লোকটা

লোকটা

সোমনাথবাবু সকালবেলায় তাঁর একতলার বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছেন। সামনেই মস্ত বাগান, সেখানে খেলা করছে তার সাতটা ভয়ঙ্কর কুকুর। কুকুরদের মধ্যে দুটো বকসার বুলডগ, দুটো ডোবারম্যান, দুটো অ্যালসেশিয়ান, একটা চিশি সড়ালে। এদের দাপটে কেউ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না, তার ওপর গেটে বাহাদুর নামের নেপালি দারোয়ান আছে। তার কোমরে কুকরি, হাতে লাঠি। সদা সতর্ক, সদাতৎপর। সোমনাথবাবু এরকম সুরক্ষিত থাকতেই ভালবাসেন। তাঁর অনেক টাকা, হীরে জহরত সোনাদানা।

কিন্তু আজ সকালে সোমনাথবাবুকে খুবই অবাক হয়ে যেতে হলো। ঘড়িতে মোটে সাতটা বাজে। শীতকাল। সবে রোদের লালচে আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এই সময়ে বাগানের ফটক খুলে বেঁটেমত টাকমাথার একটা লোক ঢুকল। দারোয়ান বা কুকুরদের দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। পাথরকুঁচি ছড়ানো পথটা দিয়ে সোজা বারান্দার দিকে হেঁটে আসতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, দিনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেয়েও বাহাদুর তাকে বাধা দিল না এবং কুকুরেরাও যেমন খেলছিল তেমনিই ছোটাছুটি করে খেলতে লাগল। একটা ঘেউ পর্যন্ত করল না।

সোমনাথবাবু অবাক হয়ে চেয়েছিলেন। আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!

লোকটার চেহারা ভদ্রলোকের মতোই, মুখখানায় একটা ভালমানুষীও আছে, তবে পোশাকটা একটু কেমন কেমন, মিস্তিরি বা ফিটাররা যেমন তেলকালি লাগার ভয়ে ওভারল পরে, অনেকটা সেরকমই একটা জিনিস লোকটার পরনে। পায়ে এই শীতকালেও গামবুট ধরনের জুতো। কারও মাথায় এমন নিখুঁত টাকও সোমনাথবাবু কখনও দেখেননি। লোকটার মাথায় একগাছি চুলও নেই।

বারান্দায় উঠে আসতেই সোমনাথবাবু অত্যন্ত কঠোর গলায় বলে উঠলেন, “কী চাই? কার হুকুমে এ বাড়িতে ঢুকেছেন?”

লোকটা জবাবে পাল্টা একটা প্রশ্ন করল, “আপনি কি সকালের জলখাবার সমাধা করেছেন?”

সোমনাথবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “না তো–ইয়ে–মানে আপনি কে বলুন তো?”

লোকটা মুখোমুখি একটা বেতের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, “আমার খুবই খিদে পেয়েছে। হাতে বিশেষ সময়ও নেই।”

লোকটার বাঁ কবজিতে একটা অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। বেশ বড় এবং ডায়ালে বেশ জটিল সব ছোটো ছোটো ডায়াল ও কাঁটা রয়েছে।

সোমনাথবাবু একটু গলা খাঁকারি দিয়ে রাগটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “দেখুন, আপনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। অচেনা বাড়িতে ফস করে ঢুকে পড়া মোটেই ভদ্রতাসম্মত নয়। তার ওপর বিনা নিমন্ত্রণে খেতে চাইছেন–এটাই বা কেমন কথা?”।

লোক্টা অবাক হয়ে বলে, “আপনার খিদে পেলে আপনি কী করেন?”

“আমি! আমি খিদে পেলে খাই, কিন্তু সেটা আমার নিজের বাড়িতে।”

“আমিও খিদে পেলে খাই।” এই বলে লোকটা মিটিমিটি হাসতে লাগল।

সোমনাথবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি নিজের বাড়িতে গিয়ে খান না।”

লোকটা হাসি হাসি মুখ করেই বললেন, “আমার নিজের বাড়ি একটু দূরে। আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এখানে একটু আটকে পড়েছি।”

সোমনাথবাবু বিরক্তির ভাবটা চেপে রেখে বললেন, “আপনি আমার দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে কুকুরগুলোর চোখ এড়িয়ে কী করে ঢুকলেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এ বাড়িতে কোনও লোক কখনও খবর দিয়ে ঢুকতে পারে না।”

লোকটা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলে, “সে কথা ঠিকই, আপনার দারোয়ান বা কুকুরেরা কেউই খারাপ নয়। ওদের ওপর রাগ করবেন না। আচ্ছা, আপনার কি সকালের দিকে খিদে পায় না? খেতে খেতে বরং দু-চারটে কথা বলা যেত।”

এই বলে লোকটা এমন ছেলেমানুষের মতো সোমনাথবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইল যে সোমনাথবাবু হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “আপনি একটু অদ্ভুত আছেন মশাই! আচ্ছা, ঠিক আছে, জলখাবার খাওয়াচ্ছি একটু বসুন।”

সোমনাথবাবু উঠে ভিতর বাড়িতে এসে রান্নার ঠাকুরকে জলখাবার দিতে বলে বারান্দায় ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, তাঁর ভয়ংকর সাত সাতটা কুকুর বারান্দায় উঠে এসে বেঁটে লোকটার চারধারে একেবারে ভেড়ার মতো শান্ত হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে আছে। আর লোকটা খুব নিম্নস্বরে তাদের কিছু বলছে।

সোমনাথবাবুকে দেখে লোকটা যেন একটু লজ্জা পেয়েই বলল, “এই একটু এদের সঙ্গে কথা বললুম আর কি। ওই যে জিমি কুকুরটা, ওর কিন্তু মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হয়, একটু চিকিৎসা করাবেন। আর টমি বলে ওই যে অ্যালসেশিয়ানটা আছে, ও কিন্তু একটু অপ্রকৃতিস্থ, সাবধান থাকবেন।”

সোমনাথবাবু এত বিস্মিত যে মুখে প্রথমটায় কথা সরল না। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে যখন কথা বলতে পারলেন তখন গলায় ভাল করে স্বর ফুটছে না, “আপনি ওদের কথা বুঝতে পারেন? ভাবই বা হলো কী। করে?”

লোকটাও যেন একটু অবাক হয়ে বলে, “আপনি কুকুর পোষেন অথচ তাদের ভাষা বা মনের ভাব বোঝেন না এটাই বা কেমন কথা? ওরা তো আপনার কথা দিব্যি বোঝে। দু পায়ে দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, পাশের ঘর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে আসতে বললে নিয়ে আসে। তাই না? ওরা যা পারে আপনি তা পারেন না কেন?”

সোমনাথবাবুকে স্বীকার করতে হলো যে কথাটায় যুক্তি আছে। তারপর বললেন, “কিন্তু ভাব করলেন কী করে?”

“ওরা বন্ধু আর শত্রু চিনতে পারে।” সোমনাথবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “কিন্তু বাহাদুর! বাহাদুর তো আমার মতোই মানুষ। তার ওপর ভীষণ সাবধানী লোক। তাকে হাত করা তো সোজা নয়।”

লোকটা মিটিমিটি হেসে বলে, “আমি যখন ঢুকছিলাম তখন বাহাদুর হাসিমুখে আমাকে একটা সেলামও করেছিল। শুধু আপনিই কেমন যেন আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারছেন না।”

সোমনাথবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “মানে–ইয়ে–যাকগে, আমার এখন আর কোনও বিরূপ ভাব নেই।”

‘আমার কিন্তু খুবই খিদে পেয়েছে।”

শশব্যস্ত সোমনাথবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যবস্থা হয়েছে। আসুন।”

লোকটার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল, গোগ্রাসে পরোটা আর আলুর চচ্চড়ি খেল, তারপর গোটা পাঁচেক রসগোল্লাও। চা বা কফি খেল না। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “আর সময় নেই, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই রওনা হতে হবে।”

সোমনাথবাবু ভদ্রতা করে বললেন, “আপনি কোথায় থাকেন?”

“বেশ একটু দূরে। অনেকটা পথ।”

“গাড়িটা কি মেরামত হয়ে গেছে? নইলে আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দেখতে পারি, সে গাড়ির কাজ খানিকটা জানে।”

লোকটা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, “এ গাড়ি ঠিক আপনাদের গাড়ি নয়। আচ্ছা চলি।”

লোকটা চলে যাওয়ার পর সোমনাথবাবু বাহাদুরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “যে লোকটা একটু আগে এসেছিল তাকে তুই চিনিস? ফস করে ঢুকতে দিলি যে বড়?”

বাহাদুর তার ছোটো চোখ যথাসম্ভব বড় করে বলল, “কেউ তো আসেনি বাবু।”

‘আলবাৎ এসেছিল, তুই তাকে সেলামও করেছিস।”

বাহাদুর মাথা নেড়ে বলে, “না, আমি তো কাউকে সেলাম করিনি। শুধু সাতটার সময় আপনি যখন বাড়ি ঢুকলেন তখন আপনাকে সেলাম করেছি।”

সোমনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, “আমি! আমি সকালে আজ বাইরেই যাইনি তা ঢুলুম কখন? ওই বেঁটে বিচ্ছিরি টেকো লোকটাকে তোর আমি বলে ভুল হলো নাকি?”

সোমনাথবাবু তার কুকুরদের ডাকলেন এবং একতরফা খুব শাসন করলেন, “নেমকহারাম, বজ্জাত, তোরা এতকালের ট্রেনিং ভুলে একজন অজ্ঞাতকুলশীলকে বাড়িতে ঢুকতে দিলি! টুঁ শব্দটিও করলি না!”

কুকুররা খুবই অবোধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল।

মাসখানেক কেটে গেছে। বেঁটে লোকটার কথা একরকম ভুলেই গেছেন সোমনাথবাবু। সকালবেলায় তিনি বাগানের গাছগাছালির পরিচর্যা করছিলেন। তার সাতটা কুকুর দৌড়ঝাঁপ করছে বাগানে। ফটকে সদাসতর্ক বাহাদুর পাহারা দিচ্ছে। শীতের রোদ সবে তেজি হয়ে উঠতে লেগেছে।

একটা মোলায়েম গলাখাঁকারি শুনে সোমনাথবাবু ফিরে তাকিয়ে অবাক। সেই লোকটা। মুখে একটু ক্যাবলা হাসি।

সোমনাথবাবু লোকটাকে দেখে বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। কারণ, আজও দেখছেন বাহাদুর লোকটাকে আটকায়নি এবং কুকুরেরাও নির্বিকার। সোমনাথবাবু নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “এই যে! কী খবর?”

“আজ্ঞে খবর শুভ। আজও আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।”

“তার মানে আজও কি আপনার গাড়ি খারাপ হয়েছে?”

‘হ্যাঁ। দূরের পাল্লায় চলাচল করতে হয়, গাড়ির আর দোষ কী?”

“তা বলে আমার বাড়িটাকে হোটেলখানা বানানো কি উচিত হচ্ছে? আর আপনার গতিবিধিও রীতিমতো সন্দেহজনক। আপনি এলে দারোয়ান ভুল দেখে, কুকুরেরাও ভুল বোঝে। ব্যাপারটা আমার সুবিধে ঠেকছে না।”

লোকটা যেন বিশেষ লজ্জিত হয়ে বলে, “আমাকে দেখতে হুবহু আপনার মতোই কিনা, ভুল হওয়া স্বাভাবিক।”

সোমনাথবাবু এ কথা শুনে একেবারে বুরবক, “তার মানে? আমাকে দেখতে আপনার মতো! আমি কি বেঁটে? আমার মাথায় কি টাক আছে?”

লোকটা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে, “না না, তা নয়। আপনি আমার চেয়ে আট ইঞ্চি লম্বা, আপনার হাইট পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। আপনার মাথায় দু লক্ষ সাতাশ হাজার তিনশ পঁচিশটা চুল আছে। আপনি দেখতেও অনেক সুদর্শন। তবু কোথায় যেন হুবহু মিলও আছে।”

উত্তেজিত সোমনাথবাবু বেশ ধমকের গলায় বললেন, “কোথায় মিল মশাই? কিসের মিল?”

লোকটা একটা রুমালে টাকটা মুছে নিয়ে বলল, “সেটা ভেবে দেখতে হবে। এখন হাতে সময় নেই। আমার বড় খিদে পেয়েছে।”

সোমনাথবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “খিদে পেয়েছে তো হোটেলে গেলেই হয়।”

লোকটা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমার কাছে পয়সা নেই যে!”

“পয়সা নেই!” এদিকে তো দিব্যি গাড়ি হাঁকিয়ে যাতায়াত করেন। তাহলে পয়সা নেই কেন?”

লোকটা কাঁচুমাচু মুখে পকেটে হাত দিয়ে একটা কাঠি বের করে বলল, “এ জিনিস এখানে চলবে?”

“তার মানে?”

“আমাদের দেশে এগুলোই হচ্ছে বিনিময় মুদ্রা। এই যে কাঠির মতো জিনিসটা দেখছেন এটার দাম এখানকার দেড়শ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কে দাম দেবে বলুন।”

সোমনাথবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কাঠি! কাঠি আবার কোথাকার বিনিময় মুদ্রা হলো! এসব তো হেঁয়ালি ঠেকছে।”

লোকটা একটু কাতর মুখে বলল, “সব কথারই জবাব দেবো। আগে কিছু খেতে দিন। বড্ড খিদে।”

সোমনাথবাবু রুষ্ট হলেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি লোকটাকে খাওয়ালেনও। লোকটা যখন গোগ্রাসে পরোটা খাচ্ছে তখন সোমনাথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা আপনার নাম বা ঠিকানা কিছুই তো বলেননি, কী নাম আপনার?”

লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “নামটা শুনবেন! একটু অদ্ভুত নাম কিনা, আমার নাম খ।”

সোমনাথবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘শুধু খ! এরকম নাম হয় নাকি?”

“আমাদের ওখানে হয়।”

“আর পদবি?”

“খ মানেই নাম আর পদবি। খ হলো নাম আর অ হলো পদবি। দুয়ে মিলেই ওই খ।”

“ও বাবা! এ তো খুব অদ্ভুত ব্যাপার।”

“আমাদের সবই ওরকম।”

“তা আপনার বাড়ি কোথায়?”

“একটু দূরে। সাড়ে তিনশো আল হবে।”

“আল! আল আবার কী জিনিস?”

“ওটা হলো দূরত্বের মাপ।”

“এরকম মাপের নাম জন্মে শুনিনি মশাই। তা আল মানে কত? মাইল খানেক হবে নাকি?”

লোকটা হাসল, “একটু বেশি। হাতে সময় থাকলে চলুন না, আমার গাড়িটায় চড়ে আলের মাপটা দেখে আসবেন।”

“না না, থাক।”

লোকটা অভিমানী মুখে বলে, “আপনি বোধহয় আমাকে ঠিক বিশ্বাস করছেন না! আমি কিন্তু ভাল লোক। মাঝে মাঝে খিদে পায় বলে হামলা করি বটে, কিন্তু আমার কোনও বদ মতলব নেই।”

সোমনাথবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, “আরে না না। ঠিক আছে, বলছেন যখন যাচ্ছি। তবে এ সময়ে আমি একটু ব্যস্ত আছি কিনা, বেশি সময় দিতে পারব না।”

“তাই হবে, চলুন, গাড়িটা পিছনের মাঠে রেখেছি।”

“মাঠে! ও তো ঠিক মাঠ নয়, জলা জায়গা, ওখানে গাড়ি রাখা অসম্ভব।”

“আমার গাড়ি সর্বত্র যেতে পারে। আসুন না দেখবেন।” কৌতূহলী সোমনাথবাবু লোকটার সঙ্গে এসে জলার ধারে পৌঁছে অবাক। কোথাও কিছু নেই।

“কোথায় আপনার গাড়ি মশাই?” বলে পাশে তাকিয়ে দেখেন লোকটাও নেই। সোমনাথবাবু বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন।

অবশ্য বিস্ময়ের তখনও অনেক কিছু বাকি ছিল। ফাঁকা মাঠ, লোকটাও হাওয়া দেখে সোমনাথবাবু ফিরবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় অদৃশ্য থেকে লোকটা বলে উঠল, “আহা, যাবেন না, একটা মিনিট অপেক্ষা করুন।”

বলতে বলতেই সামনে নৈবেদ্যর আকারের একটা জিনিস ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল। বেশ বড় জিনিস, একখানা ছোটোখাটো দোতলা বাড়ির সমান। নীচের দিকটা গোল, ওপরের দিকটা সরু।

“এটা আবার কী জিনিস?”

নৈবেদ্যর গায়ে পটাং করে একটা চৌকো দরজা খুলে গেল আর নেমে এল একখানা সিঁড়ি। লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “আসুন আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক।”

সোমনাথবাবু এমন বিস্মিত হয়েছেন যে, কথাই বলতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুট গলায় তোতলাতে লাগলেন, “ভূ-ভূত! ভূ ভূতুড়ে!..”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই না। ভূতুড়ে নয়। গাড়িটা অদৃশ্য করে না রাখলে যে লোকের নজরে পড়বে। আসুন, চলে আসুন। কোনও ভয় নেই।”

সোমনাথবাবু এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “ও বাবা, আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক! আমি ও ফাঁদে পা দিচ্ছি না। আপনি যান, আমি যাবো না।”

লোকটা করুণ মুখে বলে, “কিন্তু আমি তো খারাপ লোক নই সোমনাথবাবু।”

সোমনাথবাবু সভয়ে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “খারাপ নন, তবে ভয়ঙ্কর। আপনি গ্রহান্তরের লোক।”

“আজ্ঞে, আপনাদের হিসেবে মাত্র দু হাজার লাইট ইয়ার দূরে আমার গ্রহ। বেশ বড় গ্রহ। আমাদের সূর্যের নাম সোনা। সোনার চারদিকে দেড় হাজার ছোটো বড় গ্রহ আছে। সব কটা গ্রহই বাসযোগ্য। আপনাদের মতো মোটে একটা গ্রহে প্রাণী নয় সেখানে। সব ক’টা গ্রহেই নানা প্রাণী আর উদ্ভিদ। কোনও কোনও গ্রহে এখন প্রস্তরযুগ চলছে কোনওটায় চলছে ডায়নোসরদের যুগ কোথাও বা সভ্যতা অনেকদূর এগিয়ে গেছে, কোনও গ্রহে ঘোর কলি, কোনওটাতে সত্য, কোনওটাতে ত্রেতা, কোথাও বা দ্বাপর–সে এক ভারী মজার ব্যাপার। বেশি সময় লাগবে না, এ গাড়ি আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে।”

“ওরে বাবা রে!” বলে সোমনাথবাবু প্রাণপণে পাঁই পাঁই করে ছুটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু পারলেন না। একটা সাঁড়াশির মতো যন্ত্র পট করে এগিয়ে এসে তাকে খপ করে ধরে সাঁ করে তুলে নিল সেই নৈবেদ্যর মধ্যে।

তারপর একটা ঝাঁকুনি আর তারপর একটা দুলুনি। সোমনাথবাবুর একটু মূৰ্ছার মতো হলো। যখন চোখ চাইলেন তখন দেখেন নৈবেদ্যটা এক জায়গায় থেমেছে। দরজা খোলা। লোকটা একগাল হেসে বলল, “আসুন, ডায়নোসর দেখবেন না! ওই যে।”

দরজার কাছে গিয়ে সোমনাথবাবুর আবার মূৰ্ছা যাওয়ার যোগাড়। ছবিতে যেমন দেখেছেন হুবহু তেমনি দেখতে গোটা দশেক ডাইনোসর বিশাল পাহাড়ের মতো চেহারা নিয়ে চলাফেরা করছে। আকাশে উড়ছে বিশাল টেরোড্যাকটিল এবং অন্যান্য বিকট পাখি।

ভয়ে চোখ বুজলেন সোমনাথ। আবার দুলুনি। এবার যেখানে যান থামল সেখানে সব চামড়া আর গাছের ছালের নেংটি পরা মানুষ ঘষে ঘষে অস্ত্র তৈরি করছে। মহাকাশযান দেখে তারা অস্ত্র নিয়ে তেড়ে এল। দু-চারটে তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরো এসে লাগলও মহাকাশযানের গায়ে। লোকটা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে তার গাড়ি ছেড়ে দিল।

এবারের গ্রহটা রীতিমতো ভাল। দেখা গেল রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণভাই শিকার করতে বেরিয়েছেন। দুজনেই খুব হাসছেন। রামচন্দ্রকে জোড়হাতে প্রণাম করলেন সোমনাথবাবু। রামচন্দ্র বরাভয় দেখিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন।

সোমনাথবাবু ঘামতে ঘামতে বললেন, “এসব কি সত্যি? না স্বপ্ন দেখছি?”

“সব সত্যি। আরও আছে।”

“আমি আর দেখবো না। যথেষ্ট হয়েছে। মশাই, পায়ে পড়ি, বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।”

লোকটা বিনীতভাবে বলল, “যে আজ্ঞে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবেন। আরও কত কী দেখার আছে।”

মহাকাশযানটা ফের শূন্যে উঠল। সেই দুলুনি। কিছুক্ষণ পর জলার মাঠে নেমে পড়তেই সোমনাথবাবু প্রায় লাফ দিয়ে বৈরিয়ে এলেন।

লোকটা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “দাদা, একটু মনে রাখবেন আমাকে, মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে এসে পড়লে পরোটা-টরোটা যেন পাই।”

“হবে, হবে।” বলতে বলতে সোমনাথবাবু বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *