লেখাপড়া
আমার ঠাকুরদা, বড় ঠাকুর (= বড় ঠাকুরদা=প্রপিতামহ) স্কুলের যে শেষ পরীক্ষা পাশ করেছিলেন, কলেজপূর্ব সেই সার্বজনীন পরীক্ষার নাম ছিল এন্ট্রান্স। বাংলায় বলা হত প্রবেশিকা পরীক্ষা। সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে পরীক্ষা পরিচালনা করা হত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক সীমা তখন ছিল বিশাল। এখনকার বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, অসম এমনকী রেঙ্গুন, একালের মায়নামারের ইয়াঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই সাম্রাজ্য।
এন্ট্রান্স পরীক্ষার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দশ হাজারে উঠতে চার যুগ পেরিয়ে গিয়েছিল। এখন তো যে কোনও জেলাতেই পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দশ হাজার পেরিয়ে যায়।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা উঠে গেছে সেও নব্বই বছর হয়ে গেল। আমাদের ছোটবেলায় এন্ট্রান্স পাশ ব্যক্তিদের দেখেছি। এমনকী এন্ট্রান্স ফেল লোকেরা দাবি করতেন আমাদের সময়কার গ্র্যাজুয়েটদের থেকে তাঁরা বেশি লেখাপড়া জানেন। যে কোনও ছাত্রের এন্ট্রান্স পরীক্ষার অধিকার ছিল না, স্কুল থেকে বিশেষ কড়াকড়ি করা হত।
এই শতকের প্রথম দশকের শেষে এন্ট্রান্স অবলুপ্ত হল। এন্ট্রান্স পাশ কেউ এখন আর বোধহয় বেঁচে নেই, শেষ প্রাগৈতিহাসিক ব্যক্তিটি দশ-বিশ বছর আগে নিঃশব্দে লোকচক্ষুর অন্তরালে পরলোকগমন করেছেন।
এন্ট্রান্সের পরে এল ম্যাট্রিকুলেশন, সংক্ষেপে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। নীতিবাগীশ এক সংস্কৃত পণ্ডিত এর নামকরণ করেছিলেন মাতৃকুলনাশন পরীক্ষা। তবে বাংলায় প্রবেশিকা পরীক্ষাই বলা হত।
প্রবেশিকা অর্থে বিদ্যালয়ের পড়া সাঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পরীক্ষা। এই নামকরণের মধ্যে একটা ব্যঞ্জনা স্পষ্ট যে এই পরীক্ষা কোনওমতে পাশ করলেই কলেজে পড়া যাবে। এখন আর সমতুল্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যঙনা মোটেই অর্থবহ নয়। সবাই কেন অনেকেই কলেজে ভর্তি হতে পারে না।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা চার দশকের কিছু বেশিকাল চালু ছিল। আমি আর আমার বাবা-কাকা সবাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। মনে আছে ক্লাস নাইনে উঠে সব খাতা বইয়ে মোটা হরফে লিখেছিলাম,
তারাপদ রায়
প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী, ১৯৫১।
ওই ১৯৫১ ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষার শেষ বছর। পরের বছর থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হল। পরীক্ষা পরিচালন ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা থেকে স্বয়ংশাসিত পর্ষদের হাতে চলে গেল।
এর পরের ইতিহাস খুব জটিল। কোথাও কোথাও স্কুল ফাইনাল রইল, ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক চালু হল। এগারো ক্লাসের পরীক্ষা। অনেকটা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ধাঁচে। এদিকে পাশাপাশি স্কুল ফাইনাল পাশ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে পি ইউ বা প্রিইউনিভার্সিটি, তার জন্যে কলেজে পড়তে হবে।
সম্প্রতি বছর বিশেক দশ ক্লাস আর বারো ক্লাস, মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক কিঞ্চিৎ স্থিতাবস্থায় এসেছে। সে সম্পর্কে কিছু কিছু বলার আছে। কিন্তু আর আলোচনা নয়।
সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। মোটামুটি প্রতি তিনজনে দু’জন পাশ করেছে। এ এমন একটি পরীক্ষা যার সঙ্গে শহর-গ্রাম, ধনী-দরিদ্র, বালক-বৃদ্ধ সকলের নাড়ির যোগ আছে। সকলেই খোঁজ নেয়, মহামায়া স্কুলের রেজাল্ট কেমন হল, বাবলি কি স্টার পেয়েছে, চয়ন কি আবার ফেল করল।
পাশ ফেলের কথা যাক। আমার এই ষাট বছরের জীবনে দেখেছি কত পাশ করা লোক জীবন যুদ্ধে ডাঁহা ফেল। আবার কত ফেল করা লোককে হই হই করে বাঁচতে দেখেছি।
গরমে প্রসারিত হয় এবং ঠান্ডায় সংকুচিত হয় এর একটা উদাহরণ দিতে বলা হয়েছিল একটি ছাত্রকে। ছাত্রটি উত্তর দিয়েছিল, ‘দিন। দিন, স্যার। গ্রীষ্মকালে গরমে বেড়ে যায় আবার শীতকালে ঠান্ডায় ছোট হয়ে যায়।’
একটি ছাত্রকে আফ্রিকার তিনটি জন্তুর নাম করতে বলা হয়েছিল, সে বলেছিল, ‘সিংহ, সিংহী আর সিংহের বাচ্চা।’
অন্য একজনকে ‘মিছরির ছুরি’ এই ব্যঞ্জনাময় শব্দদ্বয় দিয়ে বাক্যরচনা করতে দেওয়া হয়েছিল। সে লিখেছিল, ‘আজকাল মিছরির ছুরির দাম খুব বাড়িয়া গিয়াছে।’
এই সব উত্তরদাতারা কেউই ভাল ছাত্র ছিল না। এই তিনজনকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। অল্প বয়সের স্কুলের পরীক্ষায় এরা ভাল করতে পারেনি। কিন্তু জীবনের বড় পরীক্ষায় চমৎকার পাশ করেছে।
সর্বশেষে সেই মাননীয় অধ্যাপককে স্মরণ করি। ভদ্রলোক ছিলেন জৈব রসায়নের পণ্ডিত। পরে তাঁর ঝোঁক পড়েছিল একই সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদ্যায়।
এ সমস্তই ঠিক ছিল।
কিন্তু মন্দভাগ্য ছিল তাঁর পোষা বেড়ালটির। যেমন হয়, গঙ্গা-যমুনা নামে সেই সাদা-কালো বেড়ালটি দুধ-মাছ খেতে ভালবাসত।
অধ্যাপক মহোদয় দীর্ঘ গবেষণা করে জেনেছেন দুধ-মাছের যা খাদ্যগুণ সবই জলে সিদ্ধ করা খবরের কাগজে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধি বাড়ে।
এবার হতভাগ্য বেড়ালটিকে তিনি দুধ-মাছ বন্ধ করে খবরের কাগজ খেতে দিতে লাগলেন। একজন সাংবাদিক একথা শুনে অধ্যাপকের খোঁজ নিলেন। কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গেছে।
অধ্যাপক বললেন, ‘দেখুন কী দুঃখের কথা, আমার বেড়ালটা সব সংস্কার তুচ্ছ করে যেদিন কাগজ খাওয়া শুরু করল, সেদিনই মারা গেল।’