লোটেশ্বরের সাধু – দিব্যেন্দু পালিত

লোটেশ্বরের সাধু – দিব্যেন্দু পালিত

কালীমন্দিরের পিছন দিকের বাঁধানো চাতালে হঠাৎই এক সাধু এসে আস্তানা গেড়েছে। যেমন-তেমন সাধু নয়। বেশ ভারিক্কি চেহারা। পরনে আধময়লা গেরুয়া, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথা থেকে পিঠের ওপর নামানো একজট চুল। সঙ্গে কমণ্ডলু, ছড়ি আর একটি ঝোলাও আছে। কথাবার্তা বলছে না, তবে ‘ব্যোম্‌’, ‘বুয়াম্‌’ হাঁক ছাড়ছে মাঝে মাঝে।

খবরটা রটতে দেরি হল না।

কোত্থেকে এল এই সাধু! সবাই বলতে লাগল, হ্যাঁ, তাই তো! জলজ্যান্ত এক সাধু তো আর হঠাৎ আকাশ থেকে পড়তে পারে না। তাকে আসতে হলে শহরে ঢোকার যে-কোনও একটা পথ দিয়েই আসতে হবে।

শহরটা ছোট হলেও বাইরে থেকে এখানে ঢোকার পথ বড় কম নেই। এ ছাড়া দিনে দশ-বারোটা ট্রেন চলাচল করে স্টেশনের ওপর দিয়ে। তারই কোনও একটা থেকে নেমে পড়ল না তো!

কেউ বলল, শহর থেকে একটু দূরে রেলপুলের ওদিকে আছে দূরপাল্লার বাসের স্ট্যান্ড। পাটনা, রাঁচি, ধানবাদ, দুমকা থেকে বাস আসে ওখানে। তারই কোনওটায় এসে থাকতে পারে।

অন্যরাও বলল, এসব সম্ভাবনা কম। রেল স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঙালিটোলা কালীমন্দিরের দূরত্ব কম নয়। ওসব জায়গা থেকে আসতে হলে শহরের মধ্যে দিয়েই আসতে হবে। মানুষজনের ভিড়ে এ শহর এমনই গিজগিজে হয়ে থাকে যে সাধু তো ছার, আঁস্তাকুড় থেকে নর্দমায় ছুঁচো লাফ দিলেও কারও না কারও চোখে পড়ে যায়। চেহারায় ও বেশবাসে এ যে-সে মানুষ নয় যে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেলে কারওই চোখে পড়বে না। রিকশ বা এক্কায় এলে অবশ্যই ধরা পড়ত। সাধুকে কেউ রঙিন কাচের মোটরগাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়েছে এখানে, এমনটাও বিশ্বাস করা যায় না। সেরকম গাড়িও তো নেই শহরে।

একটা ঘটনা অবশ্য ঘটতে পারে। কালীমন্দিরের দু’শো গজের মধ্যেই আছে গঙ্গা। নদীর ওপার থেকে। সাঁতরে এল না তো!

না, সবাই মাথা নাড়ল, সে-সম্ভাবনাও নেই। গঙ্গা বলতে এখন যেটা আছে সেটা নালা মাত্র। গোড়ালি ভেজানো জলে ডিঙিও ভাসবে না। ওপারে অনেক দূর পর্যন্ত ধুধু বালি আর এঁটেল মাটি, মটরশুঁটি আর তরমুজের খেত শুকিয়ে এখন শুধুই আগাছা-ভরতি। বর্ষার কিছুদিন বাদ দিলে ন্যাড়া পড়ে থাকে। ওদিক থেকে আসতে হলে আগে যেতে হবে ওদিকে। তাতেও পেরোতে হবে শহর আর লোকচক্ষু।

কীভাবে এল তার কোনও হদিশই যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সকলেই ধরে নিল, ট্রেন থেকে নামুক কি বাস থেকেই নামুক, সাধু নিশ্চয়ই এসেছে রাতের অন্ধকারে। এ-শহরে শিবমন্দির আছে, হনুমান মন্দির আছে, আছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। ওসব মন্দিরে না গিয়ে যখন কালীমন্দিরেই এসেছে, তখন এ তান্ত্রিকও হতে পারে। গত কালীপুজোয় ঠিকঠাক ভোগ না হওয়ায় পুজো কমিটির সেক্রেটারি টাকা মেরে দিয়েছে বলে গোলমাল হয়েছিল খুব। মন্দিরের পূজারি বিষাদ মুখুজ্যে আদ্যিকালের মানুষ; সেও বলেছিল মায়ের পুজোয় ঢালাও ভোগ হচ্ছে না, শূন্য বাটি হাতে ফিরে যাচ্ছে মেয়েপুরুষ, কাচাকুচোরা, এমনটি সে আগে কখনও দ্যাখেনি। এ বড় গোলমেলে ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত মা কালীর রোষে না পড়তে হয়।

এসব ঘটনার পর হঠাৎ সাধুর আবির্ভাবে বিষাদ মুখুজ্যেই ঘাবড়াল সবচেয়ে বেশি। এদিকের গঙ্গা শুকিয়ে যাবার ফলে রাত থাকতেই ছ’মাইল পথ হেঁটে রোজ দূরের বড় গঙ্গায় স্নান করতে যায় সে, ফেরেও ছ’মাইল হেঁটে। অভ্যাসের হাঁটা হলেও আড়াই-তিন ঘণ্টার ব্যাপার। ফিরে এসে ভিজে জামাকাপড় মেলতে গিয়ে দ্যাখে, মূর্তিমান সাধু বসে আছে চাতালের কোণে।

লোকজনের কানাকানি, ভিড় আর জটলা যখন চরমে, তখন বিষাদ মুখুজ্যেই সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল সাধুর সঙ্গে কথা বলতে। ফিরে এসে বলল, “সাধুও হতে পারে, তান্ত্রিকও হতে পারে। কথা তো বলে না দেখি।”

“কিছুই বলল না?”

বিষাদ মুখুজ্যে বলল, “দুটো কথাই বলল শুধু। লোটেশ্বরম আর বটুকম।”

“এ তো সংস্কৃত মনে হচ্ছে।” বাংলা স্কুলে সংস্কৃত পড়ায় গদাই-মাস্টার। বাজার-ফেরত মন্দিরের সামনে ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। থলে থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল শাক আর সজনে ডাঁটা। বলল, “ঠিক শুনেছেন তো, পণ্ডিতমশাই? বসুধৈব কুটুম্বকম বলেনি তো?”

“দ্যাখো, মাস্টার! বেশি জ্ঞান ফোলিয়ো না।” বিষাদ মুখুজ্যে বলল, “তিন কুড়ি দশ বয়স হল আমার। কানে এখনও তোমাদের চেয়ে ভাল শুনি। আমি হয়ে গেলাম কালা!”

“না, না। আপনাকে কালা বলব কেন!” ভয়ে গুটিয়ে গেল গদাই-মাস্টার। তারপর আমতা আমতা করে বলল, “লোটেশ্বরম কি কোনও জায়গার নাম? লোটে যে ঈশ্বর, তাঁর নিবাস যেখানে…! নাঃ। ব্যাকরণ, প্রকৃতি প্রত্যয়েও তো দাঁড়ায় না। ব্যাপারটা!”

“কেন দাঁড়াবে না!” খজু মণ্ডল কুস্তির আখড়া চালায়। সাতসকালে চেলাদের কয়েকটা রদ্দা-মার শিখিয়ে সবে অঙ্কুর গজানো কাঁচা ছোলা আর আদাকুচি মেখে খেতে বসেছিল, হট্টগোল শুনে কোনওরকমে ল্যাঙট-এর ওপর পায়জামা চাপিয়ে মাটি গায়েই ছুটে এসেছে সব ফেলে। গদাই-মাস্টারের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “রামেশ্বরম হতে পারলে ললাটেশ্বরম হবে না কেন! আপনার দৌড় তো বাড়ি থেকে স্কুল অবধি। মাদ্রাজে রেসলিং কম্পিটিশনে গিয়েছিলাম সেবার— রামেশ্বরম ঘুরে এসেছি। ওড়িশায় আছে বালেশ্বর। সব এক লাইনে। ম্যাড্রাস মেল ধরলেই হয়। এ সাধু নিশ্চয়ই লোটেশ্বরম থেকে এসেছে। লোটেশ্বরের সাধু।”

খজুর আত্মবিশ্বাসী কথা শুনে আরও দমে গিয়ে কেটে পড়ার কথা ভাবল গদাই-মাস্টার। যাবার আগে বলল, “তা আপনিই গিয়ে কথা বলে দেখুন না একবার। বটুকম কথাটারও কোনও মানে থাকতে পারে। চেপে ধরলে কি বলবে না!”

“হ্যাঁ, চেপে ধরার ব্যাপার হলে খজুদাই যাক।” ভিড়ের পিছন থেকে কে একজন বলল, “সাধুবাবার চেহারাটা বড়ই জবরদস্ত। যদি রদ্দাটদ্দা মারে…”

“না, না। রদ্দাফদ্দায় যেয়ো না।” বিষাদ মুখুজে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “মা’র কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না বুঝতে পারছি না। মা আমার জাগ্রত। যখন চাঁদার টাকা মারা গেল, ভোগ হল না— তখন যে কেন তোমরা একটা বিহিত করলে না!”

জটলার মধ্যেই হঠাৎ ভেসে এল ‘ব্যোম’ শব্দ। উচ্চারণ একটু বেঁকে গিয়ে ‘বুয়াম্’-এর মতো শোনাচ্ছে। হাঁক তো নয়, যেন শব্দভেদী বাণ। নিমেষে চারপাশের সব শব্দ ছারখার করে চুপ করিয়ে দিল সবাইকে।

কিন্তু ফিসফাস থামল না। ঠিক হল, খজু তার দুই চেলাকে নিয়ে সাধুর কাছে যাবে। মন্দিরের পূজারি বিষাদ মুখুজ্যেও থাকবে আশপাশে। আরও একটু দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে অন্যরা। সাধুর ঠিকঠাক পরিচয় জানা দরকার। মতলব কিছু আছে কি না সেটাও বোঝা দরকার। আজকাল চারদিকে বহু বদলোক ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, কেউ সাধু, কেউ বাবা। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টু-পাইস কামিয়ে নেয়। এও যদি সেরকম কেউ হয়! তা ছাড়া বিষাদ মুখুজ্যে এই কালীমন্দিরে আছে চল্লিশ বছরেরও বেশি। লোটেশ্বরের সাধু একবার গেড়ে বসলে যদি তাকেও মন্দির ছাড়া হতে হয়। না, সেটা হতে দেওয়া যায় না।

কথামতো খজু আর তার চেলারা সাধুর সঙ্গে কথা বলে ফিরে এল। সঙ্গে বিষাদ মুখুজ্যে। কাজ হয়নি বিশেষ। বড়ই অদ্ভুত এই সাধু। কথা প্রায় বলেই না।

কিন্তু খজুদা গেছে আর একেবারেই কাজ হয়নি, এটা তো হতে পারে না। জানা গেল, ‘লোটেশ্বরম’ আর ‘বটুকম’-এর পরে আরও একটা শব্দ বেরিয়েছে সাধুর মুখ থেকে। ‘দত্তম’। সাধু যেন বলল ‘বটুক দত্তম’। এ আবার কোন ভাষা!

নান্টু পাল রাজনীতি করে। গতবার বিধানসভা নির্বাচনে একশো আঠারোটা পয়েন্টে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে প্রায় একাই জিতিয়ে দিয়েছিল গণেশ পাণ্ডেকে। গোটা বাঙালিটোলা ঝেঁটিয়ে ভোট পাইয়ে দিয়েছিল ওই গণেশবাবুকে। আগামী বছর নান্টুকেই হয়তো কালীপুজো কমিটির সেক্রেটারি করা হবে। তা রেল স্টেশন থেকে তিনখানা খবরের কাগজ কিনে নান্টু ফিরছিল সাইকেলে চেপে। জটলা দেখে নেমে পড়ে। দূর থেকে একবার সাধুকে দেখে ফিরে এসে বলল, “মনে হচ্ছে একটা বোঝাবুঝির অভাব হচ্ছে কোথাও। কমিউনিকেশন গ্যাপ। লোকটার মুখের রং চকচকে তামাটে। ঠিক বাঙালি কালার নয়। তামিল বা অন্ধ্রপ্রদেশের লোক হতে পারে। ওর ভাষা বোঝা আমাদের কম্মো নয়।”

বলে একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিল নান্টু পাল। আবার বলল, “এ-পাড়ায় একজন মাত্রাজের লোক ছিল না? গতবার ভোটের সময়…”।

হঠাৎ ব্যোম্ শব্দে চমকে গিয়ে কথা শেষ করতে পারল না নান্টু। শক্ত করে চেপে ধরল সাইকেলের হ্যান্ডেল।

“দাঁড়াও বাবা, দাঁড়াও। এখন আর মাদ্রাজের লোক খুঁজে কাজ নেই।” বিষাদ মুখুজ্যে এতক্ষণ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ক্লু পেয়ে যাওয়ার ধরনে বলল, “বটুক দত্তম মানে বটুক দত্ত নয় তো? খজু, এ-পাড়ায় তো একজন বটুক দত্তও ছিল! মনে আছে?”

খজু এক ফাঁকে পাঞ্জাবি গলিয়ে নিয়েছে গায়ে। বলল, “তারা তো অনেক বছর পাড়াছাড়া পণ্ডিতমশাই! ওই তো, সরকারদের পাশের বাড়ি। ওখানেই থাকত।” তর্জনী তুলে অল্প দূরে দোতলা হলদে বাড়িটার দিকে নির্দেশ করল খজু, “সেই একতলা বাড়িটাও নেই এখন। ভাড়াটে উঠে যাবার পর সরকাররা কিনে নতুন দোতলা গড়েছে।”

বাজারের থলি বাড়িতে রেখে ফিরে এসেছিল গদাই-মাস্টার। বলল, “পাড়া ছাড়লেও শহর ছাড়েনি। বোধহয় ভিখনপুরের দিকে থাকে। ভদ্রলোক পোস্টাপিসে কাজ করতেন না? ওঁর ছোট ছেলে তো আমাদের স্কুলে পড়ে এখনও। অবশ্য একই নামের একাধিক লোকও থাকতে পারে।”

নান্টু পাল মনোযোগ দিয়ে গদাই-মাস্টারের কথা শুনছিল। কী ভেবে সাইকেলটা একজনের হাতে ধরিয়ে একাই ছুটে গেল মন্দিরের চাতালের দিকে। পিছনে পিছনে খজুও।

ধ্যানস্থ লোটেশ্বরের সাধুর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিজের সংস্কৃত-জ্ঞান ফলিয়ে নান্টু বলল, “প্রণামং বাবাম্‌। বটুক দত্তম্‌ নিবাসম্‌ যাবম্‌?”

সাধু ওর কথাবার্তার কিছু বুঝল কি না কে জানে! ধ্যান ভেঙে চোখ খুলে খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিজের বুকে হাত ঠেকিয়ে অতিরিক্ত জোর দিয়ে হাঁক পাড়ল, “বাবাম্‌! বুয়াম!” সেই হাঁক শুনে পিছিয়ে এল দু’জনেই।

নান্টু হতাশ হয়ে বলল, “নাঃ! এ এক্কেবারে খাঁটি নন-বেঙ্গলি সাধু। কিছু বুঝেছে বলে মনে হল না। বাঙালি হলে প্রশ্নটা বুঝত। কী খজুদা, তাই মনে হল না?”

খজু নিজের মোটা ঘাড়ে ডান হাতের কাটারি মারের রদ্দা ঠুকতে ঠুকতে বলল, “বাঙালি হোক বা অবাঙালি, হঠাৎ এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী তা জানা দরকার। পুলিশে খবর দিলে হয় না?”

“পুলিশ!” বিষাদ মুখুজ্যে তেতে উঠে বলল, “মন্দিরে পুলিশ ঢুকে সাধুকে গ্রেফতার করবে? মা, মা গো! রক্ষা করো!”

তা, পুলিশে খবর দেওয়া না হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের লোকই হিল্লে করল ব্যাপারটার।

লোটেশ্বরের সাধুকে নিয়ে যখন নানা গুজব ছড়াচ্ছে এবং পুরনো লোকদের সাধুদর্শন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিটোলার এদিক-ওদিক থেকে নতুন নতুন লোক আসছে, তখন নান্টু পাল সাইকেল নিয়ে ছুটল বলাই-দারোগার বাড়ি। এদিকে আসবার সময়েই দেখেছিল জিপে চড়ে বাড়ি ফিরছে বলাই-দারোগা। মানুষটা দুঁদে। এখানকারই লোক। মাঝখানে ক’বছর মুঙ্গেরে বদলিতে থেকে প্রোমোশন পেয়ে ফিরে এসেছে দারোগা হয়ে। যত-না কাজ করে হম্বিতম্বি দেখায় তার চেয়ে বেশি। ভয় পায় সবাই। তবে কিনা নান্টু রাজনীতি করে—এমএলএ গণেশ পাণ্ডের ডান হাত। ওকে একটু সমঝে চলে।

নান্টুর মুখে সাধুর কথা শুনে বলাই-দারোগা বলল, “লোটেশ্বরই হোক, বক্রেশ্বরই হোক, উপায় দুটো। ফার্স্ট, সাধুকে চ্যাংদোলা করে তুলে হাজতে পোরা। সেকেন্ড, লোকটাকে নজরে রাখা। একটা কনস্টেবল ফিট করে দিতে পারি। কোন দাওয়াই চান, বলুন?”

“মানে, সাধু তো!” নান্টু আমতা আমতা করে বলল, “যদি সত্যিকারের সাধু হয় তা হলে যে কোনও দাওয়াই-ই হজম করে নেবে। যদি অভিশাপ-টভিশাপ দেয়!”

“হুম্‌।” বিশাল টাকে হাত বুলিয়ে গোঁফ মোচড়াতে শুরু করল বলাই-দারোগা। কিছুক্ষণ পরে বলল, “বটুক দত্ত নামে একটা লোককে চিনি মনে হচ্ছে। কী একটা কেস হয়েছিল না ওদের ফ্যামিলিতে?”

“কেস! মার্ডার-টার্ডার নাকি?”

“মার্ডার!” বলাই হু-হুম হু-হুম করে গলাখাঁকারি দিল। খানিক কফ ওগরাবার চেষ্টা করে বলল, “মার্ডার কি? নাঃ, মার্ডার নয়। কিন্তু…। অনেক বছর আগেকার কথা। হ্যাঁ, লোকটা পোস্টাপিসেই কাজ করত। আমি তখন জুনিয়র। “বুধন সিং দারোগা ছিল, ও-ই হ্যান্ডেল করেছিল কেসটা।”

“লোকটাকে একবার আনা যায় না সাধুর সামনে?”

“পাগল!” বলাই-দারোগা উচ্চ স্বরে হেসে নিয়ে বলল, “বুধন সিং বেঁচে থাকলে আমি দারোগা হতাম নাকি!”

“বুধন সিং নয়। বটুক দত্তের কথা বলছি।”

“অ। বটুক দত্ত?” বলাই-দারোগা ভেবে বলল, “তা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।”

পোস্টাপিস থেকে ঠিকানা জেনে বটুক দত্তের ভিখনপুরের বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল।

বটুক বাড়িতেই ছিল। প্রথমে দেখাই করতে চায়নি। একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে বেরিয়ে এসে বলল, “পেটের অসুখ, শুয়ে আছে।” তবে, দারোগা এসেছে শুনে বেরিয়ে এল। বুড়োটে, খিটখিটে চেহারা। খরখরে গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”

দারোগাকে কী চাই জিজ্ঞেস করাতে ঘাবড়ে গেল বলাই। দেঁতো হেসে বলল, “এজ্ঞে, চাই না কিছু। মানে… আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?”

“কে আপনি!”

“বলাই-দারোগা।”

কাজ হল না। বটুক দত্ত নির্বিকার গলায় বলল, “এখানে কী! পুলিশ, দারোগা শুধু ঘুষ খায়। আমার ছেলেটাকে… আমার ছেলেটাকে…”

বলতে বলতেই কেমন যেন হয়ে গেল বটুক দত্ত। সেই ছেলেটা আবার ঘরে এসে ঢুকল। ওরা বুঝতে পারল, ভিতরের দরজার পরদার পিছনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে এক মহিলা।

বলাই-দারোগা ঘাবড়ে গেছে দেখে নান্টু পাল বলল, “দত্তমশাই, আমরা এসেছি এক বিশেষ কারণে। বাঙালিটোলার কালীমন্দিরে এক সাধু এসেছেন। লোটেশ্বরের সাধু। তিনি কেবলই আপনার খোঁজ করছেন। দারোগাবাবু জিপ এনেছেন। একবার যেতে হয় যে!”

“আমি যাব! সাধুর কাছে! ইয়ার্কি মারার জায়গা পাওনি। এক সাধুকে দশদিন পুষেছিলাম বাড়িতে। বলেছিল ভয় নেই, সব ফিরে পাবি। লোকটা জোচ্চোর। চুরি করে ভেগে গেল। নিশ্চয়ই সেই ব্যাটাই ফিরে এসেছে!”

বটুক দত্ত একটু চুপ করে থেকে হিন্দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “নিকালো হিঁয়াসে!”

বলাই-দারোগার মুখের ওপর ‘নিকালো’ বলার জন্যে বুকের পাটা দরকার। এ লোকটা তা-ই বলছে। নির্ঘাত মাথার ঠিক নেই।

ধমক শুনে বিজবিজে ঘাম ফুটে উঠল বলাইয়ের টাকে। ভাবল, নান্টুটাই নষ্টের গোড়া। কোথাকার এক সাধুর গপ্পো শুনিয়ে অপদস্থ করিয়ে ছাড়ল তাকে। এমএলএ-র শাগরেদ না হলে এটাকেই এক্ষুনি ঘাড়ে ধরে পোরা যেত হাজতে।

নান্টু জানে অপমানে চুপসে গেলে রাজনীতি করা যায় না। একটু মাথা চুলকে সে বটুককে বলল, “সার, এ সাধু তো আপনার বাড়িতে আসছে না। শুধু আপনার নাম করছে। সেই চোট্টা সাধু হলে কি আপনাকে খুঁজত! সারা শহর এই নিয়ে তোলপাড়। আমাদের এমএলএ পাঁড়েজি বললেন, আপনাকে একবার নিয়ে যেতে। আমরা গাড়ি নিয়ে এসেছি।”

“নিকুচি করেছে পাঁড়েজির!”

বটুক দত্তের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পরদার আড়াল থেকে মহিলার গলা শোনা গেল।

“শুনছ। একবার ভেতরে এসো তো!”

বটুক দত্ত ভিতরে যেতে ছেলেটিও পিছু নিল। তখন বলাই-দারোগার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে নান্টু বলল, “বউয়ের কথা শোনে কি না দেখা যাক।”

“দেখা আর কী যাবে, নান্টুবাবু! এ তো আমারই পেটের অসুখ করিয়ে ছাড়ল!”

সেই সময় আবার ঘরে ঢুকল বটুক দত্ত। একটু যেন অন্যরকম লাগছে। দু’জনকে খুঁটিয়ে লক্ষ করে বলল, “সাধুটা দেখতে কেমন?”

“খুব ভাল সার।” নান্টু বলল, “একেবারে সাধুর মতন।”

“হুঁ।” বটুক বলল, “তা চলুন, যাচ্ছি। যদি ধাপ্পা হয়, তা হলে কিন্তু থানা-পুলিশ করে ছাড়ব!”

লোটেশ্বরের সাধুকে দেখতে শেষ পর্যন্ত বলাই- দারোগার জিপে উঠল বটুক দত্ত।

কালীমন্দিরের সামনে তখন ভিড় ভেঙে পড়েছে। জিপ থেকে নেমে, মাঝখানে বটুককে রেখে ওরা এগিয়ে গেল চাতালের দিকে। দেখাদেখি পোঁ ধরল বিষাদ মুখুজ্যে আর খজু।

তারপর যা ঘটল তা অবিশ্বাস্য।

বটুককে সামনে দেখে খানিক ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে থাকল সাধু। তারপরেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা!”

“কে! লোটন! আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে!” বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সাধুকে জাপটে ধরল বটুক। হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “চোদ্দো বছর পরে ফিরে এলি। তা এখানে কেন, বাবা!”

লোটেশ্বর বলল, “বাড়িতেই তো এসেছিলাম। পাড়ায় এসে দেখি বাড়িই হাওয়া!”

“মনে পড়েছে কেসটা,” বলাই-দাবোগা নান্টু পালকে বলল, “পরীক্ষায় ফেল করে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সাধু না হয়ে গেলে ঠিক খুঁজে বের করতাম।”

“সাধু কোথায় হলাম!” সবাইকে অবাক করে লোটেশ্বরের সাধু তার মাথার পরচুলাটা খুলে ফেলে বলল, “ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা ছিল না। লখনউর এক বাবা তার পরচুলা আর পোশাকটা ধার দিল। বলল, বাপের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত সাধু সেজে থাক বাবা লোটেশ্বরম। সবাই তোর খাতির করবে।”

৩ মে ১৯৮৯

অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *