লোকির শেষ দিনগুলো

লোকির শেষ দিনগুলো

বান্ডার মারা গেছে আর দেবতারা তখনো তার জন্য শোক করছে। তারা দুঃখভরাক্রান্ত ছিল, আকাশ থেকে অনবরত ধূসর বৃষ্টি হচ্ছিল আর দুনিয়ায় কোনো আনন্দ ছিল না।

লোকি তার অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে এসেছিল কিন্তু তার মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্রও দেখা গেল না।

সময়টা ছিল এগিরের প্রাসাদে হেমন্তের ভোজসভার, যখন দেবতা আর এলফরা সমুদ্র দানব এগিরের বানানো মদিরা পান করার জন্য জড়ো হতো, অনেক আগে দানবদের রাজ্য হতে থর যে হাঁড়িটি এনেছিল, সেটায় এই মদিরা তৈরি হতো যা ছিল দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট মদিরা।

লোকিও ভোজসভায় উপস্থিত ছিল। সে এতটাই পান করে ফেলেছিল, তার কর্মকাণ্ড হাসি-ঠাট্টার পর্যায় পার করে ফেলেছিল। লোকি যখন শুনল দেবতারা এগিরের ভৃত্য ফিমাফেংকে তার পরিশ্রম আর দ্রুতগতির জন্য প্রশংসা করছে, সে লাফ দিয়ে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ফিমাফেংকে ছুরিকাঘাত করল আর হত্যা করল।

দেবতারা লোকিকে ভোজসভা থেকে বাইরের অন্ধকারে তাড়িয়ে দিল।

অনেক সময় পেরিয়ে গেল। ভোজসভা তখনো চলছিল কিন্তু সেটা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল।

দরজায় একটা হইচই এর শব্দ শোনা গেল। দেবতারা যখন সেখানে কী হয়েছে, দেখার জন্য গেল, তারা দেখল, লোকি ফিরে এসেছে। সে দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে বিদ্রুপের হাসি।

“তুমি এখানে আসতে পারো না,” দেবতারা বলল লোকিকে।

লোকি তাদের কথায় কর্ণপাত করল না। সে ওডিন যেখানে বসা, সেখানে হেঁটে গেল। “বিশ্বপিতা। আপনি আর আমি আমাদের রক্ত মিশ্রিত করেছিলাম, অনেক, অনেকদিন আগে। করিনি কি?”

ওডিন মাথা ঝোঁকাল, “হ্যাঁ, করেছিলাম।”

লোকি আরো বড় করে হাসল। “তখন আপনি কি প্রতিজ্ঞা করেননি, মহামান্য ওডিন, যে আপনি কোনো ভোজসভায় শুধুমাত্র তখনই পান করবেন, যখন আপনার রক্তের ভাই লোকি আপনার সাথে পান করবে?”

ওডিন তার ভালো চোখটি দিয়ে লোকির সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, লোকির কথা শুনে ওডিন তার চোখ নামিয়ে নিল।

‘নেকড়ের পিতাকে আমাদের সাথে ভোজে অংশ নিতে দাও,” বলল ওডিন বিষণ্নস্বরে, সে তার ছেলে ভিডারকে সরে গিয়ে তার পাশে লোকির বসার জায়গা করে দিতে বলল।

লোকি আনন্দ আর বিদ্বেষের হাসি হাসল। সে আরো পানীয় আনতে বলল আর সেগুলো গলাধঃকরণ করল।

সেই রাতে লোকি একে একে সকল দেব-দেবীকে অপমান করল। সে দেবতাদের বলল, তারা কাপুরুষ। দেবীদের বলল, তারা দোষী আর অসতী। সকল অপমানের সাথে কিছু সত্য মিশ্রিত ছিল, আর তাতে অপমানগুলো সবার গায়ে লাগল। সে তাদের বলল, তারা বোকা। সে তাদের এমনসব কথা মনে করিয়ে দিল, যা তারা অনেক আগেই ভুলে যেতে চেয়েছে। সে পুরোনো সব কেলেঙ্কারি মনে করিয়ে দিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করল। সে ততক্ষণ পর্যন্ত না সবাইকে বিরক্ত করল, যতক্ষণ পর্যন্ত না থর সেখানে পৌঁছাল।

থর খুব সহজেই কথাবার্তার ইতি টেনে দিল- সে তার হাতুড়ি মিওলনির দিয়ে লোকির দুষ্ট মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করে তাকে হেলের কাছে পাঠানোর হুমকি দিল।

লোকি ভোজসভা ত্যাগ করল, কিন্তু যাওয়ার পূর্বে সে এগিরের দিকে ফিরল। “তুমি খুব ভালো মদিরা তৈরি করো। কিন্তু এখানে আর কখনো হৈমন্তি ভোজসভা হবে না। আগুন তোমার প্রাসাদ গ্রাস করবে। তোমার শরীর আগুনে ঝলসে যাবে। তুমি যা কিছু ভালোবাস, সব তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। এটা আমি আজ প্রতিজ্ঞা করে গেলাম।”

এই কথা বলে সে দেবতাদের রেখে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে গেল।

পরদিন সকালে নেশা কেটে যেতেই লোকি আগের দিন রাতে কী করেছে তা ভাবল। সে কোনোরূপ লজ্জা অনুভব করল না, লজ্জা পাওয়া লোকির স্বভাবে নেই। কিন্তু সে জানত, সে দেবতাদের একটু বেশিই বলে ফেলেছে।

সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের ওপর লোকির একটা ঘর ছিল। সে সেখানেই লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেবতারা তার কথা ভুলে যায়। পাহাড়ের উপরের ঘরের চারদিকে চারটা দরজা ছিল, যার ফলে সে চতুর্দিকে নজর রাখতে পারত, যেকোনোদিক থেকে বিপদ এলে যাতে সে টের পায়।

দিনের বেলায় লোকি নিজেকে একটা স্যামন মাছে রূপান্তর করে নিত আর ফ্রানাং ঝরনার পাদদেশের জলাশয়ের পানির নিচে নিজেকে লুকিয়ে রাখত। ফ্রানাং ছিল একটা উঁচু ঝরনা, যেটা পাহাড় থেকে নেমেছিল। একটা জলধারা জলাশয়টাকে একটা নদীর সাথে যুক্ত করেছিল আর নদীটা সোজা গিয়ে সমুদ্রে পড়েছিল।

লোকি পরিকল্পনা আর পাল্টা পরিকল্পনা করতে পছন্দ করত। লোকি জানত, স্যামন রূপে সে অনেকটাই নিরাপদ। দেবতারা সাঁতরে তাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু তারপরই তার সন্দেহ হতে লাগল। সে ভাবল, ‘ঝরনার পাদদেশের পানির জলাশয়ের গভীরে থাকা একটা মাছকে ধরার কি কোনো রাস্তা আছে?”

কীভাবে সে নিজে, যে কি না সবার চেয়ে ধূর্ত, একটা স্যামনকে ধরতে পারে

সে সুতার গোলা নিল আর একটা জাল বুনতে শুরু করল, এমন জাল আগে কেউ বানায়নি। হ্যাঁ, ভাবল সে। ‘আমি যদি এই জাল ব্যবহার করতাম, তাহলে স্যামনটি ধরতে পারতাম’।

তখন সে একটি পালটা পরিকল্পনার কথা চিন্তা করতে লাগল, ‘যদি দেবতারা এরকম একটা জাল বুনে আমাকে ধরতে আসে, তাহলে আমি কী করব?’

সে নিজের বানানো জালটি পর্যবেক্ষণ করল।

স্যামন মাছ লাফাতে পারে, ভাবল সে। তারা স্রোতের উজানে সাঁতার কাটতে পারে, এমনকি ঝরনার ওপরেও উঠে যেতে পারে। আমি জালের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যেতে পারব।

কিছু একটা তার নজরে এলো। সে তার ঘরের প্রথম দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল তারপর অন্যান্য দরজা দিয়েও তাকাল। সে স্তম্ভিত হয়ে গেল— দেবতারা পাহাড়ের ওপরে উঠে আসছে আর তারা প্রায় বাড়ির কাছে এসে গেছে।

লোকি জালটি আগুনে নিক্ষেপ করল আর সন্তুষ্টির সাথে সেটি পুড়ে যেতে দেখল। তারপর সে স্যামনরূপে নিজেকে রূপান্তর করে নিয়ে ফ্রানাং ঝরনায় ঝাঁপ দিল, দ্রুত ঝরনার জলে সাঁতার কেটে পাহাড়ের পাদদেশে জলাশয়ের গভীরে উধাও হয়ে গেল।

এসির দেবতারা পাহাড়ের ওপরে লোকির ঘরে পৌঁছাল। তারা চারদিকের চার দরজার সামনে অবস্থান নিল, লোকি যাতে কোনোক্রমেই পালাতে না পারে, অবশ্য সে যদি তার ঘরের ভিতর থাকে।

দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী কাভাসির প্রথম দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল। একসময় তাকে হত্যা করা হয়েছিল, তার রক্ত দিয়ে মদিরা প্রস্তুত করা হয়েছিল, কিন্তু এখন সে আরেকবার জীবিত হয়েছে। জ্বলন্ত আগুন আর আধখাওয়া পানীয়ের পেয়ালা দেখে কাভাসির নিশ্চিত হলো, কয়েক মুহূর্ত আগেও লোকি ঘরের ভিতরেই ছিল।

কিন্তু লোকি কোথায় গেল, সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারল না। কাভাসির আকাশে খুঁজল, তারপর সে ঘরের মেঝে ও ফায়ারপ্লেসের দিকে নজর দিল।

সে পালিয়েছে, দুষ্ট অনিষ্টকারী লোকি,” আরেক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল থর। “সে নিজেকে যেকোনোকিছুতে রূপান্তর করে নিতে পারে। আমরা তাকে কখনো খুঁজে পাব না।”

“এতটা অস্থির হয়ো না,” বলল কাভাসির, “দেখো।”

“এখানে তো ছাই ছাড়া কিছু নেই,” বলল থর।

“কিন্তু এটার নকশাটা দেখো,” বল কাভাসির। সে নিচু হয়ে আগুনের পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা ছাই স্পর্শ করল, নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল আর জিহ্বায় লাগিয়ে স্বাদ নিল। “এটা একটা রশির ছাই, যেটা আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল পুড়ে যাওয়ার জন্য। পোড়া রশিটা ঘরের ঐ কোনায় পড়ে থাকা রশির বলের মতোই।”

থর চোখ পাকাল, “আমার মনে হয় না পুড়ে যাওয়া রশির ছাই আমাদের বলবে লোকি কোথায় আছে।”

“তোমার মনে হচ্ছে না? কিন্তু এই নকশাটার দিকে তাকাও- এটা একটা আড়াআড়ি ডায়মন্ড আকারের প্যাটার্ন, আর বর্গগুলোও সব এক মাপের।”

“কাভাসির, তুমি ছাইয়ের বানানো ডিজাইনের প্রশংসা করতে গিয়ে আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছ। এটা বোকামি হচ্ছে। ছাইয়ের দিকে তাকিয়ে যতটা সময় আমরা নষ্ট করব, লোকি ততই দূরে পালিয়ে যাবে।”

“তুমি হয়তো ঠিকই বলছ, থর। কিন্তু বর্গগুলোকে একই আকারের বানাতে হলে তোমার কিছু একটা জিনিস লাগবে, যেমন তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঠের টুকরোর মতো কিছু একটা। এটা বুনতে হলে তোমাকে রশিটা একটা কিছুর সাথে বাঁধতে হবে— মেঝেতে লাগানো এই লাঠির মতো। তারপর তুমি তোমার রশিটা দিয়ে একটা গিট দেবে, আরেকটু বুনবে, যাতে একটা রশি দিয়েই তুমি একটা ইয়ে বানাতে পারে……. হুম, আমি জানি না লোকি এটাকে কী নাম দিয়েছে, আমি এটাকে নাম দেব ‘জাল’।

“তুমি এখনো বিড়বিড় করে কী বলছো?” বলল থর। “কেন তুমি ছাই, কাঠি আর কাঠের টুকরোর দিকে তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট করছ, যেখানে আমরা এতক্ষণে লোকির পিছনে ধাওয়া করতে পারতাম? কাভাসির! তুমি যতক্ষণ ধরে ভাবছ আর আবোলতাবোল বকছো, লোকি আরো দূরে চলে যাচ্ছে।”

“আমার মনে হয়, এমন একটা জাল মাছ ধরতেই ভালো কাজে আসবে।”

“তুমি আর তোমার বোকামির সাথে আমি আর নেই,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল থর, “তাহলে এটা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার হয়? ঠিকই আছে। লোকির নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছিল, আর সে মাছ ধরতে চেয়েছিল। লোকি নানা জিনিস বানাতে পছন্দ করে। সে খুবই চালাক। আর এ কারণেই আমরা সবসময় তাকে কাছে কাছে রাখি।”

“ঠিক বলেছ। কিন্তু ভেবে দেখো, যদি তুমি লোকি হতে আর মাছ ধরার জন্য একটা জাল বুনতে, আর আমরা আসছি সেটা বুঝতে পেরে কেন তুমি সেটা আগুনে নিক্ষেপ করতে?”

“কারণ……” থর তার ভ্রু কুচকে গভীরভাবে ভাবল, “আ…’

“ঠিক বলেছ, তুমি চাইতে না আমরা এসে জালটি খুঁজে পাই। কেন তুমি চাইতে না আমরা জালটি খুঁজে পাই, তার একমাত্র কারণ, এই জালটি দিয়ে তোমাকে ধরা যাবে।”

থর আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল, “ও, আচ্ছা” বলল সে। “হ্যাঁ আমার তাই মনে হয়,” বলল সে অনিশ্চিত স্বরে, “তাহলে লোকি ……

“লোকি ঝরনার পাদদেশের জলাশয়ে মাছের বেশে লুকিয়ে আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই! আমি জানতাম তুমি বিষয়টা ধরতে পারবে, থর।”

থর উৎসাহের সাথে মাথা ঝোঁকাল, বুঝতে পারল না সে কীভাবে মেঝেতে পড়ে থাকা ছাই থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল, কিন্তু লোকি কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা জানতে পেরে খুশিই হলো।

“আমি নিচে যাব, জলাশয়ে, আমার হাতুড়ি সাথে নিয়ে,” বলল থর, “আমি তাকে……আমি তাকে……..”

“আমাদের একটা জাল সহ নিচে যেতে হবে,” বলল জ্ঞানী দেবতা কাভাসি

কাভাসির রশির গোলা আর কাঠের টুকরো তুলে নিল আর রশি নিয়ে মেঝেতে বসানো কাঠিতে বাঁধল আর জাল বুনতে শুরু করল। সে সবাইকে দেখাল কীভাবে জাল বুনতে হয়, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই মিলে জাল বুনতে শুরু করল। সে সবার বানানো জালগুলোকে একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দিল, তাতে একটা বিশাল জাল প্রস্তুত হলো, যেটা জলাশয়ের চেয়েও বড়, যেটা ঝরনার ধার থেকে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

জলাশয় উপচে পড়ে একটা নালা তৈরি হয়েছিল, যেটা সমুদ্রে গিয়ে পড়েছিল।

যখন দেবতারা ফ্রানাং ঝরনার পাদদেশে পৌঁছাল, তারা তাদের বানানো জাল খুলল। জালটা ছিল বিশাল আর এতটাই বড় যে, সেটা দিয়ে জলাশয়ের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বেড় দেওয়া যাচ্ছিল। জালটার একপাশ সকল এসির যোদ্ধা মিলে ধরেছিল, আর অন্য পাশ ধরেছিল থর।

দেবতারা জলাশয়ের একদিক থেকে জাল টানা শুরু করল, তারা ঝরনার পাদদেশ থেকে শুরু করল আর অন্য প্রান্ত পর্যন্ত জাল টেনে নিয়ে গেল। জালে কিছুই ধরা পড়ল না।

“জলের তলায় নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে,” বলল থর। “আমার মনে হলো, ওটা জালের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তারপর ওটা গভীর জলে চলে গেল, একেবারে কাদার ভিতর আর জালটা ওটার ওপর দিয়ে চলে গেল।”

কাভাসির চিন্তিত ভঙ্গিতে তার গাল চুলকাল। “কোনো সমস্যা নেই। আমাদের আবার জাল টানতে হবে, কিন্তু এবার জালের তলায় ভারী কিছু বেঁধে দিতে হবে,” বলল সে। “যাতে কোনোকিছু জালের তলা দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।”

দেবতারা ভারী পাথরের খণ্ড এনে সেগুলো ছিদ্র করে জালের নিচে বেঁধে দিল।

তারা আবার জাল টানতে শুরু করল।

প্রথমবার যখন দেবতারা জাল টানল, লোকি খুব সহজেই সেটা এড়াতে পেরে খুশি ছিল। সে জলাশয়ের গভীরে কাদার মধ্যে চলে গিয়েছিল, আর জালের দুইটা পাথরের মাঝে চুপচাপ বসে ছিল, আর তার মাথার ওপর দিয়ে জালটা চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল।

কিন্তু এবার সে উদ্বিগ্ন বোধ করল। পানির গভীরে অন্ধকার ঠান্ডায় বসে সে ভাবতে থাকল, এবার কী করা যায়।

যতক্ষণ পানিতে আছে, সে নিজেকে অন্য কিছুতে রূপান্তর করতে পারছে না, আর যদি সে তা করেও, দেবতারা তাকে ধাওয়া করবে। না, স্যামন আকারে থাকাটাই আপাতত নিরাপদ, ভাবল সে। কিন্তু স্যামন হিসেবেও সে এখন ফেঁসে গেছে। তাকে এমন কিছু করতে হবে, যেটা দেবতারা আশা করবে না। তারা ভাববে সে খোলা সমুদ্রের দিকে যাবে- যেখানে গেলে সে অনেকটা নিরাপদ কিন্তু যদি সে সেখানে পৌঁছাতে পারে, তবেই। আর সমুদ্রে যাওয়ার পথে যে নদী সেখানে তাকে সহজেই দেখা যাবে আর ধরে ফেলা যাবে।

দেবতারা ভাবতেও পারবে না, সে উজানে ঝরনার দিকে যাবে।

দেবতারা দ্বিতীয় বারের মতো তাদের জাল জলাশয়ের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।

জলাশয়ের গভীরে কী আছে, সেটা নিয়েই তাদের বেশি আগ্রহ ছিল, তাই যখন একটা বিশাল রুপালি মাছ, বিরাট বড় একটা স্যামন মাছ, এত বড় মাছ তারা কখনো দেখেনি, লেজে ঝাপটা মেরে লাফিয়ে জালের ওপর দিয়ে চলে গেল, তারা সবাই খুব অবাক হয়ে গেল। বিরাট স্যামনটা ঝরনার গা বেয়ে সাঁতরে উপরে উঠে যেতে লাগল।

কাভাসির দেবতাদের চিৎকার করে তাদের দুই ভাগে ভাগ হয়ে জালের দুই মাথা ধরার নির্দেশ দিল।

“সে বেশিক্ষণ ঝরনার মধ্যে থাকবে না। কারণ ওখানে তাকে সহজেই দেখা যাবে। তার পালানোর একমাত্র রাস্তা সমুদ্রে চলে যাওয়া। সুতরাং, তোমরা দুই দল জাল ধরে ঝরনার দিকে এগুতে থাকো,” বলল কাভাসির, যে ছিল দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, “আর থর, তুমি জলাশয়ের মাঝ দিয়ে যাবে। লোকি যদি আবার জালের ওপর দিয়ে লাফায়, তুমি তাকে শূন্যের মধ্যে লাফিয়ে ধরে ফেলবে, যেমন করে একটা ভালুক স্যামন মাছ ধরে, তেমনভাবে। তাকে কোনো ভাবেই ছাড়বে না, যদিও সে অনেক চালাক।

থর বলল, “আমি ভালুককে লাফিয়ে স্যামন ধরতে দেখেছি। আমি শক্তিশালী, ভালুকের মতোই ক্ষিপ্র। আমি তাকে ধরতে পারব।”

দেবতারা উজানে ঝরনার দিকে জাল টানতে লাগল, যেখানে বিশাল স্যামন মাছটা আছে। লোকি পরিকল্পনা করতে লাগল কী করা যায়।

জাল যখন ক্রমে কাছে আসতে লাগল, লোকি জানত এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। জাল যখন কাছে চলে আসবে, তাকে আগের বারের মতো লাফাতে হবে আর সমুদ্রের দিকে পালাতে হবে। সে স্প্রিঙ এর মতো নিজেকে বাঁকাল আর শূন্যে ছুড়ে মারল।

থর ছিল দ্রুতগতি। সে সূর্যের আলোয় রুপালি স্যামনটাকে ঝলসে উঠতে দেখল আর নিজের বিশাল দুই থাবায় সেটাকে ধরে ফেলল, ঠিক যেমন একটা ক্ষুধার্ত ভালুক বাতাসে লাফিয়ে স্যামন ধরে। স্যামন খুব পিচ্ছিল মাছ, আর লোকি ছিল আরো বেশি পিচ্ছিল। সে শরীর মুচড়ে থরের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল কিন্তু থর শক্ত করে তার লেজের মধ্যে চেপে ধরে রাখল।

সবাই বলে তখন থেকে স্যামন মাছের লেজের কাছটা সরু হয়ে গেছে।

দেবতারা তাদের জাল নিয়ে এলো, আর তারা মাছটার চারদিকে জাল জড়িয়ে নিল আর সেটাকে বহন করে নিয়ে চলল। স্যামন মাছটা বাতাসে খাবি খেতে লাগল, লাফাতে লাগল আর শরীর মোচড়াতে লাগল, আর দেখা গেল স্যামন মাছটা হাঁপাতে থাকা লোকিতে রূপান্তরিত হয়েছে। “কী করছ তোমরা?” জিজ্ঞেস করল সে। “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

থর শুধু মাথা ঝাঁকাল আর গজরালো কিন্তু কোনো জবাব দিল না। লোকি অন্য দেবতাদেরও একই কথা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেউ তার কথার কোনো জবাব দিল না, এমনকি কেউ তার চোখের দিকেও তাকাল না।

দেবতারা লোকিকে ঝুলিয়ে নিয়ে একটা গুহার মধ্যে প্রবেশ করল আর মাটির অনেক গভীরে যেতে শুরু করল। গুহার ওপর থেকে বরফের মতো দেখতে লবণের চোখা চোখা মাথা ঝুলে ছিল আর বাদুড়ের দল ডানা ঝাপটাচ্ছিল আর কিচিরমিচির করছিল। তারা গুহার আরো গভীরে যেতে লাগল। একসময় পথ এত সরু হয়ে এলো যে, লোকিকে আর ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না, তখন তারা লোকিকে তাদের সাথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। লোকির কাঁধে একটা হাত রেখে থর তার পিছনে পিছনে যেতে লাগল।

তারা গুহার ভিতর দিয়ে মাটির অনেক অনেক গভীরে চলে গেল।

গুহার একেবারে গভীরে, লোহার সিল গরম করা হচ্ছিল আর সেখানে তিনজন মানুষ তাদের অপেক্ষায় দাঁড়ানো ছিল। তাদের চেহারা দেখার পূর্বেই লোকি তাদের চিনতে পারল, আর তার হৃদয় দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে গেল। “না…” বলল সে, “ওদের কোনো ক্ষতি করো না, তারা কোনো অপরাধ করেনি।”

থর বলল, “তারা তোমারই স্ত্রী-পুত্র, মিথ্যাবাদী লোকি।”

গুহায় তিনটা বিশাল সমতল পাথর ছিল। দেবতারা পাথরগুলোকে জায়গামত বসাল আর থর তার হাতুড়ি তুলল। সে প্রত্যেকটা পাথরের মাঝে হাতুড়ির আঘাতে একটা করে ছিদ্র করল।

“দয়া করে আমাদের বাবাকে ছেড়ে দাও,” বলল লোকির ছেলে নারফি।

“তিনি আমাদের পিতা,” বলল লোকির আরেক ছেলে ভালি। “তোমরা প্রতিজ্ঞা করেছ, তাকে তোমরা হত্যা করবে না। তিনি দেবতাদের পিতা ওডিনের রক্তের প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ ভ্রাতা।”

“আমরা তাকে হত্যা করব না,” বলল কাভাসির। “ তুমিই বলো ভালি, একজন ভাই আরেকজন ভাইয়ের সাথে সবচেয়ে খারাপ কাজ কি করতে পারে?”

“ভাইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা,” একটুও দ্বিধাগ্রস্ত না হয়েই জবাব দিল ভালি। “ভাই ভাইকে হত্যা করা, যেমন হড হত্যা করেছে বাল্ডারকে। বিষয়টি খুবই জঘন্য আর ন্যক্কারজনক।”

কাভাসির বলল, “এটা সত্য যে, লোকি দেবতাদের রক্তের ভাই, আর আমরা তাকে হত্যা করতে পারব না, কিন্তু তোমাদের সম্পর্কে এমন কোনো প্রতিজ্ঞায় আমরা আবদ্ধ নই।”

কাভাসির ভালির কানে কিছু মন্ত্র পড়ল, শক্তি আর পরিবর্তনের মন্ত্র।

ভালির মানবরূপ খসে পড়ল আর ভালির স্থানে একটা নেকড়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তার হলুদ চোখ থেকে ভালির বুদ্ধিমত্তা দূর হয়ে গেল, আর সেখানে ক্ষুধা, রাগ আর পাগলামি এসে জড়ো হলো। নেকড়ে দেবতাদের দিকে তাকাল, তাকাল সিজিনের দিকে, যে তার মা ছিল, সবশেষে তার দৃষ্টি এসে নারফির ওপর স্থির হলো। নেকড়ে মৃদু গর্জন করল আর তার লোম দাঁড়িয়ে গেল। নারফি এক কদম পিছিয়ে গেল। আরেক কদম পিছানোর পূর্বেই নেকড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

নারফি ছিল সাহসী। সে একটুও চিৎকার করল না, এমনকি যখন নেকড়েটা, যে তার ভাই ছিল, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলা ছিঁড়ে ফেলল আর তার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলল। নেকড়ে তার রক্তাক্ত মুখে একটা লম্বা গর্জন করল। তারপর সে এক লাফে দেবতাদের মাথার ওপর দিয়ে গুহার অন্ধকারে হারিয়ে গেল এবং তাকে আর রাগনারকের আগে এসগার্ডে কখনো দেখা যাবে না।

দেবতারা জোর করে লোকিকে তিন বিরাট পাথরের ওপর শোয়াল। তারা একটা পাথর তার ঘাড়ের নিচে রাখল, আরেকটা পাথর রাখল তার কোমরের নিচে আর শেষ পাথরটি দিল তার হাঁটুর নিচে। দেবতারা নাফ্রির নাড়িভুঁড়ি নিয়ে সেগুলোকে পাথরের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে লোকির ঘাড় ও কাঁধ শক্ত করে বাঁধল। তারা লোকির কোমর, হাঁটু ও পা ও শক্ত করে পাথরের সাথে বেঁধে ফেলল, যাতে সে নড়তে না পারে। তারপর দেবতারা লোকির ছেলের নাড়িভুঁড়িকে একটা শক্ত শিকলে রূপান্তরিত করে ফেলল, যেটা ছিল লোহার চেয়েও শক্ত।

সিজিন, লোকির স্ত্রী, দেখল তার স্বামী লোকিকে তারই সন্তানের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো, কিন্তু সে কিছুই বলল না। সে শুধু তার স্বামীর যন্ত্রণা, ছেলেদের অপমান আর মৃত্যু দেখে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। তার হাতে একটা বড় পাত্র ছিল, যদিও সে জানত না, এটা কীসের জন্য। দেবতারা তাকে এখানে নিয়ে আসার আগে বলেছিল, তার রান্নাঘরে থাকা সবচেয়ে বড় পাত্রটি সাথে করে নিয়ে আসতে।

মৃত দানব থিয়ালজির কন্যা, সুন্দর পায়ের দেবতা নর্ডের স্ত্রী, এরপর গুহায় প্রবেশ করল। তার হাতে অনেক বড় কিছু একটা কিছু ছিল, যেটা শরীর মোচড়াচ্ছিল। সে জিনিসটা গুহার ওপরে ঝুলে থাকা লবণের চোখা মাথা থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিল যাতে সেটার মাথা লোকির মাথার ওপর পর্যন্ত আসে।

এটা ছিল একটা সাপ, সেটার জিহ্বা হিসহিস করে বেরিয়ে আসছিল, আর তার বিষদাঁত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষ ঝরছিল। এক একবার সেটা হিসহিস করে জিহ্বা বের করছিল আর এক ফোঁটা করে বিষ তার মুখ থেকে বেরিয়ে লোকির মুখের ওপর পড়ছিল, আর তার চোখ-মুখ জ্বলে যাচ্ছিল।

লোকি চিৎকার করল, শরীর বাঁকাল, মোচড়াল আর ব্যথায় নীল হয়ে গেল। সে সাপের বিষের নিচ থেকে সরে যেতে চাইল, চাইল তার মাথাটা একটু সরিয়ে নিতে। কিন্তু তার নিজের ছেলের শরীরের অস্ত্র দিয়ে বানানো শিকল তাকে শক্ত করে বেঁধে রাখল।

একজন একজন করে দেবতা চেহারায় সন্তুষ্টির ভাব নিয়ে স্থান ত্যাগ করে গেল। সবশেষে শুধু কাভাসিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সিজিন তার বেঁধে রাখা স্বামীর দিকে আর নেকড়ের আক্রমণে নিহত ছেলের শরীরের অবশিষ্টাংশের দিকে তাকাল।

“আমাকে নিয়ে তোমরা কী করতে চাও?” জানতে চাইল সিজিন।

“কিছুই না,” বলল কাভাসির। “তোমাকে আমরা কোনো শাস্তি দেব না। তোমার যা ইচ্ছে করতে পারো।” বলে কাভাসির গুহা ত্যাগ করে গেল।

আরেক ফোঁটা সাপের বিষ লোকির মুখের ওপর পড়ল আর সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল আর বাঁধন ছুটে পালাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। লোকির চেষ্টার ফলে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

সিজিন তার পাত্রটি তুলে নিল আর তার স্বামীর কাছে গেল। সে কিছুই বলল না- কীই বা বলার আছে? সে লোকির কান্নাভেজা চোখে তার পাত্র হাতে লোকির মাথার কাছে দাঁড়াল আর সাপের বিষদাঁত থেকে পড়া বিষের ফোঁটাগুলো তার পাত্রে পড়তে লাগল।

এসবই অনেক, অনেককাল আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা, সেই সময়ের ঘটনা, যখন দেবতারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত। এত আগের ঘটনা যে, সেই সময়ের পাহাড়গুলো সব ক্ষয়ে সমতল হয়ে গেছে আর সেই সময়ের সবচেয়ে গভীর হ্রদও শুকিয়ে শুষ্ক জমি হয়ে গেছে।

সিজিন সেই সুদূর অতীত থেকে এখনো তার স্বামীর মাথার কাছে পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি লোকির সুন্দর আর চিন্তিত মুখের ওপর নিবদ্ধ।

তার হাতে ধরা পাত্রটি খুব ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়, একসময় পাত্রটা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শুধুমাত্র তখনই সিজিন লোকির কাছ থেকে সরে যায়। সে বিষের পাত্রটি নিয়ে দূরে গিয়ে বিষ ঢেলে পাত্র খালি করে আসে। আর যেই সময়টায় সিজিন বিষ ফেলে পাত্র খালি করতে যায়, সাপের বিষদাঁত থেকে বিষের ফোঁটা লোকির চোখে-মুখে এসে পড়ে আর লোকির শরীরে খিঁচুনি এসে যায়, সে লাফায়, ঝাঁকুনি খায় আর শরীর মোচড়ায়। সেই ঝাঁকুনির মাত্রা এত তীব্র যে, গোটা দুনিয়া কাঁপতে থাকে।

যখন সেটা ঘটে, আমরা মিডগার্ডের লোকেরা সেটাকে ‘ভূমিকম্প’ বলি।

তারা বলে, লোকি পৃথিবীর গভীরে অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে থাকবে, আর সিজিন তার স্বামীকে বিষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর ফিসফিস লোকিকে বলবে সে তাকে ভালোবাসে। রাগনারক এসে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সেখানেই বন্দি থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *