লোকটা বড্ড ভুলো

লোকটা বড্ড ভুলো

অসিতবাবু আজও ট্রেন মিস করলেন৷ এমনিতেই গত তিনদিন ধরে তিনি লাগাতার ট্রেন মিস করে চলেছেন৷ আজও তার ব্যতিক্রম হল না৷

এমনিতেই বিহারের নাগিনা স্টেশনটা ছোট্ট৷ বেশির ভাগ ট্রেনই দাঁড়ায় না৷ জম্মু-তাওয়াই তবু মিনিটখানেকের জন্য রেললাইনে একটু চাকা ঠেকায়৷ তা-ও তার আসার কোনও গৎবাঁধা সময় নেই৷ জম্মু-তাওয়াই নামে সুপার ফাস্ট হলেও কাজে সুপার স্লো! যখন ওনার মর্জি হবে, তখন দেখা দেবেন৷ বড়জোর এক-আধ মিনিট স্থির হয়ে দাঁড়াবেন; তারপরই ধাঁ!

অবশ্য দোষটা একা ট্রেনের নয়৷ অসিতবাবু নিজেই জম্মু-তাওয়াইয়ের চেয়েও বড় লেটলতিফ৷ সকালের দিকে তাঁর ঘুম ভাঙতেই চায় না৷ যদি বা অ্যালার্মঘড়ির চিল-চিৎকারে যথাসময়ে ঘুম ভাঙল, ভদ্রলোক ঘুম থেকে উঠে অন্তত আধঘণ্টা ভোম মেরে বসে থাকবেন৷ আদতে তিনি ভুলেই গিয়েছেন যে, অ্যালার্মটা কেন দেওয়া হয়েছিল৷ যখন কারণটা মনে পড়বে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷ অগত্যা হাঁউ-মাউ করে লাফ-ঝাঁপ মেরে তৈরি হতে গিয়ে টের পাবেন যে তিনি ব্রাশ কিংবা পেস্ট, কোনওটাই খুঁজে পাচ্ছেন না! যদি বা কপালজোরে খুঁজে পাওয়া গেল, অবধারিত ভাবে গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্ট মিসিং হবেই! কোনওমতে সেগুলো জোগাড় করে পরে বেরোতে যাবেন, ঠিক তখনই চোখে পড়বে যে শার্টটা তিনি উলটো পরেছেন! অথবা প্যান্টের বেল্টের ফাঁক দিয়ে ভিজে গামছাটা উঁকিঝুঁকি মারছে!

এতসব ম্যাও সামলে টামলে দু-হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে, শেষ পর্যন্ত যখন দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে পৌঁছবেন, ঠিক তখনই চোখের সামনে দিয়ে হুশহাশ করে হাওয়া হয়ে যাবে জম্মু-তাওয়াই! আর অসিতবাবু কপালে হাত দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে নিরাশ, বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে পড়বেন স্টেশনের ওপর!

গত তিনদিন ধরেই এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে৷ যেন সিনেমাহলে চলা ফিল্মের রিল গিয়েছে আটকে! বারবার একই দৃশ্যের অ্যাকশন রিপ্লে!

আজও যথারীতি ফোঁস ফোঁস করতে করতে ট্রেনটা বেরিয়ে যাচ্ছিল৷ অসিতবাবু পাঁইপাঁই করে ধাওয়া করলেন তার পিছনে৷ চিৎকার করে বললেন; ‘রোক্কে,…রোক্কে!’

ট্রেনের গার্ড এদিকেই তাকিয়েছিল৷ একটু যেন চঞ্চল হয়ে উঠল৷ পরক্ষণেই নির্লিপ্ত মুখ করে বসে পড়ল৷ একটা লোক যে পাগলের মতো ছুটে আসছে এদিকেই, তা যেন তার নজরেই পড়েনি৷ অসিতবাবু তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রায় চিয়ার লিডারদের মতো দু-হাত ছড়িয়ে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করতে করতে চেঁচাচ্ছেন, ‘রোককে!…রোক্কে!…!’ কিন্তু গার্ডের মুখ ভাবলেশহীন৷ যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না!

মরিয়া হয়ে তিনি ট্রেনের পেছনে ছুট লাগালেন৷ ছুটতে ছুটতে চলন্ত ট্রেনের প্রায় পেছনে পৌঁছে গিয়েছেন!…আরেকটু এগোলেই চলমান ট্রেনের পা-দানিটা পাওয়া যাবে৷ ভদ্রলোক দু-হাতে ব্যাগ নিয়ে ঠিকমতন দৌড়তেও পারছেন না৷ কিন্তু আজ ট্রেনটা তিনি ধরবেনই! যেমন করেই হোক!

ট্রেনের পেছনের কামরার পা-দানিটা এসে গিয়েছে নাগালের মধ্যে৷ ছুটতে ছুটতেই অন্ধের মতো পা বাড়িয়ে দিলেন অসিতবাবু৷ কিন্তু পা-টা সঠিক জায়গায় পড়ল না৷ বরং পা পিছলে গেল! আর…!

‘গে-ছি!…গে-ছি!’ চিৎকার করে উঠলেন তিনি৷ মৃত্যুভয়ে চোখ বুঁজে ফেলেছেন৷ এই বুঝি সুড়ুৎ করে প্ল্যাটফর্মের ফাঁক গলে পড়ে গেলেন চলন্ত ট্রেনের নীচে৷ এই বুঝি ওঁর বুকের ওপর দিয়ে চলে গেল ট্রেনের চাকা! এই বুঝি তিনি দু-খণ্ড হয়ে গেলেন! এই বুঝি…!

আচমকা একটা কণ্ঠস্বর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, ‘এখনও যাননি৷ তবে আরেকটু হলেই যাচ্ছিলেন!’

অসিতবাবু তখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেননি৷ ভয়ে এখনও তাঁর হাত পা কাঁপছে৷ কোনওমতে ঢোঁক গিলে বললেন, ‘আমি কি বেঁচে আছি?’

কণ্ঠস্বরটা তেমন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এই তো কনফিউজিং প্রশ্ন করে বসলেন! বেঁচে থাকা বা না থাকাটা আপেক্ষিক ব্যাপার মশাই! তবে এইটুকু নিশ্চিত যে আপনি এখনও প্ল্যাটফর্মেই আছেন!’

এবার ভরসা পেয়ে চোখ খুললেন অসিতবাবু৷ নাঃ, ট্রেনের চাকার তলায় যাননি তিনি৷ তবে প্ল্যাটফর্ম আর লাইনের মাঝখানে ঝুলছেন৷ আর তাঁর শার্টের কলার ধরে টেনে আছে কেউ৷ বিড়ালের বাচ্চাকে যেমন ঘেঁটি ধরে টেনে তোলা হয়, তেমনই কেউ তাঁকে শার্টের কলার ধরে টেনে তুলল প্ল্যাটফর্মের ওপরে৷

‘ধন্যবাদ!’ কাঁপা গলায় বললেন অসিতবাবু৷ এখনও হাত-পা কাঁপছে৷ তবু পেছন ফিরে উপকারী বন্ধুর দিকে তাকালেন, ‘আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন৷ কী বলে যে আপনাকে…!’

বলতে বলতেই থেমে গেলেন৷ সামনের লোকটি ওঁর পরিচিত৷ গত চারদিন ধরেই দেখছেন৷ উনি এই স্টেশনের স্টেশনমাস্টার৷ মৃদু হেসে বললেন, ‘আজও ট্রেনটা ধরতে পারলেন না?’

‘নাঃ৷’ হতাশ ভাবে বললেন অসিতবাবু, ‘আজও মিস করলাম! কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না! রোজই ভাবি আজ ট্রেনটা ধরবই, কিন্তু কিছুতেই ধরা হয় না৷ কেমন যেন পাঁকাল মাছের মতো বারবার পিছলে যাচ্ছে!’

‘এত তাড়া কীসের?’ স্টেশনমাস্টার হাসতে হাসতেই বললেন, ‘এসেই যখন পড়েছেন এখানে, তবে কিছুদিন থেকেই যান৷ নাগিনা জায়গাটা এত খারাপও নয়৷’

‘না না!’ কপালের ঘাম মুছছেন তিনি, ‘খারাপ হবে কেন? তবে কী জানেন? বাড়িতে আমার স্ত্রী আছেন৷ মেয়ে আছে৷ আমার তো এখানে এতদিন থাকার কথা নয়৷ ওরা হয়তো চিন্তা করছে!’

‘তাতে কী! একটা ফোন করে দিন না বাড়িতে৷’ স্টেশনমাস্টার আস্তে আস্তে বলেন, ‘মোবাইল আছে তো আপনার কাছে!’

‘মোবাইল!’ মোবাইলের কথা মনে পড়তেই কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন অসিতবাবু, ‘মোবাইল তো ছিল৷ কিন্তু গত তিনদিন ধরে সেটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না! কোথায় যে রেখেছি একদম ভুলে গিয়েছি৷ মনেই পড়ছে না৷’

‘ঠিক আছে…ঠিক আছে৷’ তিনি কথা ঘোরালেন, ‘মোবাইলের তো আর ট্রেনের মতো চাকা নেই যে গড়গড়িয়ে চলে যাবে৷ আছে নিশ্চয়ই ব্যাগে কোথাও৷ তেমন হলে কোনও পি সি ও থেকে ফোন করে নেবেন না হয়৷’

অসিতবাবু বিষণ্ণ ভাবে মাথা নাড়েন৷ বাড়ির নম্বরটাও তাঁর মনে নেই৷ কোনওদিনই থাকে না৷ এ নিয়ে গিন্নি অনেকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছুতেই নম্বরটা মনে রাখতে পারেন না৷ বহুবার প্রতিজ্ঞা করেছেন, এবার ল্যান্ডলাইনের নম্বরটা মুখস্থ করে রাখবেনই৷ তবু প্রত্যেকবারই স্মৃতিশক্তি দাগা দেয়৷

‘আপনি বোধহয় একটু ভুলো মানুষ৷ তাই না?’

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি৷ অসিতবাবুর এই ভুলে যাওয়ার স্বভাব নিয়ে বাড়িতে অশান্তির শেষ নেই৷ গিন্নির নাম অরুণিমা৷ কিন্তু বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সঠিক ভাবে নামটা মনে রাখতে পারেননি৷ কখনও ডাকেন ‘নীলিমা’! কখনও বা ‘মধুরিমা’! কোনওবার ‘নিরুপমা’ তো কোনওবার ‘অনুপমা’৷ একবার তো ‘হেমা’ বলেও ডেকে ফেলেছিলেন৷ গিন্নি শুনে বলেছিলেন, ‘হে-এ-এ মা! এই লোকটাকে নিয়ে কী করি! তাও ভালো এখনও মাসিমা, পিসিমা, ঠাকুমা বলে ডাকেনি!’ অসিতবাবুর কী দোষ! ওঁর নামের মধ্যে শুধু ‘মা’ শব্দটাই মনে থাকে! বাকিটা পুরো গুবলেট হয়ে যায়৷ শেষ পর্যন্ত এক বন্ধু বুদ্ধি বাতলাল, ‘পুরো নাম ধরে ডাকার কী দরকার! আধখানা নাম ধরে ডাক না!’

‘কী বলে ডাকব? ‘মা’ বলে?’ অসিতবাবু চটেমটে বললেন, ‘ওই মা-টুকুই তো মনে থাকে৷ আর বৌকে মা বলে ডাকলে কি আর আস্ত রাখবে?’

‘মা বলবি কেন? ‘অরু’ বলে ডাক৷’ বুদ্ধিমান বন্ধু বলল, ‘অরু ডাকলেই তো আর প্রবলেম নেই!’

‘কিন্তু ‘অরু’টাও তো মনে রাখতে হবে৷ যদি ভুলে যাই?’

‘ভুলবি কেন? ভেরি সিম্পল!’ বন্ধু মুচকি হেসে বলে, ‘শুধু মনে রাখিস ‘গরু’৷ তাহলেই দেখবি ‘অরু’ও মনে থাকছে৷’

বন্ধুর টোটকায় কাজ হয়েছিল৷ তারপর থেকে গিন্নিকে ‘অরু’ বলেই ডেকে আসছেন অসিতবাবু৷ এবার আর ভোলেননি৷

কিন্তু ওঁর ভুলে যাওয়ার বদভ্যাসে সংসারে অশান্তি তারপরও কমেনি৷ বৌয়ের নাম তো কোনওভাবে মনে রাখা গেল৷ কিন্তু মেয়ের ভালো নাম আর কিছুতেই মনে থাকে না! একবার স্কুল থেকে ফিরে মেয়ের কী হাপুসনয়নে কান্না! সেদিন অরুনিমার শরীর ভালো ছিল না বলে অসিতবাবু গিয়েছিলেন মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে৷ মেয়ে তো কাঁদে আর মাকে বকে, ‘কেন বাবাকে পাঠিয়েছ আমায় আনতে! বাবা আমার প্রেস্টিজে পুরো গ্যামাক্সিন দিয়ে দিয়েছে৷’

মা মেয়েকে কোনওমতে শান্ত করতে করতে জানতে চাইলেন, ‘কেন? কী হয়েছে?’

‘কী আবার হবে?’ ভ্যাঁক করে কেঁদে বলল মেয়ে, ‘স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী ছুটির পর আমরা সবাই দরোয়ানের সঙ্গে ছিলাম৷ রোজকার মতো আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷ কিন্তু দেখি বাবা আসছে৷ তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘটবে৷ বাবা দূর থেকেই আমায় দেখতে পেয়ে কাছে ডাকল৷ কিন্তু দরোয়ানজি স্কুলের রুল অনুযায়ী যতক্ষণ না গার্ডিয়ান স্টুডেন্টের নাম বলছে, ততক্ষণ ছাড়বে না৷ আর বাবা কিছুতেই আমার নাম বলতে পারছে না৷ বারবার আমাকে দেখিয়ে বলছে ‘ওই তো আমার মেয়ে৷’ তবুও দরোয়ানজি ছাড়ে না৷ বলে, ‘আগে মেয়ের নাম বলুন৷’ শেষ পর্যন্ত বাবা সবার সামনে চিৎকার করে বলল, ‘এই খেঁ-দি, তোর না-ম কী-ই-ই-ই!’ সবাই আমাকে খ্যাপাচ্ছে৷’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল সে, ‘সবাই বলছে ‘যাজ্ঞসেনী, তোর নাম খেঁদি! আগে তো বলিসনি!’ কাল থেকে নির্ঘাৎ সবাই আমাকে ‘খেঁদি খেঁদি’ বলে খ্যাপাবে!’

এরকম কাণ্ড আরও বেশ কয়েকবার করেছেন অসিতবাবু৷ কিন্তু এবার যা ঘটছে, সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে! কে জানে, ওঁর স্ত্রী, আর মেয়ে এবার কী ভাবছে! অফিসের কাজে নাগিনায় এসেছিলেন৷ কিন্তু যেদিন তাঁর বাড়ি ফেরার কথা, তার থেকে চার দিন দেরি হয়ে গিয়েছে৷ কোনও খবরও দিতে পারেননি৷ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় অরুণিমা বারবার বলে দিয়েছিলেন, ‘গিয়েই পৌঁছনোর খবর দেবে৷ রোজ মনে করে ফোন কোর৷ বাড়িতে যে দুটো প্রাণী আছে, ভুলে যেও না৷’

অথচ গত চারদিন ধরে কোনও খবরই বাড়িতে দিতে পারেননি৷ ওরা হয়তো দুশ্চিন্তায় আছে…!

‘এরপরের ট্রেন আবার কাল সকালে!’ স্টেশনমাস্টারের কথায় সংবিৎ ফিরল তাঁর, ‘ততক্ষণ কী করবেন? কোথায় উঠবেন? এখানে তো ধারেকাছে আবার তেমন কোনও হোটেল নেই!’

বাড়ির চিন্তায় অন্য দুশ্চিন্তাগুলো ভুলে গিয়েছিলেন অসিতবাবু৷ এবার তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল৷ তাই তো! এবার কী করবেন? এর আগে অফিসের গেস্ট হাউসে উঠেছিলেন৷ তাও এখান থেকে অনেকটাই দূরে! তা ছাড়া যতদূর মনে পড়ছে গত তিনদিন তিনি মোটেই গেস্ট হাউসে ছিলেন না৷ এখানেই আশেপাশে কোথাও ছিলেন৷ কিন্তু কোথায়? ভুরু কোঁচকালেন তিনি; নাঃ মনে পড়ছে না!

মনে মনে বোধহয় অসিতবাবুর অসহায় অবস্থার কথা বুঝে নিলেন স্টেশনমাস্টার৷ সহৃদয় কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে৷ কোনও ব্যাপার নয়৷ আপনি আসুন আমার সঙ্গে৷’ বলতে বলতেই ওঁর ব্যাগ দুটো তুলে নিলেন৷

‘আরে…আরে! কী করছেন!’

অসিতবাবুর কথাকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে দুটো ব্যাগই তুলে হাঁটা দিলেন স্টেশনমাস্টার৷ পেছন পেছন দৌড়লেন অসিতবাবু৷

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’

‘এই তো! স্টেশনের একদম কাছে৷ ওখানে আমার এক পরিচিত মানুষের বাড়ি আছে৷ ভদ্রলোক পেশায় ম্যাজিশিয়ান৷ খুব মাই ডিয়ার লোক৷ আজকের দিনটা নাহয় ওখানেই কাটিয়ে দেবেন৷ খুব একটা কষ্ট হবে না৷’ বলতে বলতেই হাসলেন ভদ্রলোক, ‘আপনি নাগিনার অতিথি৷ আমাদের সবার অতিথি৷ আপনাকে কি কষ্ট করতে দিতে পারি?’

স্টেশনমাস্টারের অর্থপূর্ণ হাসিটা দেখে কেমন যেন সন্দেহ হল অসিতবাবুর৷ কিন্তু তিনি মুখে কিছু না বলে ভদ্রলোকের পেছন পেছন চললেন৷

স্টেশনমাস্টারের কথাই সঠিক৷ বাড়িটা স্টেশন থেকে একদম কাছেই৷ একদম পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি৷ দশাসই চেহারার ভিক্টোরিয়ান ‘গথিক’ ধরন৷ কিন্তু বাইরে থেকে দেখেই মনে হয় বাড়িটার অবস্থা এখনও বেশ ভালো৷ অন্তত অন্যান্য পুরোনো বাড়ির মতোন ধ্বংসস্তূপের চেহারা নেয়নি৷ লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দু-পাশে ঘন আমবাগান৷ মাঝখান দিয়ে মোরামের রাস্তা চলে গিয়েছে বাড়ির দিকে৷

অসিতবাবু স্টেশনমাস্টারের পেছন পেছন এসে উঠলেন বাড়িটাতে৷ হঠাৎ মনে হল; এই বাড়িটাকে আগে কোথাও দেখেছেন! কিন্তু কোথায়? নাঃ, মনে পড়ছে না! মনের ভেতরটা খুঁতখুঁত করছে৷ অথচ প্রকাশ করতে পারছেন না৷

‘আসুন৷’ স্টেশনমাস্টার একটা বিশাল ঘরে ঢুকে পড়ে আহ্বান জানালেন তাঁকে, ‘এদিকে আসুন৷ ম্যাজিশিয়ান সাহেব এখানে আছেন৷’

অসিতবাবু একটু ইতস্তত করতে করতেই ঘরে ঢুকলেন৷ কিন্তু ঘরে ঢোকামাত্রই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! একজন সুদর্শন লোক কালো জোব্বা পরে শূন্যে ভাসছে! দেখেই প্রায় আঁতকে উঠলেন তিনি৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘ও ক্কী!…উনি হাওয়ায় কী করছেন!’

‘চিন্তা করবেন না৷’ স্টেশনমাস্টার তাঁকে আশ্বস্ত করলেন; ‘জাদুকর মানুষ তো! এসব ওঁদের বাঁ হাতের খেলা! হাওয়ায় ভাসা, জলে হাঁটা; এসব ওঁরা হামেশাই করেন৷’ বলতে বলতেই একটু গলা চড়িয়ে বললেন, ‘ও জাদুকর সাহেব৷ একবার নীচে নেমে আসুন৷ কথা আছে৷’

জাদুকর টুক করে নেমে এলেন নীচে৷ চোখ খুললেন৷ অসিতবাবুর আবার মনে হল, এই লোকটাকে তিনিও চেনেন! কিন্তু কীভাবে! সে বিষয়ে আর কিছু ভাবার আগেই জাদুকর আচমকা বললেন, ‘আজও ট্রেন মিস করেছেন আপনি!’

অসিতবাবু চমকে উঠলেন৷ এই লোকটা জানল কী করে যে তিনি ট্রেন মিস করেছেন! কিন্তু কিছু বলার আগেই ফের জাদুকর সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে…ঠিক আছে৷ কোনও ব্যাপার নয়৷ আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু; কোনও না কোনওদিন তো ট্রেন পাবেনই৷ ততদিন এখানেই থাকুন৷ যদ্দিন না ট্রেন পাচ্ছেন, এখানেই থেকে যান৷ এ বাড়িটাও তো আপনারই!’

‘আমার বাড়ি! মা-নে!’ স্তম্ভিত ভাবে বললেন অসিতবাবু৷

জাদুকর কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন৷ বোঝা গেল, তিনি স্বল্প কথার মানুষ৷ স্টেশনমাস্টারকে বললেন, ‘ওঁকে ওঁর ঘরটা দেখিয়ে দিন৷’

‘নিশ্চয়ই…নিশ্চয়ই…!’ স্টেশনমাস্টার অসিতবাবুকে আর কোনও কথা বলতে না দিয়েই ওঁর ব্যাগদুটো তুলে হাঁটা দিলেন৷ অগত্যা অসিতবাবুকেও যেতে হল৷ তবে যাওয়ার আগে আড়চোখে দেখে নিলেন যে জাদুকর সাহেব ফের হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছেন!

পুরোনো আমলের বড় বড় থামওয়ালা মার্বেলের বারান্দা৷ তার বাঁ দিকে সারি সারি ঘর৷ কোনওটা খোলা, কোনওটা বন্ধ৷ একটা খোলা ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন, সব সাহেবি আমলের আসবাব ভরা! মেহগনি কাঠের বিরাট পালঙ্ক! উল্টোদিকে বেলজিয়াম গ্লাসের ভারী আয়না৷ দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর অয়েলপেইন্টিং৷ একপাশে টেবিল-চেয়ার৷ টেবিলে বই, লেখার সরঞ্জাম৷ তার মধ্যেই একটি ছেলে দেওয়ালে পায়চারি করছে!

গোটা দৃশ্যটা দেখেই চলে যাচ্ছিলেন অসিতবাবু৷ হঠাৎ তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হল! কী! একটা ছেলে দেওয়ালে হাঁটছে! তাঁর রক্ত যেন হিম হয়ে এল৷ আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ‘ও কী! ও কী!’

‘কী হল?’ স্টেশনমাস্টার পেছনে ফিরলেন৷

‘ওই যে!’ তিনি আঙুল তুলে ঘরের ভেতরে নির্দেশ করলেন, ‘দেওয়ালে হাঁটছে!’

‘দেওয়ালে হাঁটছে! কে দেওয়ালে হাঁটছে?’

‘ওই তো!’

স্টেশনমাস্টার এগিয়ে গিয়েছিলেন৷ এবার খানিকটা পিছিয়ে এসে দৃশ্যটা দেখলেন৷ পরক্ষণেই এক ধমক, ‘এই বাবু! দেওয়ালে হাঁটছিস কেন?’

ছেলেটি নীচে নেমে এসে কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘আমার ভালো লাগছিল কাকু!’

‘তাই বলে দেওয়ালে হাঁটবি! এতবড় বারান্দা আছে, ছাত আছে, বাগান আছে৷ সেখানে হাঁটাহাঁটি না করে দেওয়ালে হেঁটে বেড়ানোটা কী জাতীয় ভদ্রতা? যা! বাগানে গিয়ে হাঁট!’

বকা খেয়ে ছেলেটি মুখ চুন করে চলে গেল৷ অসিতবাবু তখনও ভয়ে কাঁপছেন৷ স্টেশনমাস্টার ওঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘ওরা সব জাদুকর সাহেবের চ্যালা৷ এসব ট্রিক খুব সহজ! চাইলে আপনিও পারেন! ভয় পাবেন না৷’

মাথার ঘাম মুছে ঢোঁক গিললেন অসিতবাবু৷ বললেন, ‘জল!’

‘জল খাবেন? একটু দাঁড়ান!’ স্টেশনমাস্টার হাঁকাড় পাড়লেন, ‘ওরে ভোলা…!’

হঠাৎ ভোজবাজির মতো কোথা থেকে একটা মুষকো কালো লোক এসে হাজির৷ যেন হাওয়া থেকে প্রকট হল! অথবা মাটি ফুঁড়ে! লোকটার চোখ দুটো লাল লাল৷ দেখলেই ভয় করে৷ খসখসে গলায় বলল, ‘কী বাবু?’

‘একগ্লাস জল নিয়ে আয় তো!’

সে বিনম্র ভাবে মাথা ঝাঁকায়, ‘এই তো, এক্ষুনি আনছি বাবু!’

বলল বটে ‘আনছি’, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! লোকটা ওখান থেকে এক পাও নড়ল না৷ বরং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখা গেল একটা রুপোলি রঙের ট্রে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আসছে৷ তার ওপর কাচের গ্লাসে এক গ্লাস জল!

অসিতবাবুর মনে হল সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর চতুর্দিকে চক্কর দিচ্ছে! যা ঘটছে তা কি সত্যিই ঘটছে? না পুরোটাই কল্পনা! প্রথমে হাওয়ায় ভাসমান জাদুকর! তারপর দেওয়ালে হেঁটে বেড়ানো ছেলে! এখন আবার শূন্যে ভাসমান জলের গ্লাস! তিনি ভয়ে প্রায় স্টেশনমাস্টারকে জড়িয়ে ধরেছেন! স্টেশনমাস্টার ওঁর ভয়ের কথা বুঝতে পেরে লোকটাকে ছোট্ট একটা ধমক দিলেন, ‘আঃ! ভোলা, কী করছিস এসব?’

‘কেন? জল আনছি বাবু!’ লোকটা নির্লিপ্ত মুখে বলে৷

‘এটা জল আনার একটা কায়দা হল?’ ভদ্রলোকের মুখে স্পষ্ট বিরক্তি, ‘কেন? কিচেনে গিয়ে জলটা নিজের হাতে করে নিয়ে এলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হত? একটু গতর নাড়াতে কি কষ্ট হয়?’

ভোলা মুখ কাঁচুমাচু করে চলে গেল৷ স্টেশনমাস্টার স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘ভয় পাবেন না৷ এসব ব্যাটাদের ম্যাজিক-ট্রিক৷ খুব সোজা৷ কিছুদিন দেখিয়ে দিলে আপনিও পারবেন৷’

‘পেরে আমার কাজ নেই৷’ তখনও ঠকঠক করে কাঁপছেন অসিতবাবু, ‘আমাকে আমার ঘরে নিয়ে চলুন প্লিজ৷’

‘নিশ্চয়ই৷ আসুন৷’

নিজের ঘরটা দেখে বেশ ভালো লাগল অসিতবাবুর৷ বিরাট বিরাট জানলা দিয়ে সুন্দর আলো-বাতাস ঢোকে৷ মেহগনির পালঙ্কটাও চমৎকার৷ ভীষণ কোমল ও নরম৷ তার বিপরীতেই সেগুন কাঠের বিশাল আলমারি৷ সেখানে নিজের জামা-কাপড় সাজিয়ে রাখলেন তিনি৷ এক ফাঁকে টয়লেটটাও দেখে নিলেন৷ নাঃ, বলতেই হচ্ছে; ব্যবস্থাপনা চমৎকার! পুরোনো আমলের বাড়িতে অত্যাধুনিক টয়লেট৷ গিজার আছে৷ এমনকি একটা দুধসাদা বাথটবও রয়েছে৷ আস্তানাটা সত্যিই ভালো৷

মনে মনে স্টেশনমাস্টারকে কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি৷ যদিও মনটা আবারও খুঁতখুঁত করতে শুরু করেছে৷ মনে হচ্ছে, এই ঘরটা, এই টয়লেট তিনি আগেও দেখেছেন! কিন্তু কোথায়, কবে, কেন দেখেছেন মনে পড়ছে না! মাঝে মাঝে নিজের দুর্বল স্মৃতিশক্তির জন্য আফসোস হয় অসিতবাবুর৷ সাধে তাঁর বৌ-মেয়ে চেঁচামেচি করে না৷ অতি সাধারণ জিনিসও মনে রাখতে পারেন না! বৌ-মেয়ের জন্মদিন, অ্যানিভার্সারি তো কোনওদিনই মনে থাকল না ওঁর! এমনকি মেয়ে এখন কী পড়ে, জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে পারবেন না তিনি৷

এই তো, সপ্তাহ দুয়েক আগেকার কথা! তাঁর এক অফিস কলিগ সস্ত্রীক এসেছিলেন বাড়িতে৷ কথায় কথায় মেয়ের কথা উঠল৷ কলিগ ভদ্রলোক সগর্বে জানালেন, তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ শুনে খুব খুশি হলেন অসিতবাবু৷ বললেন ‘বেশ! বেশ! এই তো চাই! আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের মুখ উজ্জ্বল করুক; এইটুকুই তো চাওয়া৷’

‘আপনার মেয়ে কী পড়ে?’ ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘কোন স্ট্রিমে যাওয়ার কথা ভাবছে?’

প্রশ্নটা শুনে বিপন্ন বোধ করলেন অসিতবাবু৷ তবু বিন্দুমাত্রও না ঘাবড়িয়ে বললেন, ‘আগে তো এইচ এস-টা পাশ করুক৷ তারপর দেখা যাবে৷’

মেয়ে সে কথা শুনে ফের মা’কে নালিশ করল, ‘মা, বাবা আবার ভুলভাল বকছে! বলছে, এইচ এস পাশ করার পর নাকি স্ট্রিম ঠিক হবে আমার! বাবার মনেই নেই যে কিছুদিন আগেই আমাদের বাড়িতে আমার ‘মেডিক্যালে’ র‍্যাঙ্ক করার পার্টি হল!’

ভাবতে ভাবতেই আপনমনে হেসে ফেললেন অসিতবাবু৷ তিনি একটু ভুলো মানুষ৷ কিন্তু তাঁর ফ্যামিলিটি বড় সুন্দর৷ স্ত্রী, মেয়ে নিয়ে ভরভরন্ত সংসার৷ ভুলে যাওয়ার বদভ্যাস আছে বলেই মা, মেয়ে তাঁকে আগলে রাখে৷ মেয়ে রোজ অফিসে যাওয়ার সময় বলে, ‘আর সব যত খুশি ভুলে যাও বাবা৷ কিন্তু বাড়ি ফেরার পথটা ভুলো না কিন্তু৷’

‘না রে মা!’ তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘বাড়ির পথ কি কেউ ভোলে?’

‘ভোলে৷’ মেয়ে বলে, ‘অন্তত তুমি ভোলো৷ মনে নেই? সেবার এবাড়িতে আসার বদলে তুমি তেঁতুলপাড়ার বাড়িতে চলে গিয়েছিলে!’

তেঁতুলপাড়ার বাড়িতে একসময় অসিতবাবুরা ভাড়া থাকতেন৷ বেশ কয়েকবছর ছিলেন ওখানেই৷ পরে নিজের বাড়ি তৈরি করে অন্যপাড়ায় চলে আসেন৷ সবই ঠিকঠাক চলছিল৷ একদিন কথা নেই বার্তা নেই, অসিতবাবু ভুল করে চলে গেলেন তেঁতুলপাড়ার সেই ভাড়া বাড়িতে! যেই কলিংবেল বাজাতে যাবেন, ঠিক তখনই মনে পড়ল; এটা তো তাঁর বাড়ি নয়! এখন তো ওঁরা এখানে থাকেন না! ভাগ্যিস সময়মতন মনে পড়েছিল৷ নয়তো কেলেঙ্কারির একশেষ হত!

ভাবতে ভাবতেই অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি৷ চারদিন হল বাড়িতে কোনও খবর দিতে পারেননি৷ কে জানে, বাড়িতে কী হচ্ছে! স্ত্রী হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন৷ মেয়ে হয়তো অস্থির হয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে! হয়তো ফোন করার চেষ্টাও করছে৷ ওরা তো আর জানে না যে ফোনটা অসিতবাবু হারিয়ে ফেলেছেন! হয়তো ভাবছে, বাবা এবার ফেরার পথটাই ভুলে গেল…!

আচমকা একটা গুনগুন শব্দে সংবিৎ ফিরল তাঁর! একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকেই৷ তিনি কৌতূহলী হয়ে ঘর থেকে বেরোলেন৷ নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন দরজার সামনে৷

একটি কিশোরী মেয়ে ঘরের ভেতরে আয়নার সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছে৷ তার কোমর ছাপিয়ে নেমে এসেছে চুলের ঢল৷ মেয়েটি গান গাইছে আর আপনমনে রুপোর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে৷ অসিতবাবু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন তাকে৷ মেয়েটি ওঁর মেয়ের বয়েসিই হবে৷ খেঁদিও এরকম আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গান গায়৷

ভাবতেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল তাঁর৷ কে জানে, খেঁদি এখন কী করছে! আর পারা যাচ্ছে না৷ যে করেই হোক, কালকের ট্রেনটা তাঁকে ধরতেই হবে…৷

‘কাকাবাবু৷’

যে মেয়েটি এতক্ষণ চুল আঁচড়াচ্ছিল সে এবার ওঁর দিকে ফিরেছে৷ তার মিষ্টি রিনরিনে গলায় আদুরেপনা, ‘আমার একটা হেল্প করবেন? কতক্ষণ ধরে চুল ঠিকমতো আঁচড়ানোর চেষ্টা করছি, কিছুতেই হচ্ছে না৷’

অদম্য স্নেহের বশে এগিয়ে গেলেন অসিতবাবু, ‘বলো মা, কী করতে হবে?’

‘এইটা একটু ধরুন তো!’

বলতে বলতেই মেয়েটি হঠাৎ তার মুন্ডুটা খুলে ধরিয়ে দিল অসিতবাবুর হাতে!

‘মু…মু…মুন্ডু…!’ অসিতবাবুর মুখ থেকে কথা সরে না! ভয়ে তাঁর রক্ত হিম হয়ে গিয়েছে! কোনওমতে বললেন, ‘ভূ…ভূ…ভূ-ত!’

‘ন্যা-কা!’ মেয়েটির মুন্ডুটি ভয়ানক খেপে গেল৷ কড়া ভ্রূকুটি করে বলল, ‘যেন কিছুই জানেন না! এ কাজ তো আপনিও পারেন৷ দেখবেন?’

বলার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির ধড়টি হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল অসিতবাবুর মাথার চুল৷ তিনি কিছু বোঝার আগেই পটাং করে টেনে নামাল অসিতবাবুর মাথাটা৷ ওঁরই হাতে মাথাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিন৷ এটা আপনার মুন্ডু! এবার খুশি তো!’

অসিতবাবু দেখলেন তাঁর ধড়টা দু-হাত ছড়িয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে! গলার কাছটা কাটা!

‘ভূ-উ-ত! ভূ-উ-ত! ভূ-উ-উ-উ-ত!’

চিৎকার করতে করতেই কাটা কলাগাছের মতোন ধড়াস করে পড়ে গেলেন অসিতবাবু৷ তাঁর হাতে তখনও নিজের মুন্ডুটি ধরা!

চেঁচামেচি শুনে ‘কী হল! কী হল!’ করতে করতে দৌড়ে এলেন স্টেশনমাস্টার৷ এসে অসিতবাবুর অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ পরম মমতায় তাঁর ধড়ের সঙ্গে মুন্ডুটা জুড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কী যে করিস তোরা! এমন ভীতু মানুষটাকে ভয় দেখানোর কোনও মানে হয়!’

মেয়েটি ততক্ষণে নিজের মুন্ডুটি জুড়ে নিয়েছে, ‘ভূতের আবার ভয় কী! ও তো আমাদের মতোই একজন!’

এখানেই তো যত গণ্ডগোল৷ স্টেশনমাস্টারের অসিতবাবুর জন্য দুঃখবোধ হয়৷ লোকটা বড্ড ভুলো৷ ওঁর মনেই নেই যে আজ থেকে চারদিন আগে চলন্ত জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস ধরতে গিয়ে স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলেন রেললাইনে! ট্রেনের চাকা দু-টুকরো করে কেটে দিয়ে চলে গিয়েছিল তাঁকে৷ ওঁর মনে নেই যে, চারদিন আগেই মারা গিয়েছেন তিনি৷ শুধু মনে আছে, বাড়ির লোকেরা তাঁর প্রতীক্ষায় বসে আছে৷ সেই সংসারের মায়ায়, স্ত্রী-কন্যার টানেই প্রতিদিন তিনি চেষ্টা করেন ট্রেনটা ধরার৷ কিন্তু কোনওদিনই ট্রেন ধরা হয় না৷ আর কখনও হবে না! জীবনের ট্রেন তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে৷ তবু হার মানেন না অসিতবাবু৷ রোজ চলন্ত ট্রেনের পেছন পেছন ছোটেন! আর ব্যর্থ হন৷ আর প্রত্যেকদিন স্টেশনমাস্টার ওঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন জাদুকর সাহেবের বাড়িতে! এই বাড়িতেই সব ট্রেনে কাটা পড়া আত্মাদের বসতি৷ দুর্ভাগ্যবশত চারদিন আগে থেকেই এই বাড়ি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু সকালে উঠেই আবার আগের দিনের কথা সব ভুলে যান অসিতবাবু৷ ফের চলে যান ট্রেন ধরতে৷

স্টেশনমাস্টারের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস পড়ল৷ ওঁর আর দোষ কী! তিনি নিজেও তো দেহান্তের পর স্টেশনের মায়া ছাড়তে পারেননি৷ রোজ সকালে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকেন, আর অসিতবাবুর মতোন হতভাগ্যদের নিয়ে আসেন জাদুকর সাহেবের বাড়িতে৷ এখানে ওরা আশ্রয় পায়! মনের আনন্দে থাকে!

তিনি পরম মমতায় তাকালেন অসিতবাবুর দিকে৷ প্রাণের টান, বড় টান! সব কিছু ভুলে গেলেও সেই টানটা ভোলেননি তিনি৷ ভুলো মানুষটা আবার সেই টানেই কাল দৌড়বে ট্রেন ধরতে৷ তারপর পরশু…পরশুর পর তরশু…তারপর আবার…আবার…আবার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *