লেবেডেফের ‘কাল্পনিক সং-বদল’ : ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব
সংস্কৃতিচর্চার ফলিত ক্ষেত্রে কখনো কখনো হীরকজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, শতবার্ষিকী বা দ্বি-শতবার্ষিকীর মতো কিছু স্মরণমূলক উপলক্ষ্য দেখা দেয়, যার উপজীব্যতার মূলে খানিকটা দ্রুত বিলীয়মান হুজুগ-প্রবণতা থাকলেও, তার মধ্যে একটা দীর্ঘস্থায়ী এবং কালোচিত উপযোগিতার উপাদানও যে থাকে না তা নয়। কারণ এই উপলক্ষ্যে আমরা বর্তমানের সদাব্যস্ততার প্রহরেও অতীতকে তুলে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ পাই এবং দরকার হলে অতীতের অভিপ্রায়কে বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত লাভবান হতে পারি। এই ধরনের একটি সাম্প্রতিক উপলক্ষ্য বাংলা নাটকের দ্বি-শতবার্ষিকী। এ-বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যান নিষ্প্রয়োজন, কারণ ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই গেরাসিম লেবেডেফ১ এবং ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর এবং ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ তারিখে তাঁর বাংলা নাট্যপ্রযোজনার কথা বিলক্ষণ অবগত আছেন। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে যখন বাঙালিদের প্রধান প্রমোদমাধ্যম যাত্রা-কথকতা-পাঁচালি-কবিগান, তখন বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ ইউরোপীয় কেতায় নাট্যাভিনয় প্রযোজকের পক্ষে সম্পূর্ণ অভিনব প্রচেষ্টা এবং বাঙালি প্রমোদবিলাসীদের পক্ষে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একালের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন সংগত কারণেই নড়েচড়ে বসেছেন প্রসঙ্গটি নিয়ে নানা দিক থেকে পর্যালোচনা করার জন্য। আমরাও এ ব্যাপারে উৎসুক। তবে আমাদের ঔৎসুক্যের এলাকা খুবই সীমাবদ্ধ। নাট্যকলা, নাট্যমঞ্চ কিংবা ঔপনিবেশিক সমাজতত্ত্ব অথবা অন্যান্য আরও নানা সুযুক্তিপূর্ণ সংলগ্ন প্রসঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঢুকে পড়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য লেবেডেফের নাট্যউপকরণ যা ‘কাল্পনিক সং-বদল’২ নামে সুপরিচিত, তার ভাষারূপটি পরীক্ষা করা, তার থেকে খুঁটে নেওয়া সেইসব ভাষিক উপকরণ যা হয়তো এখন বিস্মৃত এবং সেই সঙ্গে কৌতূহলভরে পর্যবেক্ষণ করা—সেই বিদেশি প্রযোজক সেই অব্যবস্থিত যুগেও বাংলা ভাষাকে কতটা আয়ত্ত করেছিলেন এবং তাঁর সেই বাংলাচর্চার মধ্যে ভাষিক স্তরে কোনো সাংস্কৃতিক প্রত্ন-উপাদান নিহিত আছে কি না।
সকলেই জানেন, ‘কাল্পনিক সং-বদল’ নাটকের তিনটি পাঠ পাওয়া যায়। প্রথমটি ‘সংক্ষেপ ভাষাপরিবর্ত্ত কাল্পনিক সংবদল’, দ্বিতীয়টি ‘কালপোণীক এক কাবব’ এবং তৃতীয়টি ‘কাল্পনিক সংবদল খেলা’। প্রথমটি মূল নাটকের ‘সংক্ষেপ ভাষাপরিবর্ত’ অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, এটির প্রথম অভিনয় ২৭ নভেম্বর, ১৭৯৫ রজনী-তে হয়েছিল। দ্বিতীয় ২১মার্চ, ১৭৯৬ রজনী-তে অভিনীত হয়েছিল তৃতীয় পাঠের কিছু অংশ [দ্বিতীয় অঙ্কের তিনটি দৃশ্যের মধ্যে প্রথম দৃশ্য হিন্দুস্থানিতে ও তৃতীয় দৃশ্য ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছিল]। দ্বিতীয় পাঠটি নাট্যাভিনয়ের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়নি। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে দ্বিতীয় পাঠটিও লেবেডেফের প্রথম অনুবাদকর্ম, তৃতীয় পাঠটি দ্বিতীয় পাঠেরই সংশোধিত রূপ [এবং প্রথম পাঠটি তৃতীয় পাঠের সংক্ষেপিত রূপ]। আমাদের মনে হয় অধ্যাপক মামুদের সিদ্ধান্তটি সঠিক। পাঠগুলি তুলনা করলেই বোঝা যায় নাট্যাভিনয়ের প্রয়োজনেই এই সংশোধন, পরিমার্জন বা সংক্ষেপীকরণ দরকার হয়েছিল।
আগেই বলেছি, আমাদের আগ্রহের বিষয় নাট্যাভিনয়, অভিনয়কলা বা নাট্যমঞ্চাদি নয়, আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রীয় বিষয় লেবেডেফের নাট্যানুবাদটির গ্রন্থরূপ বা পুথি [text]। আমরা দেখেছি নাট্যানুবাদটির তিনটি পুথি আছে। প্রথম ও তৃতীয় পুথি মস্কোতে রক্ষিত, দ্বিতীয় পুথিটি লেনিনগ্রাদে রক্ষিত—এদের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুথিই পূর্ণতর। এজন্য আমাদের বিচার-বিশ্লেষণের জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুথিকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করছি এবং অধ্যাপক মামুদের অনুসরণে আলোচনার মধ্যে দ্বিতীয় পুথিকে লেনিনগ্রাদ-পুথি (সংক্ষেপে লে-গ্রা-পুথি) এবং তৃতীয় পুথিকে মস্কো-পুথি বলে অভিহিত করছি।
২. অধ্যাপক মামুদ দেখিয়েছেন যে, Richard Paul Jodrell-এর The Disguise নামক তিন অঙ্কের নাটকের বঙ্গীয় রূপান্তর হচ্ছে ‘কাল্পনিক সং-বদল’। একে ঠিক বঙ্গানুবাদ বলা যায় না, বরং বলা যায় বঙ্গীয়করণ, তথা ভারতীয়করণ, কারণ এখানে মূল নাটকের চরিত্রগুলি বাঙালি নাম গ্রহণ করেছে। ঘটনাস্থল Seville-এর বদলে কলকাতা এবং Madrid-এর বদলে লখনউ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নাটকের প্রচ্ছদ বা পরিচ্ছদে বঙ্গীয়করণ ঘটলেও তার ভাষারূপে কতটা সঠিকভাবে বঙ্গীয়করণ ঘটেছে অর্থাৎ অনুবাদে বাংলা ভাষার ধর্ম কতটা রক্ষিত হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আরো দু-একটি সহযোগী প্রশ্নের অঙ্কুর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে :
১. লেবেডেফ কেন অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন?
২. কাদের জন্য এই অনুবাদ?
১নং প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বাংলায় নাট্যপ্রযোজনা করবেন বলেই ইংরেজি নাটকের বঙ্গীয়করণ লেবেডেফের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ, ১৭৯৭ সাল নাগাদ লেবেডেফ যে আত্মকথনমূলক Memorandum লেখেন, তাতে দেখা যায় বঙ্গানুবাদ করার পর তিনি তা ‘Several Learned Pundits’-কে দেখান, তাঁরা অনুবাদটি ‘Perused’ ‘Several times attentively’ এবং পন্ডিতদের ‘applause’ পাওয়ার পর তাঁর ভাষাশিক্ষক গোলকনাথ দাস এটি প্রকাশ্য রঙ্গালয়ে প্রযোজনার প্রস্তাব দেন এবং লেবেডেফ প্রযোজনার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সুতরাং বাংলার নাট্যপ্রযোজনা অনুবাদের প্রাথমিক প্রেরণা নয়। তাহলে প্রাথমিক প্রেরণা কী? অর্থাৎ কেন তিনি এই অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে তখনকার দিনে ইঙ্গ-বঙ্গ সামাজিক-স্তরে যে অন্তর্বিনিময়ের ভাষা-বাজার তৈরি হয়েছিল তার খোঁজ-খবর নিতে হয়। পলাশির যুদ্ধের পর এ-দেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চালু হলে ব্যাবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন ও অন্যান্য সূত্রে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালি সমাজের একটি প্রভাবশালী অংশের সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকে। ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই পরিস্থিতিকে আরও ত্বরান্বিত ও ঘনীভূত করে। এর ফলে বাঙালিদের এই অংশের মধ্যে ইংরেজি শেখা ও উপনিবিষ্ট ইংরেজদের প্রায় সকলের মধ্যে বাংলা শেখার আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। বাঙালিদের ইংরেজি শেখাবার জন্য ১৭৯৩-এ আপজনের ভোকাবুলারি এবং ১৭৯৭-এ জন মিলারের The Tutor বা ‘শিক্ষাগুরু’ প্রকাশিত হয়।৩ অন্যদিকে ইংরেজদের বাংলা শেখার চাহিদা আরও ব্যাপকতর। এই সূত্রে হ্যালহেড, ফর্স্টার ও পরে কেরি তাঁদের ব্যাকরণ-শব্দকোষ-কথোপথনের বই লেখেন। আপজনের বইও বাংলাশিক্ষার্থী ইংরেজদের পক্ষে ব্যবহার্য ছিল। অর্থাৎ আঠারো শতকের শেষ দিকে ইংরেজদের বাংলা শেখাবার উপযোগী বই লেখার একটা বাজার তৈরি হয়েছিল, প্রথম দিকে বিদেশিরা বিশেষত ইংরেজরাই সেই বাজারের প্রধান জোগানদার ছিল। লেবেডেফ রুশদেশীয় হলেও ১৭৮৭ সালে কলকাতায় এসে ইংরেজমহলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে ইংরেজদের মধ্যে বাংলা শেখার এই ব্যাপক আগ্রহের বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন। ইংরেজদের বাংলা শেখানোর ব্যাপারে তখন যে-সব উপকরণ ব্যবহৃত হত তার মধ্যে আছে ব্যাকরণ, শব্দকোশ ও কথোপকথন বা সংলাপমালা। সংলাপমালা কথ্যভাষা আয়ত্ত করতে সাহায্য করে এবং ভাষার কথ্য অনুশীলনকেও সমৃদ্ধ করে। লেবেডেফ হয়তো এই সংলাপমালার ব্যবহারকে আরও সংগঠিত আকার দেওয়ার জন্য ইংরেজি নাটকের বঙ্গানুবাদের কথা ভেবেছেন যাতে সংলাপ বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল নয়, একটি ধারাবাহিক সরস কাহিনির ওপর স্থাপিত, ফলে এই রচনা বাংলাশিক্ষার্থী ইংরেজদের মধ্যে আরও আগ্রহের সঙ্গে গৃহীত হবে এমন একটা আশা হয়তো লেবেডেফের মনে জেগেছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভাষা শেখাবার কাজে লক্ষ্য-ভাষা (target language)-য় অনূদিত নাটক ব্যবহারের পরিকল্পনা লেবেডেফের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। রুশদেশে ফিরে যাবার পর সম্রাটের আনুকূল্যে তিনি নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপন করেন এবং মৃত্যুর কয়েক মাস আগে (৩০ ডিসেম্বর, ১৮১৬) সম্রাটের কাছে কতকগুলি বই ছাপানোর অনুমতি চান। সেই বইয়ের তালিকায় সংস্কৃত ও বাংলার ভাষাশিক্ষার উপযোগী কতকগুলি বইয়ের উল্লেখ আছে। সেইসব বইয়ের মধ্যে The Disguise নাটকের বাংলা ও রুশ অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত। এই বই তিনি ভাষাশিক্ষার সহায়ক হিসাবে উপস্থাপিত করেছিলেন। এখানে বলা দরকার, ভাষাশিক্ষার কাজে নাটকের ব্যবহার লেবেডেফের নিজস্ব পরিকল্পনা নয়। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ দেখিয়েছেন যে, লেবেডেফের অনেক আগে সপ্তদশ শতাব্দীর রুশ দেশে ভাষাশিক্ষণের উপযোগী ‘শকোলনিমে দ্রামি’ বা ‘বিদ্যায়তনিক নাট্যাভিনয়ে’র প্রচলন ছিল। এই ধরনের অভিনয়ের ধারা পঞ্চদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপেও প্রচলিত ছিল, এই ধরনের নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে ছাত্রদের লাতিন ভাষার তালিম দেওয়া হত। এই ধারা পোল্যাণ্ড হয়ে রুশ দেশে আসে। লেবেডেফ সম্ভবত এই ধারা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজমহলে বাংলা শেখার চাহিদা লক্ষ করে সেই চাহিদার জোগান দেবার জন্য The Disguise নাটকখানির অনুবাদে হাত দেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অনুবাদ তিনি কাদের জন্য করেছিলেন? ১নং প্রশ্নের উত্তরে আগের অনুচ্ছেদে যে-আলোচনা করা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, অনুবাদের প্রাথমিক লক্ষ্যদল (target group) ছিল সমসাময়িক বাংলা শিক্ষার্থী ইংরেজকুল। কিন্তু গোলোকনাথের পরামর্শে তিনি যখন নাটকটির মঞ্চাভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন, তখন খসড়া অনুবাদটির পরিবর্তন বা পরিমার্জন এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংক্ষেপীকরণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ এক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্যদল সম্প্রসারিত, প্রথম অভিনয় রজনীতে লক্ষ্যদলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ইংরেজ ছাড়াও কলকাতার বাঙালি মুৎসুদ্দি-মহাজন-ভূস্বামী শ্রেণি এবং দ্বিতীয় রজনীতে লক্ষ্যদল আরও সম্প্রসারিত—এখানে ইংরেজ ও বাঙালি ছাড়াও রাজধানী কলকাতায় বসবাসকারী ভারতের অন্য প্রদেশের ধনী মানুষ, যারা হিন্দুস্থানিতে অভ্যস্ত। অভিনয় আয়োজনের সময় তাঁর অনুবাদের লক্ষ্যও পরিবর্তিত। খসড়া-অনুবাদ অর্থাৎ লেনিনগ্রাদ-পুথি তৈরির সময় তাঁর লক্ষ্য ছিল ইংরেজদের বাংলা ভাষা শেখায় সাহায্য করা কিন্তু অভিনয়-প্রস্তুতির সময় অর্থাৎ মস্কো-পুথি দুটি রচনার সময় তাঁর অনুবাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থ-উপার্জন। তাই বঙ্গীয় (ও ভারতীয়) পটভূমিকার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য খসড়া-পাঠটির নানা সংস্কার করতে হয়েছে। হিন্দুস্থানী অনুবাদটি লুপ্ত, পাওয়া গেলে বোঝা যেত তিনি রূপান্তরে কতটা সফল এবং বাংলা রূপান্তরের সঙ্গে তার কোনো স্বাতন্ত্র্য ছিল কি না, এবং স্বাতন্ত্র্য থেকে থাকলে তার মধ্যে লেবেডেফের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রবণতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি না।
যাই হোক, আমাদের মূল প্রশ্নে ফিরে আসা যাক, অর্থাৎ লেবেডেফের অনুবাদে বাংলা ভাষার ধর্ম কতটা রক্ষিত হয়েছে? এ বিষয়ে অধ্যাপক সুকুমার সেনের বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য : ‘‘লেবেডেফ পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন কি না জানি না। তাঁহার বাঙ্গালা জ্ঞানের যে পরিচয় পাই তাহা বিদেশির পক্ষে নিন্দনীয় নহে,—এই পর্যন্ত। কথ্য ভাষার পদ, পদাংশ ও ইডিয়ম ব্যবহারে তাঁহার কিছু স্বাচ্ছন্দ্য হইয়াছিল বটে কিন্তু বাঙ্গালা ভাষার পদপ্রয়োগরীতি তিনি ধরিতে পারেন নাই’।৪ জডরেলের ইংরেজি পাঠের সঙ্গে লেবেডেফের লেনিনগ্রাদ-পুথি ও মস্কো-পুথির পাঠের তুলনা করলেই অধ্যাপক সেনের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় থাকে না। যেমন, নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের সূচনা অংশ :
১.০২. মূল ইংরেজি পাঠ :
Clara (to the Musicians): Gentlemen, enough! The lady is sensible of our attention and beckons us to depart – Adieu. (Exeunt Musicians) Well,thank heaven! I have excented one part of my design; Laura there approves my addresses to her,-happy, no doubt, to obtain a new lover :- How surprised she would be, if she knew that I am a woman!-But I’ll obey her orders and retire. (Exit Clara)
১.০২. লেনিনগ্রাদ-পুথির পাঠ :
সুখময় (বাজীয়ারদিগকে কয়) মহাসএরা—এই ভাল।—ঠাকুরানি তুস্ট হইয়াছেন সুনিয়া আর উনি বলেন আমারদিগকে জাইতে—সুভ হউক (বাজীরা গেল) ভাল ইস্বর অনুগ্রহ করুন! আমি করিয়া তুলেচী একটা বিসয় আমার মনস্তের। সসিরে মখী (=সসিমখীরে) সন্ধেহ নাস্তী আমার কথায় প্রত্তয় করিয়াচেন—কি চমৎকার তিনী হবেন। জদি উনি জানেন জে মায়্যা মানুষ!—কিন্তু আমি গমন করি।। (সুখময় গেল)
১.০৩. মস্কো-পুথি :
সুখময় (বাজিয়াদিগকে কয়) মহাসএরা! এই ভাল। ঠাকুরানি তুষ্ঠ হইয়াছেন সুনিয়া আর উনি বলেন আমার দিগকে জাইতে। সুভ হউক। (বাজিয়ারা গেল।) ভাল, ঈশ্বর অনুগ্রহ করিয়া করুন, আমি এনেছী একটি বিসয় মনস্তের। সসিমখী সন্দেহ নাস্তী আমার কথায় প্রত্তয় করিয়াছেন। কি চমৎকার তিনি হবেন জদি উনি জানেন জে আমি মায়্যা মানুষ। কিন্তু আমি প্রস্থান করি। (সুখময় গেল)
নাটকের তৃতিয় ক্রিয়া (= তৃতীয় অঙ্ক) ত্রিতিয় ব্যক্ততা (= তৃতীয় দৃশ্য)-র একটি অংশ:
২.০১. ইংরেজি পাঠ :
Clara. Not in the least, Don Lewis, have not women the same right to be inconstant as the men? Is it proper that your love should be allowed wings, whilst we are encombered with the fatigue of being unfaithful? No, Sir, I protest against such unnatural distinctions, and for my part I confess…
২.০২. লেনিনগ্রাদ-পুথির পাঠ :
সুখময়—কদাচ নয়, বাবুজী মহাশয়, স্ত্রিলোকে হয় না সেই রুপ অসতি জেমন পুরুসেরা? প্রেকত এ জে তোমার প্রিতের পাখনা থাকিবে এবং আমরা সদাই জড় হইয়ে থাকি আসার সতিত্তর বোঝায়? না মহাসয় আমি প্রেত্তয় পাই দোস দেয়নে এমন অসত ক্রিয়াতে এবং আমার অংসে আমি সিকার করি—
২.০৬. মস্কো-পুথির পাঠ :
সুখময়—কদাচ নয়, বাবুজী মহাশয়। স্ত্রিলোকে হয় না সেইরূপ অসতি। জেমন পুরুষেরা। এ প্রকত জে তোমার প্রিতের পাখনা থাকিবে এবং আমরা সদাই জড় হইয়ে থাকি আসার সতিত্তর বোঝায়? না মহাসয়! আমি প্রত্তয় পাই দোস দেয়নে এমন অসত ক্রিয়াতে এবং আমার অংসে আমি সিকার করি—
উদ্ধৃতিগুলি পরস্পর মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে অনুবাদে মোটামুটি ইংরেজি বাক্যের পদক্রমই রক্ষিত হয়েছে, ভাষান্তর বা বঙ্গীয়করণ হয়েছে শুধু ইংরেজি বাক্যের শাব্দিক উপকরণের—শব্দের বা বাক্যাংশের। এখানে লক্ষণীয়, লেনিনগ্রাদ-পুথির পাঠর সঙ্গে মস্কো-পুথির পাঠের বিশেষ তফাত না থাকলেও মস্কো-পুথির পাঠে আংশিক সংশোধনের ছাপ আছে, যেমন মূল ইংরেজি বাক্য ‘have not women the same right to be inconstant as the men’? এর অনুবাদ মূলানুগ না হলেও লেনিনগ্রাদ-পুথিতে তা মূল বাক্যের অনুসরণে প্রশ্নবোধক, কিন্তু মস্কো-পুথিতে বাক্যটি নির্দেশক।৫ এর কারণ লেনিনগ্রাদ-পুথির অনুবাদে বাক্যের গঠনগত প্রশ্নবাচকতা মূলানুগ হলেও অর্থবোধের দিক থেকে বিভ্রান্তিকর বা অনভিপ্রেত, এজন্য অভিনেয় মস্কো-পুথিতে বাক্যটিকে গঠনগত দিক থেকে নিদের্শকরূপে রক্ষার মাধ্যমে অর্থগত অস্বস্তিকরতা দূর করে বাঙালি দর্শকদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্যতা তথা বাঙালিয়ানার খাতিরে প্রাথমিক মূলানুগত্যকে পরে বর্জনের আরও নজির আছে। যেমন, তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যের শেষ দিকে :
৩.০১. ইংরেজি মূল পাঠ :
Bernardo…..to be sure I am a sneaking, snivelling creature. But one kiss more! Oh yes, with all my heart. [imitating what was said in a former scene]
৩.০২. লেনিনগ্রাদ-পুথি :
রামসন্তোষ : …এ সত্তি বটে আমি এক দুঃখে অসামর্থ দিন দিন বেক্তী,—কিন্তু এক চুম আওর ও আমার অন্তকরণে সঙ্গে।
৩.০৩. মস্কো-পুথি :
রামসন্তোষ: …বটে এ প্রকত আমি এক দুঃখে খুদ্র অসামর্থ দিন হিন বেক্তী—না আকার না প্রকার।
যাই হোক, লেবেডেফের অনুবাদের মূল সংকট মূলানুগত্যের সঙ্গে বাঙালিয়ানার সামঞ্জস্য নিয়ে। লেবেডেফ বঙ্গীয়করণ বা বাঙালিয়ানা রক্ষা করেছেন, ইংরেজি বাক্যের কাঠামোকে সামগ্রিকভাবে বাংলা বাক্যরীতির অনুগামী করে নয়, ইংরেজি শব্দ বা বাক্যাংশের বঙ্গানুবাদ বা বঙ্গীয়করণ করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভাষান্তরের এই বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ অনুবাদে লক্ষ্যভাষার সামগ্রিক বাক্যরীতির অনুসরণ না করে মূল রচনার শব্দ বা বাক্যাংশের ভাষান্তর করার প্রয়াস লেবেডেফের অন্য রচনাতেও পাওয়া যায়। তাঁর A Grammar of the Mixed Indian Dialects (১৮০১) গ্রন্থে তিনি যে হিন্দুস্থানি-ইংরেজি সংলাপমালা দিয়েছেন সেখানেও ইংরেজি সংলাপের হিন্দুস্থানি অনুবাদে ইংরেজি বাক্য-কাঠামো বজায় রেখে শব্দ বা বাক্যাংশের মাত্র ভাষান্তর করেছেন; যেমন:
৪.০০ (হিন্দুস্থানি) (ইংরেজি) ৫.০০
Ham kar-deoge toomko janpasan I will introduce you
Hamare doostloke-sat to some of my acquaintance
Jo toomara koosie Hoe If it is agreeable to you
Lorneko ea meherbangie to do me this favour,
Ham boro bas hoyoge apkopas I shall be much obliged to you.
Coad toom aoge poonaray When will you come
Hamko deknego to see me again?
Job toomara koosie Hay When will you please,
Koy wokt me ham koosie hoenge at any time I shall be glad to
Toomko deknego see you.
এখানে অনুচ্ছেদ-সজ্জার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে ডানদিকের ইংরেজি বাক্যাংশগুলি যেভাবে বিভিন্ন পঙক্তিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে, বাঁদিকের হিন্দুস্থানি অনুবাদ অংশেও বাক্যাংশগুলিকে সেই বিন্যাসক্রমে সাজানো হয়েছে। বলা বাহুল্য তাতে অনুবাদের ভাষাগত সাবলীলতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বস্তুত এই ধরনের ত্রুটি বা অসংগতি শুধু লেবেডেফের অনুবাদেই ছিল না। আঠারো শতকের শেষে বা উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলা লেখ্য গদ্যের মান্যীকরণ হবার আগে পর্যন্ত গদ্যভাষায় এই অন্বয়গত বিশৃঙ্খলা অন্যের লেখাতেও ছিল, বিশেষত যাঁরা ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন তাঁদের অনুবাদেও এই বিশৃঙ্খলা সুপরিস্ফুট। আঠারো শতকের শেষ দিকের আদালতি code-এর বঙ্গানুবাদ কিংবা কেরির বাইবেলের অনুবাদ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যাই হোক, লেবেডেফের নিজের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন দেখা দেয়: তাঁর অনুবাদের ভাষা তো পরোক্ষ ও নিষ্ক্রিয় কেতাবি গদ্য নয়, অভিনয়সূত্রে তার একটা প্রায়োগিক প্রত্যক্ষতার সক্রিয় দিক আছে। এই রকম গদ্যসংলাপ যখন বাংলা বাক্যরীতির অনুগামী নয় তখন যেসব বাঙালি অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের দিয়ে তিনি নাটকটি নামিয়েছিলেন তাঁদের মহড়ার সময় সংলাপ-উচ্চারণে কোনো অসুবিধা হয়েছিল কি? দর্শকরাই-বা এই ধরনের বিসদৃশ সংলাপ কীভাবে নিয়েছিল? এ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কাজেই অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়। বাংলা নাটকের অভিনয় সম্পর্কে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার কথা কিছু জানা না গেলেও দ্বিতীয় রজনীতে অভিনীত হিন্দুস্থানি অংশ সম্পর্কে ‘হিন্দুস্থানি ভাষায় শিক্ষক ও অনুবাদকগণ’ লেবেডেফের ওপর যে ‘ক্রুদ্ধ’ হয়েছিলেন তা তিনি স্বয়ং লণ্ডনের রুশ দূতাবাসের গির্জায় কর্মরত পাদ্রি আফানাসেভিচ সামবরস্কিকে ৮মে ১৭৯৭ তারিখে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন।৬ লেবেডেফ তাঁর চিঠিতে এই ক্রোধের কারণ ব্যাখ্যা করেননি। অধ্যাপক মামুদ অনুমান করেছেন যে অভিনয়ে মেয়েদের নামানোর জন্যই রক্ষণশীল হিন্দুস্থানি শিক্ষকেরা অসন্তুষ্ট হন। আমাদের মনে হয়, সামাজিক কারণের বদলে ভাষাতাত্ত্বিক কারণই হিন্দুস্থানি শিক্ষক ও অনুবাদকদের ক্ষোভের কারণ। কারণ, রক্ষণশীলতার যুক্তি প্রধান হলে তাঁরা গোড়া থেকেই এই কাজ থেকে দূরে থাকতেন। নাটকের হিন্দুস্থানি পাঠটি পাওয়া যায়নি। তবে মনে হয়, হিন্দুস্থানি অংশেও লেবেডেফ বাংলা অংশের মতো শাব্দিক উপাদানের যান্ত্রিক ভাষান্তর করেছেন, বাক্য-কাঠামোর প্রত্যাশিত পরিবর্তন করেননি। সাবলীলতার অভাব ও আড়ষ্টতায় ভাষার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, হিন্দুস্থানি ভাষাশিক্ষকেরা সম্ভবত তাতেই ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। বাঙালি ভাষাশিক্ষকদের মধ্যে গোলোকনাথ তাঁর প্রধান সহযোগী, সুতরাং তাঁর দিক থেকে অসন্তোষের প্রশ্নই নেই। যেসব পন্ডিতকে তিনি বঙ্গানুবাদটি দেখতে দিয়েছিলেন, তাঁরা কোন কোন বাক্যকে ‘most pleasing’ মনে করতেন তা লেবেডেফ লক্ষ্য করতেন—এ থেকে মনে হয় অনুবাদের সমস্ত অংশই পন্ডিতদের কাছে সমান ‘pleasing’ ছিল না। সম্ভবত স্বাভাবিক সৌজন্য কিংবা নিটোল সাহেব-ভক্তির কারণে তাঁরা অ-‘pleasing’ অংশ সম্পর্কে আপত্তি তোলেননি। হয়তো অসুবিধা হয়েছিল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে, বিশেষত মহড়ার সময়। পাদ্রি সামবরস্কিকে লেখা পূর্বোক্ত চিঠিতে লেবেডেফ তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন : ‘আমার বহুবিধ পরিশ্রমের মধ্যেও আমি নিরুৎসাহী, ভন্ড ও বন্যপ্রকৃতির-বাঙালিদের হাস্যরসাত্মক অভিনয় শিক্ষা দিয়াছি : তিনজন মহিলা ও দশজন পুরুষকে’। এই অসুবিধা নিশ্চয়ই শুধু গান-বাজনা শেখা ও অভিনয়কলা নিয়ে ঘটেনি, সংলাপ আয়ত্ত করা নিয়েও ঘটেছিল। কারণ সংলাপ লেখা উৎকট অ-স্বাভাবিক বাংলায়, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা স্বাভাবিক বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত। তাদের হয়তো লেবেডেফ সংলাপের কৃত্রিম গদ্যই মুখস্থ করিয়েছিলেন, সেইজন্যই অসুবিধার মাত্রাবৃদ্ধি হয়েছিল। মহড়া দিতে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাই তাঁর মনে হয়েছিল ‘নিরুৎসাহী’ ও ‘বন্য’। এ-জন্য তাদের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে তৈরি করতে গিয়ে তাঁকে ‘বহুবিধ পরিশ্রম’ করতে হয়েছিল। বাঙালি দর্শকদের দিক থেকে আপত্তি না উঠলেও বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ দর্শকরা ছিল বাঙালি সমাজের একটা বিশেষ ছোটো অংশ, যাদের সঙ্গে সাহেবদের ওঠা-বসা বেশি এবং যারা এই ধরনের কৃত্রিম সাহেবি বাংলায় অভ্যস্ত। তাছাড়া, তারা তো থিয়েটারের নামে নতুন ধরনের মজা উপভোগ করতে গিয়েছে। ভাষার আড়ষ্টতা বা বিদেশিয়ানাকে এই নতুন মজার অঙ্গ হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি কী? তারা তো বাংলা ভাষার অভিভাবক নয়, তারা প্রভূত কাঁচা-পয়সার জোরে নিত্যনতুন ফুর্তির সন্ধানী! সুতরাং ভাষা বা অভিনয়-আঙ্গিকে বিসদৃশ উপাদান থাকলেও হল-ছাপিয়ে বিপুল ভিড় হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়।
যাই হোক, ‘কাল্পনিক সং-বদল’ প্রসঙ্গে এইটুকু বললেই লেবেডেফের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্পন্ন হয় না। আমরা দেখেছি, বাক্যগঠনের দিক থেকে অসংগতি থাকলেও শব্দ বা বাক্যাংশের ভাষান্তরে লেবেডেফ বিশেষ মনোযোগী ছিলেন এবং দেশীয় পন্ডিতদের ‘applause’ হয়তো তাঁর এই নৈপুণ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই। কাজেই লেবেডেফের ভাষাগত বঙ্গীয়করণের মূল্য নির্ধারণ করতে হলে এইসব শাব্দিক উপকরণের আন্তর্ভাষিক সম্পর্ক বা রূপান্তরের বিশ্লেষণ করা দরকার।
৩. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে লেনিনগ্রাদ-পুথি ও মস্কো-পুথি থেকে যেসব উদ্ধৃতি (১.০১—১.০৩, ২.০১—২.০৩ এবং ৩.০১—৩.০৩) সংকলিত হয়েছে তা থেকে লেবেডেফের ভাষাগত বঙ্গীয়করণের বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করা যায়। এই বঙ্গীয়করণে তাঁর প্রধান অসংগতি বাক্যকাঠামোর ক্ষেত্রে, তবে শাব্দিক উপাদানের ক্ষেত্রেও তিনি পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ নন। অসুবিধা হয়েছে সেইসব জায়গায় যেখানে তিনি উপযুক্ত চালু প্রতিশব্দ দিতে পারেননি। যেমন:
৫.০১ I don’t belive, there is such a place for love in the whole world. One makes love and one finds love made in every corner—and then, they have got such a cursed way of doing everything in disguise, that there is no knowing who it is that you love, or who loves you. [Act I, Scene I]
৫.০২ লেনিনগ্রাদ-পুথি :
আমি বুঝি না জে এমন সহর কোথায় আচে প্রিতের কারণ প্রিথীবির মধ্যে এবং এমন চেনালির রাহা পায় করিতে অনেক বিসয় সংএর দ্বারায় জে জানা জায় না কে সেজাকে ভালবাস তুমি আর কেবা ভালবাসে তোমাকে।
৫.০৩ মস্কো-পুথি :
আমি বুঝি না জে এমন সহর কোথায় আছে প্রিতের কারণ প্রিথিবির মদ্ধে এবং উহারা ছেনাশিসবাহা পায় করিতে অনেক বিসয় সংএর দ্বারায় জে জানা যায় না কে সেজাকে ভালবাস তুমি আর কে বা ভালবাসে তোমাকে।
লক্ষণীয়, ‘they have got such a cursed way of doing everything in disguise’—এই বাক্যের ‘cursed way’ বাক্যাংশটির উপযুক্ত ভাষান্তর না পাওয়ায় অনুবাদ কোথাও হাস্যকর, কোথাও দুবোধ্য হয়েছে। এই রকম উদাহরণ আরও দেওয়া যেতে পারে। তবে নেতিবাচক উদাহরণের চেয়ে ইতিবাচক উদাহরণ অর্থাৎ যেখানে তাঁর ভাষান্তর স্বচ্ছন্দ ও বাঙালিয়ানার অনুকূল সেইসব উদাহরণের অনুপাতই মোটের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ। এইসব উদাহরণ বিশ্লেষণ করাই আমাদের পক্ষে লাভজনক, কারণ তাতে আমরা শুধু লেবেডেফের সাফল্যের দিকটিই খুঁজে পাব না, খুঁজে পাব বাংলা ভাষার এমন সব প্রত্ন-উপাদান যা হয়তো পরবর্তী দুই শতকের গদ্যচর্চার বহুমুখী বৈচিত্র্যের মধ্যে লুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। [একাজে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে তৎকালীন কিছু বাংলা-ইংরেজি শব্দকোশ/অভিধান। বিশেষত আপজনের Extensive Vocabulary (১৭৯৩) এবং ফরস্টারের Vocabulary (১৭৯৯-১৮০২) এ প্রসঙ্গে খুবই জরুরি। কিন্তু বইদুটির দুষ্প্রাপ্যতার জন্য এখানে শুধু কেরির বাংলা-ইংরেজি অভিধান (১৮১৫)-এর সাহায্য নেওয়া হল।]
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক :
৬.০১ Bemardo :
Yet my sweet invisible Goddess! It is your poor miserable Bemardo—who is dying—that is to say—who wants to die at your sweet, sweet, little feet.
৬.০২ লেনিনগ্রাদ-পুথি :
রামসন্তোষ—হাঁ আমার সোনার চাঁদ অদিস্বী ঠাকুরাণি।….এ তোমার গরিব দিন দাস রামসন্তোষ—যে মরিতে চায়—তা বলি সুন—যে মরিতে চায় তোমার পাদপদ্দে।
৬.০৩ মস্কো-পুথি :
রামসন্তোষ—হাঁ আমার সোনার চাঁদ অদিস্বী ঠাকুরাণি। এ তোমার গরিব দিন দাস রামসন্তোষ—যে মরিতেছে—তা বলি সুন—যে মরিতে চায় তোমার পাদপদ্মে।
৭.০১ No, my sweet one.
৭.০২-৩ লেনিনগ্রাদ-পুথি ও মস্কো পুথি :
না সোনামণিটী।
৮.০১ Bemardo :
[affecting a smile] Yes, yes, I can smile now as engagingly as anybody.
[এই সংলাপের আগে বক্তা কিছু টাকা বকশিস পেয়েছে]
৮.০২ লেনিনগ্রাদ-পুথি :
রামসন্তোষ [ ইসত হাস্য করিলেন ] হাঁ হাঁ—আমি হাসিতে পারি এখন সুখেতে ডুবু ডুবু।
৮.০৩ মস্কো-পুথি :
রামসন্তোষ [ ইসত হাস্য করিলেন ] হঁ হঁ আমি হাসিতে পারি এখন সুখেতে ডুবুডুবু।
৯.০১ Bemardo :
[rising] And is it she? Have I then reached the extremity of my toils, after all that I have endured; scorching heat and cold worse than an ague? Darling woman! Girli of my affection! belold a Spanish Grandee prostrate at your foot there [kneeling again]
[Act III, Sc.I]
৯.০২ লেনিনগ্রাদ-পুথি :
রামসন্তোষ [দাঁড়ায়]—এ কি তিনি? তবে বুঝী আমার সাধনের ফল পেল্যাম, এত জে আমি সজ্জি করে করে দারুণ গ্রীষ্ম বিষম সিত পিলই জরের প্রাণেশ্বরি। আমার মিছরির ছুরি। এই দেখ তোমার মহাবল পরাক্রম রাজপত পদানত পড়ে আছে—এও! [পনুশ্চ হাটু গেড়্যা বসে]
৯.০৩ মস্কো-পুথি :
লে-গ্রা-পুথির অনুরূপ, শুধু ‘এত জে আমি সজ্জি…..’-র বদলে ‘এত আমি সজ্জী করে’, ‘রাজপত’-এর বদলে ‘রাজপুত’ ব্যবহৃত এবং বাক্যের অন্তিম ‘এও’ বর্জিত।
১০.০১ Bemardo :
Seven whole days have I suffered for your dear sake; damp beds defied, rivals subdued and bugs encountered.
১০.০২ লে-গ্রা-পুথি :
রামসন্তোষ—সাত দিবস সমদয় আমি স্মতা করেচি তোমার নিমিখে প্রানধন; শিশিরে সজ্জে সজ্জি করেচী প্রতিবাদী সকল্যকেই বিজই করেচী, চারপোকা সকলের সঙ্গে জুদ্ধ করেচী।
১০.০৩ মস্কো পুথি :
রামসন্তোষ—সাত দিবস সুমদয় আমি সষ্ণতা [ =সহিষ্ণুতা ] করেছি তোমার নিমিখে প্রানধন, শিশিরে সজ্জে সর্জ্জী করেছি, প্রতিবাদী সকলরে বিজই করেচী ছারপোক সকলের সঙ্গে জুদ্ধ করেচী।
১১.০১ Bemardo :
Yes, moss-rose, for you, I have followed you long and often, in the hopes of at length moving that flinty, obdurate heart.
১১.০২ লে-গ্রা-পুথি :
হাঁ সুধামখী, তোমার কারণ আমি তোমার পিচেল এচী অনেক দিবস এবং ক্রমে এই ভরসাতে জে কতদিনে নরম করিব ঐ বন্দুকের মত পাথরের অন্তঃকরণ।
১১.০৩ মস্কো-পুথি :
হঁ আমার সুধামখী! তোমার কারণ, তোমার জন্তে; আমি তোমার পিছে লএছী অনেক দিবস এবং ক্রমে এই ভরসাতে জে কতদিনে নরম করিব ঐ বন্দুকের পাথরের মত অন্তঃকরণ।
১২.০১ Bemardo :
O yes; the quintessence of perfection, with her dear little feet…Come, one peep at that sweet invisible face—fie, fie, Bemardo.
১২.০২ লে-গ্রা-পুথি :
হাঁ—গোলাব আত্তর পরম সুন্দরি। কিবা তাহার খুদ্র চরণকমল দুইখানি—আইস দেখসিয়া এক কটাক্ষ সেই অদিস্বী চন্দ্রমখে চী চী রামসন্তোষ।
১২.০৩ মস্কো-পুথি :
হঁ [বাকি অংশ লে-গ্রা-পুথির অনুরূপ]
১৩.০১ Beatrix :
So you fancy that I did not know you, puppy?
১৩.০২ লে-গ্রা-পুথি :
ভাগ্যবতি—তবে তুমি এই বুঝ যে আমি জানি না তোমায় ছুচ?
১৩.০৩ মস্কো-পুথি :
লে-গ্রা-পুথির অনুরূপ, শুধু শেষ শব্দ ‘ছুচ’-র বদলে ছুঁচ [=ছুঁচো]।
১৪.০১ Bemardo :
Damn it then, I am a man again. Huzza, God save the King! huzza!
১৪.০২ লে-গ্রা-পুথি :
রামসন্তোষ—মরুক গিয়া চাতুরি সকল্য, আমি পুনশ্চ মানুস হইলাম—হরি
বোল্য ভগমান ভূপতির ভাল করুন।
১৪.০৩ মস্কো-পুথি :
মরুক গিয়া তবে চাতুরি সকল। হউক বলে তবে। আমি পুনশ্চ মানুস হইলাম। হরিবোল। ভগমান ভূপতির ভাল করুন।
উপরের উদাহরণগুলিতে বক্রাক্ষরে মুদ্রিত ইংরেজি শব্দ বা বাক্যাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুবাদের স্থূলাক্ষরে মুদ্রিত অংশের তুলনা করলেই বোঝা যায় লেবেডেফ ইংরেজি বাক্যাংশকে কতখানি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে প্রচলিত বাংলা বাগবিধি ও লৌকিক বাগভঙ্গির কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন।
পরিশেষে আর একটি প্রসঙ্গ। তা হল লেবেডেফের অনুবাদে ব্যবহৃত কতকগুলো অপ্রচলিত শব্দ। অনুমান করি এই সব শব্দ পরবর্তী দুশো বছরে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু লেবেডেফের সময় বাংলা ভাষায়, অন্তত কথ্য বাংলায় প্রচলিত ছিল। কারণ, কেরির অভিধানে শব্দগুলি পাওয়া যায়, কেরি তো সমসাময়িক সাধু শব্দ ছাড়াও অনেক চলতি কথ্য শব্দও তাঁর অভিধানে স্থান দিয়েছিলেন। এই শব্দগুলির চর্চা করলে অন্ত্যমধ্য বাংলার শব্দ ভান্ডারের একটি দিক উন্মোচিত হয়। এই উদ্দেশ্যে এখানে এই ধরনের কিছু শব্দ বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হল, পাশে দেওয়া হল কেরির অভিধান থেকে তার প্রাসঙ্গিক ইংরেজি অর্থ :
অব্যাজে : Immediately, without delay.
অসংগত < অসঙ্গ : Solitary, alone.
আড়ি : A quarrel.
আস্বা : This also is an interjection expressive of recollection, anger, pain, menace or affliction.
উচক্রা : drains, headlong, mischievous, bold, impudent, insolent.
উচস্কা, উচকা : unruly, headstrong, mischievous, bold, impudent, insolent.
গদ্দি : A jest, a repartee, a launt.
গরজ : Desires.
গরিব : Humblle.
ঘড়ী : An hour.
চটকানা : A slap with the flat handle.
চমৎকার : Surprise, astonishment, amazement.
ছেঁউড়্যা : An orphan.
ধ্রুব : Certainly.
নষ্ট [করিয়াছে] : This word constructed with, কৃ to do, signifies to spoil, to ruin, to destroy, to debauch, to deflower, to taint.
নিষ্ঠা : Certainty.
পাতি : A letter, a writing, a note.
প্রত্তয় < প্রত্যয় : ১. faith, belief, credit paid to a thing said, confidence. ২. Satisfaction.
ভক্তবিটুল < ভক্তবিটল : Hypocritical.
ভেড়া : Stupid fellow.
মর্জাদা < মর্যাদা : rectitude.
রাড় < রাঢ় : Uncivilized
লোচ্চা : Lascivious, wanton, libertine.
সড়সড় : An imitative sound used to express a tingling or itching sensation.
সমিভ্যার: < সমভিব্যাহার : A society, the company of person.
সালিষ : A third person.
সুতরাং ‘কাল্পনিক সং-বদল’ শুধু নাট্যসমালোচকদেরই আগ্রহের বিষয় নয়, এই বই বাংলা ভাষার ঐতিহাসিকদের কাছেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রসদ-ভান্ডার।
__________________________________________________
১. অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ তাঁর ‘গেরাসিম স্তেপানভিচ লিয়েবেদেফ’ [বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৮৫] নামক মূল্যবান বইতে লেবেডেফের যথার্থ উচ্চারণ-অনুগ বানানটি নির্দেশ করে নিজেও ব্যবহার করেছেন। এই সংশোধন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। তবে বাঙালি সমাজে আলোচ্য নাট্যকারের নামের বানানের একটি লোকায়ত পাঠ দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে [নাটকের প্রথম অভিনয়-রজনীর প্রচারপত্রেও ‘লেবেডেব’ বানানটি দেখা যায়]। দুরপনেয় অভ্যাসের বশে এই প্রবন্ধে এই লোকায়ত বানানটিই রক্ষিত হল। প্রয়োজন হলে সংশোধিত বানান ব্যবহার করতেও বর্তমান লেখকের আপত্তি নেই।
২. ‘সং-বদল’ একটি জোড়া-শব্দ বা সমাসবদ্ধ পদ: সংয়ের [= সঙের] বদল। অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুকুমার সেন শব্দটিকে এইভাবেই নিষ্পন্ন করেছেন। ‘সং’ যে এখানে উপসর্গ নয়, একটা পৃথক শব্দ [সং = ছদ্মবেশ, disguise] তা বোঝাবার জন্য, মূলে না থাকলেও, এই প্রবন্ধে শব্দটিকে হাইফেন-বদ্ধ করে দেখানো হল।
৩. রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায়।
৪. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস [২য় খন্ড]—ড. সুকুমার সেন। [৭ম সংস্করণ, ১৩৮৬] : পৃ. ৪২।
৫. A Grammar of the Pure and Mixed East Indian Dialects—Herasim Lebedeff, London, 1801, পৃ. 98
৬. অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে রুশ ভাষায় লেখা এই দীর্ঘ চিঠিটির বঙ্গানুবাদ করে দিয়েছেন [দ্রষ্টব্য: পৃ. ১০৪-১১৭]।