লেখক হওয়া

লেখক হওয়া

কলকাতা থেকে শ্যামল এসেছিল। আজই ফিরে গেল। ওকে মোতিমহলে খাইয়ে তারপর নিউদিল্লি স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এলাম।

মনটা খুব ভালো লাগছিল। ও চলে গেল বলে নয়, অনেকদিন পর কাউকে স্টেশনে এসে সী-অফফ করলাম বলে। আগে যখন অবকাশ বেশি ছিল, সচ্ছলতা ছিল না তখন এমন ছোটো ছোটো সুখের বড়ো আনন্দগুলি আমার করায়ত্ত ছিল। আজ ব্যস্ততা বেড়েছে, সচ্ছল হয়েছি, কিন্তু জীবন থেকে উদবৃত্ত সময় গেছে উধাও হয়ে। প্রায়ই মনে হয়, আগে খারাপ থাকলেও এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ছিলাম।

ট্রেন ছাড়ার আগে শ্যামল বলল, তুই তো এখন আমাদের গর্ব। আমার এক পিসতুতো শালি আছে জুঁই, সে তো বিশ্বাসই করে না যে তুই আমার বন্ধু। খুব সুন্দরী, সপ্রতিভ মেয়ে। যদি কখনো কলকাতা আসিস একদিন কিন্তু আমার সঙ্গে যেতেই হবে ওদের বাড়ি। নইলে আমার মুখ থাকবে না।

আমি বাল্যবন্ধুকেও কৃতার্থ করার ভঙ্গি করে হেসে বললাম, কলকাতা যখন যাই, তখন মনে করিয়ে দিস।

শ্যামল বলল যাই-ই বলিস, ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, উকিল, সরকারি বা বেসরকারি অফিসার যাই-ই হতিস না কেন এমন পরিচিতি বা সম্মান আর কোনো কিছুতেই পেতিস না। লেখককে কে না চেনে, কে না সম্মান করে? সত্যিই আমরা সকলেই তোকে নিয়ে খুব প্রাউড।

হৌজ-খাস-এ বাড়ি করেছি আমি। সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড ফিয়াটও কিনেছি একটা। আমার লেটেসট বই খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। অনেকে বলছেন কোনো প্রাইজ-টাইজও পেয়ে যেতে পারি। প্রাইজে অবশ্য আমার প্রয়োজন নেই, পাঠকের হৃদয়ের প্রাইজ পেয়েই আমি খুশি।

বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে লেখার টেবলে এলাম। সাধারণত রাতেই লিখি। নিরিবিলিতে গভীর রাত অবধি লিখে আটটা অবধি ঘুমোই। রিমা প্রথম প্রথম রাগ করত কিন্তু এখন বোঝে যে, লেখাই আমার জীবিকা। জীবিকার কারণে কোনো কিছুতেই ‘না’ বলা চলে না।

রিমা গেছে বাপের বাড়ি। এলাহাবাদে ওর খুড়তুতো বোনের বিয়ে। আমি বিয়ের দিন সকালে গিয়ে পৌঁছোব ঠিক আছে।

চিঠিগুলো প্রথমে একজায়গায় করে তারপর সব ক-টি লেটার ওপেনার দিয়ে খুলে ফেলে তারপরে এক এক করে পড়ি আমি। দিনের শেষে এই-ই আমার পরমপ্রাপ্তি। কত জায়গা থেকে কত বিভিন্ন বয়েসি এবং সমাজের কত বিভিন্ন স্তরের মানুষ যে চিঠি লেখেন। যতই কাজ থাকুক, প্রত্যেক চিঠির জবাব আমি নিজে হাতেই দিই। সময়াভাব এবং ডাক মাশুলের কারণে অসুবিধা যে হয় না, তা নয়। তবে, দেখি কতদিন পারি এই অভ্যাস বজায় রাখতে।

বেশিই প্রশংসার চিঠি, ভালোলাগার চিঠি। কিছু পুরোনো পাঠক-পাঠিকার লেখা, যাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই চাক্ষুষ পরিচয় নেই। কিন্তু চিঠির মাধ্যমে যাঁদের সঙ্গে এক আশ্চর্য উষ্ণ সহমর্মিতার উজ্জ্বল হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুধু চিঠিরই মাধ্যমে। খুব ভালো লাগে আমার দিনের এই সময়টুকুতে। দেশ-বিদেশের জানালা খুলে যায় চোখের সামনে। দু-কলম লিখতে পারি বলে এক ধরনের নিরুচ্চারিত শ্লাঘাও বোধ করি।

একটি চিঠি খুলেই চমকে গেলাম। হাতের লেখাটি পরিচিত নয়। মেয়েলি। বেশ ভারী, অনেক পাতার।

মান্যবরেষু,

লেখক হয়ে তো খুব নাম ডাক করেছেন। ছিলেন উপোসি ছারপোকা এখন তো পোয়াবারো। লিখুন, লিখে বড়োলোক হোন এসব তো ভালোই। খ্যাতি-প্রতিপত্তিও বাড়ুক দিনকে দিন। কিন্তু আমার এমন সর্বনাশ না করলেই কি চলত না আপনার? কোনো ক্ষতি তো করিনি আমি বা আমার স্বামী! অথচ এ আপনার কেমন ব্যবহার?

আপনি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সম্বন্ধে কতটুকু জানেন? আমরা দুজনে বড়োছেলে এবং বউমা হিসেবে ওঁদের জন্যে কী করি না-করি সে সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণাই নেই। আশা বলে যে গল্পটি আপনি দিল্লির দিগঙ্গন কাগজে মাসখানেক আগে লিখেছিলেন সেটি যে কাদের নিয়ে লেখা তা আমরা আপনার, এবং আমার স্বামীরও, একজন বন্ধুর কাছ থেকেই জানতে পারি। ছি: ছি:।

আপনি কি জানেন যে, বার্নপুরে আমরা কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছি না, পারছি না বহরমপুরেও যেতে। কারণ ওই গল্পর কথা আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির গোচরেও আনা হয়েছে। আপনি গল্প লিখেই ক্ষান্ত হননি, প্রত্যেককে পাঠিয়েছেনও তা। কী অন্যায়-অপরাধ করেছিলাম আমরা আপনার কাছে তা জানতে পারি কি?

ছি: ছি:। আমার স্বামী ভেবে ভেবে এবং দুঃখে-অভিমানে একদিনও রাতে ঘুমোতে পারেন না। তিনি কী অসম্ভব রোগা হয়ে গেছেন যে, তা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আমার স্বামীর কিছু একটা হয়ে গেলে আমি আপনার বিরুদ্ধে পুলিশ-কেস করব। একথা জানবেন।

আপনাকে আমি ঘেন্না করি। আপনি লেখক না ছাই। আপনি আমার স্বামীর বন্ধু নন; শত্রু। আপনার মঙ্গল কখনো হবে না।

পু:—আমার স্বামী জানেন না যে এ চিঠি আমি লিখেছি আপনাকে।

ইতি আপনার অনেক পাঠিকার একজন পাঠিকা।

চিঠিতে তারিখ নেই, কোথা থেকে লেখা তাও বলা নেই, লেখিকার নাম পর্যন্ত নেই। খামটা উলটে-পালটে দেখলাম, বার্নপুর পোস্ট অফিসের সিল দেওয়া।

হঠাৎই আমার বুকে যেন কেউ ছুরি বসিয়ে দিল। এমন কষ্ট হতে লাগল বুকের মধ্যে যে কী বলব। চেয়ার ছেড়ে উঠে আমি খাবার টেবলে গিয়ে জল ঢেলে খেলাম। তবুও অস্বস্তি গেল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম ইজিচেয়ারে।

পুজো এসে গেছে। বেশ হিম হিম ভাব এখন সন্ধের পর। বাইরে হ্যালোজেন ভেপার ল্যাম্পের বুড়ি—কমলারঙা আলোয়-ভাসা পথটা সফদার জাঙ্গ-এর দিকে চলে গেছে।

ভাবতে ভাবতে সিগারেটে আঙুল পুড়ে গেল যখন, তখন হুঁশ হল। আবারও একটা সিগারেট ধরালাম।

লেখক হয়েছি কি না জানি না। লেখালেখি করি এই পর্যন্ত। এই লেখালেখির কারণেই মোটামুটি সুখের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছি আজ পনেরো বছর হল। সরকারি চাকরি। কাজ ছিল না তেমন, উন্নতির সম্ভাবনাও নয়, তবে বাঁধা মাইনে। তবে উপরিও ছিল, যারা নিত, তাদের জন্যে। নামসই করা আর বাকি সময়ে রাজনীতি, খেলা, সিনেমা, সাহিত্যর আলোচনা অফিসেরই কাজের সময়টুকুতে। পেনশন পর্যন্ত ছিল। সেখানে কাজ ছাড়া আর কোনো কিছু করতেই অসুবিধে ছিল না। অনেকেই বকেছিলেন যে অমন বিনা-কাজের না-যাওয়া চাকরি কেউ ছাড়ে? ওটাও থাক। লেখাও থাক।

তবু, ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে, লেখা ব্যাপারটা পার্ট-টাইমের নয়। পার্ট-টাইম স্টেনো-টাইপিস্ট হওয়া যায়, অ্যাকাউন্ট্যান্ট অথবা ডাক্তারও; কিন্তু লেখক নয়। আমাদের পূর্বসুরীদের মধ্যে অধিকাংশই তো ছিলেন হোল-টাইম লেখক। কিন্তু রিমা জানে আর আমিই জানি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর কতখানি আর্থিক ও মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল আমাদের।

যখন হোল-টাইম লেখক ছিলাম না, তখন দূর থেকে লেখার জগৎকে মনে হত দেবলোকের কোনো সভা। সরস্বতীর বরপুত্রদের সঙ্গমস্থলই বুঝি। সেই জগতেই সব পিছুটান ছেড়ে এসে ঢুকে পড়ার পরই হাড়ে হাড়ে জানতে পেলাম সেই জগতের ক্ষুদ্রতা নীচতা।

সাহিত্যের জগতেও অন্য যে-কোনো জীবিকারই মতো একে অন্যকে মাড়িয়ে যাওয়ার, ঠেলে ফেলার প্রবণতা, এখানেও ঈর্ষা, দ্বেষ; এখানেও অসুস্থ অর্থ এবং যশের কাঙালপনা, তা আগে একেবারেই জানা ছিল না।

সাহিত্য-জগৎ আমকে ক্লিষ্ট করেছে, বিমর্ষ করেছে, হতও করেছে। কারণ, এই-ই আমার জীবিকা। হয়তো সব জীবিকাই করে। অনেক অনেক অনেকই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে এসে আমি লেখক হয়েছি। মানে, হওয়ার চেষ্টা করছি আর কী! তবু এই চিঠিটির কষ্টটা আমাকে যেন একেবারে বিবশ করে দিল। চিঠিটি পড়া শেষ করে কোনোই সন্দেহ থাকল না যে এটি আমার বন্ধুপত্নী লিলির লেখা।

আমরা তিন বন্ধু ছিলাম। বড়ো কাছের বন্ধু। তিনজনেই কলকাতায় পড়তাম ইউনিভার্সিটিতে। হিন্দু হস্টেলে থাকতাম। লিলির স্বামী সুগতই সবদিক দিয়ে ভালো ছিল আমাদের মধ্যে। পড়াশুনোয় ভালো। রাশভারী। এবং প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব ছিল তার। অথচ রসিকও ছিল অত্যন্ত। বহরমপুরের ছেলে। অতিভালোমানুষ। ওকে দেখে ছোটোবেলা থেকেই আমার ধারণা হয়ে গেছিল যে, বহরমপুরের লোকমাত্রেই ভালোমানুষ।

দ্বিতীয়জন ছিল শ্যামল। যে শ্যামল আজ চলে গেল। শ্যামল সরকার। আর ছিলাম তৃতীয় আমি। এই অধম আশিস কর। বন্ধুরা ডাকত, আকর বলে।

আমরা তিনজনেই ভালো ফুটবল খেলতাম। সুগত ইউনিভার্সিটির ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিল। রাইট-ইন-এ খেলত। চমৎকার। বলের ওপর এমন কন্ট্রোল বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দেরও দেখিনি।

সেই সব রঙিন জার্সি-পরা খোলা-হাওয়ায় পরিশ্রমজনিত ঘামের গন্ধের দিনগুলি হারিয়ে গেছে। আর আসবে না কখনো। তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছাত্রাবস্থার অনাবিল, নি:স্বার্থ, উজ্জ্বল সব বন্ধুত্ব। জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ামাত্রই যেন মানুষের মাপ ছোটো হতে থাকে। সেই ক্ষয়রোগে বড়ো বড়ো মানুষ নুনের পুতুলের মতো গলে গলে ছোটো হয়ে যায় চোখের সামনে। তাদের সংসারের দায়দায়িত্ব বাড়ে, টাকা বাড়ে অথবা কমে। অহং বাড়ে, অথবা হীনমন্যতা, ঈর্ষা বাড়ে, দম্ভ বাড়ে, পরশ্রীকাতরতা ও দৈন্য; রোজগার বাড়ার বা কমার সঙ্গে সঙ্গে। আর তার ভেতরের মানুষটা লিলিপুট হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ।

মনে পড়ল, সুগতর বিয়েতে আমি বরযাত্রীও গেছিলাম। বার্নপুরেই বড়ো চাকরি করতেন লিলির বাবা। বিয়েটা ঠিকও হল এই কারণেই। বাবাই বি-এস-সি পাস ভাবী জামাইকে একটি প্রমিসিং চাকরি জুটিয়ে দিলেন বার্নপুরে। চমৎকার পরিবার, খুব হাসিখুশি নম্র-স্বভাবা মেয়ে লিলি। বড়োলোক বাবা মা-র একমাত্র মেয়ে। আদুরে, খেয়ালি। বিয়ের পর আমরাই ফিরে গেলাম আবার বর-বউকে নিয়ে বহরমপুরে সুগতদের আদি বাড়ি।

সুগতরা এক বোন এক ভাই। সুগতর বাবা মা এখন অত্যন্তই বৃদ্ধ। মেসোমশাইয়ের বয়স প্রায় আশি হতে চলল, মাসিমার বয়সও সত্তর-টত্তর হবে। বোন সীমা, বিয়ের তিনবছর পর বিধবা হয়ে ফিরে আসে। বাবা-মাকে দেখাশোনা করে। বাড়িতে একটি গানের স্কুলও করেছে। কলকাতার গীতিবিতান না দক্ষিণী, কোথাকার ডিপ্লোমা ছিল। বাড়িতে কিছু মেয়েও আসে গান শিখতে। তাতে কিছু রোজগার হয়। মেসোমশাই ইনকামট্যাক্স অফিসার ছিলেন। সৎ, কড়া অফিসার। রিটায়ার করার আগে ও পরে যা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড-টাণ্ড পান তা মেয়ে ও ছেলের বিয়েতে পুরোটাই তুলে ফেলেন। সুগতর মুখেই শুনেছি আমি যে, মেসোমশায় মাসিমাকে বলতেন, ছেলে আর মেয়েই দেখবে আমাদের বুড়োবয়সে। ওরা ছাড়া আমাদের আর কে-ই বা আছে। ওরাই তো আমার ইনস্যুরেন্স।

মাঝে মাঝে চিঠি পেতাম সুগতর, বার্নপুর থেকে। তার চেয়েও বেশি খবর গত পাঁচবছর হল পাচ্ছি শ্যামলেরই মাধ্যমে। কারণ, শ্যামল ই. সি. এল-এর বড়োসাহেব এখন। আসানসোলেরই কাছে ওর হেড কোয়ার্টার। শ্যামল বলত বুঝলি আকর, সুগতটা একটা অমানুষ হয়ে গেছে। লিলির বাঁদর। লিলির কথায় ওঠে বসে। একেবারে ঘরজামাই হয়ে গেছে। নিজের অতবড়ো কোয়ার্টার থাকা সত্ত্বেও শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনার জন্যে শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। বাড়িটা তো ওই-ই পাবে।

তা, কী আর করবে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেছে। উপায়ই বা কী? স্ত্রীর মা-বাবাকেও তো ফেলে দিতে পারে না। তুই হলে, তুইও হয়তো অমনই করতিস।

সেটা বুঝি। তবু তা বলে, শ্যামল বলত, নিজের বাবা-মাকেও কি ফেলে দেওয়া উচিত?

শ্যামল মাঝে মাঝেই অফিসের কাজে দিল্লিতে আসে। ওবেরয় হোটেলে ওঠে। আমাকে আর রিমাকে খেতেও ডাকে প্রায়ই। মোগলাই বা চাইনিজ। আমাদের বাড়ি নেমন্তন্ন করলে আসতেই চাইত না। বুঝতে পারতাম, ওকে নানাভাবে খাতির করার লোক আছে দিল্লিতে অনেকই। ওর চারধারে নানা ধরনের লোক ঘুর ঘুর করত। বাইরে এয়ার কণ্ডিশনড মার্সিডিস গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত চব্বিশ ঘন্টা।

শ্যামল এসেছিল গতমাসেরও প্রথমে। সেবার যা বলে গেল সুগত সম্বন্ধে তা শুনে মনে বড়োই ব্যথা পেয়েছিলাম। ওর চলে যাওয়ার পরও অনেক দিন পর্যন্ত ওই ঘটনা মাথার মধ্যে ঘুরত। শেষে নাম স্থান কাল পাত্র সব বদলে একটি গল্প লিখে পাঠিয়ে দিলাম দিগঙ্গন-এ। দিল্লির ‘‘দিগঙ্গন’’ যে অতদূরে বার্নপুরে সুগতর হাতে এত তাড়াতাড়ি পড়বে তা ভাবিনি। পড়লেও এই লেখা পড়ে বড়োজোর নিজের জীবনের ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে পারত, কিন্তু ওর বাবা-মায়ের অসহায়তার কথা শ্যামলের মুখে শুনে যে আমি ওই গল্প লিখেছি একথা মনে করার কোনো কারণ ওর থাকার কথা নয়।

সুগতর বিধবা বোন, সীমা হঠাৎই কোনো অজ্ঞাতকারণে আত্মহত্যা করেছে। শ্যামলই বলেছিল। একটি বড়ো মেহগনিগাছ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে। মাসিমা-মেসোমশায়কে দেখাশোনার জন্যে একজনও চাকর ছিল না। মাসিমা এখন নাকি নিজেই রান্না করেন। হাই ব্লাডপ্রেশার, ব্লাডসুগারের রুগি। মেসোমশায় তো বলতে গেলে অথর্বই। সুগত মা-বাবাকে দেখাশোনা তো করেই না, মাসে দু-মাসে একশো করে টাকাও পাঠায় না নাকি। মেসোমশায়ের সামান্য পেনশনে ওষুধপত্রর কথা ছেড়েই দিলাম, বুড়ো-বুড়ির না-খেয়েই থাকতে হয়। অথচ সুগতর বাড়িতে লন, কিচেন গার্ডেন, আয়া, বেয়ারা বাবুর্চি, গাড়ি, ড্রাইভার, কোনো কিছুরই অভাব নেই। শ্যামল বলছিল, আশ্চর্য! তবু মাসিমা-মেসোমশাই পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ছেলে বা ছেলে-বউ সম্বন্ধে একটিও খারাপ কথা বলেন না, বলেননি কখনো কারও কাছে। উলটে বরং সবসময় প্রশংসাই করেন।

আমি বলেছিলাম, এমনই যদি ঘটনা তবে আমি আর তুই মেসোমশাইকে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাই না কেন? এ মাস থেকে একশো টাকা করে পাঠাব।

শ্যামল বলল, মাথা খারাপ। সুগত আর লিলি মাইণ্ড করবে না! তা ছাড়া অন্যর যা দায় তা শুধুশুধু নিজেদের মাথায় চাপানোই বা কেন? সুগত তো তোর চেয়ে অনেকই ওয়েল-অফফ। যার যার দায়, যার কপাল তাকে একাই বইতে এবং সইতে দেওয়া উচিত।

লিলি বড়ো মিষ্টি মেয়ে। আমার সঙ্গেও খুবই মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। কত মজা, কথা, গান, কত হাসি। সেই লিলিরই লেখা এই চিঠিটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল।

শ্যামল না জানালে ওদের এটা জানার কথাই ছিল না। একজন লেখকের মনে যা কিছু দাগ কাটে যে-কোনো ঘটনা, তাই নিয়েই তো তিনি লেখেন। এমন কত গল্পই তো লিখেছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, যাতে যাদের নিয়ে লেখা তারা বুঝতে না পারে। গল্পে আমি সুগত বা লিলিকে বিন্দুমাত্র ছোটোও করতে চাইনি। বরং যা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম তা এই প্রজন্মর হৃদয়হীনতা এবং বয়স্কদের আশ্চর্য অসহায়তা। আমি একজন লেখক হিসেবে, দূর থেকে, নিরাসক্ত ভাবে পাঠকদের কাছে তাই-ই পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। লেখক তো পাঠকদের অছিই। পাঠকদের ক্ষতি করা বা দুঃখ দেওয়া কখনো কোনো লেখকেরই ইচ্ছে না। পাঠকরা রোজই যা দেখেন, জানেন, শোনেন তাই আবার দেখেন না বা জানেন না বা শোনেনও না। এইখানেই লেখকের ভূমিকা। লেখকের স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টিতে তিনি যা দেখেন বা জানেন বা শোনেন, পাঠকের কোনো ইন্দ্রিয়তেই সেসব ধরা পড়ে না হয়তো। পড়লেও পাঠক তা প্রকাশ করে বলতে পারে না, লেখক পারেন : এইটুকুই তফাত! আমার সুগত বা লিলির সঙ্গে কোনো ঝগড়া নেই। আমিও কি নিজের মা-বাবাকে খুব একটা দেখাশোনা করতে পেরেছি এতদূর দিল্লিতে বসে? তাঁরা থাকতেন কলকাতায়। কলকাতায় থাকলেও কি খুব একটা পারতাম? আমার দাদারা অবশ্য ছিলেন কলকাতায়। তাঁদের মধ্যেও একধরনের গা-ঠেলাঠেলি মনোবৃত্তি দেখেছি। পকেটে কেউই হাত দিতে চান না। মানুষের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে খরচ করার ইচ্ছার কোনোরকম সাযুজ্য যে আদৌ আছে তা এখন আর মনে হয় না। দাদাদের মধ্যের এই পিপু-ফিসু মনোবৃত্তিতে বাবা-মায়ের যথেষ্ট অসুবিধা এবং অনাদরই হত বলে আমার বিশ্বাস। যতখানি করতে চাই, তার কতটুকুই বা করতে পেরেছি?

সুগতকে ছোটো করতে আমি চাইনি। সত্যিই নয়। সুগতকে নয় বরং আমাকে, শ্যামলকে, আমাদের প্রজন্মর সকলকেই ছোটো করতে চেয়েছিলাম। আমাদের এই প্রজন্মর স্বার্থপরতা সম্বন্ধে সচেতন করতে চেয়েছিলাম। যাতে এই লেখাটি পড়ে একটু ভাবেন এই প্রজন্মর সবাই, তাই-ই চেয়েছিলাম। যদি মাসিমা-মেসোমশাইদের বয়েসি কেউ এ লেখাটি পড়েন তাহলেও তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁদের ছেলের বয়েসি কেউ তাঁদের অসহায়তাকে মন দিয়ে ছুঁতে পেরেছে, সহানুভূতির হাত বুলিয়েছে তাঁদের গায়ে। কিছু করতে পারুক আর নাই-ই পারুক।

কী আমি করব এখন? একদিকে আমার বল্যবন্ধু, সুন্দরী সখী, বন্দুপত্নী লিলি অন্যদিকে আমি একজন লেখক। আমার লেখকসত্তা। লেখা বলতে এবং লেখক বলতে আমি কী বুঝি বা সাহিত্য সম্বন্ধে আমার প্রত্যয় কতটুকু এবং কী তারই পরীক্ষা এখন।

নীচে তাকিয়ে দেখি বড়ো অ্যাশট্রেটা সিগারেটের টুকরোতে ভরতি হয়ে গেছে। লিলির চিঠি নিয়ে কী করব কিছুই ঠিক করে উঠতে পারলাম না।

দুই

আজ সকালের ডাকে সুগতরও একটি চিঠি এলো। ইনল্যাণ্ড লেটার-এ। ওর সুন্দর স্মার্ট হস্তাক্ষরে লেখা। লিখেছে :

আকর,

শ্যামল আমাদের কাছে দিল্লির দিগঙ্গন বলে একটি পত্রিকা পাঠিয়েছিল, আসানসোল থেকে। এবং গত উইক-এণ্ডে এসেওছিল আমাদের এখানে। সেই পত্রিকাতে তোর একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। পড়লাম।

ও বলল যে, তুই আমাকে ও লিলিকে নিয়ে এবং আমার বাবা-মাকে নিয়েই এই লেখা লিখেছিস। বারবারই পড়লাম লেখাটি। তুই সত্যিই আমাদের এই জেনারেশনকে সুন্দর করে তুলে ধরেছিস। কিন্তু আমাদের কথায় বলি যে, আমাদের খারাপত্ব ভালত্বর চেয়ে বড়ো কথা আমাদের অসহায়তাও। এই অসহায়তা আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মার অসহায়তার চেয়েও ভীষণ। যদিও একই গল্পে সব ক-টি পয়েন্ট-অফ-ভিউ প্রোজেক্ট করা যায় না, তবুও আশা করব ভবিষ্যতে আমাদের এই অসহায়তা নিয়েও কিছু লিখবি। এই ইনফ্লেশান, এই ব্রোকেন-ডাউন, ফ্র্যাগমেন্টেড ফ্যামিলি, ছেলেমেয়েদের এই এক্সপেনসিভ শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং আরও নানা কিছুতে এই সমস্যা বড়ো তীব্র হয়ে উঠেছে। যা করা উচিত অথবা যা করতে চাই, বাব-মায়ের জন্যে তার কতটুকুই বা করতে পারি বল?

গল্প হিসেবে খুবই ভালো হয়েছে। কিন্তু শ্যামল এটাতে পার্সোনাল মাত্রা যোগ না করলেই ভালো করত। আসলে লিলি খুবই আপসেট হয়ে পড়েছে। এবং হয়ে থাকবেও হয়তো বেশ কিছুদিন। অফ ওল পার্সনস; তুই ওর অতিপ্রিয় আকরদাও যে এমন দুঃখ দিতে পারিস ওকে, পুরো ব্যাপার না জেনেশুনে, নেহাত ওকেই ছোটো করার জন্যে, এ কথাটা ও ভাবতেই পারছে না। আফটার অল, তুই লেখক বলে, তোর সম্বন্ধে এক বিশেষ ভালোলাগা ও অ্যাডমিরেশন ছিল লিলির চিরদিনই! তোর হয়তো মনে নেই, আমি আর লিলি যেদিন বার্নপুর থেকে বহরমপুরে আমাদের বাড়িতে প্রথমবার এলাম বিয়ের পর বউ নিয়ে তখন তুই একাই গান গেয়েছিলি। আমার আত্মীয়স্বজনরা, লিলি এবং বিশেষ করে মা এখনও সেই গানের কথা বলেন, দীর্ঘ আঠারো বছর পরও ‘‘তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে এলো এলো এলো গো ওগো পুরবাসী।’’ এই গান না? তোর সঙ্গে লিলির সম্পর্ক আঠারো বছরের। আর আমার ছাব্বিশ বছরের।

শ্যামল কেন যে এরকম করল, আমি জানি না। এসব কথা হয়তো শ্যমলই তোকে বলেছিল। আমার মন বলছে। ও যদি এতই জানে তো আমাকে বন্ধু হিসেবে বকতে পারত। রাগ করতে পারত। জানতে পারত, পুরো ঘটনা কী? আসামীকেও তো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া উচিত? বল?

তোর লেখাতে কোনো ম্যালিস নেই। তুই যে নিছক সাহিত্য হিসেবেই ব্যাপারটা নিয়েছিস তা আমি পড়ে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, শ্যমল খুব সম্ভব দিল্লির ওই ম্যাগাজিনের অনেকগুলি কপি কিনে বা জেরক্স করে লিলির এবং আমার পরিচিত ও অর্ধপরিচিত সকলের কাছেই পাঠিয়েছে।

কারণ?

কারণ নিশ্চয়ই আছে। সেটা তোর কাছে চুকলি করতে চাই না কারণ আমার চরিত্রর সঙ্গে শ্যামলের চরিত্রর তফাত আছে। শ্যামলের যা আয় তার সঙ্গে ওর লাইফ-স্টাইল ও সম্পত্তির কোনোই সাযুজ্য নেই। আকর, এই যুগে এই সময়ে আমরা সকলেই হয়তো মারজিনালি সৎ বা অসৎ। জীবনের সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু শ্যামল আউট-এ্যাণ্ড-আউট অসৎ হয়ে গেছে। ও যে আমার বাড়িতে আসে এটা এখানের আমার অনেক বন্ধুরই পছন্দ নয়। তা ছাড়া, যা কানাঘুষোতে শুনি, উৎকোচের সঙ্গে উৎকট সব দুশ্চারিত্রিক ব্যাপার-স্যাপারেও জড়িয়ে পড়ছে। বোধহয় সুন্দর সব কিছু নষ্ট করে আনন্দ পায় আজকাল। তার মধ্যে সুন্দর সম্পর্কও পড়ে।

যাই-ই হোক, আকর, আমার বন্ধু খুবই কম। বুড়োবয়েসে অ্যাকোয়েনট্যান্স হয়, বন্ধু হয় না। তাই আমি তোকে ভুল বুঝিনি, তুইও বুঝিস না। লিলিকে ক্ষমা করিস, যদি দেখা হলে তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তুই বরং, আমি না লিখলে, এদিকে আসিসই না। সব শান্ত হয়ে গেলে আমিই তোকে গ্রিন-সিগন্যাল পাঠব। আমার স্ত্রী একজন আলাদা ব্যক্তি। তার ব্যক্তিত্বকে আমি সম্মান করি। তাই ও যখন বুঝতে চায় না, আমিও জোর খাটাতে চাই না তার ওপর।

শ্যামল কি আমাদের বন্ধু? এই প্রশ্নটা আমাকে বড়োই পীড়িত করেছে। হয়তো তোকেও করবে। যে-বন্ধু, অন্য বন্ধুদের মধ্যের সম্পর্ক নষ্ট করে সুখ পায় তাকে কি বন্ধু বলা উচিত? তবুও বন্ধু যদি-বা নাও-ও হয়, তবু ওর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিত নয় আমাদের, যদি না সে শত্রু হয়ে ওঠে। মুজতবা আলির ‘দেশে-বিদেশে’তে আছে না, ভাই গেলে ভাই আবার জন্মাতে পারে, বন্ধু গেলে কি বন্ধু আর পাওয়া যায়?

ভালো থাকিস। এখন সমসাময়িক আমাদের অনেকেরই পরিচয় তোরই বন্ধু হিসেবে। কোনো পার্টিতে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকে আমার সঙ্গে অন্যর আলাপ করিয়ে দেন, ‘‘এই যে, আশিস কর, সাহিত্যিকের বাল্যবন্ধু সুগত চ্যাটার্জি।’’

আই ফিল লেজিটিমেটলি প্রাউড বাউট ইট। কিন্তু শ্যামল আমাদের সমস্ত পরিচিতদের কাছেই কাগজটি পাঠিয়েছে এবং আমাদের আইডেনটিফাইও করেছে বলে এখন মুখ দেখাতে পারছি না কারও কাছেই। জনে-জনে গিয়ে তো আর ‘‘শুনুন মশাই আসল ব্যাপারটা হচ্ছে…’’ বলে বোঝাতে বসতে পারি না।

আবারও বলছি, ভালো থাকিস। এসব পাসিং ফেজ। লিলি কুল-ডাউন করে যাবে। একটু সময় দে। রিমাকে আমার শুভেচ্ছা জানাস। একবার বেড়িয়ে যাস এসে শীতকালে। আমার গ্রিন-সিগন্যাল পেলেই। এখানের শীত দিল্লির তুলনায় অনেক মাইল্ড।

—ইতি তোর সুগত

সকালে সাহিত্য আকাদেমিতে ড. সাহার কাছে একবার যাওয়ার ছিল একটি বইয়ের হিন্দি অনুবাদের ব্যাপারে। ফোন করে ক্যানসেল করতে হবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

বড়োই ভারাক্রান্ত হয়ে আছে মন। শ্যামল। সংসারে কতই বন্ধুবেশি শত্রু থাকে! অথচ এদের লাভ হয় কী কে জানে? কেন যে এরা এমন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট করে?

চান করে, চা-জলখাবার খেয়ে লেখার টেবলে এসে বসলাম। লিলিকে একটা চিঠি লিখতে হবে। রাগের চিঠি নয়। ভালোবাসারও নয়। একজন পাঠিকার কাছে একজন লেখক যে কেন একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে অন্যরকম হন, হওয়া উচিতও তাঁর, সে কথাই বুঝিয়ে একজন ন্যায্যত ক্ষুব্ধ পাঠিকাকে, প্রায়-আত্মীয়াকে চিঠি লিখতে হবে। বড়ো দুরূহ কর্তব্য।

লিলি, কল্যাণীয়াসু,

হৌজ-খাস নিউ দিল্লি

২৫/৯/৮৪

তোমার চিঠি পেয়ে তোমারই যে চিঠি তা বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে অবশ্য বুঝতে অসুবিধে হয়নি কোনো।

তুমি অচেনা পাঠিকার ভাণ করে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় আমাকে লিখেছ। লিখেছ, লিখে টাকা রোজগার করার জন্যে আমি সুগত আর তোমার নামে কুৎসা করে গল্প লিখেছি।

এইরকম আক্রমণ এই প্রথম নয়। আমার মা তখনও বেঁচে ছিলেন। বাবা গেছিলেন, আগে। আমাদের কলকাতার যৌথ পরিবারে ভাগের মা গঙ্গা পেতেন না। কোনো ভাগের মাই-ই পান না। এতে, আমার অপরাধও কম ছিল না অবশ্য অন্যদের চেয়ে। তবু, ভাগের মা যে সত্যিই গঙ্গা পান না, ছেলেমেয়েরা তাঁর যত কেউকেটা হোক না কেন, তা নিয়ে ‘‘গঙ্গা’’ বলে একটি গল্প লিখেছিলাম।

আমার বউদিরা আমার সঙ্গে একবছর কথা বলেননি। দাদারা মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। আমার চারখানি মিনিবাসের মালিক ছোটোভাই, পাড়ার গুণ্ডাদের দিয়ে আমাকে গুমখুন করিয়ে দেবার মতলবেও ছিল। দাদারা হস্তক্ষেপ না করলে, এতদিনে মরেই যেতাম।

একসময় রিমার সঙ্গে আমার যথেষ্ট মনোমালিন্য ঘটেছিল। সেই সময়েই আমার জীবনে একজন অল্পবয়েসি, সুন্দরী প্রাণবন্ত পাঠিকা খুব কাছাকাছি এসেছিল। একথা তোমাকে প্রথম বললাম। তার খুবই ইচ্ছা ছিল, প্রার্থনা ছিল যে আমি তাকে বিয়ে করে এ জীবনের মতো আমার সব ভার তার হাতেই তুলে দিই। তার লেখক স্বামীকে সে দেবতার মতো পুজো করবে। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না।

আমার জীবনের ওই অধ্যায় নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখি। যখন সেই উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছিল একটি সাপ্তাহিক কাগজে ধারাবাহিকভাবে তখন রিমা, আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন এবং সুগতও বার বার আমাকে বলেন এবং লেখেনও যে এ লেখা বন্ধ করে দিতে। রিমা রাগ করেছিল সবচেয়ে বেশি।

তবুও লেখা বন্ধ করিনি। আজ প্রায় বারো বছর পরে সেই উপন্যাসই এখন বেস্ট সেলার। দিল্লির হৌজ-খাস-এর জমি কিনেছিলাম আমি ওই একটি উপন্যাসের রয়্যালটিতে। বইয়ের বিক্রিটাই বড়ো কথা নয়। মানুষের জীবনে ঘটনা, নানারকম ঘটনা রোজ ঘটে আবার তটরেখার দাগের মতো মুছেও যায়। সাহিত্য সেই সব ঘটনাকে চিরস্থায়ী আনন্দ অথবা দুঃখ অথবা গভীর অনুভবের করে রাখে। শুধুমাত্র সাহিত্যই।

আসল ব্যাপারটা টাকা নয়, সাময়িক প্রশংসা বা নিন্দাও নয়, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে বিশ্বাস। তুমি তোমার যে আকরদাকে চেনো, যে তোমার রান্নাঘরের লাগোয়া খাবার ঘরের টেবলে বসে গীতবিতান খুলে গানের পর গান ভুল সুরে গেয়ে তোমাকে মুগ্ধ করেছে বহুদিন, বহুবার, যে তোমার হাতের চিতলমাছের মুঠার প্রশংসা করেছে অথবা পুদিনা পাতার বড়ার, অথবা তোমার সুন্দর করে সাজবার ক্ষমতার, সেই মানুষটি কিন্তু লেখক নয়, যাকে, তোমরা জানো; চেনো। অথবা আমি নিজেও চিনি জানি যে মানুষটিকে, যে মানুষটির নাম আশিস কর সেও আদৌ লেখক নয়।

লেখক যে, সে কখনো আমার মধ্যে বাস করে কখনো বা করে না। কখনো সে আমাকে ছেড়ে আমার বাইরে সরে গিয়ে টেলিগ্রাফের তারের পাখি হয়ে গিয়ে নীচের লাইন বেয়ে চলে যাওয়া খয়েরি ট্রেনকে দেখে। কখনো বা সে ট্যাফিক-সিগন্যাল হয়ে গিয়ে পথপেরুনো নর-নারী, গাড়ি-বাসকে দেখে। কখনো বা সে ফুল হয়ে যায় সাদা, ক্রীসান্থিমাম বা রজনীগন্ধা— কবরের এপিটাফ-এর পায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে দুধের মতো চোখের জল ঢেলে কাঁদবে বলে।

আমি যাই-ই লিখি, তাই-ই আকর-এর কথা নয়। আশিস কর বলে যে লেখকটি আছেন এসব তাঁর কথা। আমি আর সে এক নই গো লিলি। সে যে কে; তা আমি নিজেও জানি না।

তুমি জানবে না একথা, সুগত জানে। অনেকবছর আগে একজন দাম্ভিক, অগ্রজ অন্তঃসারশূন্য শিল্পীকে আক্রমণ করে একজন কথাসাহিত্যিক একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘দ্যা স্টেটসম্যান-এ। আশিস কর-এর বাবা শ্রীপ্রদীপ্ত কর সেই সমালোচকের নিন্দা করেন তীব্র ভাষায়। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই বললেন ছি: ছি: এ কী! বাবা ছেলেতে কাইজা শুরু করলে তোমরা? এ কী আকর? বাবাও আহত হয়েছিলেন আমার এহেন ‘‘অশ্রদ্ধা’’ দেখে। আমি তখনও বলেছিলাম যে, বাবাকে শ্রদ্ধা করা আর তাঁর সমস্ত মতকে শ্রদ্ধা করাটা একার্থক নয়। মতের বা পথের বা বিশ্বাসের প্রত্যয়ের ঝগড়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কিছুমাত্র মিল নেই। আকর প্রদীপ্তবাবুর অনুগত এবং প্রিয় ছেলে, কিন্তু লেখক আশিস কর প্রদীপ্ত করের কেউই নয়।

লিলি, লেখকমাত্রকেই দাম দিতে হয় জীবনে। দাম না দিয়ে যাই-ই কেনা যাক সে বস্তু থাকে না। সেই গল্প ছিল না একটা! এক পাখিওয়ালা স্টিমারঘাটে বসে পাখি বিক্রি করছিল। স্টিমার প্রায় ছাড়ো-ছাড়ো এমন সময় এক খদ্দের বলল, কত করে?

চারটে টাকায়। পাখিওয়ালা বলল।

বড্ড দাম। যাই হোক, গান তো গায় ভালো?

দারুণ।

দেবে তো দাও।

নাও।

চার-পাখির খাঁচাটি তুলে দিল পাখিওয়ালা।

বদলে একটি চাঁদির টাকা দিল চলন্ত স্টিমারের যাত্রী। জেটি ছেড়ে গভীর জলে একটু দূর যাওয়ার পর রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সেই যাত্রী পাখিওয়ালাকে বলল, মিস্টার পাখিওয়ালা, দ্যাট কয়েন উইল নেভার রিং।

উত্তরে পাখিওয়ালা আকর্ণ হেসে বলল, ‘‘দোজ বার্ডস উইল নেভার সিং’’।

অচল টাকায় বোবা পাখিই পাওয়া যায়। যে দাম যত বেশি দেয়, তার প্রাপ্তি তত বেশি। সাময়িক প্রাপ্তি নয়, চিরকালীন, প্রকৃত প্রাপ্তি।

শ্যামল প্রায়ই আমাকে যা বলত তা শুনে শুনে তোমাদের দুজনের ওপরেই নয়, আমাদের সকলের ওপরেই বড়ো ঘেন্না হয়েছিল। আমাদের বাবা-মায়েদের কথা ভেবে বড়ো দুঃখ হয়েছিল। যাঁরা আমাদের বুকে করে বড়ো করলেন, নিজেদের জীবনযৌবনের সব আনন্দকে গলা টিপে মেরে আমাদের ফুলের মতো বড়ো করে তুললেন, তুলোর মধ্যে করে; সেই আমরাই তাঁদের বৃদ্ধ, অশক্ত অবস্থায় যদি দেখাশোনা না করি তাহলে আমাদের সম্বন্ধে ঘৃণা হওয়া কি অন্যায়?

কোনো গল্প, কোনো উপন্যাসই আসলে একমুঠো নর-নারীর কাহিনি নয়। তারা নাটকের চরিত্ররই মতো চরিত্র। তারা প্রত্যেকেই অন্য অনেকেরই প্রতিভূ। তাদের মুখ দিয়ে, তাদের ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু তাদের নিজেদের কথাই নয় ; অনেকেরই কথা বলতে চান লেখক। এক-একটি যুগের কথা, প্রজন্মের কথা, সময়ের কথা। যা বলা হয় সেটাই আসল, কে বলল সেটা অবান্তর, কে নয় তাও অবান্তর।

এইরকম অভিমান অশিক্ষিত, বোকা, গুমোরসর্বস্ব পাঠককে মানায়, তোমার মতো উচ্চশিক্ষিতা বুদ্ধিমতী এবং লেখকের এমন একজন প্রিয়জনের পক্ষে আদৌ মানায় না। তুমি যে কী করে এমন নিষ্ঠুর এবং বেনামি চিঠি লিখতে পারলে আমাকে, জানি না। সত্যিই জানি না।

মাসিমা-মেসোমশাই কেমন আছেন জানিও। সুগতর মা-বাবার কথাও জানিও। তোমার ছোটোভাই? সে কি এখনও বম্বেতে?

বড়ো করে চিঠি দিও আমাকে। তুমি রাগ করতে পারো, কিন্তু তা বলে আমি পারি না। তোমাকে এবং সুগতকে আমি আগের মতো ভালবাসি। একবার এখানে চলে এসো বেড়াতে। আমার এখানেই উঠো।

শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা—তোমাদের আকর।

তিন

যেদিন আমি এলাহাবাদে রওয়ানা হব সেদিনই আরেকটা চিঠি পেলাম লিলির।

লেখক,

আপনার চিঠি পেলাম। কিন্তু আমার নিজের মত বদলাবার কোনো হেতুই খুঁজে পেলাম না। লেখকের যেমন বিশ্বাস বা প্রত্যয় থাকে, পাঠক-পাঠিকারও থাকে। থাকা উচিত।

দিল্লি গেলে, ওদের কোম্পানির গেস্ট হাউসে অথবা অনেক জানাশোনা কোম্পানিরই গেস্ট হাউস আছে; সেখানেই উঠব। আপনার এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করাই ভালো।

ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। অন্য লোকের সর্বনাশ করে আরও অনেক অনেক রয়্যালটি পান এই প্রার্থনা করি।

—একজন পাঠিকা।

পুনশ্চঃ আমার স্বামী আরও রোগা হয়ে গেছেন।

রিমাকে এলাহাবাদে পৌঁছে এসব ব্যাপারে কিছুই বলিনি। মতপার্থক্য সবচেয়ে সুন্দর এবং সহনীয় শুধু হয় পুরুষে পুরুষে। একটু অসুন্দর হয় পুরুষে-নারীতে হলে। এবং সবচেয়ে অসুন্দর হয় নারীতে নারীতে। রিমা এইসব চিঠির কথা জানলে যে আবার কোন মধুর ভাষায় লিলিকে পত্রাঘাত করবে সে সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট ধারনা ছিল না।

সুতরাং চেপেই গেলাম।

চার

অনেকগুলো বুড়ি বছর ঝরাপাতার মতো হাওয়ার সওয়ার হয়ে ঝরে গেল।

রিমার যে খুড়তুতো বোনের বিয়েতে আমরা এলাহাবাদে গেছিলাম তার ছেলের বয়স হয়ে গেছে পাঁচ।

সুগতর প্রথম ও লিলির দ্বিতীয় চিঠির পর ওদের কাছ থেকে আর কোনো চিঠিই আসেনি। আমি দু-জনকেই কম করে দশটি-দশটি কুড়িটি চিঠি লিখেছি। তবু কোনো উত্তর আসেনি। সুগতও দেয়নি। সুগতর গ্রিন-সিগন্যাল এখনও এলো না।

শ্যামল আজকাল খুব কম আসে। বোধ হয় কিছু আঁচ করেছে। এবং এলেও সুগতর খবর জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। অনেক সময় মিথ্যে কথাও বলে বুঝতে পারি। তাই-ই এখন আর জিজ্ঞেসই করি না। আমারও কিছুই যায় আসে না সুগত বা লিলি সম্পর্ক রাখল কি না-রাখল। ওদের কটা লোকে জানে? আমাকে চেনে সকলে। ইন ফ্যাক্ট ওদের সঙ্গ দেওয়ার মতো সময় আমার একেবারেই নেই।

তবু…

মুখে এবং অভিমানের বশ হয়ে যাই-ই বলি না বা ভাবি না কেন, বুকে বড়ো লাগে। একা ঘরে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কতদিনের বন্ধু। ছেলেবেলার বন্ধু। বন্ধুপত্নী লিলি। সুগতর বিয়ের পরই বহরমপুর থেকে সুগত, লিলি, আমি, শ্যামল, ভূতনাথ সকলে আমরা ফারাক্কার কাছে নৌকো ভাড়া করে পাখিশিকারে গেছিলাম। শীতের শেষে। লিলি আমার পাশে বসেছিল। নতুন বন্ধুপত্নীর গায়ের পারফ্যুমের গন্ধটি এখনও আমার নাকে লেগে আছে। নতুন সিল্কের শাড়ির গন্ধ, খসখস শব্দ। আমাদের মধ্যে সুগতই সবচেয়ে আগে বিয়ে করেছিল।

জীবন তখন অনেক সুগন্ধি, আবহাওয়া অনেক অনাবিল অক্সিজেনে ভরপুর ছিল। সত্যিই ছিল। এখন সবই পাস্ট টেন্স।

আগামীকাল দেওয়ালি।

এক পাবলিশার্স-এর বাড়ি গেছিলাম ফ্রেণ্ডস কলোনিতে। বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুন এবং মহিলা কবি রুবী রেহমানকে নেমন্তন্ন করেছিলেন প্রকাশক। হাই-টিতে। চা খেয়ে বেরিয়েছি, একাই। ওদের সকলকে প্রকাশক-বন্ধুই পৌঁছে দেবেন। কিছুটা এসেই, ডানদিকে মোড় নিতেই দেখি খুব সুন্দর একটি নতুন দোতলা বাড়ির বারান্দার রেলিং-এ চোদ্দ-প্রদীপ লাগাচ্ছেন এক সুন্দরী বাঙালি মহিলা। হালকা কমলারঙা শাড়ির ওপর দারুণ কমলারঙা একটি মলিদা গায়ে দিয়ে।

চমকে উঠলাম লিলি না?

হ্যাঁ তাই-ই তো! লিলিই!

গাড়িটা একটু এগিয়ে নিয়ে গেট-এর কাছে গিয়ে নেমপ্লেট দেখলাম, সুগত চ্যাটার্জি।

আবার অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিলাম। মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে এসে সিগারেট কেনার অছিলা করে নামলাম। জিজ্ঞেস করলাম বাড়িটাকে দেখিয়ে ; ওই বাড়িটি কার?

বহত বড়ো শেঠকা। বাঙালি বাবুকা। উনি তো বিলাইত-আমেরিকাই করেন সব সময়। এই তো এক বছর হল এসেছেন, বাড়ি কিনে।

সঙ্গে আর কে কে থাকেন? শুধুই মেমসাহেব, একা?

কেন জিজ্ঞেস করছেন?

তোমার কোনো ভয় নেই। আমি চোর-ডাকাত নই। বাবুকে আমি চিনতাম। মানে আমার বন্ধু ছিলেন। তিনিই কি না, তাই-ই জানছি। চ্যাটার্জি সাহাব কি?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনিও বাঙালি?

হ্যাঁ।

আপনার বন্ধু ছিলেন বললেন না? ছিলেন মানে? এখন বন্ধু নেই?

বোকার মতো বললাম, এখন নেই।

এখন শত্রু?

না:। তাও নয়।

পানওয়ালা বলল, এক ছেলে এক মেয়ে, আর সাহেবের মা আছেন। বুড়িয়া, সঙ্গেই থাকেন ওদের। আর মেমসাহেবের বাবা।

ঠিক জানো তুমি?

হ্যাঁ। সাহেবের বাবা আর মেমসাহেবের মা তো মারা গেছেন। আমার বহু যে ওই বাড়িতে ঠিকে কাজ করে সাহাব। এই জন্যেই তো সব জানি।

সিগারেট ধরিয়ে আমি গাড়িতে এসে বসলাম। স্টার্ট করে এসে বড়ো রাস্তায় পড়লাম। বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে দিল্লিতে। কাল দেওয়ালি। বাড়ি বাড়ি আলো এবং প্রদীপের মালা দুলে উঠছে। আমার চোখের কোণ ভিজে ওঠায় আলোগুলো সব প্রথমে বড়ো হয়ে গোল হয়ে যাচ্ছে তারপর নানারঙা হিরের মতো ভাঙা ভাঙা হয়ে উঠছে। এমন অবস্থায় গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে। গাড়িটা দাঁড় করালাম পথের বাঁ-দিকে।

সুগতটাকে কত বছর দেখি না। কে জানে? ছিল কি না বাড়িতে। লিলি আগের মতোই সুন্দরী আছে। একটুও মোটা হয়নি। তেমনই সুন্দর ফিগার। আমার গল্পর কারণে সুগত আরও কত রোগা হয়ে গেছে কে জানে? কিন্তু সুগত বাড়িতে থাকলেও যাওয়া তো আর যাবে না। আমার একটা চিঠিরও উত্তর দেয়নি ওরা কেউই। তার মানে ওদের জীবনে আমার আর কোনোই জায়গা নেই। বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট হতে লাগল। ছেলেবেলার বন্ধু মরে গেলে যেমন কষ্ট হয়।

গাড়িটা স্টার্ট করলাম আবার। খুব আস্তে আস্তে চালাতে লাগলাম। বড়ো রাস্তার মোড়ে মস্ত হোডিং পড়েছে। সুগত আর লিলির বাড়ির বারান্দা থেকে সোজা দেখা যায়। আমার ‘‘খাজনা’ উপন্যাসের শ্রুতি-নাটক হবে আইফ্যাক্স হলে। কলকাতা থেকে অপর্ণা সেন, মনোজ মিত্র, দীপংকর দে, দেবরাজ রায়, রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত আসছেন। বড়ো বড়ো হরফে আমার নাম লেখা রয়েছে হোডিং-এ। তার নীচে উপন্যাসের নাম ‘খাজনা’। তারও নীচে যাঁরা অংশ গ্রহণ করবেন তাঁদের নাম।

এখানের লোকেরা বলে আশিসজি বহত-বড়া রাইটার হেঁ! এক সময় কবিতা লিখতাম, তাই-ই অনেকে আবার বলেন, শায়ের। কত মানুষ আমাকে চেনে জানে, কত সম্মান, ফুলের মালা কত কী! কত কী যে পেয়েছি এই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে লেখক হিসেবে, সকলে সেটাই দেখে। কত কাঁটা এবং কতরকম কষ্ট কতরকম দুঃখ নীরবে বুকে বয়ে যে এত দূর পথ আসতে হল তার খোঁজ কেউই রাখে না।

বাড়ির গ্যারাজে গাড়িটা রাখতে রাখতে ভাবছিলাম, সুগতর বিয়ের অ্যালবামটা এবং আমাদের ছেলেবেলার যেসব ছবি আছে তা নিয়ে আজ বসব একা রাতে খাওয়াদাওয়ার পর। কী জানি, কোনোদিনও সত্যিকারের লেখক হতে পারব কি না। লেখে তো অনেকেই! কিন্তু লেখক কজন হতে পারেন? পারব কি কখনো? হৃদয়ের মধ্যে সব সময় নীরবে রক্তক্ষরণ হতে থাকে অথচ বাইরে থেকে কেউই বোঝে না। না ডাক্তার, না কার্ডিওলজিস্ট।

লিলি সুগত; তোমরা তোমাদের বন্ধু আকরকে অপমানিত করেছ, দুঃখ দিয়েছ, ছোটো করেছ, ভুলে গেছ ঠিকই কিন্তু লেখক আশিস করের চুলও স্পর্শ করতে পারোনি। যে মানুষটি লেখে, সে তোমাদের কেউই নয়। সে তার নিজেরও কেউ নয়। সে রেললাইনের পাশের টেলিগ্রাফের তারে-বসা ছোট্ট পাখি অথবা কবরের এপিটাফ-এর পায়ের কাছে দুধের মতো চোখের জল ফেলা ক্রীসান্থিমাম অথবা রজনীগন্ধা। অথবা…যে লেখক ব্যক্তিজীবনের ওপরে উঠে না লিখতে পারেন, তাঁর বিশ্বাসের কথা বলতে না পারেন, তিনিও কি লেখক?

গাড়িটা লক করে গ্যারাজ থেকে ভেতরে আসতে আসতে ভাবছিলাম কোনোদিনও কি পারব লেখক হতে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *