চার
পুলিশ আর জেল সমগোত্র হলেও সমধর্মী নয়। লক্ষ্য হয়তো এক, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন। এঁরা ঘাঁটেন কাঁচামাল, আমাদের গুদামে থাকে তৈরী raw materials জিনিস! ওঁদের ভাগে আমাদের finished products। পুলিসের কাজ হচ্ছে মাল সংগ্রহ করা, নানা জায়গা থেকে নানা রকম মাল। তাকে ঝেড়ে পিটিয়ে চালান করেন কোর্ট নামক ফ্যাকটরিতে। তারপর সেই বকযন্ত্রে শোধন করে finishing ছাপ দিয়ে গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে আসেন জেলের দরজায়। আমরা মাল খালাস করি, সাজিয়ে গুছিয়ে ঘরে তুলি, কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। তারপর পুরানো হয়ে গেলে ফেলে দিই রাস্তায়।
সেখানে কতগুলো পচে, কতগুলো হারিয়ে যায়, কতগুলো আবার ঘুরে ফিরে পুলিসের গাড়ি চড়ে ফিরে আসে আমাদের গুদামে। পুলিসের সঙ্গে এই হল আমাদের সম্পর্ক। ওদের যেখানে সারা, আমাদের সেখানে শুরু।
এমনি করে একদিন একটা বড় রকম পুলিস-অভিযানের জের টানবার জন্যে আমার বদলি হল এক মস্ত বড় সেন্ট্রাল জেলে। দাঙ্গা হয়ে গেছে তিরিশখানা গ্রাম জুড়ে। পাইকারি ভাবে চলেছে খুন, জখম, লুণ্ঠন, আগুন আর নারীমেধ যজ্ঞ। সব শেষ হবার পর যথারীতি পুলিসের আগমন। গোটাকয়েক অনাবশ্যক গুলিবর্ষণ। তারপর ভরে গেল জেলখানা। গিয়ে দেখলাম, “লআপ টোটাল” কয়েকশ’ থেকে একলাফে ছাড়িয়ে গেছে দু-হাজার। রীতিমত রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন। সকালে যাই, বাড়ি ফিরি বেলা দেড়টায়। আবার বিকালে যাই, ফিরে আসি রাত দশটায়। বাকি রাত যেটুকু, তারও ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির দরজায় এসে হুঙ্কার দেয় গেট-ফালতু, ‘এক লরি আসামী আয়া হুজুর।’ কিংবা হয়তো রিপোর্ট দেয় কোনো জমাদার, ‘বারো নম্বরমে একঠো মর্ গিয়া।
অতিরিক্ত অফিস বসেছে কাপড়ের গুদামে। কম্বলের গাঁট হটিয়ে পড়েছে চেয়ার টেবিল। একটা ছোট কামরায় ঠাসাঠাসি আমরা তিনজন অফিসার। মাঝখানে জাঁকিয়ে বসেন আমাদের সিনিয়র ফৈজুদ্দিন সাহেব। দু-পাশে আমরা দুজন জুনিয়র। কাগজপত্রের স্তূপ যা-কিছু আমাদের দিকে; দাদার সামনে ফাঁকা। উনি হস্তদন্ত হয়ে ফিরে আসেন। দু-চারটে হাঁক-ডাক দিয়ে লাঠিখানা নিয়ে ঢুকে পড়েন জেলের মধ্যে। কয়েক ঘণ্টা পরে ব্যস্ত হয়ে ফেরেন। ‘কোথায় গিয়েছিলেন দাদা?’ ‘একজিকিউটিভ করে এলাম খানিকটা। তোমাদের মতো কলম হাতে করে আড্ডা দিলে কি আর জেল চলে?”
দু-চারদিনেই জানা গেল দাদার ‘একজিকিউটিভ’-এর এলাকা হল রসদগুদাম কিংবা হাসপাতাল। কর্মতালিকা চা এবং সিগারেট যোগে খোসগল্প কিংবা টাটকা সিরাপের সরবত পান। তখন আমরাও মাঝে মাঝে ‘একজিকিউটিভ্’ শুরু করলাম এবং দাদার সামনে কিছু কিছু ফাইল জমতে শুরু হল। একদিন এমনি একটা ফাইল খুলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, এ কি! লুনাটিক ফাইল আমার টেবিলে কেন? পাগল-টাগল সব তুমি। বললাম, আমি পাগল! তা আপত্তি নেই? প্রতিভাবান ব্যক্তি মাত্রেই পাগল।
রসিকতাটা মাঠে মারা গেল। উনি খানিকক্ষণ শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, আহা, তোমাকে পাগল বলবো কেন? বলছিলাম, পাগলের ফাইল তুমি ডিল করবে। ওটা জুনিয়ারের কাজ।—বলে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন বাণ্ডিলটা।
প্রতি জেলকেই একদল পাগল পুষতে হয়। তাদের ক্রিয়া-কলাপ যেমন বিচিত্র, আইন কানুনের মারপ্যাচগুলোও তেমনি জটিল। পাগলের আবার শ্রেণীভেদ আছে। যে-কোনো জেলের সেল্ ব্লকে গেলে দেখতে পাবেন, ছোট ছোট কতকগুলো সাইন-বোর্ড ঝুলছে—Non-criminal lunatic। অর্থাৎ যাকে crime বলে, সে-রকম কোনো অপরাধ তারা করেনি। করেছিল শুধু পাগলামি, এবং সেইটাই তাদের জেলে আসবার কারণ। আমি কোনোদিন ভেবে পাইনি, এই কারণটা কি আমার আপনার সবার বেলাতেই প্রযোজ্য নয়? সংসারে Non-criminal lunatic নয় কে? তবে বলতে পারেন, সবাইকে তো আর জেলে জায়গা দেওয়া যায় না। তাই পুলিস যেখান সেখান থেকে দু-চারটা স্যামপল সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেয় জেলখানায়। সেখানে একবার যারা ঢোকে, তাদের নিস্তার নেই। এই সেল্-এ বসে বসেই একদিন বদ্ধ পাগল হয়ে তারা রাঁচীর রাস্তা ধরে।
আর একরকম পাগল আছে। তাদের নাম criminal lunatic। অর্থাৎ শুধু lunatic নয়, তার সঙ্গে আবার criminal। পাগলামি ছাড়াও তাদের নামে আছে একটা কোনো আইন-ভঙ্গের অভিযোগ, ঝুলে আছে Penal Code-এর কোনো ধারা। এদের আবার দুটো দল। কেউ আগে পাগল পরে criminal, কেউবা আগে criminal পরে পাগল। ফৈজুদ্দিন সাহেব বললেন, কেসটা আমি মোটামুটি দেখেছি। খুন করেছিল মেয়েটা। দ্যাখ তো, কোন্ সেকশনে কমিট্ করেছে। ৪৭১ না ৪৬৬?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম, ওটা কী বলছেন দাদা? Greek?
—আহা বুঝতে পারছ না! পাগল খুনী না খুনী পাগল?
হতাশ সুরে বললাম, নাঃ; গ্রীক নয়, হিব্রু।
দাদা কাজের লোক, ঠাট্টা তামাশা পছন্দ করেন না। গম্ভীর ভাবে বললেন, কাজকর্ম তো আর শিখতে আসনি? খালি ফাঁকি আর ফক্কড়ি। পড় পড়, ভাল করে পড়ে দ্যাখ। বলে উনি লাঠিখানা নিয়ে যথারীতি একজিকিউটিভ করতে বেরিয়ে পড়লেন।
ফাইল খুলে প্রথমেই নজরে পড়ল, আসামীর নাম। মল্লিকা গাঙ্গুলী। বেশ নামটি তো? মনে মনে পড়লাম কয়েকবার। চেহারাটা কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। দীর্ঘাঙ্গী তরুণী। মাথায় বিপর্যস্ত কেশভার; চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি; মুখখানা দিনশেষের মল্লিকা ফুলের মতো শুভ্র-মলিন। খুন করেছিল কেন? হয়তো খুলতে পারেনি জীবনের কোনো জটিল গ্রন্থি, মেটাতে পারেনি অন্তরের কোনো গভীর দ্বন্দ্ব। মনটা উদাস হয়ে উঠল। কোন্ এক অ-দৃষ্টা অপরিচিতা রহস্যময়ী নারীর বিধ্বস্ত জীবনের সঙ্গে কেমন একটা একাত্মতা অনুভব করলাম।
তথ্য যেটুকু পেলাম অতিশয় সংক্ষিপ্ত এবং অতিমাত্রায় সরল। তার মধ্যে ফৈজুদ্দিন সাহেবের প্রশ্নের উত্তর হয়তো ছিল, কিন্তু উত্তর পায়নি বৃদ্ধা পৃথিবীর সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসা—মানুষ খুন করে কেন? কী সেই দুয়ে প্রবৃত্তি যার তাড়নায় তার বুকে জাগে নর-রক্ততৃষ্ণা, চোখের পলকে অসাড় হয়ে যায় তার অনন্ত কালের মানবধর্ম—দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম; হাজার বছরের সংস্কৃতি দিয়ে গড়া যে সভ্য মানুষ, তাকে এক নিমেষে করে তোলে নখী দন্তী শৃঙ্গী?
আইন যে-টুকু দেখে, যে-টুকু দেখে তার বিচার করে সে শুধু তার বাইরের রূপ, তার কাজ, তার হাত-পায়ের অভিব্যক্তি,—তুমি এই করেছ, এই করনি। এই করা এবং না- করার অন্তরালে তার যে চিররহস্যাবৃত অন্তর্লোক, সেখানে বিচারকের দৃষ্টি পৌঁছায় না।
নথিপত্র থেকে পাওয়া গেল, মল্লিকা খুন করেছিল। তারপর পুলিশের হাতে যখন গিয়ে পৌঁছল, তখন সে আর প্রকৃতিস্থ নয়। বিকৃত মস্তিষ্কের বিচার চলে না। অভিযোগের মর্ম সে বুঝবে না। তার বিরুদ্ধে নিজেকে সমর্থন করবার যে মনন-শক্তি, সেটাও তার নেই। সিভিল-সার্জেনের মতে she is not fit to stand her trial। তাই মামলার শুনানি স্থগিত রেখেছেন জজসাহেব। এই বিকৃতি যদি কোনোদিন কেটে যায়, ফিরে আসে তার মানসিক সাম্য, সেদিন আবার তাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে বিচারশালায়, গ্রহণ করতে হবে তার প্রাপ্য দণ্ড। তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক করে তুলবার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন, সে দায়িত্বও সরকারের। তাই জজসাহেব মামলা স্থগিত রেখেই তাঁর কর্তব্য শেষ করেননি, সেই সঙ্গে আদেশ দিয়েছেন তার উপযুক্ত চিকিৎসার। মল্লিকার গন্তব্যস্থল রাঁচী উন্মাদাশ্রম। সেখানে যতদিন তার স্থান নির্দিষ্ট না হয়, তাকে জেলে থাকতে হবে। রাঁচীর পথে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে তাই এই কারাবাস।
গত ছ-মাস ধরে মল্লিকার দিন কেটেছে কলকাতার কোনো বড় জেলে, জেনানাফাটকের একটা ছোট নির্জন কামরায়। সেখানকার যা কিছু সবারই উপরে ছিল তার নীরব ঔদাসীন্য। কাউকে সে কোনো প্রশ্ন করেনি, কারও কোনো প্রশ্নের জবাবও দেয়নি। সঙ্গিনীদের কাউকে সে চিনত না। তাদের বিরাগ এবং অনুরাগ উভয় ক্ষেত্রেই ছিল সে সমজ্ঞান। তারপর একদিন একটি নতুন মেয়ে ভরতি হল। কোলে তার দু-তিন মাসের শিশু। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে মা গিয়েছিল নাইতে কিংবা খেতে। ফিরে এসে দেখে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাগলী। সর্বনাশ! মেয়েটির চিৎকার শুনে ছুটে এল সবাই। শিশুটিকে যখন কেড়ে নিল ওর কোল থেকে, মল্লিকা শুধু তাকিয়ে রইল নিষ্পলক চোখে, তারপর নিঃশব্দে উঠে গেল তার সেই ছোট্ট সেলটিতে। মা নালিশ জানাল জেলর সাহেবের কাছে। কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হলেন। মল্লিকার জন্যে নিযুক্ত হল স্পেশাল গার্ড—তার সেল-এর দরজা বন্ধ রইল উদয়াস্ত। তাতেও নিশ্চিন্ত হতে না পেরে শেষটায় তাকে সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন আমাদের জেলে। এখানে মেয়েদের ওয়ার্ডে বাচ্ছা ছেলে নেই।
কদিনের মধ্যেই সে এসে গেল। ঘোড়ার গাড়ির দরজা খুলে যখন নামানো হল জেল গেটের সামনে, একবার তাকিয়ে দেখলাম, চারদিকে যারা ছিল, সব যেন পাথর হয়ে গেছে। দেখলাম, আমাদের কল্পনা কত দীন, কত ভীরু! আসল বস্তুর কাছে ঘেঁষতেও সে ভয় পায়। আর দেখলাম, বিধাতার হাতের অনির্বচনীয় সৃষ্টি যে রূপ, মানুষের হাতের অনাদর অবহেলা তাকে কী দুর্গতির মধ্যেই না নিয়ে যেতে পারে! ছেলেবেলায় দেখেছি, আমাদের দেশের বাড়ির বৈঠকখানার সামনে ছিল একটা ডালিম গাছ। ফাল্গুনে তার সর্বাঙ্গে ছেয়ে যেত বর্ণোজ্জ্বল ফুলের মালা। বৈশাশে শাখা পল্লব নুয়ে দিত রসপুষ্ট ফলের ভার। একবার কোথা থেকে একঝাঁক ভীমরুল এসে তার ডালে বাসা বাঁধল। আমাদের একজন অতি-বিজ্ঞ অভিভাবক ভীমরুল তাড়াবার জন্য একদিন সেই ফলে ফুলে ভরা ডালিম গাছে আগুন ধরিয়ে দিলেন। মনে আছে, ইস্কুল থেকে ফিরে সেই পোড়া ডালগুলোর দিকে চেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। দেশ ছেড়ে আসবার পরেও অনেক দিন যখন-তখন তার কথা মনে পড়ত। তারপর ভুলে গিয়েছিলাম। আজ এতকাল পরে মল্লিকা গাঙ্গুলীর দিকে চোখ পড়তেই সেই দগ্ধ-পল্লব, ভ্ৰষ্টশ্রী ডালিমগাছটি আমার চোখের উপর ভেসে উঠল।
আমাদের মেয়ে-ওয়ার্ডার মানদা বিশ্বাস মল্লিকার বাহু ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে এল আমার অফিসে। একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললাম, বসুন। সে বসল না। দীর্ঘায়ত নীলাভ চোখদুটো তুলে একবার শুধু তাকালে আমার দিকে। বিস্মিত হলাম! এ তো উন্মাদের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নয়। শান্ত সমাহিত দুটি চোখ। তার অন্তরালে যেন লুকিয়ে আছে কতকালের পাথরচাপা কান্না। সে পাথর যদি সরে যায়, বেরিয়ে আসে অবরুদ্ধ অশ্রুধারা, হয়তো বিশ্বসংসার ভেসে যাবে।
মানদা তার জামা কাপড় গয়না-গাঁটির নাম বলে যাচ্ছিল, ওয়ারেন্টে যে তালিকা আছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে নেবার জন্যে। বাধা দিয়ে বললাম, ‘ও সব থাক, তুমি ওকে নিয়ে যাও।’
পরের সপ্তাহে Noon Duty-র ভার পড়ল আমার ভাগে। এখানে একটু বলে রাখা দরকার, নুন-ডিউটি নয়, মাধ্যাহ্নিক বিশ্রাম। তার স্থান গৃহ নয়, অফিস—এইটুকু শুধু তফাত, কিন্তু অফিস হলেও গৃহসুলভ আরাম-ব্যবস্থার ত্রুটি নেই। ‘আমদানি সেরেস্তার’ লম্বা টেবিলখানা তক্তাপোশে রূপান্তর লাভ করবে। তার উপর রচিত হবে তাকিয়া এবং সতরঞ্চি সহযোগে পরিপাটি শয্যা। গরমের দিনে মাথার উপর ঘূর্ণমান পাখা। শীতের দিনে সদ্য গাঁটভাঙা কম্বল। ফাঁকা অফিস। চারিদিক নিঝুম। নির্বাধ নিদ্রার মনোরম পরিবেশ। কালেভদ্রে কোনো-কোনো দিন দু-একটা টেলিফোন্-ঝঙ্কার কিংবা কোর্ট- পুলিসের হুঙ্কার–আসামী আয়া হুজুর।’ এ সব উৎপাত থাকলেও আমাদের দাদারা এই নুন-ডিউটি নামক বস্তুটিকে মোটামুটি পছন্দ করতেন। কারণ—প্রথমত তিনখানা ঘর আর তার তিনগুণ বাচ্চা-কাচ্চাওয়ালা সরকারী কুঠি দিবানিদ্রার প্রশস্ত স্থান নয়। দ্বিতীয়ত স্বামীদের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা কোনো স্ত্রীই প্রসন্ন চোখে দেখেন না। তাঁরা মনে করেন, ওটা গৃহিণী জাতির একচেটে অধিকার। দুপুর বেলা একটু গড়িয়ে নেবার প্রয়োজন যদি কারও থাকে সে তো ওঁদেরই, সংসারের চাকায় যাঁরা ঘুরপাক খাচ্ছেন উদয়াস্ত। অফিস-নামক আড্ডাখানায় যারা কাজের নামে ঝিমোয় কিংবা আসর জমায় খোসগল্পের, বাড়িতে এসে তারা নাক ডাকবে, এ অন্যায় সইবে কে?
আমি তখনও ‘দাদা’ পর্যায়ে পৌঁছতে পারিনি। সঙ্গিনীহীন শয্যায় অভ্যস্ত হতে কিছুটা বিলম্ব ছিল। Noon Duty সপ্তাহটা উৎপীড়ন বলে মনে হত। সেদিনও তাই অপ্রসন্ন মনে সতরঞ্চি-শয্যায় এপাশ-ওপাশ করছিলাম। জেলগেটের ভেতরদিকের ফটকে তুমুল গণ্ডগোল। পুরুষের সঙ্গে নারী-কণ্ঠের মিশ্রণ। গিয়ে দেখি খণ্ড-প্রলয়ের সূচনা। একদিকে বিপুল গুম্ফ গেটকীপার, আর এক দিকে অনলচক্ষু ফিমেল ওয়ার্ডার। কী ব্যাপার? গেটকীপার জবাব দিল না। অঙ্গুলি নির্দেশ করল মানদা বিশ্বাসের উদরের দিকে। চাদরের সযত্ন-আবরণ ভেদ করে সেখানকার বিপুল স্ফীতি অন্ধ ব্যক্তিরও নজরে পড়তে বাধ্য। বিস্মিত হলাম। মানদা চিরকুমারী এবং উত্তর-চল্লিশ। তবু বলা যায় না, এ হেন নারীর জীবনেও অকাল বসন্তের আবির্ভাব ঘটতে পারে। কিন্তু তার এই ফলাফল রাতারাতি দেখা দেবে কেমন করে? সুতরাং গেট-কীপার যদি এ ঘটনার কোনো অনৈসর্গিক কারণ সন্দেহ করে ফিমেল-ওয়ার্ডারকে চ্যালেঞ্জ করে থাকে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। মানদা দমবার পাত্রী নয়। নারীজাতির চিরন্তন প্রিভিলেজের উপর দাঁড়িয়ে সেও গেট-কীপারকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। নারীদেহে “তল্লাসী” করবার কী অধিকার আছে পুরুষের? অতএব দূরে রহ।
আমি উভয় সঙ্কটে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত গেট-কীপারকে কিঞ্চিৎ তিরস্কার করে মানদাকে অনুরোধ করলাম, যদি সম্ভব হয়, সে যেন আমার অফিসে গিয়ে তার দেহভার মুক্ত করে। আপাতত সেখানে কোনো পুরুষ উপস্থিত নেই। সে স্বীকৃত হল, এবং কিছুক্ষণ পরে অফিসে ফিরে দেখলাম, টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে একজোড়া শাড়ি, তার পাশে সায়া ব্লাউজ, একশিশি সুগন্ধ তেল, স্নো পাউডার এবং চুল বাঁধবার সরঞ্জাম। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই তার স্বাভাবিক রুক্ষকণ্ঠে বলল মানদা, এগুলো তো আর আপনারা দেবেন না। তাই, কপালের ভোগ আমাকেই ভুগতে হয়। এর কোটা না হলে মেয়েমানুষের চলে, বলুন?
মেয়েমানুষ ফিমেল ওয়ার্ডে আজ নতুন আসেনি। কিন্তু এতদিন তো এ দুর্ভোগ মানদাকে ভুগতে হয়নি। আজ যে-জন্য হল সেটাও বুঝলাম। তবু প্রশ্ন করলাম, কিন্তু মেয়ে তো তোমার ওখানে গুটি পনেরো। আর—
–ও আমার কপাল! একগাল হেসে বলল মানদা, এসব বুঝি ঐ হতচ্ছাড়ীগুলোর জন্যে? ওরা মাখবে স্নো পাউডার।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আচ্ছা স্যার, মল্লিকাকে জেলে পাঠিয়েছে যে হাকিম, আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারেন তার কাছে?
কেন?
—তাকে একবার বলে আসতাম পাগলা গারদে ও যাবে না, যাবে তুমি। আর বলতাম, ওর বাড়ির লোকগুলোকে ধরে এনে ফাঁসি দাও একটা একটা করে। মেয়েটা যে এখনও বেঁচে, আছে সে শুধু যীশুর কৃপায়
মানদা যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে বুকের উপর ক্রুস আঁকল।
বললাম, তুমি শুনেছ ওর সব কথা?
—কি করে শুনবো? ও তো কথা বলে না। কিন্তু ওর মুখের দিকে চেয়েই আমি সব বুঝে নিয়েছি। ক’টা দিন সময় দিন আমাকে। একটু সুস্থ করে তুলি, তারপর সব জানতে পারবো। যদি পারেন স্যার, ডাক্তারবাবুকে বলে ওর একটু দুধ-টুধের ব্যবস্থা করে দেবেন। বললাম, করবো। আর এই কাপড়-চোপড়গুলো এইখানেই থাক। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার কাছে।
দিন পাঁচ-ছয় পরে জেনেনা-ওয়ার্ডে যেতে হয়েছিল কোনো কাজে। মানদা বলল, মল্লিকাকে দেখবেন না?
—চল।
সেলব্লকের চত্বরে একটা গাছের নীচে বাঁধানো বেদির উপর বসে আছে মল্লিকা। অপরাহ্ণের ম্লান রৌদ্র এসে পড়েছে তার পায়ের কাছটিতে। দেখে চেনাই যায় না। রুক্ষ জট পাকানো চুল বহু-যত্নে বশে এসেছে। দুটি সুদৃশ্য দীর্ঘ বেণী ঝুলছে পিঠের উপর। পরনে পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড়। মুখে সামান্য প্রসাধনের চিহ্ন। কপালে একটি সিন্দুরের টিপ। কালিঢালা দুটি চোখের কোলে সদ্যলব্ধ স্বাস্থ্যের আভাস। শীর্ণ কপালে সে-দিন যে মালিন্য দেখেছিলাম, অনেকখানি মিলিয়ে গেছে, ফুটে উঠেছে লাবণ্যের আভা। সেদিনের মতই নিঃশব্দে একবার চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। তেমনি শান্ত দৃষ্টি। মানদা এগিয়ে গিয়ে চিবুকে হাত দিয়ে ওর মুখখানা আমার দিকে তুলে ধরে বলল, এই মেয়ে খুন করেছিল, আপনি বিশ্বাস করেন ডেপুটিবাবু? দু’তিনটি মেয়ে-কয়েদী কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের একজনকে বলল মানদা, যা তো সরলা, দিদিমণির দুধ আর ফলের ডিশটা নিয়ে আয়।
সরলা ছুটল। মানদা আমার দিকে ফিরে বলল, দু-একখানা বই-টই দিতে পারেন?
— বই!
—হ্যাঁ, বাচ্চাদের ছবির বই। দেখছেন না, ও এখন কচিছেলের বাড়া। সব কিছু করে দিতে হয়।
—বই পড়তে পারবে বলে মনে কর?
—এক-আধটু যদি পাতা ওলটায়।
ফিরে আসতে আসতে বললাম, কথা টথা বলে কিছু?
একেবারেই না, মাথা নেড়ে বলল মানদা—ওর নিজের কথা জিজ্ঞেস করে দেখি, তাতে শুধু ওর কষ্ট বাড়ে। সেরে উঠুক। আস্তে আস্তে সব জানা যাবে।
জানা গেল কদিন পরেই। সকালের অফিস। নিঃশ্বাস ফেলবার অবসর নেই। বড় সাহেব “সেলাম” জানালেন। গিয়ে দেখি, তাঁর টেবিলের পাশে একটি অপরিচিত সুদর্শন যুবক। তাঁকে দেখিয়ে বললেন, সাহেব, ইনি কলকাতা থেকে এসেছেন। মল্লিকা গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা করতে চান। এই মেয়েটিই কি সেদিন এল প্রেসিডেন্সি থেকে।
বললাম, হ্যাঁ স্যার।
—তাহলে দেখাটা তোমার অফিসে বসিয়েই করিয়ে দাও। কি বল, চৌধুরী?
–সেইটাই ভাল হবে।
ভদ্রলোক আমার সঙ্গে আসতে আসতে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করলেন, ও কেমন আছে, স্যার? বললাম, আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। উনি কে হন আপনার?
—আমার স্ত্রী।
মেয়েটিকে নিয়ে আসবার জন্যে মানদাকে খবর পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে এল, কিন্তু একা। বললাম, কই, মল্লিকা কই?
—সে এল না বাবু।
—কেন?
—তা কেমন করে বলবো? অপ্রসন্নকণ্ঠে জবাব দিল মানদা।
—তার স্বামী এসেছেন দেখা করতে, বলেছিলে?
—বলেছি বইকি। একেবারে কাঠ হয়ে বসে রইল। কিছুতেই আনা গেল না।—বলে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। ইনিই যে মল্লিকার স্বামী, তার বুঝতে বাকি ছিল না।
ভদ্রলোক ক্ষীণকণ্ঠে অনেকটা যেন আপনমনে বললেন, তাহলে সেই রকমই আছে, দেখছি।
বললাম, ওখানেও দেখা করত না?
—প্রথম দিকটা করত। খুব boisterous ছিল তখন। চেঁচাত, কাঁদত, হাসত, আবোল- তাবোল বকত, কিন্তু দেখা করতে আপত্তি করত না।
—আপনি বরাবর কলকাতাতেই আছেন?
—আজ্ঞে না, আমি থাকি এলাহাবাদ। সেখান থেকে মাসে মাসে এসে দেখে গেছি। মাঝে-মাঝে একটু যেন চিনতেও পারত। তারপর হঠাৎ একেবারে গুম হয়ে গেল। কথা বলে না; ডাকলে আসে না।
একটু থেমে বললেন, এবার অনেকদিন আসতে পারিনি। কাল ওখানে গিয়ে শুনলাম ওকে এই জেলে পাঠানো হয়েছে। বাড়ি না গিয়ে সোজা স্টেশনে এসে গাড়ি ধরলাম। কি জানি কেন মনে হল, এবার বোধ হয় দেখা হবে। কথা না বলুক, শুধু একবার দেখা।
গলাটা ধরে এল ভদ্রলোকের। রুমাল বের করে চেপে ধরলেন চোখের উপর। বৃথা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা না করে আমি চুপ করেই রইলাম। কয়েক মিনিট পরে উনি বললেন, এবার তাহলে আমি আসি, স্যার।
বললাম, কোথায় উঠেছেন আপনি? –
—উঠিনি কোথাও। স্টেশন থেকে সোজা চলে এসেছি।
—এখন কোথায় যেতে চান? আপনার ফিরবার গাড়ি তো সেই রাত দশটায়।
—হ্যাঁ। এ সময়টা ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দেব ভাবছি।
—তার মানে হরিবাসর?
মতীশবাবুর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বললেন, তা হোক। একটা দিন তো।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
—আজ্ঞে, এগিয়ে দিতে হবে না। গেটটা শুধু পার করে দিন।
গেট পার হয়েও ওঁকে অনুকরণ করছি দেখে মতীশবাবু হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন, এবার আমি যেতে পারব, স্যার। আপনি আর কষ্ট করবেন না।
—চলুন না।
একটা ছোট একতলা বাড়ির সামনে এসে বারান্দার সিঁড়ি দেখিয়ে বললাম, এই দিকে-
উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, এটা—
—হ্যাঁ, এটাই আমার প্রাসাদ। পৈতৃক নয়, সরকারী। তবে আপনার ওয়েটিং রুমের চেয়ে নেহাত খারাপ হবে না।
মতীশ ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু—
—আমার অসুবিধা হবে, এই বলবেন তো? তা আর কি করবো?
উপস্থিত মতো অনাড়ম্বর মধ্যাহ্ন-ভোজন শেষ করে দুজনে এসে বাইরে বারান্দায় দু-খানি ক্যাম্প-চেয়ার দখল করলাম। সামনে খানিকটা দূরে সু-উচ্চ জেলের পাঁচিল। সেদিকে কিছক্ষণ চেয়ে থেকে মতীশবাবু আস্তে আস্তে বললেন, ঐ পাঁচিলের ওপারটাতেই বুঝি-ওদের ওয়ার্ড?
বললাম, হ্যাঁ। খানিকটা গিয়েই।
—মজা দেখুন! একদিন যে আমাকে সব দিয়েছিল, আজ সে চোখের দেখাটাও দিল না। অথচ এর জন্য আমরা কেউ দায়ী নই। সেও না, আমিও না।
আমার কনিষ্ঠ শ্রীমান এসে জানিয়ে গেল, মা বলছে কাকাবাবুর বিছানা দেওয়া হয়েছে।
বললাম, মতীশবাবু, এবার আপনাকে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। এটা কিন্তু আমার অনুরোধ নয়, আপনার বৌদিদির আদেশ এবং তার ওপরে আপীল চলে না।
মতীশবাবু হেসে বললেন, বেশ তো। আর আপনি?
—আমিও উঠছি। আদেশটা আমার ওপরেও প্রযোজ্য।
.
জেলের পাশেই এক মাইল চওড়া ঘোড়দৌড়ের মাঠ। তারই মাঝখানে একটি সবুজ কোমল গলফ্-চত্বরের উপর গিয়ে বসলাম দুজনে। সূর্য তখন অস্ত গেছে। বৈশাখ মাস। শুক্ল পক্ষ। সামনের ঐ সুপারি, নারিকেল বাঁশবনে ঘেরা গ্রামের কোল ঘেঁষে চাঁদ উঠবে একটু পরেই। সেই নরম আবির্ভাবের পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে তরুশ্রেণীর মাথার উপর। ঐদিকে চেয়ে নিঃশব্দে বসে ছিলেন মতীশবাবু। তারপর একসময়ে বলে উঠলেন, খাঁটি কলকাতার জীব আমরা। এতখানি খোলা-মেলা আমাদের ধাতে সয় না।
—এসব দেশে আসেননি কোনোদিন?
—এসেছিলাম একবার বছর দুয়েক আগে। ঐ নারকেল সুপারির ঘন লাইনের দিকে চেয়ে সেই দিনটার কথাই ভাবছিলাম।
—বেড়াতে এসেছিলেন?
—হ্যাঁ; তা প্রথমটা একরকম বেড়াতেই।
—শেষটায়?
শেষটায় যা ঘটল, আজও তার জের টানছি। হয়তো সারাজীবন টেনেও শেষ হবে না।
—সে তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না, যোগাযোগটা আপনাদের ঘটল কেমন করে?
—সে বিচিত্র উপন্যাস শুনতে গেলে আপনার ধৈর্য থাকবে না দাদা।
—একবার পরীক্ষা করে দেখতে আপত্তি আছে কিছু?
—আপত্তি! মৃদু হাসির শব্দ তুলে বললেন মতীশ, এই কটি ঘণ্টা যে পরিচয় আপনার পেলাম, তারপরে আর ও জিনিসটা থাকতে পারে না। কিন্তু সে একঘেয়ে দুঃখের কাহিনী—
বাধা দিয়ে বললাম, দুঃখ জিনিসটা ফেলনা নয়, মতীশবাবু। তাকেও সম্পদ করে তোলা যায়, যদি মনের মতো কাউকে ভাগ দিতে পারেন।
মতীশের মৃদু হাসি মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মাটির দিকে চেয়ে থেকে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, বেশ, তাহলে শুনুন।
মতীশ গাঙ্গুলীর কাহিনী শুরু হল—
.
কলেজের বন্ধুদের মধ্যে সব চেয়ে যার সঙ্গে ভাব হয়েছিল এবং কলেজ ছাড়বার পরেও তাতে ফাটল ধরেনি, তার নাম হীরালাল। বাড়ি চিল বাঙাল দেশের কোনোখানে, .ঠিক জানতাম না। হঠাৎ একদিন পড়বার ঘরে এসে বলল, আমার বিয়ে! তোমাকে যেতে
হবে আমাদের দেশে।
বললাম, সর্বনাশ!
—সর্বনাশ কেন?
—আরে আমরা হলাম নির্ভেজাল কলকাতার লোক। শেয়ালদ’র স্টেশনে গাড়ি চড়া আমাদের শাস্ত্রে নিষেধ।
হীরালাল শুনতে চায় না। বুঝিয়ে বললাম, কোলকাতার বাইরেও যে বাংলা দেশ আছে, আমাদের কাছে তার অস্তিত্ব শুধু ভূগোলের পাতায়। আমার মা, বোন, বৌদিরা কেউ ভূগোল পড়েননি। পড়লেও ভুলে গেছেন।
কিন্তু হীরালাল একেবারে নাছোড়বান্দা। বাঙালে গোঁ যাকে বলে। সরাসরি বাবার কাছে গিয়ে আবেদন পেশ করল এবং একরকম জোর করেই সেটা মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে এল। মা অসন্তুষ্ট হলেন। বিধবা বোন মঞ্জরী রুষ্ট হয়ে রইল। যাবার দিন বিছানাপত্তর সুটকেস ইত্যাদি গুছিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘দেখো দাদা, বন্ধুর দেশের কোনো বিদ্যেধরী যেন ঘাড়ে চেপে না বসেন।
হেসে বললাম, চাপলে মন্দ কি? ও দেশের মেয়েগুলো সত্যিই সুন্দর। তোদের মতো ঢেসি নয়।
মুখে আগুন!—বলে আমার ভগিনী এমন মুখ করলেন, যেটা শুধু ঐ বস্তুটিযোগেই হতে পারে।
আমাদের বংশে আমিই প্রথম শেয়ালদ’র স্টেশনে গাড়ি চাপলাম। যশোরে পৌঁছে আমার জিনিসপত্রগুলো খুলে দেখা গেল, এই কটা দিন কাটাবার মতো আবশ্যক কোনো জিনিসই বাদ দেয়নি আমার ভগিনী। মায় মুখসুদ্ধির মশলা, দাঁত খোঁচাবার নিমের খড়কে এবং গায়ে মাখবার সর্ষের তেল। হীরালালের বৌদি এসে গম্ভীরভাবে বললেন, দুটো জিনিস কিন্তু আনতে ভুলে গেছেন ঠাকুরপো।
বললাম, কি জিনিস?
—চাট্টে চাল আর একটু নুন!
গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বললাম, চিন্তিত হবেন না! ওগুলো পার্শেলেও এসে পড়তে পারে।
সকলের সম্মিলিত হাসি।
যশোর থেকে মাইল পনেরো দূর কী একটা গ্রামে কনের বাড়ি। সকাল সকাল খাওয়া- দাওয়া সেরে দু-খানা বড় নৌকো করে রওনা দিল বর আর বরযাত্রীর দল। বর্ষাকাল। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে, পাটক্ষেত পাশে ফেলে কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে, খাল বিল মাঠ পেরিয়ে নৌকো চলল। দু’ধারে আম-কাঁঠাল-নারকেল-সুপারির বন। বাঁশ-ঝোপ নুয়ে পড়েছে জলের উপর। সন্ধ্যার মুখে গিয়ে পৌঁছলাম ওদের ঘাটে। সেখান থেকে হাঁটাপথে এক মাইল। গোটা তিনেক হারিকেন লণ্ঠন নিয়ে অপেক্ষা করছেন কনেপক্ষ। বরযাত্রীদলে গুঞ্জন উঠল—বরের জন্যে পালকি আসেনি, এ কি রকম ব্যবস্থা? হীরালালের বাবা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে চাপাগলায় বললেন, এ তোমাদের ভারি অন্যায়। পালকি আসবে কোত্থেকে তা বোঝ না? মেয়েটার মা নেই, বাপ নেই। গরীব ভগ্নিপতি বামুনপণ্ডিত মানুষ, কোনো রকমে নমো নমো করে পার করছে শালীটিকে!
একটু থেমে আবার বললেন, গাড়ি-পালকি দেখে তো আর বিয়ে দিচ্ছি না। দেখেছি শুধু মেয়েটিকে। মায়ের আমার সাক্ষাৎ কমলার মতো রূপ। ভালোয় ভালোয় দু-হাত এক হোক। ঘরের বৌ ঘরে নিয়ে যাই। গাড়ি পালকি ওখানে গিয়ে চড়বে যত খুশি। কি বলব বাবা, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে এটুকু হেঁটে যেতে? —বলে বৃদ্ধ আমার পিঠে হাত রাখলেন। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না। আমার বেশ ভাল লাগছে কাকাবাবু।’
চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা দু-তিনখানা খড়ের ঘর। তারই একটিতে বর এবং বরযাত্রীদের বসবার ব্যবস্থা। পরিপাটি করে গোবর নিকানো মাটির মেঝে। তার উপর ফরাস। বরের জন্যে একখানা পাড়ের সুতো দিয়ে তৈরী আসন। ঝালর দেওয়া তাকিয়া। আসনে একটি চমৎকার হরিণ, তাকিয়ার গায়ে সুদৃশ্য গোলাপ। সুরুচি এবং সূক্ষ্মশিল্পের পরিচয়। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। কনেপক্ষের একটি ভদ্রলোক লক্ষ্য করে বললেন, এ সবই মেয়ের হাতের কাজ। বললাম, ভারি সুন্দর তো? হীরালালের মুখে খুশি এবং গর্বের ঝলক খেলে গেল।
নটায় লগ্ন। বরের ডাক পড়ল বিবাহ-সভায়। ওর একটু বাইরে যাওয়া দরকার। বাড়ির গায়ে পুরানো পুকুর। সরু পায়ে-চলার পথ। দু-ধারে জঙ্গল। হ্যারিকেন নিয়ে একজন লোক চলল পথ দেখিয়ে। ওখানেই বসুন, আর ওদিকে যাবেন না—বললে পেছন থেকে। হীরালাল লাজুক মানুষ, তায় নতুন বর। আর একটু এগিয়ে গেল পুকুরপাড়ের দিকে। তারপরেই এক চিৎকার। লোকটি ছুটে গিয়ে দেখল, পায়ের একটা আঙুল থেকে রক্ত ঝরছে। লোকজন ভেঙে পড়ল লাঠিসোটা মশাল নিয়ে। খানিক খোঁজাখুঁজির পর ধরা পড়ল সাপ। সাক্ষাৎ যম। ওদেশে বলে খৈয়ে গোর্খা। হীরালালকে তার আগেই ধরাধরি করে আনা হয়েছিল বৈঠকখানায়। ওঝা এসে ঝাড়ফুঁক শুরু করল। ডাক্তার একজন এলেন ব্যাগ হাতে করে। কিন্তু হীরালাল আর চোখ খুলল না, কথাও বলল না- ঘণ্টাখানেক পরে তার ফর্সা দেহ নীল হয়ে গেল। মুখ দিয়ে উঠল গাঁজলা। আরও কিছুক্ষণ পরে ও-অঞ্চলের সব চেয়ে বড় ওঝা এসে ওর চুল ধরে আলগোছে টান দিলেন। একটা গোছা উঠে এল হাতের মুঠোয়। ওঝার মুখ কালো হয়ে গেল। বিড়-বিড় করে বললেন, আর আশা নেই।
ভিতরে-বাইরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কনের ভগ্নিপতি হায় হায় করে বেড়াচ্ছেন; আর নিশ্চল পাথর হয়ে বসে আছেন বরের বাপ। মাঝখানে একবার কাকে যেন বললেন, দ্যাখ তো পালকি পাওয়া যায় কিনা ঘাট পর্যন্ত। টাকা যা চায়, দেবো। তোমাদের বড্ড শখ ছিল..। এমন সময় কে এসে জানাল কনে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সে-কথা শুনে কারও কোনো চাঞ্চল্য দেখা দিল না। যে-যেমন ছিল, বসে রইল মৃতদেহের চারদিকে। আমি ছিলাম এক কোণে। একটি কিশোরী মেয়ে এসে বলল, আপনি একবার ভেতরে আসুন। কোথায়, কেন, কে ডাকছে, কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে যন্ত্রচালিতের মতো চললাম ওর পেছনে। উঠোনে বিয়ের সমস্ত আয়োজন তেমনি সাজানো। তার পাশ দিয়ে নিয়ে গেল একটা ঘরে। বারান্দা পার হয়ে দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। পরনে লাল চেলি। কপাল এবং কপাল জুড়ে শ্বেত-চন্দনের আলপনা। হাতে গলায় সামান্য দু-একখানা অলঙ্কার। একটা নতুন পাটির উপর যে-মেয়েটি চোখ বুজে শুয়ে আছে মনে হল সে মেয়ে নয়, কোনো সুদক্ষ শিল্পীর হাতে-গড়া প্রতিমা।
একদল মেয়েমানুষ চারদিকে ভিড় করে কলরব করছিল। আমাকে দেখে সব সরে গেল। আধঘোমটা-পরা একটি মহিলা এগিয়ে এসে ধরা গলায় বললেন, দেখুন তো ভাই, এটারও বোধ হয় হয়ে গেল। চোখ খুলছে না, সাড়াও দিচ্ছে না।
অনুমান করলাম, উনিই কনের দিদি। গায়ের চাদরটা খুলে রেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, জল নিয়ে আসুন এক বালতি। আর জানলার কাছ থেকে সবাই সরে যান আপনারা। মুহূর্ত-মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেবার পর চোখের পাপড়ি দুটো কেঁপে উঠল দু-একবার। তারপর আস্তে আস্তে খুলে গেল। বেরিয়ে পড়ল দুটি অপূর্ব নীল তারা। নীলোৎপল কথাটা কাব্যে পড়েছি। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। প্রথমটা যেন ও কিছুই বুঝতে পারলো না। হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। বুকের উপর ক্ষিপ্রহস্তে টেনে নিল স্খলিত আঁচলখানা। ধড়ফড় করে উঠে বসে গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে দিল পরনের শাড়ি। আমি তাড়াতাড়ি কাঁধের পাশটা ধরে শুইয়ে দিয়ে বললাম, না, না, উঠবেন না। শুয়ে থাকুন। ওর দিদির দিকে চেয়ে বললাম, একটু দুধ নিয়ে আসুন, গরম দুধ। মেয়েটি পাশ ফিরে চোখ বুজল। হ্যারিকেনের মৃদু আলোকে দেখলাম চোখ দুটোর কোল গড়িয়ে পড়ছে জলের ফোঁটা।
উঠোনের একধারে একটা ছোটখাটো বৈঠক বসেছে। গ্রাম্য-প্রধানের দল। সকলেই বয়সে প্রবীণ। সেখান দিয়ে যখন বৈঠকখানায় ফিরে যাচ্ছি, একজন প্রশ্ন করলেন, জ্ঞান ফিরল, বাবা? মাথা নেড়ে বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
—না ফিরলেই ছিল ভালো, বলে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। আরেকজন বললেন, যে গেল, সে তো গেলই। এবার যে রইল তার একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়। তুমি দাঁড়িয়ে কেন বাবা? বসো। ওরে, কে আছিস? একটা টুল-ঠুল নিয়ে আয় তো।
আমি সেই শতরঞ্চির একধারে বসে পড়ে বললাম, না, না, টুল দরকার নেই। আমি এইখানেই বসছি।
—আহা, ধুলোর মধ্যে বসলে! দাঁড়াও, একটু ঝেড়ে দিচ্ছি। কলকাতার ছেলে। এসেছ আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে। তারপর এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল। তোমার বড্ড কষ্ট হল, বাবা।—ভদ্রলোক তাঁর কাঁধের গামছা দিয়ে ধুলো ঝাড়তে লাগলেন। এদিকে একজন তামাক টানছিলেন। হুঁকোটা অন্য হাতে চালান করে আগের প্রস্তাবের জের টেনে বললেন, ব্যবস্থা আর কি? বিয়ে তো দিতেই হবে রাতের মধ্যে। তা না হলে সমাজে পতিত হবেন যাদব বাবাজী। আর মেয়েটাকেও থাকতে হবে আজীবন আইবুড়ো।
যাদববাবু কনের ভগ্নীপতি। হাতজোড় করে বললেন, আপনারা পাঁচজন আছেন। গরীবকে যেমন করে হোক উদ্ধার করুন। এখন আর ভালমন্দ বাছবিচারের সময় নেই
আগের ভদ্রলোকটি বললেন, হুঁ, মুশকিলের কথা। ছেলে-ছোকরাগুলো বেশীর ভাগ বিদেশে। হাতের কাছে কাউকে তো দেখছি না। এক বিপিন চাটুজ্জে মশাই আছেন। বয়স হয়েছে বটে, সংসারও তিনটে, তবে কুলীন সন্তানের পক্ষে সেটা বেশী কিছু না। তাছাড়া অবস্থা ভালো। উনি যদি রাজী হন, মেয়েটা যাই হোক, খাওয়া-পরার কষ্ট পাবে না।’
যাদব বললেন, উনি রাজী হবেন কি?
—তা হবেন, বললেন একটি দন্তহীন ভদ্রলোক। শালীটি তো তোমার ডানাকাটা পরী হে। তবে নগদ কিছু দিতে হবে।
—তা দেবো। তবে জানেন তো আমার অবস্থা। আপনারা দয়া করে একটু বলেকয়ে দেখুন। আমিও হাতে পায়ে ধরি গিয়ে। যতটা অনুগ্রহ করেন।
—আমাদের যতদূর সাধ্য, আমরা নিশ্চয়ই করবো, বললেন আগেকার সেই ভদ্রলোকটি, —মেয়ে নয়, বোন নয়, শালী। তবু তুমি যা করেছ বাবাজী, ক’জনে করে আজকাল?
—সে কথা একশোবার। সে আমরা সবাই বলাবলি করেছি। বললেন মুরুব্বিগোছের আরেকজন।
—তাহলে আর দেরি নয়। চল, সবাই মিলে চেপে ধরি গিয়ে চাটুজ্জেকে। রাত তো আর বেশি বাকি নেই।
.
কয়েক মিনিট ছেদ পড়ল মতীশের গল্পে। জ্যোৎস্নালোকে তার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল, একটু যেন ইতস্তত করছেন ভদ্রলোক। বললাম, আপনার সঙ্কোচের কোনো কারণ নেই, মতীশবাবু। বয়সে আমি হয়তো চার-পাঁচ বছরের বড়। আমাদের পরিচয়ের পরিমাণটাও চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশী নয়। তবু এই জেলের সর্দারটিকে বন্ধু বলেই মনে করতে পারেন।
—সে কথা কেন বলছেন দাদা! আহত সুরে বললেন মতীশবাবু। আগেই তো বলেছি, একান্ত আপনার জন না হলে কাউকে এসব কথা বলা যায়? সেজন্য নয়। সে রাতটা যেন চোখের উপর দেখতে পাচ্ছি। এমনি জ্যোৎস্না উঠেছিল সেদিন। বর্ষারাত হলেও আকাশ ছিল এমনি নির্মেঘ। যাক্ ….। ওঁরা ওঠবার আয়োজন করতেই কেমন ওলটপালট হয়ে গেল আমার বুকের ভেতরটা। হ্যাঁ, বাড়ির কথা মনে পড়েছিল বৈকি! বাবার কঠিন মুখ, মায়ের চোখের জল, ছোট বোনের বিষমাখা শ্লেষ, এবং তার চেয়েও ভয়ঙ্কর আমাদের হাতীবাগান বাগবাজার আর কালীঘাটের রুদ্রমূর্তি! সবই দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের উপর। কিন্তু সে সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছিল একখানি কুণ্ঠাজড়িত মুখ আর দুটি অসহায় চোখের নীল তারা। মনে হয়েছিল এ অপূর্ব সম্পদ যেন আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল বিধাতার হাতে। তা যদি না হবে, এদেশে আমি আসবো কেন, হীরালাল এমন করে মরবে কেন, আর এত লোক থাকতে আমারই বা ডাক পড়বে কেন তার মূর্ছিতা কনের চোখে জল ছিটাবার জন্যে?
যাদববাবু ঘর থেকে একটা চাদর নিয়ে ফিরে আসতেই উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, অনুমতি করেন তো, আমার একটা কথা বলবার ছিল।
উনি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বলুন!
—আমাকে যদি অযোগ্য মনে না করেন, আর আপনার শ্যালিকার যদি আপত্তি না থাকে, ওঁকে তাহলে—আমরা নৈকষ্য কুলীন। পদবী গঙ্গোপাধ্যায়।
যাদববাবু আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন, এতখানি সৌভাগ্য কি আমার সইবে ভাই?
চারিদিকে সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। একজন বললেন, কলকাতার ছেলে তো। প্রাণ আছে, দয়াধর্ম আছে। আর একজন বলে উঠলেন, ভগবান ওকে পাঠিয়েছেন, যাদব। উনি নররূপী দেবতা। এমনিধারা সব মন্তব্য। কথাটা হীরালালের বাবার কানে গেল। আমাকে ডেকে পাঠালেন। অপরাধীর মতো কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম! এগিয়ে এসে হঠাৎ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করছি বাবা, তুমি সুখী হও। আমার মাকে কোনোদিন অনাদর কোরো না।
এতক্ষণে তাঁর চোখে জল দেখা দিল।
এপাশে আমার বন্ধুর মৃতদেহ পালকি চড়ে গেল নদীর ঘাটে। ওপাশে আমি গিয়ে বসলাম বরের আসনে। একদিকে হরিধ্বনি, আরেকদিকে হুলুধ্বনি। প্রতিটি মন্ত্র স্পষ্ট করে এবং শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করে মল্লিকাকে গ্রহণ করলাম।
.
মতীশের মৃদুকণ্ঠ হঠাৎ বন্ধ হল।
বললাম, তারপর?
—তারপর-এর তো আর শেষ নেই দাদা। এ তো কেবল শুরু। কিন্তু এবার আমাকে ট্রেন ধরতে হবে।
—ট্রেন ধরবে কাল বেলা একটায়।
মতীশ চুপ করে রইল।
বললাম, বন্ধু বলে যখন স্বীকার করেছ ভায়া, বুকখানা একটু হালকা করে যাও। এখনও অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে।
ডান হাতখানা রাখলাম ওর পিঠের উপর! মতীশ বসে ছিল দু-হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে। জ্যোৎস্নালোকে দেখলাম তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।
ধীরে ধীরে বারংবার বিরাম নিয়ে মতীশ বলে গেল তার স্বল্পজীবী বিবাহিত জীবনের সুদীর্ঘ কাহিনী। মাত্র দুটি বছরের ইতিহাস। কিন্তু তার প্রতিটি দিন বেদনায় ম্লান, প্রতিটি রাত্রি দুঃখে নিবিড়। নিঃশব্দে শুনে গেলাম। যখন শেষ হল, চাঁদ অস্ত গেছে। রাত কত জানি না। অন্ধকার মাঠে চার-পাঁচটা আলো ছুটোছুটি করছে। মতীশ বলল, অতগুলো আলো নিয়ে ঘুরছে কারা?’
বললাম, সিপাইরা আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। তোমার বৌদি হয়তো পুলিসেও খবর দিয়ে থাকবেন। আর বসে থাকা নিরাপদ নয়।
মতীশের শ্রোতা সেদিন যে-মন নিয়ে প্রায় সমস্ত রাত ধরে তার কাহিনী শুনেছিল, আমার শ্রোতাদের কাছে সে মনোযোগ আশা করবো, এতটা বুদ্ধিভ্রংশ আমার ঘটেনি। তাই যে-কথা আপনার কাছে তুচ্ছ, কিন্তু তার কাছে অমূল্য, সে সব রইল অনুক্ত। বর্ণ মাধুর্যের সমস্ত রস রইল আমার কাছে। যেটুকু দিলাম, সেটা শুধু রেখাচিত্র, আপনারা যাকে বলেন স্কেচ্
সকালের গাড়িতে বৌ নিয়ে মতীশ এসে উঠল তাদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে। দরজা খোলাই ছিল। সিঁড়ির মুখেই মঞ্জরীর সঙ্গে দেখা।
—এ কে, দাদা?
—তোর বৌদি।
—মানে?
—’বৌদি’ কথাটার মানে বুঝিস না, তোকে তো এতটা মুখ্যু বলে জানতাম না। মল্লিকার দিকে ফিরে বলল, আমার ছোট বোন মঞ্জরী।
মল্লিকা কুণ্ঠিত হাসি-মুখে এক পা এগিয়ে গেল ননদের দিকে। সে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরে গেল ঝড়ের মতো। মতীশ বৌ নিয়ে উপরে উঠে গেল। মার ঘরের সামনে গিয়ে ডাকল, মা!
—কে, মতীশ এলি?
ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। পরনে পট্টবাস। এইমাত্র আহ্নিক সেরে উঠেছেন।
—তোমার বৌ নিয়ে এলাম মা, কাষ্ঠহাসি হেসে বললে মতীশ। মল্লিকা নত হয়ে প্রণাম করতে গেল, সুহাসিনী চৌকাঠের ওপার থেকেই শুষ্ককণ্ঠে বললেন, থাক, বাছা।
বলে, খানিকটা সরে গেলেন ভিতরের দিকে। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ব্যাপার কি মতীশ?
—ব্যাপার তো দেখতেই পাচ্ছ। বিয়ে করেছি। আর যা জানতে চাও, আস্তে আস্তে বলছি। তার আগে—
কথাটা শেষ না হতেই মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কয়েক মিনিট পরেই কানে এল তার বাবার ক্রুদ্ধস্বর—অ্যাঁ? বল কি! বিয়ে হয়ে গেছে! আচ্ছা, ডেকে দাও তো হতভাগাটাকে।
ডাকতে হল না। মতীশ নিজেই গেল বাপের ঘরে। সঙ্গে সঙ্গেই উনি রুক্ষকণ্ঠে গর্জে উঠলেন, এসব কি শুনছি?
—যা শুনছেন, সত্যি।
—আমাদের অনুমতি না নিয়েই বিয়ে করেছ? খবরটা পর্যন্ত দেবার প্রয়োজন বোধ করনি?
—খবর দেবার সময় ছিল না। অনুমতি নেবারও উপায় ছিল না। সব কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন।
—শুনতে চাই না তোমার সব কথা, খেঁকিয়ে উঠলেন বিশ্বনাথবাবু, যা শুনেছি তাই যথেষ্ট। এবার তাহলে আমার কথা শোনো। অতখানি স্বাধীন যখন মনে করছ নিজেকে, তখন যাকে এনেছ, তার ভারও নিজের কাঁধেই নিতে হবে। আমি তোমার এ বিয়ে স্বীকার করি না।
মতীশ মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মনে হল সেখানেও রয়েছে এই কথারই সমর্থন ‘বেশ’ বলে বেরিয়ে এল বাবার কাছ থেকে। মায়ের ঘরের বাইরে বারান্দার এক কোণে লজ্জা আর অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে তার সদ্য-পরিণীতা স্ত্রী। গাঙ্গুলী-বাড়ির প্রথম পুত্রবধূ। কিন্তু গাঙ্গুলী-বাড়ি তাকে স্বীকার করল না।
সুটকেসটা তুলে নিয়ে মতীশ বলল, চল মল্লিকা।
মল্লিকা চোখ তুলে একবার চেয়ে দেখল স্বামীর মুখের দিকে। তারপর নিঃশব্দে তার অনুসরণ করল।
সিঁড়ির সামনেই থামতে হল। ছোট ভাই জিতেশ উপরে উঠছে। ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। হাতে টুথপেস্টের টিউব আর ব্রাশ। এই সবে ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ হল। দাদার সঙ্গে বয়সের তফাত বেশি নয়। লেখাপড়ায় অনেক তফাৎ! ফাস্ট ইয়ারেই কেটে গেল বছর দুই, অর্থাৎ নামটা আছে কলেজের খাতায়, মানুষটা থাকে ক্রিকেট ফিল্ডে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছ সুটকেস নিয়ে?
—যাচ্ছি যেখানে খুশি। তুই সর্।
—আহা, তুমি না হয় গেলে, নতুন বৌকে নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?
—তা দিয়ে তোর কাজ কি?
—তার মানে একটা হোটেল-টোটেলে গিয়ে উঠবার মতলব। তোমার তো বাপু বন্ধু- বান্ধব কেউ কোথাও নেই। জানো খালি বাড়ি আর দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং।
মল্লিকা ছিল দাদার পেছনে। তার সামনে এগিয়ে বলল, দাঁড়াও বৌদি, পেন্নামটা সেরে নিই। আমার এই দাদাটিকে তুমি এখনও চিনতে পারনি। বি-কম্ পাস করলে কি হয়, বুদ্ধি-শুদ্ধি বেজায় কম। বুককিপিং ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এসো।
বলে মল্লিকার পিঠে হাত দিয়ে একরকম জোর করেই নিয়ে চলল মার ঘরের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে বলল, আচ্ছা মা। আমি তো তোমাদের কুপুত্তুর। মুখ্যু মানুষ। ফেল করি আর ব্যাট্ পিটিয়ে বেড়াই। আমার কথার কোনো দামই নেই। তবু মাঝে মাঝে দু’একটা না বলেও তো পারি না! নতুন বৌ যদি হোটেলে গিয়ে ওঠে, গাঙ্গুলীবাড়ির মুখ উজ্জল হবে কি?
তোকে সর্দারি করতে কে বলেছে জিতু? রুক্ষকণ্ঠে সাড়া দিলেন সুহাসিনী।
—না, তা কেউ বলেনি। তবু গায়ে পড়েই বলতে হয়। যা হয়ে গেছে, একদিন যা মেনে নিতে হবে, তাকে গোড়া থেকে স্বীকার করে নেওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? বাবাকে এই সোজা কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারলে না? চল বৌদি—
উত্তরের অপেক্ষা না করেই জিতেশ তার বৌদিকে নিয়ে গেল মতীশের ঘরে। বলল, এই তোমার ঘর। বই-এর জঙ্গল বললেও পার। তাই বলে পড়বার মতো কিছু পাবে না। সব বুক-কিপিং, ব্যাঙ্কিং আর কি সব ছাই-ভস্ম। তারই মধ্যে ডুবে আছে। খিদে পেল কিনা তাও অন্য লোককে বলে দিতে হয়। দ্যাখ, এবার তুমি যদি পার এই ঘরের আর সেই সঙ্গে মানুষটার ভোল ফেরাতে। মাঝে মাঝে তার এই মুখ্যু ছোট ভাইটারও একটু খোঁজখবর নিও। নেবে তো?
জিতেশের হাসি-মুখের দিকে চেয়ে মল্লিকাও হাসতে চেষ্টা করল। তার সঙ্গে দু-চোখ ভরা জল। জিতেশ সেদিকে একবার চোখ তুলে কথা ঘুরিয়ে নিলে, আচ্ছা তাহলে তুমি এখন চানটান সেরে নাও। এই পাশেই বাথরুম। আমি একটু চায়ের চেষ্টা দেখিগে।
স্বর নামিয়ে বলল, ওটা আবার ছোড়দির ডিপার্টমেন্ট। বড্ড মুখঝামটা দেয় একটু দেরি করে উঠি বলে। আচ্ছা কদিন যাক্ না, তারপর অসময়ে চা-টার দরকার হলে তোমার কাছেই আসবো, কি বল?
আঁচলে চোখ মুছে মৃদু কণ্ঠে বলল মল্লিকা, তাই এসো ভাই।
বিকাল না হতেই নানা রঙের এবং নানা আকারের গাড়ি এসে জমতে শুরু হল গাঙ্গুলীবাড়ির গেটের সামনে। কয়েকজন আরোহী, বেশির ভাগই আরোহিণী। একে একে তাঁরা জমায়েত হলেন দোতলার হলঘরে। নিজেদের মধ্যে চলল ঘণ্টাখানেক প্রাথমিক আলোচনা। তারপর মতীশের ডাক পড়ল। সে তার চিলে কোঠার ঘরে বসে কি একটা পড়ছিল। জিতেশ এসে দরজায় হাঁক দিল আদালতের পেয়াদার ভঙ্গিতে, এক নম্বর আসামী হাজির?
—কি ব্যাপার?
–তোমাকে তলব করেছেন ওঁরা, মানে The Honourable Full Bench.
–কে কে আছেন রে?
—বললাম তো ফুল বেঞ্চ। নাম চাও? কাগজ পেন্সিল নাও। শ্যামবাজার থেকে এসেছেন ছোট পিসিমা আর তাঁর দুই মেয়ে গীতা আর রীতা। ভবানীপুর থেকে বড়দি আর তাঁর চার রত্ন, নাম ভুলে গেছি। চোরবাগান থেকে মেজো কাকীমা আর পটলডাঙা থেকে ছোড়দির শাশুড়ী। তার সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট জা কল্যাণী দেবী। আরও কারা কারা আছেন, বল তো আবার গিয়ে মুখস্থ করে আসি।
—থাক্ আর মুখস্থ করতে হবে না।
মতীশ এসে দাঁড়াল কাঠগড়ায় মাসী-পিসিদের কাছে তার হঠকারিতার কৈফিয়ত দেবার জন্যে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চলল জবানবন্দী। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে জেরা। মতীশ জানিয়ে দিল সমস্ত ঘটনা এবং দুর্ঘটনার আদ্যন্ত বিবরণ। বলল না শুধু সেইটুকু যা তার
একান্ত আপনার ধন, পৃথিবীতে আর কারও যাতে প্রয়োজন নেই। মূর্ছিতা মল্লিকার পাশে সেই কটি বিরল মুহূর্ত, যারা তার সঙ্কীর্ণ জীবনধারায় এক নিমেষে নিয়ে এসেছিল বন্যার আলোড়ন।
বিচারকমণ্ডলী রায়দান শুরু করলেন। পিসিমা বললেন, সব তো বুঝলাম বাবা। কিন্তু একথা তোমারও বোঝা উচিত ছিল, ঐ মেয়ে আমাদের দেশের নয়, সমাজের নয়, ও কখনও আপনার হবে না। তাছাড়া বাঙাল দেশের পাড়াগাঁ থেকে কত কুশিক্ষা, কত রোগের বীজ বয়ে নিয়ে এসেছে, কে জানে? ও কি আমাদের ঘরের যুগ্যি?
মঞ্জরীর শাশুড়ী ঠাণ মৃদুকণ্ঠে বললেন, বিয়ের আসনে বসতে গিয়ে যার বর অপঘাতে মারা যায়, সেই দুর্লক্ষণা কন্যা ঘরে আনে কেউ? শিক্ষিত ছেলে হয়ে এ তুমি কী কাজ করলে বাবাজী?
কাকীমা তিক্ত-কণ্ঠে বললেন, বাহাদুরি দেখাবার আর জায়গা পেলে না তুমি? হতই বা বুড়োর সঙ্গে বিয়ে, তাতে আমাদের কি? পাড়াগাঁয়ে গরীব লোকের মধ্যে ঐ রকম তো হয়। এই তো আমাদের চাকরটা সেদিন বিয়ে করে এল। কনের বয়স শুনলাম বারো, আর এ মিনসে তো ঘাটের মড়া বললেই চলে। ওরা আমাদের কে, যে ছেলের ‘কর্তব্য- জ্ঞান’ উথলে উঠল?
—কর্তব্য-জ্ঞান না ছাই! ফেটে পড়লেন বড়দিদি। চাঁদপানা মুখ দেখে বাবু আমাদের মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। কি খাইয়ে বশ করেছিল কে জানে? পাড়াগাঁয়ে মেয়েমানুষগুলো কত রকম তুকতাক জানে শুনেছি।
—আমি সেটা আগেই বলেছিলাম দিদি, যোগ করলেন মঞ্জরী, বলুক তো দাদা, সাবধান করে দিইনি যাবার সময়?
সকলের শেষে মন্তব্য করলেন গৃহকর্ত্রী—ছেলের দোষ দিয়ে কি হবে বল। ছেলেমানুষ, ভুলচুক হয়েই থাকে। বুড়ো হয়ে উনি কি করলেন! পই-পই করে বারণ করলাম, যেতে দিও না। একে বাঙাল দেশ, তায় পাড়াগাঁ। শুনলেন আমার কথা? আহা, বন্ধুর বিয়ে, যেতে চাইছে যাক্। এখন বোঝো…..
এবার ডাক পড়বার পালা দু-নম্বর আসামীর। কারও কারও মতে প্রধান আসামী। মতীশ ছুটি পেয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল তরুণীর দল। রীতা গম্ভীর মুখে বলল, ডেকে কি হবে মা? দেড় ঘণ্টা সাধ্যসাধনার পর দেড়খানা কথা শুনলাম। তাও উর্দু না তেলেগু, বোঝা গেল না।
নবীনাদের দল খিলখিল করে হেসে উঠল। বড়দির মেয়ে চামেলী লরেটোতে জুনিয়ার কেম্ব্রিজ পড়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, বৌ-এর সঙ্গে একজন Interpreter আনা তোমার উচিত ছিল, বড় মামা। ওর ঐ অভিনব ভাষা তুমি Follow করতে পার?’
মতীশ যেতে যেতে বলল, তা পারি বৈকি! তোর ঐ অভিনব ফিরিঙ্গী বাংলার চেয়ে অন্তত বেশী পারি।
চামেলীর লম্বা মুখখানা আরও লম্বা হয়ে গেল।
মঞ্জরীর জা কল্যাণী বলল, কিন্তু যাই বলুন, মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী। এরকম রূপ আমার জানাশোনার মধ্যে আমি দেখিনি।
—ছাই রূপ! ভ্রূকুটি করল মঞ্জুরী, ঘোড়ার মতো মুখ। চোখদুটো যেন আফিম খেয়ে ঢুলছে। না জানে চুল বাঁধতে, না জানে কাপড় পরতে। সকালে এসে যখন দাঁড়াল, কপালে তেল চক্চক্ করছে। তার ওপর এত বড় একটা সিঁদুরের ফোঁটা। ম্যাগো!
রীতা বলল, এখনও দেখে এলাম, মুখটা কেমন তেলা-তেলা। টয়লেটের বালাই নেই।
কল্যাণী বলল, সেই কথাই তো বলছিলাম। আমরা এই যে ক’জন রয়েছি এখানে, কারও বেলায় টয়লেটের কোনো ত্রুটি হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু ওসব না ঘষেও যা দেখাচ্ছে, কেউ দাঁড়াতে পারবে কাছাকাছি?
কল্যাণীর এই স্পষ্ট উক্তি মহিলারা কেউ প্রসন্ন মনে নিতে পারল না। অল্পবিস্তর প্রসাধনের চিহ্ন প্রবীণা নবীনা সকলের মুখেই সুস্পষ্ট। তার বিধবা শাশুড়ী ঠাকুরুণটিও সেদিকে কার্পণ্য করেননি। রীতা আবার একটা কী বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল দরজার দিকে চেয়ে। ঘরে ঢুকল ক্রিকেটের পোশাক পরা জিতেশ আর তার পেছনে গাঙ্গুলী- বাড়ির নববধূ। সকলের বিস্মিত দৃষ্টি পড়ল তার আনত মুখের উপর। জিতেশ বলল, এসো বৌদি। এখানে যারা বসে আছেন, ফাজিল মেয়েগুলো ছাড়া, সবাই তোমার গুরুজন। সকলের পায়ে কপাল ঠুকতে গেলে কপালে আইওডেক্স্ ঘষতে হবে। তার চেয়ে বরং একটা পাইকারী পেন্নাম লাগিয়ে দাও।
বড়দি রুষ্টকণ্ঠে বললেন, তোকে এসব ব্যাপারে কে ডেকেছে শুনি? ফাজিল ছেলে কোথাকার!
—আহা, ডাকেনি বলেই তো আসতে হল বড়দি। গাঙ্গুলী-বাড়ির মান-সম্মান নিয়ে তোমরা তো অনেক মাথা ঘামাচ্ছ দেখছি, নতুন বৌয়ের কাছে কি মানটা তোমাদের রইল, তাই খালি বুঝলাম না।
—আচ্ছা তুমি এবার যাও তো জিতু, বলে কল্যাণী এসে নতুন বৌয়ের হাত ধরল—এসো ভাই, আমি পরিচয় করে দিচ্ছি।
.
দিদির সংসারে সমস্ত কাজ ছিল মল্লিকার হাতে। রান্না-বান্না, বাসন বাজা, ঘর নিকানো, এমন কি গরুর সেবা পর্যন্ত। এখানে তার কোনো কাজ নেই, দু-দিনেই সে হাঁপিয়ে উঠল। এদের রান্নার জন্যে আছে ঠাকুর, ঘরের কাজের জন্যে ঝি চাকর। সকালে বিকালে চায়ের পাঠ, তাও মঞ্জুরীর হাতে। একদিন সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিল, আমায় একটু দেখিয়ে দাও না ঠাকুরঝি। মঞ্জরী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, রক্ষে কর ভাই, তোমাদের সোনার অঙ্গে এসব কঠিন কাজ সইবে না। তারপর আর যায়নি। নিজের ঘরখানা ঝেড়ে গুছিয়ে সময় আর কাটতে চায় না। বাকী সময়টা একটু-আধটু ‘পড়াশুনা করতে চেষ্টা করে। বইতে মন বসে না। চোখের উপর ভেসে ওঠে তার সেই ফেলে আসা দিদির বাড়ির দিনগুলো। নিরলস কর্মময় দিন। ভোর থেকে শুরু, অনেক রাতে শেষ। একটা ঘুমের কোল থেকে উঠে আর একটা ঘুমের কোলে নেতিয়ে পড়া। তার মধ্যে নেই আলস্যের অবসর। মল্লিকার দু-চোখ ছাপিয়ে ওঠে জলের ধারা। বইয়ের অক্ষর ঝাপসা হয়ে যায়।
এমনি একদিন সকাল বেলায় বই হাতে করে বসেছিল মল্লিকা। নীচে কি একটা সোরগোল শুনে তার তন্দ্রা ভেঙে গেল। গিয়ে শুনল, ঠাকুর আসেনি। সমস্ত মনটা তার খুশীতে নেচে উঠল। মঞ্জরী অপ্রসন্ন মুখে ঘোরাফেরা করছে, কুণ্ঠিত অনুনয়ের সুরে বলল, আজকের রান্নাটা আমি করি ঠাকুরঝি। তুমি আঁশ-কোশের মধ্যে নাই বা এলে।
—পারবে তুমি? ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল মঞ্জরী।
–মোটামুটি পারবো। ওখানকার রান্না তো বরাবর আমিই করেছি।
—ও আমার কপাল! গালে হাত দিয়ে বলল মঞ্জরী, এ কি তোমার সেই পাড়াগেঁয়ে পুঁইডাটার চচ্চড়ি, না, লাওয়ের ঘণ্ট! কি কি হবে শোনো। রুই মাছের ফ্রাই, চিংড়ির কালিয়া, বাবার জন্যে মাংসের স্টু, জিতুর জন্যে ডিমের কোপ্তা। পারবে এসব?
মল্লিকা হতাশ সুরে বলল, ও সব তো আমি জানি না ভাই। ঠাকুর রোজ যা রাঁধে, ঝাল ঝোল শুক্তো ডালনা, সেগুলো একরকম নামিয়ে দিতে পারবো, আশা করি।
—বেশ রাঁধো। তবে গাদাখানেক ঝাল দিও না যেন। তোমাদের দেশে তো কাঁচালঙ্কা ছাড়া আর কোন মশলা নেই।
খেতে বসে কর্তা প্রশ্ন করলেন, এসব কে রেঁধেছে মঞ্জু?
—তোমাদের নতুন বৌ, বাবা।
বিশ্বনাথবাবু সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পাতে কিছুই পড়ে নেই। দু-একখানা রান্না বরং পুনশ্চরূপে দেখা দিল। উনি কোনো আপত্তি করলেন না। জিতেশ সকাল সকাল কলেজ চলে গিয়েছিল। একটার সময় ফিরে খেয়েদেয়ে উপরে এল পেটে হাত বুলোতে বুলোতে।
—বৌদি?
—কি ঠাকুরপো?
—হাত দাও।
—সে কি!
—আহা হাত বাড়াও, হ্যাণ্ডশেক্ করবো।
মল্লিকা হেসে ফেলল, কেন, হ্যাণ্ডশেকের দরকার পড়ল কিসে?
চারদিকে চেয়ে গলা খাটো করে বলল জিতেশ, বুঝতে পারছ না! তোমাদের ঐ উড়ে মহারাজের পাঁচন আর ছোড়দির অরিষ্ট খেয়ে খেয়ে পেটে কড়া পড়ে গিয়েছিল। অ্যাদ্দিন পরে দুটো ভাত খেলাম।
আর একটু কাছে সরে এসে বলল, কিন্তু নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরে বসলে বৌঠাকরুণ।
— কেন?
—বাবা-মার মধ্যে পরামর্শ হচ্ছিল, ঠাকুর রেখে আর দরকার নেই। আড়ি পেতে শুনে এলাম। তোমার চাকরি পার্মানেন্ট হয়ে গেল।
—সে তো আমার সৌভাগ্য ঠাকুরপো। এ ভার যদি সত্যিই ওঁরা দেন, আমি বেঁচে গেলাম।
দিনগুলো যেমন করেই কাটুক মল্লিকার, রাতগুলো কাটে মধুর স্বপ্নের মতো। স্বামীর নিবিড় সান্নিধ্যে তার বুক দুরদুর করে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়, চোখে আসে জল। ভাবে, এত সুখ তার সইবে কি? অনেক রাত পর্যন্ত মতীশকে কাটাতে হয় তার উপরের চিলেকোঠার ঘরে। বাবা-মার ঘরের দরজা বন্ধ হলে, তারপর সে নীচে নেমে আসে। সেদিন একটা কি জটিল জিনিস পড়বার ছিল! আরও রাত হল ঘরে ফিরতে। মল্লিকা তখনও জেগে বসে আছে। মতীশ এসে শুয়ে পড়ল তার কোলের উপর। তার লম্বা লম্বা চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলল মল্লিকা, তুমি বড্ড গম্ভীর হয়ে গেছ আগের চেয়ে। হাস না, কথা বল না। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ।
মতীশ তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, কোন্ মুখে হাসব মল্লি? কি সুখেই না আমরা রেখেছি তোমায়!
—ওসব কথা বললে আমি কিন্তু সত্যিই রাগ করবো। কেন, আমার কষ্ট কিসের? তুমি কাছে আছো, এই তো আমার পরম সুখ। তাছাড়া ঠাকুরপো রয়েছে। ওর জন্যে সাধ্য কি দু-দণ্ড মন খারাপ করে থাকি?
—হ্যাঁ ঐ ছেলেটা আছে বলেই এখানে আমরা আছি। নাহলে তোমাকে নিয়ে কবে চলে যেতাম। তোমাকে এতদিন বলা হয়নি মল্লি, আমি চাকরি খুঁজছি। কলকাতায় নয়, বাইরে।
—বাইরে! চমকে উঠল মল্লিকা, বাইরে কেন?
তোমাকে নিয়ে একদিন ঘর বাঁধবো বলে। তখন আর তোমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
মল্লিকার বুকের স্পন্দন থেমে গেল যেন। নীচু হয়ে লজ্জারক্ত ডান কপালখানি রাখল স্বামীর কপালের উপর। মৃদু গুঞ্জনের সুরে বলল, এখানে আমার কোনো দুঃখ নেই।
মাসখানেকের মধ্যেই মতীশের চাকরি জুটে গেল। এলাহাবাদে কোনো একটা ব্যাঙ্কে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট্। বাবা বললেন, ‘চাকরি করবার কি দরকার পড়ল তোমার? এম. এ.-টা পাশ করলে হত না?’
—এম. এ. প্রাইভেটে দেবো, স্থির করেছি।
মা বললেন, দেশ ছেড়ে এতদূরে যাচ্ছিস কেন? এক বছর পরে উনি রিটায়ার করলে ওঁর অফিসেই তো ঢুকতে পারতিস। সায়েব কথা দিয়ে রেখেছে, উনি বলছিলেন।
—কারও কথার উপর নির্ভর করে হাতের জিনিস ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কি? মা আর উত্তর দিলেন না।
সে রাত্রে মল্লিকার চোখে ঘুম এল না। স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে এতদিনের সংযমের বাঁধ বুঝি ভেসে গেল। অনেকক্ষণ কান্নার পর বুকটা যখন একটু হালকা হয়েছে, ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, এ চাকরি তুমি ছেড়ে দাও, লক্ষ্মীটি। তোমাকে ছেড়ে আমি একটা দিন ও থাকতে পারবো না।
ওর মুখখানা দু-হাতে ধরে নিজের মুখের কাছে এনে সান্ত্বনার সুরে বলল মতীশ, এরকম ভেঙে পড়লে তো চলবে না, মল্লি। তুমি একটু শক্ত না হলে আমি জোর পাব কোথায়?
বাকী রাত ধরে চলল ওদের স্বপ্নের জাল বোনা, দু-জনে মিলে নীড় বাঁধবার স্বপ্ন। স্টেশনে তুলে দিতে গেল জিতেশ। গাড়ি ছাড়বার মিনিট কয়েক আগে বলল, ও- মাসেই আসছো তো?
মতীশ হেসে বলল, কেন, তুই তো রইলি।
—তা বৈকি, আমি উইকেট আগলাবো, না তোমার বৌ আগলাবো?
—এখন তো দুটোই আগলাতে থাক্, বলে উঠে পড়ল গাড়িতে।
দাদা চলে যাবার পর থেকে জিতেশ রোজ একবার করে উপরে মল্লিকার খোঁজ নিয়ে যায়। ‘বৌদি’ বলে হাঁক দেয়, খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে, বোনার পশম আর পড়বার বই যোগায়, ফাইফরমাস খাটে। একদিন দুপুর বেলা ঘর থেকে বেরোতেই দেখে দরজার পাশ থেকে দ্রুত বেগে সরে গেল মঞ্জরী। পালাবার ধরনটা ভালো লাগল না জিতেশের। কিন্তু এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্যও করল না। দিনকয়েক পরে বিকালের দিকে একদিন রান্নাঘরে চা করছিল মল্লিকা, মঞ্জরী এসে বলল, অসময়ে চা কেন?
—ঠাকুরপো খাবে।
—কোথায় সে?
—আমার ঘরে বসে আছে।
—চা তো সে বরাবরই নীচে এসেই খায়। আজ তোমার ঘরে কেন?
—তা তো জানি না। চাইল খেতে। করে নিয়ে যাচ্ছি এক কাপ।
পেয়ালা হাতে চলে যাচ্ছিল মল্লিকা। মঞ্জরী ডাকল, শোনো-
মল্লিকা ফিরে দাঁড়াল। মঞ্জরীর কণ্ঠ থেকে উপচে উঠল বিষ, একটাকে খেয়ে পেট ভরেনি, ঐ কচিটাকেও চিবিয়ে খেতে শুরু করেছ!
—তার মানে? শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল মল্লিকা
—এই সোজা কথাটার মানে বোঝ না, এতটা কচিখুকী তো তুমি নও বৌ! মল্লিকার চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভ্রূ-যুগলে দেখা দিল ঘৃণার কুঞ্চন। সংযত এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ছি! এত নোংরা মন তোমার ঠাকুরঝি?
উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুতপায়ে উঠে গেল উপরে। মঞ্জরী চেয়ে রইল জ্বলন্ত চোখ মেলে। তার মধ্যে যতখানি ক্রোধ, তার অনেক বেশি বিস্ময়।
জিতেশের চা খাওয়া হয়ে গেলে মল্লিকা সহজ ভাবেই বলল, আমার ঘরে আর তুমি এসো না ঠাকুরপো।
জিতেশ বিস্ময়ে বলে উঠল, কেন?
–সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না ভাই। আমি বলতে পারবো না।
—তোমাকে বলতে হবে না বৌদি, আমি বুঝেছি।
সেই দিন দু-খানা চিঠি গেল মতীশের কাছে। জিতেশ লিখল, তোমার বৌকে তুমি নিয়ে যাও দাদা। আমাকে শিগিরই দিল্লী যেতে হচ্ছে।
মল্লিকা লিখল, ওগো তুমি একবার এসো। আমি আর থাকতে পারছি না।
এলাহাবাদে গিয়ে দুপুরে চাকরি, আর সকালে-বিকালে বাড়ি খোঁজা—এই ছিল মতীশের রুটিন! শুধু বাড়ি নয়, সেই সঙ্গে একটা টিউশান্। শ’দেড়েক টাকার ভেলায় চড়ে সংসার-সমুদ্রে অবতরণের সাহস করা যায় না। মল্লিকাকে সকল রকম দুঃখ এবং দৈন্য থেকে রক্ষা করতে হবে। দিদির বাড়িতে সে অভাবের মধ্যে মানুষ হয়নি। তার চিহ্ন রয়েছে তার দেহের অটুট স্বাস্থ্যে এবং অপরূপ লাবণ্যে। মল্লিকাদের সেই ছোট্ট গ্রামখানির সঙ্গে মতীশের পরিচয় স্বল্পক্ষণের। তবু যে সামান্য কটি মানুষ তার দেখবার সুযোগ হয়েছিল, তাদের দেহে বস্ত্রের স্বল্পতা যতই থাক, পুষ্টির দীনতা চোখে পড়েনি। একদল উলঙ্গ এবং অর্ধোলঙ্গ ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে ধরেছিল, ‘কলকাতার বাবু’ নামক আজব জীবটিকে দেখবার জন্যে। তাদের চালচলনে চাকচিক্য ছিল না, কিন্তু সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটি সরল নিরাভরণ স্নিগ্ধতা। প্রবীণদের সঙ্গে আলাপ করে এটা বোঝা গিয়েছিল, ওদেশের ক্ষেতে আছে ধান, খালবিলে পুকুরে আছে মাছ, গরুর বাঁটে দুধ এবং আম কাঁঠাল বাতাবী নারিকেলের বনে অজস্র ফল। যশোর জেলার কোন্ দূর দুর্গম পল্লী প্রান্তে এই জঙ্গলে ঘেরা গ্রামখানি তার শ্যামলশ্রী নিয়ে মতীশের মনের একটা কোণ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
একথা সে অন্তর দিয়ে অনুভব করে, এই গ্রামের কোলেই একদিন কুঁড়ি হয়ে দেখা দিয়েছিল তার মল্লিকা। এরই আকাশতলে, এরই বাতাসের ছোঁয়া লেগে দিনের পর দিন তিলে তিলে মেলে ধরেছিল তার রূপমাধুরীর সমগ্র দল। সেখান থেকে উপড়ে এনে এই মমতাহীন রুক্ষতার মধ্যে কি দিয়ে তাকে বাঁচাবে এই তার একমাত্র চিন্তা।
মল্লিকার চিঠির উত্তর দিল মতীশ, আর ক’টা দিন কষ্ট করে থাকো মল্লি। আমাদের ঘর যে বাঁধা হয়নি। জিতেশকে লিখলো, তোর দিল্লী লাহোর এখন শিকেয় তুলে রাখ। যতদিন না আমি যাচ্ছি, বৌদিকে ফেলে কোথাও গেলে আর রক্ষা রাখবো না।
আরও মাসখানেক চেষ্টার পর একটা ছোট বাসা পাওয়া গেল এবং সেই সঙ্গে জুটল একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হিসাব লেখার কাজ—সন্ধ্যাবেলা দু-ঘণ্টা। মতীশের মনে হল তার মতো ভাগ্যবান কেউ নেই। সাতদিনের ছুটি নিয়ে এল কলকাতায়। এসেই শুনল, পিসিমার মেয়ে গীতার বিয়ে। মা বললেন, ওঁর প্রথম কাজ। অনেক ঘটা হবে। বার বার করে বলে গেছেন, নতুন বৌকে যেতেই হবে। না গেলে ভালো দেখায় না। অগত্যা মতীশকে রাজী হতেই হল।
সেইদিনেই বিকাল বেলা শাশুড়ীর ঘরে ডাক পড়ল মল্লিকার। গিয়ে দেখে নিক্তি আর মোটা খাতা নিয়ে বসে রয়েছে গাঙ্গুলীবাড়ির পুরানো সেকরা মতিলাল। সামনে কয়েকখানা গহনা। সুহাসিনী দেবী বললেন, তাহলে ঐ কথাই রইল, মতি। ব্রেসলেট আর ওপর- হাতের মাপটা নিয়ে নাও। চুড়ির মাপ আর নিতে হবে না। একটা চুড়ি খুলে নিলেই হবে। জিনিস কিন্তু আমার সোমবারের মধ্যেই চাই। মল্লিকার দিকে ফিরে বললেন, তোমার একটা চুড়ি খুলে দাও বৌমা।
মল্লিকা চুড়ি খুলে রাখল শাশুড়ীর সামনে। সেকরা উঠে এসে তার বাহুর উপর এক জড়োয়া আর্মলেট রেখে বলল, এটাই ঠিক হচ্ছে মা? খাসা মানিয়েছে দেখুন। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে যেতে যেতে বলল, সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রীর মতো বৌ আপনার। সাজান না কত সাজাবেন।
সন্ধ্যাবেলা বড়বাজার থেকে বেনারসীর বোঝা মাথায় নিয়ে এল কপ্পুরলাল। দোতলার হলঘরে একশ’ পাওয়ারের আলো জ্বেলে মা আর মেয়েতে মিলে ঘণ্টাখানেক চলল বাছাবাছি। তারপর মল্লিকাকে ডেকে পাঠানো হল। দোকানী একটিবার তার দিকে চেয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, রঙ পছন্দ আর দরকার হোবে না, মা। বহুমাকে সব রঙ মানিয়ে যাবে। এই নিন, বলে মল্লিকার দিকে এগিয়ে দিল চার-পাঁচখানা দামী জমকালো শাড়ি। রাত এগারোটায় মল্লিকা যখন শুতে এল, মতীশ বলল, অনেক কাপড় গয়না পেলে নাকি শুনলাম?
—হিংসা হচ্ছে বুঝি তোমার! মুখ টিপে হাসল মল্লিকা।
মতীশ সে হাসিতে যোগ দিল না, কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। মল্লিকা এগিয়ে এসে ডানহাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আহা রাগ করছ কেন? তোমাকেও কিছু ভাগ দেবো। এবার খুশি তো?
ম্লান হাসি হেসে বলল মতীশ, খুশি হবারই তো কথা। কিন্তু তুমি তো জানো না মল্লি, এ গয়না কাপড় তোমার জন্যে আসেনি, এসেছে গাঙ্গুলীবাড়ির মানরক্ষার জন্যে।
মল্লিকার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। স্বামীর আর একটু কাছে সরে এসে বলল, এ বিয়েতে যেতে কেমন যেন ভয় করছে আমার। তার চেয়ে চল না, আমরা আগেই চলে যাই। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বললে ওঁরা নিশ্চয়ই জোর করবেন না।
—বুঝিয়ে বলেছি। ওঁরা শুনবেন না। কিন্তু না—হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল মতীশ, বিয়েতে তোমাকে যেতেই হবে, ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের আমরা মারবো। ঐ বেনারসী আর জড়োয়ার অস্ত্র। ঐগুলো পরে, রানীর মতো মাথা উঁচু করে একবার তুমি গিয়ে দাঁড়াও ঐ হিংসুটে কুচক্রী ছোটলোকগুলোর মধ্যে। ওরা চেয়ে দেখুক; দেখে জ্বলে পুড়ে মরুক। ওদের সেই জ্বালা আমি একবার নিজের চোখে দেখতে চাই।
স্বামীর পাশে বসে মল্লিকা তার বুকের উপর আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এই শান্ত-শিষ্ট নিরীহ মানুষটির বুকের মধ্যে এতখানি আগুন লুকিয়ে ছিল, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কোনোদিন।
নতুন বৌকে সাজাবার ভার নিল মঞ্জরী। একদিন এসব আর্টে নাকি তার জুড়ি ছিল না। আজ কপাল পুড়েছে বলেই সাধ-আহ্লাদ তো আর নিঃশেষ হয়ে যায় নি। প্রসাধন পর্বের প্রথম অঙ্ক হল স্নানঘর। সেখান থেকেই শুরু। নিপুণ হাতে সাবান লেপনের পর মুখে কপালে যখন শুরু হল শুষ্ক তোয়ালের নির্মম ঘর্ষণ, মল্লিকা আর মুখ না খুলে পারল না—আর কত ঘষবে ঠাকুরঝি! একপরতা চামড়াই বুঝি উঠে গেল এতক্ষণে।
মঞ্জরী জবাব দিল তার স্বভাবমধুর কণ্ঠে, অঢেল আছে কিনা, তাই এত দেমাক, এত হেলা-ফেলা। দ্যাখ্ চোখ খুলে, কি ময়লাটা উঠছে! এক-চোখো বিধাতার কি কাণ্ডজ্ঞান আছে? উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে দিয়েছে। এত রূপ, তার একটু যত্ন নেই! একগাদা তেলকালি মেখে ভূত সেজে বসে আছে। পড়তিস সেরকম লোকের হাতে—
পরিহাস-তরল কণ্ঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মল্লিকা, থেমে গেল ননদের দিকে চেয়ে। হঠাৎ যেন নিশ্চল হয়ে গেছে মঞ্জরী। তার নির্নিমেষ চোখটি তারই সিক্ত দেহের উপর নিবদ্ধ। কিন্তু সেখানে তারা থেমে নেই, ভেদ করে চলে গেছে হয়তো কোনো স্মৃতি- মুখর অতীত দিনের আলোয় যার খবর মল্লিকা জানে না।
গয়না পরাতে গিয়ে বিরক্তি ফুটে উঠল মঞ্জরীর মুখে। এই রকম নেকলেস কি আজকাল কেউ পরে? মার যেমন পছন্দ! আর এই বুঝি ব্রেসলেট! দূর! বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজের গয়নার বাক্স খুলে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর তাকাল নিজের দিকে। বোধহয় মনে পড়ল সেই মঞ্জরীকে যার সর্বদেহে একদিন এরা ছিল প্রাণময় জ্যোতি। আজকের মঞ্জরীর কাছে এগুলো শুধু নিষ্প্রাণ স্বর্ণপিণ্ড। তাড়াতাড়ি কয়েকখানা অলঙ্কার বেছে নিয়ে ফিরে এল মল্লিকার কাছে। নিপুণ হাতে চলল অঙ্গসজ্জা। এক-একটা স্তর পার হয়, আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারদিক থেকে দেখে মৃৎশিল্পী যেমন করে দেখে তার হাতের গড়া দেবীমূর্তি।
দীর্ঘ প্রসাধন পর্ব যখন শেষ হল, কাছে এসে বৌ-এর রক্তাভ কপোলের উপর আলগোছে একটি ছোট্ট চুম্বন রেখে বলল, দাদার হয়ে একটিনি করলাম একটুখানি— বলেই হঠাৎ বেরিয়ে গেল ঝড়ের মতো। মল্লিকা বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইল তার এই দুর্বোধ্য, দুর্মুখ ননদটির দিকে।
জিতেশ বাড়ি নেই। ক’দিন হল তার ক্রিকেট টিম্ নিয়ে খেলতে গেছে দিল্লী। বাড়িতে আর চারটি প্রাণী। একখানা গাড়িতেই চললেন সবাই। যাবার আগে গোপন ষড়যন্ত্র হল মতীশ আর মল্লিকায়, শেষ পর্যন্ত ওদের থাকা চলবে না। ঘণ্টা দুয়েক পরেই মল্লিকার ভীষণ মাথা ধরবে কিংবা গা-বমি করবে, এবং মঞ্জরীর প্রস্তাবে মতীশের উপর ভার পড়বে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার। ওরা ট্যাক্স করে ঘুরবে। দেখবে আলোকোজ্জ্বল কলকাতার বিচিত্র রূপ। তারপর বাড়ি ফিরবে অনেক রাতে। আর দু-দিন পরেই তো চলে যাচ্ছে এ শহর ছেড়ে, কবে ফিরবে কে জানে? মল্লিকা উৎসাহিত হয়ে উঠল, বেশ হবে কিন্তু। সত্যি, কলকাতার কত গল্প শুনেছি ছেলেবেলা থেকে, একদিনও ভালো করে দেখা হল না।
মতীশ ভার নিয়েছে, সে ক্ষোভ তার মিটিয়ে দেবে এক রাতেই। এসব ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত সফল হবে কিনা, সে বিষয়ে ওদের সন্দেহ কম ছিল না। পিসিমা যদি ছাড়তে না চার্ন, মা যদি বেঁকে বসেন, মঞ্জরী যদি সাহায্য না করে—এর সবগুলো সম্ভাবনাই ছিল। কিন্তু একটা আকস্মিক ঘটনায় ওদের পথ সুগম হয়ে গেল।
তিনতলার একটি সুসজ্জিত প্রশস্ত কক্ষে নিমন্ত্রিতা মেয়েরা জড় হয়েছেন। অত্যুজ্জ্বল তড়িতালোকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্বলছে রূপ আর বেশভূষার চমক। কনেও আছে তাদের মধ্যে। বরপক্ষের একটি বর্ষীয়সী মহিলা ঘরে ঢুকলেন, কই আমাদের বৌ কই, মা-লক্ষ্মী কই গো? একবার চারদিকটা চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন মল্লিকার কাছে, এই বুঝি? বাঃ, মেয়ে সুন্দর শুনেছি। এত সুন্দর, এ যে স্বয়ং মা-দুগ্গা গো। মুখখানা দ্যাখ, একেবারে ঠাকুর-দেবতার মুখ…..
মল্লিকা বিব্রত হয়ে পড়ল। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। তবু বুঝতে পারছে চারদিক থেকে সবগুলি চোখই তার উপর উদ্যত এবং তাদের কোনোটাই প্ৰসন্ন নয়। এমন সময় কে একজন তাকে রক্ষা করল।
—এই যে কনে, এই দিকে আসুন ঠাকুরমা, বলে কাণ্ডজ্ঞানহীনা বৃদ্ধার হাত ধরে নিয়ে গেল আসল কনের কাছে। তিনি স্পষ্টত নিরাশ হলেন।
খবরটা যখন কনের মায়ের কানে পৌঁছল, তিনি হলেন ক্ষিপ্ত। কী দরকার ছিল মাঝখানে জাঁকিয়ে বসবার? রূপ না হয় আছে, তাই বলে এতখানি দেমাক কিসের? এসেছো তো বাপু কোন্ হাড়ফুটোর ঘর থেকে। বাসন মেজে মেজে হাতে কড়া পড়ে গেছে।—ইত্যাদি মধুর বাক্যের গুঞ্জরণ উঠল ঘরে ঘরে এবং তার সবটুকুই এসে পৌঁছল মল্লিকার কানে। সুতরাং মাথাটা তার সত্যিই ধরল এবং চলে যাবার প্রস্তাবে একবাক্যে সম্মতি দিলেন স্নেহময়ী অভিভাবিকার দল।
প্রকাণ্ড একখানা নতুন ক্রাইসলার গাড়ি। গম্ভীর হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে চলেছে চৌরঙ্গীর বুকের উপর দিয়ে। স্বামীর বাহুবন্ধনে ধরা দিয়ে পিছনের সিটে যখন ডুবে গেল মল্লিকা, তার মনে হতে লাগল সেই একটি মাত্র কথা, এত সুখ তার সইবে তো? মতীশের জীবনেও কোনোদিন আসেনি এমনিধারা উচ্ছল মুহূর্ত। তার মনে জেগেছে উৎসবের জোয়ার। এ যেন তারই বিবাহরাত্রি। রূপৈশ্বর্য-মণ্ডিতা যে অগ্নিশিখার উত্তপ্ত স্পর্শ জড়িয়ে আছে তার অঙ্গে সে যেন তার সদ্যলব্ধা নববধূ। মল্লিকা যেন আজই প্রথম এসেছে তার জীবনে। তাকে সে আরও একান্ত, আরও নিবিড় করে পেতে চায়। হঠাৎ একসময়ে দু-খানা মুখের ব্যবধান যখন অতন্ত সংকীর্ণ হয়ে এল, মল্লিকা আস্তে ঢেলে দিল স্বামীকে, ফিফিস্ করে বলল, দেখছে যে লোকটা!
—ওর পেছনে দুটো চোখ আছে নাকি? তেমনি চুপি চুপি বলল মতীশ।
—বাঃ, বুঝতে পারে তো!
কিন্তু এসব কোন যুক্তিই টিকল না। ব্যবধান ঘুচে গেল। তার জন্যে ও তরফেও যে কোনো সত্যিকার আপত্তি ছিল মনে হল না।
ঘণ্টাতিনেক ঘুরে আমহার্স্ট স্ট্রীটে যখন এসে পৌঁছল, তার আগেই বেশ জোরে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ওদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হল। মতীশ নেমে পড়ল। মল্লিকাও নামতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে বলল মতীশ, দাঁড়াও দরজা খুলুক আগে, ভিজে ঢোল হয়ে যাবে যে!
—তা হোক, আমি নামবো; কোণের দিকে সরে আসতে আসতে বলল মল্লিকা। ততক্ষণে গাড়ির দরজা বন্ধ করে এগিয়ে গেছে মতীশ। ফুটপাথ পার হয়ে কড়া নাড়তে যাবে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চীৎকার শুনে পেছনে ফিরে দেখে, গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
‘রোখো, রোখো, এই ড্রাইভার! এই ট্যাক্সি! চোর! চোর! পাকড়ো।’ উন্মাদের মতো চীৎকার করতে করতে ছুটল মতীশ। তার আগেই তার মুখের উপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বিদ্যুৎবেগে মিলিয়ে গেছে ট্যাক্সি। রাস্তায় জনমানব নেই। দোকানপাট বন্ধ। শুধু সাক্ষীগোপালের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে ল্যাম্প পোস্টগুলো।
মতীশ বাড়ি ফিরল না। মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো সারারাত। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতে ভোরবেলা গেল থানায় খবর দিতে। গাড়ির নম্বর জানা নেই। কি গাড়ি তাও মনে করতে পারলে না! পাঞ্জাবী ড্রাইভার, এইটুকু তথ্য শুধু জানতে পারলেন থানা অফিসার।
পরদিন বেলা আটটার সময় একখানা রিকসা করে সে যখন বাড়ি ফিরল, তখন আর চলবার শক্তি নেই। টলতে টলতে বসে পড়ল উঠানের পাশে। মা ছুটে এলেন, কোথায় ছিলি সারারাত! এ কি চেহারা হয়েছে ছেলের! বৌমা কই?
কি জবাব দেবে মতীশ? হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে একবার শুধু বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে মা। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কর্তার এক বন্ধু ছিলেন পুলিশের উচ্চ মহলে। ট্যাক্সি করে ছুটলেন তাঁর কাছে। থানায় থানায় সাড়া পড়ে গেল। শহর এবং শহরতলিতে শুরু হল সন্ধান। টেলিগ্রাম ছড়িয়ে পড়ল এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে। দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল, প্রত্যাশিত খবর এসে পৌঁছল না।
তৃতীয় দিন ঝি আসছিল কাজে, চারদিক তখনো ফরসা হয়নি। বাইরের রোয়াকে ঝুঁকে পড়ে কি একটা দেখছে দুজন উড়ে মিস্ত্রি, হাতে তাদের রাস্তায় জল দেবার হোজ- পাইপ
—কী গা? হেঁকে বলল ঝি।
এগিয়ে গিয়ে একপলক দেখেই চেঁচিয়ে উঠল কালীদাসী—ওমা, এ যে আমাদের বৌদিদিমণি!
ধরাধরি করে ওর নিজের ঘরে তোলা হল বৌকে। নিরাভরণ দেহ। আবরণও নেই বললেই চলে! একটা নোংরা ধূতি কোনো রকমে জড়ানো। মতীশ আছড়ে পড়ল সংজ্ঞাহীনার বুকের উপর। চিৎকার করে ডাকল, মল্লি, মল্লিকা! কেউ সাড়া দিল না।
খবর পেয়ে ডাক্তার এলেন। মোটামুটি পরীক্ষা করে ক্ষিপ্রহস্তে লিখলেন প্রেসক্রিপশন। সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় নেই, ভাল হয়ে যাবে। তারপর কর্তার ঘরে গিয়ে বললেন, Physical injury যেটা হয়েছে, তার জন্যে ভাবি না। কিন্তু nerve-এর shock কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। Treatment তো আছেই, তার চেয়েও বেশী দরকার long and patient nurse — দরদ এবং সেবা। দু-দিন একদিন নয়, বোধহয় কয়েক মাস।
ঘরভর্তি লোক। সবাই নিস্পন্দ। নিঃশব্দে চেয়ে আছে ডাক্তারের মুখের দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল মঞ্জরী। দৃঢ়কণ্ঠে বলল, সেজন্য ভাববেন না ডাক্তার কাকা। আমাদের তো কোনো কাজ নেই! ও ভার আমি নিলাম।
—তুমি কি পারবে, মা? সন্দেহের সুরে বললেন বৃদ্ধ ডাক্তার।
—কেন পারবো না?
—ওটা আনাড়ি হাতের কাজ নয়। নার্সিং-এর জন্যে প্রাণ চাই নিশ্চয়ই, কিন্তু তার সঙ্গে চাই ট্রেনিং।
কর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল বৌকে আপাতত কোনো নার্সিং হোমে পাঠানো হবে। সেখানে তার ভার নিয়ে থাকবে দুজন সুদক্ষ নার্স! অবিলম্বে তার ব্যবস্থা করবার জন্যে ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন।
প্রথম যেদিন জ্ঞান হল মল্লিকার, চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল চারদিকে। বোধহয় মনে করতে চেষ্টা করল সব কথা। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমি কোথায়? মতীশ কাছেই ছিল, ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি আমার কাছে আছ, মল্লি।
—তুমি! না-না, ভীতকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল মল্লিকা, সরে যাও। আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁতে নেই-
—সে কি কথা মল্লি! ওকে জড়িয়ে ধরে বলল মতীশ, আমি, আমি! আমার কাছে রয়েছ তুমি।
—ওগো তোমার পায়ে পড়ি, আমায় ছেড়ে দাও। আমি অশুচি, অস্পৃশ্য। আমার যে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
চিৎকার শুনে ছুটে এল সিনিয়র নার্স মিস্ সরকার। বিরক্তির সুরে বলল, করছেন কি! ছেড়ে দিন ওকে।
মতীশ অপরাধীর মতো উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ উত্তেজনার পর ক্লান্ত, অসাড় হয়ে চোখ বুজল মল্লিকা। নার্স তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে পাল্সে হাত রাখল।
মতীশের উপর কড়া হুকুমজারি হল, ডাক্তারের অনুমতি যতদিন না মেলে মল্লিকার ঘরে তার প্রবেশ নিষেধ। তবু বিকেল হলে নার্সিং হোমের অফিসে গিয়ে ধর্না দেয়, মিস্ সরকারের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছে আজ। উত্তর প্রায় একই—একটু ভালো কিংবা আগের মতোই। এমন সময় এলাহাবাদ থেকে চিঠি এল—আর ছুটি দেওয়া হবে না। অবিলম্বে জয়েন না করলে তারা অন্য লোক দেখে নেবে। উত্তরে তৎক্ষণাৎ ইস্তফা পত্র লিখে ফেলল মতীশ। তারপর কি ভেবে আস্তে আস্তে ছিঁড়ে ফেলে দিল। মনে পড়ল মল্লিকার সেই কথাগুলো—চল আমরা বিয়ের আগেই চলে যাই। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বল, ওঁরা নিশ্চয়ই জোর করবেন না। ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন এখনও তো নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
মঞ্জরী রোজ একবার করে যায় নার্সিং হোমে। সেদিন ওকে একটু সুস্থ দেখে বলল, দাদাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস কেন রে? পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেচারা।
মল্লিকার মুখখানা করুণ হয়ে উঠল। বলল, ওকে তুমি দেখো, ভাই।
—আমি দেখবো, মানে? তুই কি বাড়ি-টাড়ি যাবি না নাকি? কদ্দিন আর এই হাসপাতালে শুয়ে থাকতে চাস শুনি?
—বাড়ি যাবার পথ তো আমার আর নেই ঠাকুরঝি।
—সে আবার কী কথা!
মল্লিকা একটু চুপ করে থেকে বলল, যা হারিয়েছি, তার চেয়ে বড় মেয়েমানুষের আর কী আছে ভাই? সে-কথা উনি না বুঝতে পারেন, মেয়ে হয়ে তুমি তো বোঝো। এই দেহটা কি আর তার পায়ে রাখা যায়, না এ দিয়ে তার সেবা চলে?
মঞ্জরী উষ্ণকণ্ঠে বলল, দ্যাখ্ বৌ, তোর এই সব পণ্ডিতি-বুলি শুনলে আমার গা জ্বালা করে। দেহের কথা বলছিস? কিন্তু একে বাঁচাবার কোনো উপায় তো তোর হাতে ছিল না?
—তা ছিল না। কিন্তু তাই বলে যা ঘটল তার ফলটা তুমি অস্বীকার করবে কেমন করে? ভূমিকম্পে যখন বাড়ি ভেঙে পড়ে, তার উপরেও বাড়ির কোনো হাত নেই! তবু সেই ভেঙে পড়াটা সত্যি। তার ফলভোগও ঐ বাড়িকেই করতে হয়।
মঞ্জরী অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, কি জানি ভাই, তোমার ওসব বড় বড় তত্ত্বকথা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি মুখ্যু মানুষ, সহজ বুদ্ধিতে বুঝি, পাপ পুণ্য শুচি অশুচি—এসব বোধ হল মনের। দেহের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক? দেহে যদি দাগ লেগেও থাকে, মনকে তা স্পর্শ করবে কেন? সেই জানোয়ারটাকে তো তুই ভালবেসে আত্মদান করিসনি!
—না ভাই, তা করিনি। তবু দেহের দাগ মনের গায়েও লাগে। শরীরটা যখন বাসের অযোগ্য হয়ে গেল, মন দাঁড়াবে কিসের ওপর? দেহই না মনের আধার?
মঞ্জরীর দৃষ্টি ছিল জানালার বাইরে। সেই দিকে চেয়েই মৃদু কণ্ঠে বলল, তোর কথার ঠিক জবাব আমি দিতে পারবো না বৌ! সে বিদ্যা আমার নেই! আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, তোর কপালে যা ঘটেছে সেটা যদি আমার হত, আমি তাকে স্রেফ একটা দুঃস্বপ্নের মতো ঝেড়ে ফেলে দিতাম। একদিন এক পশুর হাতে পড়েছিলাম বলে তার দাঁতের বিষ আর নখের আঁচড়টাই আমার জীবনে সত্য হয়ে থাকবে, আর মিথ্যে হয়ে যাবে আমার চিরদিনের দেবতার অমৃত-স্পর্শ, একথা আমি কিছুতেই মানতে পারি না।
মল্লিকার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় বৌ, তুই বড় স্বার্থপর। খালি নিজেকে নিয়েই আছিস। নিজের শুচি, নিজের ধর্ম। আর একজনের দিকে দ্যাখ্, আর একজনের কথাও ভাবতে চেষ্টা কর।
ক্ষণেকের বিরতির পর মল্লিকা বলল, ঐখানেই তো আমার সব দুঃখ ঠাকুরঝি। উনি যদি আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতেন, মুখ ফিরিয়ে নিতেন আমার এই অভিশপ্ত দেহটার দিক থেকে, আমি বেঁচে যেতাম ভাই। সংসারে সব মেয়ে সারাজীবন নিতে চায় স্বামীর ভালবাসা, আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে চাইছি আমার স্বামীর ঘৃণা। কী করলে তা পাওয়া যায় বলতে পারো?
মঞ্জরী কোন উত্তর না দিয়ে রাগ করে চলে গেল। বাড়ি পৌঁছেই ঝড়ের মতো ঢুকল দাদার ঘরে। তিক্ত কণ্ঠে বলল, পরী দেখে ভুলেছিলে, এবার বোঝো! বুনো পাখি ঘরে এনে রাখলেই কি পোষ মানে, না কোনোদিন আপনার হয়!
সেই রাত্রেই মতীশ এলাহাবাদ চলে গেল।
নার্সের সঙ্গে রুগীর যে সম্পর্ক, সেটা যে কখন ওরা নিঃশব্দে পার হয়ে এসেছে, মিস্ সরকার বা মল্লিকা কেউ তা টের পায় নি। আজ ওদের সত্যিকার সম্পর্কটা কি, ওরা জানে না। শুধু জানে, ওরা দাঁড়িয়েছে একে অন্যের অন্তরের মুখোমুখি, এবং তার মাঝখানে কোনো অন্তরাল নেই।
সেদিন মঞ্জরী চলে যাবার পর বহুক্ষণ তেমনি অসাড় হয়ে পড়ে রইল মল্লিকা, ডুবে গেল তার অন্তহীন চিন্তার গহন অতলে। মিস্ সরকার কখন এসে তার শয্যার একটা কোণ দখল করেছে জানতেও পারেনি। জানতে পারল, তার ডান হাতখানা যখন পড়ল এসে ওর হাতের ওপর। চমকে উঠে বলল, ওমা! তুমি এখন এলে?
মিস্ সরকার সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, মঞ্জরী দেবী ঠিকই বলেন, দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে হলে অনেক কিছু ভুলতে হয়।
—ভুলতে যে পারি না ভাই।
—আমি কেমন করে ভুললাম? — তুমি!
—হ্যাঁ, এই আমি।
মল্লিকা পাশ ফিরে হাতখানা নার্সের কোলের উপর রেখে বলল, তুমিও কি আমারই মতো—
মিস্ সরকার হেসে বলল, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে মিল অনেক—একটু-আধটু অমিলও আছে। আমি যাদের কবলে পড়েছিলাম, তাদের মাথায় পাগড়ি ছিল না, তবে মুখে ছিল চাপদাড়ি। প্রয়োজন ফুরোবার পর তাঁরা যখন দয়া করে আমাকে মুক্তি দিয়ে গেলেন, তোমার মতো এমনি একটা নার্সিং হোম আমার কপালে জোটেনি, জুটেছিল শুধু একটা গাছতলা। সেখান থেকে নিজের অসাড় দেহটাকে নিজেই টেনে-হিঁচড়ে যখন ঘরে নিয়ে গেলাম, তখন জুটল গলাধাক্কা।
—বল কি! চমকে উঠল মল্লিকা।
—হ্যাঁ। অবিশ্যি গলায় হাত দিয়ে ধাক্কাটা কেউ মারেনি। কিন্তু যা পেলাম তার মানে ঐ দাঁড়ায়। তারপর রইল শুধু পথ। এলাম কলকাতায়। কি করে সেকথা আর জিজ্ঞেস কোরো না। বারকয়েক হাত-বদল হবার পর শেষটায় যখন বেরিয়ে এলাম, একেবারে রীতিমতো পাসকরা নার্স। আজ কে বলবে এই রমা সরকারই হচ্ছে নোয়াখালির এক প্রসিদ্ধ গ্রামের স্বনামধন্য মিত্রবংশের আদরের মেয়ে অতসী।
—নামটাও বদলে ফেলেছ?
—মানুষটাই যখন রইল না, তুচ্ছ নামটা রেখে কি লাভ হত মল্লিকা?
মল্লিকা নিজের মনে কি ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কিন্তু একটা কথা দিদি, অনেক কিছু পেয়েছ বুঝলাম। ঘর বাঁধতে তো পারনি!
—ঠিকই বলেছ। কিন্তু তার কারণ, তুমি যা ভাবছ তা নয়। তার কারণ, ঘর থেকে বাইরে নেবার অনেক সঙ্গী জুটলেও, ঘর বাঁধবার সঙ্গী আজ পর্যন্ত একটাও আসেনি। -তেমন সঙ্গী যদি পাও, তোমার দিক থেকে মনে-প্রাণে পারবে তার ঘর করতে? -কেন পারবো না?
মল্লিকা করুণ কণ্ঠে বলল, কিন্তু আমি যে পারছি না, ভাই। আমার দেবতার মতো স্বামী। তার মুখের দিকে চাইলে আমার বুক ফেটে যায়। তবু তো পারি না তার ডাকে সাড়া দিতে? মল্লিকার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। নিজের আঁচলে সস্নেহে মুছিয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল মিস্ সরকার, আমি সব জানি বোন। কিন্তু তোমার ঐ পুঁথির বুলি তোমাকে ভুলে যেতে হবে। তুমি অনেক পড়েছ, অনেক শিখেছ। সে সব শুধু বোঝা। জীবনের মাঝখান থেকে যখন টান আসে, ওগুলো কোনো কাজেই লাগে না। ওসব ঝেড়ে ফেলে তখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়।
মল্লিকা বলল, না দিদি, তুমি ভুল করছ। লেখা-পড়া যাকে বলে, আমি তা কোনোদিন শিখিনি। পাড়াগাঁয়ে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের ঘরে মানুষ। একটু বাংলা একটু সংস্কৃত। সে-সব আমার মনেও নেই। জীবনে যদি কিছু পেয়ে থাকি, পুঁথির কাছ থেকে পাইনি, পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে। আমার ভেতরে যা-কিছু দেখছ, সব ঐ একটিমাত্র মানুষের দান।
—কে তিনি?
—আমার কৈশোর-গুরু আমার দিদির স্বামী।
ঝি এসে জানাল ডাক্তারবাবু মিস্ সরকারকে ডেকে পাঠিয়েছেন। নার্স যেতে যেতে বলল, এবার উঠে মুখ হাত ধুয়ে নাও। তোমার খাবারটা এখানেই দিতে বলি।
মল্লিকা যেন শুনতেই পেল না কথাগুলো, তার দু-কান ভরে বাজতে লাগল যাদব তর্করত্নের স্নেহ-গভীর উদার কণ্ঠস্বর। মনে পড়ল, কি একটা প্রসঙ্গে একদিন তিনি বলেছিলেন, এই যে মানব-দেহ আমরা ধারণ করেছি, একে তুচ্ছ কোরো না মল্লিকা। দেহ হচ্ছে দেবতার মন্দির। একে শুচি, শুদ্ধ পবিত্র রাখলেই তার মধ্যে দেবপ্রতিষ্ঠা সম্ভব। তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছ। আজ হোক, কাল হোক একদিন তোমাকে পতিবরণ করতে হবে। স্বামী হয়ে যিনি আসবেন, তোমার এ দেহ-মন যেন তাঁর পায়ে শুদ্ধভাবে সমর্পণ করতে পার, যেমন করে আমরা নিবেদন করি দেবতার পায়ে পূজার ফুল। মনে রেখো মল্লিকা, নিখুঁত নিষ্কলঙ্ক ফুলই দেবভোগ্য। যে-ফুল আঁস্তাকুড়ে পড়েছে, যাকে কেউ পায়ে মাড়িয়ে গেছে, সে কখনও দেবতার পূজায় লাগে না।
কথাগুলো মল্লিকার অন্তস্তলে গাঁথা হয়ে গেছে। কে জানত একদিন তার নিজের জীবনেই দেখা দেবে তার মূল্য-পরীক্ষার প্রয়োজন? কিন্তু প্রয়োজন যখন সত্যিই দেখা দিল, ঘর বাঁধতে না বাঁধতেই যখন ডাক পড়ল সে ঘর ভাঙবার, সহসা দমকা বাতাসে নিবে গেল তার যৌবনারতির সদ্য-সাজানো দীপমালা, তখন সব কিছু ফেলে সমস্ত শক্তি দিয়ে একেই সে আঁকড়ে ধরল, এই আ-কৈশোর-বন্দিত নির্মম কঠিন আদর্শ। মনে মনে বলল মল্লিকা, প্রথম জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে যাকে সত্য বলে জেনেছি, তার মর্যাদা যেন কোনোক্রমে ক্ষুণ্ণ না হয়। তার জন্যে যতবড় মূল্য দিতে হয় দেবো। এই উচ্ছিষ্ট দেহ ত্যাগ করতে হয় করবো, তবু একে দিয়ে আমার দেবতার পূজা অসম্ভব।
দেখতে দেখতে প্রায় দু-মাস কেটে গেল। অনেকখানি সেরে উঠেছে মল্লিকা। নার্সিংহোমের এই সস্নেহ আশ্রয় থেকে বিদায়ের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে। ছোট্ট খাটখানির উপর শুয়ে সেই কথাই বোধ হয় ভাবছিল। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। অন্যদিনে এতক্ষণে সে উঠে পড়ে। আজ যেন কোনো তাগিদ নেই। জানালা দিয়ে নিঃশব্দে চেয়ে ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের পানে। মিস্ সরকার হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলল, ওমা তুমি এখনও শুয়ে?
—উঠতে ইচ্ছা করছে না ভাই।
নার্স মুখ টিপে হাসলো, কেন?
–কেমন যেন জোর পাচ্ছি না কদিন থেকে। মাথা তুললেই গা পাক দেয়।
মিস্ সরকার টেবিলটা গোছাতে গোছাতে বলল, তাই তো দেবে। তুমি খেতে পার আর না পার, আমাদের যে এবার পেটভরে সন্দেশ খাবার পালা।
একটু থেমে মল্লিকার সন্দিগ্ধ চোখের দিকে চেয়ে বলল, বুঝতে পারছ না? নোটিস টের পাওনি?
চোখ নামিয়ে নিল মল্লিকা। কোথা থেকে এক ঝলক রক্ত এসে পড়ল তার শীর্ণ পাণ্ডুর মুখের উপর। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তকাল। পরক্ষণেই সভয়ে দেখল নার্স, সে-মুখে একফোঁটা রক্ত নেই। যেন একখানা সাদা কাগজ। দু-চোখে ভরে উঠেছে কিসের এক গভীর আতঙ্কের ছায়া। চমকে উঠল মিস্ সরকার। ছুটে এগিয়ে গিয়ে বসল ওর বিছানার পাশটিতে। সহসা তার বুকের উপর ভেঙে পড়ল মল্লিকা, চেঁচিয়ে উঠল আর্তকণ্ঠে, এ আমায় কী শোনালে দিদি! তুমি ঠিক জানো, যে আসছে সে আমার গর্বের ধন না কলঙ্কের কালি? নার্সের মুখে এ প্রশ্নের উত্তর যোগাল না। ওকে শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে সর্বাঙ্গে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
মঞ্জরী এল পরদিন বিকালে। মিস্ সরকারের মুখে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে ঢুকল এ-ঘরে। চৌকাঠের ওপর থেকেই কলকণ্ঠের চিৎকার—কিগো পণ্ডিতমশাই, তোমার লেকচারের ঝুড়ি এবার শিকেয় উঠলো তো? বাড়ি যাবে না? এমন অনাছিষ্টি কথা ভগবান কখনো সইতে পারেন? ঘাড় ধরে নেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন পেয়াদা। কেমন জব্দ!
কাছে এসে বসতে শুষ্ক কণ্ঠে বলল মল্লিকা, বড্ড ভয় হচ্ছে ঠাকুরঝি।
—আ মর্! ভয় কিসের! ছেলে যেন ওরই হচ্ছে, আর কারও কোনোদিন হয়নি!
–না ভাই, সে কথা নয়—
—থাক্, তোমার কোনো কথাই বলে কাজ নেই।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যি, ঠাট্টার কথা নয় বৌ। এবার তুমি আর একা নও। পেটে রয়েছে আমাদের ঘরের ছেলে, গাঙ্গুলী-বাড়ির প্রথম বংশধর। তার মান-মর্যাদা আছে, কল্যাণ-অকল্যাণ আছে। এই নার্সিংহোমে পড়ে থাকা আর চলে না। বাবাকে বলছি গিয়ে। ডাক্তারকে উনি বুঝিয়ে বলুন!
সে রাতটা মল্লিকার কাটল প্রায় বিনিদ্র শয্যায়। তাকে নিয়ে এ কী কৌতুক বিধাতার! এতদিন যে সমস্যা ছিল, সেইটাই কি যথেষ্ট নয়? তার ওপর এ আবার কী পরীক্ষা! ‘গাঙ্গুলী-বাড়ির প্রথম বংশধর!’ মঞ্জরীর মুখে একথা শুনবার পরেও তার সমস্ত বুকখানা কই আনন্দে, গৌরবে ভরে উঠল না তো? অন্তরের অন্তস্তল থেকে কুৎসিত সাপের মতো মাথা তুলে উঠল এক বিষাক্ত সন্দেহ। দুলে উঠল তার সমস্ত অস্তিত্ব।
ভোরের হাওয়ায় কখন চোখ বুজে এসেছিল। যখন ঘুম ভাঙল ঘর ভরে গেছে সকাল বেলার কোমল রোদে। তাড়াতাড়ি চোখে জল দিয়ে এসে দেখে জুনিয়ার নার্স মীরা তার খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে চেয়ে বলল মল্লিকা, একটু কাগজ কলম দিতে পার ভাই?
—চিঠি লিখবেন বুঝি? মুখ টিপে হাসল অল্পবয়সী মেয়েটি।
মল্লিকা মাথা নাড়ল।
—বড় কাগজ চাই তো?
—হ্যাঁ, বড় কাগজই দিও।
অনেকদিন পরে দিদির কাছে তার এই দীর্ঘ চিঠি। প্রথম খানিকটা অনুযোগ, অভিমান—আপদ বিদায় করে নিশ্চিন্ত হয়েছ তোমরা। একবার জানতেও চাও না, সেটা মরেছে, না বেঁচে আছে। ইত্যাদি। তারপর লিখল—বড্ড ভয় হয়েছিল দিদি। পাড়াগেঁয়ে মুখ্যু মেয়ে। কি চোখে দেখবেন এঁরা। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দেখছি, আমার জন্যেই যেন সবাই পথ চেয়ে বসেছিলেন। যেমন দেওর, তেমনি ননদ। আর তেমন ভগ্নীপতিটি। তার কথা আর নাই বললাম।
সকলের শেষে রইল তার চরম সর্বনাশের কথা। সেই দুর্যোগের রাত, নার্সিং হোম. স্বামী ননদ, মিস্ সরকার এবং এই সমস্যা-জড়িত সন্তানের আবির্ভাব। সব অকপটে এবং সবিস্তারে জানিয়ে লিখল—দিদিভাই, এবার তোমরা বলে দাও আমি কোন্ পথে যাবো! জামাইবাবুর প্রতিটি উপদেশ আমার কাছে অলঙ্ঘ্য গুরু-মন্ত্র। এতদিন তারই আলোতে পথ চলেছি। হঠাৎ ঝড় উঠল। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আজ এসেছে নতুন নির্দেশের প্রয়োজন। এত বড় প্রয়োজন আমার জীবনে আর কোনোদিন দেখা দেয়নি।
উত্তর এল সাত-আট দিন পরে। দিদির কয়েক লাইন, তার সঙ্গে জামাইবাবুর কয়েক পাতা। কুশল প্রশ্নাদির পর লিখেছেন তর্করত্ন—মানুষের জীবনে ঝড় আসে, আবার কেটে যায়। যে-ক্ষতি সে রেখে যায়, তার চিহ্নও একদিন মিলিয়ে আসে। ঝড় ক্ষণিকের, কিন্তু সূর্যালোক শাশ্বত। ঝড়ের কথা মনে রেখো না, সূর্যকে অর্থাৎ ধ্রুবকে আশ্রয় কর।
তারপর লিখেছেন, ‘তুমি মা হতে চলেছ। এইখানেই তোমার সব প্রশ্ন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আমাদের শাস্ত্র বলেছেন নারীর পরিপূর্ণ রূপ হচ্ছে মাতৃরূপ। অন্যত্র সে খণ্ডিতা, অসম্পূর্ণা। সন্তানের মধ্যে সে পুনর্জন্ম লাভ করে। তার সমস্ত সত্তা বিলীন হয়ে যায় ঐ ক্ষুদ্র একটি শিশুর সত্তায়। সে তখন ঐ শিশু-দেবতার সেবাদাসী। সেই তার একমাত্র পরিচয়। নিজস্ব বলে তখন আর তার কিছুই থাকে না! তোমার আর কোনো সমস্যা নেই।
চিঠির উপসংহারটি বারে বারে পড়ল মল্লিকা—তোমার বিবাহের সঙ্গে সঙ্গেই আমার গুরু-গিরির পালা শেষ হয়ে গেছে ভাই। এখন তোমার গুরু এবং পথ-নির্দেশক তোমার স্বামী, আমার পরম স্নেহাস্পদ মতীশভায়া। তিনি যা বলেন সেইটাই তোমার মন্ত্র। তিনি যেখানে নিয়ে যাবেন, সেইটাই তোমার তীর্থ।
চিঠিখানা বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে রইল অনেকক্ষণ। মনে মনে উচ্চারণ করল—তবে তাই হোক। আমি আর ভাবতে পারি না।
মঞ্জরীর চিঠি পেয়ে মতীশ আবার এল কলকাতায়। ভয়ে ভয়ে ঢুকল মল্লিকার ঘরে। দূরত্ব রেখে বসল একটা টুলের উপর। মল্লিকার মনে আবার জেগে উঠল সেই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন, যার উত্তর সে জানতে চেয়েছিল মিস্ সরকারের কাছে। কিন্তু স্বামীর উদার সরল স্নেহস্নিগ্ধ চোখদুটির দিকে একবার মাত্র চেয়ে প্রশ্নটি তার মনের মধ্যেই রয়ে গেল। নিজের দেহে প্রথম মাতৃত্বের সূচনা স্মরণ করে তার সদ্য-রোগমুক্ত মুখের উপর ফুটে উঠল একটি লাজসুন্দর মৃদু হাসি। দুর্নিবার আকর্ষণে এগিয়ে গেল মতীশ। মল্লিকার একটি হাত নিজের দু-খানা হাতের মধ্যে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আমি সব শুনেছি মল্লি। ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো।
বাড়ির কথা শুনেই বুকের ভিতরটা চমকে উঠল মল্লিকার। ভীত কণ্ঠে বলল, কিন্তু-
—আর কোনো ‘কিন্তু’ নেই, বাধা দিয়ে বলল মতীশ। সব ‘কিন্তু’ সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকে তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও দেখি।
কথাগুলো মল্লিকার কানে এল সুধা বর্ষণের মতো। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে জেগে উঠল তার গুরুর ক’টি ছত্র। আর কোনো কথাই তার মুখে এল না। শুধু ক্লান্ত হাতখানি এলিয়ে পড়ল স্বামীর কোলের উপর।
এর ক’দিন পরেই গাঙ্গুলী-বাড়ির মাথার উপর আবার হল বজ্রপাত। সুহাসিনী দেবী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলেন, হঠাৎ পড়ে গেলেন মাথা ঘুরে। প্রেসারের খেলা। আগেও দু-একবার ভেলকি দেখিয়ে গেছে। ডাক্তারের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও সাবধান হননি সুহাসিনী, এবার তার ফল ফলল। ছেলেরা বাড়ি নেই, কর্তা অফিসে, মঞ্জরী গিয়েছিল তার রুগ্ণা শাশুড়ীকে দেখতে। ঝি আর চাকরে মিলে সংজ্ঞালুপ্ত দেহটাকে কোনো রকমে দিয়ে গেল ঘরে। ডাক্তার এসে যা করবার করলেন। কিন্তু স্বামী এবং ছেলেমেয়েরা ফিরবার আগেই উনি পৌঁছে গেলেন ওদের নাগালের বাইরে।
দিল্লী লাহোর ক্রিকেট পিটিয়ে ঘুরছিল জিতেশ। খবর পেয়েই এসে পড়ল। দেখল এবং শুনল সব। তারপর সোজা গিয়ে হানা দিল মল্লিকার নার্সিং হোমে।
—বৌদি! দরজার বাইরে থেকেই সেই দরাজ গলার ডাক। ধড়মড় করে উঠে বসল মল্লিকা।
—তুমি এখনও বিছানায় পড়ে আছ? বিনা ভূমিকায় কঠোর প্রশ্ন।
—না ভাই, এই তো উঠে বসেছি।
—তারপর, যাচ্ছ কখন?
–কোথায়?
—কোথায় মানে? তোমার মতলবটা কি খুলে বল দিকিনি বৌদি! মা তো দিব্যি পাড়ি দিলেন। এদিকে ছোড়দির সমন এসে গেছে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে। শাশুড়ি বুড়ী নাকি যায়-যায়। আমাদের কি শেষটায় গুষ্টিসুদ্ধ বেঘোরে মারতে চাও? বেশ কর যা খুশী। আমার কি? মুখ্যু মানুষ, ব্যাট্ ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়বো একদিকে। কিন্তু ঐ বুড়ো মানুষটাকেই বা দেখে কে, আর তোমার ঐ নাবালক বি.কম্.-টিকেই বা কে সামলায়? মল্লিকা নিবিষ্ট মনে ভাবছিল। দু-মিনিট অপেক্ষা করে আবার হুঙ্কার দিল জিতেশ, ভাবছ কি? উঠবে না ঘাড়ে তুলবো?
—বাব্বা, ছেলে একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছেন!
—ঘোড়ায় নয়, মোটরে! তুমি ভুলে যাচ্ছ, এটা তোমার যশোর নয়, সুসভ্য কলকাতা শহর। বৌরা এখানে ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যায় না, মোটরে চড়ে যায়।
—যাও বাপু, নিয়ে এসো তোমার মোটর।
—বাঃ, একেই তো বলে লক্ষ্মী মেয়ে। নাও, চটপট গুছিয়ে নাও। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
বলে গাড়ি আনতে বেরিয়ে গেল।
নিজের হাতে সংসার তুলে নিল মল্লিকা। ঠাকুর রয়েছে। সে শুধু নামমাত্র। বেশীর ভাগ রান্নাগুলোই তাকে করতে হয়। যেদিন না পারে, কর্তা এটা হয়নি, ওটা হয়নি বলে অনুযোগ করেন, আধপেটা খেয়ে চলে যান অফিসে। খাবার সময় সামনে গিয়ে বসতে হয়। শ্বশুর গম্ভীর মানুষ। কথাবার্তা বড় একটা বলেন না। কিন্তু মল্লিকা বুঝতে পারে তাঁর মনের কথা। একদিন বলেও ফেললেন, জানো বৌমা, আমি ছিলাম মায়ের একমাত্র ছেলে। মা কাছে এসে না বসলে একদিনও খাওয়া হত না। বুড়ো বয়সে আবার বুঝি সেই অভ্যাস ফিরে এল!
জিতেশ আসে তার ক্রিকেট বন্ধুদের দলবল নিয়ে। যখন তখন ‘বৌদি’ বলে হাঁক দেয়। অসময়ে চায়ের ফরমাস করে। আর মাঝে মাঝে আসে রমা সরকার। মল্লিকা তাকে বসায় নিয়ে তার শোবার ঘরের কোণটিতে। আটকে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রমা হয় তো বলে, এবার উঠি, মল্লিকা বাধা দেয়।
—ডিউটি রয়েছে যে, বোঝাতে চায় নার্স।
—থাক্গে ডিউটি। ও ছাই চাকরি তুমি ছেড়ে দাও।
—সর্বনাশ! চাকরি ছাড়লে খাবো কি? তোমার ছেলে হলে যদি আয়ার চাকরিটা দাও, তখন না হয় ছেড়ে দেওয়া যাবে নার্সিংহোম। কিন্তু তার তো এখনও কয়েক মাস দেরি। মল্লিকা সে কথার জবাব দেয় না। অনেকটা যেন আপন মনে বলে, ঘর নেই, বাঁধন নেই, শুধু ভেসে ভেসে বেড়ানো। এই কী মেয়েমানুষের জীবন?
—কি করবো ভাই! পানসি সাজিয়ে এলো না তো কোনো রাজপুত্তুর! ভেসে না বেড়িয়ে যাবো কোথায়?
—ও সব বাজে কথা। আসলে ঘরের দিকে মন নেই তোমার।
—হয়তো তাই। এমন অবাধ খোলামাঠে চরতে পেলে সংসারের জোয়াল কে ঘাড়ে তুলতে চায়, বল?
মল্লিকার হঠাৎ মনে হল কথাটা পরিহাসের সুরে বললেও কেমন একটা করুণ রেশ রয়েছে শেষের দিকে। তার ছোঁয়া ওর মনেও লাগল, এবং তার ছায়া পড়ল ওর মুখের উপর। সেদিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে রমা বলল, তবে শোনো, একটা গল্প বলি। গল্পটা আমার পিসতুতো দাদার কাছে শোনা। উনি ছিলেন মস্ত বড় এক রাজার ছেলের প্রাইভেট সেক্রেটারি। শুধু রাজার ছেলে নয়, তার ওপরে আবার নামজাদা সিনেমা আর্টিস্ট। তার পর যা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সিনেমা আর তার আশপাশের যেসব ‘এবং’ থাকে, তাতেই আস্তে আস্তে তাঁকে গ্রাস করে ফেলল। রাজকুমার আর ঘরে আসেন না। রাজা তখনও বেঁচে। রেগে-মেগে ছেলেকে করলেন ত্যাজ্যপুত্তুর, তার বৌরানীকে যোগাতে লাগলেন নিত্য নতুন শাড়ি জুয়েলারী, বই আর গান-বাজনার সরঞ্জাম। একটু নড়তে গেলেই চারদিক থেকে ছুটে আসে চারজন দাসী। এমনি তার খাতির।
হঠাৎ একদিন কি খেয়াল হল বৌরানীর, বেলা ন’টার সময়ে বেড়াতে গেলেন প্রাইভেট সেক্রেটারির বাড়ি। একশ’ টাকার চাকুরে। আমার বৌদিটি তখন কোমরে আঁচল বেঁধে মাছ ভাজছে তার সেই রান্নাঘর নামক খুপরির মধ্যে। ময়লা কাপড়ে হলুদের ছাপ। সর্বাঙ্গে ঘাম আর কালিঝুলি। আমার দাদা ছুটে এলেন তাঁর হাতল-ভাঙা চেয়ার ঘাড়ে করে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বৌরানী সোজা হয়ে গিয়ে উঠলেন ঐ রান্নাঘরের দরজায়। বৌদি শশব্যস্তে বেরিয়ে এসে বলল, এখানে আপনার কষ্ট হবে! ও-ঘরে চলুন। তা হোক। এইখানেই বসি। আপনি রান্না করুন’—বলে নিজেই একটা পিঁড়ি টেনে নিলেন। মাছ ভাজা চলল। ঘরময় ধোঁয়া। বৌরানী বার বার চোখ মুছছেন। বৌদি আবার বলল, বড্ড কষ্ট হচ্ছে আপনার। সেকথা বোধহয় ওঁর কানে গেল না। সেই কালিমাখা ঝুলেভরা অন্ধকার খোপটার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, ‘এরকম একটা রান্নাঘরও যদি পেতাম…’
—যাক; এবার আমি চলি, বলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল মিস্ সরকার
মঞ্জরী গেছে শ্বশুরবাড়ি। সাত-আট দিন পরে কখনও কখনও এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। মল্লিকা দু-দিন জোর করে ধরে রাখে। তার প্রিয় রান্নাগুলো রেঁধে খাওয়ায়। মঞ্জরী বলে, তোর মতলব তো ভাল নয়, বৌ! ঐ জঙ্গল-টঙ্গল খাইয়ে একেবারে বাঙাল বানিয়ে ফেলতে চাস? – বলে আরও খানিকটা মেখে নেয় কুমড়োর ডাঁটা দিয়ে মটর ডাল কিংবা ধনেপাতা দিয়ে লাউ-এর ঘণ্ট।
সমস্ত দিন খেটে সবার মন যুগিয়ে অনেক রাতে যখন শুতে যায় মল্লিকা, নিঃসঙ্গ শয্যার দিকে চেয়ে মনটা তার হু-হু করে ওঠে। বিছানায় না গিয়ে কোনো কোনো দিন কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে। নানা খুঁটিনাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে, তারপর আর রাখতে পারে না নিজেকে —ওগো, আমার এই সুখের দিনে তুমি কাছে নেই, এ যে আমি আর সইতে পারছি না।
মতীশ লেখে, মল্লি, এতদিন তুমি ছিলে শুধু আমার। বড় ছোট করে সংকীর্ণ করে পেয়েছিলাম তোমাকে। আজ তুমি সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছ। তোমাকে নতুন করে, বড় করে পেলাম। আমার এ আনন্দ রাখবার জায়গা নেই। তোমার থেকে দূরে থেকেও আমি তোমাকে জড়িয়ে আছি। আমি তোমার কাছে যাবো না। তুমি আসবে আমার কাছে। নতুন করে ঘর বাঁধবো আমরা। সেই দিনটির প্রতীক্ষায় দিন গুনছি।
.
দেখতে দেখতে মাস এগিয়ে চলল। মল্লিকাকে আবার যেতে হল নার্সিং হোমে। তারপর একদিন হঠাৎ শুরু হল যমযন্ত্রণা, যার হাত থেকে কোনো মায়েরই নিস্তার নেই। সমস্ত রাত যমে-মানুষে টানাটানির পর ভোরের দিকে তার কোলে এল কোলজোড়া খোকা শ্বশুর এসে গিনি দিয়ে মুখ দেখলেন। মঞ্জরী আর জিতেশ এসে হৈ-হল্লা করল কিছুক্ষণ সাত-আট দিন পরে এল মতীশ। মল্লিকা রাগ করে বলল, অ্যাদ্দিন পরে বুঝি মনে পড়ল? মতীশ সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ঈস্, বড্ড ছোট!
খিলখিল করে হেসে উঠল মল্লিকা,—ওমা, ছোট হবে না তো পেট থেকে পড়েই ছুটবে নাকি?
মতীশ নিরাশ সুরে বলল, নিয়ে যাবার মতো বড়-সড় হতে যে এখনও অনেক দেরি!
মল্লিকা বাঁকা চোখে তাকাল স্বামীর মুখের দিকে, বাবুর বুঝি আর সবুর সইছে না?
দিনকয়েক পরে সকাল বেলা বাচ্চাকে তেল মাখাচ্ছিল ঝি, মল্লিকা পাশে বসে স্নিগ্ধ চোখ মেলে চেয়েছিল সেই দিকে। ঝি বলে উঠল, হ্যাঁগা, ছেলে তোমার কারও মুখই পায়নি—না বাপের, না মার!
বুকের ভেতরটা ধ্বক্ করে উঠল মল্লিকার। এ কথার অর্থ কী? ঝুঁকে পড়ে বেশ করে দেখতে লাগল ছেলেকে। সত্যিই তো, এ কার মুখ!
কি রকম রাঙা হয়েছে দ্যাখ, আবার বলল ঝি, বড় হলে কালো হবে। মায়ের তো ধার দিয়েও যায়নি, বাপের রঙও পাবে না।
মল্লিকার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। বুকে যেন আটকে গেল নিঃশ্বাস। চোখ বুজে শুয়ে পড়ল সেইখানেই।
কি হল গো! বলে ঝি তাড়াতাড়ি ছেলে ফেলে উঠে গেল। ক্ষিপ্র হাতে লেগে গেল মায়ের পরিচর্যায়। খানিকক্ষণ বুকে পিঠে মালিস করবার পর একটু সুস্থ বোধ করল মল্লিকা। উঠে বসে ঝিকে বলল ছেলেকে তার কোলে তুলে দিতে। ঝি বলতে লাগল, আহা হোক না কালো, নাই বা হল বাপ-মায়ের মতো। বেঁচে থাক্। ব্যাটাছেলের চেহারায় কি আসে যায়? নাও একটু দুধ দাও। বাছার আমার গলা শুকিয়ে গেছে।
মল্লিকা দু’চোখের তীব্র দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইল তার সদ্যোজাত শিশুর দিকে। তবে কি-
পরদিন ছেলে দেখতে এলেন পিসিমা। সঙ্গে বড়দি। একথা সেকথার পর বললেন ভাইঝিকে, দ্যাখ্ ললিতা, কি রকম গাট্টাগোট্টা দেখতে হয়েছে খোকা। একেবারে পাঞ্জাবী গড়ন।—বলে একটু বিশেষভাবে চোখ টিপলেন। বড়দি বললেন, সেটা আমি এসেই লক্ষ্য করেছি পিসিমা। তাছাড়া মাথাটা কেমন গোল দেখেছ, আর কত বড়? আমাদের বাড়িতে এরকমটা কারও নেই।
—কি জানি বাবা! বংশের প্রথম ছেলে বংশের ধারা পাবে, এই তো সবাই আশা করে। তা এ যে একেবারে গোত্তরছাড়া,—বলতে বলতে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়লেন পিসিমা। তাহলে আসি বৌ—বলে বড়দিও তাঁর অনুগমন করলেন। তাঁর বাঁকা ঠোটের হাসিটি মল্লিকার দৃষ্টি এড়াল না।
তাঁরা চলে যাবার পর বহুক্ষণ বজ্রাহতের মতো বসে রইল মল্লিকা। সন্ধ্যা এল। আস্তে আস্তে গভীর হল রাত। সবাই শুয়ে পড়ল। ঘুম এল না শুধু ওর চোখে। হ্যারিকেন তুলে বারে বারে দেখতে লাগল ঘুমন্ত ছেলের মুখের পানে। যত দেখে ততই দৃঢ় হল মন, হ্যাঁ, ওদের কথাই ঠিক। এ ছেলের সঙ্গে তার নাড়ীর যোগ আছে, আত্মার যোগ নেই। এ গাঙ্গুলী-বংশের কেউ নয়। তার নামহীন গোত্রহীন অবাঞ্ছিত সন্তান। ভেঙে দিতে এসেছে তার এত দুঃখের গড়া নীড়, এত সুখের সাজানো সংসার। যে-রাতটাকে সে ভুলতে চেয়েছিল, মুছে ফেলতে চেয়েছিল তার জীবন থেকে, তারই কলঙ্ককাহিনী সর্বাঙ্গে লিখে নিয়ে এল এই মাংসপিণ্ড। এরই মধ্যে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে সেই অভিশপ্ত রাত, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে তার নারী-জীবনের চরমতম গ্লানি!
বিদ্যুৎ-স্ফুরণ হল মল্লিকার দু-চোখের নীল তারায়। কানদুটো থেকে ছুটে এল আগুনের হল্কা। মাথার শিরগুলো মনে হল ফেটে বেরিয়ে যাবে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে মাথা পেতে দিল স্নানঘরে কলের তলায়। কিন্তু দেহের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বলছে যে অনলজ্বালা, সাধ্য কি জল তাকে ঠাণ্ডা করে!
একরাশি ভিজে-চুল নিয়ে আবার ফিরে এল খাটের পাশে। শিশু কাঁদছে। হ্যারিকেনটা একবার তুলে ধরল মল্লিকা। ইস্। কী কুৎসিত সে বিকৃত মুখ! কী কুশ্ৰী কৰ্কশ গলা!
দু-হাতে কান ঢেকে ছুটে গেল ঘরের কোণে। মাথাটা লুটিয়ে দিল টেবিলের উপর। কিন্তু সে কান্নার হাত থেকে তবুও তার মুক্তি নেই। কেঁদে ককিয়ে যাচ্ছে ছেলে। হয়তো এখনই দম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই যাক্, চিৎকার করে উঠল মল্লিকা, সরে যাক্ ঐ অভিশাপ, আমার জীবন থেকে মুছে যাক্ ঐ পাপচিহ্ন!
দৃপ্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল মল্লিকা। তার মুখের প্রতি রেখায় ফুটে উঠল এক পাশব জিঘাংসা। তীব্র আরক্ত চক্ষু মেলে মোহাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে গেল ঐ জড়পিণ্ডটার দিকে। আস্তে আস্তে অজ্ঞাতসারে বেরিয়ে এল তার দীর্ঘ তীক্ষ্ণ আঙুলগুলো; যেন একদল হিংস্র বৃশ্চিক।
তারপর কি যে হল জানে না মল্লিকা। হঠাৎ খেয়াল হল কান্না থেমে গেছে। ঐ ক্ষুদ্র দেহটা আর ছটফট করছে না! পড়ে আছে নিস্পন্দ নিশ্চল ক্ষুদ্র একখণ্ড পাথরের মতো। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল মল্লিকার। কী হল, কাঁদছে না কেন খোকা? ছুটে গিয়ে নিয়ে এল হ্যারিকেন। উঁচু করে ধরলো বাচ্চার মুখের উপর। রক্তে ভিজে গেছে শুভ্র সুন্দর শয্যা। এত রক্ত কেন! বিকৃত প্রেতকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল—এত রক্ত কেন! ওগো, তোমরা ওঠো। দিদি, ডাক্তারবাবু, মীরা শীগগির এসো—
গভীর রাত্রির বুক চিরে ফেটে পড়ল নারী-কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। নার্সের দল ছুটে এল। উপর থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন ডাক্তার। মল্লিকা হেসে উঠল পৈশাচিক
—হাসি—হাঃ-হাঃ-হাঃ, খুন, খুন করেছি আমি! এই দ্যাখ।
হা-হা-হা-হা…সে হাসির আর শেষ নেই।
.
পরদিন একটার গাড়িতে মতীশের যাওয়া হল না। গৃহিণী বললেন, সমস্ত রাত বকিয়ে মেরেছ ছেলেটাকে, এখন একটু ঘুমোতে দাও।
কাছে এগিয়ে এসে অনুনয়ের সুরে বললেন, হ্যাঁগো, ভেতরে নিয়ে একবারটি দেখা করিয়ে দিতে পার না?
বললাম, ফিমেল ওয়ার্ড যে।
—হলই বা ফিমেল ওয়ার্ড। কোন্ রাজকন্যারা আছেন সেখানে শুনি? তোমাকে দেখে যদি অ্যাদ্দিন অজ্ঞান না হয়ে থাকেন, ওকে দেখে কেউ মূর্ছা যাবে না।
—আমাকে দেখে কেউ অজ্ঞান হয়নি, বুঝলে কি করে?
—ইস, এত সস্তা নয়, উল্টোটা হয়েছে কিনা, তাই বল! না সত্যি, একটা ব্যবস্থা কর। পাগল হোক আর যাই হোক, মেয়েমানুষ তো? চোখের ওপর দেখলে হয়তো মনে পড়বে।
—ডাক্তাররা সে ভরসা দেন না।
—হ্যাঁঃ, তোমাদের ডাক্তাররা তো সব জানে!
বিকেলবেলা মতীশকে বললাম, চল তোমাকে আমাদের রাজত্বটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই।
ওর বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। আপত্তিও করল না। ম্লান হাসি হেসে বলল, চলুন।
দু-চারটা ওয়ার্ড ঘুরে জেনানা ফটকের গেটে গিয়ে কড়া নাড়লাম। মানদা এসে দরজা খুলে সেলাম জানাল। ভেতরে ঢুকলাম। মতীশ ইতস্তত করছিল। সাইনবোর্ডটার দিকে চেয়ে মনে হল তার পা দুটো যেন সরছে না। বললাম, দাঁড়িয়ে কেন? এসো!
মেয়েদের সাধারণ ব্যারাক ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম সেল-ব্লকের দিকে। মানদা দরজা খুলতেই দেখলাম সামনেকার ঘাসে ঢাকা ছোট্ট চত্বরটি আলো করে বসে আছে মল্লিকা। অপর্যাপ্ত কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠের উপর। একটি মেয়ে-কয়েদী তারই পরিচর্যায় ব্যস্ত।
মতীশের বাহু ধরে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডাকলাম, মল্লিকা!
ও চোখ তুলে চাইল, ওর সেই আশ্চর্য চোখে
—দ্যাখ তো কে এসেছে? মতীশকে এগিয়ে দিলাম সামনের দিকে। মল্লিকার দৃষ্টি পড়ল তার মুখের উপর। তেমনি শান্ত, নিস্তরঙ্গ, ভাবলেশহীন। তার কোথাও নেই ক্ষীণতম পরিচয়ের আভাস। উদ্গত অশ্রু কোনো রকমে সংবরণ করে মতীশ বলল, আমি–আমি এসেছি মল্লি! চিনতে পারছ না?
মল্লিকা সাড়া দিল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে যেন ক্লান্ত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
—মল্লি! গাঢ়স্বরে ডাকল মতীশ, একবার চেয়ে দ্যাখ। আমি!
আবার চোখ তুলল মল্লিকা। মনে হল একটু যেন ভাবান্তর দেখা দিল সেই অর্থহীন নিষ্পলক চোখের তারায়। একটু যেন সরে গেল বিস্মৃতির ঘন আবরণ। সেদিকে চেয়ে মতীশের চোখেও ফিরে এল তার বহুদিনলুপ্ত আশার রশ্মি। আগ্রহাকুল স্বরে বলল, চিনতে পারছ?
উত্তর এল না। ধীরে ধীরে সেই ভাষাহীন মুখের উপর ফুটে উঠল একটা ক্ষীণ বেদনার চিহ্ন। কোনো দূরানুভূত যন্ত্রণা। ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠল তার রেখা। যেন দুঃসহ আবেগে মুক্তি চাইছে কতদিনের কোনো অবরুদ্ধ অশ্রুর ভাণ্ডার। সহসা দু-হাতে মুখ ঢেকে সে ছুটে চলে গেল ঐ সেলগুলোর দিকে। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল তড়িৎ-শিখার ঝলকে।
কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ চোখে পড়ল মল্লিকার সেল থেকে বেরিয়ে এসে হাত নেড়ে কি বলছে মানদা। বুঝলাম আমাদের চলে যাবার ইঙ্গিত। সঙ্গে সঙ্গেই আবার সে ব্যস্ত হয়ে ফিরে গেল ঘরের মধ্যে।
মতীশের দিকে তাকালাম। সাড়া নেই, সম্বিৎ নেই; চেয়ে আছে কিন্তু সে যেন পাথরের চোখ। কাঁধের উপর হাত রাখতেই চমকে উঠল। মৃদুকণ্ঠে বললাম চল, আমরা যাই।