লেপ
বিনয় বিয়ে করে তিনটে বাঁশ পেয়েছে। একটা জ্যান্ত। সেটি হল তার বউ। অন্য দুটি হল ঘড়ি আর লেপ। আমার কথা নয়। স্বয়ং বিনয়ের স্বীকারোক্তি। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর বিনয় চুপচাপ ছিল। না খুশি, না অখুশি, একটা তূরীয় অবস্থা। যত দিন যাচ্ছে বিনয় নীরব থেকে সরব হয়ে এখন রবরবা। কথায় কথায় সংসারের কথা আসবেই। শুরু হবে বউকে দিয়ে। বউ থেকে সেই ভদ্রমহিলার জন্মদাতায়। সেখান থেকে ঘড়ি, ঘড়ি থেকে লেপ। ঘড়িটাকে বিদায় করেছে। কব্জির কাছে ব্যান্ডের সাদামতো গোল দাগ এখনও রং ধরে মিলিয়ে আসেনি। মেলাবার মুখে। বউ চিরকালের জিনিস। ঘাড় থেকে নামাবার উপায় নেই, ডিয়ার্ডিয়া অ্যামিবায়োসিসের মত ক্রনিক কেস। সারাজীবন ভোগাবে। আর লেপ। শীতে নামাতেই হবে। নামালেই দু-জনে গায়ে দেবে। এবং পরের দিন সকালে আমাদের সেই লেপকেচ্ছা শুনতেই হবে।
বিবাহ মানেই একটি বউ এবং মনোরম একটি বিছানা। বিছানা ছাড়া ফুলশয্যা হবে কী করে! বিনয় শীতকালে বিয়ে করেছিল বলে একটি লেপও পেয়েছিল। ডবল মাপ। দুটি প্রাণীর শীতের আশ্রয়। লাল শালুর খোলে শিমুল তুলো। এর মধ্যে সমস্যার কী আছে সরল বুদ্ধিতে বুঝে ওঠা শক্ত। কিন্তু সমস্যা অনেক।
প্রেম যখন ঘনীভূত ছিল তখন সমস্যা ছিল না। আলো নিবিয়ে লেপের তলায় ঢুকে দু-জনে জড়াজড়ি করে ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই’ গোছের ব্যাপার। এখন একদিন পরে অপ্রেমে সেই ‘কমন’ লেপকে গালাগাল দিলে আমরা শুনব কেন? তবু শুনতে হয়। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া হলে সম্পত্তি ভাগাভাগি হতে পারে, কিন্তু কথায় কথায় একটা আস্ত লেপকে তো দু-টুকরো করা যায় না। কাপড়ও নয় যে জোড়া কেটে দুটো করবে। বউ আর লেপ অবিচ্ছেদ্য। দাম্পত্য প্রেম আবার অবিচ্ছেদ্য নয়। সেখানে জোয়ার ভাঁটা খেলে। এই হলায় গলায়, এই চুলোচুলি। তেঁতুল যত পুরোনো হয় ততই টক বাড়ে। লেপের ঝগড়া, ঝগড়ার লেপ। লেপের দুই মূর্তি। বউয়ের মতোই। এই মনোরম, পরমুহূর্তেই বিস্ময়। সামলানো দায়।
প্রেমে মানুষ ত্যাগী হয়। বিনয় যখন প্রেমিক ছিল (বছর খানেক মাত্র) তখন শীতে বউকে লেপের তিনের চার অংশ ছেড়ে দিয়ে নিজে একের চার অংশে হিহি করত। ছেড়ে দিত বললে ভুল হবে। বউ কেড়ে নিত। প্রথম রাতে লেপের তলায় দু-টি মানুষ হলেও প্রেমে তালগোল পাকিয়ে একাকার। তখন আর সমস্যা কী? সমস্যা মাঝরাতে। বিনয়ের আদরে আদুরী বউ উঁমুমু করে পাশ ফিরলেন, লেপের তিনের চার অংশ তার সঙ্গে চলে গেল। বিনয়ের শরীরের আধখানা খোলা, উদোম পড়ে রইল পৌষের শীতে শীতল সাদা চাদরে। পা দুটোকে জড়ো করে স্ত্রীর জোড়া ঠ্যাঙে গুঁজে গরম করতে গেলেই ঘুমের ঘোরে খ্যাঁক করে ওঠে, হচ্ছে কী? এবার ঘুমোও। লেপের বাইরে হায়নার মতো মাঝরাতের গাছ-গাছালির শিশির-মাখা শীত হামা দিচ্ছে। বিনয় কুকুরকুন্ডলী হয়ে পশ্চাদ্দেশটিকে লেপের অংশে ঠেলে দিয়ে ভাবতে থাকে—ঘুমাও, হ্যাঁ এখন ঘুমাও কবি, রাতের কবিতা শেষ। জীবনটা যেন রঙমহলের অভিনয়। প্রেমের নাটকে যবনিকা পড়ে গেছে। নায়িকা পাশ ফিরে লেপের আরামে শুয়ে নায়ককে বলছে, দৃশ্য শেষ মনের মেকআপ তুলে ফেলেছি। তখন তোমাকে সহ্য করেছি, কারণ করতেই হবে। তোমাকে বিশেষ অঙ্কের বিশেষ দৃশ্যে সহ্য করাই আমার জীবিকা। আমার জীবনের দুটো দিক, একটা অভিনয়ের দিক আর একটা নিজস্ব দিক। শীতের নির্জনতায় মানুষের মনে স্যাতসেঁতে চিন্তাই আসে। মনমরা চিন্তা সব হিলহিল করে ওঠে। পায়ের পাতা দুটোই বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ওই জন্যেই বলে শীত করে। করে মানে, হাতে। শীত পায়। পায় মানে পায়ে, পদে। পা দুটো আশ্রয় খুঁজেছিল। পদাঘাতে ফিরিয়ে দিলে। একটা হাত বুকের উষ্ণতায় গরম হতে চেয়েছিল, খুব বিরক্ত হয়ে বললে, মাঝরাতে কী ইয়ার্কি হচ্ছে! সাবাশ বেটা। ঘুমোলে মানুষের মনের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। বউ বলে আমিই এক বুরবাক, হেদিয়ে মরি, আসলে তুমি শ্বশুরমশাইয়ের কন্যা। পাকা বাঁশ কি সহজে নোয় রে বাবা!
সামান্য লেপ থেকে বিনয়ের অভিমান বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় উঠল যেখানে বিনয় যৌবনে যোগিনী। কার বউ? কীসের সংসার? বউও শ্বশুরমশাইয়ের লেপটাও তাঁর। যাও তোমার লেপ তুমিই নিয়ে শুয়ে থাক। বিনয়ের শুধরে দেবার কেউ নেই। শ্বশুরমশাইয়ের বউ কী রে? ওই হল আর কী।
ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলে লেপ সরে যেতেই পারে, তা নিয়ে অত মান-অভিমানের কি আছে বাপ। তুমিও টেনে নাও না। এ তো পাক-ভারত লড়াই নয় যে বাউন্ডারি কমিশন বসিয়ে সীমানা ঠিক করে দিতে হবে। বিনয় বললে, বউকে নিজের মনে করতে পারলে সে অধিকার অবশ্যই খাটাতুম।
এ আবার কী কথা! বউ নিজের নয় তো কি পরের?
বিনয়ের উত্তর শুনে ঠাণ্ডা মেরে যেতে হয়। চব্বিশ ঘণ্টায় এক দিন। চব্বিশ ঘণ্টায় দশ ঘণ্টা নিদ্রা। বাকি রইল চৌদ্দো ঘণ্টা। চৌদ্দ ঘণ্টার চার ঘণ্টা চান, খাওয়া, এটা ওটা। বাকি দশ ঘণ্টার সবটাই বিনয়ের খরচ করতে হয় জীবিকার সংগ্রামে। খুব ভালো হিসেব। তাহলে বউয়ের সঙ্গে এত ঠোকাঠুকি, মান অভিমানের সময় আসে কোথা থেকে। তুমি শ্রীকৃষ্ণ নও, তোমার বউ রাধিকা ঠাকরুণও নন যে সারাদিন কদমতলায় বসে মানভঞ্জন পালা গাইবে। আধুনিক মানুষ তুমি খাবে-দাবে, ছোটাছুটি করবে, কেরিয়ার গুছোবে, তা না দিবারাত্র বউ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান, লেপ নিয়ে লাঠালাঠি। এইসব পানসে সমস্যা আমরা শুনতে চাই না। পৃথিবীতে অনেক বড়ো বড়ো সমস্যা আছে যা নিয়ে মাথা ঘামালে দেশের উপকার হবে।
বিনয় তখনকার মতো চুপ করলেও আবার সরব হয়ে ওঠে। লেপের যে এত মহিমা কে জানত। বিনয় ক্রমশ দার্শনিক হয়ে উঠছে। বিনয়ের মতে, বউ পরের ঘর থেকে আসে আসুক, তার সঙ্গে খাট, বিছানা, বালিশ আর সাটিনে মোড়া একটি লেপ যেন না আসে। খাল কেটে কুমির এনেছ এই যথেষ্ট, সেই সামলাতেই তোমার হাড়ে দুব্বো গজাবে, সঙ্গে আর কয়েকটা ফালতু লেজুড় এনে ন্যাজে গোবরে হওয়াটা ডবল মুখ্যুমি। পরের সোনা দিও না কানে, কান যাবে তোমার হ্যাঁচকা টানে। হীনমন্যতায় ভুগবে। একই কক্ষপথে দুটো গ্রহ যদি বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে, তাহলে প্রথমেই যা হবে তা হল দমাস করে একটি সংঘর্ষ। তারপর দুটোতে গায়ে গা লাগিয়ে ঠেলাঠেলি। তারপর যার শক্তি বেশি সে-ই ঘোরাতে থাকবে নাকে দড়ি দিয়ে চোখবাঁধা কলুর বলদের মতো। সংসারে স্ত্রী জাতিই প্রবলা। প্রবলা হবার কারণ পুরুষ জাতির দুর্বলতা। আমার মানু, মানু আমার করে ফার্স্ট ইয়ারে যে সোহাগ করেছিলে সেই সোহাগের পথে তোমার পার্সোনালিটি লিক করে বেরিয়ে গেছে। ফলে সেকেণ্ড ইয়ার থেকেই তুমি কৃতদাস। ট্যাঁকে নবজাতক, ঘাড়ে সিংহজাতক।
সিংহজাতক মানে?
শ্বশুরমশাইয়ের নাম নরেন সিংহ। এটা ট্যাঁ করে তো ওটা গর্জন করে। দু-জনেরই সমান সমান বায়না। বায়না না মিটলেই এর ক্রন্দন, ওর আস্ফালন, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ, আমার ধোপা নাপিত বন্ধ। পিরিতের তাসের ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। প্রেম যে কত ঠুনকো তা বিয়ে না করলে বোঝে কার বাপের সাধ্য।
প্রেম ঠুনকো হোক ক্ষতি নেই। তুমিও প্রেমের বয়স পেরিয়ে এসেছ। এখন তুমি পিতা এবং স্বামী। সেই ভাবে বুঝে-সুজে গুছিয়ে-গাছিয়ে সংসার করে যাও। ঘ্যানর ঘ্যানর করে লাভ কী? শাস্ত্র বলছে, ‘দাম্পত্য কলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।’ এই ভাব, এই ঝগড়া। সংসারে জীবন-নৌকো চলবে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে। উঠবে পড়বে। পড়বে উঠবে।
উপদেশ দেওয়া সহজ। পড়তে আমার মতো অবস্থায়, ঠ্যালার নাম বাবাজীবন। শুনবে কী জিনিস! তখনও গা থেকে গায়ে-হুলুদের রং ওঠেনি, পাওনা শাড়ির মাড় ওঠেনি, লেপের তলা থেকে বলে উঠলেন, বাবা একটা লেপ দিয়েছে বটে, পালকের মতো হালকা, উনুনের মতো গরম। নজর দেখেছ? আমি বললুম, ও তোমার যৌবনের উত্তাপ। তায় আবার পান খেয়েছ কাঁচা সুপুরি দিয়ে। লেপের আবার ভালো-মন্দ কী! সেই এক সালু কী সাটিন, ভেতরে তুলো। সব লেপেই যা থাকে এর মধ্যেও সেই একই মাল। সিংহকন্যা গর্জন করে উঠলেন, রাখো! বরের লেপে শ্মশানের তুলো ভরে দেয়, বুঝলে চাঁদু?
শ্মশানের তুলো? সে আবার কি।
কি জানো তুমি? শ্মশানের যত মড়া আসে তাদের বিছানা ছিঁড়ে তুলো বের করে তুলোপট্টিতে জলের দরে বিক্রি হয়। সেই তুলো দিয়ে তৈরি হয় ফুলশয্যার লেপ। এ জিনিস সে জিনিস নয়। এ হল এক নম্বর মাল। আগুন ছুটছে।
আমি থাকতে না পেরে বলে ফেললুম, তোমার পিতাঠাকুর কি চৈত্র মাসে শিমুল গাছের তলায় গিয়ে হাঁ করে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়েছিলেন? পাকা তুলো ফাটছে আর তিনি লাফিয়ে লাফিয়ে ধরছেন, খোলে পুরছেন। আহা, এ মণিহার আমার নাহি…। ব্যস, সঙ্গেসঙ্গে কথা বন্ধ। ফ্যাঁসোর ফোঁসোর। তুমি আমার বাবাকে শিমুলতলায় দাঁড় করালে এরপর কোন দিন বাবলাগাছে চড়াবে। অনেক সাধ্যসাধনা করে শেষে রাত তিনটের সময় দেহি পদপল্লবমুদারম আওড়াতে আওড়াতে স্বামীর অধিকার সাব্যস্ত হয়। ভোরবেলা শুকনো মুখে, বসা চোখে কাকের ডাক শুনতে শুনতে মনে মনে বললুম, ইহা লেপ নহে, যিশুখ্রিস্টের মৃতদেহের সেই আচ্ছাদন।
শ্বশুরবাড়ির জিনিস সম্পর্কে সব মেয়েরই ওইরকমের এক ধরনের দুর্বলতা থাকে। বউ বস্তুটিকে ব্যবহার করার কায়দা আছে ভাই। মোলায়েম হাতের ময়দা ডলার মতো ময়ান দিয়ে মাখতে হয়, তবেই না খাসা মুচমুচে লুচি।
তা হলে শোন। সেই লেপপর্ব কোথাকার জলকে কোথায় নিয়ে গেছে। লেপের তলায় ঢুকে একদিন পা দুটোকে বেশ একটু খেলাচ্ছি। সিংহকন্যা বললে, হঠাৎ আবার দেয়লা শুরু করলে কেন? সাতজন্মে পা ঘষ না। তোমার ওই চাষাড়ে পায়ের ঘষা লেগে লেপের ছাল উঠে যাবে।
কথাটা কিছু অসত্য বলেনি হে। তোমার পায়ের যা মাপ আর তার যা চেহারা। অনেকটা এবমিনেবল স্নোম্যানের মতো।
পুরুষের পা এইরকমই হয়। পদাঘাতের পা। আঘাতের লোক তো আর পেলুম না, পদাঘাত খেয়েই গেলুম। আমার বরাতে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুই লেখা আছে।
কেন?
কেন আবার! এই শীতে রোজ রাতে বিছানায় ওঠার আগে কনকনে ঠাণ্ডা জলে ঘষে ঘষে পা ধুয়ে লেডি ইন্সপেক্টার জেনারেলকে দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে বিছানায় উঠতে হবে। তারপর শুনবে, আরও শুনবে বিনয়ের বিনীত কাহিনি। পেঁয়াজ কী রসুন কাঁচা খাওয়া চলবে না। মুখ দিয়ে গন্ধ বেরিয়ে লেপের ভেতরের হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে। মুলো খাওয়া চলবে না। পেট গরম হতে পারে। গরম পেটঅলা লোক নিয়ে কমন লেপে শোয়া যায় না। রোজ টক দই খেতে হবে। ঠাণ্ডা জলে সাবান মেখে চান করতে হবে। শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে ছোবড়া ঘষতে হবে। নিম্নবাহুতে গোলাপের নির্যাস মাখতে হবে। পরিষ্কার ধবধবে পাজামা আর গেঞ্জি পরতে হবে। কারণ লেপের তলায় চাই কলগেট নিশ্বাস, বাগিচার সুগন্ধ। লেপের তলায় নেড়িকুকুর নিয়ে কোন ফ্যাশানেবল মহিলা শুতে পারেন না। লোমঅলা, ধবধবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাউডার মাখা বিলিতি কুকুর চাই। মাথায় তেল মেখে কলুর বলদ হওয়া চলবে না। তেলচিটে বালিশ, তার ওপর সাটিনের লেপ, ম্যাগো, ভাবা যায় না! এবম্বিধ অবস্থায় আমার কী করা উচিত তোমরাই বল।
বউকে পারবে না, লেপটাকেই ডিভোর্স করো। সিংহশাবককে বলো, খুব হয়েছে মা জননী, তুমি থাক মহাসুখে লেপের তলায়, আমি থাকি আমার মতো কাঁথার তলায়। শীতকালে প্যাঁজ না, রসুন না, মুলো না, মাথায় তেল নয়। মামার বাড়ি আর কী! রোজ চান? এমন অনেকে আছেন যাঁরা শরতে শেষ চান করেন, শীত পার করে ফাল্গুনের হোলিতে রঙিন হয়ে আবার চানপর্ব শুরু করেন। তোমার যদি হাঁপানির ব্যামো থাকত, তোমার বউ কী করতেন—তালাক দিতেন?
আরও একটা দুঃখের কথা বলি ভাই, ফুলকপি আমার ভীষণ প্রিয়। সারাবছর অপেক্ষায় থাকি, শীত এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে। সেই কপি খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। কপি বায়ুকারক। আমার স্ত্রী বলে, লেপের যোগ্য হবার চেষ্টা করো। যা তা মাল লেপে সিঁধোলে পলিউশান হবে।
মার শালা তোর শ্বশুরবাড়ির লেপে এক লাথি।
তাই তো মেরেছি। আগে আগে হত কী, সন্ধ্যে বেলাই হিসেব নিয়ে বসতুম। অফিস থেকে ফিরে চা খেতে খেতে বউকে অর্থনীতির উপদেশ দিতে ইচ্ছে হত। আয় বুঝে ব্যয় করতে শেখো! কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ। তেলটাকে সেই তিন কিলোতেই তুললে। কয়লা দু মণেই তাহলে পাকা হয়ে গেল! রোজ এক কেজি আলু লাগবেই! পাঁচ কেজি মুগের ডাল? লম্বে হাত। মাসে গায়েমাখা সাবান পাঁচটা? বহুত আচ্ছা। ঠুস ঠাস, ঠুস ঠাস করতে করতে পর্বত ধূমাৎ বহ্ণিমান। টুক করে বলে বসল, এবার থেকে তুমিই তাহলে রাঁধো। শীতকালে তেল একটু বেশিই খাবে।
না, খাবে বললেই খাবে। একটু টানতে শেখো, কেবল ছাড়তেই শিখেছ।
আমার বাপের বাড়িতে এত টানাটানি ছিল না। হলঘরের মতো সংসার আমি করতে পারব না।
ডোন্ট ফরগেট, দিস ইজ নট ইয়োর বাপের বাড়ি। শ্বশুরের তেল বেচা পয়সা আহ্লাদী মেয়ে দুহাতে উড়িয়েছেন। দীয়তাং ভুঞ্জতামের কাল চলে গেছে। ব্যস, সিংহী অমনি ফুঁসে উঠে তাঁর চাল চালতে লাগলেন। রাতে অনশন। শয্যাত্যাগ, ভূতলে শয়ন। সাধ্যসাধনায় তিনি ভূতল ছেড়ে শয্যাতলে এলেন। ঘাড়ে লেপ চড়ানো হল। রাগ পড়ল না। স্বামী সাংঘাতিক হলেও একটি প্রাণী। মশা কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর, আরও রমণীরক্ত লোভী এবং ঝাঁক ঝাঁক। মশার আক্রমণে লেপাশ্রিতা হলেও সন্ধি হয় না। একই লেপের তলায় দুই রাগী। লেপের গরম, রাগের গরম, ঘেমে মরি। তখন ছিল একদিন ঝগড়া তো পরের দিন ভাব। তিরিশ দিনের পনেরো দিন স্বামী-স্ত্রী আর পনেরো দিন ছোটোলোকের বাচ্চা আর ছোটোলোকের বেটি। পাশ ফিরে শুয়ে হাপর টানে। পশ্চাদ্দেশে পশ্চাদ্দেশে ঠেকলেও জ্বলে জ্বলে ওঠা, ছিটকে ছিটকে সরে যাওয়া। বাঘ কিংবা বিষধর সাপ নিয়ে শুয়ে থাকা।
সে তো ভালোই। দাম্পত্যকলহের পর প্রেম আরও জমে ওঠে। মেঘলার পর রোদ, রোদের পর মেঘলা, কনট্রাস্ট না হলে খেলা তেমন জমে না ভাই। ঠিক রাস্তাতেই চলেছ গুরু। ঠাকুর বলতেন, রসেবশে রাখিস মা।
হ্যাঁ ভাই, তা ঠিক। সেই রস এখন জমে মিছরির ছুরি হয়ে যেতেও কাটছে আসতেও কাটছে। গত একমাস বাক্যালাপ বন্ধ। আঠারো কেজি চিনির দাম নিদেন এক-শো আশি টাকা। বেশি মিষ্টি করেই মিষ্টির কথা বলতে গেলুম। এক-শো আশি টাকার চিনি খেলে আমি যে চিতেয় উঠব ভাই। উত্তর হল, মায়ের পেট গরমের ধাত, রোজ সরবত খেতে হয়। মেয়ে হয়ে কিছুই করব না, তা তো হয় না। তুমি আর মায়ের মর্ম কি বুঝবে বল। ছেলেবেলাতেই খেয়ে বসে আছ। মা ছিল বলেই না আমাকে পেয়েছ। তা আমি ভাই একটু ভেঙচি কেটে বলে ফেলেছিলুম, আহা মাতৃভক্ত মাতঙ্গিনী, স্বামীকে শয়ে চাপিয়ে মায়ের দেনা শোধ! কথাটা মুখ ফসকে বেরোনোমাত্রই ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। কাপ ডিশ ভেঙে, দেরাজের আয়না চুরমার করে, বইয়ের র্যাক ভেঙে আধুনিক রাজনীতির কায়দায় অ্যায়সা প্রতিবাদ জানালে তিনদিন হাঁড়ি চড়ল না। দফতর চালু হলেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে অসেনি। আমি বউবাজার থেকে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড লিখিয়ে এনে ঝুলিয়ে দিয়েছিলুম—রাগ চন্ডাল। তার তলায় লিখেছি—চন্ডালের হাতে পড়েছি। তোরা আমাকে একটা লেপ কিনে দে ভাই, ডিসেম্বরের শীতে কেঁপে মরছি।
কেন সেই লেপটা?
ভাই বিছানায় পার্টিসান উঠেছে। একটা রাত শুধু লেপ বয়ে কেটেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। কেঁপে কেঁপে ঘুম আসছে, এসে গেছে, ঝপাৎ করে গায়ে ভারি মতো কী একটা পড়ল। আচমকা। ভেবেছিলুম বউ হয়তো অনুশোচনায় ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়ল। ক’দিন চালাবে বাবা কোল্ড ওয়ার। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা চলে কী? ওঠো ওঠো! কেন ওরকম কর? বলেই মনে হল, আরে বউ তো আরও একটু শক্ত হবে, লম্বামত হবে। এ তো দেখছি অনেকটা জায়গা নিয়ে চৌকো মতো কী একটা এসে পড়েছে। বউ নয়, লেপ। কী হল লেপটা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলে? উত্তরে মিনি গর্জন শোনা গেল, হুঁ।
তোমার বাবার লেপ তুমি নিয়েই শোও। আমার ঘাড়ে কেন?
সংক্ষিপ্ত উত্তর, লেপ তোমার।
হ্যাঁ, লেপ আমার। তা ঠিক। বউ আর লেপ দুটোই আমার ছিল। আসলটা হাত ছাড়া, ফাউ জড়িয়ে মাঝরাত্রে মটকা মেরে পড়ে থাকি। এ যেন সেই গ্যারেজে গাড়ি রেখে বাবুর বাসে ঝোলা। লেপটা দু হাতে তুলে ঝপাং করে সিংহকন্যার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে এলুম। সারারাত লেপ নিয়ে পিংপং। তোরা ভাই আজ আমাকে একাট লেপ কিনে দে।
বেডিং স্টোরে গিয়ে আমাদের লেপ দেখা শুরু হল। দেখি একটা হাল্কা সিঙ্গল লেপ। বিনয় বললে, সিঙ্গল নয় ডবল।
ডবল কী করবি? সিঙ্গল মানুষ!
না, ডবল কিনব। এতকাল শীতের রাতে বউয়ের লেপের তলায় নেড়িকুকুরের মতো আশ্রয় খুঁজেছি। এইবার নিজের লেপে বুক চিতিয়ে পাশে একটু জায়গা রেখে শুয়ে থাকব। দেখি তুমি আস কি না তোমার অহঙ্কারের দরজা খুলে।