লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
উঁচু পাহাড়টার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড গুম্ফাটা। অবস্থানগত কারণে খুব কম পর্যটকই এটা দেখেছে। এমনকী স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে এর সম্পর্কে যেসব ভীতিকর গল্প ছড়িয়ে আছে তা সম্পর্কেও জানে না। যে পর্বতের গায়ে মনাস্ট্রিটা ঝুলে আছে সেটা সাগরসমতল থেকে প্রায় দুই মাইল উঁচুতে। চারপাশে উঁচু সব পর্বতচূড়া গুম্ফাটাকে আড়ালে রাখতে সাহায্য করেছে।
বরফঢাকা হিমালয় ঘেরা বিশাল এক মালভূমি তিব্বত। রহস্যময় এক দেশ এটি। পুরানো রীতি-নীতি নিয়ে টিকে আছে এখনও এর অনেক প্রাচীন মনাস্ট্রি। পর্যটকদের জন্যও অনেকটাই নিষিদ্ধ এলাকা। বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবে এর অনেক কিছুই বদলে গেলেও কোথাও কোথাও নানা ধরনের অদ্ভুত রীতি-নীতি পালন করা হয়।
আমরা এখন যে গুম্ফাটার বর্ণনা দিচ্ছি সেটা কিন্তু এখনও প্রাচীন তিব্বতের বিচিত্র রীতি-নীতি লালন করে আসছে। এর প্রধান লামা খুব ক্ষমতাধর। বলা হয় অদ্ভুত সব ক্ষমতা আছে তাঁর। নানান ধরনের জাদুর রাজা বলা যায় তাঁকে। বিশাল এক দুর্গসদৃশ দালানে বাস করেন তিনি। সেখানে কেবল নির্দিষ্ট কিছু মানুষেরই যাওয়ার সুযোগ মেলে। চারপাশ ঘিরে আছে উঁচু দেয়ালে। এর গায়ে ডজনখানেক জানালা। নিচের ভবনগুলোতে মনাস্ট্রির অন্য লামাদের বাস। উপাসনা আর ধ্যান করে তাঁদের সময় কাটে। আবার আশপাশের গ্রামগুলো থেকে লোকেদের নিয়ে আসা অর্থ-কড়িও সংগ্রহ করেন তাঁরা, গুম্ফার দেখভালের জন্য।
প্রধান লামার দুর্গসদৃশ দালানেই ইয়ামার মন্দির। এখানে বিশাল আকারের একটা কাঠের ভাস্কর্য আছে অন্ধকারের দেবতা ইয়ামার। এর চারপাশ ঘিরে আছে ছোট ছোট কম গুরুত্বপূর্ণ সব ভাস্কর্য। এখনও পুরানো তুকতাক আর মন্ত্রে বিশ্বাসীদের কাছে এই স্ট্যাচু অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাদের জানা নেই এর মুখ থেকে যে শব্দ বের হয় তা আসলে কাঠামোটার পেছনে গুপ্ত কামরায় থাকা এক ভিক্ষুর।
এই মন্দিরের লামারা মাথায় এক ধরনের কালো টুপি পরে থাকে। মন্দিরের নিচে গুপ্ত কক্ষে রাশি রাশি স্বর্ণ আর হীরা-জহরত নাকি লুকানো আছে। তবে এই গুল্ফার বুড়ো, কঠিন চোখের লামা ছাড়া আর কেউ জানেন না এর সত্যতা কতটা কিংবা কীভাবে ওই ধনসম্পদের কাছে যাওয়া যায়।
জাপানের কিয়োটোর এক কিউরিও দোকান। একজন ক্রেতাকে হাতে ধরে রাখা খুলির একটা বল সম্পর্কে বলছে বিক্রেতা। ‘স্যর, এটা তিব্বতের খাঁটি জিনিস। এর জন্য আমাকে কেবল আড়াইশো ইয়েন দিতে হবে তোমাকে। এক মানুষের খুলি দিয়ে এটা তৈরি। যে স্থানীয় লোকটার কাছ থেকে আমার এজেন্ট এটা কিনেছে সে বলেছে এটা লাসার দক্ষিণের এক মন্দির থেকে আনা হয়েছে।’
ক্রেতা আর. এল. রিচার্ডসনের জিনিসটা ভারী পছন্দ হয়েছে। এই অদ্ভুত গুম্ফার কথা এই প্রথম শুনছে সে। জিনিসটা কেনার সঙ্গে সঙ্গে ওই মন্দির এবং এর গুপ্তচর্চা সম্পর্কেও যতটা সম্ভব জেনে নিল।
কোন একটা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলে বসে থাকার লোক নয় রিচার্ডসন। লাসার কাছের রহস্যময় ওই মন্দিরের গুপ্তভাণ্ডারের খোঁজে নিজেই যাওয়া স্থির করল। বন্ধুরা তাকে এই কাজ করতে নিষেধ করল বারবার। তবে অভিযান আর পরানো রত্নের গন্ধ যখন পেয়েছে কে ঠেকায় রিচার্ডসনকে!
মে গেল দার্জিলিং। তারপর পাহাড়ি পথে রওয়ানা হলো। সঙ্গে মালপত্র বোঝাই ঘোড়া আর ভয়াল দর্শন কয়েকজন তিব্বতী গাইড। এদের একজনই কেবল ইংরেজি জানে।
পাঁচ সপ্তাহ পাহাড়ি পথে পাড়ি দিয়ে এক সন্ধ্যায় ওই গুম্ফার ধূসর দালানগুলো যে পাহাড়ের কাঁধে অবস্থিত সেখানে পৌছল।
‘এটাই সে জায়গা,’ অল্পবিস্তর ইংরেজি জানা গাইডটি জানাল, ‘এটা কোথায় জানতাম না। তবে অনেক লোককে জিজ্ঞেস করেছি। তারা কেউ বলেছে এখানে, কেউ ওখানে। তবে আমি এটা বের করেছি। বুদ্ধির জোরে। বাড়তি টাকা পাওনা আমার। দিয়ে দাও। কারণ বড় লামা সাদা মানুষ পছন্দ করেন না। বেঁচে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে ভাল হয় যদি ফিরে যাও।’
তবে দুঃসাহসী অভিযাত্রীর পরিকল্পনা ভিন্ন। মালামাল বোঝাই ঘোড়াগুলোকে দাঁড় করিয়ে মনাস্ট্রির পাঁচ মাইল দূরে নিচু এক পাহাড়সারির পেছনে ক্যাম্প করল। তার লোকদের আপাতত এখানেই অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে একাকী রওয়ানা হলো মনাস্ট্রির উদ্দেশে।
আঁকাবাঁকা পাহাড়টার নিচে যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। দেয়ালের চারকোনা জানালাগুলো গলে কিছুটা আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল রিচার্ডসন। কখনও তার পক্ষে এটা সম্ভব হত না, যদি না ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকত।
প্রথম দালানগুলোর কাছে পৌঁছে সাবধানে ভিক্ষুদের বাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। পাথরের খাড়া ধাপ ছাড়া ওখানে ওঠার আর কোন উপায় নেই। সন্ধ্যার শীতল বাতাস তার কানে নিয়ে এল একটা ঘণ্টাধ্বনি। ওপরের মন্দির থেকে আসছে।
হঠাৎ কাছের দেয়াল থেকে আলাদা হলো কালো একটা ছায়া। তাড়াতাড়ি রিভলভার বের করে যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হলো রিচার্ডসন। আলখেল্লা পরিহিত এক লামার ছায়া ওটা। মাথায় উঁচু ব্রিমের একটা কালো টুপি শোভা পাচ্ছে। ওটার চূড়াটা বিশেষ আকৃতির এক স্তম্ভের আদলে গড়া।
সিঁড়ি বেয়ে একটা ভূতের মত নেমে গেল ছায়াটা। তার আলখেল্লা রিচার্ডসনের রিভলভার ছুঁয়ে গেল। ভিক্ষু বেশ দূরে চলে গেছে নিশ্চিত হওয়ার পর আবার প্রাচীন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল রিচার্ডসন। শেষ পর্যন্ত বিশাল আটকোনা দালানটার সদর দরজার সামনে হাজির হলো। এর ভেতরেই তিন মাথার ইয়ামার অবস্থান। প্রধান লামার কামরায় একটা বাতি জ্বলছে। ওটার আলো ছিটকে আসছে উঠনে।
মন্দিরের দরজাটা তালা তো মারা নয়ই, এমনকী বন্ধও না। ছায়ার মত ভেতরে প্রবেশ করল রিচার্ডসন। তারপর বাসি ছাতা পড়া গন্ধের একটা বড় চেম্বারের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ছাদ থেকে ঝুলছে তিব্বতী পর্দা আর নানা ধরনের পেনডেন্ট। বাতাস ভারী। এখানে-সেখানে বাতিদানিতে লাল কয়লা জ্বলছে। পায়ের নিচের মেঝে ঠাণ্ডা, সেঁতসেঁতে। চারপাশে বড় বড় পিলার মাথা উঁচু করে। ওগুলোর গায়ে সময়ের আবর্তে ফিকে হয়ে যাওয়া নানান কারুকাজ। এসব কিছুই ‘রিচার্ডসন দেখছে তার পকেট থেকে বের করা ফ্ল্যাশ লাইটটার আলোয়। একবার এক জায়গায় আরেকবার অন্য জায়গায় আলো ফেলছে। জানে মৃত্যুকে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে সে’। তবে বিপদ ভালই লাগে এই প্রাক্তন সৈনিকের। আজকের সন্ধ্যাটা রোমাঞ্চকর কিছু আবিষ্কারের প্রত্যাশা এনে দিয়েছে তার মনে।
সামনেই আরেকটা দরজা। প্রথমটা থেকে ছোট। ভেতরের একটা কক্ষ বা চেম্বারের দিকে গিয়েছে। ওই দ্বিতীয় দরজাটা আগলে থাকা দেবতা আর শয়তানের নানান প্রতিমূর্তি আঁকা পর্দাটার কাছে পৌঁছনোর জন্য বইয়ের বাক্স এবং আরও বিভিন্ন জিনিসের মধ্য দিয়ে এগুল।
পর্দাটা একপাশে সরিয়ে কামরাটার ভেতরে তাকাল। মাটির মেঝের মাঝখানে বড় একটা বাতিদানে রাখা বিশাল একটা মোমের আলোয় আবছাভাবে আলোকিত কামরাটা। দেয়ালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছবি আঁকা। মেঝে ঢাকা পুরানো মোটা কাপড় দিয়ে।
বড় একটা পাত্রে ধূপ জ্বলছে সামনে। এর উল্টোপাশে সোনালি গিল্টি করা একটা দরজা পেরোলেই গুপ্তকুঠুরী। দরজা গলে ঝিকমিক করতে থাকা মন্দিরটার দিকে চোখ গেল ‘তার। কাঁপতে থাকা মোমের আলোয় শত শত ছায়া দেখা যাচ্ছে। এদিকে চেম্বারগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস অদ্ভুত একটা হিস হিস শব্দ তৈরি করছে। চারপাশ ধূপের ধোঁয়ায় কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আছে। সব জায়গায় কেমন আলো-আঁধারির খেলা।
কেঁপে উঠল রিচার্ডসন। তারপরও রিভলভারটা আঁকড়ে ধরে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চারপাশে ছোট ছোট দেবতাদের ঘেরাওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিকট দর্শন ইয়ামা। তার তিন মুখে বীভৎস ভঙ্গি। বুকে ক্রুশ আঁকল রিচার্ডসন। পরমুহূর্তেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। ধর্মীয় অমূল্য সব কিউরিওতে পরিপূর্ণ গোটা কামরাটা। পান্না, রুবিতে মোড়া খুলির বাটি, মূল্যবান সব পাথরের জপমালা, অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত ঝুলতে থাকা কাপড়, মূল্যবান পাথর ঝকমক করতে থাকা ছোট মূর্তি, দামি চিত্রকর্ম-এসব কিছু দেখে রিচার্ডসনের তো দিশেহারা অবস্থা। তবে মাথা ঠাণ্ডা রাখল। মূল্যবান আর ছোট জিনিসগুলোই সে হাতিয়ে নেবে।
পান্নার চোখ এবং কপালে হীরে আটকানো জেড পাথরের ছোট্ট এক বুদ্ধমূর্তি তার মনে ধরল। ওটা পকেটে চালান করল। এবার সোনার গিল্টি করা ইয়ামার দিকে তাকাল। দামি সব মুক্তো দিয়ে তৈরি একটা হার ঝুলছে তার গলায়। কীভাবে ওখানে পৌছানো যায় বুঝতে চারপাশে তাকাল। একটা ছোট সিঁড়ি নজর কাড়ল।
ওটা ধরে উঠতেই বহু হাতের ওই দেবতার পেছনে নিজেকে আবিষ্কার করল। আর তখনই বুঝতে পারল ওটা ফাঁপা। মূর্তিটার শূন্য কোটর দিয়ে অনায়াসে তাকাতে পারল রিচার্ডসন।
মুখটা ভেতর থেকে খোদাই করা। তবে তার জানা নেই এখন যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কখনও এসে দাঁড়ান প্রধান লামা। ছোট্ট ছুরির এক খোঁচায় কাঠের পেরেকদুটো খুলে ফেলতেই মুক্তোগুলো এসে হাতে জমা হলো।
মন্দিরের সামনে ফিরে এসে রত্নখচিত জপমালাটা হস্তগত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছল যথেষ্ট হয়েছে। আরও অনেক কিছুই তার পছন্দ। তবে বুদ্ধিমান রিচার্ডসন জানে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণ নিয়ে ফেরা।
গিল্টি করা দরজা ঠেলে বের হয়ে আবারও সেই শত ছায়ার রুমে প্রবেশ করল। কামরাটার আশ্চর্য নীরবতা তাকে আঁকড়ে ধরল। ভয় পেয়ে গেল কেন যেন। হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগল। ব্রোঞ্জের বাতিদানের মধ্যে বিশাল মোমবাতিটাকে পাশ কাটাল। অশুভ জায়গাটি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করলেও থেমে চারপাশে দৃষ্টি বোলাল। মৃদু, ব্যাখ্যাতীত একটা শব্দ কানে এল তার। আবছা আলো- আঁধারিতে প্রতিটি কোণ এবং কুলুঙ্গিতে খেলা করা ছায়াগুলো দেখে চুলগুলো খাড়া হয়ে গেল।
হঠাৎই বুঝতে পারল ছায়াগুলো জীবন্ত। মনে মনে নিজেকে একটা ধমক দিল। এটা অবশ্যই কল্পনা। আবার তাকাল। এবার আর কোন ভুল নেই। চওড়া কিনারার একটা কালো টুপি নজর কাড়ল তার। ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। যে দরজাটা কেবল পেরিয়ে এসেছে সেদিকে তাকাল। আতঙ্কে পিছু হটল। আরেকটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। ওটার মাথায়ও কালো টুপি। যেদিকেই তাকাল কালো টুপির ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। পালাবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। দ্রুত ঘুরে ভেতরের মন্দিরের দিকে যাওয়া দরজাটার দিকে এগুল। ওটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। সে নিশ্চিত এই কামরাতে ঢুকবার কিংবা এর থেকে বেরোবার আর কোন পথ নেই। চারপাশের ছায়াগুলো দেখছে।
হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানি। এটা কোন দৃষ্টিবিভ্রম নয়। ভুতুড়ে এক কাঠামো, যেটাকে ছায়া ভেবেছিল, ওটার হাতে শোভা পাচ্ছে ধারালো এক ছুরি। শিস দেয়ার মত একটা আওয়াজ। প্রবৃত্তিগতভাবে মাথা নিচু করল রিচার্ডসন। আর এটাই জীবন বাঁচিয়ে দিল তার। যেখানে মুখটা ছিল সে জায়গাটা দিয়ে সজোরে চলে গেল পাতলা একটা ইস্পাতের ছুরি। ব্রোঞ্জের একটা বলে বাড়ি খেয়ে তার পায়ের ওপর পড়ল ওটা।
ছায়াগুলোর মধ্যে একটাকে লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করল রিচার্ডসন। তারপর আরেকটাকে নিশানা করল। কিন্তু বুঝতে পারল কোন লাভ হবে না। ওগুলো খুব ঝাপসা। পকেট থেকে টর্চটা বের করে একটা অন্ধকার কোণ লক্ষ্য করে বাতিটা জ্বালল। আঁধার কেটে যাওয়া আলোকরশ্মিতে লম্বা, পাতলা একটা কাঠামো ধরা দিল। গায়ে এক জাতের হরিণের চামড়ার পোশাক, মাথায় কালো টুপি। আলো পড়তেই দেয়ালের গায়ে ঝুলতে থাকা নকশাখচিত কাপড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল কাঠামোটা। তারপরই একটা চিৎকার শোনা গেল। নানা দিক থেকে ছুরি হাতে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতে লাগল।
রিচার্ডসনের হাতের রিভলভার আগুন ঝরাল। চিৎকারের সঙ্গে যোগ হলো গোঙানি। দুটো কাঠামো মাটিতে আছড়ে পড়ল। পরমুহূর্তে খালি হয়ে গেল কামরাটা।
একটার পর একটা ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে লাগল। রিচার্ডসন কড়া পাহারায় আছে। কিছুই এল না। এখান থেকে নড়তে সাহস করল না সে। দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করতেই মৃদু একটা আওয়াজ শুনল। সেদিকে টর্চের আলো ফেলল। দেখল দেয়ালের পর্দাগুলো একটু নড়ছে।
ভোর হলো। একই সঙ্গে ক্লান্ত, চিন্তিত রিচার্ডসনের দিশেহারা অবস্থা। একটা সেগুন কাঠের টুলের ওপর বসল। সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকতে পারছে কমই। কেবল আবছা একটা আলোর আভা জানিয়ে দিল ভোরের আগমনী। কামরাটা বিশেষ করে যে ছোট্ট চেম্বারটায় আছে সেটা ভালভাবে পরীক্ষা করতে লাগল।
ঈষৎ দুলতে থাকা পর্দা ভরা এই হল ছাড়া পালানোর আর কোন রাস্তা যে সামনে খোলা নেই এটা ভালই বুঝতে পারছে রিচার্ডসন। এটা করার চেষ্টা করলে অন্তত বিশটা ছুরি তার পিঠে গাঁথবে। মাটিতে ভূপাতিত দুই লামার দেহ অদৃশ্য হয়েছে। কে তাদের নিয়েছে বলতে পারবে না।
দরজার গরাদের ফাঁক দিয়ে যখন দেয়াল এবং ছাদ পর্যবেক্ষণ করছে হঠাৎ বুঝতে পারল, পায়ের নিচে মাটি নড়ছে তার। পাথুরে ভূমি যেন একটু একটু করে ওপরে উঠছে।
লাফিয়ে সরে গিয়ে তাকাল লুকানোর একটা জায়গার খোঁজে। এসময়ই বুদ্ধিটা এল মাথায়। ইয়ামার ফাঁপা শরীরটার ভেতরেই তো লুকাতে পারে সে।
গিল্ড করা দরজার ওপর দ্রুত একটা পর্দা ফেলল, যেন তার গতিবিধি কারও নজরে না পড়ে। ভুতুড়ে দেবতার কাঠামোর দিকে সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গেল। তারপর বিশাল মূর্তিটার পেছনে ঢুকে পড়ল অনায়াসে।
ইয়ামার শূন্যগর্ভ চোখ দিয়ে দেখছে সে। মাটি আস্তে আস্তে ওপরে উঠেই চলেছে। মাটির সমতলের কয়েক ইঞ্চি নিচে একটা ট্র্যাপডোর আছে নিশ্চিতভাবেই। সম্ভবত মন্দিরের নিচের মূল্যবান হীরা-জহরতের ভল্টের দিকে গিয়েছে ওটা।
একটু একটু করে ওপরে উঠছে মেঝের ওই অংশ। ট্র্যাপডোরের ওপরের অংশটা ধরে থাকা লম্বা হলুদ একটা হাত নজরে পড়ল। কয়েক সেকেণ্ড পর কালো টুপি পরা একটা কাঠামো খোলা অংশটা দিয়ে চেহারা দেখাল। সিঁড়ি ধরে এসে বিশাল স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়াল লামা।
তারপর একজনের পর একজন আসতেই লাগল। এভাবে জনা বারো লামা হাজির হলো গুপ্ত দরজাটা দিয়ে। রিচার্ডসন টু শব্দটি করছে না। লামারা খোঁজ করতে লাগল তার। দরজা খুলে দেখল। ভেতর থেকে যোগ দিল আরও কয়েকজন। উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে কামরার নানা দিকে নির্দেশ করছে। তবে ইয়ামার স্ট্যাচুর দিকে নজর নেই কারও। তারপরই একজনের নজরে পড়ল দেবতার হার গায়েব। অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ক্রোধে, দুঃখে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।
এসময়ই প্রধান লামা বা মন্দিরের অধ্যক্ষ হাজির হলেন। গলায় পেঁচানো নানা ধরনের মূল্যবান পাথরের অনেকগুলো জপমালা। নিচু স্বরে কী যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে চারজন লামা সিঁড়ি বেয়ে ইয়ামার ভাস্কর্যের দিকে আসতে লাগল। নেকলেসটা চুরি করায় নিজেকে অভিশাপ দিল রিচার্ডসন তবে এখন আর অতীতের ভুলের কথা ভেবে লাভ নেই। প্রথম লামাটির মাথা নজরে আসতেই ঘুরে গুলি করল। একটা চিৎকার। পরক্ষণেই ভিক্ষুরা সঙ্গীর দেহটা নিয়ে পিছু হটল। সবাই গিল্টি করা দেবতার মূর্তির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।
প্রধান লামা কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর নিচু কণ্ঠে বেশ কিছুটা সময় ধরে নির্দেশ দিলেন। সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। এক ঘণ্টা পর তিনজন ফিরল। দু’জন ভারী একটা টেবিল বহন করে এনেছে। ওটাকে মেঝেতে পাতা হলো। লম্বা একটা বোর্ডের ভারে রীতিমত নুয়ে পড়েছে আরেকজন। ওটার ওপরে ময়দা দিয়ে বানানো মানুষের একটা কাঠামো শোয়ানো। এখানে নরবলি দেয়া নিষিদ্ধ। এর বদলে ময়দায় তৈরি মানুষের কাঠামো ব্যবহার করা হয়। একজন সাদা মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে এখানে। এবার ওটাকে টেবিলের ওপর রেখে তিনজন অদৃশ্য হলো।
একটার পর একটা ঘণ্টা পেরোতে লাগল। আবারও সন্ধ্যা এল। একজন লামার নিয়ে আসা মোম আবছা আলো ছড়াচ্ছে ময়দার কাঠামোটার ওপর। কেউ নেই দেখে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এল রিচার্ডসন, হাত-পায়ের খিল ছাড়ানোর জন্য। আরও একটা রাতের আতঙ্ক চেপে ধরল তাকে। খাবার, পানি ছাড়া এভাবে কয়দিন বাঁচতে পারবে জানে না। তবে পৃথিবীর মায়া এখনই কাটাতে চায় না।
ঘড়িতে যখন দশটা তখন আবার ছায়াময় কিছু কাঠামো একটার পর একটা হাজির হতে লাগল। জমকালো পোশাক পরনে। অনেকের মাথায় সিংহ, পাখি, ড্রাগন নানান কিছুর মুখোশ। কাঁপছে, মন্ত্র পড়ছে ছায়ামূর্তিগুলো। ওগুলো কি মানুষ নাকি অন্য কিছু বলতে পারবে না রিচার্ডসন। হঠাৎ অদ্ভুত জিনিসগুলোর মাঝখানে আবির্ভূত হলেন প্রধান লামা। ঢিলেঢালা জমকালো এক আলখেল্লা পরনে, মাথায় কালো টুপি। এক হাতে একটা মশালের মত, অন্যহাতে লম্বা একটা লাঠির মাথায় সুচালো ইস্পাতের ফলা। ইয়ামার দিকে মুখ উঁচু করে কথা বলতে শুরু করলেন, ‘সাদা মানুষ, তুমি আমাদের পবিত্র মন্দির লুঠ করতে এসেছ। ইয়ামার হার চুরি করেছ। আমরা তোমাকে আঘাত করিনি। কিন্তু তুমি আমাদের ভিক্ষুদের হত্যা করেছ। এখন দুটো পথ খোলা আছে তোমার সামনে। শয়তানি লাঠিটা (রিভলভার) ব্যবহার করে মরো, নতুবা আমরা তোমাকে মারব। তুমি পালাতে পারবে না। আমাদের এক ডজনকে মারলেও বাকিরা তোমাকে হত্যা করবে। আমরা চাইলে অনাহারে রেখেও মারতে পারি তোমাকে। এর চেয়ে নিজে নিজেই মরো।’
নিঃশব্দে হাসল রিচার্ডসন। মূর্তির অশুভ হাঁ করা মুখটার মাঝখান দিয়ে নিশানা করে গুলি করল। বুড়ো লামার শরীরটা কেঁপে উঠল। হাত থেকে মশালের মত জিনিসটা খসে পড়ল। তাঁর কাঁধ ভেদ করে গিয়েছে বুলেট। দু’জন লামা তাঁকে সাহায্য করতে এগুল। কিন্তু হাত নেড়ে নিষেধ করলেন। মন্দিরের ওই অদ্ভুত মানুষ কিংবা জন্তুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগুলেন তিনি। ময়দার তাল দিয়ে তৈরি কাঠামোটার সামনে দাঁড়ালেন। একজন সহকারী একটা ধারালো ছুরি এনে দিল তাঁকে।
ইয়ামার মুখের দিকে চোখ তুলে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করলেন প্রধান লামা। ক্রমেই বাড়তে লাগল তাঁর কণ্ঠের জোর। সেই সঙ্গে বেজে উঠল মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। চারপাশে ঘিরে থাকা অদ্ভুত ওই ছায়ামূর্তিগুলো পৈশাচিক কণ্ঠে হুল্লোড় করছে।
রিচার্ডসনের কেমন ঘুম ঘুম আসছে। খাবার আর ঘুমের অভাবেই এমনটা হয়েছে, ভাবল সে।
কান ফাটানো একটা অশুভ চিৎকারের মধ্য দিয়ে শেষ হলো প্রধান লামার মন্ত্রপাঠ। যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোন ঈগলের মরণ চিৎকার। তারপর আশ্চর্য নীরবতা। মাথা তুলে লুকিয়ে থাকা সাদা মানুষের উদ্দেশে বললেন, ‘তুমি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করোনি। এবার লামাদের জাদুর হাতে মরবে। কিছুই করতে পারবে না। কারণ লামাদের গুপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তোমাদের সাদা মানুষদের।’
ঝুঁকে পড়ে ছুরিটা দিয়ে ময়দার মূর্তিটার এক হাত কেটে ফেললেন তিনি। ওটা মাটিতে ছুঁড়ে মারলেন। ওখান থেকে রক্তের মত একটা কিছু বেরোতে লাগল।
ইয়ামার ভেতর থেকে অমানুষিক এক আর্তনাদ শোনা গেল। এবার অপর হাতটা কাটলেন লামা। তারপর দুই পা। ভয়ঙ্কর এক আঘাতে ময়দার তালটাকে রীতিমত ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারলেন।
সবশেষে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করলেন। এটা যখন করলেন ভেতরের গোঙানি থেমে গেল। তারপরই কাঠের কাঠামোটা বেদি থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ওটার ওপর পড়ে বেদিটাকেই খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলল। তারপর পড়ল টেবিলের ওপর। টেবিলটাকে ভেঙে ফাঁপা কাঠামোটা অন্তত এক ডজন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। প্রধান লামার কাঁপতে থাকা শরীরটা, যেটা অন্য লামারা ধরে রেখেছে, রিচার্ডসনের কাঠামোটার দিকে তাকাল। ময়দার তালটা যেভাবে কাটা হয়েছে সেভাবেই কাটা পড়েছে সাদা মানুষের শরীরটা।