লোভসংবরণ
এক দরিদ্র বালক কোনও বড় মানুষের বাটীতে কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছিল। তাহার প্রতি গৃহমার্জ্জনা প্রভৃতি অতি সামান্য নিকৃষ্ট কর্ম্মের ভার ছিল। সে, এক দিন, গৃহস্বামিনীর বাসগৃহ পরিষ্কার করিতেছে, এবং গৃহমধ্যে সজ্জিত মনোহর দ্রব্য সকল অবলোকন করিয়া, আহ্লাদে পুলকিত হইতেছে। তৎকালে সে গৃহে অন্য কোনও ব্যক্তি ছিল না, এজন্য সে নির্ভয়ে এক একটি দ্রব্য হস্তে লইয়া, কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, পুনরায় যথাস্থানে রাখিয়া দিতেছে।
গৃহস্বামিনীর একটি সোনার ঘড়ী ছিল, সেটি অতি মনোহর, উত্তম স্বর্ণে নির্ম্মিত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরকখণ্ডে অলঙ্কৃত। বালক, ঘড়ীটি হস্তে লইয়া উহার অসাধারণ সৌন্দর্য্য ও ঔজ্জ্বল্য দর্শনে মোহিত হইল, এবং বলিতে লাগিল, যদি আমার এরূপ একটি ঘড়ী থাকিত, তাহা হইলে কি আহলাদের বিষয় হইত। ক্রমে ক্রমে তাহার মনে প্রবল লোভ জন্মিলে, সে ঘড়ীটি অপহরণ করিবার নিমিত্ত ইচ্ছুক হইল।
কিয়ৎক্ষণ পরে, বালক সহসা চকিত হইয়া উঠিল, এবং কহিতে লাগিল, যদি আমি, লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া এই ঘড়ী লই, তাহা হইলে চোর হইলাম। এখন কেহ গৃহমধ্যে নাই, সুতরাং আমি চুরি করিলাম বলিয়া কেহ জানিতে পারিবে না, কিন্তু যদি দৈবাৎ চোর বলিয়া ধরা পড়ি, তাহা হইলে আমার দুর্দ্দশার সীমা থাকিবে না। সর্ব্বদা দেখিতে পাই, চোরেরা রাজদণ্ডে যৎপরোনাস্তি শাস্তি ভোগ করিয়া থাকে। আর যদিই আমি চুরি করিয়া মানুষের হাত এড়াইতে পারি, ঈশ্বরের নিকট কখনও পরিত্রাণ পাইতে পারিব না। জননীর নিকট অনেক বার শুনিয়াছি, আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না বটে, কিন্তু তিনি সর্ব্বদা সর্ব্বত্র বিদ্যমান রহিয়াছেন, এবং আমরা যখন যাহা করি, সমুদয় প্রত্যক্ষ করিতেছেন।
এই বলিতে বলিতে, তাহার মুখ ম্লান ও সর্ব্বশরীর কম্পিত হইয়া উঠিল। তখন সে ঘড়ীটি যথাস্থানে স্থাপিত করিয়া, কহিতে লাগিল, লোভ করা বড় দোষ, লোকে, লোভ সংবরণ করিতে না পারিলেই, চোর হয়, আমি আর কখনও কোনও বস্তুতে লোভ করিব না, এবং লোভের বশীভূত হইয়া, চোর হইব না, চোর হইয়া ধনবান্ হওয়া অপেক্ষা, ধর্ম্মপথে থাকিয়া নির্ধন হওয়া ভাল। তাহাতে চির কাল নির্ভয়ে ও মনের সুখে থাকা যায়। চুরি করিতে উদ্যত হইয়া, আমার মনে এত ক্লেশ হইল, চুরি করিলে, না জানি আমি কতই ক্লেশ পাইতাম। এই বলিয়া, সেই সুবোধ, সচ্চরিত্র দরিদ্র বালক পুনরায় গৃহ মার্জ্জনে প্রবৃত্ত হইল।
গৃহস্বামিনী সেই সময়ে পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে উপবিষ্টা থাকিয়া, বালকের সমস্ত কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন। তিনি তাহাকে তৎক্ষণাৎ এক পরিচারিকা দ্বারা আপন সম্মুখে আনাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, অহে বালক। তুমি কি জন্য আমার ঘড়ীটি লইলে না? বালক, শুনিবা মাত্র স্তব্ধ ও হতবুদ্ধি হইয়া গেল, কোনও উত্তর দিতে পারিল না, কেবল, জানু পাতিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিষণ্ণ বদনে, কাতর নয়নে গৃহস্বামিনীর মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। ভয়ে তাহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে ও নয়ন হইতে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল।
তাহাকে এইরূপ কাতর দেখিয়া, গৃহস্বামিনী স্নেহবাক্যে কহিতে লাগিলেন, বৎস। তোমার কোনও ভয় নাই, তুমি কি জন্য এত কাতর হইতেছ? আমি, এই খানে থাকিয়া, তোমার সকল কথা শুনিতে পাইয়াছি, শুনিয়া তোমার উপর কি পর্য্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি, বলিতে পারি না। তুমি দরিদ্রের সন্তান বটে, কিন্তু আমি কখনও তোমার তুল্য সুবোধ ও ধর্ম্মভীত বালক দেখি নাই, জগদীশ্বর তোমায় যে লোভ সংবরণ করিবার এরূপ শক্তি দিয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহাকে প্রণাম কর ও ধন্যবাদ দাও। অতঃপর, সর্ব্বদা এরূপ সাবধান থাকিবে, যেন কখনও লোভে পতিত না হও।
এই বলিয়া, তাহাকে অভয় প্রদান করিয়া, তিনি কহিলেন, শুন বৎস। তুমি যে এরূপে লোভসংবরণ করিতে পারিয়াছ, তজ্জন্য তোমাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। এই বলিয়া, কতিপয় মুদ্রা তাহার হস্তে দিয়া, কহিলেন, অতঃপর, তোমায় আর গৃহমার্জ্জন প্রভৃতি নীচ কর্ম্ম করিতে হইবে না, তুমি, বিদ্যা শিক্ষা করিলে, আরও সুবোধ ও সচ্চরিত্র হইবে, এজন্য কল্য অবধি আমি তোমাকে বিদ্যালয়ে নিযুক্ত করিয়া দিব, এবং অন্ন বস্ত্র পুস্তক প্রভৃতি সমস্ত আবশ্যক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহ করিব। অনন্তর, তিনি হস্তে ধরিয়া তাহাকে উঠাইলেন, এবং তাহার নয়নের অশ্রুজল মার্জ্জন করিয়া দিলেন।
গৃহস্বামিনীর এইরূপ স্নেহবাক্য শ্রবণে ও সদয় ব্যবহার দর্শনে, সেই দীন বালকের আহ্লাদের সীমা রহিল না। তাহার নয়নযুগল হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। সে, পর দিন অবধি, বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, যার পর নাই যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া, শিক্ষা করিতে লাগিল। কালক্রমে সে বিলক্ষণ বিদ্যা উপার্জ্জন করিল, এবং লোকসমাজে বিদ্বান্ ও ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি বলিয়া গণ্য হইয়া, সুখে ও স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে লাগিল।