সাত
গোজাতির সেবা যদি পুণ্যসঞ্চয়ের পরম-পন্থা বলে স্বীকৃত হয়ে থাকে জেল প্রাঙ্গণ অবশ্যই একটি পুণ্য-ক্ষেত্র। ছোট বড় সব জেলেই একটি করে ডেয়ারী বা গোশালা আছে এবং সেখানকার যারা অধিবাসী তাদের সেবার উপকরণ সাধু গুরু মোহান্তের ঈর্ষার উদ্রেক করবে। তাদের বাসের জন্যে সুদৃশ্য ইমারত, পানভোজনের জন্যে অনায়াসলব্ধ মহার্ঘ্য খানা এবং দলন-মর্দনের জন্যে বিনা মাইনের অনুগত ভৃত্য। মাঠে মাঠে চড়ে বেড়াবার দৈন্য কিংবা মাটির ঘাস খুঁটে খাবার উঙ্কুবৃত্তি—তাদের কোনোদিন স্পর্শ করে না। তারা বংশ-গৌরবে কুলীন এবং মেদ-বাহুল্যে অভিজাত। গিরীনদা মিথ্যা বলেননি, অক্ষয় পুণ্যের অধিকারী যারা, তারাই পরজন্মে জেলের গরু হয়ে জন্মায়।
ইংরেজের তৎকালীন রাষ্ট্রবিধানে যেমন ডায়ার্কি, ডেয়ারি বিধানেও তেমনি দ্বৈত- শাসনের ব্যবস্থা। গোধনের সুরক্ষা এবং খাদ্য নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়ে রয়েছেন পশুপালন বিভাগ, আর কারাবিভাগের হাতে রয়েছে দুগ্ধ-ভাণ্ড। একদিকে পশু-ডাক্তার আর একদিকে জেল-ডাক্তার। প্রথম ব্যক্তিটি নিষ্কাম-ধর্মে দীক্ষিত। তার অধিকার শুধু কর্মণ্যেব। দ্বিতীয়টি কর্মাতীত মহাপুরুষ। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শুধু ফলেষু। যাদের নিয়ে দার্শনিক ভেদাভেদ, তারা ষেঠের বাছা ষষ্ঠীর দাস হয়ে তৈলচিক্কণ দেহে পরম সুখে বেঁচেবর্তে থেকেই তাদের কর্তব্য শেষ করেন। চতুর্থ পক্ষ, অর্থাৎ আমরা, সকৌতুকে লক্ষ্য করি—গোধনের নধর দেহ যেমন শুক্লপক্ষের শশিকলার মত দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকে, তার দুধের অঙ্ক তেমনি কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের মত ক্রমশ বিলীয়মান। অধিকাংশ জেল-ডায়ারির এই হল সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বলা বাহুল্য, আমাদের ক্ষেত্রেও এই সাধারণ রীতির বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটেনি।
একদিন কাগজপত্র সই করতে করতে দুগ্ধাঙ্কের এই তথ্যটি বড়সাহেবের নজরে পড়ে গেল। ডেয়ারির হিসাব-রক্ষার দায়িত্ব ডাক্তারের। অতএব ডাক্তার থাপার ডাক পড়ল। সাহেব প্রশ্ন করলেন, ডক্টর, তোমার দুধ কমে যাচ্ছে কেন দিন দিন?
ডাক্তার শুষ্ক কণ্ঠে উত্তর করল, I don’t know.
—You don’t know! তাহলে জানবে কে?
ডাক্তার নিরুত্তর। মিস্টার রয় গলা চড়িয়ে বললেন, বল। দুধের খবর তুমি না জানলে জানবে কে?
ডাক্তার একবার আমার মুখের দিকে, একবার জেলরসাহেবের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল এবং কোনো তরফ থেকে কোন ভরসা না পেয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললে, The cows might know, Sir.
মিস্টার রয় হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বোধ হয় সন্দেহ হল; ডাক্তার বিদ্রূপ করছে। পরক্ষণেই তার নিতান্ত অসহায় দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে কি মনে হল জানি না, তিনি সহসা উচ্চহাস্য করে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে বললেন, All right, you may go.
আমি প্রবেশনার। অতএব দুগ্ধ-হ্রাসের রহস্য উদ্ঘাটন করবার ভার পড়ল আমার উপর। আমি যথারীতি তদন্ত শুরু করলাম। দু’চার দিনেই বুঝতে পারা গেল, একজন দেশোয়ালী জমাদারের একটি বৃহৎ লোটা এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত। গেট-কীপারকে চেপে ধরলাম, তুম কেয়া করতা হ্যায় জী? লোটা তো সচল পদার্থ নয় যে নিজে নিজে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যাবে! এ রকম চলতে থাকলে তোমার নকরি অচল হয়ে যাবে, বলে দিচ্ছি।
সে আশ্বাস দিল, সব ঠিক হো জায়গা।
পরদিন লোটা অন্তর্ধান করল। দুধের অঙ্ক বেড়ে গেল এক লাফে কয়েক ধাপ। মনিব খুশী হলেন।
ক’দিন না যেতেই আবার যে-কে-সেই। গেট-কীপারকে ডেকে বললাম, তোমার আর রক্ষা নেই। প্যাক আপ প্লিজ। লোটা কম্বল বেঁধে-ছেদে তৈরী হও।
সে জানাল, দুধ যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ‘লোটাসে নেহি’।
—নাই বা হল লোটাসে? হাঁড়ি কিংবা ঘড়াসে যাচ্ছে বলে তোমার দায়িত্ব কমে যাবে? তুমি তল্লাসি করছ না ঠিকমত।
এ কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল, ভোরবেলা একবার মেহেরবানি করে যদি আসেন, সব নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
তাই হল। গেলাম ভোরবেলায়। ডেয়ারিতে তখন দোহনপর্ব শুরু হয়েছে। গেট- কীপারের পরামর্শমত আমরা লুকিয়ে রইলাম পাশেই এক পাঁচিলের আড়ালে। সেই বিশালকায় জমাদারসাহেব চেয়ার জুড়ে বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে শোভা পাচ্ছে তাঁর অনুগত কয়েদীর দল। কী একটা হাসির কথা হচ্ছিল। সবটা শোনা গেল না। শেষটুকু শুনলাম,—তিন দিনের ছোকরা। লাগতে আসে আমার সঙ্গে। ঠেকাক দেখি, কেমন বাহাদুর?
বুঝলাম ‘ছোকরাটি’ এই অধম। জমাদারসাহেবের আস্ফালন যে নেহাত শূন্যগর্ভ নয়, পরক্ষণেই বোঝা গেল। একজন কয়েদী একটা বালতি করে খানিকটা দুধ তাঁর হাতে এনে দিল এবং তিনি কালবিলম্ব না করে সেটা ঢঢক্ করে ঢেলে দিলেন গলার মধ্যে। সের তিনেক আন্দাজ খাঁটি কাঁচা দুধ! পাত্রটি নিঃশেষ করে স্ফীত উদরে হাত বুলাতে বুলাতে একটা রাজোচিত উদ্গার তুললেন এবং তারপরেই যেন ভূত দেখে চমকে উঠলেন।
পরের দৃশ্য নিতান্ত করুণ। যে ‘ছোকরাকে’ তিনি দু’মিনিট আগে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন তারই পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ল তাঁর দুগ্ধপুষ্ট নধর দেহ।
গেট-কীপারের অসহায় অবস্থাটা উপলব্ধি করা গেল। লোটা নয়, হাঁড়ি নয়, দুগ্ধ- বহনের এমন পাত্রও আছে, যেখানে তার তল্লাসি সত্যিই অচল।
সরকারী চাকরির সুখ-সুবিধা বহুবিধ। তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে নিজ ক্যাম্পের বিরাগভাজন এবং অপর ক্যাম্পের ঈর্ষাভাজন হতে চাইনে। তার মধ্য থেকে একটি জিনিস শুধু উল্লেখ করবো, যেটা আমার কাছে সবচেয়ে লোভনীয়, তার নাম ছুটি। ছুটি -তারই বা রকম কত! তার ব্যাখ্যা বিন্যাস বিবরণ এবং টিকাটিপ্পনীর অসংখ্য জটিল ধারা জুড়ে আছে Fundamental Rules-এর একটি মস্ত বড় দুর্বোধ্য অধ্যায়।
প্রথম ধরুন ক্যাজুয়েল লিঙ্। বছর পড়তেই পনের দিন। একসঙ্গে নিন, কিংবা একটু একটু করে ভোগ করুন; কিন্তু যা কিছু করবেন, ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে। তারপরেই সব পচে গেল। প্রিভিলেজ লিভ্ বা যাকে বলে হক্ ছুটি পচনশীল পদার্থ নয়। বছর ঘুরে এলেই এক মাস দু’দিন জমা হল আপনার অ্যাকাউন্টে, বাড়তে থাকল ভাগ্যবান ব্যক্তির ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সের মত। তারপর সুযোগমত নিয়ে নিন পুরো চার মাস। সবটাই পাবেন পুরো তলবে। পরিশ্রম নেই, কিন্তু পারিশ্রমিক অক্ষুণ্ণ রইল। স্বচ্ছন্দে বেড়িয়ে আসুন সেতুবন্ধ রামেশ্বর কিংবা ডেরা ইসমাইল খাঁ। সাগর ডিঙিয়ে ‘হোম্’-এ যেতে চান? তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ঐ চার মাসটা এক লাফে আট মাস হয়ে যাবে। স্বর্গসুখ আর কাকে বলে?
তিন নম্বর—মেডিকেল লিঙ্, অসুখের দরুন ছুটি। ঘাবড়াবেন না। অসুখের দরকার করে না, দরকার শুধু একখানা ডাক্তারী সার্টিফিকেট। সেটুকু সংগ্রহ করতে যে অক্ষম, সরকারী চাকরির সে যোগ্য নয়।
তালিকা আর বাড়াতে চাই না। সবচেয়ে যেটা সেরা ছুটি তার উল্লেখ নেই কোন আইনের গ্রন্থে। তার নাম French leave. যখন খুশি, যতবার খুশি, একটু ঘুরে আসি স্যার বলে, বেরিয়ে পড়ুন। এ ছুটির কোনো হিসাব নেই, আছে একটিমাত্র শর্ত—বকে প্রসন্ন রাখতে হবে।
সে দুর্লভ সৌভাগ্য আমি অর্জন করতে পারিনি। আমার একমাত্র পথ—দরখাস্ত এবং তার ফলাফলের জন্যে অধীর প্রতীক্ষা। বহুকষ্টে বহু বিড়ম্বনার পর শেষ মুহূর্তে পনের দিন ক্যাজুয়েল ছুটি লাভ করা গেল। আর একটি দিন দেরি হলেই তার পচনক্রিয়া শুরু হয়ে যেত।
কাশ্মীর নয়, চিদাম্বরম্ নয়, সেই পুরাতন কলকাতার বহু পুরাতন বন্ধু-সমাজেই কাটিয়ে এলাম দুটো সপ্তাহ। ফিরে দেখি আমার দরজায় যে তালাটি ঝুলছে তার একমাত্র যোগ্য স্থান হতে পারতো কোনো রাজবাটীর সিংহদ্বার। এই অতি-সতর্কতার কারণ ছিল। শুনলাম, ঠিক আগের রাতেই আমার একমাত্র কাণ্ডারী শ্রীমান রামবাহাদুর ওরফে কেটা হঠাৎ অন্তর্ধান করেছেন এবং তাঁর সহযাত্রী হয়েছে আমার একমাত্র সম্পত্তি—একটি শূন্যগর্ভ স্টীল ট্রাঙ্ক আর কয়েকটা ঘটি-বাটি। যে-সিপাইটির উপর আমার কুঠী-তদারকের ভার ছিল, সে তার স্বদেশী ভাষায় বিস্তর আপসোস জানাল। আপসোস আমারও হল। কিন্তু সেটা আমার অপহৃত সম্পত্তির জন্যে নয়, অপহরণের পরিশ্রম যে ভোগ করল, তার জন্যে।
সিপাইটি জানতে চাইল, দোকান থেকে চা আনতে হবে কিনা। বললাম, না, থাক দোস্বা নকর একটা সন্ধান করবার প্রস্তাব জানাল। তাও আপাতত না-মঞ্জুর করে দিলাম।
Smiles সাহেবের Self Help নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আমার পড়া ছিল; এবং বাংলায় স্বাবলম্বন সম্বন্ধে অনেক রচনাও একদিন মুখস্থ করেছি। এতকাল পরে সে-সব বহুমূল্য উপদেশ কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করবার সুযোগ উপস্থিত। দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না। নগদ পাঁচ টাকা ব্যয় করে একখানা সচিত্র রন্ধনশিক্ষা এখানে আসবার আগেই সংগ্রহ করেছিলাম।
অবিলম্বে চা-এর প্রয়োজন, এবং তার প্রথম পর্ব স্টোভ ধরানো। আধ বোতল স্পিরিট সহযোগে, আধ ঘণ্টা পাম্প চালিয়ে সেটা কোন রকমে সমাধা হল। অতঃপর কী করণীয় সে-সম্বন্ধে সদ্য জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে ‘চা প্রস্তুত প্রণালী’ অধ্যায়টা সবে খুলে বসেছি, এমন সময় দরজায় কাঞ্ছীর আবির্ভাব।
একটি অতুলনীয় কৌতুক-হাসির অভিনন্দন মনে মনে আশা করছিলাম, হঠাৎ শিউরে উঠলাম, তার মুখের দিকে চেয়ে। এ কী হয়েছে কাঞ্ছীর? দুদিন আগেও যে মুখ ছিল কলহাস্যমুখর, আনন্দোচ্ছল, সহসা কার নির্মম অভিশাপে সে যেন নিষ্প্রাণ পাথর হয়ে গেছে। সর্বাঙ্গে গভীর বিষাদের মৌন ছায়া। এ কটা দিনেই যেন তার বয়স বেড়ে গেছে কয়েক বছর। এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি হয়েছে কাঞ্চী?
সে আমার ব্যাকুল প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। হাতে ছিল খাবারের থালা। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে সেটা সামনে টুলের উপর রেখে মৃদুস্বরে বলল, বড়ী আম্মা পাঠিয়ে দিলেন। তারপর স্টোভটা নিভিয়ে দিয়ে, যেতে যেতে বলল, চা নিয়ে আসছি।
যত দূর দৃষ্টি যায়, আমার বিস্মিত চোখ তাকে অনুসরণ করল। কিন্তু সে একবারও ফিরে চাইল না।
চা নিয়ে এল ডাক্তারের বছর দশেকের মেয়ে রুমী। টী-পট্টা টুলের উপর রেখে বলল, চা কিন্তু আজ আমি করেছি বাবুজী। দেখ দুধ চিনি আর বিয়ে।
—কাঞ্ছী এল না, রুমী?
—তাকে যে বড়ী আম্মা নাইতে পাঠিয়ে দিলেন।
—নাইতে? এত সকাল সকাল?
—ও—ও। তুমি জানো না বুঝি! বড় বড় চোখ করে বলল রুমী, কাঞ্ছীর যে আজ
—কাঞ্ছীর বিয়ে! যন্ত্রচালিত পুতুলের মত আবৃত্তি করলাম আমি।
বিয়েতে কারা কারা এসেছে, আর কারা আসেনি, ক’খানা গয়না হল তার, কে কোন্ জিনিসটা দিলে, এমনি আরো কত কি। তার কতক আমার কানে গেল, কতক গেল না। জানালার বাইরে সদ্য-মেঘমুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাতের দিকে তাকালাম। দেখলাম তার মরণাহত পাণ্ডুর রূপ। অনাগত জীবনের দীর্ঘপথের দিকে তাকালাম। দেখলাম সবটাই রুক্ষ ও ঊষর, কোথাও নেই একবিন্দু শ্যামলিমা।
সম্বিৎ ফিরে এল রুমীর ধমকে—তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না বাবুজী, আমি আর কতক্ষণ বসে থাকবো?
বললাম, তুই এখন যা, রুমী। এসব থালা-টালা পরে এসে নিয়ে যাস্।
–বাঃ, তুমি না খেলে আমি যাই কি করে?
-কেন?
—কাঞ্ছী বকবে যে?
—না, না। বকবে না। তুই যা।
—হ্যাঁ, তুমি তো খুব জানো! এখুনি বললে—বকবে।
—কি বললে?
—বললে, রুমী খাবার আমি রেখে এসেছি। তুই এক পেয়ালা চা করে বাবুজীকে দিয়ে আয়। তিন চামচে চিনি দিস্ কিন্তু, বাবুজী চিনি বেশী খায়। আর, দিয়েই যেন চলে আসিস নে। সামনে বসে খাওয়াবি। কিচ্ছু যেন ফেলে না রাখে। তাহলে কিন্তু ভীষণ বকবো তোকে।
এই কাঞ্ছীই আজ চলে যাচ্ছে চিরদিনের তরে। একটি মাত্র রাত্রির ব্যবধান। তারপরে আর তাকে দেখতে পাবো না।
এই তো সেদিনের কথা। একটা মাসও হয়নি। এইখানে বসে একথা ওকথার পরও হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবুজী, বউ আসবে কবে?
হেসে বলেছিলাম, বৌ বলে যে একজনকে আসতেই হবে, এ রকম চুক্তি তো কারো সঙ্গে করিনি।
—ওমা! তুমি চিরকাল এমনি একলাটি থাকবে? তোমাকে দেখবে কে?
-কেন? যার গরজ সেই দেখবে।
কাঞ্ছীর হাস্যোজ্জ্বল মুখের উপর হঠাৎ ঘনিয়ে এল বেদনার ছায়া। কণ্ঠে বেজে উঠল অপূর্ব করুণ সুর। ঐ জানালার বাইরে চেয়ে ধীরে ধীরে বলেছিল, সে কপাল তো সে করে আসেনি! আজ হোক, কাল হোক, যেতে তাকে একদিন হবেই।
সেই দিনটা যে এত কাছে ঘনিয়ে এসেছিল, সেও জানতো না, আমিও বুঝতে পারিনি।
রুমীর দ্বিতীয় ধমক খেয়ে খাবারের থালায় হাত দিতে হল। এই কটি তুচ্ছ খাদ্যবস্তু। একে উপলক্ষ করেও কী না পেয়েছি এই পাহাড়ী মেয়েটির হাত থেকে! শুধু আজ নয়, আমার এই কেটা যন্ত্রটি তো বিকল হয়েই আছে। কতদিন দেখেছি, সে খবরটা যখন আমার কানে এল তার আগেই ওবাড়ি থেকে এসে গেছে খাবারের থালা। খাবারটা বরাবরই আসে বড়ী আম্মার নামে। কিন্তু আমি তার মধ্যে আর একখানা শুভ্ৰ কল্যাণহস্তের স্পর্শ পাই। আজই তার শেষ। সে স্পর্শ এ জীবনে আর কোনদিন পাবো না।
ঘণ্টাখানেক পরেই বড়ী আম্মা এলেন নিমন্ত্রণ করতে। বললেন, মেয়েটার মা নেই, বাপ নেই, এক আমি ছাড়া আপনার বলতে কেউ নেই। সম্বন্ধটা হঠাৎ জুটে গেল। ছেলেটা মোটামুটি ভাল। অথচ দিতে-থুতে হবে না কিছুই। তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে দিলাম বিদায় করে। তোমাকে ও বড্ড ভালবাসে। তুমি দাঁড়িয়ে থেকে আশীর্বাদ করলে কাঞ্ছী আমার সুখী হবে! একটু কষ্ট করে আসতে হবে বাবুজী। আসবে তো?
আমি সাগ্রহে বললাম, যাব বৈকি, বড়ী আম্মা। নিশ্চয়ই যাবো।
কথা দিলাম। কিন্তু বড়ী আম্মা চলে যেতে না যেতেই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল মনের ভিতরটা। কর্তব্যবোধ আঁকড়ে ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। সব ব্যর্থ হল। কেবলি মনে হতে লাগল যাবার উপায় নেই। পালাতে হবে। যেখানে হোক, পালাতে হবে। ছুটি ফুরাতে তখনো একদিন বাকী। হঠাৎ মনে পড়ল, এক বাল্য-বন্ধু থাকেন কার্সিয়াং-এ, পি ডবলিউ ডি-র কর্ণধার। তাঁর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
ডাক্তার থাপার নামে একটা চিঠি লিখে গেলাম, বড়ী আম্মাকে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ে বলবেন, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে হঠাৎ আমাকে কার্সিয়াং যেতে হচ্ছে। কাঞ্ছীর বিয়ে দেখা হল না। ভারী দুঃখ রইল। ওকে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করছি—ইত্যাদি।
পরদিন ফিরবার পালা। ওখানে ভালো লাগল না। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনে এসে দেখলাম গাড়ির তখনো অনেক দেরি। খানিকক্ষণ প্লাটফরমে পায়চারি করা গেল। সময় কাটতে চায় না। মানুষের ভিড় অসহ্য। ওয়েটিং রুমটায় উঁকি মেরে দেখলাম, একেবারে ফাঁকা। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। যখন- তখন চায়ে আমার রুচি নেই। সেদিন কি হল জানি না, পর পর দু-কাপ কখন গলায় চলে গেল, জানতেই পারলুম না। তৃতীয় কাপের জন্যে বয়টাকে ডাকব কিনা ভাবছি, হঠাৎ নজর পড়ল বাইরের দিকে। চমকে উঠলাম। বিস্ময়ে আনন্দে, না বেদনায়, বুঝতে পারিনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঞ্ছী। আনত ম্লান মুখ। পরনে নববধূর বেশ। পেছনে দাঁড়িয়ে তার বর। সোজা হয়ে বসে ওদের অভ্যর্থনা করলাম। সহাস্যে, সহজভাবেই বললাম, এসো। ছেলেটি মিলিটারী কায়দায় এক সেলাম করল, তারপর সবিনয়ে অনুমতি নিয়ে বাইরে চলে গেল। কাঞ্ছী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার কাছটিতে।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। আমি তার ডান হাতখানি আমার হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম, তোমার বিয়েতে থাকতে পারলুম না। সেজন্য দুঃখ করো না, কাঞ্ছী। তুমি তো সবই জানো। পার তো আমাকে ক্ষমা কোরো।
কাঞ্ছী তড়িতাহতের মত দু-হাতে আমার হাতখানি জড়িয়ে ধরে বলল, সেকি কথা, বাবুজী? তুমি ক্ষমা চাইছ আমার কাছে! আমারই যে তোমার কাছে অপরাধের অন্ত নেই! তার অপরাধ কোথায় জানি না, তবু প্রতিবাদ করলাম না। আরো কিছুক্ষণ পরে সে সহজ মৃদুকণ্ঠে বলল, আজই ফিরছ?
বললাম, হ্যাঁ।
একটু অপেক্ষা করে আবার বলল, ছুটি তো তোমার পাওনা আছে। আরো কিছুদিন বরং বাড়ি থেকে এসো।
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
—কেন? হতাশভাবে জবাব দিল কাঞ্ছী, সে কথাও কি বলে দিতে হবে? কে আছে তোমার ওখানে? কে দেখবে? তেষ্টা পেলে এক গ্লাস জল চেয়ে খেতে যে জানে না, তার কষ্টের কি শেষ আছে? কতদিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে, সে তো আমি চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি। না, ছুটি তোমাকে নিতেই হবে। তা না হলে ভীষণ রাগ করব আমি।
হেসে বললাম, বেশ, না হয় নিলাম। কিন্তু ছুটির তো শেষ আছে। তারপর?
—তারপর যখন ফিরবে, বিয়ে-থা’ সেরে একেবারে বৌ নিয়ে এসো।
তার উদ্বেগ-আকুল চোখ দুটির দিকে চেয়ে বললাম, তাহলেই তুমি সুখী হবে, কাঞ্ছী? –হবো না? তুমি ভাল আছ, সুখে আছ; তোমার কোনো কষ্ট নেই—দূর থেকে এইটুকু যদি শুনতে পাই, সেই তো আমার পরম সুখ।
আরো বোধ হয় কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু গলাটা ধরে এলো। রক্তাভ গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু।
যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। ওড়নার প্রান্তে অশ্রুরেখা মুছে ফেলে সে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। মাটিতে হাঁটু রেখে উপুড় হয়ে আমার পায়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। বাধা দিলাম না। নত হয়ে ডান হাতখানা তার পিঠের উপর রেখে মনে মনে বোধ হয় আশীর্বাদ করলাম। সমস্ত দেহটা তার থরথর করে কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই বাঁধভাঙা বন্যার মত উপচে পড়ল কান্না। সে অশ্রুধারার উত্তপ্ত গোপন স্পর্শ অক্ষয় হয়ে রইল শুধু আমারই কাছে। এ পৃথিবীতে আমার এই তুচ্ছ পা দুটোই রইল তার একমাত্র নীরব সাক্ষী।
কাঞ্ছীকে এতদিন শুধু হাসতেই দেখেছি। উচ্ছ্বসিত রজতধারার মত হাসি; সংসারে যার তুলনা নেই। আজ বিদায়ের দিনে দেখলাম তার কান্না। হৃদয়-নিংড়ানো দুর্বার কান্না তারও কোনো তুলনা নেই।