লেডি চ্যাটারলি
নিমিত্ত মাত্র। আসলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, সাহিত্যে শ্লীল অশ্লীলে কি কোনও পার্থক্য নেই? যদি থাকে তবে তার বিভাগ করব কোন সংজ্ঞা দিয়ে? আর যদি করা যায় তবে পুলিশের সাহায্য নিয়ে অশ্লীল জিনিস বন্ধ করব, না অন্য কোনও পন্থা আছে?
এ প্রশ্ন আজ এই প্রথম ওঠেনি সেকথা সবাই জানেন, এবং একথাও নিশ্চয়ই জানি যে, এ প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান কোনওদিনই হবে না– যতদিন মানুষ গল্প লিখবে, ছবি আঁকবে, একে অন্যের সঙ্গে কথা কইবে, এমনকি, অঙ্গভঙ্গি করবে (অধুনা কলকাতার এক বিখ্যাত হোটেলে কোনও নর্তকীর নৃত্য দেখে পুলিশ বলে, এগুলো অশ্লীল, নর্তকী ও ম্যানেজার বলেন, ওগুলো উচ্চাঙ্গের নৃত্যকলা, আদালত বলেন, মহিলাটির নৃত্যের পিছনে বহু বৎসরের একনিষ্ঠ কঠোর সাধনা রয়েছে এবং সে নৃত্য কলাসৃষ্টি)।
লেডি চ্যাটারলি খালাস পেলে পর বিলেতে এ নিয়ে প্রচুর তোলপাড় হয়–অবশ্য স্মরণ রাখা ভালো যে, মার্কিন আদালত লেডি চ্যাটারলির লয়ার (লাভার না লিখে আমেরিকা লয়ার- উকিল লিখেছিল) পূর্বেই জিতে গিয়েছিলেন, এবং গত ত্রিশ বৎসর বইখানা কন্টিনেন্টের সর্বত্রই ইংরেজিতেও অনুবাদে পাওয়া যেত। আরও মনে রাখা ভালো যে, এসব বাবদে ইংরেজ সবচেয়ে পদী পিসি মার্কা, অর্থাৎ গোড়া। একটা উদাহরণ দিলে যথেষ্ট হবে। লেও বুম্ যখন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি একখানা বই বের করেন, নাম মারিয়াজ বিবাহ। ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধ গোছের বই–যদিও রুমের মূল বক্তব্য ভূদেববাবুর ঠিক উল্টো। নানাকথার ভিতরে তার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল, যুবক-যুবতীরা বিয়ের পূর্বে পরিপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা করে নিয়ে বিয়ে করলেই ভালো– তা হলে একে অন্যকে বোঝার সুবিধে হয়, বিবাহবিচ্ছেদের আশঙ্কা কমে যায় (!)। ইংরেজ সমালোচক তখন বলেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের কোনও প্রধানমন্ত্রী যদি আপন নামে এরকম একখানা বই প্রকাশ করতেন। তবে পরের দিনই তাঁকে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিতে হত।
তাই চ্যাটারলি জিতে যাওয়ার পর একাধিক প্রাচীনপন্থী বললেন,
১. এই বইয়ে যে নৈতিক আদর্শ প্রচারিত হয়েছে সেটা ইংরেজের যুগ যুগ সঞ্চিত নৈতিক ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে ও লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ নরনারী এতে করে মর্মাহত হবেন।
২. এ বইয়ের অনুকরণে যদি বিলাতে যুবক-যুবতীরা তাদের যৌন আদর্শ নির্মাণ করে তবে দেশে সর্বনাশ হবে।
৩, এই আইনে জিতে যাওয়ায় এর অনুকরণে–লাই পেয়ে–অশ্লীলতর ও জঘন্যতর বই বাজার ছেয়ে ফেলবে।
৪. এ বই জিতে যাওয়ায় সাহিত্যিক তথা সাধারণ নাগরিক আইন-রাজ্যে অনেকখানি এগিয়ে গেল বটে, কিন্তু নীতির রাজ্যে সে পিছিয়ে গেল। দা-কাটা বাঙলায় আইনের জয়, ধর্মের পরাজয়।
নবীনরা বললেন,
১. স্ত্রী-পুরুষের যে সম্পর্ক গোঁড়া ইংলন্ড বড়জোর বরদাস্ত করে নিত, লরেন্স যার সত্য মূল্য দেখিয়ে কোনও কোনও সমালোচক স্পিরিচুয়াল পর্যন্ত বলেছেন) সমাজের অশেষ কল্যাণ করেছেন তারই জয় হয়েছে।
২. বাজারে যখন ভূরি ভূরি অশ্লীল, পাপ, পৈশাচিক উত্তেজনাদায়ক বই অবাধে বিক্রি হচ্ছে তখন লরেন্সের এই উত্তম সাহিত্য নির্বাসিত করা শুধু যে আহামুকি তা নয়, অন্যায়ও বটে।
৩. শক্তিশালী সতত্যানন্মাচনকারী লেখকদের এখন আর পুলিশের ভয়ে বিশেষ বিষয় বর্জন করতে হবে না।
৪. অশ্লীল কদর্য পুস্তক কামকে কর্দমের স্তরে টেনে নামিয়ে আনে। লরেন্সের বই তাকে সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়েছে। সংস্কৃত অলঙ্কারে শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে কিছুটা আলোচনা আছে। কিন্তু আইন করে কোনও বই বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব কেউ করেছেন বলে শুনিনি। হয়তো তার প্রধান কারণ এই যে, বুদ্ধের আমলেই সংস্কৃত সাধারণ জনের পক্ষে কঠিন ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে; সে ভাষা আয়ত্ত করতে করতে মানুষের এতখানি বয়েস হয়ে যেত যে, তখন কী পড়ছে না পড়ছে তার দায়িত্ব তারই হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত।
কিন্তু আরবিতে লেখা আরব্যোপন্যাস? সে তো অল্প আরবি শেখার পরেই পড়া যায়। বাজারে যে আরব্যরজনী ইংরেজি বা বাঙলাতে পাওয়া যায় সেগুলোর কথা হচ্ছে না, তথাকথিত আপত্তিজনক অংশগুলো সেগুলোতে নির্মমভাবে কেটে দেওয়া হয়। বারো না আট ভলমে বার্টনের যে ইংরেজি অনুবাদ আছে তাতেও তিনি হিমশিম খেয়ে আনট্রেনসলেটেবল বলে বেশকিছু বাদ দিয়েছেন। এমনকি বইরুতে ক্যাথলিক পাদ্রিদের দ্বারা প্রকাশিত আরবি আরব্যরজনীতেও বিস্তর জিনিস বাদ পড়েছে এবং আরবভূমিতে ছেলেবুড়ো সবাই পড়ে সেই সম্পূর্ণ সংস্করণ কেউ কিছু বলে না।
ফারসিতে লেখা জালালউদ্দিন রুমির মসনবি গ্রন্থের উল্লেখ করতে পেলে আমি বড় আনন্দ বোধ করি। এই বই ইরানের গীতা এবং এতে হেন পাপাচার নেই যার বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি। ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় অনুবাদক সে-সব অংশ লাতিনে অনুবাদ করেছেন। (সংস্কৃত শিখতে শিখতে মানুষ যেরকম বয়স্ক হয়ে যায় এবং ধরে নেওয়া হয় তার শাস্রাধিকার হয়েছে লাতিনের বেলাও তাই।) অথচ ইরানভূমিতে আট বছরের ছেলেও যদি মসনবি নিয়ে বসে, পিতা এবং গুরু তাতে আনন্দিত হন।
বাংলা গদ্য আরম্ভ হয়, পরিষ্কার হাত নিয়ে এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে দেখতে পাই, ভারতচন্দ্র অশ্লীল ব্যাখ্যা পাচ্ছেন। ভিক্টোরিয়া যুগের বাই তখন আমাদের পেয়ে বসেছে। এরই মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ চৌর-পঞ্চাশিকা গীতিকাব্যের উদ্দেশে গেয়ে উঠলেন,
ওগো সুন্দর চোর
বিদ্যা তোমার কোন সন্ধ্যার
কনক-চাঁপার ডোর। –(১৩০৪ সন) কল্পনা।
ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর রচেছেন এই চৌরপঞ্চাশিকার প্লট নিয়েই এবং এ কাব্যের অনুবাদও করেছেন। এরকম অনবদ্য খণ্ডকাব্য সংস্কৃত সাহিত্যে বিরল।
শ্লীল-অশ্লীল নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। সৎসঙ্গ অসৎসঙ্গে নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। এমনকি কাব্য অশ্লীল না হয়েও অনুচিত হতে পারে। অনেকে মনে করেন, স্বয়ং কালিদাস এ পার্থক্য জানতেন না। কুমারসম্ভব্বে অষ্টম সর্গ সম্বন্ধে কবিরাজ রাজেন্দ্রভূষণ বলেছেন, জগন্মাতা ও জগৎপিতার এই সম্ভোগ একটা বিরাট ব্যাপার হইলেও পড়িতে লজ্জা জন্মে। তাই আলঙ্কারিকগণ, এই অষ্টম সর্গের উপর অত্যন্তম নুচিত বলিয়া কটাক্ষ করিয়াছেন। তবে চিত্রের জন্য যেমন চিত্র দেখা, তেমনই এই হরপার্বতীর বিহার পাঠ, ইহাতে দেখিবার ও শিখিবার বস্তু প্রচুর। কবির এই আলেখ্য দেখিয়া চমকাইলে, মহামায়ার বিপরীতরতাতুরাম এই ধ্যানাংশেরও পরিহার করতে হয় এবং আদি কবি বাল্মীকি-কৃত গঙ্গাস্তবের তুঙ্গস্তনা-ফালিত প্রভৃতি অংশ বাদ দিতে হয়। কাব্য কাব্য, তাহা উপনিষদের চক্ষে দেখিতে যাহারা চান বা দেখেন, তাহাদের উহা না পড়াই ভালো।*[* পণ্ডিত রাজেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, কালিদাসের গ্রন্থাবলি ২য় ভাগ, বসুমতী, পৃ. ১৫৫ পাদটীকা।]
কালিদাসের তুলনায় বামন লরেন্স্ নাকি কামকে স্বর্গীয় (স্পিরিচুয়াল) স্তরে তুলতে চেয়েছিলেন! তা তিনি চেয়েছিলেন কি না, পেরেছিলেন কি না সে কথা আমি জানি না–তবে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, কালিদাস চেয়েছিলেন এবং তাই জগন্মাতা ও জগৎপিতার দাম্পত্যপ্রেম বর্ণনা করেছিলেন। কারণ কামকে যদি সত্যই পূতপবিত্র করতে হয়, তবে সর্ব দেশকালপাত্র পূজ্য পিতা মাতা এবং তাঁদেরও পূজ্য জগন্মাতা ও জগৎপিতার দাম্পত্য প্রেমের চেয়েও উচ্চতর লোক তো আর কোথাও নেই।
স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, কোনও কোনও আলঙ্কারিকের মতে তিনি সক্ষম হননি, কারণ তারা বলেছেন, কালিদাস অত্যন্ত অনুচিত কর্ম করেছেন। পড়ার সময় লজ্জাবোধ সত্ত্বেও বিদ্যাভূষণ কিন্তু তাঁর নিন্দা করেননি। পড়ার সময় আমার সঙ্কোচ বোধ হয়নি, কারণ প্রতি ছত্রে আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম, কালিদাস আমাকে তাঁর অতুলনীয় কাব্যসৃষ্টি প্রসাদাৎ সর্বশেষে আমাকে এমন দ্যোলোকে উড্ডীয়মান করে দেবেন যেখানে কামের পার্থিব মলিনতার কথা আমার স্মরণেই থাকবে না। হয়তো আমি অক্ষম, কিংবা কালিদাসের সে শক্তি ছিল না। ব্যাসের যে সে শক্তি ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কাম সম্বন্ধে ব্যাসের মনে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না বলে তিনি নির্লিপ্তভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন।
রচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সংক্ষেপে নিবেদন,
ইয়োরোপের অনুসরণ যদি আমরা অত্যধিক শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে কামকে সাহিত্য থেকে তাড়িয়ে দিই তবে নিছক নির্জলা অশ্লীল রচনা উত্তরোত্তর বেড়েই যাবে। আর্টের কাজ তাকে আর পাঁচটা বিষয়বস্তুর মতো আপন কাব্যলোকে রসস্বরূপে প্রকাশ করা। কালিদাস করেছেন, চূড় কবি করেছেন, বিদ্যাপতি ভারতচন্দ্র করেছেন।
অশ্লীল সাহিত্য তাড়াবার জন্য পুলিশ সেন্সর বোর্ড বিশেষ কিছু করতে পারবে না। মার্কিন মুলুকে তারা আপনার হার মেনে নিয়েছে। বিশেষত সাহিত্যিকরাই যখন শ্লীল-অশ্লীলে ঠিক কোথায় পার্থক্য সে জিনিসটা সংজ্ঞা এবং বর্ণনা দিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারেননি।
সংস্কৃত আরবি ফারসিতে নিছক অশ্লীল রচনা অতি অল্প। তার কারণ গুণী-জ্ঞানীরা রুচিবোধ ও সাধারণ জনের শুভবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানবোধ (কমনসেন্স)। নির্ভর করতে হবে প্রধানত এই দুটি জিনিসের ওপর।
পাঠক হয়তো শুধোবেন, চ্যাটারলি বইখানা আমি পড়েছি কি না? পড়েছি। যৌবনে প্যারিসের কাফেতে বসে পড়েছি। ভালো লাগেনি। লরেন যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন সে অতি সাধারণ জিনিস। এবং ওই অতি সাধারণ স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি দেগেছেন বিরাট বিরাট কামান। এবং কামানগুলো পরিষ্কার নয়।
.