লেখার সময়
জর্জ বলল, ‘এক সময়ে একজনকে জানতাম, যার সঙ্গে তোমার একটুখানি মিল রয়েছে।
একটা ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা লাঞ্চ করছিলাম আর জর্জ চিন্তামগ্ন বিষণ্নভাবে তাকিয়েছিল।
আমি বললাম, ‘আশ্চর্য! আমি তো ভেবেছিলাম, আমি একমাত্র, অদ্বিতীয়।’
‘তুমি তাই,’ জর্জ বলল, ‘যে মানুষটির কথা বলছি, সে একটুখানি তোমার মতন। মাথা না খাটিয়ে আজে-বাজে সাজে লিখেই চলেছে, লিখেই চলেছে, লিখেই চলেছে, এ ব্যাপারে তোমার একার কেরামতি।’
‘সত্যি কথা বলতে, আমি কিন্তু ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যবহার করি, হাতে লিখি না।’
‘আমি বলেছি আজো-বাজে-সাজে,’ জর্জ জোর দিয়ে বলল, ‘যা একজন প্রকৃত লেখক বুঝতে পারবে, রূপান্তরের অর্থে।’ চকোলেট কেক খেতে খেতে জর্জ নাটকীয়ভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
আমি লক্ষণ বুঝলাম। ‘আজাজেল্ সম্পর্কিত তোমার কল্পনার উড়ানের কোনো কাহিনী আমাকে বলতে চলেছ, তাই নয় জর্জ?’
সে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ‘তুমি নিজস্ব কল্পনায় দীর্ঘ নিস্তেজ উড়ানে উড়ে চল, যখন শোন, তখনো সত্যকে খুঁজে পাও না। যাক গে, তোমাকে বলতে, খুবই দুঃখের কাহিনী এটা।’
‘তাছাড়া, তুমি তো শুরু করতেই চলেছ, তাই না?’
.
জর্জ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এটা সেখানকার সেই বাস স্টপ (জর্জ বলল), যা আমাকে মর্ডিয়াকাই সিম্স এর কথা মনে করিয়ে দেয়। চিত্রবিচিত্র দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করে যার রুজি রোজগার। যতটা তুমি করে থাক, বা যতটা যাচ্ছেতাই তুমি কর, অবশ্যই ততটা নয়, কারণ তার সঙ্গে তোমার একটুখানি মাত্র মিল। তার প্রতি সুবিচার করলে, আমি মাঝে মাঝে তার লেখা পড়ে দেখেছি, কোনো মতে চলে যায়।
তোমার মনে আঘাত না দিয়ে বলি, তুমি সে জায়গায় কখনো পৌঁছাওনি। অন্ত তপক্ষে তেমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। মনে মনে আমি এতটা নিচে নামিনি, যে তোমার লেখা নিজে পড়বো।
মর্ডিকাই আরো এক বিষয়ে তোমার থেকে পৃথক ছিল। সে ছিল ভয়ানক রকমের অধৈর্য্য। তুমি কেমন দেখতে, সেটা তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি না ভেবে, একবার ওদিককার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখ, দেখবে কেমন বেখেয়ালে বসে রয়েছ, একটা হাত চেয়ারের পিছনে ছড়ানো আর নিজে যেমন তেমন গা ঢেলে দিয়েছ। তোমাকে দেখে কেউ মোটে ভাববেই না, যখনতখন টাইপ করা দৈনিক কাগজের গোছা নিয়ে তোমার কোনো ঠেকা আছে!
মর্ডিকাই এ রকম ছিল না। সে সর্বদা সময়ের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন থাকতো। যেটা পেরোলেই তার স্থায়ী বিপদের আশঙ্কা। সেই সময়ে প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার তার সঙ্গে আমি লাঞ্চ করতাম আর বক্বক্ করে সে আমাকে কুৎসিত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়ে দিত।
‘একেবারে শেষ মুহূর্তে, আগামীকাল, সেটি আমি ডাকে পেতে যাচ্ছি’ সে বলত ‘আর আমাকে আরেকটা লেখার ভুল সংশোধন করতে হবে আগে, আর, আমার একদম সময় নেই। শয়তান বিলই বা দিচ্ছে না কেন? ওয়েটারকে দেখা যায় না কেন? তারা রান্নাঘরে করছে কি? ঝোলে সাঁতার কাটছে নাকি?
সে বিশেষভাবে বিলের জন্য সর্বদা অধৈর্য্য থাকত আর আমি ভাবতাম, রেগে গিয়ে সে না আমাকে বিল দিতে রেখে, চলে যায়। তার ওপর সুবিচার করলে বলতেই হয়, এমন কখনো ঘটেনি। কিন্তু তখন ঐ চিন্তায় আমার খাওয়ার আনন্দ মাথায় উঠত কিংবা দেখ ওদিকের বাসস্টপ। আমি পনেরো মিনিট যাবৎ লক্ষ্য করছি। তুমিও দেখে থাকবে, কোনো বাস আসেনি একটা ঝোড়ো দিন, বাতাসে শেষ শীতের কামড়।
আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, জনগণের কলার ওঠানো। পকেটে হাত ঢোকানো, নাক লাল বা নীল হয়ে যাচ্ছে, গরম হবার জন্য সবাই পা রগড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না, বাসের লাইনে কোনো বিদ্রোহ, বা আকাশ পানে কোনো ঘুষি পাকিয়ে উঠছে। সকলে সমর্পিত, জীবনের অন্যায় বিচারের সামনে ভেঙে পড়া।
কিন্তু মর্ডিকাই সিস তা নয়। সে যদি বাসের লাইনে থাকত, সে রাস্তায় নেমে পড়ত উৎসাহের সঙ্গে। দূরদিগন্তে দৃষ্টি চালাতো কোনো গাড়ির টিকি দেখা যাচ্ছে কিনা যাচাই করতে, রাগে গরগর করত, দাঁত মুখ খিঁয়ে গালাগাল দিত, হাত পা ছুঁড়ত। সিটি হলে পদযাত্রার ভয় দেখাতো, ছোট্ট করে বলতে গেলে, তার অত্যুৎসাহী শরীরের গ্রন্থিগুলি ক্ষয় পেত।
আমার যোগ্যতা আর উপলব্ধি ক্ষমতার শীতল বাতাসে আকৃষ্ট হয়ে অনেকের মতন সেও আমার কাছে তার অভিযোগ নিয়ে আসত।
‘আমি একজন ব্যস্ত লোক জর্জ,’ সে দ্রুত বলে চলত, সে সব সময়েই তাড়াতাড়ি কথা বলে।
‘এটা দারুণ লজ্জা, কলঙ্ক, অপরাধ, যেভাবে জগৎ আমার সঙ্গে শত্রুতা করে চলে। হাসপাতালে যেতে হয়েছে কিছু রুটিন টেস্টের জন্য। ঈশ্বর জানেন, কেন আমার ডাক্তারই ভাবে, তারই জীবিকা রয়েছে। আর আমাকে বলা হয়েছে, সকাল ৯-৪০এ এই জায়গায় আসবে।
আমি ঠিক ৯-৪০-এ চলে গেছি, ডেস্কে বোর্ড লাগানো ৯-৩০ থেকে খোলা। ঠিক এই কথাগুলোই লেখা ছিল জর্জ, এবং টেবিলের ওপারে অবশ্যই কেউ ছিল না।
‘আমার ঘড়ি দেখলাম; আর সামনেই যাকে হাসপাতালের ধূর্ত অ্যাটেনড্যান্ট বলে বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায়!’ ডেস্কের ওপাশে যার বসার কথা, সেই বদমাশটা কোথায়?’
‘এখনো এখানে আসেনি,’ নীচু জাতের জোচ্চোরটা বলল।
‘বলা আছে, সকাল ৯-৩০ টায় খুলে যাবে।’
‘শিগগিরই কেউ না কেউ এসে পড়বে। অনুমান করি,’ উত্তর দিল, যেন তার কিছুই যায় আসে না।
‘যতই হোক, এটা হচ্ছে হাসপাতাল। আমি মর-মর হতে পারি। কারো কোনো দৃকপাত নেই! সময়েরও কোনো দাম নেই আমার!
এই যে সময় চলে যাচ্ছে, তাতে আমি যা রোজগার করতাম, তা আমার ডাক্তারের বিল ভরতে যথেষ্ট। (যদি ধরেই নিই, খরচ করার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু নেই, কিন্তু তা তো হয় না)। কারোর কোনো খেয়াল আছে! না! ১০-০৪ এর আগে কাউকে দেখা গেল না এবং যখন আমি তাড়াহুড়ো করে ডেস্কের দিকে এগোলাম, সেই দেরী করে আসা শয়তান উগ্রভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার পালা না আসা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।’
মর্ডিকাই এর গল্প সম্ভার এমন বড়ই ছিল, যেমন ব্যাংকের এলিভেটরের লবিতে সে যখন অপেক্ষমাণ, ধীরে ধীরে একেক করে এগোচ্ছে সব অফিসকর্মীরা বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত লাঞ্চ করছে আর যখনই তার পরামর্শের দরকার পড়ছে, উপদেশ দাতারা বুধবার থেকে চারদিনের ছুটি কাটাতে হাওয়া হতে যাচ্ছে। ‘আমি বুঝি না, সময় আবিষ্কার করতে কারো দায় পড়েছিল কেন, বল তো জর্জ?’
সে বল্ল ‘এটা যেন সব রকমের নতুন নতুন পন্থায় অপচয় করার এক যন্ত্রবিশেষ। যত ঘণ্টা আমাকে আস্পর্ধাওয়ালা নানা ধরনের পাজী লোকের সুবিধার অপেক্ষায় ব্যয় করতে হয়, সেটা আমি আমার নিজের লেখায় ব্যয় করতে পারি। নষ্টের গোড়া বিল আসছে কই?’
আমি না ভেবে পারতাম না, যদি তার আয় বাড়াতে সাহায্য করতে পারতাম, সত্যিই এক লাভের কাজ হতো, যেহেতু আমার জন্য কিছু ব্যয় করার সুরুচি তার ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, কোথায় খাব, তার জন্য সে ভাল জায়গা পছন্দ করতো, এটাও আমার হৃদয় ভরিয়ে দিত। তোমার মতো নয়, বন্ধু। তোমার রুচিবোধ যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে খামতির দিকে। আমার মতে, তোমার লেখা থেকেই তা বোঝা যায়।
অতএব তাকে সাহায্য করতে, আমি আমার শক্তিশালী চিন্তাধারাকে নাড়িয়ে দিলাম। আমি তখুনি আজাজেলের কথা ভাবিনি। সেই সময়ে আমি ঠিক আজাজেল্ এর ব্যাপারে এতোটা অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি যতই হোক, একটা দুই সে.মি. লম্বা জিন, আর কতটাই বা সাধারণের ঊর্ধ্বে হবে।
ঘটনাক্রমে যদিও আমার মনে বিস্ময় জেগেছিল, কারোর লেখার সময় তৈরি করে দিতে আদৌ আজাজেল্ সমর্থ হবে কিনা! এটা হয়তো হবার নয়, আমি হয়তো তার সময় নষ্টই করব, কিন্তু অপার্থিব প্রাণীর কাছে সময়ের মূল্য কি!
প্রয়োজনীয় প্রাচীন যাদুমন্ত্র উচ্চারণের সনাতন পদ্ধতিতে তাকে আহ্বান করলাম। যেখান থেকেই আসুন না কেন, সে ঘুমন্ত পৌঁছাল। তার ছোট্ট চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত। তার কাছ থেকে একটা তীক্ষ্ণ গুনগুন আওয়াজ আসছে, যা যেমন তেমন ভাবে উঠছে আর নামছে। মনে হয়, এটা মানুষের নাক ডাকার তুল্য কিছু।
বুঝতে পারছিলাম না, তাকে কেমন করে জানাই? অবশেষে তার পেটের ওপর এক ফোঁটা জল ফেলা স্থির করলাম। তার পেট ছিল সুগোল, যেন সে একটা ‘বল বেয়ারিং’ গিলে রেখেছে। আমার সামান্যতম ধারণাও নেই, এটা তাদের জগতের সচরাচর বস্তু কিনা, এক একবার আমি উল্লেখ করেছিলাম। সে আবার বল বেয়ারিং’ কী, জানতে চেয়েছিল। তাকে যখন আমি ব্যাখ্যা করলাম, সে আমাকে Zapulnicate করে দেবে বলে ভয় দেখালো। আমি জানি না তার অর্থ কি? তবে তার গলার স্বর থেকে বুঝলাম, যহোক কিছু অপ্রীতিকর।
জলের ফোঁটা তাকে জাগিয়ে দিল এবং সে যারপরনাই বিরক্ত। সে বলে চলল, সে তো প্রায় অর্ধেক ডুবেই যাচ্ছিল, আরো একঘেয়ে বর্ণনা দিল, তাদের জগতে ঘুম থেকে ওঠানোর সঠিক উপায় কি, সে সম্পর্কে। সেটা ছিল নাচ, ফুলের নরম পাপড়ি, বাজনা আর জাঁকজমকপূর্ণ নর্তকীদের বিষয়বস্তু। আমি বললাম, আমাদের পৃথিবীতে আমরা বাগানের জলের হোস পাইপ ব্যবহার করে থাকি। আমাদের তত্ত্বে বর্বরতার ওপর কিছু মন্তব্য করল, আজাজেল্। তারপর ঠাণ্ডা হয়ে, আমাকে আসলে কথা বলার সুযোগ দিল।
আমি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলাম, বরং ভাবলাম আর অকারণ হৈচৈ না করে সে হয়তো কিছু বাজে বক্ করবে আর তাই-ই হবে।
আজাজেল্ এসবের কিছুই করল না। পরিবর্তে তাকে গম্ভীর দেখাল। সে বলল, ‘এখানে তুমি আমাকে সম্ভাবনা তত্ত্বের সূত্রসমূহের ওপর হস্তক্ষেপ করতে বলছ।
শুনে ভাল লাগল, সে পরিস্থিতি বুঝে গেছে। ‘একদম ঠিক,’ আমি বলি।
‘কিন্তু তাতো সোজা নয়!’ সে বলে।
‘অবশ্যই নয়,’ আমি বলি, ‘যদি এটা সোজাই হবে, তবে তো নিজেই করে
ফেলতাম। সোজা নয় বলেই তোমার মতো একজনকে ডাকতে হল, যে আশ্চর্য পারদর্শী।’
বিরক্তিকর অবশ্যই, কিন্তু অপরিহার্য, যখন তোমাকে এমন এক জিনের সঙ্গে কারবার করতে হচ্ছে, যে তার বল বেয়ারিং পেট এর বিষয়ে সমান স্পর্শকাতর।
আজাজেল্কে আমার যুক্তিতে প্রসন্ন দেখাল, সে বলল, ‘বেশ, আমি বলছি না, এটা অসম্ভব।’
‘বাঃ!’
‘তোমাদের জগতে জিন হুইপার স্থান কাল শৃঙ্খলে কিছু সংযোগ বিন্দু অনুপ্রবেশ করাতে হবে।
‘একদম ঠিক।’ তুমি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছ।
আমাকে যা করতে হবে তা হল, তোমার সহায় সামর্থ্যসমেত ঐ বন্ধুর স্থান- কাল-বন্ধনে পারস্পরিক সংযোগ স্থলে নতুন কিছু যোগাযোগ বিন্দুর সূচনা করতে হবে। ভাল কথা, সময়সীমাগুলো কি কি?
আমি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম, সে ঝড়ের মতন এক ছোট্ট শ্বাস ছাড়ল। ‘আঃ হ্যাঁ, আমাদেরও এইসব জিনিস রয়েছে, স্নেহ প্রদর্শনের বায়বীয় প্রক্রিয়ায়। একটা সময়সীমা অতিক্রম করে গেলেই, ছোট্ট প্রিয় প্রাণীরা, তোমাকে আর শেষটা শুনতেই দেবে না। আমার মনে পড়ে একবার-’
আজাজেলের তুচ্ছ যৌবন জীবনের নোংরা বর্ণনা আর তোমাকে দেব না।
‘কিন্তু একটা কথাই থেকে যাচ্ছে’ আজাজেল্ শেষ পর্যন্ত বলল, ‘এরপর আমি সংযোগ বিন্দুগুলি ঢুকিয়ে দিলে, আর কিন্তু এগুলো নষ্ট হবে না।’
‘কেন নয়!’
আজাজেল্ এককথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘আমার ভয়, তত্ত্বগতভাবেই সম্ভব নয়।’
আমি ওর কথা একদম বিশ্বাস করলাম না। দেখ, শোচনীয় অনুপযুক্ত প্রাণীটি আসলে জানেই না, কি করে কী করতে হয়। তবে ধাঁধাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি দেখেছি, আমার জীবন অসম্ভব করে তোলার ক্ষমতা আজাজেলের আছে। তবু তাকে তা জানতে দিলাম না। সরলভাবে বললাম, ‘তোমাকে নষ্ট করতে হবে না। মৰ্ডিকাই লেখার সময়ের পশ্চাতে পড়ে রয়েছে, আর একবার সেটা পেয়ে গেলেই, সারা জীবনের মতন খুশি।’
‘তাই যদি হয়, তবে আমি করে দেবো!
অনেকক্ষণ ধরে ঢং-টাং করল। দেখাচ্ছিল, এক যাদুকর কিছু করছে। হাতের আঙুলে টুকি মারছিল আর মাঝে মধ্যে অল্পক্ষণের জন্য বা বেশ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যচ্ছিল। এগুলো এত ক্ষুদ্র, নিশ্চিত করে বলা খুব শক্ত, সত্যিই দেখা যাচ্ছিল বা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছিলই না।
‘কি করছ কি তুমি?’ আমি জিজ্ঞাসা করি। আজাজেল্ মাথা নাড়ল, তার ঠোঁট নড়ছিল এমনভাবে যেন কিছু গুনে চলেছে।
আপাতত শেষ হতে, সে টেবিলে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল।
বললাম, ‘হয়ে গেছে?’
মাথা নেড়ে, সে বলল ‘আশা করি তুমি বুঝবে, ওর পরম তাপমাত্রার অঙ্ক কমিয়ে দিতে হল, কমবেশি বরাবরের মতন।’
‘এর অর্থ কী?’
‘তার মানে, তার প্রতিবেশে বিষয়গুলি সন্দেহাতীতভাবে আর একটু নিয়ম শৃঙ্খলিত হবে।
‘শৃঙ্খলিত হওয়ায়, কোনো দোষ দেখি না।’ আমি বলি, ‘তুমি হয়তো একথা ভাবতেই পার না বন্ধু। কিন্তু আমি সর্বদা শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে চাই। তোমার কাছে আমি কতখনি ধার করেছি, তার পাই-পয়সাটির হিসাব রাখি। এর বিস্তারিত তালিকা এখানের বাজে কাগজে রেখেছি। আমার অ্যাপার্টমেন্টেও রয়েছে। যেদিনই চাইবে, পাবে।
আজাজেল্ বলল, ‘অবশ্যই সুশৃঙ্খল হওয়া দোষের নয়। শুধু তুমি তাপবলবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র লঙ্ঘন করতে পার না। তার মানে হচ্ছে, বস্তুদের অল্প একটু বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকতে হবে, ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে।’
‘কীভাবে?’ আমি বলি, জিপার ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে (সব সময় সতর্ক থাকা যায় না)।
‘বিভিন্ন ভাবেই, লক্ষ্যে পড়ে না। আমি সৌর গঠনতন্ত্রের মধ্যে প্রভাব ছড়িয়ে দিয়েছি। তাতে আরো কয়েকটি বেশি গ্রহাণু সংঘাত ঘটবে, যা সচরাচর ঘটে, তার চেয়ে। শনির উপ হ।O-তে আরো কিছু বিস্ফোরণ ঘটবে, এমনই আর কি। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে সূর্যের ওপর।’
‘কেমন করে!’
আমার স্থান-কাল-বন্ধনে, সংযোগ বিন্দু যোগ করার আগে, সূর্যের উত্তাপে পৃথিবীর প্রাণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা, তার আড়াই নিযুত বছর আগেই এটা ঘটে যাবে, সূর্য সাংঘাতিক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। কয়েক নিযুত বছর আগুপিছুতে কি যায় আসে, যখন আমার ডিনার বিল কেউ সহাস্যে প্রফুল্ল মনে তুলছে কিনা, এই প্রশ্ন সেখানে জড়িয়ে রয়েছে।
এর এক সপ্তাহ পরে, আমি আবার একদিন মর্ডিকাই এর সঙ্গে ডিনার করলাম। নিজের কোটের পকেট পরীক্ষা করে তাকে খানিক উত্তেজিত লাগল। টেবিলে পৌছাল! আমি ধৈর্য ধরে আমার পানীয় নিয়ে অপেক্ষা করছি, সে উজ্জ্বল মুখে হেসে উঠল।
‘জর্জ,’ সে বলল, ‘কি যে অসাধারণ সপ্তাহ আমার গেছে না!’
না তাকিয়ে সে হাত তুলল, আর আশ্চর্য হওয়া চলে না, সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে খাবারের মেনু এসে গেল। মনে রেখ, এই রেস্তোরাঁর ওয়েটাররা সব উগ্র উদ্ধত স্বভাব। তিন দফায় ম্যানেজারের কাছে দরখাস্ত দেওয়ার পরই মেনু আসে।
মর্ডিকাই বলল, ‘প্রত্যেকটা জিনিস হয়ে চলেছে ঘড়ির কাঁটা ধরে।’
হাসি চেপে বললাম, ‘সত্যি!’
‘ব্যাংকে ঢুকেছি, আমার জন্য খালি জানালা, হাস্যমুখ ক্যাশিয়ার। পোস্ট অফিস গেছি, সেখানেও খালি জানালা। আর তুমি নিশ্চয় আশা করবে না, পোস্ট অফিস কর্মী হাসবে, তবে অন্ততপক্ষে সে আমরা চিঠি রেজিস্ট্রি করার সময় দাত খিঁচিয়ে কথা বলেনি। স্ট্যান্ডে পৌঁছানো মাত্র, বাস এসে পড়েছে।
গতকাল সাংঘাতিক ভীড়ের সময়ে হাত উঠিয়েছি কি না উঠিয়েছি, ট্যাক্সি এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। পর পর আরেকটা। যখন বললাম, পঞ্চাশ নং আর ঊনপঞ্চাশ নং রাস্তায় যাব, তখন ঠিকঠাক রাস্তার চিহ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে, নিয়ে চলল। এমন কী ইংরেজি বলছিল। আর কী চাই বল তো জৰ্জ?’
মেনুতে একবার চোখ বোলানোই যথেষ্ট আপাতত মনে হল ঠিক করাই আছে। আমি তাকে দেরি করাতে পারবো না। মর্ডিকাই মেনু একপাশে সরিয়ে রেখে, আমাদের দুজনের জন্য দ্রুত অর্ডার দিতে লাগল। লক্ষ্য করলাম, সে দেখলও না ওয়েটার তার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিনা। সে যেন ধরেই নিয়েছে কেউ না কেউ থাকবেই।
আর, সত্যিই একজন ছিল।
ওয়েটার দুহাত কচলাল। নিচু হয়ে অভিবাদন জানাল তৎপরতার সাথে শোভনভাবে, দক্ষতার সঙ্গে খাবার পরিবেশনে এগোল।
বললাম, ‘বেশ হচ্ছে। সৌভাগ্যের চমক এসেছে তোমার কাছে। মর্ডিকাই, বন্ধু, এর কারণ বলতে পার? (অবশ্যই মানছি, একটা ভাবনা এসেছিল মাথায়, হয়তো এর জন্য যে আমি দায়ী, তা তাকে বিশ্বাস করাতে পারব)।’ যতই হোক, সে যদি জানতে পারে, সে কি আমার ওপর সোনা বর্ষণ করবে, না, কিংবা মূল্যবৃদ্ধির যুগে শুধুই কাগজ!
শার্টের কলারে ন্যাপকিন গুঁজে, ছুরি কাঁটা হাতে চেপে ধরে মর্ডিকাই বলল, ‘খুব সহজ।’ মর্ডিকাই তার সব গুণ নিয়ে ভোজন রসিকদের একজন ছিল না।
সে বলল, এটা একেবারেই বরাত নয়। সম্ভাবনার কারবারে অবধারিত পরিণতি।’
‘সম্ভাবনা? দৈবাৎ।’ আমি ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধে বলি।
মর্ডিকাই বলে, ‘নিশ্চয়ই। পৃথিবী এ যাবৎ দেখেছে, আমি আমার সমস্ত জীবন দৈবাৎ দেরী হওয়ার লাগাতার শোচনীয় চক্করে পড়ে কাটিয়েছি। সম্ভাবনা তত্ত্বের সূত্র অনুসারে, এইবার দুর্ভাগ্যের ভাণ্ডার বন্ধ হওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। আর সেটাই এখন ঘটে চলেছে। এবং বাকি জীবন ধরে ঘটে চলবে। এই রকমই প্ৰত্যাশা আমার। আমার আস্থা রয়েছে।’
সে আমার দিকে ঝুঁকে এল আর বিশ্রীভাবে আমার বুকে চাপট মেরে বলল, ‘এর ওপর নির্ভর কর। তুমি সম্ভাবনা তত্ত্বকে এড়াতে পার না।’
সমস্ত খাবার সময়টা সে আমাকে সম্ভাবনা তত্ত্বের বক্তৃতা শোনাল। যার সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত, আমারই মতো সেও খুব কমই জানে।
শেষ পর্যন্ত বলি, ‘নিশ্চয়ই এসব থেকে তুমি এখন লেখার অনেক সময় পাচ্ছ।’
‘স্পষ্টতই।’ সে বলল, ‘আমার লেখার সময় বিশ শতাংশ বেড়ে গেছে।’
‘তার মানে, আমার মনে হয়… ‘তোমার লেখার মান পরিমাণও সেই অনুপাতে বর্ধমান।
‘বেশ’ একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘এখনো পর্যন্ত নয়। আমার ভয় হচ্ছে। স্বভাবতই আমাকে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। এত দ্রুত সব পেয়ে যেতে,
আমি তো ঠিক অভ্যস্ত নই। আমাকে বিস্মিত হতে হচ্ছে
খোলাখুলি বললে, আমার কাছে তাকে বিস্মিত কিছু লাগছিল না। সে হাত তুলল, তাকিয়ে দেখলও না, আর ওয়েটারের আঙুল থেকে বিল নিল, যে তার দিকে এগিয়ে এসে পড়েছিল। ভাসা ভাসা ওপর ওপর দেখে ক্রেডিট কার্ডসহ সে ওটা ফিরিয়ে দিল ওয়েটারকে, যে অপেক্ষমাণ ছিলই। ওটা নিয়েই সে তুরন্ত চলে গেল।
পুরো ডিনার খতম হতে, সময় লাগল মাত্র ত্রিশ মিনিটের একটু বেশি। তোমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই, আমার ভদ্রসম্মত আড়াইঘণ্টার ডিনার ভাল লাগে। খাওয়ার আগে শ্যাম্পেন পরে ব্র্যান্ডি, ফাইন ওয়াইন কিংবা দুটো আলাদাভাবে চাখি। সংস্কৃতি-চর্চা, এই সমস্ত আনুষঙ্গিক অন্তর্বর্তী পর্যায়সমেত। যাই-ই হোক, বাস্তবের উজ্জ্বল দিকটি হল মর্ডিকাই দুঘণ্টা বাঁচাতে পেরেছে, যার থেকে তার অর্থোপার্জন বৃদ্ধি পাবে, আর আমিও পরোক্ষে উপকৃত।
.
সেই ডিনারের পর তিন সপ্তাহের মতন আমার মর্ডিকাই এর সঙ্গে দেখা হয়নি। কারণটা ঠিক মনে নেই। হতে পারে, আমরা পালাক্রমে দুজনেই শহরের বাইরে ছিলাম।
যাই হোক, একদিন সকালে কফি হাউস থেকে ঠিক বেরোচ্ছি, যেখানে আমি মাঝে মাঝেই রোল আর স্ক্র্যাম্বলড এগ খেয়ে থাকি। আধ ব্লক দূরে এক কোণে মর্ডিকাই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেটা এমনই এক ভেজা বরফের শোচনীয় দিন যে, যখন খালি ট্যাক্সি তোমার দিকে এগিয়ে আসছে, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে তোমার প্যান্টে-পায়ে গলা বরফ ছিটকিয়ে দিয়ে যাবে। দেখিয়ে যাবে তাদের অফ ডিউটি নির্দেশ চিহ্ন। মৰ্ডিকাই আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ছিল, আর হাত তুলেছে কি না তুলেছে, অমনি এক খালি ট্যাক্সি সাবধানে তার দিকে এগিয়ে এল। আমি অবাক হলাম, সে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ট্যাক্সি, খানিক গড়িমসি করে, চলে গেল।
মর্ডিকাই দ্বিতীয়বার হাত তুলল, শূন্য থেকে যেন ট্যাক্সি ফুঁড়ে বেরোল আর তার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। সে উঠল বটে, তবু আমি চল্লিশ গজ দূর থেকেও শুনতে পেলাম, তার গজগজানি, শহরে যদি যত্নে লালিত সজ্জন থাকে, তবে তার কাছে অশ্রাব্য।
আমি পরে সেই সকালেই তাকে ফোন করলাম আর এক আরামদায়ক বারে ককটেল এর বন্দোবস্ত করলাম। সেখানে সারাদিনই ‘এক ঘণ্টার খুশি’র ব্যবস্থা। তার কাছ থেকে একটা ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত আমার তর সইছিল না।
আমি যা জানতে চাইছিলাম, তার সেই অস্ফুট গজগজানির মানে কী ছিল!
না, বন্ধু আমি তার অভিধানগত অর্থ চাইনি। ধরে নিচ্ছি হয়তো পাওয়া যাবে। আমি বলতে চাইছি, আদৌ কেন ঐ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছিল। সব দিক থেকে তার তো পরমানন্দে ভাসা উচিত।
যখন আমরা পানশালায় প্রবেশ করলাম, তাকে মোটেই খুশি লাগছিল না। বরং পরিষ্কার চোখ বসে যাওয়া খ্যাপাটে লাগছিল।
সে বলল, (পরিচারিকাকে ইশারা করবার দায়িত্বটা তুমি নেবে জর্জ?’
এটা এমনই এক পানশালা যেটাকে পরিচারিকারা যেমন তেমন বেশ পরে থাকে ও উষ্ণ ব্যবহারের তোয়াক্কা করে না। তাতে আমি অবশ্য নিশ্চিত উষ্ণ থাকি।
আমি সানন্দে একজনকে ইশারা করলাম। যদিও আমি জানতাম, আমার ভাবভঙ্গী দেখে সে বুঝেই নেবে, ড্রিঙ্কের অর্ডার দিতে চাই।
বাস্তবে, সে ভাবভঙ্গী বুঝলই না, বরং আমার দিকে অবজ্ঞায় পিঠ ফিরিয়ে রইল। আমি বলি, ‘মর্ডিকাই, যদি কাজ পেতে চাও, তবে তোমার নিজেরই ডাকতে হবে। সম্ভাবনা সূত্র এখনো আমার প্রতি অনুকূল হয়নি, যদিও এটা লজ্জার বিষয়। কারণ কতদিন হয়ে গেল, আমার ধনী চাচার মৃত্যুতে এক ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করারই কথা।’
‘তোমার ধনী চাচা রয়েছে!’ মর্ডিকাই সামান্য উৎসাহ দেখালো।
‘না! আর সেটাই তো অবিচার। পানীয়ের জন্য ইশারা কর, মর্ডিকাই।’
‘চুলোয় যাক।’ রেগে গরগর করতে করতে মর্ডিকাই বলল, ‘ওদের অপেক্ষা করতে দাও।’
ওদের অপেক্ষা করতে দিতে আমার কিছু যাচ্ছিল আসছিল না অবশ্যই।
কিন্তু আমার কৌতূহল অনেক তৃষ্ণা জয় করে নিল।
‘মৰ্ডিকাই,’ আমি বলি ‘মনে হচ্ছে তুমি অসুখী। আসলে, যদিও সকালে তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। আমি তোমাকে দেখেছিলাম। তুমি খালি ট্যাক্সি চলে যেতে দিলে, এমনই দিনে, যখন ট্যাক্সি সোনার মতন দামী আর দ্বিতীয়টাতে ওঠার সময় যেন কী শপথ নিচ্ছিলে!’
মৰ্ডিকাই বলল, ‘তাই নাকি! ওঃ আমি এইসব আপদগুলোর জন্য ক্লান্ত হয়ে গেছি। ট্যাক্সি আমাকে তাড়া করে ফেরে। লম্বা লাইনে তারা আমার পিছু পিছু আসে, আমি এগিয়ে আসা ট্রাফিক দেখতেই পাই না, তাদের একজনকে না থামিয়ে। ওয়েটারদের ভীড়ে যেন আমি ঝুলে রয়েছি। আমি এগিয়ে গেলে, দোকানদাররা বন্ধ দোকান খুলে দেয়। আমি কোনো বিল্ডিং এ ঢোকামাত্র এলিভেটরের দরজা সবেগে খুলে যায় আর আমি যে তলাতেই থাকি না কেন, অবিচল আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
আমার গন্তব্য ব্যবসার অফিসে, আমি তৎক্ষণাৎ রিসেপশন অঞ্চলে পৌঁছে যাই, সেখানে দন্ত-বিকশিত রিসেপশনিস্টের দল অপেক্ষা করে থাকে। প্রতিটি গভর্নমেন্ট দপ্তর, অধস্তন কর্মচারীদের অস্তিত্ব যেন শুধু—’
ততক্ষণে আমি প্রশ্বাস নিয়েছি। ‘কিন্তু মর্ডিকাই’ আমি বলি, ‘এতো চমৎকার সৌভাগ্য। সম্ভাবনা তত্ত্ব এর সূত্র-
তার প্রস্তাব মতন সম্ভাবনা তত্ত্বের ওপর আমার করণীয় সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল, কারণ সেগুলো বাস্তব দিক বাদে বিমূর্ত মাত্র।
‘কিন্তু মর্ডিকাই,’ আমি যুক্তি দেখাই, ‘এ সমস্তই কিন্তু তোমার লেখার সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
‘না, দিচ্ছে না’ জোরের সঙ্গে মর্ডিকাই বলল, ‘আমি মোটেই লিখতে পারছি না।
‘দোহাই তোমার, কেন নয়!’
‘কারণ চিন্তার সময় আমি হারিয়ে ফেলছি।
‘তুমি কী হারিয়ে ফেলছ?’ আমি সম্পূর্ণভাবে জিজ্ঞাসা করি।
‘এই সমস্ত অপেক্ষা যা আমাকে করতে হত লাইনে দাঁড়িয়ে, রাস্তায়, বাইরে অফিসে, সেই সময়টা আমি চিন্তা করতে পারতাম। আমি খসড়া করতাম। কি লিখতে চলেছি। এটা ছিল আমার গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতির সময়।’
‘আমি জানতাম না।’
‘আমিও তখন জানতাম না, এখন জানি।’
আমি বলি, ‘আমি ভেবেছিলাম, তুমি অপেক্ষা করার সময়, রেগে ফুঁসে, শপথ নিয়ে, নিজের মাথা খেয়ে কাটাতে।’
‘খানিকটা সময়, যে ভাবেই যেত। কিন্তু বাকিটা আমি চিন্তা করতে পারতাম। এমন কি, পৃথিবীর অবিচার ভেবে যে সময়ে আমি উত্যক্ত, তাও দরকার ছিল, কারণ ঐ বিরক্তি আমার রক্তপ্রবাহে হর্মোনসমূহের নিঃসরণ ঘটিয়ে উদ্বুদ্ধ করত। যখন আমি টাইপরাইটারে পৌঁছতাম, আমার সমস্ত বিরক্তি টাইপরাইটারের চাবিতে ঘা দিয়ে, উঠিয়ে দিতে পারতাম। আমার চিন্তা আমাকে বুদ্ধিদীপ্ত প্রেরণা দিত। আর আমার উষ্মা দিত আবেগে প্রেরণা। দুয়ে মিলে ফল হতো। আমার অন্তরাত্মার অন্তর্নিহিত আগুন ও তমসা-ঢালা রচনার চমৎকার উপাচার। এখন আমি কী পেয়েছি দেখ!’
সে আলতো করে বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা মটকাল আর সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পবাসে এক মোহময়ী তরুণীর উদয়, ‘আমি কি আপনার সেবা করতে পারি?’
অবশ্যই সে করতে পারত। কিন্তু মর্ডিকাই শুধু দুজনের জন্য দুটো পানীয় অর্ডার করল, তাতে আমার কোনো সান্ত্বনা ছিল না।
‘ভেবেছিলাম’ সে বলল, ‘নয়তো নতুন পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে, মাত্র। কিন্তু এখন আমি জানি, কোনো মতেই খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
‘তোমার কাছে সেধে আসা পরিস্থিতির সুবিধা, তুমি তো প্রত্যাখ্যান করতেই পার।’
‘পারি কি?’ তুমি সকালে আমাকে দেখেছিলে। আমি যদি একটা ট্যাক্সি প্রত্যাখ্যান করি, পরক্ষণেই আরেকটা এসে দাঁড়ায়। যদি পঞ্চাশবারও প্রত্যাখ্যান করি, একান্নতম ট্যাক্সি ঠিক চলে আসবে। ওরা আমায় ছিঁড়ে খায়।’
‘বেশ, তবে তোমার অফিসের আরামে বসে প্রত্যকদিন এক দু ঘণ্টা চিন্তার সময় রাখ না?’
‘ঠিকইতো! আমার অফিসের আরামে। আমি তখনই ভালভাবে চিন্তা করতে পারি, যখন আমি পায়ে পায়ে রাস্তার কোণে হাঁটছি বা ওয়েটিং রুমে গ্র্যানাইটের চেয়ারে বসে রয়েছি কিংবা খালি ডাইনিং টেবিলে ক্ষিধে নিয়ে বসে আছি। আমার প্রচণ্ড রাগের আবেগ চাই।’
‘কিন্তু এখন কি তুমি প্রচণ্ড রেগে নেই?’
‘এটা এক জিনিস নয়। অবিচারের কারণে একজন রেগে যেতে পারে, কিন্তু যারা তোমার প্রতি যত্নশীল, চিন্তাশীল, তাদের ওপর কি করে রেগে উঠবে? সংবেদনশীল না হয়ে অভব্য গোঁয়ারের মতন! আমি এখন রেগে নেই। শুধু বিষণ্ন। বিষণ্ণ থাকলে আমি লিখতে পারি না।
‘এক ঘণ্টার খুশি’তে, আমরা অসুখী বসে রইলাম, যা আমি কখনো থাকিনি।
‘শপথ করছি জর্জ,’ মর্ডিকাই বলল, ‘আমার মনে হয় আমার অভিশাপ লেগেছে। আমার খৃষ্টান হবার সময় হয়তো কোনো পরী ধর্মমা নিমন্ত্রিত না হওয়ায় ক্রোধান্বিতা হয়ে শেষে একটাই জিনিস খুঁজে পেলেন, যা প্রত্যেকবারের অবস্থিত বিলম্বের চেয়ে অনেক মন্দ। তিনি খুঁজে পেয়েছেন সার্বিক ইচ্ছা পূরণের অভিশাপ।
তার দুঃখ দেখে আমার মতো পুরুষের চোখেও জল এল।
এই চিন্তায়, আমিই সেই পরী ধর্মমা, যার উল্লেখ সে করছে আর কোনো ব্যাপারে হয়তো তা বার করে ফেলতেও পারে। যতটা হোক, সত্যিই যদি পারে, হয়তো আত্মহত্যা করে বসতে পারে বা তার চেয়েও খারাপ কিছু, আমাকেই খুন করে ফেলবে।
তারপর এল। চরম ভয়। বিলের জন্য ডাক দিয়েই এবং অবশ্যই তক্ষুনি তা এসেও গেল। সে নিষ্প্রভ চোখে পরখ করে আমার দিকে ঠেলে দিল এবং ফাঁকা দম ফাটানো হাসি হেসে বলল, ‘এই যে, তুমি এটা মিটিয়ে দিও। আমি বাড়ি চললাম।
আমাকে মেটাতেই হল। অন্য কোনো পথ তো ছিল না। বুকের সেই ব্যথা আজও বৃষ্টিভেজা দিনে চিন্ চিন্ করে। যতই হোক আমি যে সূর্যের আয়ু আড়াই নিযুত বছর কমিয়ে দিয়েছিলাম শুধু এক পানীয়ের দাম দিতে হবে বলে! এই কী বিচার!
মর্ডিকাই এর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ঘটনাক্রমে জানতে পারি, সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে আর দক্ষিণ সাগরে কোনো সৈকতে ভবঘুরের মতন উঞ্ছবৃত্তি করে চালায়, যাকে বলে beachcomber। বীচ্কোম্বার ঠিক কি করে, আমার জানা নেই, তবে সন্দেহ হয়, তাতে লোকে ঐশ্বর্যশালী হতে পারে না। তবে আমি নিশ্চিত, সৈকতে দাঁড়িয়ে, যদি সে ঢেউ চায়, তবে ঢেউ তক্ষুনি আসবেই আসবে।
.
ইতিমধ্যে নাক সিঁটকানো এক চাপরাশি আমাদের মধ্যে বিল এনে রেখেছে। যেন রাগের চোটে জর্জের তা চোখেই পড়ল না। যা সচরাচর সে করেই থাকে।
আমি বলি, ‘আমার জন্য আজাজেল্ যদি কিছু করে, তুমি সে সম্পর্কে ভাবছ না জর্জ? ভাবছ কি?’
‘সত্যি বলতে কি না’ জর্জ বলল, ‘দুর্ভাগ্যবশত বন্ধু, ভাল কাজের সঙ্গে যারা জড়িয়ে থাকে, তুমি তো তাদের একজন নও।
‘তাহলে, তুমি আমার জন্য কিছু করবে না?’
‘একটা জিনিসও নয়।’
‘বেশ’ আমি বলি, ‘তাহলে আমি বিলটাই মেটাই।’
‘এটাই তো একমাত্র কাজ যা তুমি করতে পার।’ জর্জ বলল।