লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ
এই বাসায় সন্ধেবেলা সবাইকে লেখাপড়া করতে হয় (কিংবা লেখাপড়া করার ভান করতে হয়)। সেটা শেষ হবার পর সবাই দাদির ঘরে একত্র হয়ে মহা হট্টগোল শুরু করে। তবে ছুটির দিনগুলি অন্য রকম, সেদিন হট্টগোল ভোরবেলা থেকে শুরু হয়ে যায়। বাসার বড় মানুষেরা সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকে বলে ছুটির দিন ভোরবেলাতেই দাদি (কিংবা নানির) কাছে চলে আসে। সাধারণত একসাথে নাস্তা করার সাথে সাথে গল্পগুজব করে। দাদি কিংবা নানি তার ছেলেমেয়ে আর তাদের বউ-জামাইয়ের খোঁজখবর নেন। কিন্তু নাতি-নাতনিরা সাধারণত এমন তাণ্ডব শুরু করে যে কথা বলা রীতিমতো কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আজকেও ঠিক তা-ই ঘটেছে। দাদি (কিংবা নানির) বড় ছেলে, বাচ্চাদের বড় চাচা তার অফিসের খুবই একটা জটিল পরিস্থিতির কথা সবাইকে বলছেন, দাদি চোখ বড় বড় করে শুনছেন ঠিক তখন একটা গগনবিদারী চিৎকার শোনা গেল। বাচ্চাদের একজন তার পেট চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাইরের যে কেউ হলে ভয়ে আঁতকে উঠত, এই বাসার কেউ আঁতকে উঠল না, মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েও দেখল না। যে পেটে চেপে ধরে চিৎকার করছিল হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে লাফ দিয়ে উঠে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে ছুটতে লাগল এবং বেশ কয়েকজন তাকে ধরার জন্য তার পিছু পিছু ছুটতে লাগল। হট্টগোল যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন বড় চাচা একটা ধমক দিয়ে বললেন, “এই তোরা চুপ করবি? তোদের জ্বালায় শান্তিমতো একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারি না।”
কয়েক সেকেন্ডের জন্য হট্টগোল কমে সেটা আবার নূতন করে শুরু হলো। বড় চাচা আবার বললেন, “চুপ করবি? তোরা চুপ করবি?”
একজন বলল, “আমরা তো চুপ করেই আছি। আমরা কি কথা বলছি?”
আরেকজন বলল, “আসলে তোমরাই তো কথা বলছো!”
আরেকজন বলল, “তোমরা যখন কথা বলো আমরা তো কখনো তোমাদের চুপ করতে বলি না। বলি?”
দাদি যুক্তিতর্কের মাঝে গেলেন না, ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর না- হয় ঠ্যাং ভেঙে দিবো।”
ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে শুনে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। নিজদের মাঝে হুটোপুটি করতে করতে বলল, “আগে আমার ঠ্যাং—আগে আমার ঠ্যাং”
দাদি হংকার দিলেন, “চুপ। সবাই চুপ। চুপ না করলে–”
বাচ্চারা চুপ করল। খুবই আগ্রহ নিয়ে তারা অপেক্ষা করতে লাগল, চুপ না করলে দাদি কী করবেন সেটা শোনার জন্য দাদি কিছু বললেন না দেখে একজন জিজ্ঞেস করল, “চুপ না করলে কী করবে দাদি?”
“ঢং করবি না আমায় সাথে, বিদায় হ এখান থেকে।”
ঝুমু খালা ঠিক তখন এক কেতলি চা বানিয়ে আনছিল, সে ঠকাস করে কেতলিটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে মাথা নামিয়ে বলল, “না খালাম্মা, না। এরা মুখের কথায় ঠান্ডা হবে না। এদের অনেক সমস্যা।”
বাচ্চাদের একজন চোখ বড় বড় করে উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা ঝুমু খালা?”
“তোমাদের ঠিক করে মানুষ করা হয় নাই। এই বাসার কেউ পোলাপান মানুষ করা জানে না।”
ঝুমু খালার এত বড় অভিযোগের পরেও বড় মানুষেরা তার কাছ থেকে বাচ্চা মানুষ করার সঠিক পদ্ধতি কী সেটা জানতে চাইল না, কিন্তু বাচ্চারা বেশ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলো, জানতে চাইল, “ঝুমু খালা, পোলাপান কীভাবে মানুষ করতে হয়?”
“কথা না শুনলে ধইরা শক্ত পিটা দিতে হয়।”
“কিন্তু আমরা তো কথা শুনি।”
“খালি কান দিয়া কথা শুনো—কিন্তু সেই কথামতন কাম করো না। তোমাগো মুখ বন্ধ করতে বলছে, তোমরা মুখ বন্ধ করছো? করো নাই। বকরবকর কইরাই যাচ্ছ।”
একজন বলল, “বাকস্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে- ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে বলল, “রাখো তোমার বক স্বাধীনতা আর কাউয়া স্বাধীনতা, শক্ত পিটনা খাইলে কই যাইব বক আর কাউয়া—”
ঝুমু খালার কথা শুনে বাচ্চারা খুবই মজা পেল। তারা আনন্দে হি হি করে হেসে একজন আরেকজনের ওপর গড়াগড়ি খেল। তারপর একজন বলল, “তাহলে আমাদের কোনো দোষ নাই! আমাদের ঠিক করে মানুষ করল না কেন? আমরা কী না করেছিলাম?”
আবার একটা বিশাল হট্টগোল শুরু হলে তখন ছোটাচ্চু তার হাতের চামচ দিয়ে টেবিলে ঠক ঠক শব্দ করে বলল, “সাইলেন্ট। পিনড্রপ সাইলেন্স।”
ইংরেজিতে বলার জন্যই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক বাচ্চারা চুপ করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আচ্ছা তোদের মাঝে কি একটু আত্মসম্মানবোধ নাই? নিজের ওপর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নাই?”
একেবারে ভিন্ন লাইনের কথাবার্তা, তাই বাচ্চারা এবারে ছোটাচ্চুর কাছে এগিয়ে এলো। ছোটাচ্চু বলল, “বড় হওয়ার পর তোদের কী হবে? তোরা বড় হয়ে কী হবি? পরগাছা? নাকি উইপোকা?”
কয়দিন আগেই বাসায় নিচের তলায় হঠাৎ করে দলবেঁধে উইপোকা আক্রমণ করেছিল, তাই উইপোকার কথা সবারই মনে আছে এবং উইপোকার সাথে তুলনাটা তাদের কাছে খুবই অপমানজনক মনে হলো। শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি কী বলতে চাইছো?”
