ল্যাটে

‘ল্যাটে’

রদাঁগৎ কাকে বলে জানো?

একরকমের ফরাসি কোট। প্রায় ফ্ৰককোটের কাছাকাছি। এর বেশি কিছু জানি নে, কখনও দেখিনি।

শব্দটা– রাদার, সমাসটা– কোত্থেকে এসেছে?

আমার ইংরেজ বন্ধু সিরিল বেশভূষা বাবদে পয়লা নম্বরি, কিন্তু শব্দ, ভাষা এসব বাবদে তাঁর অণুমাত্র ইনট্রেসটু নেই। তাই একটু উৎসাহ দেখিয়ে বললুম, কোত্থেকে?

চেনবার জোটি নেই। ইংরেজি রাইডিং কোটের এই হল ফরাসি উচ্চারণ। শুধু তাই নয়, এতে আরও মজা। সেই রাগৎ যখন ফের বিলেতে এল তখন তার ইংরেজি উচ্চারণ হয়ে গেল রেডিংগট এবং ফ্রান্সে নবজন্মপ্রাপ্ত এ পোশাক এদেশে আবার এক নবজন্ম লাভ করে হয়ে গেল মেয়েদের পোশাক– পুরুষ আর এটি এদেশে পরে না, অন্তত এ নামে পরিচিত পোশাকটি পরে না। কিন্তু রাগৎ এখনও ফ্রান্সের ভারিক্কি পোশাক। তোমারও তো বয়স হতে চলল, আর যাচ্ছও ফ্রান্সে–

আমি বললুম, থাক, আমার সাদামাটা লাউনজ স্যুটেই চলবে।

***

ফ্রান্সের একটি জায়গা দেখার আমার অনেককালের বাসনা।

বহু বছর পূর্বে আমরা একবার মার্সেলস বন্দরে নামি। সঙ্গে ছিলেন দেশনেতা স্বর্গত আনন্দমোহন বসুর পুত্র ড, অজিত বসু ও তাঁর স্ত্রী শ্রদ্ধেয়া মায়া দেবী।

বড়ই দুঃখের বিষয় এই গুণী, জ্ঞানী কর্মবীর অজিত বসু সম্বন্ধে কেউ কিছু লেখেননি। আসলে ইনি চিকিৎসক ছিলেন কিন্তু তার জ্ঞানসাম্রাজ্য যে কী বিরাট বিস্তীর্ণ ছিল সেটা আমি আমার অতি সীমিত জ্ঞানের শিকল দিয়ে জরিপ করে উঠতে পারিনি।

তার কথা আরেকদিন হবে।

তখনকার মতো আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জিনিভা যাওয়া। কিন্তু খবর নিয়ে জানলুম, সন্ধ্যার আগে তার জন্য কোনও থ্রু ট্রেন নেই।

গোটা মধ্য এবং পশ্চিম ইয়োরোপ তিনি চিনতেন খুব ভালো করে। এবং বিখ্যাত শহর হলেই তিনি ইয়োরোপের ইতিহাসে সে শহর কী গুরুত্ব ধরে ধাপে ধাপে বলে যেতে পারতেন, কারণ তার মতো পুস্তক কীট আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।

বললেন, তার আর কী হয়েছে! চলুন, ততক্ষণে অ্যাকস্ হয়ে আসি। মাইল আঠারো পথ।

 আমি বললুম, সে কী? অ্যাকস-লে-ব্যাঁ তো অনেক দূরে।

 তিনি হেসে বললেন, আমার জানা মতে তিনটে অ্যা আছে। উপস্থিত যেটাতে যেতে চাইছি সেটা আগা খানের প্যারা জায়গা অ্যাক্স-লে-ব্যাঁ নয়– এটার পুরোনাম অ্যাকস–আঁ-প্রভাঁস!

আমি বললুম, প্রভাঁস? তা হলে এ জায়গাতেই তো আমার প্রিয় লেখক আলস দোদে তার লেটারজ ফ্রম মাই মিল লিখেছিলেন, এখানকারই তো কবি মিস্ত্রাল যিনি নোবেল প্রাইজ পান–

ড. বোস বললেন, পূর্ব বাঙলার যে লোকসাহিত্য আছে সেটা প্রভাঁসের আপন ফরাসি উপভাষায় রচিত সাহিত্যের চেয়ে কিছু কম মূল্যবান নয়। অথচ দেখুন, মিস্ত্রাল যে-রকম একটা উপভাষা– একটা ডায়লেকটে, অবশ্য আজ এটাকে ডায়লেকট বলছি–কাব্য রচনা করে বিশ্ববিখ্যাত হলেন, নোবেল প্রাইজ পেলেন, ঠিক তেমনি পুব বাঙলায় কেউ সেই ভাষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, গর্ব অনুভব করে, মিসূত্রালেরই মতো পরিশ্রম স্বীকার করে, সেটিকে আপন সাধনার ধন বলে মেনে নিয়ে নতুন সৃষ্টি নির্মাণ করে না কেন? জানেন, আমি বাঙাল?

ইতোমধ্যে যান এসে গেছে।

এদেশের বর্ণনা আমি কী দেব? অ্যাও নাকি দু হাজার বছরের পুরনো শহর। কই, মেয়েগুলোকে দেখে তো অত পুরনো বলে মনে হল না! তা হলে বলতে হয়, শহরটা দু হাজার বছরের নতুন।

পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে ভাবছিলুম, এই তো কাছেই তারাসক শহর যাকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন দোদে তার তারতারা দ্য তারাসকঁ লিখে।(১) তারই পাশে ছোট্ট জায়গাটি– মাইয়ান (জানি নে, প্রভাঁসলে তার উচ্চারণ কী) যেখানে কবি মিস্ত্রাল তার সমস্ত জীবন কাটালেন। তারই মাইল সাতেক দূরে বাস করতেন দোদে– ভিয়েই গ্রামের কাছে। কবি মিত্রালের বর্ণনা লিখে একাধিক ফরাসি লেখক নিজেদের ধন্য মেনেছেন। কিন্তু অপূর্ব দোদের বর্ণনাটি –এক রোববারের ভোরে ঘুম থেকেই উঠে দেখেন, বৃষ্টি আর বৃষ্টি, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। গোটা পৃথিবীটা গুমড়ো মুখ করে আছে। সমস্ত দিনটা কাটাতে হবে একঘেয়েমিতে। হঠাৎ বলে উঠলেন, কেন, তিন লিগ আর কতখানি রাস্তা? সেখানে থাকেন কবির কবি মিস্ত্রাল। গেলেই হয়।

কিন্তু দোদে যেভাবে (তাঁর লেয়-এ Letters de mon Moulin-এর ইংরেজি অনুবাদ কতবার কত লোক যে করেছেন তার হিসাব নেই, পাঠক অনায়াসে পুরনো বইয়ের দোকানে মূল অনুবাদ জোগাড় করতে পারবেন)(২) সেই জলঝড় ভেঙে পয়দল মিস্ত্রালের গায়ে গিয়ে পৌঁছলেন তার বর্ণনা আমি দেব কী করে? দোরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে পেলেন কবি উঁচু গলায় কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন– কী করা যায়? নিরুপায় ঢুকতেই হবে–

মিস্ত্রাল যেন লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে পড়লেন–অ্যাঁ! তুই এসেছিস! আর ঠিক আজকেই। কী করে তোর মাথায় সুবুদ্ধিটা খেলল, বল দিকিনি।

তার পর কী হল? বলব না।

শুধু একটি কথার উল্লেখ করি।

খানিকক্ষণ পরে গির্জা থেকে ফিরে এলেন মিস্ত্রালের মা। বুড়ি বড়ই সরলা, রান্নাতে পাকা, কিন্তু হায়, প্রভাসাল ছাড়া কোনও ভাষা বলতে পারেন না। তাই কোনও ফরাসি (যেমন প্রভাঁসের লোক ফরাসি নয়!) ছেলের সঙ্গে খেতে বসলে তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতেন না কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তিনি রান্নাঘরে না থাকলে তো রসুইয়ের নিখুঁত তদারকি হবে না।

আরেকটি কথা। মিস্ত্রালের শোবারঘরটি ছিল বড়ই ন্যাড়া। ফরাসি একাডেমি যখন মিস্ত্রালকে তিন হাজার ফ্রাঙ্ক উপহার দিল, তখন বুড়ি চাইলেন ঘরটিকে একটু ভদ্রস্থ করতে।

না, না, সে হয় না–বললেন মিস্ত্রাল– এ যে কবিদের কড়ি; এটা ছুঁতে নেই। ঘরটি ন্যাড়াই থেকে গেল। দোদে বলেছেন, কিন্তু যতদিন ওই কবিদের কড়ি ফুরোয়নি, ততদিন কেউ তাঁর বাড়ি থেকে রিক্ত হস্তে ফিরে যায়নি!

বৃষ্টি হচ্ছিল না? না, আমি স্বপ্ন দেখছিলুম।

 তবে কি আমি ডা. বসুর সঙ্গে বসে? না, সে-ও স্বপ্ন।

 আমি এসেছি মিত্রালের গ্রামে, বহু বছর পরে, সেই রঁদাগৎ পরে।

আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। শুধু একটি দুঃখ রয়ে গেল। যাকে এখানে আসার খবরটি পিকচার পোস্টকার্ডে জানালে খুশি হতেন, তিনি এখন এমন জায়গায় যেখানে এখনও ডাক যায় না।

———–

১. বছর চার পূর্বে বোধহয় খগেন দে সরকার এর অনুবাদ দেশ-এ প্রকাশ করেন।

 ২. এ লেখক দোদের একটি লেখা সম্প্রতি অনুবাদ করেছে। দু-হারা গ্রন্থ পশ্য। কিন্তু আমার অনুবাদ থেকে মূল যাচাই করতে যাবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *