লেখালেখি খেলা
ময়মনসিংহে গ্রন্থমেলা হচ্ছে।
আমি এক ফাঁকে একটু দূরে সরে গিয়ে চা খাচ্ছি। তখনি তাকে দেখলাম। অল্প বয়েসী ছেলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?
সে বলল, হ্যাঁ।
বলে ফেল।
আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। আপনি ঠিকঠাক জবাব দেবেন। মিথ্যা জবাব না।
আমি বললাম, তোমার কেন ধারণা হল আমি মিথ্যা জবাব দেব?
সে চুপ করে রইল। আমি বললাম, কি তোমার প্রশ্ন?
ব্যর্থ কবিরাই ঔপন্যাসিক হন। আপনি কবি হিসেবে ব্যর্থ বলেই ঔপন্যাসিক হয়েছেন।
আমি বললাম, এটা তো কোন প্রশ্ন না। তুমি আমার উপর একটি বক্তব্য রেখেছ। আমার তো এখানে বলার কিছু নেই। বলতে চাচ্ছিও না।
ছেলেটি রাগী গলায় বলল, আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে আপনি একজন ব্যর্থ কবি।
আমি লক্ষ্য করলাম, ছেলেটির চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেছে। সে কথা বলছে রাগী ভঙ্গিতে। এইসব ক্ষেত্রে ছেলেটি যা বলছে তাতে রাজি হয়ে গেলেই সমস্যা মিটে যায়। রাজি হয়েও যেতাম। নিজেকে ব্যর্থ কবি বলতে আমার অহংবোধ আহত হবে না। কিন্তু ছেলেটির জেদী ভঙ্গি আমার ভাল লাগল না। কাজেই চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে আমি ছেলেটির মতই চোখ-মুখ কঠিন করে বললাম, নিজেকে ব্যর্থ কবি আমি কেন বলব? আমি তো কবিতা লিখি না। কবিতা লিখে যদি ব্যর্থ হতাম তখন বলতাম আমি ব্যর্থ। কবি। আমি যে যুক্তিতে নিজেকে ব্যর্থ গায়ক বা ব্যর্থ অভিনেতা বলব না, একই যুক্তিতে ব্যর্থ কবি অপবাদও মাথা পেতে নেব না।
ছেলেটি আমার যুক্তির ধার দিয়েও গেল না, চোখ-মুখ আরো কঠিন করে বলল, আপনি কবিতা লিখতে পারেন না বলেই উপন্যাস লিখছেন। এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।
এটা স্বীকার করলে কি তুমি খুশি হও?
আমার খুশি হওয়া না হওয়া কিছু না, আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনি একজন ব্যর্থ কবি।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আচ্ছা বেশ, স্বীকার করলাম।
মুখে স্বীকার করলে হবে না। কাগজে লিখে দিতে হবে।
কাগজ নিয়ে এসো, লিখে দিচ্ছি।
সে কাগজ নিয়ে এল, আমি সেখানে লিখলাম–আমি কবিতা লিখতে পারি না বলেই গল্প-উপন্যাস লিখি। আমি একজন ব্যর্থ কবি। সই করলাম, তারিখ দিলাম। ছেলেটি যুদ্ধজয়ের আনন্দ নিয়ে চলে গেল।
সে কেন এরকম করল?
কোন কারণে সে কি আমার উপর রেগে ছিল? তাকে রাগাবার মত আমি কি করতে পারি? হয়ত আমার লেখা তার ভাল লাগে না। তা তো হতেই পারে। লেখা। ভাল না লাগলে পড়বে না, কিন্তু রাগ করবে কেন? হয়ত সে নিজে একজন কবি। কবিরা অভিমানী হয়, রাগী হয়, এবং কেন জানি খানিকটা ছেলেমানুষও হয়। এদেশের বেশকিছু কবিকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কাব্যপ্রতিভা ছাড়াও আরো যা আছে তা রাগ, অভিমান এবং ছেলেমানুষী।
আমার নিজের কাব্যপ্রতিভা নেই, কিন্তু বাকি তিনটি যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। ময়মনসিংহের ঐ ছেলেটিকে যখন কাগজে লিখে দিলাম–”কবিতা লিখতে পারি না বলেই গল্প-উপন্যাস লিখি” তখন ভুল লিখিনি, ঠিকই লিখেছি। ব্যাপারটা আসলে তাই।
ছাপার অক্ষরে আমার প্রথম প্রকাশিত রচনা কবিতা। পাঠক-পাঠিকারা শুনে হাসবেন, সেই কবিতা ইংরেজি ভাষায় লেখা। তখন পড়ি বগুড়া জিলা স্কুলে। স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা দিতে হবে। চারটা কবিতা (বাংলায়) জমা দিলাম। স্যার বললেন, হাবিজাবি এইসব কি লিখেছিস? অগা-বগা লিখলেই কবিতা হয়?
আমি মরমে মরে গেলাম। স্যার বললেন, ইংরেজি সেকশান খালি যাচ্ছে, যদি পারিস ইংরেজিতে কিছু লিখে দে। সুন্দর করে একটা Essay লিখে নিয়ে আয়–A journey by boat PapeTi Village carnival.
আমি পরদিন একটা ইংরেজি কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতার নাম ‘God’, প্রথম চার লাইন ও
Let the Earth move
Let the Sun shine
Let them to prove
All are in a line.
স্যার বললেন–মন্দ না। শেষে মিল আছে।
কবিতা ছাপা হল। কবির ছবিসহ। বাবা কবিতা পড়ে গম্ভীর গলায় বললেন, মধুসূদন হবার চেষ্টা করছিস না-কি? ইংরেজিতে কে তোকে কবিতা লিখতে বলল? বাংলা ভাষাটা আছে কি জন্যে?
ঘটনার তিন বছর পর বাংলা ভাষায় দুটি কবিতা প্রসব করলাম। ‘প্রসব’ শব্দটা আমার পছন্দ নয় তবু ব্যবহার করলাম এই কারণে যে কবিতা দুটি বের করতে প্রসব যন্ত্রণার মতই যন্ত্রণা হল। রাতে ঘুম হয় না। মাথার ভেতর কবিতার লাইন ঘুরে। পুরো কবিতা না, একটা মাত্র লাইন।
কবিতার ছন্দ-টন্দ কিছুই জানি না, অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, পয়ার, অমিত্রাক্ষর এইসব শুনেছি–কোনটা কি জানি না। অথচ দুটা কবিতা লেখা হয়ে গেছে।
তখন পড়ি ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা খুব সাহসী হয়। কাজেই আমিও খুব সাহসী হয়ে এক কাজ করে বসলাম। দুটি কবিতা কপি করে পাঠিয়ে দিলাম দৈনিক পাকিস্তানে (এখন দৈনিক বাংলা)। তবে নিজের নাম দিলাম না। আমার ছোটবোনের নাম দিলাম–মমতাজ আহমেদ শিখু। ছোটবোনের নাম দেয়ার পেছনে যুক্তি হচ্ছে–কবিতা দুটি আমার কাছে পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছিল। তবে মহিলা কবির লেখা হিসেবে মন্দ নয়। দৈনিক পত্রিকার মহিলা পাতায় ছাপা যায়।
আমার এই বক্তব্যে মহিলারা রাগ করবেন না, ফার্স্ট ইয়ারে পড়া একটি বাচ্চা ছেলে এরকম ভাবলে ক্ষতি নেই। এখন আমি এরকম ভাবি না। মেয়েদের ছোট করে দেখার প্রবণতা আমাদের সমাজে আছে। আমার মধ্যে তা নেই। অনেক অনেক আগেই। তা দূর হয়েছে। আমি নিশ্চিত, মেয়েদের মানসিক ক্ষমতা পুরুষদের চেয়ে বেশি। তবে। সেই ক্ষমতার অনেকটাই তাঁদের নষ্ট করতে হয় শিশুদের লালন-পালন করে বড় করতে গিয়ে। কিছু ক্ষমতা নষ্ট হয় স্বামী নামক মানুষটিকে সুখী রাখার নানান প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে। তার উপর আছে নিজেকে আড়াল করে রাখার এক বিচিত্র প্রবণতা।
মূল গল্পে ফিরে আসি–ছোটবোনের নামে কবিতা পাঠিয়ে অপেক্ষা করছি। ছাপা হবে এমন দুরাশা নেই–কারণ, শুনেছি সম্পাদকরা অপরিচিত কারোর লেখা পড়েন না। তাঁদের এত সময় নেই।
কি আশ্চর্য কাণ্ড! যে সপ্তাহে কবিতা পাঠালাম, তার পরের সপ্তাহে দৈনিক পাকিস্তানের মহিলা পাতায় দুটি কবিতাই এক সঙ্গে ছাপা হয়ে গেল। শুধু তাই না, সম্পাদিকা একটি চিঠিও পাঠালেন–
“প্রিয় আপা,
কবিতা ছাপা হল। আরো কবিতা পাঠাবেন।”
কি সর্বনাশ! শেষে কিনা মহিলা কবি? সম্পাদিকার চিঠি পাওয়ার পর ঠিক করলাম, না, আর কবিতা না। যথেষ্ট হয়েছে। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা করা যাক। কবিতার খাতা নষ্ট করে ফেললাম। কবিতার ভূত মাথা থেকে নেমে গেল।
ছোটবোনের নামে প্রকাশিত আমার সেই দু’টি কবিতার একটির কয়েকটি লাইন তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিতার নাম “একশ’ ফানুস”।
দিতে পার একশ’ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ
একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।
দীর্ঘদিন ধরে গদ্য লিখছি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়–আহা, কেন লেগে থাকলাম না! সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে কবিতাকে কাছে পেতে চাইলে হয়ত সে কাছে আসত। দরজার ওপাশ থেকে ফিরে যেত না। কিংবা কে জানে সে হয়ত এখনো অপেক্ষা করছে–যদি তাকে ডাকি।