ছোটাচ্চু শান্ত থেকেও বেশি গুরুগম্ভীর স্বরে বলল, “আমি বলতে চাইছি যে তোরা নিজেরাও নিশ্চয়ই টের পাচ্ছিস যে এখন তোদের মুখ বন্ধ করে রেখে অন্যদের একটু কথাবার্তা বলতে দেওয়া দরকার। কিন্তু তোরা তোদের মুখ বন্ধ করতে পারিস না। তোদের সেই ক্ষমতা নাই—তোদের নিজের ওপর কন্ট্রোল নাই।”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “জিন-ভূতে ধরলে নিজের কন্ট্রোল থাকে না। তখন জিন-পড়া দিতে হয়।”
শান্ত ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “কথা বন্ধ করলে কী দিবে বলো?”
ছোটাচ্চু মুখ বাঁকা করে বলল, “কী দিবো? কিছু দিবো না। তোরা কি সন্ত্রাসী যে চাঁদা দিয়ে তোদের মুখ বন্ধ করতে হবে?”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু, আমরা ইচ্ছা করলেই আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারি।”
ছোটাচ্চু বলল, “মুখে না বলে করে দেখা।”
শান্ত বলল, “অবশ্যই দেখাতে পারি। একশ বার পারি।”
সবচেয়ে ছোট জন, মুনিয়া, তার রিনরিনে লায় বলল, “এই দেখো মুখ বন্ধ করলাম।” তারপর হাত দিয়ে দুই ঠোঁটকে জিপ লাগানোর মতো ভঙ্গি করে মুখ বন্ধ করল।
মুনিয়ার দেখাদেখি অন্যরাও মুখ বন্ধ করল এবং হঠাৎ করে ঘরে প্রথমবার একধরনের বিস্ময়কর নীরবতা নেমে এলো।
ছোটাচ্চু আবার তার প্যাটেন্ট করা বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তোদের আমার খুব চেনা আছে। কয় মিনিট মুখ বন্ধ করে থাকতে পারিস দেখা যাবে!”
যেহেতু কথা বলবে না বলে মুখ বন্ধ করেছে তাই তারা ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না কতক্ষণ মুখ বন্ধ করে থাকলে ছোটাচ্চু বিশ্বাস করবে যে তারা ইচ্ছা করলে চুপ করে থাকতে পারে।
শেষ পর্যন্ত একজন বুদ্ধি করে একটা বলপয়েন্ট কলম খুঁজে আনল। লেখার মতো কাগজ খুঁজে না পেয়ে টুম্পা তার হাতের ওপর লিখল, “কতক্ষণ?”
ছোটাচ্চু সেটা পড়ে হাসল, তারপর বলল, “তিরিশ সেকেন্ডও হয় নাই, এখনই জিজ্ঞেস করছিস কতক্ষণ?”
যেহেতু কথা বলা যাবে না তাই সবাই নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু মুখটা ষড়যন্ত্রীর মতো করে বলল, “কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা।”
বাচ্চারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মুখের ভিতর দিয়ে যে গগনবিদারী আর্তনাদ বের হয়ে যাচ্ছিল সেটা অনেক কষ্টে চেপে রেখে তারা মাথায় থাবা দিয়ে নিঃশব্দে উল্টে পড়ে গেল!
ছোটাচ্চু বাচ্চাদের অতি-অভিনয় না দেখার ভান করে বলে যেতে লাগল, “আসলে তোদের চব্বিশ ঘণ্টা মুখ বন্ধ করে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই! যদি ঠিক করে থাকিস তোদের মনের জোর লুডলসের মতো লুতলুতা নরম হলেই তোরা খুশি, তাহলে তোদের কথা বন্ধ করে থাকতে হবে কেন? কথা বলা শুরু করে দে! আর যদি তোরা মনে করিস তোদের নিজের ওপর বিশ্বাস আকাশের সমান, বুকের জোর বাঘের বাচ্চার মতো, তাহলে দেখা যাক তোরা চব্বিশ ঘণ্টা কথা না বলে থাকতে পারিস কি না! দেখা যাক তোরা উইপোকা নাকি হোমো স্যাপিয়েন!”
মুনিয়া প্রায় বলেই ফেলছিল, হোমো স্যাপিয়েন মানে কী? কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। কলম দিয়ে লিখে জিজ্ঞেস করা যায় কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন বানান করে লেখার সাহস করল না।
বাচ্চাদের দলটা কিছুক্ষণ মুখ বন্ধ করে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর নিঃশব্দে উঠে গেল।
ঝুমু খালা সেদিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “দেখছেন খালাম্মা, দেখছেন? পোলাপাইন যখন চিল্লাফাল্লা না করে তখন ঘরটার মাঝে কী রকম ঠান্ডা একটা ভাব? বেহেশতী একটা ভাব!”
দাদি মুচকি হেসে বললেন, “কয় মিনিট মুখ বন্ধ করে থাকে সেইটা দেখ! কথা না বললে এদের পেটের ভাত হজম হবে না।’
বাচ্চারা ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। শান্ত ফিসফিস করে বলল, “আমি চব্বিশ ঘণ্টা কথা না বলাবলির মাঝে নাই।”
টুনি মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না কিন্তু বুঝিয়ে দিলো সে ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে। তারপর গম্ভীরভাবে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারল না কিন্তু সবাই তার পিছু পিছু যেতে থাকে। টুনি শাহানাপুর ঘরে গিয়ে টোকা দিলো। ঘরের ভেতর থেকে ঘুম ঘুম গলায় শাহানাপু বলল, “কে?”
যেহেতু কথা বলা নিষেধ, তাই টুনি উত্তর না দিয়ে দরজা ফাঁক করে মাথা ঢোকাল। শাহানাপু বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে, এখনও বিছানা থেকে উঠে নাই। শাহানাপু অনেক রাত জেগে কাজ করে, তাই ছুটির দিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। টুনিকে দেখে ঘুম ঘুম চোখে কী একটা বলতে যাচ্ছিল তখন টুনির পিছনে পুরো দলকে নিঃশব্দে ঢুকতে দেখে তার ঘুম চটকে গেল। শাহানাপু উঠে বসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার? কী হয়েছে?”
কথা বলা নিষেধ বলে মুনিয়া দুই হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে পুরো ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করল, তার ফল হলো ভয়ানক, শাহানাপু আরো ভয় পেয়ে গেল, শুকনো গলায় বলল, “কী হলো? এ রকম করছিস কেন? কী হয়েছে?”
টুনি তখন তাড়াতাড়ি শাহানাপুর টেবিল থেকে একটা কলম আর কাগজ নিয়ে সেখানে লিখল, “কথা বলা নিষেধ।”
শাহানাপু সেই লেখা দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন?”
টুনি লিখল, “ছোটাচ্চু চ্যালেঞ্জ ২৪ ঘণ্টা।”
শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তোদের ২৪ ঘণ্টা কথা না বলার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে?”
এবারে সবাই জোরে জোরে মথা নাড়ল। শাহানাপু হাই তুলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল, বলল, “ভালোই তো! তোরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিস—তোরা মুখ বন্ধ করে বসে থাক। তোদের জন্য ভালো, বাসার সবার জন্য ভালো। পৃথিবীর জন্য ভালো।”
সবাই প্রবল বেগে না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মুখে কোনো কথা না বলে সবাই হাত-পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে, যেটা দেখে কিছুই বোঝার উপায় নাই। টুনি আবার কাগজে লিখল, “কী করব বলে দাও।”
অন্যরা তার নিচে লিখল, “প্লিজ প্লিজ…ইনফিনিটি প্লিজ।”
শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “তার মানে তোরা সত্যি সত্যি কথা না বলে চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতে চাস?”
