লোকায়ত দেব-দেবী
হিন্দুর দেব-দেবীকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই দুই শ্রেণির মধ্যে এক শ্রেণিতে পড়ে লৌকিক অথবা লোকায়ত দেব-দেবী, অপর শ্রেণিতে পড়ে অন্যান্য দেব-দেবী। এই শ্রেণি বিভাজন কী ভিত্তিতে করা হয় তা পরিষ্কার নয়। তবে দেখা যায় সাধারণ হিন্দু যে দেব-দেবীগণকে পূজা করেন তারা লোকায়ত দেব-দেবী হিসেবে আখ্যায়িত, আর যে দেব-দেবীগণকে ‘ব্রাহ্মণ্য’ আচারে সংস্কৃত করা হয়েছে তারা পরিচায়িত অলোকায়ত দেব-দেবী হিসেবে। কিন্তু লক্ষণীয় হিন্দু মানস ও সমাজ গঠনে লৌকিক দেব-দেবী ও লৌকিক সংস্কৃতির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বস্তুত লৌকিক দেব- দেবী ও লৌকিক সংস্কৃতি বাদ দিয়ে হিন্দুধর্ম বা সভ্যতা কল্প করা যায় না। কারণ শত হোক সিংহভাগ হিন্দুর বিশ্বাস, আচার ও পূজা অৰ্চনাকে বাদ দিয়ে হিন্দু সভ্যতা বা ধর্ম সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কারণ লৌকিক দেব-দেবী ও লৌকিক সংস্কৃতি সাধারণ হিন্দুর প্রাণের ধন। বলা যায় হিন্দু সভ্যতার প্রধান ধারা ও অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
লৌকিক দেব-দেবী ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে দু’জনের মত এখানে তুলে ধরা দরকার। এদের মধ্যে একজন শিবনারায়ণ রায় ও অন্যজন প্রমথ চৌধুরী। শিবনারায়ণ রায় (স্বদেশ স্বকাল স্বজন: প্যাপিরাস : ১৯৯৬) লৌকিক সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন : হরপ্পা পতনের প্রায় ১৫০০-২০০০ বছর পরে হিন্দুসমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের উদ্ভব ও বিবর্তন শুরু হয়। এ বিবর্তনে সিন্ধু সভ্যতা, অষ্ট্রিক লোকসংস্কৃতি ও দক্ষিণ দেশের দ্রাবিড় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভূমিকা আর্য সংস্কৃতির ভূমিকার চেয়ে বেশি বই কম নয়।
অপরদিকে প্রমথ চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে (প্রবন্ধ: ভারতবর্ষের ঐক্য : প্রবন্ধ সংগ্রহ : বিশ্বভারতী : ১৯৯৩) বলেছেন : বৈদিক ধর্ম নয়, লৌকিকধর্মই ভারতবর্ষকে পুণ্যভূমি করে তুলেছে। ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম হচ্ছে লৌকিকধর্ম। বিদেশি বিজেতা আর্যদের ধর্ম হচ্ছে বৈদিকধর্ম। ভারতবর্ষের মাটি ও ভারতবর্ষের জলই হচ্ছে লৌকিক ধর্মের প্রধান উপাদান। সে ধর্ম আকাশ থেকে পড়েনি, মাটি থেকে ওঠেছে। ভারতবর্ষের জনগণ চিরদিন কৃষিজীবী। যে পৃথিবী তাদের চিরদিন অন্নদান করে সেই হচ্ছে অন্নদা এবং যে জল তাদের শস্যক্ষেত্রে রসসঞ্চার করে সেই হচ্ছে প্রাণদা। তাই ভারতবর্ষের অসংখ্য লৌকিক দেবতা সেই অনুন্দার বিকাশ। সীতার মতো এ সকল দেবতা হলমুখে ধরণী হতে উত্থিত হয়েছে। তাই এ দেশের প্রতিমা মাটির দেহ ধারণ করে এবং জলে তার বিসর্জন হয়। ‘তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে এ কথা মোটেই বৈদিক মনোভাবের পরিচায়ক নয়। কেননা, পঞ্চনদবাসী আর্যেরা মন্দির গড়াতেন না, প্রতিমা পূজাও করতেন না।
প্রমথ চৌধুরীর উপরোক্ত মন্তব্য থেকে বোঝা যায় সাধারণ হিন্দুরা কেন পূজা করে। হিন্দুদের কাছে পৃথিবী হচ্ছে অন্নদাত্রী। মাটি, জল, প্রকৃতি, পাহাড়, বন ও নদ- নদী মানুষের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন। তাই মাটির প্রতিমা (মূর্তি নয়) গড়ে হিন্দু প্রকৃতি ও পৃথিবীর পূজা করে। এই প্রতিমা, মন্দির, পূজা ও দেব-দেবীর ধারণা কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পরিচায়ক। যেহেতু পৃথিবী বা মাটি, জল ও প্রকৃতি তাকে ভরণ পোষণ করে তাই সে সকল পূজায় নৈবদ্য হিসেবে ব্যবহার করে কৃষিজ ফসল ও পণ্য। নৈবদ্যের মধ্যে থাকে : ধান, চাউল, কলা, ফলমূল, চিড়া, গুড়, বাতাসা ও দুধ থেকে শুরু করে প্রকৃতির সকল ধরনের দান। এর সাথে থাকে ফুল, তুলসীপাতা, বেলপাতা, আম-কাঁঠাল পাতা, সিঁদুর, ঘট, প্রদীপ ও দুর্বা থেকে শুরু করে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির ফসল।
প্রকৃতি ও ঋতু ভেদে হিন্দু বিভিন্ন ধরনের পূজার আয়োজন করে। প্রকৃতির নিয়মে সংঘটিত রোগ-শোক, আশা-নিরাশা, ভয়-ভীতি, আত্মরক্ষা, পশুর মঙ্গল, সন্তানের মঙ্গল, সন্তান কামনা ইত্যাদিকে উপলক্ষ করে সে দেব-দেবীর কল্পনা করে নিয়েছে। শুধু দেব-দেবী নয়, দেব-দেবীর সাথে সাথে গড়ে ওঠেছে লৌকিক সংগীত, ছড়া, নৃত্য, গান, বাজনা ও শিল্পের এক বিরাট ঐতিহ্য। প্রায় প্রতিটি লৌকিক দেব-দেবীর পূজাকালে অনুষ্ঠিত হয় নানা ধরনের মেলা। মানুষের মিলন ছাড়াও এসব মেলায় গ্রামীণ শিল্পপণ্য ও কৃষিজপণ্যের বেচা-কেনা চলে। দেব-দেবীর প্রতিমা গড়ার জন্য সৃষ্ট হয়েছে এক বিশাল গ্রামীণ শিল্পী শ্রেণি। তাই দেখা যায় লোকায়ত দেব-দেবীর পূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকে নি, এগুলো হয়ে ওঠেছে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-উলাসের মাধ্যম।
আমরা জানি হিন্দু ‘বহুর মধ্যে এক, একের মধ্যে বহুর’ অনুসন্ধান করে। তাই সে অঞ্চল ও স্থান ভেদে নিজের প্রয়োজন মত অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবীর সন্ধান করে নিয়েছে। এই কারণে হিন্দুর কত সংখ্যক লোকায়ত দেব-দেবী আছে তার সংখ্যা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। উপস্থিত ক্ষেত্রে এ প্রসঙ্গে আমরা মোটামুটি একটি ধারণা জন্য গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর সাহায্য নিতে পারি। বসু তাঁর গ্রন্থে (বাংলার লৌকিক দেবতা: দে’জ পাবলিশিং : কলকাতা : ১৯৯৬) সর্বমোট পঁয়ত্রিশটি লৌকিক দেব-দেবীর একটি পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই পঁয়ত্রিশটি দেব-দেবী হচ্ছে:
লৌকিক দেব-দেবী
মাকাল ঠাকুর
পাঁচু ঠাকুর
জ্বরাসুর
ভৈরব
রাজভলবী
করম রাজা
বনবিবি
ঢেলাই চণ্ডী
সিনি দেবী
আটেশ্বর
নারায়ণী
দক্ষিণ রায়
কালু রায়
হাড়িঝি
ভাদু
মুণ্ডমূর্তি
ওলাই চণ্ডী
সাতবোন
মানিক পীর
পীর গোরাচাঁদ
ক্ষেত্রপাল
বাবা ঠাকুর
বসন্ত রায়
ঘাঁটু দেবতা
বড়খাঁ গাজী
দেবী উত্তরবাহিনী
ওলা বিবি
বাসালী
ইঁদ পূজা
ধর্ম ঠাকুর
যোগাদ্ধা
রংকিনী
সত্যনারায়ণ/সত্যপীর
বড়াম
টুসু
স্থান ও অঞ্চল ভেদে এই পঁয়ত্রিশটি লোকায়ত দেব-দেবী বাদেও হিন্দুর আরও অনেক লোকায়ত দেব-দেবী আছে। এঁরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে সাধারণ হিন্দুর দ্বারা পূজিত হন।
দেব-দেবীগণ যে নামেই পূজিত হোন না কেন এসব পূজার কেন্দ্রবিন্দুতে কাজ করে বংশ পরম্পরাগত কতগুলো বিশ্বাস। এই বিশ্বাসগুলো কী? ড. অতুল সুর এ ব্যাপারে আমাদের একটা ধারণা দিয়েছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে (বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন : সাহিত্যলোক : ১৯৯৪) বলেছেন : লৌকিক বিশ্বাস হচ্ছে আদিম অধিবাসীদের ধর্ম। তাঁর মতে এই অঞ্চলের আদিবাসী বা ভূমিপুত্রগণ অর্থাৎ হিন্দুদের পূর্বপুরুষগণ পরলোকে বিশ্বাসী ও মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তারা যাদু বিদ্যায় যেমন বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি বিশ্বাসী ছিলেন সৃজন শক্তিতে। সৃজনশক্তিকে তারা মাতৃজ্ঞানে পূজা করতেন। লাঙ্গলের প্রতীক হিসেবে লিঙ্গ পূজা এই সৃজনশক্তির একটি উদাহরণ। তারা কুমারী পূজায় বিশ্বাসী ছিলেন। নানা ধরনের টোটেম ছিল তাদের। এই টোটেমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আদিম অধিবাসীরা। অরণ্য, নদী ও বৃক্ষ ইত্যাদি শক্তির প্রতিও তারা সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
এসব বিশ্বাসেরই প্রতিফলন দেখা যায় লোকায়ত দেব-দেবীতে। শুধু দেব- দেবীতে নয়, এসব বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে হিন্দুর জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠানে। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু কর্তৃক আলোচিত দেব-দেবীতে যেমন এসব বিশ্বাসের প্রতিফলন রয়েছে, তেমনি এই বিশ্বাসগুলোর প্রতিফলন রয়েছে হিন্দুর অন্যান্য পূজা, অনুষ্ঠান ও আচার-পার্বনে। এর মধ্যে আছে : দুর্গা-কালী-চণ্ডী পূজা, শীতলা ও তুলসী পূজা, ষষ্ঠীপূজা, লক্ষ্মীপূজা ও অন্যান্য পূজা, শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বন, হোলি, চড়ক ও গাজন, পান খিলি, গাত্র হরিদ্রা, গুটি খেলা, অম্বুবাচী ও আরও বিচিত্র সব অনুষ্ঠান। এসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাথে হিন্দু তার খাদ্য রীতি, পোষাক রীতি, ব্যবহার রীতি, জ্যোতিষীচর্চা ও ব্রতাচার ইত্যাদিকেও মিলিয়ে নিয়েছে, সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নিয়েছে।
এবারে দেখা যাক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু যে পঁয়ত্রিশটি দেব-দেবীর পরিচয় দিয়েছেন তাঁদের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? প্রথমত দেখা যায় এই দেব-দেবীগণের মধ্যে কেউ কেউ সাধারণভাবে সকল হিন্দু কর্তৃক পূজিত। আবার কেউ কেউ পূজিত হন বিশেষ বিশেষ বৃত্তি ও পেশাজীবীদের দ্বারা ( যেমন মৎস্যজীবীদের পূজ্য মাকাল ঠাকুর)। কেউ পূজিত হন শুধু মেয়েদের দ্বারা (ভাদু ও টুসু দেবী)। কেউ কেউ শুধু উপজাতিদের দ্বারা (ভৈরব)। আবার কেউ কেউ পূজিত হন হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী দ্বারা (ওলাই চণ্ডী, বড় খাঁ গাজী, পীর গোরা চাঁদ ও সত্যনারায়ণ/সত্যপীর)।
দ্বিতীয়ত এঁদের কারও কারও প্রতিমা আছে, কারও কারও প্রতিমা নেই (মাকাল ঠাকুর, বন বিবি, হাড়িঝি ও করম রাজা)। কোনো কোনো দেব-দেবীর প্রতিমার রূপ উগ্র (পাঁচু ঠাকুর), আবার কোনো কোনো দেব-দেবীর প্রতিমা সৌম্য, শান্ত ও সুশ্রী। আবার কোনো কোনো দেব-দেবীর প্রতীক বৃক্ষ, প্রস্তর খণ্ড অথবা মাটির স্তূপ। তৃতীয়ত এঁরা পূজিত হন পূজারীর বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণের জন্য। ইচ্ছাগুলোর মধ্যে আছে : অধিক মৎস্য পাওয়ার বাসনা, বনে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা, ব্যাঘ্র থেকে আত্মরক্ষা, শিশুদের মঙ্গল, রোগ থেকে মুক্তি, গ্রামরক্ষা, পশুদের রোগমুক্তি, চর্মরোগ থেকে মুক্তি, কলেরা রোগ থেকে মুক্তি ও সম্মান লাভের ইচ্ছা ইত্যাদি। চতুর্থত এই সব দেব-দেবীর পূজায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োজিত হয় না। সাধারণ হিন্দু যার যার মত করে মন্ত্রবিহীন এই পূজাগুলো করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অব্রাহ্মণ পুরোহিতরাই এদের পূজা করেন (ধর্মঠাকুর)। পঞ্চমত এই দেব-দেবীগণের মধ্যে বেশ কয়েকজন মিলিত বা যুক্ত সাধনার দেব-দেবী অর্থাৎ তারা বিভিন্ন ধর্মের লোক দ্বারা পূজিত হন।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর পুস্তকস্থ আলোচনা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত বোঝা যায় লোকায়ত দেব-দেবীগণ অনাদিকাল থেকেই পূজিত হয়ে আসছেন। মাঝখানে আর্যদের উত্থানের সময় এরা পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ আর্যরা প্রতিমা পূজায় বিশ্বাস করত না। দ্বিতীয়ত তাদের নিজস্ব দেবতা ছিল। তৃতীয়ত তারা এই পূজা-অৰ্চনাকে অবজ্ঞার চোখে দেখত। তাই বহুদিন নেপথ্যে থেকে মুসলমান আগমনের পর এঁরা মাথা তুলে ওঠেন। আর্য-ব্রাহ্মণ্য সমাজ তখন দু’দিক থেকে বিপদের সম্মুখীন হয়। এদের মধ্যে ছিল স্থানীয় ভূমিপুত্রগণ যারা আর্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। দ্বিতীয়ত ছিল মুসলমান শাসকশ্রেণি ও নব ধর্মান্তরিত মুসলমান যারা আর্যদের মতই প্রতিমা পূজায় বিশ্বাস করে না। এই প্রেক্ষাপটে যখন প্রবল গতিতে লোকায়ত দেব- দেবীগণ সামনে আসতে থাকেন তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় তারা লোকায়ত দেব-দেবীকে গ্রহণ করার জন্য নানা ধরনের কল্প-কাহিনীর জন্ম দেন। গ্রহণের একটা ব্যবস্থা হিসেবে তারা আশ্রয় নেন মহাদেবের (শিব)। কোনো কোনো দেবতাকে তারা শিবের সাথে যুক্ত করেন। দেবীগণকে যুক্ত করা হয় শিবের স্ত্রী উমা, গৌরী ও পার্বতীর সাথে। কোনো কোনো দেবতাকে শিবপুত্র কার্তিক ও গণেশের সাথে যুক্ত করা হয়।
লক্ষণীয় ব্রাহ্মণ্য সমাজ লোকায়ত দেব-দেবীকে আর্যদের দেবতা ইন্দ্র, অরুণ, বরুণ, ব্রহ্মা অথবা বিষ্ণুর সাথে যুক্ত করার সাহস পায় নি। কারণ এই আর্য দেবতাদের সাথে লোকায়ত দেব-দেবীর কোনো সম্পর্ক নেই। তন্ত্র, তান্ত্রিক মত, মাতৃপূজা, পরলোকে বিশ্বাস, মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃষির সাথে সম্পর্কিত নানা বিশ্বাস ইত্যাদি আর্য-সংস্কৃতির বিষয় নয়। তাই নিতান্ত গ্রহণযোগ্যতার জন্যে পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ লোকায়ত দেব-দেবীকে শিবের পরিবারভুক্ত করে নিতে বাধ্য হয়। মনসা, শীতলা, চণ্ডী, পাঁচু ঠাকুর, কালু রায়, রাজভলবী, হাড়িঝি, দেবী উত্তরবাহিনী, রংকিনী ও দক্ষিণ রায় থেকে শুরু করে বহু লোকায়ত দেব-দেবী আছে যাঁরা এর সাক্ষ্য। এসব দেব-দেবীকে শিবের আশ্রয়ে আনার আরও একটি কারণ লক্ষণীয়।
দেখা যায় অনেক লোকায়ত দেব-দেবী বৌদ্ধধর্ম থেকে আগত। বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের সময় এদেরকে শিবের পক্ষভুক্ত করা ছাড়া বিকল্প ছিল না। এই পক্ষভুক্তি অবশ্য বিনা দৈবসংগ্রামে হয় নি। পুরো মধ্যযুগ এই দৈবসংগ্রামের যুগ। এই সংগ্রামে অনেক দেব-দেবীকে শিবের প্রতিপক্ষ করার চেষ্টা করা হয় যাতে শিব দেবতা হিসেবে তিরোহিত হন। শিবের অনুসারীদেরকে নানা দেব-দেবী দিয়ে মধ্যযুগে যারপরনাই হেনস্তা করা হয়েছে।
হেনস্তার বড় দুটো উদাহরণ চাঁদ সওদাগর ও ধনপতি সওদাগরের কাহিনী। এরা দু’জনেই ছিলেন শিবের উপাসক। চাঁদ সওদাগরকে মনসার নামে ও ধনপতি সওদাগরকে চণ্ডীর নামে নির্যাতন করা হয়। পরিশেষে মনসা ও চণ্ডীকে শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করে আপোষরফা হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য বৌদ্ধদের দেবতা বা পূজ্যকে সরাসরি ‘আর্যধর্মের’ সাথে সংশিষ্ট করা হয়েছে। বৌদ্ধদের ত্রিরত্ন হচ্ছে : ‘বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ’। এই তিনের আদলে গড়ে তোলা হয় উড়িষ্যার ‘জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা’ এই দেবতামণ্ডলী (প্রবন্ধ : বঙ্গ ভাষায় বৌদ্ধ স্মৃতি : রমেশ বসু : গ্রন্থ : বুদ্ধ ও বৌদ্ধ : সংকলন বারিদ বরণ ঘোষ : করুণা প্রকাশনী : কলকাতা, ১৪০১)।
মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশযুগ পর্যন্ত দৈব সংগ্রামের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এই দিকটি হচ্ছে যুক্ত বা মিলিত সাধনার প্রচেষ্টা। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মুসলমানদের মধ্যে দেবতার আরাধনায় নৈকট্য আনার জন্য সমাজ একটি চেষ্টা চালায়। এই ঐক্য সাধনায় ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর একটি ভূমিকা পালন করে। দেখা যায়, লোকায়াত দেব-দেবীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছেন ধর্মঠাকুর। এই ধর্মঠাকুর যে বৌদ্ধধর্মের পরিণতি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৌদ্ধদের ত্রিরত্ন অর্থাৎ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের ‘ধর্মই’ হচ্ছেন ধর্মঠাকুর। বৌদ্ধদের ‘ধর্মমঙ্গল’ বোধ হয় তারই স্মৃতি বহন করছে। বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়কালে ত্রিরত্নের ‘ধর্ম’ আলাদাভাবে দেবতা হিসেবে পূজিত হতে থাকেন। পাশাপাশি নাথ সম্প্রদায় কর্তৃক পূজিত হতেন ‘সত্যদেব’। এই ‘সত্যদেব’ই এক সময়ে মুসলমান আগমনের পর ‘সত্যপীর’ এ পরিণত হন। নাথ সম্প্রদায়ের ‘সত্যদেব’, মুসলমানের ‘সত্যপীর’ ধারণার সাথে একসময়ে যুক্ত হয় ব্রাহ্মণ্য সমাজের ‘নারায়ণের’ ধারণা। পরবর্তীকালে ‘ধর্মঠাকুর’ ও ‘সত্যদেব’ বিবর্তনের মাধ্যমে ‘সত্যনারায়ণে’ রূপান্তরিত হন। ইত্যবসরে অবশ্য বিলীন হয়ে যায় ধর্মঠাকুর। কিন্তু তার স্মৃতি এখনও বহন করছে কলকাতার বিখ্যাত অঞ্চল ‘ধর্মতলা’। এ শহরের প্রধানতম জায়গার নাম যদি বৌদ্ধ স্মৃতিবহ হয়, তাহলে কি শহরটির নাগরিকরা অ-বৌদ্ধ ছিল?
পরিশেষে লোকায়ত দেব-দেবী সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। প্রথমত দেখা যায় লোকায়ত দেব-দেবীগণ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হচ্ছে। অনেক লোকায়ত দেব- দেবী তিরোহিত হচ্ছে। অনেক লোকায়ত দেব-দেবী আবার নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করে নিচ্ছে, মিশে যাচ্ছে অ-লোকায়ত দেব-দেবীর সাথে। গড়ে উঠছে হিন্দুর বৃহত্তর পূজা ঐতিহ্য ও সাধনার নতুন নতুন মাধ্যম। সমাজ বদলের সাথে সাথে ব্রাহ্মণ্য সমাজও ধীরে ধীরে এঁদের গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু এ ফাঁকে ব্রাহ্মণ মন্দির নিয়েছে দখল করে। মন্দিরে মন্দিরে দেব-দেবী পূজার অধিকার এখন একমাত্র তার। বাকি হিন্দুরা দেবদেবীকে ডাকেন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে। যেন ঈশ্বরকে ডাকার সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত দেখা যাচ্ছে দেব-দেবীর এই গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্যেই লুক্কায়িত আছে হিন্দু সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার যেন কোনো শেষ নেই। এতে অনেক সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর হাসি-কান্না, দুঃখ ও অভিমান লুকিয়ে আছে। পাশাপাশি লুক্কায়িত আছে হিন্দুদের সামাজিক ইতিহাসও। তবে একটি জিনিস পরিষ্কার এ প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত জয়ী হচ্ছেন সাধারণ হিন্দুরাই। তাদের চিন্তা-চেতনাই পরিশীলিত হয়ে ক্রমাগতভাবে পরিপুষ্ট করছে হিন্দু সভ্যতাকে। তা বলে কি বাধা- বিপত্তি নেই। বাধা-বিপত্তি প্রচণ্ড। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই জনশক্তির জয় হচ্ছে।