়ে পড়ছে। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে হতে পারে?

বাবা।!’ আমার মুখ দিয়ে প্রথমেই বেরিয়ে পড়ল।

মহাদেবদা?’ বলতে বলতেই উনি দরজার কাছে গিয়ে, ল্যাচ-কী খুলে হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুললেন। তিতির–তিতির বাবা না। তিতির সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে এক বার দেখল, তারপর ভিতরে লায়লী সিং-এর দিকে, এবং ঘরের মধ্যে ঢুকে এল, আমার দিকে তাকাল, এক্সপ্রেশন–অবাক আর জিজ্ঞাসা। আমি বললাম, মিসেস চ্যাটার্জি আর মিসেস সিং দি–দিল্লিতে থাকেন।

তিতির দুজনের দিকে ফিরে কয়েক সেকেন্ড দেখল, লায়লী সিং আঁচলটা ইয়েবুকে চেপে ধরে আছে, তিতিরকে অবাক চোখে দেখছে এবং সুদীপ্তা চ্যাটার্জিও। তিতির হঠাৎ একটু হাসল, কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে ইংরেজিতে বলল, আমার নাম রজনীবালা। আমার মনে হয়, আপনাদের কফি পেলে ভাল হয়।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ঘাড় অল্প ঝাঁকিয়ে বললেন, রিয়্যালি।

 তিতির সেখান থেকেই ভয়েস তুলে উঠল, হিরা। সঙ্গে সঙ্গে হিরা দরজায় দেখা দিল। তিতির বলল, চার জনের মতো কফি নিয়ে এসো।’ বলেই লায়লী সিং-এর দিকে ফিরে হেসে বলল, ডু য়ু মাইন্ড, ইফ আই হেল্প য়ু?’ এবং অ্যানসারের অপেক্ষা না করেই, পড়ে যাওয়া আঁচল বেশ ইয়ে মানে সুন্দর করে গুছিয়ে সাজিয়ে কাঁধের ওপর তুলে দিয়ে, খোলা নাভির অংশ একটু ঢেকে দিয়ে, লায়লী সিং-এর ডান হাত থেকে ব্রোচটা নিয়ে আটকে দিল, আর লায়লী সিং-এর ঠোঁট নড়ল, কী যেন বলল, তিতির হেসে বলল, নো নিড টু মেনশন, প্লিজ সিট ডাউন’ বলে সুদীপ্তা স্যাটার্জির দিকেও তাকাল।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জির চোখে এখনও জিজ্ঞাসা আর কৌ–কৌতূহল। লায়লী সিং ওঁর দিকে তাকাল। উনি ইংরেজিতে বললেন, এসো লায়লী, বসি।

লায়লী সিং আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মাদান, আমি তোমার কাছে এসেছি। অসুবিধা হলে তুমি আমার সঙ্গে চলো।

আমি তিতিরের দিকে তাকালাম, তিতির আমার দিকে। লায়লী সিং-এর দিকে ফিরে বলল, আমি আপনাদের ডিসটার্ব করব না। একটু বসুন, কফি পান করুন, এটা আমার কর্তব্য, তারপরে আপনারা বসে গল্প করবেন, আমি চলে যাব।

লায়লী সিং বলে উঠল, আপনার কর্তব্য পালনের কোনও দরকার ছিল না। তার স্বরে ঝাঁজ এবং চোখের দৃষ্টি যেন কেমন, ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। তিতির হাসল, বলল, কিছু মনে করবেন না, কর্তব্যের ফাঁকি দিতে আমি শিখিনি, অতিথিদের সময়োপযোগী সেবা করা আমার কাজ। আপনার আর্জ আপনি দশ মিনিটের জন্য চেপে রাখুন, তারপরেই ঠক্ ঠক্ ঠক্ জুতোর শব্দ বারান্দায়, এগিয়ে এসে থামল আমার দরজায়–বাবা। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা, ঘরের ভিতরে সবাইকে এক বার তাকিয়ে দেখলেন, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বলে উঠলেন, দাদা!’ বলেই তিনি ছুটে গিয়ে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন, বাবা মুখ নিচু করে দেখলেন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি দাঁড়ালেন, বাবা ওঁর মুখের দিকে দেখলেন, তাঁর মোটা এবং লাল ঠোঁটে একটু যেন হাসি, শব্দ করলেন, হুম! তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে, কারোর দিকে না তাকিয়ে, লায়লী সিং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। লায়লী সিং বাবার দিকে তাকিয়ে, অবাক অস্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি?

মদনের বাবা। বাবা বললেন। লায়লী সিং এক বার আমার দিকে দেখল, তারপরে হঠাৎ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ওহ, য়ু আর দ্য ফাদার!

আমার পায়ের তলায় মাটি যেন কেঁ–কেঁপে গেল, কিন্তু বাবা কিছুই বললেন না, কেবল থ্যাংকু’ বলে লায়লী সিং-এর পিঠে হাত দিয়ে, ওকে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, বিমি এসো। বলে দরজার বাইরে বারান্দা দিয়ে চলে গেলেন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি এক বার পাজলড চোখে আমার আর তিতিরের দিকে দেখে বেরিয়ে গেলেন। তিতির কয়েক সেকেন্ড পরে, আমার কাছে এগিয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছেন?

আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে–মানে, মাথাটা কেমন ইয়ে হয়ে যাচ্ছে। ভেকান্ট চোখে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললাম। তিতির বলল, মাথাটা ঠিক রাখবার চেষ্টা করুন। আমি যাচ্ছি।’ বলে ও ঘরের বাইরে চলে গেল।

.

তারপরে রাত্রি আটটা পনেরো অবধি আমি ঘরেই ছিলাম। যত দূর মনে পড়ে হিরা আমাকে কফি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল, আলোও বোধ হয় ও জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, এবং আমি কখনও বসছিলাম, উঠছিলাম, পায়চারি করছিলাম, খাট থেকে বই আর পত্রিকা খুলে পড়বার চেষ্টা করছিলাম, মাথায় কিছুই ঢুকছিল না, এমনকী এক বার টেবলের ওপরে ট্রানজিস্টারের নবও ঘুরিয়ে ফেলেছিলাম, এবং তখন সংবাদ পাঠ হচ্ছিল, মাঝখান থেকে শুনতে পেয়েছিলাম…আজ বিকালে এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সিম্পোসিয়ামের বিষয়বস্তু ছিল, সাহিত্যে শ্লীলতা। লক্ষণীয় ছিল, বিভিন্ন সাম্যবাদী, গান্ধীবাদী এবং জনসংঘি সংস্থার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একাধিক প্রবীণ সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আলোচনার সময় মূল আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেন ত্রিদিবেশ রায়। তিনিও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির বক্তৃতার আগে, ত্রিদিবেশ রায়কে বলতে বলা হলে, তিনি বলেন, বিষয়বস্তুর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তির ওপর আক্রমণ শুধু চলছে, তার জবাবে শুধু এই বলতে পারি, আমার যে পিপীলিকা’ উপন্যাসের প্রতি এত আক্রমণ, তার একমাত্র কারণ, আক্রমণকারীরা ভীত ও বিরক্ত, কারণ তাঁদের ক্রোধের আগুনে তাঁদেরই মোমের মুখোশ গলে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ গোলমাল শুরু হয়ে যায়, পরে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরি ও কয়েকজনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। এ ছাড়া আজকের শহরের বিশেষ। ওহ, ম্যাডনেস। আবার নবটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে, পায়চারি করছিলাম, এবং নীচের তলায় কী ঘটছিল, কিছুই জানি না, বেরিয়ে যাব কি না ভাবছিলাম, তিতির এসে বলল, নীচে চলুন, মেসোমশাই ডেকেছেন।

দেখেছিলাম, তিতির সেই আগের পোশাকেই, নতুন করে কোনও ড্রেস করেনি–মানে সাজেনি, এবং ওকেও যেন কেমন একসাইটেড অথচ, ওর সেই চোখে একটা মিষ্ট্রির ভাব দেখেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন?

বাহ, তা আমি কী জানি? আপনার বান্ধবীরা সব রয়েছেন।

 বান্ধবীরা?

 হ্যাঁ, লায়লী সিং, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি—।

 তারা কেউ আমার বান্ধবী নন।

তবু মেসোমশাই যখন আপনাকে যেতে বলেছেন, আপনি যান।’তিতির বলেছিল, আর পোশাকটা যদি নিতান্তই বদলাতে না চান, তবে অন্তত মাথাটা আঁচড়ে যান।’ বলে তিতির কয়েক সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। ওকে আমার ঠিক নরমাল লাগেনি। আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, চিরুনিটা তুলে নিয়েও, রেখে দিয়ে, আয়নায় নিজেকে দেখেছিলাম, হ্যাঁ, ঝোঁপঝাড়ের মতো দেখাচ্ছে, সো হোয়াট, আমি এ ভাবেই যাব। মনে মনে বলে আমি নীচে নেমে গেলাম। ড্রাইভার, মতিয়া, জানকী ছাড়া, বাড়ির কাজের লোকেরা বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল, আমাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়াল, ব্যাপার কী? আমি বাবার ঘরের পরদা তুলে দেখলাম, দরজা বন্ধ, যা কখনও থাকে না। ভিতর থেকে বন্ধ কিনা, দেখবার জন্য ঠেলতেই দরজা খুলে গেল, আর প্রথমেই আমি বাবাকে দেখতে পেলাম, তার গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে চ–চন্দন সিং, আনথিংকেবল, এবং রেকর্ডের মিউজিকের তালে তালে, ঠিক যেন একটা ইয়ে বাঁ-বাঁদরের মতো নাচছে, আর বাবা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ঘরের অন্য দিকে তাকিয়ে, যেখানে জোড়ায় জোড়ায় অনেকে নাচছেন, লায়লী সিং + মিঃ বি. বি., সুদীপ্তা চ্যাটার্জি + মিঃ কর, মিস রঞ্জনা (এক্স-মিনিস্টার অভয়বাবুর মেয়ে, কখন এসেছে জানি না।) + মিস্টার জগট বিশওয়াস, মিসেস ঘোষ–সেকেন্ড (ক্রিমিনাল লইয়ারের স্ত্রী, কখন এসেছেন জানি না।) + মিঃ চ্যাটার্জি–দিল্লি, বেগম সোফিয়া খান (মিঃ হাবিবুর বিজনেসম্যানের স্ত্রী, কখন এসেছেন জানি না।) + মিঃ দাশগুপ্ত, এই পাঁচ জোড়া নাচছেন, বাকিরা সকলেই ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বসেছেন, পান এবং স্মোকিং চলছে, বৈদ্যনাথ দরজায় দাঁড়িয়ে সকলের গেলাসের দিকে লক্ষ রাখছে, কেবল বুঝতে পারছি না, চ–চন্দন সিং বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কেন ও রকম করছে, বাবার যেন কোনও ইয়ে মানে খেয়ালই নেই। আচ্ছা, বাবা কী করেন? হঠাৎ একটা শাউটিং হল, মাদান। মাদান।

লায়লী সিং ছুটে এল এদিকে, সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালেন, তার আগেই চন্দন সিং মাদান’ বলে আমার কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে, ঠিক আগের মতোই নাচতে লাগল, আর লায়লী সিং বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল, বাবা বললেন, গবা এসেছিস? আয়, বোস। লায়লী আজ আমাদের ক্যাবারে ড্যান্স অব ইন্ডিয়ান স্টাইল দেখাবে।

কে যেন আমার নাম ধরে ডেকে উঠলেন, মদন এসো৷’ গলাটা চিনতে পারলাম না, কেন না, আজ সবাই বাবার ঘরে, যে কারণে জায়গার অভাব অনেকে কারপেটের ওপরেই বসেছেন, চন্দন সিং তেমনি করে নেচেই চলেছেন, আমার ঘাড়ে লাগছে–এটা আমার বাবার ঘাড় না, বাকিদের নাচ তখন থেমে গিয়েছে, আমি কানের কাছে শুনতে পেলাম, বসে পড়ুন। পিছন ফিরে দেখলাম, তিতির। ও আবার বলল, পড়ে যেতে পারেন।

আমার ডান দিকেই একটা ছোট টুল ছিল, আমি সেটাতে বসতে গেলাম, চন্দন সিং মেঝেতেই বসে পড়ল এবং শরীর নাচতে লাগল, সেই অবস্থাতেই তিতিরের মুখে আঁচল চাপা, চোখ চিকচিক করছে।

বাবার গলার স্বর শুনতে পেলাম, সমর।

ইয়েস স্যার।সমর জবাব দিল রেকর্ড প্লেয়ারের কাছ থেকে, এ হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান, শুনেছি বাবার অফিসে কাজ করে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে স্যার।’ বলেই সুইচ বোর্ডের কাছে গেল, ঘরের মাঝখানে বড় আলোর ঝাড়ে সব আলোগুলো জ্বলে উঠল, আর বাদবাকি সব আলোগুলো নিভে গেল। সমর ফিরে গেল রেকর্ড প্লেয়ারের দিকে, নতুন রেকর্ড চালাল–ক্যাবারে মিউজিক। ঘর ঠিক অন্ধকার না, সবাইকেই স্পষ্ট দেখা যায়। লায়লী সিং বাবার দিকে একবার তাকিয়ে নাচের ফ্লোরে চলে গেল, বাবা সোফায় বসলেন, চন্দন সিং বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়ল মেঝেয়, লায়লী সিং মিনি শাড়ি পরা, হঠাৎ দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে দিয়ে, ইয়ে মামা-শ্যামা প্রতিমার মতো ভঙ্গিতে দাঁড়াল, আর তখনই কৃষ্ণবাবু শাউট করলেন, অবসিন, অবসিন। হোয়াই দিস মিনি শাড়ি? ইট’জ অবসিন, শি শু্যড অ্যাপিয়ার উইদাউট দ্যাট আগলি পিস অব ক্লথ।

আশ্চর্য, উনি মিছিল থেকে এখানে কখন এসেছেন? এবং হঠাৎ এত উদারই বা হয়ে উঠলেন কেমন করে যে, লায়লীকে তিনি ভেনাসের মতো ইয়ে মানে নগ্ন দেখতে চাইছেন? অথচ সন্ধেবেলা তো অবসিন লিটারেচর অ্যান্ড আর্টের বিরুদ্ধে মিছিল পরিচালনা করেছেন। হঠাৎ মিঃ বি. বি. বি. বলে উঠলেন, ইমপসিবল, ল ডাজ নট অ্যাপ্রুভ নডিটি, হুইচ মে পারভার্ট অ্যান্ড কোরাপ্ট আনএক্সপার্ট কমন পিপল অ্যান্ড টিন-এজারস।

মিস্টার জগট বিশওয়াস বললেন, আমি কৃষ্ণ চৌধুরিকে সমর্থন করি।’

মিঃ কর বলে উঠলেন, কিন্তু আমি তা করতে দিতে পারি না, আমার একটা রেসপনসিবিলিটি আছে।

লায়লী সিং সেই ভঙ্গিতেই তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার গম্ভীর গলা শোনা গেল, এখানে কেউ কিছু না, যে যার জায়গায় বসো। সাম পিপল সেজ, ল ইজ অ্যান অ্যাস। সেটা ল এক্সপার্টসদের কার্যকলাপের জন্যই, বাট রিয়্যালি ল ইজ নট অ্যান অ্যাস। কিন্তু মানুষের জীবন আর ল, ইট’জ সামথিং ডিফারেন্ট। এনি হাউ, উই উইল সি লায়লী, দ্যাট শি ইজ বার্নিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ক্যারি অন লায়লী, স্টার্ট।

সমর মিউজিক থামিয়ে দিয়েছিল গোলমালের মধ্যে, আবার চালিয়ে দিল। লায়লী তার ক্যাবারে ড্যান্স অব ইন্ডিয়ান স্টাইল শুরু করল। আমি ভাবলাম, বাবা আমার বাবা লোকটা কে? হোয়াট হি ডাজ, হোয়াট ইজ হিজ বিজনেস? আমার মাথা যেন ঘুরছে, লায়লী ব্রোচ খুলল, আমি উঠলাম, দরজা ফাঁক করে বাইরে গেলাম, কাজের লোকেরা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে, সরে দাঁড়াল, আমি সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে বাইরে যাবার দরজার দিকে গেলাম। ছোট লন পেরিয়ে, গেট ক্রস করবার আগেই, তিতিরের গলা পিছনে শুনতে পেলাম, কোথায় যাচ্ছেন?

আমি না থেমেই বললাম, ঘুরে আসছি। হয়তো তিতির কিছু বলল, আমি শুনতে পেলাম না, এবং সেই দিন রাস্তায় রাস্তায় আমি কতক্ষণ ঘুরেছিলাম জানি না, যখন বাড়ি এসেছিলাম, তখন সব চুপচাপ অন্ধকার। নাথু আমাকে গেট খুলে দিয়েছিল, সন্তোষ আমাকে বাড়ির ভিতরে যাবার দরজা খুলে দিয়েছিল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, দোতলায় অন্ধকারে আমি তিতিরকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু দাঁড়াইনি, সোজা আমার ঘরের দিকে গিয়েছিলাম। তিতির আমার পিছনে পিছনে এসে, আমার ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে বলেছিল, টেবলে আপনার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। আমি তিতিরের দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ও ঘুমোয়নি, জামাকাপড় কিছুই বদলায়নি, বলেছিলাম, আলো অফ করে দাও, আমি শোব।’ তিতির তবু প্রায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল, তারপরে আলো অফ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল, আমি শুয়ে পড়েছিলাম।

নেক্সট মর্নিং-এ বেলা নটায় তিতির আমাকে সকালবেলার খাবার খেতে যাবার জন্য ডাকতে এসে বলেছিল, মেসোমশাইও আজ সকালে ওঁদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন।

কাদের?

 মিস্টার জগট বিশওয়াস, মিঃ চ্যাটার্জি, মিঃ চন্দন সিং, লায়লী সিং, মিসেস চ্যাটার্জি, মিস রঞ্জনা।

কোথায় ছিলেন এঁরা?

 এ বাড়িতে নীচের তলায়। মেসোমশাইও কাল রাত্রে নীচেই ছিলেন। খেতে আসুন।বলে তিতির দরজার কাছে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, এবিডি ওয়াজ ডায়িং ফর মেসোমশাই, সেই জন্য।’ বলে তিতির চলে গিয়েছিল, আমি ভাবছিলাম, তার মানে কী, কাল রাত্রে–?..

.

হ্যাঁ, ইয়ে, বাবা আর তিতির। পনেরো দিনের মধ্যে মানুষের জীবনে কোনও চেঞ্জ ঘটে কি না, আমি জানি না, কিন্তু আমার মধ্যে ঘটেছে, আর মনে হচ্ছে, সেটা খুব পজেটিভ। আমার মধ্যে যা ঘটেছে, তা–তা কী? তিতির। পজেটিভ, এবং সেটাকে সামথিং রং বলা যায় কি না, আমি জানি না। আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, ঠিক করেছি, কেন না, কোনও দিক থেকেই এ বাড়ি আমার বাসের জায়গা না। তা ছাড়া তিতিরা, তিতির এখন আমার কাছে এলে, আমি ইয়ে–আনিজি ফিল করি, আমি ওর কাছে আর আগের মতো থাকতে পারি না, কারণ, আমার মনের মধ্যে একটা পজেটিভ কিছু ঘটেছে, আর এটা ঘটার আগে আমি কিছুই জানতে পারিনি, অথচ আমি তিতিরের কিছুই জানি না। বিশেষ করে, বাবা আর তিতির কী সম্পর্ক দুজনের মধ্যে? মেসোমশাই এবং ইয়ে–শ্যালিকা কন্যা? সেবা? সেক্রেটারি? অলমোস্ট সবই হতে পারে। কিন্তু প্রায় আঠারো দিনের মধ্যে, সন্ধের গেস্টদের মুখে আমি বাবা আর তিতিরকে নিয়ে অনেক ইয়ে মানে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা শুনেছি। যা শুনে তিতির হেসেছে, বিদ্রূপ করে, অথবা এমনিই, দু-একবার অবিশ্যি ওকে ফ্রাউন করতে বা মুখ শক্ত করতে দেখেছি, এবং দু-একটা কঠিন কথাও বলতে শুনেছি, যা শুনে কমেন্টটররা অনেকেই থতিয়ে গিয়েছেন, অ্যাপলজি চেয়েছেন, কিন্তু তাতেই বা কী? বাবা আর তিতিরের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা দেখেছি, দুজনকে প্রায় বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে দেখেছি, যদিও কখনও রেসপেক্টের অভাব দেখিনি, স্নেহ বা আদরেরও না, তথাপি ইয়ে মানে, না পেইন–পেইন–তিতির একটা কষ্ট–আমার, যা একেবার নতুন ঘটনা আমার মধ্যে, এত কষ্ট, যে আমি তিতিরের দিকে ভাল করে তাকাতে পারছি না, নিজের এই কষ্টের জন্য, অপরাধ বোধ করছি। তিতির। ওহ, না না, মালভা না, মিস্টার জগট বিশওয়াস শুনলে হয়তো বলতেন, মাল পড়ে আমার মনে এ রকম ঘটেছে, বাবা আর ছেলে মারামারি–ওহ, না। আমি চলে যাব। শুধু এই একটি কারণেই না, আমার সমস্ত জীবনটার জন্যই।

তিতির এক দিন বলেছিল, ও নাকি হিসাব করে দেখেছে, এ বাড়িতে প্রতি সন্ধে ও রাত্রে নরমালি তিনশো-চারশো টাকা খরচ হয়ে থাকে, বিশেষ উৎসব থাকলে, মিনিমাম হাজার। আমি? আমি কী করছি এখানে, অ্যান একসপেন্স অব হোয়াট? পু–পু-পুত্র? পুত্রের খরচ? বয়স কত? শরীর সুস্থ? দেন? সবই কেমন যেন পজেটিভ হয়ে উঠছে–পজেটিভ আর তিতির তার কারণ। তিতির তিতিরের এক একটা কথা, তিতিরের প্রতিটি বিহেবিয়ার তার কারণ। এ সপ্তাহের মাঝামাঝিও আমি তিতিরের সঙ্গে বাইরে গিয়েছি, ঘুরেছি, বেড়িয়েছি, খেয়েছি, একটা কি দুটো ফিলম শোও দেখেছি, কিন্তু সব সময়ে যেন একটা ছায়া ঘুরছে। সেটা হয়তো আমার মনে, আমার মস্তিষ্কের মধ্যে, কিন্তু ঘুরছে, যা আমি টলারেট করতে পারছিলাম না, এবং আর বাইরে যাইনি। তিতির আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে, চুপচাপ, অনেকক্ষণ, ওর সেই চোখে, এবং হঠাৎ জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে? আমি জবাব দিচ্ছি, কিছু না। তথাপি তিতির তাকিয়ে থাকছে, হয়তো বা হঠাৎ ওর চোখে বা ঠোঁটে একটু হাসি ফুটছে, আবার ইনস্ট্যান্ট গম্ভীর, আর চোখে সেই, সেই কিছু খোঁজার মতো দৃষ্টি। ও জানে না, আমার কষ্ট হয়, ও আমার কষ্ট, আর তার জন্য কী রকম অপরাধ বোধ করি, যা ওকে আমি বলতে পারি না। আমি কেন এখানে আছি?

তিতির আমার দরজায় এসে দাঁড়াল। রোদ এখন কোন দিকে? ওর বাঁ দিকের গাল, খোলা চুল, কাঁধ কাটা সাদা জামার ওপরে হলুদ আঁচল লাল দেখাচ্ছে। তা হলে বিকাল, ও সেজেছে, খোলা চুলটাও কখনও কখনও সাজ।

চা খেয়েছেন? তিতির ঘরের মধ্যে এল।

 খেয়েছি। আমি ভারতীয় আধুনিক ইতিহাসের পাতা মেলে ধরলাম।

তিতির আমার সামনে, খুব সামনে এসে দাঁড়াল, বইয়ের পাতার ওপরে ওর হাত উলটে মেলে ধরল, আমি ওর দিকে তাকালাম। ও বইটা টেনে, টেবলের ওপর সরিয়ে দিল, বলল, এর চেয়ে মুখ খোলা ভাল৷ ওর সেই চোখের দৃষ্টির মধ্যে কেমন একটা ফার্মনেস। সেটা এখন আমার মধ্যেও আছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললাম, মুখ খোলার মতো কিছু নেই, ভাবছি চলে যাব।

কোথায়?

যেখানেই থোক, কোথাও।

কেন?

সন্তোষের জীবনও আমার থেকে ভাল, কাজ করে, খায় আর–আর—

 প্রেম করে।’ তিতির হাসল, কাপে চামচের ঠুং ঠুং শব্দ বাজল, বলল, কিন্তু মহাদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো বাবা ওর নেই।’

তাতে কী? মানুষকে কিছু করতেই হয়।

 এ চিন্তা খুব ভাল। জানতে পারি, রিয়্যালাইজেশনটা হঠাৎ কবে হল?

অনেক সময় হঠাৎ হয়।

তিতির কয়েক সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, ওর ঠোঁটের কোণে যেন একটু হাসি চিকচিক করছ, নিচু স্বরে বলল, য়ু আর জেলাস।

জেলাস?

 তিতির একটু ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, অব মোর ফাদার।

আমি জানি না, কেমন করে আমার হাত উঠল, আর শার্পলি হিট করল তিতিরের গালে। তিতির যেন পাথরের মূর্তি, একটু মুভ করল না, হাত তুলল না, ঠিক যেমন মুখ ছিল, তেমনিই, কেবল চোখ দুটো যেন কেমন স্পার্ক করল, আর ঠোঁটের কষে চোঁয়ানো রক্তের বিন্দু। কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই ও চলে গেল ঘর থেকে, এবং আমি এখন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি, কেবল একটা কষ্ট আর রাগ নিজের ওপর, ঘৃণা আর রাগ, আর একটা কষ্ট, ওহ! হোয়াট হ্যাভ আই ডান? পরাজিত অপরাধী কিন্তু জেলাস? কিন্তু এ হাত, ডার্টি ফিলদি হাতটা নিয়ে আমি কী করব? ওহ, দিল্লির কনট সার্কাসের ঘটনার থেকেও এটা বীভৎস! তিতির… তিতির… তিতির… তিতির…ফ্রিজ আমি।…কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে, একটি আলো জ্বলল, শেডে ঘোড়া ছুটছে। তিতির দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়েই যেন চমকে উঠল, কেন, আমি তা জানি না, তারপর আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এল, কাছে এল, আমার সেই–সেই কুৎসিত হাতটাই দু হাতে ধরল, তুলে ওর সেই–সেই গালে চেপে ধরল, আর আমার দিকে তাকাল, চোখ দুটো যেন জলের মধ্যে পাথর টলটল করছে, শুধু বলল, বুঝেছি। বলা মাত্রই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, আর আমার নিশ্বাস-বন্ধ বুকে তিতিরের মুখ। কোনও ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি না, দেওয়ালে টাঙানো ঝরনার ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। তিতিরের নিশ্বাসের আগুনে আমার জমে যাওয়া নিশ্বাস আবার পড়ছে। তিতির আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, বসুন।আমি বসলাম, ও বলল, যাবার আগে আমাকে ডাকবেন।’ যেন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা বলল, আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও চোখমুখ মুছে, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করবেন, ভাবছেন?

ইয়ে’–আমি হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠে বললাম, তিতিরের হাত ধরে, আমার সামনে টেনে নিলাম, আমার গলা কঁপছে না, কিন্তু যেন কেমন একরকম শোনাচ্ছে, আমার লিখতে ইচ্ছা করছে। মর্ডান হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড মোটামুটি পড়েছি, আর আমি যা দেখেছি, আমার সে সব এক্সপিরিয়েন্স লিখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কেন লিখব, আমি এখনও তা জানি না।’

তিতির বলল, হয়তো জীবনকে আপনি একটু নতুন শেপ দিতে চান।

আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, ওহ নো, না না, তা না, আমি ও রকমভাবে ভাবতে পারি না, কিন্তু আমি কিছু বলতে চাই–আমার–আমাদের কথা, এবং আমাদের–এ বাড়ি না, আমাদের মধ্যে, এই ওয়ার্লডে আমি কেন বেঁচে আছি, আর সত্যি বলতে কী, কেন বেঁচে থাকতে চাই। আমি বোধ হয় উপন্যাসের রূপ দিতে চাই, কিন্তু আমার লেখবার কোনও ল্যাঙ্গুয়েজ জানা নেই।

তিতির বলল, আপনার যা জানা আছে, সে ভাবেই লিখবেন, চিরদিনের ল্যাঙ্গুয়েজ বলে, কী আছে?

কিন্তু আমি তিতিরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে, লাইটের শেডের দিকে এক বার তাকালাম, আবার ফিরে বললাম, কিন্তু সব লিখতে গেলে ইয়ে–আমার জীবনের যা অভিজ্ঞতা, ফিলিংস, তা এমনই ক্রুয়েল,শকিং আর এমন নেকেড অ্যান্ড ফিউরিয়াস, যা আমি অসংকোচে লিখতে চাই–প্লিজ তিতির, আমি বক্তৃতা করছি না তো? শোনো, সবাই আমাকে ইয়ে মানে আমার লেখা–অবসিন হয়ে গেলে?

আপনি কেন সে কথা ভাবলেন। আপনি আপনার কাজে বিশ্বস্ত থাকবেন। কে যেন বলেছিলেন, সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়?

নামটা মনে করতে পারছি না। আমি তিতিরের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম, ওর সেই চোখের দিকে তাকালাম। তিতির। আমার কষ্ট আমার–আমার, ওহ, না, চোখে যেন জল না আসে, আমার সহযাত্রী। বললাম, বাবাকে বলে আসি।

তিতির জিজ্ঞেস করল, কেন?

বলেই আবার সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ বলা উচিত। কৃতজ্ঞতা ছাড়াও, উনি আপনাকে ভালবাসেন। চলুন আমিও যাচ্ছি।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে, পিছন ফিরে দেখলাম, তিতির আসছে। আমি সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আবার পিছন ফিরে দেখলাম, তিতির আসছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম, নীচে, ডাইনে বাবার ঘর। তিতির নেমে এল।