বাচ্চারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল, তারপর সবাই হ্যাঁ-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। টুনি কাগজ লিখল, “কিন্তু—” তারপর থেমে গেল।
শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
টুনি খুব সূক্ষ্মভাবে একটু হাসল, তারপর কাগজে লিখল, “কিন্তু যেন আর কখনো কেউ চ্যালেঞ্জ না দেয় – “
শাহানাপু টুনির দিকে তাকাল, তারপর সেও সূক্ষ্মভাবে হাসল, বলল, “তার মানে তোরা কথা না বলে থাকবি কিন্তু সেই জন্য বড়রা যেন ঝামেলায় পড়ে যায়?”
টুনি মাথা নাড়ল। অন্যরা বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু টুনি যেহেতু মাথা নেড়েছে তাই তারাও মাথা নাড়ল। শাহানাপু তার সূক্ষ্ম হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তার মানে, তোরা কথা বলবি না, চুপ করে থাকবি কিন্তু তোদের রেগুলার ঘ্যানঘ্যান ঠিকই চালিয়ে যাবি?”
এবারে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল।
শাহানাপু এবার বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, “তোদের যেটা দরকার সেটা হচ্ছে ফ্ল্যাশ কার্ড।”
ফ্ল্যাশ কার্ড বলতে শাহানাপু কী বোঝাচ্ছে কেউ ঠিক করে বুঝতে পারল না। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। শাহানাপু বলল, “যখন কিছু বলতে চাস সেটা কাগজে লিখতে সময় লাগে। আবার হাতের লেখায় সমস্যা আছে, বানানে সমস্যা আছে। কাজেই যা যা বলা দরকার হতে পারে সেগুলো আগে থেকে ছোট ছোট কার্ডে লিখে রাখবি। তারপর কথা বলার দরকার হলে কার্ডটা বের করে চোখের সামনে নাড়বি। বুঝেছিস?”
সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল, এবারে তারা বুঝতে পেরেছে। শুধু তা-ই না, মানুষদের জ্বালাতন করার জন্য এটা যে একটা অসাধারণ অস্ত্র হতে পারে সেটাও তারা টের পেয়ে গেল। কাজেই সবাই মহা উৎসাহে কাজ শুরু করে দিলো। সবাই নানা রকম পুরানো কার্ড নিয়ে এলো, পুরানো কার্ড বোর্ডের বাক্স আনা হলো, বাসায় যত রকম আর্ট পেপারের টুকরা পাওয়া গেল, সেগুলো আনা হলো, তারপর মাপমতো কেটে সেখানে মার্কায় দিয়ে লেখা শুরু করল।
বাসায় সবচেয়ে ছোটজন তার যে কথাগুলো লেখার দরকার হতে পারে সেগুলো লিখল। কথাগুলো এ রকম : “আউ আউ আউ”, “ভ্যাঁ অ্যাঁ অ্যা অ্যা…”, “পেট ব্যথা করছে”, “কান কটকট করছে”, “চকলেট খেতে চাই”, “হি হি হি হি…”, তার মাঝে মুনিয়ার জন্য আরো একটা খুবই কঠিন লেখা লিখে দেওয়া হলো, সেটা হলো “ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ।”
টুম্পার কার্ডগুলোতে লেখা কথাগুলো এ রকম, “আমি এটা খেতে চাই না”, “ঝাল ঝাল অনেক বেশি ঝাল”, “না, আমি শাক খাব না”, “আমার ঘুম পায় নাই”…
শান্ত তার কার্ডে লিখল, “একটা দশ টাকার নোট হবে?”, “বললাম তো পারব না”, “ভালো হবে না কিন্তু”, “খবরদার ঝামেলা কোরো না”- এবং এ রকম আরো কিছু কথা।
পুরো ব্যাপারটা যেহেতু শুরু হয়েছে ছোটাচ্চুর কারণে তাই ছোটাচ্চুকে আলাদা করে জ্বালাতন করার জন্য বেশ কিছু ফ্ল্যাশিং কার্ড তৈরি হলো। সেগুলোর কথাগুলো হলো এ রকম, “আমার এই অঙ্কটা করে দেবে”, (ছোটাচ্চু অঙ্ককে খুব ভয় পায়, সেটা সবাই জানে), “মাকড়সা! মশারির ওপরে মাকড়সা!” (ছোটাচ্চু অঙ্ক থেকেও বেশি ভয় পায় মাকড়সাকে!), “ব্ল্যাক হোলের মাঝে লাল রং ঢেলে দিলে সেটা কি রেড হোল হবে?” (ছোটাচ্চু বিজ্ঞানের জিনিসপত্র দুই চোখে দেখতে পারে না।), “রোজারিও সভ্যতা নিয়ে একটু বলবে?” (রোজারিও সভ্যতা নামে কিছু নাই)। শুধু তাই না, ছোটাচ্চুকে জ্বালাতন করার জন্য তার কথার মাঝখানে মাঝখানে দেখানোর জন্য কিছু ফ্ল্যাশ কার্ড তৈরি হলো, সেখানে লেখা, “বুঝি নাই আবার বলো”, “কেন?”, “কীভাবে?”, “হতেই পারে না?” এ রকম আরো কিছু।
চব্বিশ ঘণ্টার কথা না বলার চ্যালেঞ্জ ঠিক করে পার করতে হলে যার সাহায্য সবচেয়ে বেশি দরকার, সেটা হচ্ছে ঝুমু খালা। তাই ঝুমু খালাকে নরম করে রাখার জন্য কয়েকটা ফ্ল্যাশ কার্ড তৈরি হলো। সেখানে লেখা, “তোমাকে আজকে খুব সুইট লাগছে”, “তোমার কিছু লাগবে? এনে দেবো?”, “তুমি এত মজা করে কেমন করে রাঁধো?”
“আমার খালা তোমার খালা ঝুমু খালা ঝুমু খালা” এবং এ রকম আরো কিছু কথা।
ফ্ল্যাশ কার্ড দিয়ে হয়তো সবকিছু কুলানো যাবে না, তাই সবাই নিজের সাথে একটা কলম আর কিছু কাগজ নিয়ে নিল। তারপর বের হলো তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য।
প্রথমে দেখা হলো ঝুমু খালার সাথে। পুরো দলটা একসাথে দেখেই ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে ঝংকার দিয়ে বলল, “এই যে এই যে, পুরা গুষ্টি একসাথে! গেছিলা কই? আমি কয়টা আলুর চপ বানাইছি কিন্তু খাওনের মানুষ নাই। কোনখানে গেছিলা, আমি খুঁইজা পাই না।“
মোটামুটি সবাই একসাথে হাত দিয়ে মুখ জিপ করে ফেলার ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিলো তারা কথা বলছে না।
ঝুমু খালা চোখ বড় বড় করে বলল, “কী কও? তোমরা কথা বন্ধ করছো?”
সবাই মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা বলল, “অনেক লাটক হইছে, এখন আইসা খাও, খায়া আমারে মুকতি দাও।”
আগে হলে তারা ঝুমু খালার অদ্ভুত উচ্চারণগুলো মাঝে মাঝে শুদ্ধ করে দিত, যেমন শব্দটা যে লাটক না, নাটক, সেটা বলে দিত। এখন আর সেটা করে না, কারণ তারা টের পেয়েছে ঝুমু খালা চাইলেই সুন্দর করে কথা বলতে পারে, ইচ্ছা করে বলে না। ঝুমু খালা সবসময় নিজের ভাষায় তেজিভাবে কথা বলে। আজকে অবশ্য বাচ্চারা কথা বন্ধ করেছে, তাই ইচ্ছা করলেও ঝুমু খালার ভুল উচ্চারণ শুদ্ধ করার উপায় নাই।
ঝুমু খালা চোখ পাকিয়ে আরেকটা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই টুনি তার ফ্ল্যাশ কার্ড বের করে ঝুমু খালার সামনে ধরল, সেখানে লেখা, “তোমাকে আজকে অনেক সুইট লাগছে।”
ঝুমু খালা রাগের ভঙ্গি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এই কার্ডের লেখা পড়ে ফিক করে হেসে দিলো। তারপর বলল, “বানরামিতে তোমাগো সমান কেউ নাই। গোল্ড মেডেল সিলভার মেডেল একলগে।”
সবার হাতেই বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাশ কার্ড। ঝুমু খালা সেগুলো দেখল, তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “সবকিছু নিয়া তোমাগে টেংরামি। এখন তো মনে লয় তোমরা ক্যাচম্যাচ করলেই ভালো ছিল। জবান বন্ধ কইরা যদি এই কার্ড নাইড়া নাইড়া সারা দিন সবাইরে জ্বালাও তাহলে তো সইন্ধ্যার আগেই সবাই পাগল হইয়া যাইব!”
সবাই দাঁত বের করে হাসল, তারপর বুঝিয়ে দিলো সেইটাই উদ্দেশ্য। তাদেরকে কোনো কিছু নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে পাল্টা চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।
ঝুমু খালার পিছন পিছন সবাই ডাইনিং রুমে গেল। বড়রা কেউ নেই, নাস্তা করে দাদি (কিংবা নানির) সাথে কথাবার্তা বলে সবাই চলে গেছে। ঝুমু খালা টানা কথা বলতে বলতে টেবিলে গরম গরম চপ এবং মিষ্টি পায়েশ রাখল। কথাবার্তার বিষয়বস্তু এখন একেবারে উল্টো দিকে, এই বাড়িতে এতগুলো বড় বড় মানুষ, তাদের কেউই এই ছোট মাসুম বাচ্চাগুলোর দিকে নজর দেয় না। টুনি তখন তার খালি কাগজে লিখল, “তুমি খালি দেখতে সুইট না, তুমি মানুষটাই সুইট।” অন্যেরা নিচে লিখল, “সুইটের ওপরে সুইট। সুপার সুইট।” টুম্পা খুঁজে খুঁজে ফ্ল্যাশ কার্ডটা বের করল, যেখানে লেখা, “আমার খালা তোমার খালা ঝুমু খালা ঝুমু খালা”, তারপর সেটা মাথার ওপর তুলে নাড়াতে লাগল।
ঝুমু খালার পর তাদের দেখা হলো দাদি (কিংবা নানির) সাথে। দাদির অফিস যেতে হয় না, স্কুলেও যেতে হয় না, তাই প্রত্যেক দিনই তার ছুটির দিন কিন্তু তারপরও সবার যেদিন ছুটি সেদিন দাদি (কিংবা নানি) আলাদাভাবে কিছু কাজ করেন। আজকে মনে হয় তার পুরানো কাগজপত্র গোছানোর দিন। ড্রয়ার থেকে এক গাদা কাগজপত্র, খাম, চিঠিপত্র বিছানায় ঢেলেছেন, তারপর সেখান থেকে কোনো কোনোটা তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে সেটা পড়ে দেখছেন। বাচ্চাদের একসাথে ঢুকতে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন, বললেন, “এই, আয় তো—এই খামটার ওপর কার ঠিকানা লেখা পড়ে দেখ তো—এত ছোট করে লিখেছে, পড়তেই পারছি না।”
বাচ্চারা রোবটের মতো তার বিছানার কাছে গিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে তারা কথা বলছে না। দাদি ঠিক বুঝতে পারলেন না, ভাবলেন, বাচ্চারা তার সাথে কোনো একটা মজা করছে। বললেন, “ঢং করতে হবে না—পড় ঠিকানাটা।”
টুনি তখন বাধ্য হয়ে তার কাগজে লিখল, “আমরা কথা বলা বন্ধ করেছি।”
দাদির তখন মনে পড়ল সকালে কথা না বলা নিয়ে ছোটাচ্চু তাদের একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। দাদি সেটাকে মোটেও গুরুত্ব দিলেন না, বললেন, “হয়েছে হয়েছে, অনেক হয়েছে। এখন এটা পড়ে দে। কী লেখা?”
বাচ্চারা কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। তারা কথা বলবে না। দাদি তখন ভুরু কুঁচকে বললেন, “কতক্ষণ কথা না বলে থাকবি?”
শান্ত এগিয়ে গিয়ে টুনির কাগজে বড় করে লিখল, “২৪ ঘন্টা।”
দাদি সেটা দেখে বললেন, “ঘণ্টা বানান ভুল। মূর্ধন্য হবে।”
তারা যখন কথা না বলে থাকার একটা জটিল চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তখন ছোটখাটো বানান নিয়ে শান্তর মাথা ঘামানোর মুড নাই, কিন্তু দাদি ছাড়লেন না। ছোট একটা লেকচার দিলেন, “ট, ঠ, ড, ঢ এবং মূর্ধন্য। তার মানে ট বর্গের অক্ষরের সাথে সবসময় মূর্ধন্য হয়। বুঝেছিস?”
শান্তর বোঝার ইচ্ছা নাই কিন্তু এখন না বুঝে উপায় নাই, তাই সে মাথা নাড়ল।
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “ঠিক আছে, তোরা চব্বিশ ঘণ্টা কথা না বলে থাকতে চাইছিস খুব ভালো কথা। কিন্তু প্রথমবারেই পুরো চব্বিশ ঘণ্টার কোনো দরকার নাই। দুই-এক ঘণ্টা থাকলেই হবে।” এখন কথা বলে ফেল।
বাচ্চারা খুবই গম্ভীরভাবে না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। মুনিয়া হাত নেড়ে এবং মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে তাদের ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ থেকে পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। দাদি অবশ্য মুনিয়ার অঙ্গভঙ্গি দেখে কিছুই বুঝলেন না, হাঁ করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুনিয়া তখন তার একটা ফ্ল্যাশ কার্ড দেখানোর চেষ্টা করল, ভুল করে যেটা দেখাল সেখানে লেখা, “আমার পেট ব্যথা করছে।“
দেখে দাদি আঁতকে উঠলেন, বললেন, “পেট ব্যথা করছে?”
সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল, তারপর মুনিয়ার ফ্ল্যাশ কার্ড থেকে ঠিক ফ্ল্যাশ কার্ডটা বের করে দিলো, মুনিয়া সেটা নানি (কিংবা দাদির) সামনে নাড়তে লাগল। নানি হাত দিয়ে নাড়ানো থামিয়ে পড়লেন, “ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ”! তারপর হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, “এই শাহরিয়ারটাকে নিয়েই সব ঝামেলা। যা দেখি—ডেকে আন তো পাজিটাকে।”
টুনি তখন ছোটাচ্চুকে ডাকতে গেল। ছোটাচ্চু তার ঘরে টেবিলের ওপর পা তুলে কী একটা বই পড়ছিল। টুনিকে দেখে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কী রে টুনি! কী অবস্থা?”
টুনি কোনো কথা না বলে তার হাতের কাগজে লিখল, “তোমাকে দাদি ডাকছে।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “আমাকে? আমাকে কেন?”
টুনি হাত দিয়ে কিল মারার ভঙ্গি করল, মুখের কথায় সেটা অনুবাদ করলে হয়তো শোনাত, “দাদি তোমাকে বানাবে!”
ছোটাচ্চু বইটা বগলে নিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে দাদি (কিংবা নানির) ঘরে রওনা দিলো। টুনি তার পিছু পিছু গেল।
দাদি ছোটাচ্চুকে দেখেই গলা উঁচিয়ে বললেন, “তুই কী শুরু করেছিস শাহরিয়ার?”
ছোটাচ্চু বলল, “কেন মা? কী হয়েছে?”
“এই বাচ্চাকাচ্চাদের কী বলেছিস? সব মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে?”
“আমি? আমি কী বললাম?”
“এরা কেউ কোনো কথা বলছে না! চব্বিশ ঘণ্টা নাকি কথা না বলে থাকবে! চব্বিশ ঘণ্টা এদের মুখ বন্ধ করে রাখবি—এটা কী রকম কথা?”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “আমি? আমি কেমন করে এদের মুখ বন্ধ করে রাখব! তাদের ইচ্ছা, কথা বলবে নাকি মুখ বন্ধ রাখবে। আমি কি জোর করছি নাকি?”
দাদি (কিংবা নানি) মাথা নেড়ে বললেন, “সবসময় কী আর গায়ের জোর দিতে হয়? মুখের কথা দিয়েও জোর করা যায়-“
ছোটাচ্চু তার বিখ্যাত বাঁকা হাসিটা দিয়ে বলল, “এখনও এক ঘণ্টা পার হয়েছে কি না সন্দেহ, তার মাঝে এরা তোমার কাছে নালিশ নিয়ে এসেছে—”
ছোটাচ্চু কথা শেষ করার আগেই বাচ্চারা প্রবল বেগে মাথা নাড়ল। বুঝিয়ে দিলো তারা মোটেও নালিশ আনে নাই। মুনিয়া এবারে ঠিক ফ্ল্যাশ কার্ডটা খুঁজে বের করে সেটা ছোটাচ্চুর নাকের সামনে নাড়তে থাকে। ছোটাচ্চু দেখল সেখানে লেখা, “ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ!”
ছোটাচ্চু বলল, “খুব ভালো কথা! তোরা তোদের লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে থাক।” কথা শেষ করে ছোটাচ্চু একবার বাচ্চাদের দিকে তাকাল, তারপর আবার তার বাঁকা হাসিটা দিলো।
দাদি (কিংবা নানি) এত আলোচনার মাঝে গেলেন না, ছোটাচ্চুকে বললেন, “খামখা ঝামেলা করিস না। বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে যা, বুঝিয়ে- সুঝিয়ে কথা বলিয়ে দে।”
ছোটাচ্চু বলল, “কী বলছো মা? এর আগে কোনোদিন এত শান্তিতে ছিল কখনো? কোনো শব্দ নাই, ক্যাচম্যাচ নাই, ঝামেলা নাই! শান্তিটা উপভোগ করো-“
দাদি ধমক দিয়ে বললেন, “আমার এত শান্তির দরকার নাই। নিয়ে যা বাচ্চাদের!”
কাজেই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ছোটাচ্চু নিজের ঘরে গেল। চেয়ারে বসে সবার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “এখনও এক ঘণ্টা হয় নাই, তার মাঝে সবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে?”
শান্ত লিখল, “এক ঘন্টা সাঁইত্রিশ মিনিট হয়েছে।” ঘণ্টা বানানটা আবার ভুল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা ধরতে পারল না।
“সবাই চ্যালেঞ্জে হার মেনেছিস?”
টুনি লিখল, “না, আমরা হার মানি নাই।”
“তাহলে এখানে এসেছিস কেন?”
টুনি লিখল, “তোমার সাথে কথা বলতে।”
“আমার সাথে কী নিয়ে কথা বলবি?”
টুনি লিখল, “নানা বিষয়।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “যে রকম?”
তখন টুম্পা তার একটা ফ্ল্যাশ কার্ড বের করে ছোটাচ্চুর নাকের সামনে নাড়তে লাগল, সেখানে লেখা, “রোজারিও সভ্যতা নিয়ে একটু বলবে?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকালেন, “সুমেরীয় সভ্যতার নাম শুনেছি কিন্তু রোজারিও সভ্যতা?”
টুম্পা জোরে জোরে তার ফ্ল্যাশ কার্ড নাড়তে থাকে, দেখে মনে হয় এক্ষনই না শুনলে তার কোনো একটা সর্বনাশ হয়ে যাবে। ছোটাচ্চু আমতা আমতা করে বলল, “মনে হয় রোমান সভ্যতার সাথে সম্পর্ক আছে, রোজ—মানে গোলাপ ফুলের কোনো ব্যাপার-স্যাপার।”
অন্যরা তখন, “কেন” লেখা ফ্ল্যাশ কার্ড ঝাঁকাতে লাগল।
ছোটাচ্চু অ্যা অ্যা করতে লাগল এবং রোজারিও সভ্যতা কত সাল থেকে শুরু হয়েছে সেটা নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করে কিন্তু যে বিষয়টা আসলে নেই সেটা নিয়ে কীভাবে আলোচনা করবে? তার মাঝে বাচ্চারা অন্য ফ্ল্যাশ কার্ড বের করে ঝাঁকাতে শুরু করেছে, যেখানে লেখা, “বুঝি নাই আবার বলো।” কেউ কেউ ফ্ল্যাশ কার্ড বের করেছে যেখানে লেখা, “হতেই পারে না”। ছোটাচ্চু তখন আরো থতমত খেয়ে যাচ্ছে।
শান্ত এর মাঝে তার অঙ্ক বইটা বের করে সেখান থেকে খুবই জটিল একটা অঙ্ক বের করেছে। অনেক শ্রমিক মিলে কাজ করছে, বাঁকা একটা বিল্ডিং সোজা করা নিয়ে অঙ্ক, যেটা করতে হলে অ্যালজেবরা, জ্যামিতি আর বর্গমূল একসাথে ব্যবহার করতে হয়। সেটা ছোটাচ্চুর হাতে ধরিয়ে তার ফ্ল্যাশ কার্ড নাড়তে শুরু করেছে, সেখানে লেখা, “আমার এই অঙ্কটা করে দেবে?”
ছোটাচ্চু অঙ্কের অর্ধেকটা পড়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। বলল, “এইটা আবার কী রকম অঙ্ক? ঘণ্টা বাজার অঙ্ক থাকলে দে, লসাগু করে উত্তর বের করে দেই।”
কিন্তু শান্ত মোটেই লসাগু করার অঙ্ক করতে চায় না—এটাই চায়, তাই এক হাতে অঙ্ক বই অন্য হাতে ফ্ল্যাশ কার্ড নিয়ে ছোটাচ্চুকে ঘিরে লাফাতে লাগল।
ছোটাচ্চু শান্তকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “এই অঙ্ক এখন করতে পারব না। বইটা রেখে যা—রাত্রে করে দিবো।”
শান্ত রাজি হলো না, ছোটাচ্চুর শার্ট ধরে টানাটানি করতে লাগল। যখন গোলমাল বেশ পাকিয়ে উঠেছে তখন আরেকজন ব্ল্যাক হোলের ফ্ল্যাশ কার্ড বের করে ঝাঁকাতে শুরু করেছে। যেখানে লেখা “ব্ল্যাক হোলের মাঝে লাল রং দিলে সেটা কী রেড হোল হবে?”
ফ্ল্যাশ কার্ডটা টানা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছিল, তাই কার্ডটা পড়তেই ছোটাচ্চুর একটু সময় লাগল। পড়া শেষ হতে মাথা চুলকে বলল, “ব্ল্যাক হোলে লাল রং দিবি? এত লাল রং পাবি কোথায়?”
বাচ্চারা তখন, “কেন”
“কীভাবে”
“বুঝি না”, “বুঝিয়ে দাও” কার্ডগুলো নিয়ে লাফাতে লাগল। ছোটাচ্চু বলল, “লাল রং দিলে তো রেড হোল হওয়ারই কথা—কিন্তু তাহলে তো অন্য রংও দেওয়া যাবে—কিন্তু কিন্তু—” বলে ছোটাচ্চু মাথা চুলকাতে লাগল।
পুরোপুরি নিঃশব্দে বাচ্চারা যখন মোটামুটি একটা বড় ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছে তখন হঠাৎ একজন মাকড়সার ফ্ল্যাশ কার্ডটা বের করল, সেখানে লেখা, “মাকড়সা! মশারির ওপর মাকড়সা!”
ফ্ল্যাশ কার্ডটা দেখেই ছোটাচ্চু একেবারে গগনবিদারী লাফ দিয়ে বিছানা থেকে এক লাফে নিচে নেমে ভয়ের চোটে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল! একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারত দিনদুপুরে এই ঘরে মাকড়সা চলে আসবে এবং সেটা যে ঠিক মশারির ওপর থাকবে সেটা বাচ্চাদের আগে থেকে জানা সম্ভব না—যে তার জন্য একটা ফ্ল্যাশ কার্ড তৈরি করে রাখবে। বাচ্চারা ছোটাচ্চুর গগনবিদারী চিৎকার এবং লাফ দেখে হেসে কুটি কুটি হলো। সেই পুরোপুরি নিঃশব্দ হাসি দেখে ছোটাচ্চু ভয়ানক রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “আমার সাথে তামাশা? বের হ। সবগুলি ঘর থেকে বের হ! আর যদি আমার কাছে আসিস বারোটা বাজিয়ে দেবো।”
ঠিক এ রকম সময় ঝুমু খালা ছোটাচ্চুর ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, সে অবাক হয়ে ভাবল, ঘরে অন্য কোনো মানুষের কোনো শব্দ নেই তার মাঝে ছোটাচ্চু একা একা চেঁচামেচি করছে কেন? ঘরের ভেতর কী হচ্ছে দেখার জন্য ঝুমু খালা মাত্র দরজার কাছে গিয়েছে তখন হঠাৎ করে দরজা খুলে বাচ্চাদের দলটি নিঃশব্দে বের হয়ে এলো। তাদের সবার এগাল-ওগাল জোড়া নিঃশব্দ হাসি। ঝুমু খালার আর বুঝতে কোনো কিছু বাকি থাকল না। এই বাচ্চাগুলোকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ছোটাচ্চু খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে কি না সেটা নিয়ে ঝুমু খালার সন্দেহ হতে থাকে।
ঘরের বাইরে ঝুমু খালাকে দেখে বাচ্চাদের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, মুনিয়া তার প্রিয় ফ্ল্যাশ কার্ডটা বের করে ঝুমু খালাকে দেখাল, যেটাতে বড় বড় করে লেখা, “ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ!”
ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে বলল, “অনেক হইছে! এখন ক্ষান্ত দাও।” বাচ্চারা অবশ্য ক্ষান্ত দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাল না, দলবেঁধে হেঁটে চলে গেল।
বিকেলের ভিতরে কোনো কথা না বলে থাকাটা বাচ্চাদের অভ্যাস হয়ে গেল। তারা নিজেদের ভেতর কথাবার্তা চালানোর জন্য বেশ কিছু আকার- ইঙ্গিত তৈরি করে নিয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করে অন্যদের সামনেই এখন গোপন কথাবার্তা বলতে পারে! কীভাবে এই আকার-ইঙ্গিত আরো বাড়িয়ে মোটামুটি নূতন একটা ভাষা তৈরি করে ফেলা যায় এখন সেটা নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করছে।
* * *
বিকেলবেলা সবাই ছাদে গিয়ে খেলছে, শুধু টুনি নিচে আছে। ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো, টুনি যেহেতু কথা বলছে না তাই এখন তার গিয়ে দরজার খোলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু ঝুমু খালা আশেপাশে নাই তাই সে-ই দরজা খুলতে গেল।
দরজা খুলে দেখল দুইজন অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। নূতন কোনো মানুষ দেখলেই টুনি মানুষটা সম্পর্কে মনে মনে একটা ধারণা করার চেষ্টা করে, তাই এবারেও করল। মানুষগুলো দুইজন দেখতে দুই রকম কিন্তু তাদের ভিতরে একধরনের মিল আছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, টুনির মনে হলো মানুষগুলির উদ্দেশ্য খুব ভালো না।
টুনি দরজায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, মানুষ দুইজনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কাজেই টুনি শেষ পর্যন্ত তার কাগজ বের করে লিখল, “কাকে চান?”
মানুষ দুইটা একজন আরেকজনের দিকে তাকার, তারপর আবার টুনির দিকে তাকাল, তারপর একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ক্যাচাল! এই ছেমড়ি তো দেখি বোবা।”
টুনির মেজাজটা ছ্যাৎ করে গরম হয়ে উঠল। কত বড় সাহস যে তাকে ছেমড়ি ডেকেছে। তার ওপর বোবা শব্দটা ব্যবহার করেছে। সেই ছোটবেলা থেকে তাদের শেখানো হয়েছে অন্ধ, বোবা, খোঁড়া এই শব্দগুলো ডিকশনারিতে থাকলে থাকুক কিন্তু কখনো মুখে ব্যবহার করতে হয় না। শুধু তা-ই না, এ ধরনের মানুষের সাথে দেখা হলে কখনোই তাদের আলাদাভাবে দেখতে হয় না, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তাদেরকে গ্রহণ করতে হয়।
টুনি যেহেতু কথা বলতে পারছে না তাই কিছু বলল না, মুখ শক্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
একজন মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ডিকেটটিভ শাহরিয়ার।”
অন্যজন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “দূর! বেকুব। বোবা মানুষ কানে শুনে না। কাগজে লিখে দিতে হবে।”
টুনি কানে শুনে কিন্তু যেহেতু এই মানুষগুলো ধরে নিচ্ছে সে কানে শুনে না তাই সে রকম ভান করেই দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষ দুইজন একজন আরেকজনকে ঠেলাঠেলি করতে লাগল লেখার জন্য, বোঝা যাচ্ছে এরা মোটামুটি অশিক্ষিত মানুষ। লেখালেখিতে খুব বেশি অভ্যাস নাই। শেষ পর্যন্ত একজন টুনির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে সেখানে লিখল, “ডিটিকটিব সাহিরিয়ার” শুধু যে হাতের লেখা জঘন্য তা নয়, বানানের অবস্থা দেখেও প্রায় বমি এসে যায়।
টুনি তখন মানুষ দুইজনকে ভিতরে এনে সোফায় বসার ইঙ্গিত করল। মানুষ দুইজন যখন ভিতরে ঢুকছে তখন টুনি শুনল একজন বলছে, “তুই সিওর এই মেয়ে কানে শুনে না?”
অন্যজন বলল, “সিওর। এই দেখ আমি পিছন থেকে ডাক দিমু সে টের পাইব না।”
টুনি যখন দরজাটা বন্ধ করছে তখন মানুষটা পিছন থেকে ডাকল, “এই মেয়ে—এই।”
মানুষটার ধারণা সত্যি করার জন্য তার ডাকটা একেবারে না শোনার ভান করে টুনি ধীরে-সুস্থে দরজা বন্ধ করল, তারপর বাসার ভেতরে গিয়ে ছোটাচ্চুকে খবর দেওয়ার জন্য রওনা দিলো। তখন শুনল মানুষটা বলছে, “মনে আছে তো কী করতে হবে?”
টুনি কান খাড়া করল, মানুষগুলো কী করতে হবে জানা দরকার। যেহেতু ধরে নিয়েছে সে কানে শুনতে পায় না টুনি এই ঘরে থেকেই শোনার চেষ্টা করতে পারে। টুনি হঠাৎ করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। ভান করল সে মেঝেতে কিছু একটা দেখেছে। প্রথমে উবু হলো, তারপর বসে গিয়ে অদৃশ্য ছোট জিনিসটা দেখার ভান করল।
সোফায় বসে থাকা দুইজনের একজন গলা নামিয়ে বলল, “এই বোবা ছেমড়ি এখন কী করে?”
আরেকজন বলল, “আস্তে। শুনব।”
“শুনব আবার কী? বোবাকালা ছেমড়ি। চামচিকার মতন ঠসা। এই দেখ—” বলে মানুষটা আবার টুনিকে ডাকল, বলল, “এই মেয়ে, এই ঠসা মেয়ে—এই—” শুধু কথা বলে শেষ করল না, জোরে জোরে হাততালি দিলো।
টুনি কিছু না শোনার ভান করে মেঝেতে পড়ে থাকা অদৃশ্য জিনিসটা খুব সাবধানে তুলে হাতের তালুতে রাখার ভান করতে লাগল।
মানুষ দুইজন যখন নিঃসন্দেহ যে টুনি কিছুই শুনে না তখন তারা আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল। একজন বলল, “হ্যাঁ। যেটা বলছিলাম—প্রথমে তুই ফাইলটা চ্যাংড়া ডিটেকটিভের হাতে দিবি—হে এইডা নাড়াচাড়া করব তখন কাগজে আঙুলের ছাপ পড়ব। বুঝলি এই কাগজে আর কারো আঙুলের ছাপ নাই।”
“হ। বুঝছি।”
“তারপর খুব সাবধানে কাগজগুলো নিজের হাতে না ধইরা ফাইলে ঢুকাবি। বুঝলি?”
“বুঝছি।”
“তারপর আমি তারে ট্যাহা দিমু। ওপরে-নিচে খালি আসল নোট। মাঝখানে জাল নোট। বুঝলি?”
“জে বুঝছি।” পুলিশে খবর দিবা কখন?
“হেইডা স্যার খবর দিবো। কাফী স্যার নিজে খবর দিবো।”
টুনির চোখ কপালে উঠে গেল। তার মানে সরফরাজ কাফী নিজে লোক পাঠিয়েছে ছোটাচ্চুকে বিপদে ফেলার জন্য। কী সর্বনাশ! লোক দুইজন আরো কী করতে চাইছে জানা দরকার কিন্তু এখন তার সময় নাই—ভিতরে গিয়ে ছোটাচ্চুকে সতর্ক করতে হবে। টুনি এবার তার হাতের তালুতে রাখা অদৃশ্য জিনিসটা দেখতে দেখতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল—মানুষ দুইজন তখনও নিচু গলায় কথা বলছে।
টুনি ছুটে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল। ছোটাচ্চু বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছিল। টুনিকে ঢুকতে দেখে একটু অবাক এবং ভয় পেয়ে তাকাল। টুনি ধাক্কা দিয়ে ছোটাচ্চুকে বিছানা থেকে তুলে তার কাগজটা টেবিলে রেখে লিখতে থাকে, “সাবধান। সরফরাজ কাফী দুইজন এজেন্ট পাঠিয়েছে। গোপন। তারা তাদের কাগজে তোমার হাতের ছাপ নিতে চায়। তাদের কোনো কাগজ হাত দিয়ে ধরবে না। না না না। তোমাকে অ্যাডভান্স টাকা দিবে। টাকা সব জাল নোট। তুমি টাকা নিবে না—”
টুনি কী লিখছে ছোটাচ্চু সেটা তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে দেখছিল। এবারে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল—টুনির হাত থেকে কলমটা টেনে নিয়ে বলল, “লিখতে হবে না—মুখে বল—তাড়াতাড়ি—”
টুনি মাথা নাড়ল, বুঝিয়ে দিলো মুখে বলবে না।
ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “কী যন্ত্রণা! এটা ইমার্জেন্সি—এখন ঢং করার সময় না—কী বলবি, মুখে বল।”
টুনি গম্ভীর মুখে ছোটাচ্চুর হাত থেকে তার কলমটা আবার টেনে নিল, কাগজে লিখল, “মুখে বলব না। তোমার চ্যালেঞ্জ লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ।”
ছোটাচ্চু দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে- লিখতে থাক—”
টুনি লিখল, “যদি ভালো হয় তুমি এদেরকে এখানে ব্যস্ত রেখে পুলিশকে খবর দিতে পারো।”
“পুলিশ!” ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল।
টুনি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “মানুষ দুইজন জানে আমি বাকপ্রতিবন্ধী আর শ্রবণপ্রতিবন্ধী—তুমি তাদেরকে বলে দিও না যে আমি নরমাল —“
ছোটাচ্চু তার টেলিফোনটা হাতে নিয়ে একটা নম্বর খুঁজতে খুঁজতে বলল, “তুই সত্যি বলছিস তো? সত্যি সত্যি পুলিশ আসার পর বেইজ্জতি হব না তো?”
টুনি লিখল, “সত্যি বলছি। তুমি বেইজ্জতি হবে না।”
ছোটাচ্চু তখন তার পরিচিত একজন পুলিশ অফিসারের সাথে ফোনে কথা বলতে শুরু করেছে।
টুনি তখন দৌড়ে ছাদে উঠত লাগল। বাসার সব বাচ্চাকে খবর দেওয়া দরকার যে ড্রইং রুমে কিছুক্ষণের মাঝে অনেক বড় একটা নাটক হতে যাচ্ছে!
* * *
কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট পরে যখন বাইরের ঘরের দরজা ঠেলে একজন পুলিশ অফিসার সাথে বেশ কয়েজন পুলিশকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে তখন মানুষ দুইজন মাত্র ঝুমু খালার তৈরি চপ শেষ করে চায়ে চুমুক দিয়েছে। তারা পুলিশ দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, “পু-পুলিশ কেন? কার কাছে এসেছে?”
ছোটাচ্চু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মনে হয় আপনাদের জন্যই এসেছে।”
“আ-আ-আমাদের জন্য কেন?”
“তারা সন্দেহ করছে আপনাদের কাছে জাল নোট আছে। নোটের বান্ডিলের ওপরে-নিচে আসল নোট ভিতরে সব জাল নোট।“
মানুষ দুইজন মাছের মতো খাবি খেতে থাকে। বলার চেষ্টা করে, “জা- জা-জা”—কিন্তু কথা শেষ করতে পারে না।
বাচ্চারা এতক্ষণ জানালার ফাঁক দিয়ে পুরো ঘটনা দেখছিল, এখন ভালো করে দেখার জন্য ঘরের ভিতর চলে এসেছে। এতগুলো বাচ্চা একসাথে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, নিজেদের ভেতর আকারে-ইঙ্গিতে কথাবার্তা বলছে, এতটুকু শব্দ নেই, বিষয়টা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট অবাক ব্যাপার। পুলিশ অফিসার অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল দেখে ছোটাচ্চু বলল, “এরা কথা বলতে পারে, শুনতেও পারে—আজকে কথা না বলার একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, সেই জন্য কথা কেউ বলছে না।”
পুলিশ অফিসার হা হা করে হাসলেন এবং মানুষ দুইটা আর্তনাদ করে উঠল, “কথা বলতে পারে? অ্যা-অ্যা—শুনতেও পারে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?”
টুনিকে দেখিয়ে বলল, “এই চশমা পরা মেয়েটাও পারে?”
“হ্যাঁ। খুব ভালো কথা বলতে পারে।”
কখন ঝুমু খালা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ করেনি। খালি হাতে আসে নাই, হাতে একটা ঝাঁটা। ঝুমু খালা ঝাঁটাটাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এই বাসায় ঢোকার আগে সাবধান। এই বাসার পোলাপান একজন থেকে আরেকজন বিচ্ছু! আপনাগো মতো দুই-চাইরটারে পানিতে গুলে কপাৎ করে গিলে খায়া ফালাইতে পারে!”
* * *
রাত্রিবেলা সবাই দাদি (কিংবা নানির) ঘরে একত্র হয়েছে। সাধারণত এই ঘরে প্রচণ্ড চেঁচামেচি, হইচই, হুটোপুটি হতে থাকে। আজকে কিছুই হচ্ছে না, বাচ্চারা কথা বলছে না বলে ঘর নিঃশব্দ। সবাই চুপচাপ বসে আছে এবং ছোটাচ্চু বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে কথা বলছে।
ছোটাচ্চু বলল, “দেখ, আমি স্বীকার করে নিচ্ছি তোদের মনের জোর আছে, তোদের নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস আছে, তোদের চব্বিশ ঘণ্টা কথা না বলে থাকতে হবে না। তোরা চাইলে এখন কথা বলতে পারিস। আমি যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছি সেই চ্যালেঞ্জে তোরা জিতে গেছিস।”
বাচ্চারা কাগজে লিখল, “এবং তুমি হেরে গেছো?”
“হ্যাঁ আমি হেরে গেছি।” ছোটাচ্চু বলল, “শুধু তাই না, এই রকম অবস্থাতেও টুনি যেভাবে সরফরাজ কাফীর দুই এজেন্টকে ধরেছে, সেইটা খুবই অসাধারণ ছিল।”
বাচ্চারা কোনো শব্দ না করে নিঃশব্দে হাত ওপরে তুলে হুর রে বলার ভান করল।
ছোটাচ্চু গলা পরিষ্কার করে বলল, “তোরা আবার কথা বলতে শুরু কর, আমি তোদের সবাইকে খেতে নিয়ে যাব, চায়নিজ কিংবা পিজ্জা কিংবা ফাস্টফুড কিংবা আইসক্রিম—যেটা ইচ্ছা–“
শান্ত কাগজে লিখল, “কিংবা সবগুলো?” ছোটাচ্চু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিংবা সবগুলো। বাচ্চারা আবার নিঃশব্দে হুর রে বলল।“
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে? তাহলে এখন লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জ শেষ!” টুনি কাগজে লিখল, “সেইটা নির্ভর করে আমাদের লিডারের সিদ্ধান্তের ওপর।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “লিডার? তোদের লিডার কে?”
টুনি লিখল, “লৌহ কঠিন চ্যালেঞ্জের লিডার হচ্ছে মুনিয়া!”
সবাই তখন মুনিয়ার দিকে তাকাল। মুনিয়া তখন মোটামুটি লিডারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে প্রথমবার মুখে কথা বলল, “শেষ! চ্যালেঞ্জ শেষ।”
সবাই একটা গগনবিদারী চিৎকার করল। পুরো বারো ঘণ্টা আটকে থাকা কথা মনে হয় একবারে বের হয়ে এলো!