লেপ
‘একটা পুরানো লেপ ভেঙে ফেলে, আরেকটা নতুন বানাতে, সাড়ে সাতশো তুলো কম পড়ে যায়’…
এই পঙ্ক্তি দুটি, অনেকদিন, তা প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আগে লেখা, আমারই একটি কবিতার প্রথমাংশ।
পাঠক-পাঠিকারা লক্ষ করে থাকবেন যে চৌর্যবৃত্তির প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। এদিক-ওদিকের নানা রচনার থেকে টুকে, এর-ওর গল্পগুজব, কথাবার্তা শুনে আমি লিখি, ওই যাকে ‘টুকলিফাই’ করা বলে তাই আর কী।
অভ্যাস এমন খারাপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে আজ কিছুদিন হল আমি নিজের লেখা থেকেও টোকা শুরু করেছি। সবচেয়ে খারাপ হল, এর মধ্যে নিজের আগেকার লেখা কবিতাও ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এ জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যাঁরা কবিতা ভালবাসেন না, যাঁদের কবিতা দেখলে বা শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়—তাঁরাও দয়া করে মার্জনা করবেন। তবে একটা কথা, একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এগুলি ঠিক কট্টর কবিতা নয়, কবিতার মতো, পড়লে হয়তো খুব খারাপ লাগবে না।
সে যা হোক, এবার লেপ প্রসঙ্গে আসি। আমার সেই লেপ কবিতায় দুটি প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্ন দুটি আজও আমার মনে আছে।
এই ভরা শীতকাল। ধনুকে টঙ্কার তুলে ধুনুরিয়া পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বাড়ির সামনে বসে, ওই বাড়ির বারান্দায় বসে তুলো ধুনছে, লাল শালু সেলাই করছে। যতই তুলো ধোনা, লেপ বানানো চোখে পড়ে আমার সেই পুরনো প্রশ্ন দুটি ফিরে আসে।
প্রথম প্রশ্নটি আগেই বলেছি। একটি পুরনো লেপ ভেঙে নতুন লেপ বানাতে আবার তুলো লাগবে কেন, সাড়ে সাতশো কিংবা এক কেজি তুলো কেন কম পড়বে?
কেমন করে কম পড়বে। অমন আঁটোসাঁটো শক্ত সেলাই করা লেপের মধ্যে থেকে সাড়ে সাতশো তুলো কোথা গেল, অতটা তুলো কোথায় উধাও হয়ে গেল?
অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন এটা, আজও এর উত্তর পাইনি। ওই কবিতায় যে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল সেটা একটু অন্যরকম, ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত।
প্রশ্নটি সোজা করে এইভাবে উত্থাপন করা যায়, লেপ এমন নরম জিনিস, অমন কোমল, সেই লেপ কেন ভাঙতে হয়। পাথরের বাটি নয়, কাচের পেয়ালা নয়, পুরনো বাড়ি নয়, ফুটপাথে হকারের দোকান নয়, নরম কোমল লেপ সেটা কেন ভাঙতে হবে?
এসব প্রশ্ন উত্তরের আশা না রেখেই করা। বরং এবার লেপ বিষয়ে পুরনো প্রসঙ্গে যাই।
আমাদের ছোটবেলায় সংসারে সবকিছু নিয়েই বিধি নিষেধ ছিল, লেপ নিয়েও ছিল। কার্তিক মাসে লেপ বার করা চলবে না। অঘ্রানে নামাতে হবে। সম্ভবত লেপের অপব্যবহার ঠেকানোর জন্যেই এই বিধি।
কিন্তু এই বিধির মধ্যেও কিছু ফাঁক ছিল। কার্তিকে লেপ নামানো নিষেধ কিন্তু আশ্বিনে সে বাধা নেই। প্রত্যেকবার আশ্বিনের শেষে ঠাকুমা আমাকে বলতেন, ‘ওরে, লেপটা নামিয়ে আমার শরীরে ছুঁইয়ে রাখ।’ অর্থাৎ এর পরে কার্তিক মাসে যদি লেপ গায়ে দিতে ইচ্ছে হয়, বা দরকার পড়ে তাতে কোনও বিধিনিষেধ ভঙ্গ হবে না।
এই লেপ নামানোর কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ছে সেও এক বিরাট ব্যাপার। দালানের সব ঘরে ছাদের সঙ্গে বড় বড় হুক ছিল, যেমন পাখা লাগানোর জন্যে থাকে। তখন তো পাড়াগাঁয়ে বিদ্যুৎ ছিল না, কিন্তু ছাদের কড়িকাঠের সঙ্গে লোহার শিকলে হুক বা মোটা বঁড়শি ঝুলত। সেই হুকের সঙ্গে বড় বড় চটের বস্তায় ভরে লেপ ঝুলিয়ে রাখা হত।
পূর্ববঙ্গে প্রবাদ আছে যে হালের গোরু বেচে ব্রাহ্মণ চৈত্র মাসে লেপ বানিয়েছিল। এ কথার অর্থ এই যে, ওই প্রবাদ কাহিনীর ব্রাহ্মণ পুরো শীতকাল লেপ ছাড়া বহু কষ্টে কাটিয়েও আর শেষ রক্ষা করতে পারেনি। চৈত্র মাসে এমন ঠান্ডা পড়ল যে তাকে হালের গোরু বেচে লেপ বানাতে হল। নবীন শহুরে পাঠক, তুমি হালের গোরুর মানে বোঝো। সত্যিই এক-এক বছর চৈত্র মাসেও এমন হাড় কাঁপানো শীত পড়ত আমাদের সেই অনতি উত্তর মধ্যবঙ্গে, উত্তুরে বাতাস পাহাড়ে ফিরে যাওয়ার আগে শেষবার জানান দিয়ে যেত। সেই চৈত্র শীত, তার জন্যে হালের গোরুও বেচতে হত, এ যেন মেয়ের বিয়ের জন্যে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙানো।
তাই সাধারণত লেপ তুলে ফেলা হত চৈত্রের শেষে। ছাদে তুলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে লেপকে শায়েস্তা করা হত, তারপর রোদে দেওয়া হত। গরম সোডার জলে লেপের ওয়াড় সেদ্ধ হত, তারপর কেচে তুলে ফেলা হত।
এরপর ওই সব ভরা হত চটের বস্তায়, সেই বস্তার মুখ বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হত ছাদের হুকে। সেও এক কঠিন ব্যাপার। বাড়িতে মই ছিল না। টেবিলের ওপর চেয়ার, তার ওপরে টুল, তার ওপরে দোদুল্যমান দাঁড়িয়ে সার্কাসের কসরতের কায়দায় সেই সব লেপের বস্তা ঝোলানো সকলের কর্ম ছিল না।
এখন লেপ আর ছাদের সঙ্গে ঝোলানো হয় না। শীত চলে গেলে বিছানাতেই তোষকের নীচে রেখে দেওয়া হয়।
কলকাতার শীতে লেপ গায়ে দেবার খুব একটা দরকার পড়ে না। তা ছাড়া লেপ গায়ে দেবার আমার একটা ব্যক্তিগত অসুবিধা আছে। রাতের ঘুমের মধ্যে শরীরের ওপরে লেপ ঘুরে যায় লম্বার দিকটা পাশে চলে যায়, পাশের দিকটা লম্বায় চলে আসে। ফলে গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত শীত নিবারণ হয়। তার চেয়ে আমার কাঁথাই ভাল। পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরি নরম কাঁথা, তার মধ্যে গুটিসুটি দিয়ে কলকাতার শীতের রাত চমৎকার কেটে যায়।